• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • মুক্তিনাথ যাত্রীর ডায়েরি : সোমদত্তা মণ্ডল




    ভূমিকা, মে ২০১৫

    মাদের চিরাচরিত তীর্থস্থানগুলো যে কখনও আমাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে তা আমাদের সাধারণের মনে সহজে উদয় হয় না। গত দু-বছর আগে ২০১৩র ১৬ই আর ১৭ই জুনে আচমকা প্রবল বৃষ্টি আর হড়কা বানে উত্তরাখণ্ড অঞ্চলে কেদারনাথ উপত্যকা প্রচণ্ড ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এর ফলে শয়ে শয়ে তীর্থযাত্রী সমেত কেদারনাথ যাবার পথের সমস্ত গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। আজ দু-বছর পরে রাজ্য সরকারের অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ওই পথে আর কেদারনাথ যাওয়া যায় না। শোনপ্রয়াগ, গৌরীকুণ্ড বা রামওয়ারা চটি এখন শুধু আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকবে। একই ভাবে আরও একটা তীর্থযাত্রার পথের অবলুপ্তি ঘটে গেল এই বছর এপ্রিল মাসে। গত ২৫শে এপ্রিল প্রচণ্ড ভূমিকম্পে পুরো নেপাল দেশটা ছারখার হয়ে গেছে। অসংখ্য মানুষ মারা গেছে আর ঘরছাড়া হয়েছে। মাউন্ট এভারেস্ট আর লাংতাং উপত্যকাও এই বিপর্যয় থেকে বাদ পড়েনি। আর ক্ষয়ক্ষতির হিসেবের সঙ্গে যোগ হবে আরও একটা তীর্থের যাত্রাপথ। সেটা হল মুক্তিনাথ। ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো পথে ওখানে আবার যাওয়া যাবে কিন্তু আগেকার যাত্রাপথ বেঁচে থাকবে শুধু স্মৃতির মণিকোঠায়।

    কয়েকদিন আগে পড়ার ঘরের তাকে এলোমেলো বই-খাতাপত্রর মধ্যে হঠাৎ একটা পু্রনো ডায়েরি আবিষ্কার করলাম। এর অস্তিত্ব আমার কাছে একেবারেই অবলুপ্ত ছিল। প্রায় তেত্রিশ বছর আগে মুক্তিনাথ যাত্রার এই বিবরণ আশা করি কিছু পাঠককে আনন্দ দেবে। ষোলোজনের দলে আমি তখন ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। অনেক কষ্ট করে পনেরো দিন হেঁটে যে-পথে গিয়েছিলাম তার বিবরণ আমার মনের মধ্যেও ম্লান হয়ে গেছে এত বছর পরে। রাস্তাঘাট ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও এখন নিশ্চয় আরও উন্নত হয়েছে। তবে এখন তো কেউ যেচে নিয়ে যেতে চাইলেও আর ওই পথে যেতে পারব না। তেত্রিশ বছরে তেত্রিশ কেজি ওজন বাড়া ছাড়াও এখন আমি সিনিয়র সিটিজেনের তকমা পরেছি। ভাইবোন আর ছেলে বউমা তাই অনেক ঘটা করে ষাট বছরের জন্মদিনের কেকও কাটিয়েছে। শারীরিক ব্যাধিও অনেক। এখন শুধু ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

    প্রস্তুতি পর্ব

    বন্ধুরা সব ঠাট্টা করে বলে, “তোর পায়ের নীচে সর্ষে” – কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। যখনই শুনি কেউ কোথাও বেড়াতে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে মনটা নেচে ওঠে – ওদের সঙ্গী হতে চায়। তখন রইল পড়ে কাজ কর্ম, সংসার ধর্ম, ছেলে হল মা’র কাউনটারে জমা, কোনরকমের কাউকে কোন নোটিশ না দিয়েই বেরিয়ে পড়ি। এ যে কি সাংঘাতিক নেশার বস্তু তা যে বেরোয় সেই জানে। যাই হোক, যেই শুনলাম যে ইয়ুথ হোস্টেলের কয়েকজন মিলে মুক্তিনাথ যাবে, আমিও ওদের দলে ভিড়ে গেলাম। আগে টিকিট তো কাটাই তারপর কেমন করে যাবো সেটা পরে ঠিক করা যাবে। সবার অগোচরে আস্তে আস্তে যাবার প্রস্তুতিপর্ব চলতে লাগল। ১৯৮২-সালের এপ্রিল মাসে যাত্রা শুরু হবে। পাহাড়ে ট্রেকিং করতে গেলে যে সব জিনিষ লাগে সেগুলো তো খুবই নখদর্পণে, অতএব সেই মতো জিনিষ গুছাতে বসলাম – গ্লাভস, হনুমান টুপি, মোজা, কেডস জুতো, ইত্যাদি। দলনেতা প্রদীপদা গত দু বছর আগে ১৯৮০তে ওখান থেকে ঘুরে এসেছেন, অতএব ওনার নির্দেশ মত সময়সূচি এবং সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। রাস্তায় শুনলাম হাঁটাপথ অনেক (প্রায় ১৫০ কিলোমিটার) তাই সেই অনুপাতে তোড়জোড়ও হতে লাগলো বেশ জোরদার করেই। রাস্তায় নাকি অনেক গ্রাম পড়ে যেখানে পেট ভরার মত ডাল ভাত পাওয়া যায়, তাই আমাদের সঙ্গের খাবার কেবলমাত্র বিস্কুট, চিঁড়ে আর নারকেল নাড়ু। পাহাড়ে গেলে হিল ডায়রিয়া অবধারিত, তাই চানাচুর বা অন্য মুখরোচক সব খাবার একেবারেই বাদ।

    দেখতে দেখতে যাত্রার দিন এগিয়ে আসছে – নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনার সাথে আরও একটা চিত্তচাঞ্চল্যকর বিষয় হচ্ছে যে আমরা কলকাতা থেকে কাঠমাণ্ডু যাবো সেই চিরাচরিত নর্থ বিহার এক্সপ্রেস-এ চেপে নয় – রীতিমত রাজকীয় ভাবে – রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্স কর্পোরেশন এর প্লেনে। এতকাল শুধু দমদম গেছি লোককে রুমাল নেড়ে সি-অফ করতে, এবার লোকে আমাদের উল্টে সি-অফ করবে – এটাও কম আনন্দের বিষয় নয়।

    ১ এপ্রিল ১৯৮২, বৃহস্পতিবার

    রাত জেগে এবারের পূজাবার্ষিকী ‘দেশ’ পত্রিকায় উমাপ্রসাদ বাবুর লেখা মুক্তিনাথ ভ্রমণকাহিনিটা গোগ্রাসে গিলছি। অন্তত যাবার আগে যতটা ফার্স্ট হ্যান্ড ইনফরমেশন নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সত্যি বলতে কি লেখাটা তেমন কিছু ঔৎসুক্য বা প্রেরণা জোগাল না। কারণ উনি গেছেন ১৯৫৬ সালে – তখন তো আমার বয়স মাত্র দুবছর। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর বাদে সেই বর্ণনার কেমন যেন ততটা প্রাণ নেই – খালি যেন কিছুটা পু্রনো স্মৃতি রোমন্থন। যা হোক, আগামীকাল সকাল এগারটায় আমাদের প্লেন ছাড়ার কথা। সেই মতো প্রস্তুত হয়ে অধীর আগ্রহে তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

    ২রা এপ্রিল, শুক্রবার

    সকাল থেকে উঠে যে কতবার ঘড়ি দেখেছি তা লিখে রাখলে বোধহয় গিনেস বুক অফ রেকর্ডে নাম উঠে যেত। সব কিছু সেরে আমি প্রস্তুত হয়ে বসে আছি, গাড়ি আর আসে না। অবশেষে পৌনে দশটা নাগাদ গাড়ি এলো। জয় বাবা মুক্তিনাথ বলে আমরা যাত্রা শুরু করলাম। দমদম বিমানবন্দরে এসে আমাদের যাত্রার গোটা দলের সঙ্গে প্রথম দেখা হল। সংখ্যায় মোট ষোলোজন – তার মধ্যে আমরা মেয়েরাই দলে ভারি – নয় জন। এদের মধ্যে সবার চেয়ে বয়সে বড় যিনি তিনি অর্ধ শতাব্দী বেশ কিছুদিন আগে পেরিয়ে এসেছেন – সর্ব কনিষ্ঠ আমি।


    কাস্টমস-এর চিরাচরিত কাজকর্ম আর ডিক্লারেশান শেষ হবার পর অবশেষে মাইকে ঘোষিত হল যে আমাদের যাবার জন্য প্লেন প্রস্তুত। দু-একজন বাদে সকলেরই প্রায় জীবনে প্রথম প্লেন চাপা – তাই সবার মনে সুপ্ত উত্তেজনা। কিন্তু প্লেনটা দেখেই কেমন যেন নিরাশ হয়ে যাই। কেমন পুরনো আর সাদামাটা চেহারা। রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্স কর্পোরেশনের ছোট্ট ৪৪ সিটের ব্রিটিশ আভ্রো ৭৪৮ প্লেন। ভিতরে উঠে মনটা আরও দমে গেল – আমাদের স্বাগত জানাতে একটা সুন্দরী এয়ার হোসটেসও নেই। সকলের মনে তো আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের “বলাকার মন”-এ পড়া ছবি উজ্জ্বল। দুজন নেপালি স্টুয়ার্ড চার্জ-এ রয়েছে। আমরা ছাড়া প্লেনে আর মাত্র ছয়-সাত জন আরোহী। অতএব যার যেখানে ইচ্ছা বসে যেতে পারলাম। একটু পরেই প্যাকেট লাঞ্চ এলো। আমাদের মধ্যে অনেকে আবার বার আর ব্রতর ভক্ত। তাই প্লেনে বসে ঝোলা থেকে কলাপাতা বের করে তাতে লুচি আর আলু ভাজা খাওয়াও দেখা গেল।

    মাত্র দেড় ঘণ্টা সময়, তাও যেন ফুরাতে চায় না। এত একঘেয়ে নাকি প্লেনে চাপা? প্লেনটা এত স্থির ভাবে যাচ্ছে যে মনে হচ্ছে যেন নড়ছেই না। “মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন পিছন থেকে হেঁইও মারি করে ঠেলে দিই” – কতজনের কতরকম মন্তব্য। কেউ বলে “প্লেনটা দিয়েই যখন আমাদের যাত্রা শুরু, তখন আমাদের ভাগ্যটা বোঝাই যাচ্ছে”। আবার শোনা গেল কে যেন এক কোনা থেকে বলে উঠল, “কোথা থেকে যেন ডিস্পোসালের একটা ভাঙা প্লেন আমাদের জন্য উঠিয়ে এনেছে”। আমাদের দলে একজন প্রবীণ ব্যাচেলার মিত্তিরদা – তিনি সর্বদাই কথা বলেন কৌতুক রসে। তিনি বললেন, “আসুন এখান থেকেই ব্রিজের ডিল খেলতে শুরু করা যাক চারটে সীটের মধ্যে গামছা বিছিয়ে” – রাজকীয় প্লেনের কী রাজকীয় সম্মান!

    কিছুদূর যাবার পর ডান দিকের জানালা দিয়ে পরিষ্কার আকাশে পুরো হিমালয় পর্বতমালা দেখা গেল। একটু পরে এভারেস্টও দেখা দিল। প্লেনটা যখন প্রায় কাঠমাণ্ডু পৌঁছবে তখন দূরে বাঁদিকে কেবলমাত্র অন্নপূর্ণা পর্বতমালা দেখা গেল। যেন আমাদের অভ্যর্থনা করছে। কয়েকদিনের মধ্যে আমরা ওই পাহাড়ের কত কাছে চলে যাবো সেটা ভেবেও আনন্দ হচ্ছিল। অনেক পাহাড় ডিঙিয়ে অবশেষে যখন আমাদের প্লেন ত্রিভুবন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নামল তখন আমাদের ঘড়িতে ঠিক দুটো – নেপালি সময় ২ টো ১০। এদেশে আসতে আমাদের পাসপোর্ট ভিসা কিছুই লাগেনা। ইমিগ্রেশান অফিসার খুবই অমায়িক ব্যাবহার করলেন; ভাবলেন ইন্ডিয়া থেকে আসা সাধারণ টুরিস্ট আমরা – কয়েক দিন ঘুরে বেড়িয়ে বাজারহাট করে ফিরে যাবো। কিন্তু মুক্তিনাথ শুনেই তাঁর ভুরু দুটো কুঁচকে গেল। আমাকে আর আমার সঙ্গের দুই মহিলাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বলে উঠলেন, “ওখানে আপনারা যেতে পারবেন না। অনেক কষ্ট, অনেক হাঁটা। এইরকম নাদুসনুদুস শরীর নিয়ে ওসব জায়গায় যাওয়া যায় না”। ভদ্রলোকের কথা শুনে মনে মনে বেশ রাগ হল, কিন্তু উত্তর দেওয়ার মত কথা মুখে যোগালো না।

    প্রায় জনশূন্য এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমরা শহর অভিমুখে যাত্রা করলাম। কলকাতার ট্যাক্সি-হয়রানিতে অভ্যস্ত আমরা – বেশ আনন্দের সঙ্গে বিলিতি ডাটসন আর টয়োটা ট্যাক্সি চেপে হোটেলে গেলাম। অবশ্য হোটেল বললে একটু বেশীই বলা হয়, কারণ “আরনিকো লজ” বলে যে বাড়িতে আমরা উঠলাম তা শহরের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত হলেও, যথেষ্ট নোংরা। ঘরে ঢোকামাত্র সকলেই পালাই পালাই করছে – সবার মন পড়ে আছে আসার পথে ফেলে আসা দুই ধারের দোকানের দিকে। কোনোরকমে জিনিসপত্র ঘরে গাদা করেই আমরা তাই রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম – দু-চোখ ভরে নিউ রোডের দোকানে বিলিতি পন্নের সমারোহ দেখতে। ভারতীয় সেই চিরন্তন ‘ফরেন’ জিনিষের প্রতি আকর্ষণ - এ তো সহজে যাবার নয়। কিছুক্ষণ পরে সবাই মিলে পশুপতিনাথজির মন্দিরে যাওয়া হল। তখন মন্দিরে সন্ধ্যা-আরতি হচ্ছে। কাল থেকে যাত্রা শুরু তাই সবাই যাবার আগে পশুপতিনাথজির আশীর্বাদ নিতে বেশ আগ্রহী দেখলাম। মন্দির থেকে বেরিয়ে আবার এক দফা বাজার করার ধুম শুরু হল। তারপর বাইরে ডিনার সেরে লজে ফিরে আমরা যখন শুতে গেলাম, তখন তিন তারিখ হতে আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি।

    ৩রা এপ্রিল, শনিবার

    ভোর চারটে থেকে সকলে উঠে পড়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করেছে। আজ আমাদের পোখরা যাবার কথা। বাস ছাড়বে সকাল সাড়ে ছটায়। সকলে মিলে তাড়াতাড়ি মালপত্র নিয়ে ভিমসেন টাওয়ার-এর কাছে বাসস্ট্যান্ডে এলাম। বাসের চেহারা মোটেই আকর্ষণীয় নয়। যদিও সরকারী এক্সপ্রেস বাস (শ্রী পাঁচ সরকারের ডাক পরিবহণ সেবা) তবুও আমাদের এখানকার লোকাল বাসের থেকেও করুণ অবস্থা। প্রথম থেকেই যাত্রী ঠাসা – যত সীট তার থেকে বেশী যাত্রী – তার মধ্যে বেশ ভালো সংখ্যার হিপি-হিপিনি চলেছে। তাদের পাশে বসতে বেশ মনের জোর দরকার হয় কারণ যত বছর তারা বাড়িঘর ছেড়েছে তত বছর বোধহয় স্নানের সঙ্গেও সংস্পর্শ ত্যাগ করেছে। পরে জানা গেল যে বেসরকারি বাস সংস্থার কিছু লাক্সারি কোচ ছিল কিন্তু আমাদের লিডারকে বোকা বানিয়ে বলা হয়েছিল যে আর দ্বিতীয় কোনও বাস নেই। যা হোক, অবশেষে সাতটা নাগাদ বাস ছাড়ল। স্থানীয় যাত্রী তুলতে তুলতে বাস চলেছে তার ইচ্ছামতো – যেখানে যতক্ষণ ইচ্ছে থামতে থামতে। কিছুক্ষণ পরে থানকোট বলে একটা জায়গায় এসে বাস গেল থেমে। কি ব্যাপার? চেকিং হবে। বাসের মাথায় যত বাক্স-পেঁটরা আছে সব একটা একটা করে নামিয়ে খুলে সার্চ হবে কতটা পরিমাণ গাঁজা আর চরস আমরা লুকিয়ে নিয়ে চলেছি। এখানকার মতো এত কর্মনিষ্ঠ পুলিশ আমরা খুব কমই দেখেছি। বেশ কিছু সুটকেস খোঁজার পর অবশেষে বিফল মনোরথ হয়ে তারা আমাদের ছেড়ে দিল। আবার বাস চলতে লাগলো। পথ মামুলি পাহাড়ি রাস্তা। এমন কিছু সুন্দর দৃশ্য নয়। সমস্ত পাহাড়ি অঞ্চলের রাস্তা যে রকমের হয় তারই মত – বাঁ দিকে পাহাড় আর ডান দিকে ত্রিশূলী নদীর ধার দিয়ে রাস্তা। এখানকার আবহাওয়া বেশ শুষ্ক – চতুর্দিকে কিরকম যেন একটা রুক্ষ ভাব চোখে পড়ে। তবে রাস্তার দুই ধারে বটলব্রাশ ফুলের সমারোহ দেখবার মতো। গাছের ডালগুলো লাল ফুলে উপচে পড়ছে – ঠিক যেমন মে মাসে আমাদের কলকাতায় রেড রোডের দুই ধারে কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো ভরে যায়।

    দেখতে দেখতে সাড়ে দশটা বাজলো। তখন আমরা দুপুরের খাবারের জন্য মুগ্লিম বাজার বলে একটা ছোট্ট জায়গায় আধঘণ্টার জন্য থামলাম। এখানে রাস্তার দুই ধারে সার দিয়ে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক হোটেল। সব হোটেলের ‘দিদি’রা খদ্দের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। রান্না তৈরি। ভাত, ডাল, তরকারি, মাংস, ডিম, মুলোর আচার – যার যা পছন্দ। এখান থেকে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমরা আবার রওনা দিলাম। কাঠমাণ্ডু থেকে পোখরা ২০০ কিলোমিটার পথ। তার ৯০ কিলোমিটার এখনও বাকি। মাঝে মাঝে বাস থামছে ছোটো ছোটো গ্রামে। সেখান থেকে বাসের কন্ডাক্টর মেল ব্যাগ বোঝাই করছে বাসে – মাঝে মাঝে নামাচ্ছেও। এটাই এখানকার সরকারী ডাক পরিবহনের একমাত্র উপায়। কিছুক্ষণ পর সারা বাস মোটামুটি নিস্তব্ধ। ঝিমোতে ঝিমোতে আর গরমে ভাজা হয়ে আমরা যখন পোখরা পৌঁছলাম তখন তিনটে বাজে। বাজার আর বাসস্ট্যান্ড যেখানে সেই জায়গাটার নাম ‘মহেন্দ্রপুল’। এখানে ‘নিউ হলিডে’ বলে একটা মোটামুটি ভালো হোটেলে বেশ আরাম করে অবস্থান করা গেল।


    ৪ঠা এপ্রিল, রবিবার

    আজ পোখরায় বিশ্রাম। কাল থেকে পদযাত্রা শুরু। জায়গাটা ভারী সুন্দর। ভোরবেলা হোটেলের ছাদে উঠে সূর্যোদয় দেখা গেল। আমরা যখন গতকাল বিকেলে এসে পৌঁছেছিলাম তখন আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। তাই এত কাছ থেকে বরফের চূড়া দেখা যাবে ভাবতেও পারিনি। এখন ভোরবেলা আকাশ পরিষ্কার। সামনে পুরো রেঞ্জ দেখা যাচ্ছে। মনে হয় এত কাছে যে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। এত কম উচ্চতা থেকে (মাত্র ২,৯৫০ ফুট) এতো কাছে অন্য কোনও জায়গা থেকে হিমালয় রেঞ্জ দেখা যায় বলে মনে হয় না। আমাদের সামনে একদম বাঁদিকে ধবলগিরি (২৬,৭৯৫ ফুট), তার পাশে অন্নপূর্ণা সাউথ (২৩,৬৮৩ ফুট )। তারপর এখানকার সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা ১ (২৬,৫৪৫ ফুট) একটু পিছনে বলে এই শৃঙ্গটাকে একটু ছোটো মনে হয়। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এক অদ্ভুত নামের শৃঙ্গ – মচ্ছপুছারে। মাছের ল্যাজের মত খাঁজকাটা চূড়াওলা এই পাহাড়টা প্রায় ভূগোল বইয়ে পড়া যথার্থ ত্রিভুজের মতো। সবচেয়ে কাছে বলে--মাত্র পঁচিশ কিলোমিটার দূর--এখান থেকে মনে হয় এই পাহাড়টাই সব চেয়ে উঁচু। শুনলাম আজ পর্যন্ত কেউ এই পাহাড় জয় করতে পারেনি। এর থেকে কিছুটা পূর্বে অন্নপূর্ণা ৩ (২৪,৭৮৭ ফুট) আর অন্নপূর্ণা ৪ (২৪,৬৮৮) আর তার পাশে অন্নপূর্ণা ২ (২৬,০৪১)। মূল অন্নপূর্ণা থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে তারপর দাঁড়িয়ে আছে নামজুং হিমাল (২২,৭১৪)। অবশেষে একেবারে পূর্বদিকে দেখা যাচ্ছে মানসালু আর হিমালচুলি। মনে পড়ল কৌশানী আর গোয়ালদাম গিয়ে খুব কাছ থেকে হিমালয় রেঞ্জ দেখে যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছিলাম। কিন্তু এ যেন অভূতপূর্ব। এর কাছে কৌশানীর দৃশ্য নিতান্তই সাধারণ আর মামুলি।

    সকালবেলা ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা স্থানীয় বাসে করে গেলাম পোখরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা – ফেওয়া লেকে। লেকটি অতি সুন্দর। নইনিতালের মত পাড় বাঁধিয়ে কৃত্রিম ভাবে তার সৌন্দর্য বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়নি। লেকের মধ্যে একটা দারুণ ফাইভ স্টার হোটেল আছে যেটা নৌকো করে ছাড়া যাওয়া যায় না। তাতে বিদেশী পর্যটকের ভিড় উপছে পড়ছে। পাড়েও বেশ কয়েকটা ভালো হোটেল আছে। লেকের মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপ তার ওপরে একটা মন্দির, নাম ‘বরাহি মন্দির’। এক হাঁটু জল ভেঙে আমরা সেই মন্দিরে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে তারপরে ঘণ্টা খানেক নৌকো বিহার করা হল। দুটো নৌকা ভাড়া করা হয়েছিল, ভাড়া ঘণ্টা পিছু দশ টাকা। শুনেছিলাম যে এই লেকের জলে পুরো পাহাড়ের রেঞ্জের ছায়া পড়ে অপূর্ব প্রতিচ্ছবি হয়, বিশেষ করে মচ্ছপুছারের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু তা দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় না কারণ পাহাড়ের চূড়াগুলো ততক্ষণে মেঘে ঢেকে গেছে।

    হোটেলে ফিরে এসে সবাই অলস ভাবে সময় কাটাতে লাগলো। কেউ তাস খেলছে, কেউ দোকান বাজার যাচাই করছে, আবার কেউ কেউ সুযোগ বুঝে একটা দিবানিদ্রাও দিয়ে নিচ্ছে। লিডাররা কালকের জন্য গাইড আর কুলি নির্বাচনে ব্যস্ত। পোখরায় এসে দুটো আশ্চর্য জিনিষ দেখলাম। প্রথম হচ্ছে জলের ঘাটতি। তার ওপর বঙ্গ ললনাদের বিখ্যাত কাপড় কাচার ভয়ে হোটেলের ম্যানেজারও ট্যাঙ্কের চাবি বন্ধ করে রাখে। দ্বিতীয়টা হল লোডশেডিং। আমরা সকলেই কলকাতায় লোডশেডিঙে অভ্যস্ত, কিন্তু সারাদিনে মাত্র চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ সাপ্লাই কল্পনাও করতে পারি না। যেদিন সকালে আলো থাকে সেদিন গোটা রাতটা নিষ্প্রদীপ। আবার যেদিন সন্ধে ছটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আলো থাকে, সেদিন সারাদিনই বিদ্যুৎ থাকে না।


    দুপুরে এখানকার স্থানীয় টুরিস্ট অফিসে আমরা দুটো তথ্যচিত্র দেখলাম – ‘ফেসটিভালস অফ নেপাল’ আর ‘ট্রেকিং ইন নেপাল’। যদিও পর্যটকদের জন্য এটা বিনামূল্যে প্রচার বটে, কিন্তু রঙিন আলোকচিত্র গ্রহণ খুবই সুন্দর। রাতে মোমবাতির আলোয় আমরা জিনিষপত্র গুছাতে লাগলাম। সঙ্গে যাবে দু-প্রস্থ জামাকাপড় আর খাবারদাবার। বাদবাকি জিনিষপত্র আমাদের ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই হোটেলে জমা থাকবে। সন্ধেবেলা দলনেতা প্রদীপদা একটা সুখবর আনলেন। মুক্তিনাথ যাত্রার হাঁটা পথ সাধারণত শুরু হয় পোখরা শহরের শেষ প্রান্তে শাইনিং হসপিটাল বলে এক জায়গা থেকে। গত ১৯৮০ সালেও ওরা ওখান থেকে ট্রেকিং শুরু করেছিল। গত বছর থেকে আরও সাত কিলোমিটার জীপ যাবার রাস্তা তৈরি হয়েছে। তাই আমাদের হাঁটাপথ ওই সাত কিলোমিটার কমবে। এই আনন্দ সংবাদে সকলেই বেশ খুশি দেখলাম। মনে মনে মুক্তিনাথজিকে প্রণাম জানিয়ে ঘুম।

    ৫ই এপ্রিল, সোমবার

    দলের কিছু তাড়াতাড়ি ওঠা সদস্যার কল্যাণে ফরসা হবার বেশ কিছুটা আগেই সকলে বিছানা ছেড়ে তৈরি হতে লাগল। ঠিক সাড়ে ছটায় আমাদের বুক করা দুটো জীপ আর তিনজন কুলিও এসে গেল। জীপ বলে কল্পনা করবেন না যেন যে যানগুলো সচরাচর রাস্তায় দেখেন। এখানে জীপ নামক যন্ত্রটা স্রেফ টিনের বডি বিশিষ্ট একটা ভাঙাচোরা যান। ডিসপোসালে ফেলে দিলেও এখানে কেউ নেবে না মনে হয়। দশজন করে গাদাগাদি করে তাতে উঠে যাত্রা শুরু হল। সবাইকে মুড়ির টিনে ঠাসা হল যেন। তাতেও কুলিরা ধারে চাল ধরে ঝুলে ঝুলে আছে। এইভাবে সহর পেরিয়ে তিন কিলোমিটার দূরে তিব্বতি ক্যাম্প বলে একটা গ্রাম পড়ল। তারপর হায়েঞ্জা। রাস্তা মোটামুটি সাধারণ। তারপর এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা শুরু হল। ডানদিকে শ্বেতি খোলা নদী (নেপালি ভাষায় নদীকে বলে খোলা), তার বুকে বাঁধ বানানোর কাজ চলছে। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা বলে প্রায় কিছুই নেই। উঁচু নিচু পাথরের ওপর দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আমরা চলেছি। তারপর হঠাৎ রাস্তা শেষ হয়ে গেল। নদীর চড়ায় নুড়ির ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে জীপ চলল। মাঝে মাঝে সরু সরু জলের ধারা, তার ওপর দিয়েই গাড়ি চলছে। এইরকম ভাবে কুলোর পাছড়ানো খেতে খেতে সাত কিলোমিটার পথ শেষ হল। পাহাড়ের ঠিক পাদদেশে ফেদি বলে একটা ছোট্ট গ্রাম পড়ল। নীচে কয়েকটা ছড়ানো চায়ের দোকান, তার পাশ দিয়েই হাঁটা পথ শুরু। সকাল নয়টার সময় আমরা যখন এখানে জীপ যাত্রা শেষ করলাম, তখন আমাদের অবস্থা ফেলুদার গল্পের লালমোহন বাবুর উট চাপার অভিজ্ঞতার মতো। সারা শরীরের যন্ত্রপাতিগুলো যেন নড়ে গেছে – সব স্ক্রুগুলো টাইট করার দরকার হয়ে পড়েছে।

    ফেদিতে চা পান করেই পাহাড়ের মাথায় ওঠার চড়াই রাস্তা শুরু হল। সারাটা রাস্তা সিঁড়ি বেয়ে ক্রমাগত চড়াই। সকলে মিলে হাঁপাতে হাঁপাতে আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে সোয়া দশটা নাগাদ পাহাড়ের মাথায় নউদাণ্ডা (৪৭৮২ ফুট) পৌঁছলাম। এখানে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। পাহাড়ের মাথায় প্রচুর হোটেল আর লজ রয়েছে। তাদের ‘হাতে-লেখা’ মেনু কার্ডগুলো দারুণ – চাইনিজ, ইন্ডিয়ান, সব রকম খাবারই বানাতে পারে দেখলাম। ওদের মধ্যে মোটামুটি ভালো ‘মচ্ছপুছারে লজে’ আমাদের খাবারের অর্ডার দেওয়া হল। তৈরি করতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণ আমরা লজের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলাম কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে। ওপরে উঠে চোখ ধাঁধিয়ে যাবার যোগাড় – রীতিমতো খাট বিছানা পাতা – তার ওপর আবার ফোমের গদিও আছে। এই খাটের ভাড়া চার টাকা প্রতি রাত, বিনা গদির বিছানা হলে দুটাকা। এই রাস্তায় টুরিস্ট বলতেই বিদেশী সাহেবদের বোঝায় – সাদা চামড়ার সাহেব ছাড়া অন্য কোনও যাত্রীই নেই, তাই ব্যবস্থাও বেশ উন্নত। আমাদের দেশে কেদারবদ্রীর রাস্তায় যে সব চটী দেখেছি, তার মধ্যে এমন অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে রাত্রে শোবার পর বুকের ওপর ইঁদুর নৃত্য করে, কিন্তু এখানে অনেক ছোটো গ্রামে এরা টুরিস্টের জন্য দারুণ সুব্যবস্থা করে রেখেছে। অবশ্য আক্ষরিক অর্থে আমরাও যে নেপালে বিদেশী টুরিস্ট সেটা ওরা মানতে রাজি নয়। এখানকার সব হোটেলে স্ত্রী-স্বাধীনতার দারুণ বিজ্ঞাপন – মেয়েরা শুধু রান্না করছে তাই নয়, যাত্রীদের সাথে কাজ চালানো গোছের ইংরেজি বলে হাসিমুখে অভ্যর্থনাও করতে পারে।


    একটা মিনি ঘুম দেবার পর খাবারের ডাক পড়ল। লাঞ্চের মেনু আশাতীত – পরিষ্কার স্টেনলেস স্টিলের থালায় ভাত, ডাল, আলু দিয়ে বাঁধাকপির তরকারি, সালাদ আর ডিম সিদ্ধ। বাড়ির থেকেও বেশি তৃপ্তিদায়ক খাওয়া হল। মিল প্লেট-প্রতি ছয় টাকা। এই রাস্তায় ডিম আর কোকাকোলা অফুরন্ত পাওয়া যায় যা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রে যাবার সময় কল্পনাতীত। নেপালি ভাষায় ডিমকে বলে ‘ফুল’ আর তার দাম প্রতিটা দেড় থেকে দু টাকা। আর কোকাকোলার কথা না বলাই ভালো। সমস্ত রাস্তায় ছোট্ট চায়ের দোকানেও এই ঠাণ্ডা পানীয় বড়ই প্রলোভন যোগায়।

    খাওয়া-দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর আবার পথ চলা শুরু হল। এতক্ষণে পুরো নউদাণ্ডা গ্রামটা দেখা গেল। পাহাড়ের মাথায় বেশ বড় গ্রাম। রাস্তার দুই ধারে ঘর, বাড়ি, দোকান, স্কুল, আর দুটো ব্যাংক চোখে পড়ল। আস্তে আস্তে চলছি আমরা। রাস্তা মোটামুটি পাহাড়ি অঞ্চলের মত – কিছুটা চড়াই আবার মাঝে মাঝে কিছুটা সমতল। এইভাবে চলতে চলতে ঘণ্টা দুএক পরে খারে বা কাঁড়ে গ্রামে এলাম। রাস্তার দুপাশে কয়েকটা হোটেল আর চায়ের দোকানের পর রাস্তা হঠাৎ ঢালু হয়ে নামতে শুরু করল। মাঝে মাঝে পাথরের সিঁড়ি করা আছে আর তার ওপর দিয়ে বেশ আনন্দের সঙ্গে আমরা নামছি। এইভাবে খারে থেকে পরের গ্রাম লুমলে পুরোটাই উতরাই। প্রায় দু কিলোমিটার রাস্তা। মনে হচ্ছে সারা সকাল কষ্ট করে যতটা চড়েছিলাম, সবটাই বুঝি আবার নেমে এলাম। আমরা যখন লুমলে (৫০০০ ফুট) পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। তবে পাহাড়ি জায়গায়ে বেশ দেরী করে সন্ধে হয় তাই তখনও বেশ রোদ আছে। আমাদের দলের দুজন সব সময় আগে আগে হাঁটে (পারলে জগিং রেসে নামও লেখায়) তাই তাদের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে আগে গিয়ে হোটেল ঠিক করার। আমরা যখন সবার শেষে পৌঁছলাম ওদের বুক করা ‘লুমলে হোটেল’-এ তখন সবাই হোটেলের সামনে বসে আছে। নিচে একটা খাবার ঘর আর তার পাশ দিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে একটা অন্ধকার শোবার ঘর। সেখানে সার দিয়ে নয়টা খাট পাতা। ওপরের চালটা এত নিচু যে খাটের ওপর দাঁড়ানোর উপায় নেই। সেই আধা-অন্ধকার ঘরে আমরা পোঁটলাপুটলি নিয়ে বেশ আরাম করে বিশ্রাম নিতে বসলাম। আজকের মত যাত্রা সমাপ্ত। কিন্তু আমরা তখনও বুঝতে পারিনি যে আমাদের ভাগ্যে কি আছে। হোটেলে না আছে আলো, না আছে জল। জল চাইতে হোটেল মালিক এক বুড়ো নেপালি গুরুং দূরে ঝরনা দেখিয়ে দিল। আমরা হোটেলে ঢোকার আগে ডান দিকে নবনির্মিত বাথরুম আর ল্যাট্রিন দেখেই ঢুকেছি কিন্তু এখন শোনা গেল যে ওটা বানানো হয়েছে কেবল সাহেবদের জন্য টয়লেট পেপার ব্যবহার করতে। আমাদের জন্য সে কিছুই ব্যবস্থা করতে পারবে না। অগত্যা সবাই মিলে মুখ হাত ধুতে কিছুদূরে গ্রামের ভিতর সেই ঝরনায় গেলাম। সেখানে আরও করুণ দৃশ্য দেখতে হল। আসার পথে দেখেছি যে এখানকার গ্রামবাসীরা প্রায় সকলেই শুয়োর আর মুর্গী পালে তাই গ্রামের মধ্যে রাস্তাগুলো বেশ নোংরা। কিন্তু ঝরনার ধারে গিয়ে দেখি সেখানে সদ্য একটা মোষ কেটে তিন চার জন মিলে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিঠের ওপর ঝুড়ির মধ্যে মাংসের বড় বড় টুকরো, যারা বইছে তাদের পিঠ আর পা বেয়ে রক্তের ধারা সারা রাস্তা লালে লাল করে রেখেছে। শুনলাম এখানকার সবাই মোষের মাংস খায় না, কেবল নিচু জাতের লোকেরা খায়।

    লজে ফিরে দেখি যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ পায়ের ব্যথায় রিলাক্সিল মালিশ করছে, আর একদল ছেলেরা ২ হার্টস, ৩ ক্লাবস – অর্থাৎ ব্রিজের খেলায় মেতে আছে। রাত্রে খেতে বসে আমাদের হোটেলের মালিকের কারসাজি টের পাওয়া গেল। সে শুধু বাক্যবাগীশই নয়, একেবারে হাড়ে হাড়ে শয়তান। একটা থালায় রুটি আর তরকারি গাদা করে দিয়ে বলল যে তার কাছে কোন বাসন নেই। তার ওপর কুলিদের রান্নার চাল অর্ধেক মেরে দিয়ে তাদের শুধু গতবছরের কতগুলো শুকনো বাঁধাকপির পাতা দিয়ে খেতে দিয়েছে। এছাড়া লোকটা এমন ভাব দেখায় যেন সে সব বিষয়ে পারদর্শী। এখানে একটা দারুণ মজার ঘটনা ঘটলো। গুরুং সারাক্ষণ শুধু বলে যে সে মিলিটারিতে কাজ করত – ভারত, বর্মা, আর মালয়েশিয়াতে হেন জায়গা নেই যে সে নাকি যায় নি। তার ওপর একটা পুরনো মর্চে পড়া বন্দুক দেখিয়ে বলে যে সে নাকি ওটা দিয়ে অনেক কিছু শিকার করেছে। একে তার ব্যবহারে আর তার খাবার খেয়ে সকলেই বেশ ক্ষিপ্ত, তায় কতক্ষণ আর এইসব সহ্য করা যায়। আমাদের দলের চারজন নীচে স্লিপিং ব্যাগ পেতে শুয়ে ছিল। তারা দেখলে যে একে না শায়েস্তা করলে ঘুমও আসবে না। হঠাৎ প্রদীপদা তাকে বলে উঠল, “তোমার বন্দুকটা দেবে ভাই, আমি কাল এখানে শিকার করব। তোমাদের এখানে কি কি শিকার পাওয়া যায়?” গুরুং বলল, “কলকাতায় ছোট ছোট বাঘ পাওয়া যায়, আমি চিড়িয়াখানায় দেখেছি। এখানের জঙ্গলে বড় বড় রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়”। মিত্তিরদার কথা আগেই বলেছি। সেই মিত্তিরদা তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, “আরে, এর কাছে তুমি বাঘের গল্প করছ, জানো এ কত বড় শিকারি? এ হচ্ছে প্রিন্স অফ পিপ্লিগড়। এ যে কত শো বাঘ মেরেছে তা এর বাড়ি গিয়ে দেখে আসবে, বুঝেছ”।

    গুরুং এবার কিছুটা দমলেও, মনে তার তখনও অবিশ্বাস। সে ভারতবর্ষে ছিল, অতএব ওখানকার ভূগোলের বিষয়ে ধারণা তার কিছুটা আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল, “সেই জঙ্গলটা কোথায়? আমি ত কখনও নাম শুনিনি”। একটা কিছু বলতেই হয় তাই দলের আরেকজন, নাম হারুদা, বলে উঠল, “ঢেরিঝুমকোর জঙ্গলে”। সকলেই তখন কম্বলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। কিন্তু গুরুং যদি বুঝতে পারে যে এরা টেনিদার জাতভাই হয়ে গেছে তা হলে মহা বিপদ। গুরুং তখনও এর ওর মুখ চাওয়াচাই করছে। মিত্তিরদা তখন দেখলেন যে অবস্থা বেগতিক। একটা কিছু বলে ম্যানেজ দিতেই হয়। তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, “আরে ঢেরিঝুমকোর জঙ্গলের নাম শোন নি? তুমি তো বেশ কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছ, তাই জানো না। তুমি চলে আসার পর, ভারত সরকার বাঁকুড়ায় একটা নতুন জঙ্গল বানিয়েছে। সব জায়গা থেকে বাঘ আনিয়ে এই জঙ্গলে রেখেছে, আর আমাদের প্রিন্স সেখানে গিয়ে সেই বাঘগুলো মেরেছে”। টেনিদা সত্যিই এদের কাছে শিশু। এরপর যে ওরা না হাসি চেপে কতক্ষণ ছিল তা আমি বলতে পারি না।

    ৬ই এপ্রিল, মঙ্গলবার

    ভোরবেলা উঠে আবার সেই ঝরনায় গিয়ে, প্রাতঃকৃত্য সেরে, চা খেয়ে আমাদের আজকের মত যাত্রা শুরু হল। লুমতে আমরা ছিলাম একেবারে গ্রামে ঢোকার মুখে। এখন সারা গ্রামের নোংরা রাস্তার ওপর দিয়ে চলতে হল। গ্রামের শেষে কিছুটা সমতল রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে কিলোমিটার খানেক দূরে চন্দ্রকোট বলে আর একটা গ্রাম। এইখানে একটা বড় অশ্বত্থ গাছের নীচে বাঁধানো বিশ্রামের জায়গা। এখান থেকে অন্নপূর্ণা আর মচ্ছপুছারের সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। পথে কয়েকজন তীর্থযাত্রীর সঙ্গে দেখা হল। স্থানীয় নেপালি বুড়োবুড়ির দল। রামনবমীর সময় মুক্তিনাথে যে উৎসব আর মেলা হয়, সেখান থেকে ওরা ফিরছে। ওরা আমাদের কয়েকটা লাঠি দান করল আর ভয়ও দেখাল যে পথ দারুণ চড়াই। আমাদের দলের মহিলাদের স্বাস্থ্য দেখে আরও বিশেষ করে উদ্বিগ্ন হয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করল যে শেষ পর্যন্ত হয়ত আমরা পৌঁছতে পারব না। মনে মনে ভাবছি, তোমরা এই সাতাত্তর কেজি দেখে ভয় পাচ্ছ বটে কিন্তু আমাদের কিছুই মনে হচ্ছে না। এইরকম যদি রাস্তা হয় তো কিছুই না, যে কেউ হেসে খেলে মুক্তিনাথ পৌঁছতে পারবে। তখন তো জানি না যে পথের কষ্টর কিছুই তখনও শুরু হয়নি।

    চন্দ্রকোট গ্রামের শেষে পথ এবার সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করল। মাঝে মাঝে পাথরের সিঁড়ি বাঁধানো আর মাঝে মাঝে মাটির ঢাল। সেই উতরাই পথে উৎসাহের সঙ্গে সকলে নামতে থাকি। মাঝের কিছুটা জায়গায় বড় বড় চির আর পাইন গাছের বন। তারই ফাঁক দিয়ে আবার মাঝে মাঝে বরফের চূড়াগুলো উঁকি মারছে। উতরাই পথে সকলের প্রধান সমস্যা হাঁটুর ব্যথা – আমার অবশ্য সেটা নেই। মোটা মানুষ, উঠবার সময় বুকে হাঁফ ধরে বটে কিন্তু নামার সময় কোনও চিন্তা নেই। তাই বেশ মনের আনন্দে ক্যাডবেরি খেতে খেতে নীচে নামছি। মাঝে মাঝে পিঠে রুকস্যাক নিয়ে কিছু সাহেব মেমদের উঠতে দেখছি। এই সকালেও ওদের কপালে ঘামের ধারা – নেহাত মুখের খাতিরে ‘হ্যালো’ বলছে, কিন্তু মুখগুলো করুণ। আমরা যত নামছি তত মনে হচ্ছে ফেরার সময় উঠবো কি করে। একেবারে আড়াই কিলোমিটার রাস্তা সোজা পাতালে উতরাই। কিছু দূর গিয়ে পাহাড়ের একটা বাঁকে হঠাৎ দূরে অনেক নীচে মোদী খোলা আর ভুরুন্দি খোলার সঙ্গম দেখা গেল। তারই একপাশে একটা বেশ বড় গ্রাম, নাম বিরেথান্তি। আমাদের ওইখানে নামতে হবে। এখান থেকে বাড়িঘরগুলো যেন পটে আঁকা ছবির মত দেখাচ্ছে। আরও কিছুটা নেমে একটা ঝোলা পুল পার হয়ে বিরেথান্তি পৌঁছলাম। বেশ কড়া রোদ উঠেছে, তাই গরম। বিরেথান্তি মাত্র ৩৪০০ ফুট উঁচু। তার মানে আমরা এইটুকু সময়ের মধ্যে চন্দ্রকোট থেকে একেবারে ১৭০০ ফুট নেমে এলাম। এখানে মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। রাস্তার ধারে ‘সানশাইন হোটেল’। লেমন টি খেয়ে শরীরটা বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল। খাবারের অর্ডার দিয়ে আমরা কয়েকজন নদীতে হাত মুখ ধুতে গেলাম। রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর জলে। সেখানে জল যেমন পরিষ্কার তেমনি ঠাণ্ডা। মুখ হাত ধুতে ধুতে যেই একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, ওমনি পাথরে পা হড়কে ঝপাৎ করে একদম এক গলা জলে পড়লাম। আরামও যেমন হল তেমন চিন্তাটাও কিছু কম হল না কারণ অন্য এক প্রস্থ জামাকাপড় তো কুলির পিঠের বোঝার ভিতরে আর তারা ব্রিজের ওপারে অনেক এগিয়ে গিয়ে রান্নাবান্না করে খাচ্ছে। যা হোক, এই অবস্থায় ভিজে কাপড় পরেই লাঞ্চ খেলাম। মেনু – ভাত, ঢেঁকি শাকের তরকারি আর ট্রাউট মাছের ঝোল।

    খাওয়াট-দাওয়া সেরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোতে লাগলাম। কাতলা মাছ ধরার জন্য কোমরে দারুণ ব্যথা। বিরেথান্তির পর থেকে এবার রাস্তাটা সুন্দর। পথ প্রায় সোজা – বাঁ দিকে সারাক্ষণ ভুরুন্দি খোলা পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। কিছুদূর এগিয়ে একটা বিরাট জলপ্রপাত দেখা গেল। নদীটা পাথরের মধ্যে দিয়ে হঠাৎ খাড়া হয়ে সোজা নেমে গেছে – নীচে একটা বেশ বড় পুকুরের মত সৃষ্টি হয়েছে। সেখানটা স্নান করার অতি উত্তম জায়গা। প্রচুর সাহেব মেমকে সেখানে স্নান করতে দেখে আমাদের দলের কয়েকজনও অবগাহনে নেমে পড়ল। কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা শেষ। নদীর বুকে বড় বড় পাথরের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে কিছুটা দূরে ওই একই রকম গুঁড়ি ফেলা ব্রিজ। সেটা পেরিয়ে আবার আমরা একই পাড়ে ফিরে আসি। এখন গ্রীষ্মকাল, নদীতেও মোটামুটি জল কম, তাই এইভাবে আসা গেল। অন্য সময় ডানদিকে বনের মধ্যে দিয়ে পথ চলতে হয়। এরপর রাস্তা সামান্য চড়াই শুরু হল। কুলিদের মতে এটা মিনি চড়াই, নিছক পাহাড়ি রাস্তার ওঠা নামা। কিছুটা এগিয়ে সুদামে গ্রাম। রাস্তার ধারে পাকা বাড়ির দাওয়ায় বসে নেপালিরা চিরাচরিত জুয়োর আড্ডায় মেতেছে। আবহাওয়া বেশ গরম। জোর গলায় কথা কাটাকাটিও চলছে। ওই জায়গা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার হয়ে প্রায় কিলোমিটার খানেক পরে ‘হিলি’ গ্রামে পৌঁছলাম। এখান থেকে পরের গ্রাম ‘তিরখেদুঙ্গা’ (৪৮০০ ফুট) প্রায় দেড় কিলোমিটার দূর আর রাস্তা সবটাই সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। মাঝে মাঝে ঘোড়া, গাধা আর খচ্চরের পাল সার দিয়ে নেমে আসছে। তাদের মাথার ওপর ফ্রেমের মধ্যে রঙ করা চামরগুলো হাতপাখার মত উঁচু হয়ে আছে, আর তাদের গলার পাশে নানা রঙের ফিতে দিয়ে বিনুনি বাঁধা। এছাড়া প্রত্যেকের গলায় বড় বড় ঘণ্টা বাঁধা। সেই ঘণ্টার আওয়াজ বহু দূর থেকে যাত্রীদের সচেতন করে দেয় রাস্তা ছেড়ে দিতে। শব্দটা বেশ মিঠে লাগে শুনতে। কয়েকটার পিঠের ওপর আবার রঙচঙে কার্পেটের মত ফুলকাটা জিন। এক একটা দলে প্রায় বিশ পঁচিশটা করে জানোয়ার থাকে। তাদের সঙ্গে তাদের তিব্বতি মালিক মুখে বিচিত্র রকমের শিস দিতে দিতে চলে। প্রত্যেকের পিঠে বোঝাই করা জিনিষ। সবাই চলেছে পোখরায় সওদা করতে। এরাই হচ্ছে এই সব গ্রামের একমাত্র ভরসা। চাল, ডাল, কেরোসিন ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিষ এরাই দূর দূর গ্রামে সরবরাহ করে। পুরো রাস্তাটা অবশ্য একই জানোয়ার যায় না, কিছুদূর গিয়ে থেমে যায়। সেখান থেকে অন্য একদল আবার ভার নেয়। এইভাবে দিনের পর দিন রিলে রেসের মত করে এরা জিনিষপত্র আনা নেওয়া করে। শুনলাম আগেকার দিনে নেপালের সাথে তিব্বতের এটাই ছিল প্রধান বাণিজ্য পথ। এই পথে তুকুচে ছিল প্রধান ব্যবসাকেন্দ্র। নীচ থেকে নেপালিরা নুন, চাল, কাপড় ইত্যাদির বদলে তিব্বতিদের কাছ থেকে ওরা নিত জেড পাথর, চামর ইত্যাদি। এখন যদিও সেটা বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও পথের গুরুত্বটা কিছু কমেনি। মাঝে মাঝে এই কারাভানের ভয়ে পথের ধারে পাথরের ওপর উঠে ওদের পাশ দিতে হয়। কারণ বেশি কাছে দাঁড়ালে ওদের পিঠের বোঝায় পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাবার ভয় থাকে। আর খাদের দিকে দাঁড়ালে তো নিশ্চিত কালীগণ্ডকীর বুকে সলিল-সমাধি।

    হিলি পার হয়ে মিনিট পনেরো পরেই তিরখেদুঙ্গা পৌঁছে গেলাম। আজকের মত আমাদের এখানেই বিশ্রাম। আজকে আমরা মোট সাড়ে দশ কিলোমিটার হেঁটেছি। কাল সকালে সেই বিখ্যাত উলেরির চড়াই শুরু। কেমন করে সেটা পার হবে, সকলেরই মনে মনে ভয়। দু-মাইলের মধ্যে প্রায় দুহাজার ফুট উঠতে হবে। তার মধ্যে কোন চায়ের দোকানও নেই যেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাবে। সন্ধেবেলা ‘স্টার হোটেল’ বলে এক জায়গায় আমরা উঠলাম। এখানকার ব্যবস্থা অন্য সব হোটেলের মতই। নীচে রান্না আর খাবার ঘর। তার মধ্যে দিয়ে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানে মাথা নিচু করে দরজা দিয়ে ঢুকতে হয়। ঘরের মধ্যে সার দিয়ে চৌকির ওপর বিছানা পাতা। রাতে এক প্লেট করে স্রেফ আলু সিদ্ধ দিয়ে ডিনার পর্ব শেষ করে সকলে পদসেবা করতে করতে ঘুমোতে গেল। সবে তন্দ্রা এসেছে এমন সময় প্রচণ্ড হট্টগোলে ঘুম ভেঙে গেল। নীচে প্রচণ্ড বেগে চিৎকার চেঁচামিচি হচ্ছে, এমনকি ছোরা ছুরি চালানোরও প্রস্তুতি চলছে। হোটেলকর্ত্রী তার স্বামীকে ধরে বেদম প্রহার দিচ্ছে আর পয়সার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে চিৎকার করছে – “গুন তেরি পয়সা গুন...”। তারা নীচে যত চেঁচাচ্ছে ওপরে আমাদের সঙ্গীরা তাদের চুপ করাবার চেষ্টায় ততোধিক জোরে চেঁচাচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বিরাট দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধল বোধহয়। এই দৃশ্যের রকমফের পথে যেতে যেতে অনেকবারই দেখলাম। অকর্মণ্য নেপালি পুরুষরা কেবল জুয়া খেলে বেড়ায় আর ঘর সংসারের যাবতীয় কাজ, এমনকি হোটেল চালায় ‘দিদিরা’। যে হোটেলে ‘দিদি’ অনুপস্থিত, সে হোটেলে চরম অব্যবস্থা।

    ৭ই এপ্রিল, বুধবার

    রাত থাকতে থাকতে সবাই উঠে পড়ে লম্ফর আলোয় গোছগাছ শুরু করে দিয়েছে। তারপর আর এক প্রস্থ আলু আর ডিম সিদ্ধ খেয়ে আবার পথচলা শুরু। সামনেই একটা ঝোলা পুল – সেটা পেরিয়ে গিয়ে শুরু হল চড়াই। সারা রাস্তা পাথরের সিঁড়ি করা তাই এত ভোরেও উঠতে মাঝে মাঝে হাঁপাতে হচ্ছে। উঠছি তো উঠছি কিন্তু পথ আর শেষ হয় না। রাস্তা সারাক্ষণ ৪০ থেকে ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে উঠেই যাচ্ছে। মনে আছে গঙ্গোত্রী যাবার সময় লঙ্কা থেকে ভৈরবঘাটির চড়াইটা উঠতে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু সেটাও যেন এর কাছে নিতান্তই শিশু। মুক্তিনাথ যাত্রাপথে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে নামকরা চড়াই। সব লোকেরা সেই কাঠমাণ্ডু থেকে আমাদের এটারই ভয় দেখাচ্ছিল।


    ঘণ্টাখানেক ওঠার পর হঠাৎ ডানদিকে পাহাড়ের ফাঁকে বরফে ঢাকা অন্নপূর্ণা সাউথ বা প্রচলিত কথায় গণেশ পিক উঁকি মারতে লাগল। দেখে মনে হল কে যেন বস্তা বস্তা চুন ঢেলে দিয়েছে ওর ওপরে। সকালের প্রথম রোদ পেয়ে বরফগুলো আরও চকচক করছে। এতক্ষণে রোদটাও আমাদের গায়ে নেমে এসেছে। সকলে একে একে সোয়েটারের পলস্তারা খুলতে শুরু করেছে। পাথরের ধাপের ওপর কয়েক মিনিট বসে আবার ওঠা শুরু হল। সারা রাস্তা এইরকম সিঁড়ি না করা থাকলে চড়াই উঠতে অনেক আরাম হত। এতদিন ধরে এই উলেরির কথা শুনতে শুনতে নিজেদের অজান্তেই মনটা নিশ্চয়ই কিছুটা প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল, তাই নটা নাগাদ হঠাৎ একটা মোড় ঘুরে দেখি একটা চা এর দোকান – চড়াই শেষ, আমাদের এডভান্স পার্টির সকলে স্বাগত জানাচ্ছে। তখন মনে হল – কই তেমন তো কিছু কষ্ট হল না। এই আড়াই কিলোমিটার পথ উঠতে আমাদের পুরো তিন ঘণ্টা সময় লাগল। পথে কতগুলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সাথে দেখা হল। তারা চলেছে নীচে তিরখেদুঙ্গার স্কুলে পড়তে। উলেরিতে যে পাঠশালা আছে তাতে ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়া যায়। স্কুল ছুটির পর ওরা আবার সন্ধেবেলা এই চড়াই ভেঙে উঠে আসবে। রোজ এই ১৯০০ ফুট চড়াই আর উৎরাই? এর থেকে আমার মূর্খ হয়ে থাকাও বোধ হয় ভালো। অবশ্য এই পরিবেশে মানুষ হওয়ার জন্য হয়ত এটা ওদের কাছে কিছুই নয়। এর চেয়ে অফিস টাইমে কলকাতায় বাস এর হাতল ধরে জিমন্যাস্টিকস করতে করতে যাওয়াকে হয়ত এরা আরও কঠিন মনে করবে। ৪৯০০ ফুট থেকে এক লাফে চলে এলাম ৬৮০০ ফুটে। এরপর উলেরির ‘মহাদেব হোটেল’-এ মধ্যাহ্নভোজের বিরতি আর দু ঘণ্টা বিশ্রাম।

    বেলা এগারোটা বাজার সাথে সাথে আমরা আবার ঝোলা কাঁধে রওনা দিলাম ঘোরেপানির দিকে। আবার আর এক দফা চড়াই শুরু। সাড়ে চার কিলোমিটার পথ, উঠতে হবে আরও ২৭০০ ফুট। প্রায় ঘণ্টা খানেক চড়াই ভাঙ্গার পর দু তিনটে চায়ের দোকানওলা ছোট্ট একটা গ্রাম পড়ল, নাম বনথান্তি। এখান থেকে বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা শুরু হল। কিছুদিন আগে এখানে এক সাহেব ট্রেকারকে একা পেয়ে কিছু লোক নাকি এই জঙ্গলে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাকে খুন করেছে। তারপর থেকে এই জঙ্গলের পথে কেউ বড় একটা একা চলে না। মাঝে মাঝেই নাকি চোর ছ্যাঁচোড়ের পাল্লায়ও পড়তে হয়। তাই লিডার দল ঠিক করে দিল – দলছাড়া হলে খুব মুস্কিল। বন শুরু হল। খুব যে ঘন তা নয়, তবে চারিপাশে বড় বড় গাছ, আর কোথাও বা ঝোপঝাড়। মনে হল এই বনের মধ্যে কখনও আলো ঢোকে না। সারা রাস্তায় স্যাঁতস্যাঁতে ভাব, ঠিক যেন অল্প আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। তবে রাস্তা দারুণ সুন্দর। চারিদিক নিস্তব্ধ – খালি মাঝে মাঝে গাছ কাটার শব্দ। তার মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ কলকল শব্দে ঝরনার জলধারা বয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ম্যাগনোলিয়া গাছের ফুলগুলো দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। সত্যিই ফুলগুলো এত সাদা আর বড় যে বক বা অন্য কোন পাখি বলে ভুল হয়। তারপর মাঝে মাঝে শুরু হল রডোডেন্ড্রনের বন – গাছে যত পাতা তার চেয়ে ফুল বেশি। লাল, গোলাপি, সাদা – কতো রকমের রঙের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে আমাদের দলের কয়েকজন ডাল ভেঙে আনছে। শুনলাম এই ফুল শুকনো করে বেটে খেলে নাকি রক্ত আমাশার অব্যর্থ ওষুধ হয়। দিশি অসুখের এমন বিলিতি ওষুধ কে প্রথম আবিষ্কার করেছিল কে জানে!

    আমরা বেশ গল্প করতে করতে চলেছি – বিষয়ও বিচিত্র। সারা রাস্তা ছায়ায় ঢাকা তাই দুপুর রোদের তাপে যে ক্লান্তি আসে সেটা অনুভব করতে হয় না। তা ছাড়া এদিককার চড়াইটাও ভদ্র গোছের – উলেরির মত সোজা সিঁড়ি নয় – কিছুটা সিঁড়ি আর কিছুটা সমতল। কিছুদূর এগিয়ে পথের একটা বাঁকে বেশ বড় একটা ঝরনা পড়ল, নাম শুনলাম ‘ভালুয়ারা’ ফলস। জায়গাটা খুব সুন্দর। বড় বড় কালো পাথরের মধ্যে দিয়ে নেমে ঝরনার জলটা একটা ছোটোখাটো পুকুরের সৃষ্টি করেছে। আশপাশটা কেমন যেন আবছা অন্ধকার, একটা গা ছমছমে ভাব। তারই মাঝ থেকে জলস্রোতের কলধ্বনি উঠছে আর পাহাড়ের পাথরে পাথরে তার প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ঝরনাটা পার হয়েই বনের মধ্যে খানিকটা ফাঁকা সমতল জায়গা দেখা গেল। একপাশে পাথর সাজিয়ে বিশ্রামের জায়গাও করা আছে। দেখেই পা যেন আর চলতে চায় না। ধপ করে বসে পড়ি সেই পাথরের বেঞ্চে।


    আমাদের তিনজন কুলি তিন ‘বাহাদুর’– অকাল বাহাদুর, বীর বাহাদুর, আর সূর্য বাহাদুর – তারাও সেখানে পিঠের ভারী বোঝা নামিয়ে রেখে বিশ্রাম নিচ্ছে। সকালে যে উত্তেজনা নিয়ে চড়াই ভাঙা শুরু করেছিলাম, এখন সেটা অনেকটাই কমে গেছে। পা দুটোও ভারী হয়ে যেন বিদ্রোহ করতে শুরু করছে। সারা রাস্তায় কোনও লোকবসতির চিহ্ন দেখলাম না। মনটা চায়ের জন্য আকুলি বিকুলি করতে লাগল। দু পা করে এগোই আর কুলিদের জিজ্ঞাসা করি –“আর কত দূর?” ওরাও সব সময় আশার বাণী শোনায় –“আর বেশি নয়, এইতো প্রায় এসে গেছি”। মনে পড়ে হেমকুণ্ডর শেষ চড়াই ওঠার সময় ফিরতি পথের যাত্রীরা খালি উৎসাহ দিত – “আ গায়া বহেন জি... আউর চার কদম”—কিন্তু চার কদম চার শত হয়েও রাস্তা ফুরায় না। এখানেও ঠিক তাই। এ যেন পাহাড়ি রাস্তার ট্র্যাফিক আইনের একটা আইন। এখানকার কুলিরাও তাই রুমাল শুকানো ক্রোশ দেখায়। ডালভাঙা ক্রোশের মত, “এখানে এক ঝরনার জলে রুমাল ভেজাবেন,” অকাল বাহাদুর বলে ওঠে, “তারপর পথ চলতে চলতে যেখানে রুমালটা শোকাবে, সেইটাই হবে এক ক্রোশ”।

    এইভাবে ওদের সাথে তর্কবিতর্ক করতে করতে অবশেষে সাড়ে তিন কিলোমিটার চলার পর পাহাড়ের কোলে হঠাৎ কিছুটা সমতল জায়গা চোখে পড়ে। তার সামনে চায়ের দোকানে ওই তো আমাদের দলের সকলে চায়ের গেলাস হাতে বসে আছে। জায়গাটা ওক গাছের বনের মধ্যে একটা বড় উপত্যকা গোছের – নাম নয়াথান্তি। মামুলি ছোট্ট গ্রাম। মোট তিন চারটে চায়ের দোকান। এখানে এক গ্লাস লেমন টী অমৃতের স্বাদ এনে দেয়। চা খেয়েই আবার পথ চলা শুরু। ঘড়িতে তিনটে বেজে পনের মিনিট। এখান থেকে ঘোরেপানি আরও এক কিলোমিটার। আমরা কয়েকজন সব সময় শেষে চলি – তাতে এগিয়ে যাবার তাড়া থাকে না, উপরন্তু লাভ হচ্ছে এই যে শেষে যখনই পৌঁছাই তখন দেখি অ্যাডভানস পার্টি আমাদের জন্য চা, বিছানা, সবই প্রস্তুত করে রেখেছে। দলের দু জন ছেলে সবসময় শেষে থাকে। এদের কাজ হল আমাদের গরু তাড়া করে নিয়ে যাওয়া - একপ্রকার ‘ঝাড়ুদার’ বিশেষ।

    আবার চলা শুরু হল। বনের মধ্যে দিয়ে পথ ঘুরে ঘুরে উঠছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় এত রডোডেনড্রন পড়ে আছে গালচের মতো যে ওগুলো মাড়িয়ে যেতে কষ্ট হয়। নেপালি ভাষায় এই ফুলের নাম ‘লালি গুরাস’। আজ সারাদিনে আমরা মাত্র সাত কিলোমিটার হাঁটলাম কিন্তু পুরোটাই চড়াই। খানিকটা এগিয়ে বাঁ দিকে কিছুটা দূরে আমাদের হোটেল দেখা গেল। রাস্তা থেকে কিছুটা নেমে গিয়ে হোটেলের চত্বর। নাম ‘হোটেল পুন হিল’। দারুণ ভাল আর সুন্দর ব্যবস্থাসম্পন্ন হোটেল। সারা রাস্তায় এত ভাল হোটেল আমরা এর আগে পাইনি আর পাবো যে সেটাও কল্পনাতীত ছিল। হোটেলে ঢুকে মনটা আরও উৎফুল্ল হয়ে উঠল। মাঝখানে লবিতে গনগন করছে ফায়ার-প্লেস আর তার চারিধারে সবাই গোল হয়ে বসে কফি সহযোগে হাত পা সেঁকছে। আমাদের দলের সকলে ছাড়াও কয়েকজন সাহেব মেমও বসে আছে আগুনের ধারে। আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা কারণ ঘোরেপানির উচ্চতা ৯৫০০ ফুট। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার গরম কফি আর আলু ভাজা এলো আর চোখের পলক পড়তে না পড়তেই সকলে তৃপ্তির সঙ্গে সেগুলো উদরস্থ করল। বাইরে এখনও বেশ আলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর ধীরে ধীরে শরীরের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়ে গেল। ঠাণ্ডাতে হাতে পায়ে জল ঠেকাতে ইচ্ছে করল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাসুড়েরা যথারীতি তাদের ব্রিজের আড্ডায় বসে গেল। অন্য ঘরে ফোমের গদির ওপর বসে মহিলারাও গুলতানি শুরু করল। কেউ কেউ আবার সুযোগ বুঝে লেগে গেল তাদের চিরন্তন কাজে – অর্থাৎ কাপড় কাচতে। এই ফাঁকে আমি ডায়েরি আর গাইড ম্যাপ নিয়ে দেখতে বসলাম আমরা কতদূর এসে পৌঁছলাম, আরও কতটা পথ বাকি।

    রাত্রে ডিনারে বহু আশা করে যে মুর্গীর ঝোলটা খেলাম, তা এক কথায় অখাদ্য। তার ওপর দাম শুনে সকলে আরও মন মরা হয়ে গেল। দুটো মুর্গীর দাম ১৬০ টাকা। আহা, এই পয়সায় কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে তো লাঞ্চ হতই। যা হোক, খেয়ে দেয়ে সকলেই তাড়াতাড়ি লেপ মুড়ি দিতে চলে গেল। কিন্তু এত ভাল বিছানা পেয়েও হয়তো উচ্চতার জন্যই কারো ভাল করে ঘুম হল না। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে দেখি চতুর্দিক এতো চাঁদের আলোয় ভরে গেছে যে ভোর হয়েছে বলে ভুল হচ্ছে। আগামীকাল পূর্ণিমা। সেই আধো ঘুম আধো জাগরণে এই চাঁদের আলোর বন্যা যেন আরও অদ্ভুত লাগছিল। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, উমাপ্রসাদ বাবুর লেখা পড়ে একই ঘরে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগলের সঙ্গে রাত কাটাবার জন্য সকলেরই মনটা প্রস্তুত হয়ে ছিল। কিন্তু সত্যিই কালের চাকা বড় দ্রুতগতিতে ঘোরে। এই থ্রি স্টার হোটেলের ফোমের গদিতে শুয়ে মনে মনে প্রশ্ন জাগছিল, সত্যিই কি আমাদের মনের মধ্যে তীর্থযাত্রার মানসিকতা অবশিষ্ট আছে? আমরা কি নিছক ট্রেকার? না কি মুক্তিনাথ চলেছি পুণ্যের ঝুলি ভরতি করার লোভে? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন শেষ রাত্রে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম জানি না।

    ৮ই এপ্রিল, বৃহস্পতিবার

    আজ ভোরে উঠে সোয়া ছটা নাগাদ পুন হিলে ওঠার দারুণ অভিজ্ঞতা হল। ঘোরেপানির হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা সোজা উঠে গেছে পাহাড়ের গায়ে। রাস্তা খুব খাড়া – সকলে এমন ভাবে ধীরে ধীরে উঠছে মনে হচ্ছে যেন মাউন্টেনিয়ারিং-এর ট্রেনিং নিচ্ছে। হনুমান টুপি আর গ্লাভস পরেও প্রচণ্ড হাওয়ার বেগ রোধ করা যাচ্ছে না। পাহাড়ের মাথাটা নেড়া – সেখান থেকে বাঁ থেকে ডানদিক জুড়ে প্রায় ১৬০ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে সম্পূর্ণ হিমালয়ের রেঞ্জ দেখা যায়। পাহাড়ের মাথায় একটা নজর মিনার আছে, সেখানে টেলিস্কোপ দিয়ে নির্দিষ্ট চূড়াগুলো চেনা যায়। মনে আছে আমরা কৌশানি আর গোয়ালদাম থেকে হিমালয়ের বিভিন্ন বরফ চূড়া দেখে যারপরনাই উৎফুল্ল হয়েছিলাম। কিন্তু এর কাছে সেটা কিছুই নয়। যারা মুক্তিনাথ পর্যন্ত পুরোটা যায় না, তিন চার দিন ট্রেকিং করেই ফিরে যায়, তাদের পক্ষে এটাই স্বর্গ। আমাদের ক্ষেত্রে বিধাতা কিন্তু বিরূপ হলেন। একেবারে পাহাড়ের মাথায় উঠতে না উঠতেই কোথা থেকে এক রাশ মেঘ এসে সব কটা চূড়া ধীরে ধীরে ঢেকে দিল। আর বৃথা অপেক্ষা না করে আমরাও তাই অন্য রাস্তা দিয়ে অনেক শর্টকাট পথে দেউরালি নেমে এলাম। সোজা রাস্তায় ঘোরেপানি থেকে দেউরালি যেতে আধঘণ্টাও লাগে না। পুন হিলের প্রচণ্ড ঠাণ্ডা হাওয়ায় হাতপা একদম বেঁকে গিয়েছিল। এখানে হোটেলে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডাটা কাটল।

    দেউরালিতে রুটি আর আলুভাজা খেয়ে সোয়া দশটা নাগাদ আমরা আবার রওনা হলাম তাতোপানির উদ্দেশ্যে। তাতোপানি একেবারে কালীগণ্ডকী নদী বা থকখোলার উপত্যকায় অবস্থিত। জায়গাটার উচ্চতা মাত্র ৩৯০০ ফুট। ১০৫০০ ফুট থেকে ৩৯০০ ফুটের উতরাইও কম কষ্টের নয়। দেউরালি থেকে রাস্তাটা নামছে ধীরে ধীরে। প্রথম এক ঘণ্টা নামার রাস্তায় দু-ধারে শুধু রডোডেন্‌ড্রনের বন। যেদিকেই তাকাই মনে হয় যেন গাছগুলোয় আগুন লেগেছে। বড় বড় থোকা থোকা ফুলের রঙেরও কত বৈচিত্র্য – সেই সুন্দর দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, বেশ কিছুটাই কেবল মাত্র অনুভব করা যায়। একটু এগিয়ে গিয়ে বনের মধ্যে হঠাৎ কিছুটা জায়গা পরিষ্কার। ছোট্ট উপত্যকা যেন। সেখানে পাথর সাজিয়ে যাত্রীদের বিশ্রামের জায়গা। ওইখানে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে শুধু দু-চোখ ভরে দেখছি। রবিঠাকুর তো সব সময়, সব মেজাজের সঙ্গী আছেনই। একজন খুশ মেজাজে গান ধরল, “ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে”। তার সঙ্গে আরও অনেকে গলা মিলালো, “রঙে রঙে রঙ্গিল আকাশ - - -”। গানের ফোয়ারা ঝরতেই লাগল – “নীল দিগন্তে ওই ফুলের আগুন লাগলো”। সকলের মনে এত আনন্দ হচ্ছিল যে বাড়ির প্রিয়জনের কথা বার বার উঠে এলো – আহা সকলকে যদি ডেকে এনে দেখানো যেত তো কি ভালই না হত। মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে অনেক কষ্ট করে ফুল আর প্রকৃতির নিসর্গ শোভা দেখতে নন্দনকানন বা ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ারস গিয়েছিলাম। কিন্তু আজ যা আনন্দ পেলাম সেটা ওখানে পাইনি।

    আমরা এগিয়ে চলেছি। আস্তে আস্তে বনের গাছপালা পাতলা হয়ে আসতে লাগল। তারপর একটা বাঁক ঘুরতেই হঠাৎ ধবলগিরির বিশাল চূড়া সামনে পড়ল। বহু নিচে বিস্তীর্ণ উপত্যকা দেখা যাচ্ছে – পাহাড়ের কোলে ঘরবাড়িগুলো সব ছবির মত সাজানো। দেড় কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে প্রায় দু হাজার ফুটের বেশি নেমে পৌঁছলাম চিত্রে বলে একটা গ্রামে। উচ্চতা ৭৭০০ ফুট। রাস্তার ধারে ধাপে ধাপে ছোট ছোট যবের ক্ষেত – তার সবুজ গাছগুলো হাওয়ায় দুলছে ঠিক যেমন করে আমাদের বাংলাদেশে ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে তেমনি। কিছুক্ষণ আগে ফেলে আসা বনের পথের থেকে একটা বড় প্রাকৃতিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। একেবারে গ্রামের রাস্তা। একটা বড় ধসের রাস্তা পেরিয়ে ফালাটে (৭৫০০ ফুট) গ্রাম ছাড়িয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। ততক্ষণে পেটের মধ্যে ভস্মকীটরা জানান দিচ্ছে যে বহুক্ষণ হল ‘লাঞ্চ টাইম’ পেরিয়ে গেছে। লজেন্স, চকোলেট আর নাড়ু – যার ঝোলায় যা অবশিষ্ট ছিল, সব নিমেষের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। আরও প্রায় হাজার ফুট নামার পর আমরা শিখা গ্রামে (৬৬০০ ফুট) পৌঁছলাম। পাহাড়ের গায়ে অনেকখানি সমতলভূমি জুড়ে গ্রাম। এখানে দোতলা স্কুল-বাড়ি আর পোস্টঅফিস তো আছেই, এমনকি স্কুলের খোলা মাঠটা দেখলাম হেলিপ্যাডেরও কাজ করে। এখান থেকে নদীর উপত্যকা এখনোও অনেক নীচে।

    গ্রামে ঢোকার মুখে ‘বীণা লজে’ সকলে দুপুরের খাবার খাচ্ছে। মেনু একই – হাতে-গড়া মোটা মোটা বজরার রুটি আর আলুভাজা। সেগুলো কোনোরকমে গিলে এতটুকু বিশ্রাম না নিয়েই সঙ্গে সঙ্গে আবার পথ চলা শুরু হল। যেতে যেতে পুরো গ্রামটা চোখে পড়ল। অনেকগুলো পাকা বাড়ি পেরিয়ে গেলাম। এখানে পথ বেশ নেড়া, পাহাড়ের গায়ে তেমন বনজঙ্গল নেই। মাঝে মাঝে দুএকটা ধস নামার চিহ্ন। ঘণ্টাখানেক যাবার পর আরও একটা ছোট গ্রাম পড়ল, নাম ঘারা (৫,৮০০ ফুট)। এখান থেকে পেছন ফিরে দেখলে শিখা গ্রামটা মনে হয় একদম সামনে। যেন পাহাড়ের গায়ে সাজানো ছবি। আসলে পাহাড়টা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মত, এক মাথায় শিখা, অন্য মাথায় ঘারা। তাই শিখা থেকে দেখলে ঘারা গ্রামটা মনে হয় দশ মিনিটের রাস্তা, কিন্তু চলতে গেলে পথ আর ফুরায় না। একটু পরে রাস্তায় একটা চায়ের দোকান পড়ল, নাম ‘স্নো ট্রি লজ’। নামের বাহুল্য যাই হোক না কেন, এটা যে সত্যিই মরুভূমির মধ্যে মরুদ্যান তা ফেরার পথে খুব ভালো ভাবে টের পেয়েছিলাম। এই জায়গা থেকে যে উতরাই এবার শুরু হল তা এক কথায় মারাত্মক। বড় বড় পাথর দিয়ে সাজানো একদম খাড়া সিঁড়ি – তার এক একটা জায়গায় ধাপগুলো অন্তত দু ফুট সমান উঁচু। একেবারে খাড়াই নামা তাই প্রায় সকলেরই হাঁটুর সমস্যায় নামতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। নীচে নামছি তো নামছি, পথ আর শেষ হয় না। ডানদিকে বহু নীচে দেখা যাচ্ছে ঘারখোলা নদীর উপত্যকা। বিকেল হয়ে গেছে। সকলেই তাড়াতাড়ি করছে যাতে অন্ধকার হবার আগেই তাতোপানি পৌঁছানো যায়। কিন্তু রাস্তা আর শেষ হতে চায় না। পাতালে নামছি ক্রমাগত। মনে ভয় হচ্ছে ফেরার পথে এই চড়াইটা কি করে উঠবো। দলের একজন আমাদের লিডারকে বলে উঠল, “কি পাপ করেছিলাম যে আমাদের এখানে এনে এমন কষ্ট দিচ্ছ?” পাশ থেকে আর একজন বলে উঠল, “ফিরে গিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেব – পয়সা খরচ করিয়া কষ্ট পাইতে হইলে মুক্তিনাথ চলুন” – ইত্যাদি।

    কিছু দূর গিয়ে পথটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে, আমরা সকলে ওপরের পথটা ধরলাম। আমাদের দলের দুজন যারা সব সময় আগে চলে, তারা কিন্তু নীচের পথ ধরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্য ডুবে গেল। পথ আর শেষ হয় না। এবার পা ব্যথা শুরু হল। সকলেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত। অনিচ্ছুক ভাবেই পায়ের গতিবেগ কমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে দুপরে খাওয়া সেই বজরার রুটি পেটের মধ্যে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার যখন নেমে এলো তখন আমরা ঘারখোলা, আর কালীগণ্ডকীর এখনি শেষ হবে। আমাদের দলের যে দুজন নীচের রাস্তা দিয়ে আসছিল, তারাও এসে পৌঁছেছে। ওই রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার হয় বলে ওখানে জোঁকের উপদ্রব আছে। তা না হলে আমরা আর কোথাও জোঁক পাইনি। বর্ষার পরে এদের উপদ্রব বাড়ে। সামনেই দুটো রাস্তা যেখানে মিলেছে, সেখানে লোহার একটা বড় ঝোলা পুল। সেটা পেরোলে কয়েকটা বাড়ি আর চায়ের দোকান। একটা বাড়ির দাওয়ায় ধপ করে বসে পড়লাম। আর যেন পা চলছে না। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে সকলের মুখগুলো শুকনো হয়ে গেছে। সন্ধে সাতটা বেজে গেছে, তাই চারিদিক বেশ অন্ধকার। এমতাবস্থায় অলস শরীরটাকে আবার টেনে তুলতে হল। সামনে কালীগণ্ডকীর ওপর আরও একটা ঝোলা পুল। আজ প্রথম এই নদীটার সাথে সাক্ষাৎ হল। জলটা একদম মাটি-গোলা নোংরা, কিন্তু নদীতে প্রবল স্রোত। এখন থেকে এই নদীর পাড় ধরে সোজা উত্তর মুখে মুক্তিনাথের পথ। আবার এই নদীর পাড় ধরে আরও দক্ষিণে নেমে গেলে বাগলুং যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার মত কারও মনের অবস্থা নেই। কেউ কেউ ক্রমাগত তাদের পিতামাতাকে স্মরণ করতে করতে চলেছে। যারা মুখে কিছু বলছে না, তারা মনে করছে যে কথা বলতে গেলেও অনেকটা শক্তি ক্ষয় হবে। সেই শক্তি আসবে কোথা থেকে? কালীগণ্ডকী নদীর সৌন্দর্য প্রশংসা করার কথা তখন কারও মনেই আসে না। কষ্ট করে দ্বিতীয় ঝোলা পুল পেরিয়ে ভাবছি এখনই হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নেব। কিন্তু হোটেল আর আসে না। সকলেই ভাবছে এসে গেছি, মনটাও সেইমত প্রস্তুত, কিন্তু তবুও পথ শেষ হয় না। অনেক কষ্টে টর্চের আলোয় সাবধানে এগোতে এগোতে একটা বৈদ্যুতিক আলোযুক্ত বাড়ি দেখে মনে একটু আশার সঞ্চার হল। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনি, আসল তাতোপানি গ্রাম পৌঁছাতে আরও দশ পনের মিনিটের পথ বাকি। সকলের মনের তখন যে কি অবস্থা তা এখানে বলে বোঝানো মুস্কিল। আমাদের মেয়েদের তো স্বাভাবিকভাবেই ছেলেদের থেকে কষ্টসহিষ্ণুতা অনেক কম, আর এই অবস্থায় সব ছেলেদের মুখ দিয়েও প্রায় ফেনা উঠে গেছে। পা গুলোর ওপর শরীর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে – সেই দুটি তার নিজগুণে চলছে। এলোমেলো ভাবে যেখানে সেখানে পা ফেলে ধুঁকতে ধুঁকতে যখন অবশেষে হোটেলে পৌঁছলাম তখন রাত পৌনে আটটা। কিন্তু চারিদিকে ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ রব। ছোট্ট গ্রামের সব হোটেলে বিদেশী সাহেব মেম ঠাসা। তার মধ্যে আমরা ষোলোজন আর তিনজন কুলিকে কে জায়গা দেবে? সময় থাকলে ঘর খোঁজা যেত কিন্তু আমরা এতই পরিশ্রান্ত যে পারলে সবাই রাস্তায় শুয়ে পড়ি। তখন সাহেবরা নৈশ ভোজ সারছে। আমাদের দলে শেষে যারা ছিল, তারা যখন এসে পৌঁছল তখন রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। তাতোপানির উচ্চতা মাত্র ৩৯০০ ফুট। সেই আধমরা অবস্থায়, ছেলেরা এক জায়গায় কোনোরকমে উঠল আর আমরা বাকি মেয়েরা ‘নমস্তে লজ’-এর মেঝেতে বিছানা পাতা একটা ঘরে রাত কাটানো স্থির করলাম। কোনোরকমে রাতের খাওয়া সেরে সবাই রিলাক্সিল দিয়ে পা মালিশ করেই ঘুম।

    তাতোপানি নামটা শুনলেই বোঝা যায় যে কাছেই কোথাও নিশ্চয় উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। শুনলাম নদীর ধারে দু মিনিট হেঁটে গেলে সেই মাটি থেকে ওঠা গরম জল পাওয়া যাবে। আমাদের খুব ইচ্ছে করছিল একবার গিয়ে ওই গরম জলে পা ডুবিয়ে বসি, কিন্তু রাত হয়ে গেছে বলে সেই ইচ্ছা পূরণ হল না। ঠিক হল ফেরার পথে যেহেতু এখানে দুপুর থেকে বিশ্রাম নেবার কথা, তখনি যাওয়া যাবে। আজকে আমরা মোটামুটি কিলোমিটার দশেক হেঁটেছি কিন্তু এত কষ্ট আগে কখনো হয়নি।

    ৯ই এপ্রিল, শুক্রবার

    প্রায় সকাল সাতটা নাগাদ পুরি আর তরকারি খেয়ে তাতোপানি থেকে আবার যাত্রা শুরু। একটু এগিয়ে গিয়েই একটা পুলিশ চেকপোস্ট; এখানে আমাদের নাম রেজিস্ট্রি করতে হল। এরপর পাহাড়ি অঞ্চলের মত মামুলি রাস্তা পেরিয়ে কিছুক্ষণ পর একটা বড় গ্রামে পৌঁছলাম। নাম দানা (৪৭৬০ ফুট)। গ্রামে ঢোকার মুখে দেখা গেল ঝরনার জলকে একটা পাকা নালার মধ্যে দিয়ে এনে সেখানে একটা আটা চাকি বসানো হয়েছে। জলের বেগে তার কাঠের চাকাটা বেশ জোরে জোরে ঘুরছে। গ্রামে ঢোকার পর বোঝা গেল যে সেটা বেশ সমৃদ্ধ। অনেকগুলো বড় বড় বাড়ি। কয়েকটা বাড়ির সাথে লাগোয়া পাথরের পাঁচিল ঘেরা বড় বড় লেবুর বাগান। আমরা শুরু থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার মত হেঁটে এসেছি। এখন প্রচণ্ড রোদের তাপ। রীতিমত মাথা থেকে ঘাম ঝরছে। একটা বাড়ির বারান্দায় ছায়া পেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। ভেতর থেকে বাড়ির মালকিন মোটা একটা পিতলের গেলাসে করে ঝরনার ঠাণ্ডা জল এনে দিল। এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কালীগণ্ডকী নদীর ডান ধার দিয়ে আসছিলাম। দানা গ্রাম শেষ হবার পর একটা ঝোলা পুল পার হতে হল। তারপর থেকে নদীর বাঁ দিক দিয়ে রাস্তা। আবার পথের চড়াই শুরু হল। প্রায় কিলোমিটার খানেক যেতে না যেতেই আরও একটা গ্রাম পড়ল। ম্যাপ দেখে ভাবলাম আমরা বুঝি কাব্রে গ্রামে এসে গেলাম। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে শুনি এটাও দানা – আপার ধরমশালা আর লোয়ার ধরমশালার মত এখানেও আপার দানা আর লোয়ার দানা।

    গ্রাম পেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে একটা বিরাট জলপ্রপাত। নাম রূপসে ঝোরা। খানিকটা জল পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে বেশ কিছু ফুট সোজা শূন্য দিয়ে নামছে যেন। এখানে রাস্তার ধারে কয়েকটা ভুটিয়া ঘর আর চায়ের দোকান। কিন্তু বেশিক্ষণ এই শোভা উপভোগ করার সময় নেই। আজকে এখন পর্যন্ত তেমন কোন চড়াই পাইনি। কিন্তু তবুও প্রচণ্ড রোদে সকলেরই বেশ কাহিল অবস্থা। বেলা এগারোটা নাগাদ একটা ছোট অজানা গ্রামে পৌঁছলাম। মাত্র কয়েকটা ঘর। প্রদীপদার হুকুম, এখানেই মধ্যাহ্নভোজের বিরতি কারণ সামনে আবার বিরাট চড়াই আর তাই ইঞ্জিনে কয়লা না দিলে আরও বেশি কষ্ট হবে উঠতে। কাব্রে গ্রামে গেলে আরও কিলোমিটার খানেক পথ ঘুর হবে বলে এখানেই বিশ্রাম। ছায়ায় বসে ঝিমুনি আসছে। ভাত রান্না শুরু হল। ঘণ্টা খানেক পরে খাবার এলো – ভাত আর তার সাথে মাস কলাই দিয়ে অদ্ভুত সবুজ রঙের ডালের মত একটা পদার্থ। সুগৃহিণীরা ভাগ্যিস সঙ্গে মাখন এনেছিলেন, তাই তার সাহায্যে অন্তত কয়েক মুঠো গরম ভাত খাওয়া গেল।

    খেয়ে উঠে সঙ্গে সঙ্গে আবার রওনা। এদিককার পাহাড়গুলো আগের থেকে অনেক নেড়া। চারিদিকে কেমন একটা রুক্ষ ভাব। আগেকার মত বিস্তীর্ণ গ্রাম আর চাষের ক্ষেত নেই। একটুখানি রাস্তা নদীর বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে সামনের একটা পাহাড় পুরো চড়াই। দু পা করে হাঁটছি আর সামনের পাথরে বসে পড়ছি। চারিদিক নিস্তব্ধ, খালি এক ধরনের ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। এদের চোখে দেখা যায় না। আওয়াজটা এমন যে হঠাৎ শুনলে মনে হবে যে কেউ হয়ত একটা বড় মাছ ধরা ছিপের চাকা ঘোরাচ্ছে। এদেরকেই ইংরাজিতে বলে ক্রিকেট। প্রচণ্ড রোদ, ততোধিক চড়াই – সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। মিত্তিরদা বলে উঠলেন, “মুক্তিনাথজির কোন আক্কেল নেই। অত দূরে গিয়ে বসে থাকার কি দরকার ছিল? আমাদের জন্য তো একটু এগিয়ে এসে কাছাকাছি কোথাও থাকতে পারতেন। এর থেকে আমাদের কলকাতার গড়ের মাঠে পাতাল রেলের কল্যাণে যে পাহাড়গুলো হয়েছে তার ওপর কোয়ালিটি কোম্পানির সাথে চুক্তি করে ‘বাবা কোয়ালিটিশ্বর মহাদেব’ তৈরি করলেই হয়। তাদেরও টু পাইস হয়, আর আমাদেরও এত কষ্ট বাঁচে”।

    সকলেই আস্তে আস্তে চড়াই ভাঙছে, তাদের মধ্যে আমি সবার শেষে নিজের এই সাতাত্তর কেজি দেহটাকে কোনোমতে টেনে তুলছি। মাঝে মাঝে আবার খচ্চরের দলকে পাশ দেবার অছিলায় একটু বেশি সময় নিয়ে পাথরের ওপর নিরাপদ জায়গায় বিশ্রামও নিচ্ছি। কিছুক্ষণ এগোনোর পর আবার একটা ঝোলাপুল পড়ল। শুনলাম সেটা পার হবার পর ঘাসা গ্রাম আসবে। কিন্তু ব্রিজ পেরিয়ে আরও বেশ কিছুটা চড়াই ওঠার পরেও গ্রাম আর আসে না। আরও প্রায় কিলোমিটার খানেক গিয়ে গ্রামে ঢোকার মুখে পথের মাঝে কতগুলো বৌদ্ধ ধর্মস্তূপ বা চোরটেন চোখে পড়ল। সংস্কারের অভাবে ওগুলোর দশা খুবই জীর্ণ। কিছুক্ষণের মধ্যে কুলিরাও আমাদের ধরে ফেললো। অবশেষে প্রায় পাঁচটা নাগাদ ঘাসা পৌঁছলাম। উচ্চতা ৬৬০০ ফুট। গ্রামের শুরুতেই রাস্তার দু ধারে অনেক হোটেল। এখানে ‘হোটেল সামঝানা’য় আজকের মতো যাত্রার ইতি। হোটেলের ব্যবস্থা ভালই। নীচে একটা বড় রান্নাঘর আর খাবার জায়গা। তার পাশ দিয়ে পাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে দোতালায়। সেখানে সার দিয়ে কাঠের ছোট ছোট কেবিন। প্রতিটা কেবিনে দুটো করে খাট পাতা। হোটেল থেকে কিছুটা দূরে সাধারণের জন্য স্নানাগার। ঝরনার জলকে নালার মধ্যে দিয়ে এনে একটা বাঁধানো জায়গায় জমা করা হয়েছে। সেখানে একটা মুখ লাগিয়ে দিয়ে স্থায়ী কলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে সবাই মনের সুখে মুখ হাত ধুচ্ছে, স্নান করছে, আর পাঁচ দিনের পরা নোংরা জামাকাপড় কাচাকাচি করছে। এই সব পর্ব শেষ করে যে যার নিজের ইচ্ছে মত সময় কাটাতে লাগল। কেউ কেউ গরম ডিমের অমলেট বানিয়ে খাচ্ছে, কেউ বসে তাস খেলছে, আর আমি ডায়েরি নিয়ে বসেছি। এর মধ্যে কয়েকজন আবার বহুদিনের সঞ্চিত দাম্পত্য কলহও ঝালিয়ে নিতে লাগল। মান-অভিমান পর্বগুলো কেন যে এরা বাড়িতে জমা রেখে আসেনি বুঝি না। মাঝখান থেকে আমরা যারা একা এসেছি তাদের খুব অপ্রস্তুত হতে হল। সন্ধ্যাবেলা দেখলাম কয়েকজন এখানকার স্থানীয় ‘রাকশি’ এক কাপ করে পান করে আগামীকালের জন্য শরীরটাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি নৈশ ভোজ শেষ করে আটটার মধ্যে ঘুম।

    ১০ই এপ্রিল, শনিবার

    সকালে উঠে সব বাঁধাছাঁদা করে, চিঁড়ে বা রুটি আর তরকারি খেয়ে, বাকি সব নিয়মমাফিক কাজকর্ম করে যাত্রা শুরু করতে প্রায় সাতটা বেজে গেল। হোটেল সামঝানাকে বিদায় জানিয়ে আমরা চললাম লেতে অভিমুখে। কাল আমরা ধবলগিরি আর অন্নপূর্ণা পর্বতের যে খাতের মধ্যে দিয়ে এসেছিলাম, সেই দিকে পিছন ফিরে আর একবার তাদের বিদায় জানালাম। ঘাসা গ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা বড় প্রাকৃতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন চোখে পড়ল। এদিককার পাহাড়গুলোর গাছপালা অন্য রকম। বড় বড় পাইন গাছের বন দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিপাশার তীরে কুলু বা মানালিতে এসে গেছি। তা ছাড়া এখানকার আবহাওয়াও অনেক শুকনো। প্রকৃতি ছাড়াও আরও একটা তফাৎ চোখে পড়ে। সেটা হচ্ছে এখানকার গ্রামবাসীদের সাজপোশাক আর চেহারার মধ্যে কেমন যেন তিব্বতি ছাপ এসে পড়েছে। ঘাসাতে ঢোকার মুখে তো বৌদ্ধ চোরটেন চোখেই পড়েছিল। শুনলাম, নেপালিরা জাতে বেশিরভাগ হিন্দু হলেও, এখন থেকে এদের মধ্যে বৌদ্ধ আচার-ব্যবহার আর ধর্মনীতিরও চল আছে। দুই ধর্মের সুন্দর সমন্বয় লক্ষ্য করার মতো। এখান থেকেই প্রকৃত থাকালি গ্রামও শুরু। থাকালিরা নেপালি হলেও ভুটিয়া সম্প্রদায়ের। এদের পূর্বপুরুষরা এককালে তিব্বত থেকে এসেছিল। এই সব জায়গায় বসবাস করতে করতে এরাও নেপালি হয়ে গেছে। আরও শুনলাম যে এই পথে সমস্ত হোটেল আর ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে এই থাকালিরা।

    পথ চলা শুরু হতেই চড়াইও শুরু হয়। মাঝপথে একটা বেশ বড় ধসের জায়গা খুব সাবধানে পেরোনোর পর পথটা আবার নিম্নগামী হল। বেশ কয়েকটা পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা ঝোলাপুল পেরিয়ে তারপর একটা সমতল জায়গায় এলাম। এখানে একটা মাত্র চায়ের দোকান। জায়গাটার নাম লেতে। এটা লেতে গ্রামের একদম নিচের দিকে তাই লোয়ার লেতে বললেও ভুল হবে না। চা পানের বিরতির পর আরও এক দফা পাহাড়ে খাড়া চড়াই। চড়াই উঠতে উঠতে একটা দারুণ সুন্দর জিনিস দেখলাম। এখানে কালীগণ্ডকী নদীটা এমন ভাবে নেমেছে যেন কেউ ধাপে ধাপে সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছে। যেন হিন্দি সিনেমার সেট তৈরি, এখুনি নায়িকা ‘ঝনক ঝনক পায়েল বাজে’ গাইতে গাইতে নেমে আসবে। একটু বিজ্ঞানের মনোভাব নিয়ে দেখলে অবশ্য মনে হবে যে প্রকৃতি এখানে খুব সহজেই জলবিদ্যুত তৈরির ব্যবস্থা করে রেখেছে।

    চড়াইটা ওঠার পর কিছুটা পাইন বন পেরিয়ে পাহাড়ের ওপরে বিরাট একটা সমতল জায়গা। ঘাসা থেকে লেতে (৮৪০০ ফুট) প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা। লেতে বিরাট বড় গ্রাম, কিন্তু ঠিক যেন ঘুমন্ত পুরী। পথে ঘাটে কোথাও কোনও লোক দেখলাম না। একটা চায়ের দোকানও খোলা নেই। এখানে এসে মিত্তিরদার কাব্য আবার স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে জেগে উঠল --

    “পায়ে যদি থাকে বাত গেঁটে
    হেঁটে হেঁটে যাও তুমি লেতে
    সেরে যাবে এইটুকু খেটে”।

    লেতে পেরিয়ে একদম সমতল রাস্তা ধরে কিলোমিটার-খানেক দূরে আরও একটা গ্রাম, নাম কালোপানি। উচ্চতা সেই একই – ৮৪০০ ফুট। আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেলাম। বেলা তখন সাড়ে এগারোটা। কালোপানি জায়গাটার সৌন্দর্য তুলনাহীন। চারিদিকে উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় গোল করে ঘিরে আছে। তার নীচে, আমাদের সামনের পাহাড়গুলো ঘন পাইনবনে ঢাকা। এক জায়গায় দেখলাম কিছুটা জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেখানে একটা ছোট্ট সাইনবোর্ডে লেখা –“টুরিস্ট ক্যাম্পিং সাইট”। সঙ্গে তাঁবু আর অন্যান্য সরঞ্জাম থাকলে এখানে অনায়াসে থাকা যেত। আমরা যে হোটেলে ছিলাম তার পাশে একটা মাঠ। তার পাশে একটা জুনিয়ার স্কুল।

    অবশেষে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি। বেশ সুগন্ধি বাসমতী আতপ চালের ভাত খাওয়া হল। কালোপানি ছাড়ার সময় দেখলাম যে আকাশ হঠাৎ মেঘে ছেয়ে গেছে। একটু পরেই গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে লাগল। সবে একটা বাজে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন সন্ধ্যা হব হব। সকলেই দ্রুতবেগে পা চালাচ্ছ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। নদীর বুকের ওপর দিয়ে কিছুটা গিয়ে আবার পাড় ধরে চলা। ৮৫০০ ফুট উচ্চতায় এই রকম নদীর বিস্তার সত্যিই অকল্পনীয়। ভূগোল বইতে এইরকম নদীর এঁকে বেঁকে চক্রাকারে চলার ছবি দেখেছিলাম। মাঝে মাঝে পাথর আর বালি আর তার ফাঁকে ফাঁকে সরু সরু জলধারায় ভাগ হয়ে হয়ে নদী বয়ে চলেছে। পাহাড়ি নদী বলতে আমরা যা বুঝি, তার সাথে বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। মধ্যে মধ্যে যে চর পড়েছে সেগুলো দেখে অনেক আগে দেখা ফারাক্কার কাছে পদ্মা নদীর চড়ার কথা মনে পড়ে গেল।

    টিপ টিপ বৃষ্টি আর হু হু করা ঠাণ্ডা হাওয়ার মধ্যে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। একটু পরে আবার পাহাড়ের গায়ে একটা পাইনবনের মধ্যে দিয়ে চড়াই ভাঙতে হল। গায়ে উইন্ড-চিটার পরেও কিছু সুরাহা হয় না। মনে হয় ঠাণ্ডা বাতাস হুল ফোটাচ্ছে। কিছুটা গিয়েই আবার রাস্তা নেমে গেল নদীর পাড়ে। এইবার সামনে তাকিয়ে আমরা সবাই হতবাক। ধুধু মরুভূমির মত বিস্তীর্ণ নদীর বুক এমনই দীর্ঘ প্রসারিত যে এক পারে দাঁড়ালে অন্য পারের লোকজনদের পিপীলিকা বলে ভুল হতে পারে। এর পর বড় বড় পাথর আর বালির সেই চরের ওপর দিয়ে চলা শুরু হল। রাস্তায় কোথাও চড়াই উতরাই নেই, একেবারে সমতল। কিন্তু প্রচণ্ড হাওয়া আমদের পিছন থেকে এমন ধাক্কা মারছে যে কেউ তাড়াতাড়ি এগোতে পারছে না। এর ওপর ওই হাওয়ার সাথে মাঝে মাঝে বালি আর ছোট পাথরকুচি উড়ে এসে গায়ে তীরের মত বিঁধছে। সকলে লাইন দিয়ে চলেছে। আগের জনকে অনুসরণ করে পর পর সব চলছে ঠিক যেন মরুভূমির মধ্যে উটের সারি। এই প্রচণ্ড হাওয়া নাকি এখানকার বিশেষত্ব। প্রতিদিন বেলা দশটা বাজার সাথে সাথে এই বিশেষ হাওয়া ওঠে। দুদিকে এত উঁচু পাহাড় আর তার মধ্যে এইরকম ফাঁকা নদীগর্ভ হওয়ার দরুন ভৌগোলিক কারণে এই হাওয়া এখানকার পথ চলার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মাঝে মাঝে দূর থেকে ঘণ্টা দোলাতে দোলাতে খচ্চরের পাল আসছে। রাস্তার ওপর ওদের পায়ের ছাপ দেখে আমরা মোটামুটি এগোচ্ছি।


    মাঝে মাঝে সরু সরু জলের ধারাগুলো লাফ দিয়ে পার হতে হচ্ছে। একবার পেছন ফিরে দেখি ধবলগিরি, তুকুচে, আর নীলগিরি পাহাড়ের চূড়াগুলো এত কাছে যে মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই পাওয়া যাবে। সামনের লোকেরা অনেক এগিয়ে গেলেও তাদের ধরা যাচ্ছে না। পথও ফুরায় না। প্রায় দু কিলোমিটার এইরকম এক ভাবে নদীর বুকে হাঁটছি তো হাঁটছি। বাঁ-দিকে দু-তিনটে গ্রাম দেখা গেল – সোকুং, লারজুং, আর খোবাং। বর্ষাকালে নদীতে যখন অনেক বেশি জল থাকে, তখন এই বাঁ দিকের গ্রামের পথ দিয়ে যেতে হয়। এখন নদীর বুকের ওপর দিয়ে চলার দরুন প্রায় কিলোমিটার খানেক পথ কমলো। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক হল চলেছি – যেন অ্যারিজোনা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়েছি। মাঝে মাঝে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে এক একটা লোক যখন ঘোড়ায় চড়ে পেরিয়ে যাচ্ছে তখন সবার ‘লরেন্স অফ আরাবিয়া’ ছবির কথা মনে হচ্ছিল। চলতে চলতে নদীর বুকে দুটো ঝুপড়ি ঘর দেখা গেল। ঠিক যেন মরুভূমির মধ্যে মরূদ্যান। গরম কফি পান করে সবারই প্রাণ জুড়োবার চেষ্টা, কিন্তু বাতাসের প্রবল বেগে বাইরে আনা মাত্র সব উষ্ণতা শেষ। সকলে বাঁদুরে টুপিতে কান ঢেকে হাওয়া প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।


    এমন অবস্থায় আবার দ্বিতীয় দফা পথ চলা শুরু হল। একটু এগিয়ে দূরে একটা গ্রাম দেখা গেল। নাম তুকেচে। ওখান থেকে এগিয়ে গিয়ে পরের গ্রাম মারফায় আমাদের রাত্রের বিশ্রাম নেবার কথা। চলতে চলতে সকলের চোখ কিন্তু পায়ের দিকে। নদীর বুকে অজস্র সুন্দর পাথর। বেশির ভাগই কালো, তার গায়ে সাদা দাগ – ব্রাহ্মণের পৈতের মতো। এখান থেকেই নাকি আমাদের পুজো করার জন্য নারায়ণ শিলা সংগ্রহ করা হয়। একজন হঠাৎ বলে উঠল – “কত ব্রাহ্মণ মোক্ষলাভের আশায় এখানে মরে পড়ে আছে দেখ। এদের হিসাব কে রাখবে”। আমরা অনেকেই খুব সুন্দর দেখতে পাথর কুড়চ্ছি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে ওজনের জন্য সেগুলো কুলির পিঠে চাপানো চলবে না। নিজেদেরই বইতে হবে।


    আমরা সারাক্ষণ নদীর বাম তীর ধরে এগোচ্ছি। পথ যখন প্রায় শেষ হব হব, তখন বাঁ দিকে তুকুচে গ্রাম দেখা গেল। কিন্তু গ্রামটা দেখে মনে হচ্ছে যেন নিঝুম পুরী – কোথাও কোন জনমানবের চিহ্ন নেই। এবার নদী পার হতে গিয়েই বিপদ। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ার জন্য নদীতে জল আর স্রোত দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন উপায়? অনেক চেষ্টা করে অগত্যা কেডস জুতো হাতে নিয়ে খালি পায়ে কালীগণ্ডকীর জলে নামতে হল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বরফ গলা জল। জল হাঁটুর সমান, কিন্তু নিচে পাথরের ওপর খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। একটু বেসামাল হলেই পড়ে গিয়ে একদম চান করে যেতে হবে। প্রচণ্ড স্রোতে আস্তে আস্তে পার হয়ে শেষে কাঠের গুঁড়ি-ফেলা সাঁকোটা পেলাম। সেটা পার হয়ে যখন সকলে ওপারে পৌঁছলাম, তখন ঠাণ্ডায় দাঁতে দাঁতকপাটি লাগার জোগাড়। কুলিদের কাছে গরম জামাকাপড় প্রায় নেই বললেই হয়। তারাও কাঁপছে ঠক ঠক করে। ঠাণ্ডায় সবার হাতপা এমন জমে গেছে যে পায়ে আবার জুতোগুলো পরে নেবার ক্ষমতা নেই।


    গ্রামে ঢোকার মুখে বৌদ্ধ ধাঁচের একটা বড় তোরণ। তারপর সার দিয়ে বাঁধানো পাথরের পাঁচিল। তার একপাশে বৌদ্ধ চোরটেন। দেওয়ালের গায়ে সার দিয়ে যে ধর্মচক্রগুলো লাগানো আছে তা সংস্কারের অভাবে জীর্ণ। সারা গ্রাম যেন রূপকথার সেই ঘুমন্ত পুরী, সোনার কাঠির ছোঁয়ায় সবাই অচৈতন্য। গ্রামে ঢুকে একটা জিনিষ বিশেষভাবে চোখে পড়ল। আগেকার ফেলে আসা এতগুলো গ্রামের থেকে এটা একেবারে অন্য রকম। সব বাড়িগুলোই পাথরের তৈরি আর একটার সাথে অন্যটা জোড়া – ঠিক যেন একটা ছোটোখাটো দুর্গ বিশেষ। তার ওপর স্থাপত্যর দিক দিয়েও অনেক তফাৎ। এখানকার প্রতিটা বাড়ির ছাদ একদম সমতল। তার সাথে পাথরের দেওয়াল আর কাঠের নকশা করা জানালা আর বারান্দা। গ্রামের অনেক ভিতরে ঢুকে লোকজনের সাড়া পাওয়া গেল। শুনেছিলাম তুকুচে আগে তিব্বতের সাথে ব্যবসা ক্ষেত্রে একটা প্রধান কেন্দ্র ছিল। এখন অতীত গৌরব কিছুটা কমলেও পুরনো ঐতিহ্য এখনও বেশ কিছুটা বজায় আছে। গ্রামটা বেশ বড়, তাতে ডাকঘর, ফুটবল খেলার মাঠ, স্কুল, সবই আছে। বড় বড় অবস্থাপন্ন ব্যবসাদারদের বাড়িগুলো বেশ সুসজ্জিত।

    এরপর যথারীতি হোটেল খোঁজার পর্ব শুরু হল। হোটেলের থাকার ব্যবস্থা যেমনই হোক না কেন, নির্বাচনের প্রধান বিষয় হচ্ছে বাথরুম। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে অনেক খুঁজে অবশেষে একদম গ্রামের শেষ প্রান্তে ‘ইয়াক হোটেল’ নামে একটা নতুন হোটেল ঠিক হল। জায়গাটা ছোট হলেও মালিকের রুচিবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। বেশ শিল্পসুলভ ভাবে ভেতরের দালানে একটা ছোট্ট ফায়ার-প্লেসের ওপর একটা স্টাফ করা ইয়াক বা চমরী গাই-এর মাথা ঝোলানো। এছাড়া চারিদিকে বিভিন্ন রকমের তিব্বতি শিল্পবস্তু সাজানো। হোটেলের রান্নাঘরটা চিরাচরিত কিন্তু বাথরুমটা খুবই ভাল। কলে সব সময় জল পড়ে, তাছাড়া একটা বেসিনও আছে। হোটেলের মালিক থাকালি, অর্থাৎ নেপালি কিন্তু মূলত তিব্বতি। ওঁর চেহারা আর বেশভূষা দেখলে তিব্বতি বলেই ভুল হয়। হোটেলের ঠিক সামনে খোলা নদী-প্রান্তর আর তার পাশ দিয়ে রাস্তা। রাস্তার শেষ থেকেই যেন তুকুচে আর নীলগিরি পাহাড়ের চূড়া উঠেছে। মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই বরফগুলো ছোঁয়া যাবে। তার ওপর বৃষ্টির পর মেঘ-ভাঙা রোদ্দুরে আরও অদ্ভুত একটা প্রতিফলন হচ্ছে। একটু পিছন ফিরলে সৌন্দর্যের আরও একটা অন্য রূপ দেখা গেল। সেখানে ধবলগিরি পূর্ণ গৌরবে বিরাজ করছে। তুকুচের উচ্চতা মাত্র ৮৪৬৫ ফুট। যদিও সেটা দার্জিলিঙের চেয়েও বেশি, তবুও যেহেতু জায়গাটা অন্নপূর্ণা আর ধবলগিরির মধ্যে একটা বিস্তীর্ণ উপত্যকায় অবস্থিত, এটার এতটা উচ্চতা আছে বলে মনেই হয় না। নদীর বুকে গেলে বিভ্রমটা আরও বেড়ে যায় কারণ পাহাড়ি নদীর কোন চরিত্রই এখানে নেই। এ যেন সমুদ্রের মোহনার কাছাকাছি নদীর বিস্তার। তবে বৃষ্টিতে ভেজার দরুন আজ সকলেই যেন ঠাণ্ডায় বেশ কাবু হয়ে গেছে।

    সন্ধেবেলা এখানকার স্থানীয় খাবার চাখতে গিয়ে বেশ বিপদ হল। আমি বেশ ভোজন-রসিক মানুষ। রোজ রোজ রুটি আর আলুভাজা ভাল লাগে না। তাই হাতে লেখা মেনু কার্ডে নানারকম খাবারের নাম দেখে বেশ খুশি হলাম। কি সব গালভরা নাম – পাম্পকিন সূপ, টম্যাটো এগ ড্রপ সূপ, আপেল ফ্রিটার, তিবেতিয়ান মোমো, কোথে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি অর্ডার দিলাম এক প্লেট চম্পা পরিজ আর জ্যাম দেওয়া তিবেতিয়ান ব্রেড। চম্পা পরিজ খেতে গিয়ে প্রায় চোখের জল বেরিয়ে আসে। এ যে কেবলমাত্র এক বাটি আমাদের ঘরে তৈরি পাতলা আটার আঠা আর তার ওপর নামমাত্র দুধ ছড়ানো। তিবেতিয়ান ব্রেড শুনেছিলাম খুব সুস্বাদু। কিন্তু আমার সামনে যে জিনিষটা দিয়ে গেল সেটা কাঁচা আটার তৈরি হিন্দুস্তানি লিটটি গোছের। আমাদের গাইড কেবি ভরসা দিল যে এরা নাকি ঠিক বানাতে পারেনি, আসলে এটা অন্যরকম করে বানাতে হয়। পরে অবশ্য অন্য জায়গায় ভালো তিবেতিয়ান ব্রেড খেয়ে এর আসল স্বাদ বুঝেছিলাম। সেটা মোটামুটি পু্রি আর পাঁউরুটির সংমিশ্রণ। সন্ধেবেলা ঘরে লেপের নীচে ঢোকার আগে বাইরে বেরিয়ে আর একবার পাহাড়ের চূড়াগুলো দেখতে গেলাম। চারিদিকে অন্ধকার কিন্তু তারই মধ্যে সামনে তুকুচে আর নীলগিরি পাহাড়ের মাথায় বরফগুলো কেমন যেন একটা মায়াবী আবহাওয়া সৃষ্টি করেছে। মনে হয় কেউ যেন এখনই বস্তা বস্তা চুন ঢেলে দিয়েছে ওগুলোর ওপরে। বাড়ির লোকদের জন্য মন খারাপ লাগে। হায় রে, এমন সুন্দর দৃশ্য দেখতে পেল না। মুখে ব্যাখ্যা করলেও কখনও বোঝানো যাবে না।


    (এর পরে)



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখকের সৌজন্যে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments