|| ১ ||
আসলে শতদ্রু কোন স্বপ্নই দেখেনি কখনো। মেয়ে বেশে না, মা-বেশেও না। তার নিবিড় ঘুমের তারজাল ছিঁড়ে কোন স্বপ্নের বিদ্যুৎপ্রভাই স্মৃতিতে ভাসতো না শেষ পর্যন্ত। সে কেমন স্বপ্ন-ছাড়া অঙ্ক-ভালো-লাগা এক অদ্ভুত নামের মেয়ে হয়েই একদিন বিবাহিত হয়ে যায়। জ্যাঠামশাইয়ের দেওয়া তার শতদ্রু নামের মতোই, ঈষৎ টাকপড়া, কোমল অথচ স্নিগ্ধ কাঠিন্যময় মানুষটির আদরও তার কাছে প্রাপ্য, বিস্বাদ ঠেকতো। এভাবেই বড় মেয়েটার হামাগুড়ি ও পাঁশুটে গন্ধের বিছানায় বসে তার মনে হঠাৎ স্বপ্ন আসে। ঘরময় দেওয়ালে ঝোলানো বো, হাতকাটা কালো কোট, কুচি দেওয়া গাউন। সে যদি উকিল হতো জ্যাঠামশাই-এর মতো!
|| ২ ||
গাছ থেকে যেমন ফুল পড়ে, তেমনি মায়ের ফুল থেকে খসে পড়েছে এই ছেলে।
বড় মেয়েটা তখনো মুতের কাঁথা ছাড়েনি। বড় মিডিওকার মেয়েটির পর এই তো শীর্ণ ছেলেটি এল শতদ্রুর কোলে। তার উকিল হতে চাওয়া অন্তঃকরণ যা ঘরের কোণে ভাতের হাঁড়ি, ঠাণ্ডা বিছানা বা স্বামীর প্রিয় উচ্ছেভাজা করতে করতে দমে গেছিল, সেও একদিন উদ্দীপনার সঙ্গে বলে, ছেলের নাক মুখ, বুদ্ধি আমার মনের মতো!
নিটোল খুদে হাত-দুটো নিজের হাতে নিয়ে মাথার গন্ধ শুঁকে নেয় মা! বড় মেয়েটা যেমন বাপ-ঘেঁষা তেমনি ভাবে-ভোলা। অঙ্কে মাথা গোল, ওর সঙ্গে যে-সখ্য তৈরি হয়নি সেই সখীভাব এই শ্যামসন্তানে যেন যত্নে স্থাপন করে সে।
|| ৩ ||
ছোট্ট ময়ূরের মত বাড়িময় ঘোরে ছেলেটা। কোমরের মোটা বিছে, পায়ের মলসহ ওর হাসির পুচ্ছটি যেন বাড়ি মাত করে রাখে। যখন তখন নাচ আর হাসি বাড়ির কাজের মানুষ বেলুদি সহ বাবা মা দিদি সবাইকে ফুল্ল করে তোলে। রুটি তরকারি বানাতে বানাতে মা বোঝে শিশুর খুশিটুকু জানতে দ্বিতীয় সন্তান কত জরুরী। বড়টির সময় থতমত ভাব কাটতে না কাটতেই মেয়ে পাঁচবছর, দম্পতিও পাঁচ বছর মৃত্যুর দিকে। যদিও নতুন সন্তানের সহস্র সমস্যা তাকে ক্রমসংকুচিত করছিল রোজ, তবু বড় মেয়েটার পর এই ছেলেটিকেই ঘিরে যেন তৈরি হতে থাকে শতদ্রুর স্বপ্নের ঘরবসত। কালো কোটের সমরাস্ত্র পরে সে অথবা তার ছেলে, ছেলে অথবা তার আত্মা যেন উকিলস্য উকিল হয়ে গুমগুম ডাকে।
বড় মেয়ের জন্য যা-সব নিষেধ ছিল, সে-সব নিষেধহীন করতে দিতে এ ছেলের ক্ষেত্রে বারণ ছিল না মায়ের। এমনকি ছেলে কাচের গ্লাস ভেঙে দিলেও বড় মেয়েকে ওটা অ-স্থানে রাখবার জন্য বকাবকি করে নিজের মন খারাপ হলেও নয়। এবারে সে বেশ হিসেবী। খুব বেশি ছড়ায় ছড়াক্কার করে ছেলের স্মৃতির বাক্স ভরে দিতে সে নারাজ। উল্টে মা শতদ্রু যেন বালিকা শতদ্রু হয়ে বাছাই কিছু সুর নির্ভার তুলে দিতে চায় তার কানে। ছেলেটা যদিও জন্মেই মায়ের চশমা দেখল চোখ নয়, তবু সেইমতো সুরের মধ্য দিয়ে এক শুদ্ধ অন্তঃবেদনা তার মধ্যে ছাইতে চাইল মা। ছেলে কতটা নিল কে জানে!
|| ৪ ||
বড় মেয়েটা অঙ্কে গোল্লা। ছেলেকে অঙ্ক শেখাতে গিয়ে মা দেখে খুব দ্রুত বুদ্ধির গলিপথে হাঁটে ছেলেটা। সে অঙ্কের প্যাঁচ খুলতে পারে, ইংরেজির টেনসে্ অপ্রতিরোধ্য, সামান্য পড়াতেই এসে যায় মনঃসংযোগ। শতদ্রুর উকিল হতে না পারা এবং মাঝপথে বিয়ের ধকল সইয়ে নেওয়া মাথাটা বেশ চনমনে হয়ে যায়। প্রাণের সমস্ত উপকরণ ঢেলে সে ছেলেকে পড়াতে থাকে। ফল যেন তৈরিই ছিল, প্রথম হতে থাকে ছেলেটা। লতানে গাছের সরু সরু ডালপালার মতো মায়ের আহ্লাদ যেন মাটির কোল ঘেঁষে দৌড়তে চায়। রিনরিন করে আকশের তারারা নেমে আসে তাদের বিছানায়। মা বাবাকে সহ খুঁড়ে তুলতে চায় বিস্ময়। বাবা তার কৈশোরের দুরন্তপনার গল্প করেন, মা বলে তার জ্যাঠামশাই-এর কাহিনি, যিনি তাকে উকিল হবার ইচ্ছেটুকু উপহার দেন না জেনে।
|| ৫ ||
ছেলের জন্য হারমোনিয়াম কেনা হয়। আর পাড়ার মৃদুল-মাস্টার। গানের মাস্টারদের টেরি থাকবেই, সঙ্গে সেন্টের গন্ধ। ক্রমেই চুল ফাঁকা হয়ে যাওয়া স্বামীর দিকে তাকিয়ে মায়ের যেমন শীত করত, সাদা পাঞ্জাবী, ঝাঁকড়া চুল, ঝলক সুবাতাস আর মৃদুলবাবুর সাইকেলের রিংটিং তাকে বেশ উদ্দীপ্ত করত। অথচ চা দেওয়া ছাড়া মৃদুলমাস্টারের মেয়েভুলানি কারসাজিতে মোটেই সামিল হত না শতদ্রু। বরঞ্চ মফঃস্বলে হেজে যাওয়া এই গানের প্রতিভাটিকে খুব ন্যায্য সম্মান দিতে চাইত সে। আশ্চর্যভাবে ছেলে মৃদুলবাবুকেও গর্বিত করে দিচ্ছিল রোজ রোজ। তান, সরগম, খেয়ালে দেখাচ্ছিল এক অনুপম অগ্রগতি। বস্তুত এক জলসায় ছেলের গাওয়া গানের শেষে শ্রোতাদের বিপুল হর্ষ ও অভিনন্দন ভিজিয়ে দিল মায়ের চোখের পাতা। যে শব্দহীন প্রেমিক তার বুকে ঘুমিয়ে আছে বহুদিন সে কি তার কালো সন্তানের রূপে জাগাতে এলো!
সাকির শরাবের পিয়ালির পরেছেলেটা গাইছিল।
যেন তার পিয়ার সমাধির পরে
তরুণ ইরাণ কবি কাঁদে নিরজনে
ঝরা বন গোলাপের বিলাপ শুনে
|| ৬ ||
ছেলের অষ্টম শ্রেণী। সময় এ-সংসারে কেমন কুবাতাস বয়ে আনে। দুই সন্তানের ধকলে মা অতি
অসুস্থ হয়ে পড়ে। বড় মেয়ে রান্নাবান্না কিছু শিখেছে। চালিয়ে দেয়। অথচ তার শরীরটি বিছানালগ্ন
হয়ে রয়েছে, এটা মায়ের বড় পীড়া। নেহাত অভ্যাসমন্থনে অষ্টমীর উপোষ ছাড়া এ পরিবারে নিয়মিত পুজো কিছু ছিল না। হঠাৎ দুর্বল শঙ্কাগ্রস্ত শতদ্রু তার অনটন ও অরঙিন সংসারটিতে
শনির আমদানী করে। একটি পুরুষ্টু কমলালেবু দিয়ে বড়মেয়েকে সে ব্রীজের তলায় শনিমন্দিরে
পাঠায় পুজো দিতে আরোগ্য কামনায়। সন্ধেবেলা মন্দির থেকে ফেরে বড়মেয়ে। একটু হাবাগোবা
বলে মায়ের ভারি করুণা ছিল ওর জন্য। শনিমন্দির থেকে সন্দেশ এনেছে মেয়ে কমলার বদলে।
মাকে সেটি দিতে দিতে প্রায় কান্না পেয়ে যায় তার,
—শনি মন্দিরে কী ঝাপসা আলো জ্বলে মা! মন খারাপ হয়ে যায়।
মেয়েকে বুঝিয়ে শান্ত করে মা নিজের মনখারাপ গোপন করে। ওই বিভীষিকায় কেন যে মেয়েটাকে পাঠাল!
এতসবের মধ্যে ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বড়মেয়ে আবিষ্কার করে সে পাশের বাড়ির নাড়ুর সঙ্গে লাট্টু খেলায় ব্যস্ত। সে কোন অংশিদারি জানে না। সে জানে না সহানুভূতির বালাই। বারণ শুনতে অনভ্যস্ত। মা রোগশয্যা থেকে লক্ষ করে সে পড়ার গতি কমিয়ে খেলার গতি বৃদ্ধি করেছে।
শতদ্রু তার স্নেহের মাখন দিয়ে ছেলেকে ফেরাতে চায় অনুশীলনের আনন্দে। অথচ ছেলে কিভাবে যেন মায়ের কথাকে অগ্রাহ্য করার মহৎ তাৎপর্য অভ্যাস করে। পরিস্থিতিতে পড়ে মা কঠিন হয়। আবশ্যিক শৃঙ্খলায় ফেরাতে ছেলেকে জোরে জোরে পড়তে বলে এবং ছেলে আজীবনের অভ্যাস ছেড়ে নিঃশব্দে পড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তার এই নৈঃশব্দের সিদ্ধান্তে মা চুপচাপ আহত হয়।
|| ৭ ||
ইজি চেয়ারে বসেছে ক্লাশ এইটের ছেলে। কোলে তার সি.ডি. প্লেয়ার। মা তাকে যন্ত্রটি স্বস্থানে রেখে
শুনতে বলে। এই কথার কুটো ধরে ঝুলে পড়ে ছেলে,
— আমি কোলে নিয়েই শুনবো
— ওটা গান শোনার পদ্ধতি নয়, কারেন্ট লাগতে পারে
— তুমি কিছু জানো না, কারেন্ট এভাবে লাগে না।
— বেশ আমি জানি না, তুমি ওটা পাশে রেখেই গান শোনো।
— আমার এভাবেই ভালো লাগছে।
— আমি তোমায় বলছি ---
ছেলে কথা শোনে। গানটি প্রকৃতই বন্ধ করে দেয়। অস্বীকারের কি বিচিত্র পদ্ধতি।
অভিমানের এক ঘন ছায়া মায়ের মুখে লেপে যায়। সঙ্গে রাগ। শতদ্রু শুয়ে পড়ে। খায় না রাতে। ছেলে মায়ের অভিমানকেও জেদ বলে ভাবে। কেমন বিকারহীন খায় দায়। তার সামনে পড়ে থাকা বিস্মৃত তারুণ্য তাকে এসব গুমোটকে তুচ্ছ করতে আস্কারা দেয়।
|| ৮ ||
ক্রমেই ছেলের ব্যাপারটা অন্যরকম আকার নেয়। এক চূড়াস্পর্শী আত্মবিশ্বাসে তার মনে হয় পড়াশোনায় মায়ের বড় কড়াকড়ি। গানেও মায়ের এই এত নিয়মটিয়ম বাদ দিয়েও সে শুধু ফার্স্ট, ফার্স্ট আর ফার্স্ট হতে পারত। নাড়ুদের সঙ্গ এখন তার ভালো লাগে না। বরঞ্চ পুলিশ কোয়ার্টারে আসা নতুন ছেলে মনোজ অনুজদের সঙ্গে বেশ বসিং বজার রেখে মিশতে ভাল লাগে।
যেহেতু এ পরিবারের বাবাটি কাজপাগল, অফিসমুখী, সংসারে মায়েরই কর্তৃত্ব। ছেলের চোখে অন্য মায়েদের সঙ্গে ক্রমেই তার মায়ের পার্থক্যটা চোখে পড়ে। অন্য সংসারের সাজুগুজু, ধর্মপ্রাণ, কোমল, অবুঝ মায়েদের সঙ্গে এই যাতনাদানকারিণীকে বেশ অসহ্য মনে হয়। অন্য মায়েরা সংসারে, সন্তানে কেমন তৃপ্ত, অথচ তার মা কি এক অতৃপ্তিতে ... কিসের যে অতৃপ্তি! উকিল হতে না পারার কি! হাসি পায় ছেলের!
|| ৯ ||
খুব সহজভাবেই একাদশ শ্রেণীতে ছেলের রেজাল্টের নিম্নমুখিতা চোখে পড়ে। সে নিজেও হোঁচট খায়, অথচ মায়ের দেখানো কারণগুলো মানতে চায় না। মা তাকে নিজস্ব অধিকার থেকে বলে,
— তোকে পড়ায় মন দিতে হবে।
— আমি মন দিয়েই পড়ি।
— তাহলে এই রেজাল্ট ... ওই সব ছেলের সঙ্গ তোকে ছাড়তে হবে।
— ওদের সঙ্গে তোমার কি!
— আমার কিছু না। ওরা তোর মনঃসংযোগ নষ্ট করছে।
— কি যে বল তার ঠিক নেই। আমার বেশি পড়তে ভাল লাগে না!
— বাঃ তা বলে এত সুন্দর রেজাল্ট তুই নষ্ট করবি।
— চেষ্টা তো করছি!
— ওসব আমি শুনতে চাই না। তোকে পড়তেই হবে ভালোভাবে--
প্রবল বিরুদ্ধাচরণের মন নিয়েও ছেলে চুপ করে। স্কুলে তার গুরুত্ব কমে। মুখস্থবাজ ছেলেরা তাকে
ছেড়ে এগিয়ে যায়। মা ছটফট করে। হারতে থাকা ছেলে প্রবল আঘাতে তাকে বারবার রক্তাক্ত
করে। ছেলের স্বরভঙ্গ হয়। তার গানের গুরুত্ব কমতে থাকে। শতদ্রু কোনভাবেই এই ঘটে চলা বর্তমানকে মেনে নিতে পারে না, অথচ মেনে নিতে নিতে পাথর হতে থাকে। অন্যদিকে ছেলে, তার বন্ধুকুল, গোঁফ-গজানো বয়স ও অস্বীকারের বাতাস বাড়তে বাড়তে ঝড় হতে থাকে।
|| ১০ ||
ছেলে নতুন ডাইনিং টেবিলে বসে। অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করিয়ে মা যা ইনস্টলমেন্টে
কিনেছে। তার উকিল না-হতে পারা যাপনে এসব যুক্তি ছাড়া আর যুক্তি বিস্তারের মওকা কই!
স্বচ্ছ টেবিলক্লথ। টেবলম্যাট তখনো কেনা হয়নি। পাশে ছোট বাটি রেখে মা পরিবারস্থ
সবাইকে শুনিয়ে বলে,
— মুখ থেকে কেউ টেবিলক্লথে ফেলবে না। এই বাটিতে ফেলবে, যতদিন না ম্যাট কিনতে পারি।
মেয়ে, মেয়ের বাবা আধো-সাড়া দেয়। ছেলের দিক থেকে নীরবতা। একেবারে শক্ত একটি নীরবতার মাঝে মা বেলা দুটোয় ছেলের থালায় ভাত দিতে দিতে বলে
— টেবিলে মুখ থেকে কিছু ফেলিস না, হ্যাঁ! এই বাটিটাতে ফেলিস।
দশ সেকেন্ড পর রান্নাঘর থেকে মা লক্ষ করে ছেলে সজনেডাঁটার খোসা টেবিলে ফেলছে।
নিজেকে থামাবার চেষ্টা করে হয়ত আর ফেলবে না। পরক্ষণেই ডালের ভাসমান লংকা স্বচ্ছ টেবিল
ক্লথে। মা টেবিলের পাশে যায়,
— ওগুলো টেবিলক্লথে ফেলিস না।
— ওটুকু পড়বেই। কিছু করার নেই!
— সে কি! এটা একটা কথা! আজকাল হোটেল, নিমন্ত্রণ বাড়িতেও ...
— এটা বাড়ি, নিমন্ত্রণ বাড়ি না।
— তুই ওগুলো ফেলবি।
— ফেলব।
মা শান্ত বসে চেয়ারে। ছেলে যা টেবিলে ফেলে তা তুলে তুলে মুখে পুরে গিলে নিতে থাকে। সেই
উচ্ছিষ্ট গিলেও তার বমি পায় না। ছেলে তবু অনেক ফেলে। মা ডাঁটার ছিবড়ে, লংকা, বেগুনের
খোসা সব গিলে নেয়।
রাতেও ছেলে কোন কথা বলে না। মা স্বপ্ন দেখে একশ দু’শ শকুন তাকে মাঝে রেখে বোঁ বোঁ করে ওড়ে। তাদের মার্বেলের মত চোখে হাসি আর খোঁচাওয়ালা ডানাজোড়া যেন উকিলের কালো কোটের মত উড়ন্ত, সর্বনাশা।
|| ১১ ||
মা-মানুষটিকে হারাতে চেয়েও হারানো যায় না, তার অভিমানটিও বড় শক্ত। কান্না বা হাহুতাশ নয়, শাড়ি গয়নার ইচ্ছেহীন ঐ মানবীটি কি আশ্চর্যভাবে জিইয়ে রাখে তার জিত। তার দিকে তাকিয়েই বোঝা যায় নিজের অপরাধ। অথচ জানা অপরাধকে অস্বীকার করতে ছেলেকে কাঠিন্যের আড়াল নিতে হয়। ছেলের বন্ধুরা ‘ইমোশনাল’ বা ‘বকওয়াস আওরত’ বলে কত সহজে মা-কে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে। তার মাকে তো সেইভাবে নিতান্ত মেয়েছেলে ভাবাও মুশকিল। স্কুলে গুরুত্ব কমে যাবার পাশাপাশি এই আর এক হেরে যাওয়া ছেলেকে তাতায়। মা স্তব্ধ থাকলে তার রাগটা আক্রোশ হয়ে যায়। আক্রমণ জেগে ওঠে। যেন মায়ের চাহিদাহীন সততার জন্য আক্রোশ, জীবনব্যাপী ত্যাগের জন্য আক্রোশ। ছেলের উজ্জ্বল মুখে সেই আক্রোশের, আক্রমণের কালো লেগে থাকে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার তরী ডুবে গেলে একজন মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন বেকার হয়ে যেতে যেতে ছেলে মায়ের কোন একটা সঙ্কীর্ণতা খুঁজতে থাকে।
|| ১২ ||
সময়ের নিরাসক্ত ঢেউ শতদ্রুর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। বড়মেয়ে আর্টসে চলাচল করে মধ্যম মানের ডিগ্রী ও বর পেয়ে যায়। ছেলে এক। পরিবারে ও বাইরে সব অর্থে কপর্দকশূন্য। পুলিশ কোয়ার্টারের ছেলেদের সঙ্গে মিশতে বিতৃষ্ণ। তার যথার্থ কোন বন্ধু নেই। একটিই শত্রু আছে। সে তার মা।
খুঁজে পেতে মায়ের কৃপণতার দোষটি সে বেছে নিয়েছে। যেদিন সামান্য কারণে তুমুল ঝগড়া হয় সেদিন ছেলেটি মাকে কমদামি জুতো দেবার জন্য, কমদামি স্কুলে পড়ানোর জন্য বাজারের গুঁড়ো মাছ খাইয়ে বড় করার জন্য দোষারোপ করে। এমনকি বাবার উদাসীনতার ফাঁকে বসতবাড়িটিও নিজের নামে রাখার জন্য মাকে আঙুল তোলে। কখনো ক্ষোভে চিৎকার করে। শতদ্রুকে ছেলে ‘মা’ বলে ডাকে না। উনি, উনি বলে নিরীহ বাবার উপস্থিতিতে বাড়িতে রণাঙ্গন প্রস্তুত করে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাচ্চা হতে আসা বড়মেয়ে তাদের কথাবার্তায় ভয় পেয়ে যায়।
|| ১৩ ||
শতদ্রুর ছেলে আর গান গায় না। তার অবচেতনেও শৈশবে মায়ের শোনানো সুররাজি খেলা করে কিনা
জানা যায় না। এ সংসারের মা সারাদিন কাজকর্ম বা রান্নাবান্না সবই করে। রাতে শোবার আগে
বলে, আজকের মতো আমার ছুটি! তারপর মরা মাছের মত ঘুমোয়। অন্ততঃ উকিল হবার কথা
আর স্বপ্নেও ভাবে না।