সকালে ঘুম থেকে উঠেই লীনার মনে পড়ল আজ ২৭শে শ্রাবণ, ওর জন্মদিন, এবং ওর বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল, কারণ সে জানে না শেখর আসবে কিনা। আট মাস আগে ওদের সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছে। শেখর রূঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছে সে ওকে বিয়ে করতে পারবে না। তারপর থেকে শেখরের সঙ্গে ওর আর দেখাই হয়নি। লীনা ফোন করেছিল। শেখর কথা বলেনি। আজ ওর জন্মদিন, আজ এলেও আসতে পারে, আগে প্রতি জন্মদিনে এসেছে। লীনার বুক ঢিপঢিপ করছিল। শ্রাবণ মাস হলেও বাইরে উজ্জ্বল রোদ, সামনের বকুলগাছটায় পাখিরা কিচিরমিচির করছে, দোতলার রেলিং-এ হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে লীনা দেখল। রাস্তাঘাট কেমন মন্থর, রোববার তো, ফলে আজ সেও সারাদিন বাড়িতে থাকবে, কলেজে পড়াতে যেতে হবে না, আর শেখর যখন-তখন চলে আসতে পারে। লীনার বুকে কাঁপুনি বইছিল।
মা, বাবা, ছোট বোন রিমা ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল। হাসির পাশে ওদের মুখে গোপন শঙ্কাও, কারণ শেখর আসবে কিনা ওরাও জানে না। অথচ এর আগে প্রতিটি জন্মদিনে এসেছে। সবাই ধরে নিয়েছিল শেখরের সঙ্গে লীনার বিয়ে হবেই। অনেক বছর মিশছে দু'জনে।
সবশেষে শুভেচ্ছা জানাতে এল বিধবা বুড়ি পিসি। একগাল হেসে ওর চিবুক ছুঁল, তারপর চোখ পাকিয়ে বলল, 'আজই ওর শেষ পরীক্ষা। না এলে জয়দেবের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব।'
জয়দেব পিসির দূর-সম্পর্কের দেওর। পিসির ইচ্ছে ওর সঙ্গে লীনার বিয়ে হোক। গেঞ্জির ফ্যাক্টরি করেছে। ভাল রোজগার। এতদিনে লীনার বাবা-মাও রাজি হয়েছে।
সামনের গাছটায় নানারকম পাখির কলরব, সকালটা কেমন মন্থর, আয়েসি। শ্রাবণের আকাশ, কিন্তু মেঘ নেই। বুকের ভেতর উত্তেজনা লীনার কমেনি, যেন কোনও ক্ষুদে পশু আরও ভেতরে ঢোকার জন্য ওর হৃৎপিণ্ডে গুঁতো মারছে। আজ রোববার না হলেই ভাল হত, লীনা ভাবছিল, তাহলে সে কলেজে যেতে পারত, কাজে ব্যস্ত থাকতে পারত সারাদিন, পাখিরা কী সুন্দর ডেকে চলেছে, শ্রাবণের রোদ, শেখর কি সত্যি আসবে?
বারান্দা থেকে সে ভেতরে চলে এল। এবং হঠাৎ ফোনের শব্দে ধকধক করতে লাগল ওর বুক। আসার আগে শেখর হয়ত ফোন করল। কিংবা ফোনেই শুভেচ্ছা জানাল। লীনা ফোন দেখে। কার ফোন জানতে রিমা ছুটে আসে। সেও চায় শেখরদা যেন দিদিকে ফোন করে, আজ বাড়িতে আসে।
'বল,' লীনা বলে।
রুমার ফোন। লীনার কলিগ। কলেজে শুধু সেই জানে লীনার জন্মদিনের তারিখটা।
'কী বলছে ফোনে?' পিসি এসে জিজ্ঞেস করে।
'শেখরের ফোন নয়,' লীনা বলে বিরক্ত গলায়।
পিসি চুপ করে তাকিয়ে থাকে লীনার মুখের দিকে। তারপর হেসে ফেলে।
'এ বছরই গাড়ি কিনছে জয়দেব,' পিসি বলে। 'তুই ভাবিস না। তোর মতো মেয়ের ছেলের অভাব হবে?'
দুপুরে সবাই খেল একসঙ্গে বসে। মনের উত্তেজনা গোপন করার জন্য লীনা অকারণেই প্রচুর হাসল। মজার মজার কথা বলে অন্যদের হাসাল। বাবা একটা চামড়ার সাইডব্যাগ দিল। মা শাড়ি। রিমা বই। 'দ্য ইনওয়ার্ড ওডিসি'। ভেতরে নামো। শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ তো নিজের ভেতরেই করতে হয়। বইটা উল্টেপাল্টে লীনা একটু স্তব্ধ হয়ে গেল, কিন্তু মনের ভেতর যে অদ্ভুত অস্থিরতা! খাওয়ার পর সবাই তখন বিশ্রাম নিচ্ছে, সে চুপিচুপি দেখল টেলিফোন ঠিকমতো রাখা আছে কিনা। ঠিকমতো রাখা আছে। ব্যাটারি চার্জও আছে। তবে টেলিফোন বাজছে না কেন? শেখর ফোন করছে না কেন? সে কি তবে বিকেলে চলে আসবে ঠিক করেছে?
বিকেল এল। কিন্তু শেখর এল না। অবশ্য সন্ধে বা রাতের দিকেও আসতে পারে। রোববার। যখন খুশি আসতে পারে। বিকেলে লীনা ছাদে গেল, অন্যেরা হয়ত ঘুমোচ্ছে, বা বিছানায় শুয়ে ওর সম্পর্কে দুশ্চিন্তা করছে। আস্তে আস্তে গোধূলির অন্ধকার নামতে লাগল ছাদে, আকাশে এখন মেঘও, দূর থেকে আসছে শাঁখের শব্দ আর বকুলগাছটা থেকে পাখির কিচিরমিচির, যেন লক্ষ লক্ষ পাখি ডাকছে একসঙ্গে। হঠাৎ লীনার চোখে পড়ে পাশের বড় ছাদটায়, যার জমি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে কালচে হয়ে গিয়েছে, আর একটা সাদা বেড়াল লম্বা লম্বা পদক্ষেপে পায়চারি করে চলেছে, ছাদের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। যেন গভীরভাবে চিন্তা করে চলেছে। বেড়ালের এরকম দীর্ঘ, গম্ভীর, নির্ভুল পদক্ষেপে পায়চারি লীনা এর আগে কখনও দেখেনি। কী চিন্তা করছে ওটা? শাঁখ থেমেছে। পাখির কিচিরমিচিরও। চারপাশে হঠাৎ কেমন স্তব্ধতা। এবং নিঃশব্দ গোধূলি। এবং শ্রাবণের এরকম স্তব্ধ, নিঃশব্দ, ঘন গোধূলিতে ওই সাদা বেড়ালটা প্রশস্ত ছাদটায় একমনে পায়চারি করে চলেছে। লীনার কেমন ভয় করছিল। সে নীচে নেমে এল।
চা খেতে খেতে বাবা কিছু বলছিল না। মাও না। সবাই চুপ।
'ওর গেঞ্জি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বিহারে,' একবার পিসি বলল।
কেউ কিছু বলল না।
সন্ধে রাত হল। রাত গভীর রাত। আর ফোন একবারও বাজেনি। কলিংবেল একবারও বাজেনি। লীনা ও রিমা নিজেদের ঘরে। ওরা একসঙ্গে ঘুমোয়। পাশে শুয়ে লীনা মজা করার চেষ্টা করল বোনের সঙ্গে। রিমা হাসল না।
'শেখরদা আর মনে হয় কখনওই আসবে না,' সে বলল।
'জানি', লীনা বলল।
রিমা দিদির হাতের বালাটা ধরে আপনমনে নাড়াতে লাগল।
'সব ছেলেই কি এরকম?' হঠাৎ রিমা প্রশ্ন করে।
লীনা হেসে ফেলে। বলে, 'তোর অনিরুদ্ধ এরকম নয়, তুই নিশ্চিন্তে থাক।'
রিমা দিদির বুকে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক রাত। লীনার মাথার ভেতর, বুকের ভেতর, ধমনীর ভেতর এমন উদ্বেগ আর অবসাদ আর কান্না বয়ে যাচ্ছিল যে সে ভাবছিল এসব দমন করার কোনও শক্তিই আর ওর মধ্যে নেই। এর চেয়ে বরং সরাসরি নরকে বেঁচে থাকাই ভাল। নারকীয় জ্বালাকে সেখানে আর দমন করতে হয় না। ভোগ করতে হয়। দমন করার চেয়ে ওই জ্বালা বরং প্রাণ খুলে ভোগ করা বোধহয় কম কষ্টের।
সে যখন বিছানা থেকে নামছিল, রিমার ঘুম ভেঙে যায়।
'কোথায় যাচ্ছিস?' রিমা জিজ্ঞেস করে।
'নরকে', লীনা বলে।
ঘুমের ঘোরে রিমা কিছু বুঝতে পারল না। এবং আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লীনা দেখল রাত দুটো। তারপর উঠে গেল ছাদে। আকাশে একটু চাঁদ ছিল, ফলে আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছিল বেড়ালটা পায়চারি করে চলেছে আগের মতো। লীনাকে দেখে লাফ দিয়ে এই ছাদে এল, তারপর লীনার পায়ে পা ঘষে ডাকতে লাগল। লীনা বুঝল বেড়ালটা ওকে অনুসরণ করতে বলছে, সে ওকে নরকে নিয়ে যাবে। শেখর আর কখনওই আসবে না, আকাশে চাঁদ, আবার শ্রাবণের মেঘও। এরপর নানা বাড়ির ছাদের ওপর দিয়ে বেড়ালটা হেঁটে চলল আর লীনা ওটার পেছনে পেছনে। এক সময় ওটা একটা অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগল। অনন্ত সিঁড়ি, লীনা নামতে থাকে, তারপর এক সময় পৌঁছয় নরকে। ওখানে শুধু অগ্নিকুণ্ড আর অগ্নিকুণ্ড, যার চারপাশে পাক দিচ্ছে অসংখ্য নরনারী, কিন্তু কোনও শ্বাসপ্রশ্বাসের লক্ষণ ওদের ভেতর নেই। ওরা সবাই দম বন্ধ করে বেঁচে আছে। এটা অর্থহীন! লীনা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। এর কোনও মানে হয় না! প্রাণের উদ্দেশ্য এটা নয়! এভাবে বাঁচা বাঁচাই নয়!
সে পালাতে থাকে। নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখে রিমা ঘুমোচ্ছে। সে পাশে বসে হাঁপাতে লাগল। বিছানা নড়ছিল বলে রিমার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু লীনা সেটা লক্ষ করল না।
'আর মনে হয় আমি কষ্ট পাব না,' শেখরকে সে বলল।
'কেন?' অদ্ভুত হেসে শেখর জিজ্ঞেস করল।
'কারণ এরপর থেকে তুমি সব সময় আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে ছেড়ে আর যেতেই পারবে না।'
রিমা বিছানায় উঠে বসে।
'তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস?' ভয় পেয়ে সে জিজ্ঞেস করে।
'শেখরের সঙ্গে।'
'কিন্তু শেখরদা কোথায় এখানে?'
'আছে। তুই দেখতে পাবি না।'
রিমা ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বাবা-মাকে ডেকে নিয়ে আসে। সবাই ভাবে লীনা পাগল হয়ে গিয়েছে।
ওদের দেখে একটু লজ্জা পেয়ে লীনা বলল, 'শেখর এলে হয়ত ওর সান্নিধ্য ততটা অনুভব করতে পারতাম না, যতটা পারছি ও আসেনি বলে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত শুধু ওর কথাই ভাবছি। ফলে ওর সঙ্গে আমার বিচ্ছেদও আর কখনও হবে না।'
এরপর থেকে লীনা স্বাভাবিকভাবেই বেঁচেছিল। বিয়ে করেনি। তার জন্য কোনও দুঃখও ওর হত না। বরং প্রসন্ন মনে বেঁচে থাকল দীর্ঘ জীবন। বৃদ্ধ বয়সে একদিন শেখর এসেছিল এ বাড়িতে। কাজ করা একটা মেয়ের সঙ্গে তখন লীনা থাকে। কলেজ থেকে অবসর নিয়েছে।
'শেখর মজুমদার নামে একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে,' দোতলায় এসে কাজকরা মেয়েটা বলল।
লীনার হাতে চায়ের কাপটা কাঁপতে লাগল। চোখদুটো ছলছল করে উঠল। তারপর প্রসন্ন মনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল দূরের আকাশের দিকে। শীতের দুপুরে একটা চিল ডাকছিল। লীনা নীচে নামেনি, কারণ ওর ভয় করছিল দেখা করলে ওর ভেতরে যে শেখর বাস করছে সে ওকে ত্যাগ করে চলে যেতে পারে।
বৃদ্ধ শেখর নীচের ঘরে অপেক্ষা করতে থাকে।