• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • পুস্তক-সমালোচনা - অন্ধের স্পর্শের মতো : শান্তনু চক্রবর্তী


    অন্ধের স্পর্শের মতো শঙ্খ ঘোষ; প্রথম প্রকাশ: ২০০৮; গাংচিল - কলকাতা; পৃষ্ঠাঃ ৪৬

    "বেতার-সাংবাদিক প্রয়াত প্রণবেশ সেন স্মরণে বক্তৃতামালার সম্ভবতঃ প্রথম বক্তা ছিলেন শ্রীশঙ্খ ঘোষ; কবি, প্রাবন্ধিক বা সাহিত্যিক হিসেবে যাঁর পরিচয় প্রদান অপ্রয়োজন। বক্তৃতাটি জনানুরোধে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে, বর্তমানে দ্বিতীয় সংস্করণ লভ্য। আকারে ছোট, কিন্তু আকর-মূল্যে সমূহ সমৃদ্ধ! তবে প্রকাশ ও দ্বিতীয় মুদ্রণের সাত বছর পরে বইটিকে নিয়ে পর্যালোচনা সাহিত্যসমাজে সঙ্গত কিনা—এ সন্দেহ স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে সেই অনিবার্য পুরুষটিই ত্রাতা; কেন না তিনিই লিখে গেছেন "যখনই চিত্ত জেগেছে, শুনেছ বাণী/ এসেছে প্রভাত"। আবার গেয়েও গেছেন—"তোমায় নতুন করে পাবো বলে..."। সুতরাং এহ বাহ্য!

    শুধু কথা বলা নিয়ে, মনের ভাব প্রকাশ নিয়ে, ভাব-বিনিময় নিয়ে যে এমন একটি সন্দর্ভ হতে পারে, তা আমাদের মত সাধারণ পাঠকদের বোধহয় ভাবনার বাইরে ছিল। যদিও আমরা সবাই জানি যে "সহজ কথা যায় না বলা সহজে"! কিন্তু মাত্র ৪৬ পৃষ্ঠায় লেখক/বক্তা বিষয়টি নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন তা পাঠককূলকে ভাবায়! আর বোধহয় বইটির genesisও সেই পথেই! বর্তমান যুগে ভাবনা ব্যাপারটা যে দুর্লভ থেকে দুর্লভতর, কথা বলার শিল্প যে বিলুপ্তপ্রায়, সেই সমস্যাকেই গোড়া ধরে নাড়া দিয়েছেন এই স্বল্পবাক্‌ স্বল্পপ্রসূ চিন্তাবিদ্‌! আজ থেকে ২০/২২ বছর আগে যুগন্ধর গীতিকার ও সুরকার সুমন চট্টোপাধ্যায় কিম্বা আজকের বিতর্কিত রাজনীতিক কবীর সুমন ব্যক্তিগত পত্রালাপে একবার লিখেছিলেন 'কথা বলার লোক আর পাই না, বড় অভাব!' অথচ চারদিকে আজ তো শুধুই কথার বন্যা, কথার ঝড়, কথার পাহাড়!

    এই কথা বলা নিয়েই এই গ্রন্থের কথকতা!

    Gabriel Marquez-এর স্বল্প-খ্যাত একটি চটি-উপন্যাসের নাম 'Anatomy of a Death Foretold'—সেখানে বইটি শুরুই হচ্ছে একটি খুনের ঘটনা দিয়ে। খুনীর পরিচয়ও প্রথমেই প্রকাশিত। বাকি অধ্যায়গুলি জুড়ে নিপুণ বুনটে সেই খুনের বিচার বিশ্লেষণ! আর এই 'অন্ধের স্পর্শের মতো' গ্রন্থটিতে 'কথা বলা' নিয়ে সকল কথার পরে, একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় একটি নিরুপম ঘটনার বিবরণের থেকে তুলে নেওয়া বইটির নাম, যেখানে একটি পথ-নাটিকার অন্ধ কুশীলবেরা নাটক শেষে হাত বাড়িয়ে রাখেঃ শ্রোতা-দর্শকদের শুধু স্পর্শের লোভে। ভাষায় নয়, সেখানে ভাব-বিনিময় ঘটে ঐ স্পর্শের মাধ্যমে!

    বর্তমানে অতি জনপ্রিয় soft skill প্রশিক্ষণে communication একটি বিরাট স্তম্ভ। তার প্রশিক্ষণের শুরুতেই বলে রাখা হয় যে এর তিনটি অঙ্গঃ—বক্তা (যা/যিনি বলছেন), শ্রোতা (যা/যিনি শুনছেন), এবং মাধ্যম। অর্থাৎ কে বলছেন, কী বলছেন--তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ কাকে বলছেন এবং কেমন করে বলছেন! 'ভাতকাপড়ের ভাবনা'-খ্যাত এক আটপৌরে দার্শনিক, অরিন্দম চক্রবর্তীর কথায়—"ইতরজনে ভিতরটাকে দেখতে তো আর পায় না;/ ভদ্র জামায় মোড়া আমায় চেনায় ভাষার আয়না।" তবে গবেষণায় নাকি এও জানা গেছে যে এই ভাষা, বা বক্তব্য যদি শতকরা কুড়িভাগ নিয়ন্ত্রণ করে, আশি ভাগ নির্ভর করে নির্বাক ভাব-ভঙ্গি, বা non-verbal রকম-সকমের ওপরে। নিত্যদিনের অভিজ্ঞতায়ও আমরা সেরকমটাই তো দেখি! পাশ্চাত্য-সভ্যতার যে ধন্যবাদ-দান/Thank you মহামারি আমাদের সভ্যতাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, তাতে 'ধন্য' হবার বোধ অধিকাংশ সময়েই যে উদ্বায়ু হয়ে যায়, লেখক এই প্রসঙ্গ এনেছেন বইটির শেষাংশে, যেখানে 'কণিকা' কাব্যগ্রন্থের উদ্ধৃতিটি যারপরনাই প্রাসঙ্গিকঃ

    "দয়া বলে কে গো তুমি মুখে নাই কথা?
    অশ্রুভরা আঁখি বলে, আমি কৃতজ্ঞতা।"

    বহুকাল আগে কলকাতার এক ভিড়ে-ভিড়াক্কার বাসে নিজের বসার জায়গা ছেড়ে দিয়ে যে দৃষ্টি দেখেছিলাম অপরিচিত এক প্রৌঢ়ার চোখে। আজও চোখ বুজলে তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাই! কোনও মৌখিক ধন্যবাদের ধোঁয়া সেখানে ছিল না, বোধহয় তাই!

    বেশি কথার সঙ্গে সঙ্গে যেমন অনৃত ভাষণও জড়িয়ে থাকে ("সে কহে বিস্তর মিছা, যে কহে বিস্তর") এটা যেমন সত্য, তেমনি সত্য ১৮৮৩ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের 'চেঁচিয়ে বলা'; যেখানে আজ থেকে প্রায় দেড়শ' বছর আগে তিনি বলছেন বাঙালি সমাজ যত না চলে, তার থেকে বেশি শব্দ করে, কেন না "কানটাই আমাদের এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হইয়াছে"। খবরের কাগজগুলোও যে যে-কোনও একটা খবর নিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে, ভালো করে শোনা বা বোঝার আগেই, এই প্রবণতা কি আজও পাল্টেছে? এর জাজ্বল্যমান সমান্তরাল প্রমাণ সম্ভবতঃ দূরদর্শনের পর্দায় তথাকথিত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের (বা আরো ভাল বলা 'প্রবক্তা'দের) আলোচনা-চক্রগুলো। বক্তব্যের সারবত্তা, তথ্য-নির্ভরতা, পরিসংখ্যান, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা সেখানে লজ্জায় মুখ লুকোয়, চোখমুখের শিরা ফুলিয়ে যে জাতীয় মত-বিনিময় এইসব চক্রে প্রায়শঃই হয়ে থাকে, তাতে আবারও তাঁকেই মনে করতে হয়ঃ "বিষয়টা যত কম বোঝা যায়, বোধ করি, ততই হো হো করিয়া চেঁচাইবার সুবিধা হয়।"

    অথচ নীরবতারও যে এক গভীর ভাষা আছে, যা অনেক সময়ই উচ্চারিত ভাষার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী, তা কি আমাদের অজানা? সৈয়দ মুজতবা আলীর গ্রামের স্কুলের পণ্ডিতমশাইকে নিয়ে লেখা সেই অবিস্মরণীয় গল্পের শেষ লাইন ভুলি কি করে, যেখানে তাঁর মর্মভেদী এক প্রশ্নে সমস্ত ক্লাস প্রস্তরীভূত হয়ে যায়! আর লেখক লেখেন—"Silence is golden একথাটা যে বলেছিল, মৃত্যুর আগে তাকে যেন একবার সামনাসামনি পাই"।

    এরকম তীক্ষ্ণভাবে নয়, অনেক স্নিগ্ধ স্বরে উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের 'কণিকা'র কবিতা "ফুলগুলি যেন কথা।/ পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার পুঞ্জিত নীরবতা।" পাতার নীরবতা যেমন ফুলের শোভা বর্ধন করে, তেমনই ভাষণে, বচনে-বাচনে, অধ্যাপনায় নীরবতার যথাযথ ব্যবহার বক্তব্যের সারবত্তাকেই গভীরতর করে। প্রয়োজন মাত্রাবোধের। প্রসঙ্গত, শ্রীঘোষ স্মরণ করেছেন তাঁর দর্শনের অধ্যাপক প্রয়াত গোপীনাথ ভট্টাচার্যের কথা; তাঁর আচার-আচরণ, পড়ানোর ভঙ্গিমা, সর্বোপরি সুসমাহিত তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা। যাঁর জ্ঞানের গভীরতা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছিল ঐ মাত্রাবোধের মাধ্যমে--"স্বরের, বাচনের এবং নীরবতার"। সৌভাগ্যক্রমে পারিবারিক সূত্রে এই প্রবাদপ্রতিম জ্ঞানতপস্বীকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। নির্লোভ, অনুচ্চাশী, স্বল্পবাক্‌ এই মানুষটির ব্যক্তিত্বের ছটা কৈশোরে সহ্য করতে পেরেছিলাম, এখন হয়ত পারতাম না!

    অধ্যাপক ভট্টাচার্যের পাশাপাশি লেখক আরো একটি উদাহরণ দিয়েছেন, তবে চেনা জগৎ থেকে নয়, রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকেঃ 'ঘরে বাইরে'র চন্দ্রনাথবাবু। 'তুল্যনিন্দার্স্তুতির্মৌনী' এই অধ্যাপকের সার্থক ছাত্র নিখিলেশ, যার ব্যক্তিত্বের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে উগ্র, উত্তেজিত ও উচ্চারিত সন্দীপ। প্রাসঙ্গিক কিছু উদ্ধৃতিসহ এই বৈপরীত্যের সংক্ষিপ্ত আলোচনাটি এই গ্রন্থের একটি সম্পদ। এবং অবশ্যই গভীরভাবে বিষয়ানুগ।

    যে তর্ক সন্দীপের সঙ্গে নিখিলেশের, দর্শনের ক্লাসে গোপীনাথবাবুর উৎসাহিত তর্কের থেকে তার ভাষা-ভঙ্গি পৃথক। কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা ছিল ছাত্রেরা "যাতে নিজেরাই বিচারবোধের জাগরণে যথার্থ একটা লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে"। একে শ্রীঘোষ বলেছেন 'তর্ক-সৌন্দর্য'; আর ২০১৪/জুলাইয়ের 'বইয়ের দেশ'-এ এক দার্শনিক এক সাক্ষাৎকারে এই একই তর্কের জয়গান গেয়ে বলেছিলেন এই তর্ক মানে ঝগড়া নয়, এই তর্ক আমাদের ভাবতে শেখায়, চিন্তাকে শাণিত করে; আর তাই আমাদের উচিত সদা-স+তর্ক থাকা! শঙ্খবাবুও আবু সৈয়দের কথা উদ্ধৃত করে পরিচিত প্রমাদের পথ থেকে পাঠককে সরিয়ে এনেছেন, কেননা এ-জাতীয় তর্কে কোনও জয়-পরাজয় থাকে না।

    (কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিক হলেও 'তর্কণীয়' শব্দটি সম্পর্কে আমার কেন জানি ব্যাকরণগত অ্যালার্জি হচ্ছেঃ বরণীয়, সহনীয়, নমনীয় এ সমস্ত শব্দই ধাতুর উত্তরে অনীয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে। 'তর্কণীয়' কি সেই দলে পড়ে?)

    এখান থেকে যদি ফিরে যাই প্রাথমিক সেই আলোচনার স্তরে, যেখানে বলেছি বক্তা, শ্রোতা এবং মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে যোগাযোগের যথার্থতা, সেখানে বক্তার মানসিক গঠন এবং শ্রোতার (বা পাঠকের) আপেক্ষিক সামাজিক বা বৌদ্ধিক অবস্থানও নির্ধারণ করে দেয় সংযোগের সাফল্য। উলঙ্গ রাজাকে উলঙ্গ বলে চিহ্নিত করেছিল অবোধ একটি শিশু, আর দুই বিখ্যাত কবির আকাশবাণীতে প্রচারিত কথিকাকে দুর্বোধ্য বলে অভিহিত করেছিলেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মা—"তোমাদের কারো কথাই যে বুঝতে পারে না কেউ"! এই প্রসঙ্গ নিয়ে বলতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন এই দুর্বোধ্যতা কি স্বতঃস্ফূর্ত, না নিজেদের জ্ঞানবত্তাকে শ্রোতাদের কাছে প্রচার-প্রকাশ করার এক ছদ্মবেশী প্রয়াস? এই প্রবণতারই কি প্রকট পরিচয় পাই না 'গল্পসল্পে'র বাচস্পতি মশাই-এর কথাবার্তায়ঃ
    "সম্মম্‌মরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যন্ত পর্যূগাসন উথ্রংসিত—" ইত্যাদি ইত্যাদি, যেখানে কথাটার মানে না জানা থাকুক, কথাটা 'শোনাচ্ছে ভালো'। অথচ ভাষার সরলতা মানেই যে তরলতা নয়, এ'কথা শঙ্খ ঘোষের চেয়ে ভালো আর কে বোঝাতে পারেন?

    এর বিপরীতে, সম্পূর্ণ বিপরীতে মনে পড়ে একটি সাক্ষাৎকারের কথা, যেখানে প্রয়াত দুই সাধক-সাধিকা (মা আনন্দময়ী এবং শ্রীশ্রী সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ) সামনাসামনি বসে উত্তরকাশীতে কিছু সময় কাটিয়েছিলেন সম্পূর্ণ নীরবতায়; অথচ পরে শুনেছি তাঁদের 'কথা' হয়েছিল অনেকই!

    এই লেখা শেষ করার আগে এই বইয়ের আরেকটি উজ্জ্বল প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে পারছি না। 'আমি' এবং 'আমরা' উত্তমপুরুষের এক ও বহুবচন আমরা সবাই জানি এবং বেশিরকম জানি। কিন্তু গৌরব ছাড়াও যে বহুবচন ব্যবহৃত হয়, আর সে ব্যবহার সাহিত্যিককে, কবিকে, এমন কি চিকিৎসককেও যে আরও গ্রহণীয় করে তোলে তার আলোচনা এ বইয়ে হৃদয়গ্রাহী। আবার 'আমরা'কে 'আমি' করে নেওয়ার প্রবণতা, তা সে নেতৃবর্গের হোক্‌, কিম্বা অফিসের বরিষ্ঠ পদাধিকারীর, তারও বিপদ যে কতটা, আলোচনাতে সে প্রসঙ্গও এসেছে। এবং আবার সেই চক্রবর্তীর কবিতাকে নিবারণ করা যাচ্ছে নাঃ

    "        ...কোথায় আমি গৃহস্বামী?
                            ঘরের ভেতর কামরা।
    তার ভিতরে চোর-কুঠুরিঃ পরত পরত চামড়া!
    ত্যাগ-বিরাগের মলাট মোড়া মুখচোরা প্রেমকামরা।
    থামিয়ে কোদাল, 'আমি' খোঁজার ঠনাৎ করে আমরা।"

    বইটির প্রাক্‌-কথনে প্রণবেশ সেন স্মারক সমিতির পক্ষ থেকে লেখা ভূমিকাটি সুন্দর। প্রচ্ছদ এবং হরফ-বিন্যাস আকর্ষণীয়। বিশেষ করে প্রচ্ছদে মাত্রা-বর্জিত বইএর নামটিতে সামান্য একটু রঙের গাঢ়ত্বের হেরফেরে যে একটা ত্রিমাত্রিক আভাস এসেছে, তা নজর কাড়ে। বইটি পড়বার মত এবং পড়াবার মত।

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments