দিদুন বাড়ি এসেই মিঠি ছটফট শুরু করে দিয়েছে, কখন ও ছাদে উঠবে? মা দিদুনের সঙ্গে একটু কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। দিদুনও খালি বলছে, 'ওরে সোনা একটু বস। দুটো কথা বলি। তোর জন্য পনির বল দিয়ে কোপ্তা, আর ডিম পোস্ত করে রেখেছি। সে সব একটু চেখে দেখ। তারপর নয় ছাদে যাবি।'...
না দিদুন, আমি আগে ছাদে যাব। চলো না দিদুন, ছাদে যাই। মিঠি বায়না জুড়ে দিল বেজায়।
মিঠি এবার দিদুন বাড়ি এসেছে শুধুমাত্র দাদুর কীর্তি দেখবে বলেই। দাদু বাড়ির ছাদে দারুণ এক রুফ গার্ডেন করেছে। সেই বাগানে অনেক শাক, সবজি, ফুল, ফল সব হয়েছে। বাগানে নাকি রোজ অনেক পাখি আসে। কিচিরমিচির করে। শিস্ দিয়ে ডাকে। গান শোনায়। পাকা ফল, ফুলের মধু খেয়ে যায়। দাদু আবার বলছে, ছাদে এবার ধানচাষ করবে। ধান গাছ বসাবে। বিদেশে নাকি এভাবে বাড়ির ছাদে অনেক মানুষ কিচেন গার্ডেন বানায়, চাষ করে। দাদু সেসব খবর বই পড়ে, ইন্টারনেট থেকে জেনেছে।
মিঠি দাদুর সেই রুফগার্ডেন দেখার জন্য ছটফট করছে। চিলেকোঠার ঘর পেরিয়েই দিদুনদের মস্ত ছাদ। এত বড় ছাদ যে মিঠি এক দৌড়ে শেষ করতে পারবে না! সেই ছাদে এসে মিঠি তো অবাক। দাদু করেছে কি! মনে হচ্ছে যেন সত্যিকারের কোনও থিমপুজোর বাগান।
ছাদে মাটি ফেলে, সার, জল দিয়ে বিরাট এক বাগান বানিয়েছে দাদু। সেখানে পালংশাক, ধনেপাতা, কাঁচালংকা, সব হয়েছে। ক্যাপসিকাম গাছে ফুল এসেছে। লেবু গাছ ভরে আছে লেবুতে। বড় বড় টবের মাটিতে ডালপালা মেলে দুলছে কলমের আমগাছ, পেয়ারাগাছ। আর বাগানের এককোনায় অনেকটা জায়গা জুড়ে বসানো রয়েছে এক মস্ত মাটির গামলা। গামলায় স্বচ্ছ - পরিষ্কার জল। টলটল করছে সেই জল। হাওয়ায় হাওয়ায় ঢেউ খেলছে।
— দিদুন, গামলায় এত জল কেন?
— জল কেন? দিদুন মুখ টিপে একটু হেসে নিয়ে বলল, তোমার দাদু ওটা পাখিদের জন্য রেখেছে।
— পাখিরা কি করে?
— জানো তো দিদিভাই, আমাদের এখানে এখন আর কোনও পুকুর নেই। আগে অনেক পুকুর দিল। ছোট ছোট ডোবা ছিল। সেগুলো সব হয় শুকিয়ে গেছে, নয়তো প্রোমোটাররা মাটি ফেলে ভরাট করে ফ্ল্যাট তুলে দিয়েছে। তাই পাখিদের আর জল খাওয়া হয় না। জল খেতে এখন ওদের বড় কষ্ট। ওরা দুপুর রোদে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একটু জলের জন্য ছটফট করে। শুকনো গলায় চিঁ চিঁ করে ডাকে। দাদু তাই ওদের খাওয়ার জন্য গামলায় ভরে এই জল রেখে দিয়েছে।
— তাই! মিঠি আনন্দে হেসে উঠে বলল, কি মজা! পাখিরা রোজ জল খেতে আসে?
— আসে তো। রোজ আসে। আর তোর দাদুও গামলার জল রোজ পালটে দেয়। টলটলে ফর্সা জলে পাখিরা মনের সুখে চানও করে। ডানা ঝাপটিয়ে জলখেলা করে। তখন খুব কিচিরমিচির হয়। সে রকম বাড়িটা একদম অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয় যেন পাখিদের কিন্ডারগার্ডেন স্কুল বসেছে ছাদে।
— দিদুন, তোমাদের ছাদে কি কি পাখি আসে? মিঠির খুব আগ্রহ।
— টুনটুনি, চড়াই, বুলবুলি, লেজ ঝোলা ফিঙে, শালিক, বেনেবউ, কোকিল আরও কত সব পাখিরা আসে।
— তুমি সব পাখিদের চেনো?
— আগে তো চিনতাম না। এখন চিনতে পারি। তোর দাদুই তো আমাকে চিনিয়ে দিয়েছে।
— দিদুন, পাখিদের তো তাহলে দাদুকে থ্যাঙ্ক ইউ বলা উচিত! ওরা বলেছে?
— হা-হা-হা। দিদুন খুব হাসল একথা শুনে। তারপর মিঠির গালে আলতো করে একটা আদুরে চিমটি কেটে বলল, নারে বলে নি। ওরা সব দুষ্টু পাখি!...
— তাই বুঝি!
এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে চারটে পাখি উড়ে এসে ছাদে বসল। এদিক ওদিক চাইল। কি সুন্দর শিস দিল। তারপর উড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের গামলায়। ঠোঁট ডুবিয়ে ডুবিয়ে জল খেল। ডানা ঝাপটিয়ে খুব জলখেলা করল। আর শুরু করে দিল খুব কিচিরমিচির। ওমা, আরও দুটো পাখি কোথা থেকে যেন উড়ে চলে এল। দিদুন, দ্যাখো দ্যাখো ওই পাখিটার ডানাটা কি সুন্দর!
— সত্যিই তো কি সুন্দর ডানা দুটো পাখিটার।
— এই পাখিটার নাম তুমি কি জানো দাদুন?
— নারে সোনা, তোর দাদু নিশ্চয়ই জানে।
পাখি গুলো দলবেঁধে কি সুখেই না গামলার জলে খেলছে। কিচিরমিচির করছে। মিঠির খুব মজা লাগে। হাসি পায়। আনন্দে হাসতে হাসতে বলে, দিদুন তোমাদের পাখিপুকুরটা খুব সুন্দর!...
— কি বললি সোনা? আবার বল....
— তোমাদের পাখিপুকুরটা খুব সুন্দর।
— ওরে তোর দাদু আসুক, দাদুকে বলছি, কি সুন্দর একটা নাম দিলি তুই এই জলভর্তি গামলাটার—পাখিপুকুর!
দিদুন খুশিতে-হাসিতে মিঠিকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এমন সময় আবার শুরু হয়ে যায় পাখিদের কলকাকলি। এবার যেন আরও বেশি। দিদুন, মিঠি অবাক হয়ে দেখে, একটা বড় পাখি ওর ছোট্ট ছানাকে কোলে করে গামলার জলের কাছে এনে মুখে জল তুলে দিচ্ছে। অন্য পাখিরা সব গোল হয়ে ঘিরে রয়েছে মা পাখিটাকে। মা পাখি মনের সুখে জল খাওয়াচ্ছে তার ছোট্ট ছানাকে। ছানাটা কি মিষ্টি! কি কিউট!
মিঠি এবার আনন্দে লাফিয়ে উঠে দিদুনকে বলে, দিদুন, দিদুন তুমি মামাকে ডাকো। এক্ষুনি ডাকো। ক্যামেরাটা নিয়ে আসতে বল। এই ছবিটা মামা তুলে দিক, আমি আমার সব বন্ধুদের দেখাব, ওদের সবাইকে বলব, বাবা আমাদের ছাদেও তুমি একটা বাগান কর। ঠিক এমন একটা পাখিপুকুর করে দাও আমাকে! পাখিপুকুর আমার চাই!