গতকাল ওই ক্লান্তির মধ্যেও কালীগণ্ডকীর তীরে খাড়া পাহাড়ের কোল ঘেঁষা তাতোপানিকে পছন্দ হয়েছিল হবু-গবুর। গতকালের ক্লান্তি গরম জলের স্নানে দূর করে, গভীর ঘুমে রাত পার করে হবু-গবু আজ তরতাজা। তাছাড়া গত রাতের খানাটাও ছিল জবরদস্ত। তাজা শরীর মন, ভরপেট ব্রেকফাস্ট, ঝকঝকে সকাল, কালীগণ্ডকীর উজানে নীলগিরির উপস্থিতি — হবু-গবু টগবগিয়ে পথ পেরোতে লাগলেন। কালীগণ্ডকী একটানা হাততালি দিয়ে তাঁদের উৎসাহ দিয়ে চলেছে, দেখতে দেখতে গুইতে এলো এবং গেল। হবু-গবুর গতি এখন এক্সপ্রেস। পথে একপাল রামছাগলকে 'রাম রাম' করে সূর্যকিরণ গায়ে মেখে অল্প অল্প চড়াই ভেঙে তরতরিয়ে চলেছেন দু-জনে। কালীগণ্ডকীর খাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। খোশ মেজাজেই এসে পড়লেন দানা-য়। সেখানে পেটে দানাপানি পড়তেই উৎসাহ বেড়ে গেল। উৎসাহের চোটে বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন দুই মক্কেল। কত ট্রেকার, কত তীর্থযাত্রী এলো গেল — হবু-গবু শালগ্রাম শিলার মতো বসে রইলেন। কালীগণ্ডকীর তীরেই তো শালগ্রাম শিলার বাস। সূয্যিমামা দিকবদল করতে টনক নড়ল তাঁদের। বাধ্য হয়ে তাঁরাও নড়লেন, স্থাবর জঙ্গম হল। পথ এখন তেমন বন্ধুর নয়, বরং বন্ধু-র মতোই। বনপথে পাখির গান আর গভীর থেকে উঠে আসা কালীগণ্ডকীর কলতান শুনতে শুনতে তাঁরা এক সুন্দরীর মুখোমুখি হলেন। রূপসেছারা-র রূপে মুগ্ধ হয়ে কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়। তাঁদের চমক ভাঙল এক অঘটনে। উলটো পথে আসছিল একপাল ছাগল। রূপসে ছারা-র ধারাকে ছোট্ট পুলে পেরিয়ে যাচ্ছিল তারা। হঠাৎই তাদের একজনের বজরংবলী হবার শখ জাগল — সে লাফিয়ে পেরোবার চেষ্টা করল। কে ওকে বোঝায় —
'ওরে ওরে ছাগলছানা, উড়িস নেরে উড়িস নেঅতএব, যা হবার তাই হলো — উনি জলে পড়লেন, 'মা'-কে বার দুই ডাকলেন এবং বিদ্যুৎগতিতে ভেসে গেলেন, কে জানে, হয়ত সোজা কাঠমাণ্ডুতেই! তাঁর মালিক শুধু কপাল চাপড়ালো আর চাপা গলায় আফসোস করল, 'গয়ো হজার রুপিয়া।' দু-জনে দু-খানা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হবু-গবু এগিয়ে গেলেন। ভাঙা মন নিয়ে তাঁরা বেশিদূর যেতে পারলেন না; কোপচেপানি আসতেই সেঁধিয়ে গেলেন সেখানকার ছোট্ট সরাইখানায়। আঁধার রাতে কুপির আলোয় কালীগণ্ডকীর কল্লোল মেখে অতি সাধারণ খাবারও অসাধারণ হয়ে উঠল।
ছাগলের যে উড়তে মানা, সে কথা কি জানিস নে?'
নতুন ভোরে কোপচেপানিকে বিদায় জানিয়ে উপচে পড়া উৎসাহ নিয়ে হবু-গবু অগ্রসর হলেন। অতল গভীর থেকে সগর্জনে কালীগণ্ডকী তাঁদের সমর্থন জানাতে লাগল। কাবরেতে আর এক দফা চা-খাবার সাবড়ে নবীন উদ্যমে অভিযানে নামলেন দুই বীরপুঙ্গব। পথে মাঝেমধ্যেই দেখা দিচ্ছে চড়াই — বাঁকের ফাঁকে পথ চড়ছে। এই করতে করতে এসে পড়ল ঘাসা। বেশ খাসা জায়গা। দিব্যি কালীগণ্ডকীর রক-সঙ্গীত শুনতে শুনতে পানভোজন করা যায়।
ঘাসার আগে থেকেই হবু-গবু লক্ষ করছিলেন, গাছপালাদের ভিড় কমে আসছে। ঘাসার খানিক পর থেকে তারা উধাও মাঝেমধ্যেই; ফলে মাটির বাঁধন আলগা; যার ফলে হবু-গবুর বেশ সার্কাসের ট্রেনিং হয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় তো ধসের গা বেয়ে পথ নেমে গেল কালীগণ্ডকীর কোল ঘেঁষে। এরকমটা বেশ কিছুক্ষণ চলল, তারপর আবার কোত্থেকে এক দঙ্গল জঙ্গল এসে পাহাড়ের দখল নিল। সেই বনে এই ভর দুপুরেও দিব্যি ঠাণ্ডা।
বেশ কিছুক্ষণ চলার পর বন আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনে প্রায় দুশো মিটারের এক জবরদস্ত ধস। গোটা পাহাড়ের শরীরটা যেন কোনও কসাই চেঁচে নিয়েছে। নিচে দুরন্ত কালীগণ্ডকীতে আত্মসমর্পণ করেছে লেতে খোলা। ওপারে লেতের আস্তানাগুলো দেখা যাচ্ছে। সঙ্গমের ওপরে পুলটাও পুরোপুরি ঠিক আছে। শুধু এইখান থেকে পুল পর্যন্ত পথটা স্রেফ 'নেই' হয়ে গিয়েছে। হবু-গবু কুলকুল করে ঘামতে লাগলেন।
স্থানীয় লোকেরা ধসের ঝুরঝুরে শরীর বেয়েই যাতায়াত করছে। দু-চারজন সাহেব-মেমও টলোমলো পায়ে পেরিয়ে গেল ধসটা। যা থাকে কপালে — বলে হবু-গবুও নেমে পড়লেন ধসে। কাঁপা কাঁপা পায়ে একসময় পেরিয়েও এলেন সেই মহা ধস! কে জানে, কীভাবে! রাখে হরি মারে কে?
লেতের চা-পকোড়ায় ধস পেরোনোর কাঁপুনি কমিয়ে আবার চড়াইতে পা রাখলেন তাঁরা। নুড়ি-ধুলোভরা চড়াইটুকু পেরিয়ে এসেই কিন্তু দু-চোখ জুড়িয়ে গেল — কে যেন একখানা আস্ত পাইনবন এনে বসিয়ে দিয়েছে। তার ছায়া মেখে তাকে পেরিয়ে আসতেই এসে গেল কালোপানি। কালোপানির পিছনে ধৌলগিরি আর টুকুচে-র পাহারা, সামনে অন্নপূর্ণা পরিবার। হবু-গবুর হাঁ বন্ধ হতে ঢের সময় নিল। শরীর শীতল হতে না হতেই মেঘ আর পাহাড়চূড়োয় আবির মাখিয়ে রাত্রিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বিদায় নিল দিন।
কালোপানির আকাশ কালো থেকে নীল হবার মাঝে তুষারশৃঙ্গদের সাজবদল দেখতে গিয়ে অনেকটা সময় কেটে গেল হবু-গবুর। ঘোর কাটতে টের পেলেন ঠাণ্ডাটি জবর। অতএব চা চাইতে তাঁরা অন্তপুরস্থ হলেন। চা-টা চাপিয়ে কালোপানিকে টাটা জানালেন দু-জনে। পাইনবন অনেকক্ষণ সঙ্গ দিল সানন্দে; তারপর পথ হুড়মুড়িয়ে নদীমুখো নামতেই থমকে দাঁড়াল। হবু-গবু দেখলেন বিশাল এক প্রান্তর, তার মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে নদী, যেন ভীমের বুকে পৈতে। স্থানীয় মানুষদের পিছু পিছু দু-জনে সেই মাঠ, নদী পেরোলেন, তারপুর আবার পাহাড় বাইতে লাগলেন। ওপার থেকে টুকুচে শৃঙ্গ তাঁদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি মেলে রইল।
পাহাড়টাকে বেড় দিতেই মুহূর্তে ভোজবাজির মতো পালটে গেল সব। এদিকটা একেবারে ন্যাড়া, রুক্ষ। সবুজ বলতে কালীগণ্ডকীর ধারে কোথাও কোথাও কিছু গাছপালা ঝোপঝাড় মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে।
হবু-গবুর মধ্যে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে — আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে এমন নিষ্করুণ প্রকৃতির মাঝে এসে পড়েও সেভাবে আঁতকে উঠলেন না। প্রায় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে দেখলেন কালীগণ্ডকীর অববাহিকা এখানে সুবিশাল; মাঝখান দিয়ে মহানন্দে বয়ে চলেছে সে। তার দু-পাশে ঊষর পাহাড় মাথা তুলেছে; তাদের মাথা ছাড়িয়ে হবু-গবুর হাবাগোবা রূপ দেখছে ধৌলাগিরি, টুকুচে, ধামপুস, নীলগিরি, অন্নপূর্ণারা।
হঠাৎই খটাখট খটাখট শব্দ। কোথা থেকে যেন উদয় হল এক ঘোড়সওয়ার। ধুলো উড়িয়ে বীরদর্পে এসে কালীগণ্ডকীর তীর ধরে উধাও হয়ে গেল উজানপথে। মুহূর্তে হবু-গবু পৌঁছে গেলেন মধ্যযুগে। নিজেদের তাতার সৈন্য ভেবে নিয়ে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা।
অল্প উঠে নেমে চলতে চলতে রুক্ষ প্রকৃতির বুকে উঁকি মারতে লাগল দু চার ঝলক সবুজ। একটা বাঁক ঘুরতেই দেখা দিল লারজুংয়ের তোরণ। হবু গবুকে জ্ঞান দিলেন, 'এই তোরণই বলে দিচ্ছে, এই গ্রামে বৌদ্ধধর্মের প্রাবল্য।'
তোরণের ভিতর পা রেখেই থমকে গেলেন হবু-গবু। তাঁদের পা স্থির — চক্ষুও। তোরণের নিচে সারা সার বসে পসারিরা — বিশাল ঝুড়িভরা আপেল নিয়ে! একেবারে রসে টইটম্বুর। হবুচন্দ্র খাদ্যরসে প্রবল আসক্ত। গবুচন্দ্রও বেরসিক নন। দরদাম করতে গিয়ে মাথা খারাপ হবার জোগাড় — এরা কি আপেল বেচছে, না আলু! নাঃ, আলুও এত সস্তা হয় না — নেপালি এক টাকায় আটখানা আপেল — মানে, ষাট পয়সায় আটখানা আ-পে-ল! হবু-গবু আহ্লাদে আটখানা ছেড়ে আটাত্তর হলেন। আট টাকার আপেল কেনা হল। এর বেশি বওয়ার ক্ষমতা নেই ওঁদের। দু-জনে দু-খানা আপেলে কামড় বসিয়ে পুনর্চলিত ভব হলেন। ওঁদের রকমসকম দেখে লারজুং গ্রামটা অভ্যর্থনা পর্যন্ত ভুলে গেল। হাতে মুখে আপেলের রস মেখে হবু-গবু লারজুং-য়ের পর কোবাঙ্গো পেরিয়ে গেলেন জোরকদমে; গাছের গুঁড়ির পুল পর্যন্ত পেরিয়ে গেলেন অনায়াসে।
হবুচন্দ্রের মনে হল অল্পবয়সে দেখা ওয়েস্টার্ন ছবির সেটে ঢুকে পড়েছেন। ধুলো-ওড়া (এখানে ছোট ছোট পাথরকুচিও ওড়ে) প্রান্তরের মাঝে রহস্যময় পাথুরে শহর মারফা। হাত পাঁচেক চওড়া আঁকাবাঁকা পাথুরে গলিটাই মারফার রাজপথ। আঁকাবাঁকা পথটার দু-ধারে থমথমে সব পাথুরে বাড়ি কাঠের জানালা নিয়ে হাজার বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একফোঁটা ডাকঘরটা আবার মুদিখানাও বটে। মাঝেমধ্যে দু একটা আরও সরু নিঝুম গলি এসে পড়েছে এই রাজপথে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে 'শহরের' প্রান্তে খাড়া পাহাড়ের গায়ে একটা মন্দির অলৌকিক উপায়ে ঝুলে আছে। কেউ যেন তাকে পেরেক ঠুকে পুঁতে দিয়েছে পাহাড়ের গায়ে। ভক্তরা ওই মন্দিরে পুজো দিতে যায় কী করে? খালি চোখে দেখে তো মনে হচ্ছে, উড়ে ছাড়া আর কোনওভাবে ও কম্মোটি করা সম্ভব নয়। এই ভর দুপুরেও ঠাণ্ডা যেন চাবুক মারছে। হবু-গবু খুবই কাতর হয়ে পড়তেন, যদি না শুনতেন জোমসোম আর মাত্র ঘন্টাখানেকের পথ।
হাওয়ার তাড়ায় তাড়ায় বেশ তাড়াতাড়িই জোমসোমে ঢুকে পড়লেন হবু-গবু। এ জায়গাটা বেশ ছড়ানো। বাঁ হাতে রুক্ষ পাহাড় ধাপে ধাপে উঠে গেছে। আরও ওপরে দিগন্ত জুড়ে ধৌলাগিরি, টুকুচে, ধামপুস — কত সব রথী মহারথী সাদা আলোয়ান জড়িয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে। আর ডানদিকে কালীগণ্ডকীর ওপারে নীলগিরি থেকে অন্নপূর্ণা। বিচ্ছিরিরকম ঠাণ্ডা আর হিমেল দুরন্ত গতির বাতাসে উড়ে আসা কুচো নুড়ির গুলিবর্ষণ না থাকলে হবু-গবু এ দৃশ্য অনেকক্ষণ ধরে দেখতেন। হোটেলে ঢুকে পড়তেই শীত আর বাতাস দুটোই 'ভ্যানিশ'। বসার আর খাবার জায়গায় দোতলাসমান কাচের দেয়ালের ফ্রেম জুড়ে নীলগিরি। কালীগণ্ডকীর ধারে একফালি মাঠটা নাকি 'এয়ারস্ট্রিপ' — এরোপ্লেন নামার জায়গা! আর কত অবাক হওয়া যায়! বিরক্ত হয়ে হবু-গবু খাবারের অর্ডার দিলেন। এরপর সবথেকে জরুরী কাজ বাকি রয়েছে — বিছানায় শুয়ে ঠ্যাং নাচানো।
জানালার কাচের ভিতর দিয়ে সূর্যকিরণ এসে ডেকে তুলল হবু-গবুকে, 'এবার ওঠো, মুখচোখ ধুয়ে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে বেরোও হাড় আলসের ডিম।'
অগত্যা। পেটপূজা সমাপনান্তে বোঁচকা পিঠে পথে পা রাখলেন হবু-গবু। সক্কাল বেলার নিস্তরঙ্গ চারপাশ দেখে কে বলবে আর একটু বেলা হলেই চরাচর জুড়ে শুরু হবে ডাকাতে হাওয়ার তাণ্ডব! বাঁধানো পুলে চড়ে কালীগণ্ডকীকে পার হবার সময় তার রূপ দেখে পাক্কা দশটা মিনিট কোথা দিয়ে গলে গেল, টেরই পেলেন না হবু-গবু। এবার কালীগণ্ডকীর তীর ধরে অযুত নিযুত নানা মাপের নুড়ি মাড়িয়ে যেতে যেতে হবু ভাবতে লাগলেন নুড়ির মধ্যে কত শত নারায়ণ শিলা, মানে শালগ্রাম শিলা বিরাজমান! হবুচন্দ্রের শিউরানি দেখে গবুচন্দ্র আশ্বস্ত করলেন — শালগ্রাম শিলা আসলে পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন (প্রায় একশো কোটি বছর) প্রাণী অ্যামোনাইটের ফসিল। অতএব, পাপ হওয়ার সুযোগ অতীব ক্ষীণ। শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে হবুচন্দ্র নুড়ি মাড়ানো জারি রাখলেন। ধৌলগিরি আর নীলগিরি দু-ধার থেকে মুচকি হাসল। একসময় এসে গেল একেলাভট্টি। এককালে সত্যিই একটামাত্র সরাইখানা ছিল এখানে; এখন তার একজন সঙ্গী জুটেছে। মনের আনন্দে চাতাল হলেন দু-জনে।
একেলাভট্টি থেকে পথ দু-ভাগ। ডানদিকের পথ হালকা চড়াই ভেঙে ধীরে ধীরে উঠে গিয়েছে মুক্তিনাথ পানে; বাঁদিকের প্রায় সমতল পথ কাগবেনী হয়ে চলেছে মুস্তাংয়ে। কাগবেনী থেকে সরাসরি চড়াই ভেঙে উঠে আসা যায় মূলপথের বেশ খানিকটা উজানে। হবু-গবু স্বাভাবিকভাবেই পা রাখলেন সমতল পথে।
দু-জনে কাগবেনী পৌঁছে মুস্তাংয়ের দিকে এক ঝলক আড়নয়নে চাইলেন (সে সময় মুস্তাং বহিরাগতদের কাছে নিষিদ্ধ ছিল) এবং দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তারপর সেই দুঃখ ভুলতেই সামনের লজটায় সেঁধিয়ে গেলেন। কাগবেণীতেই বড় মেজ সেজ গাছপালাদের দৌড় শেষ — এর পর তারা ভারি দুষ্প্রাপ্য। হবু-গবুর গলা এমনিতেই শুকিয়ে উঠেছিল, মুক্তিনাথের মরুভূমি-প্রায় পথ দেখে একেবারে কাঠ হয়ে গেল আর পেটের ভিতর সাতশোটা উদবেড়াল একসঙ্গে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করল। জুঁই-চা এবং চাউমিন দিয়ে পরিস্থিতি খানিক সামাল দিতেই লেগে গেল ঘন্টাখানেক। লজের গা ঘেঁষে নুড়িভরা ধুলোওড়া 'স্বর্গারোহিনী' পথে পা দেবার আগে দু-জনে দুনিয়ার এবং দেবদেবীর শরণাপন্ন হলেন। সাত মিনিটেই জিভ হাঁটু ছুঁয়ে ঝুলতে লাগল। কী চড়াই রে বাপ! তার ওপর সূর্যদেবের অগ্নিবর্ষী নিরন্তর আশীর্বাদ!
অগাধ পরিশ্রমের পর গিরিশিরার মাথায় উঠে এলেন দু-জনে এবং এলিয়ে পড়লেন। দুর্দশার অন্ত হলো ভেবে দু-জনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানালেন, দেখতে পেলেন না ভগবান মিটিমিটি হাসছেন। চড়াই মোটামুটি শেষ হলেও, তার জায়গা নিল পঁচাত্তর কি.মি. বেগের হাওয়ার নন-স্টপ থাপ্পড়। সেই থাপ্পড়ের ঘায়ে হবু-গবু বার তিনেক খাদস্থ হতে হতে রক্ষে পেয়েছেন। হাওয়ার দাপটে ঝোপঝাড় পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াতে সাহস পায়নি, গাছপালা তো দূর অস্ত। ঝোপেদের কয়েকজন মহাবীর কোনও মতে পাহাড় আঁকড়ে, ঘাড় গুঁজড়ে টিকে রয়েছে। যুদ্ধ করতে করতে গোটাকতক বাঁক ঘোরার পর আড়াল পাওয়ায় হাওয়ার ধমকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। দিগন্ত বিস্তৃত নিষ্করুণ পাহাড়ের ঢেউ। কোনও আড়াল না থাকায়, এখন থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে মুক্তিনাথের অস্তিত্ব। ধৌলাগিরি নীলগিরি পিছন থেকে সতর্ক নজর রাখছে। আলগা নুড়িতে পা সামলে ফেলতে হচ্ছে, তবু হবু-গবু বেশ মনের আনন্দেই পথ চলেছেন। আজ স্বপ্নপুরণের দিন। এত শুকনো প্রকৃতি এর আগে কখনও ওঁরা দেখেননি — বেশ নতুন অভিজ্ঞতা। বহু নিচে, যেখানে একটু জল জমার বা বওয়ার সুযোগ আছে, সেখানে সবুজমাখা একটু প্রাণের ছোঁয়া। পাহাড়ের পর পাহাড় বেড় দিতে দিতে ওঁরা এমন এক পাহাড়ের সামনে এসে পড়লেন, যার কথা ওঁরা কল্পনাও করতে পারেননি। কেউ যেন গোটা পৃথিবীর কালচে ছাই এনে জড়ো করে এখানে পাহাড় বানিয়েছে। পথ এর গা বেয়েই! পা ডুবে যাচ্ছে সে ছাইয়ের গাদায়। সেই ভস্মাচল পার করার পর পিতৃনাম স্মরণ করতে দু-জনের বেশ কিছুটা সময় লাগল।
অর্ডার দেওয়ার পর দু-হাত দাড়িগোঁফ বেড়ে গেল খাবারের দেখা নেই। এদিকে পেটে তখন ছুঁচোদের টি ২০ চলছে। সোয়া ঘন্টা অপেক্ষার পর আসা খাবার সোয়া চার মিনিটে উধাও। এর পর আধঘন্টা না জিরোলে চলে!
নবার্জিত উদ্যমে হবু-গবু এবার পৌনে এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলেন মুক্তিনাথের রাণীপৌয়ায়। মুক্তিনাথ — শিশিরদার স্বপ্নের মুক্তিনাথ। শিশিরদার স্বপ্ন সফল করতে পেরে আপ্লুত হয়ে পড়লেন হবু-গবু। মন্দির এখান থেকে মিনিট কুড়ির পথ। দু-জনে ঠিক করলেন, আজই মন্দির দর্শন করবেন। তা, দেবতা তো আর পালাচ্ছেন না; অন্ততঃ গত হাজার বছরে তাঁর তেমন ইচ্ছের কথা কেউ শোনেনি। কিন্তু পেটে এক্ষুনি কিছু না পড়লে হবু-গবুর প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে পালাতেও পারে।
পেট এবং পদযুগল, থুড়ি, চতুষ্টয়কে যথোপযুক্ত উজ্জীবিত করে দু-জনে বেরোলেন দেব-দর্শনে। পৌঁছে দেখেন — ও বাবা! এ যে ধর্মের মিউজিয়াম! বিষ্ণু (নারায়ণ) ছাড়াও মহাদেব, জ্বালামাতা এমনকি বুদ্ধদেব নিজের নিজের মন্দিরে হাজির। বিষ্ণুমন্দিরের (এটাই মুক্তিনাথ মন্দির) পাশে ১০৮টা মকরমুখী জলধারা। তাতে স্নান করলেই অক্ষয় স্বর্গলাভ। দু-চারজনকে সে চেষ্টা করতেও দেখা যাচ্ছে। স্বর্গে যাবার খুব একটা ইচ্ছে হবু-গবুর আছে এমন মনে হল না। মহাদেব, মুক্তিনাথ কেউই হবু-গবুর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হলেন না — বিশ্রামের অজুহাতে দরজা বন্ধ করে বসে রইলেন।
জ্বালামাঈয়ের মন্দিরে হিমশীতল জলধারার নিচে অনির্বাণ অগ্নিশিখা; হবু-গবু ঝাঁকিদর্শনেই কাজ সারলেন। বাড়তি ক্লান্তি আর কমতি ভক্তির দৌলতে দু-জনে বিশ্রামের টানে ফিরতে লাগলেন, এমনকি ঊষ্ণ প্রস্রবনের টানও তাঁদের ধরে রাখতে পারল না। ওঁদের ভক্তির বহর দেখে সূয্যিমামা বিষন্নবদনে বিদায় নিলেন। পুণ্যে টইটম্বুর হয়ে হবু-গবু নিদ্রাদেশে যাত্রা করলেন। মুক্তিতীর্থ মুক্তিনাথ ওঁদের এই ঔদ্ধত্য নির্দ্বিধায় মাফ করে দিল। উদার তুষারশৃঙ্গের দল রক্ষাকর্তা হয়ে জেগে রইল।
পরদিন পুণ্যপ্রাতে পূষণের অগ্রিম আশীর্বাদ নিয়ে দু-জনে ফেরার পথ ধরলেন। মুক্তিনাথ তখনও চোখ খোলেনি। ঝড়ের গতিতে অবতরণ শুরু হলো হবু-গবুর। দ্যাখ-না-দ্যাখ ঘুমন্ত ঝারকোটে এসে পড়লেন দু-জনে এবং মুক্তি পেতে পেতে বেঁচে গেলেন। এক্সপ্রেস গতিতে নামতে নামতে হবুচন্দ্র আবিস্কার করলেন, তিনি একটি বাড়ির ছাদের (এবং খাদেরও) কিনারায়। কোন উপায়ে যে তিনি এমার্জেন্সি ব্রেক কষেছিলেন, হবুচন্দ্র আজও মনে করতে পারেন না। চোখ বুজলেই শুধু দেখতে পান তিনহাজার ফুটের খাদ হাঁ করে তাঁকে গেলার জন্য তৈরি। গবুচন্দ্র অনেক বিবেচক। শান্তভাবে এসে হতভম্ব হবুকে সঠিক পথে স্থাপন করলেন।
সরাসরি একেলাভট্টি নেমে জোমসোম যখন পৌঁছলেন, সকাল তখনও সিংহাসনে। অতএব প্রভূত খাদ্য সহযোগে বিশ্রাম নিয়ে দু-জনে যখন আবার পথে নামলেন, হাওয়া-দানব তখন আসরে নেমে পড়েছে। তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে হবু-গবুর প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। হাওয়ার ধাক্কায় গবুচন্দ্র তাঁর ক্ষীণ শরীর নিয়ে তো প্রায় উড়েই যাচ্ছিলেন। মারফা পৌঁছতেই অঁদের 'দম নিকল গয়া'। অতএব, মারফাতেই আজকের মতো অগ্রগতির ইতি।
পরদিন ভোর ভোর ফের পথে। হবুচন্দ্রের ইচ্ছে তিন-চার ঘন্টার বেশি না হাঁটার; কিন্তু গবুচন্দ্রের গতি এখন দুরন্ত। ফলে, সাতঘন্টা দৌড়ে ওঁরা এসে থামলেন, লেতেতে।
রাতটা মড়ার মতো ঘুমিয়ে পরদিন আবার পথে। রাতোপানি থেকে এবার নতুন পথে। ঘোড়েপানির আকাশমুখো চড়াই এড়িয়ে জঙ্গুলে পথ ধরে দিনভর হাঁটা আর হাঁটা। আজ আর সাতঘন্টায় শানালো না, পাক্কা এগারো ঘন্টা উজিয়ে যখন ওঁরা বেনীতে এস এপৌঁছলেন, হবুচন্দ্র তখন চোখে আঁধার দেখছেন। তাঁর অবস্থা থেকে উৎসাহ পেয়েই আঁধার নেমে এলো বেনিতে।
পরদিন পোখরা পৌঁছনোর উৎসাহে ওঁরা পথস্থ হলেন সকাল-সকালই। মহানবমীর ঝলমলে সকালে একটা নালা (ছোট নদী) পেরোতে গিয়ে নাকাল হওয়া ছাড়া বাগলুং মোড়ে পৌঁছতে খুব একটা অসুবিধের সম্মুখীন হলেন না হবু-গবু। তারপর ট্রাকবাহনে সূর্যকে পুব আকাশে রেখেই পৌঁছে গেলেন পোখরায়। হবু-গবুর (*) মুক্তিনাথ যাত্রা সম্পূর্ণ হলো; শিশিরদার স্বপ্ন সফল হলো।
এখন মুক্তিনাথ যেতে আর হাঁটতে হয় না। গাড়ি এখন বেনী, ঘাসা, জোমসোম হয়ে চলে যাচ্ছে একেবারে মুক্তিনাথে। পরিশ্রমের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে রোমাঞ্চও। তবে পথের সৌন্দর্য আজও অমলিন।
(*) প্রখ্যাত শিশু সাহিত্যিক শিশিরকুমার মজুমদার
(*) লীলা মজুমদার
(*) হবুচন্দ্র হলেন লেখক এবং গবুচন্দ্র শ্রীযুক্ত দেবাশিস সেন।