• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | গল্প
    Share
  • শ্বাপদ : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়


    সুগত দেখছে সুজাতা সামান্য ঝুঁকে হেঁটে যাচ্ছে, পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে। ওখানে কি আয়না রাখা আছে? নিজের প্রতিবিম্ব দেখছে। নিজেকে দেখেদেখে কি সাধ মেটে না? দলছুট হয়ে পল্লবিনী কড়াইশুঁটির ক্ষেতে নেমে যাচ্ছে সুজাতা। আল পথ ধরে হেঁটে একটু এগোলেই ঝির-ঝিরে স্বচ্ছতোয়া নদী। জলের মধ্যে কয়েকটা পাথর। গাছপালার ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি রোদ। চটি খুলে জলে নামল সুজাতা, জল নিয়ে খেলা করবে বলে। অফিসের পিকনিকে এসে একবারও সুগতর দিকে তাকায় নি। যেন চিনতেই পারছে না। যে ফার্ম হাউসটায় ওরা পিকনিক করতে এসেছে সেটা শহর ছাড়িয়ে। অনেকটা রাস্তা। সবাইকে জড়ো করে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দুপুর হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা একটা দল বেরিয়েছে চারদিকটায় নজর ফেলতে। হঠাৎ বৃষ্টি এল। ওদের সঙ্গে যারা আসছিল তারা সবাই ফিরে গেল। ছাদের নীচে। ফার্ম হাউসের ভেতরে। সুগত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। ভিজে যাচ্ছে সর্বাঙ্গে। পিকনিক থেকে ফিরে ওর জ্বর হবে। ধুম জ্বর, কাল অফিসে যেতে পারবে না।

    সুগত কোন কারণে অফিসে না এলে সুজাতা পঙ্কজের সঙ্গে অফিসের ক্যানটিনে বসে কফি খায়। হাসে, গল্প করে। অফিসের বাসে ওর পাশে বসে যায়। বাসের পিছনের সীটে বসে চার জন তাসাড়ু ব্রীজ খেলে। হল্লা শুনে সুজাতা বিরক্ত হয়ে তাকায় কখনো সখনো। চশমার ফাঁক দিয়ে। পঙ্কজ তখন আড়চোখে তার কুঞ্চিত ঠোঁটের সুষমা দেখে নেয়। পঙ্কজের গাঁওঘর রাজস্থানের কোন একটা রুখো-শুখো এলাকায়। লম্বা দোহারা চেহারা। চোখে মুখে মুরুভূমির চোয়াড়ে রুক্ষতা। তবু যখন সে সুজাতার দিকে তাকায় তার চোখে মুগ্ধতা ঝরে। মুখের কঠিন রেখাগুলো কমনীয় হয়ে আসে। সুজাতা দেখেও দেখে না। ইচ্ছে করে অবজ্ঞা করে।

    বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু নিজস্ব নিয়ম থাকে। সুজাতাদের প্রোজেক্টের টাস্কফোর্সটা কনফিডেন্সিয়ালিটির খাতিরে অন্যদের থেকে আলাদা বসে। একটা বড়সড় কাঁচের কিউবিকলের মধ্যে আটদশটা টেবিল, ওয়ার্কস্টেশন। দুটো টেবিলের মাঝে পার্টিশন নেই। আলাপ-আলোচনা, কাগজপত্র আদান-প্রদানের সুবিধের জন্য। সুজাতা বেশ বুঝতে পারে মাঝেমাঝেই পাশের টেবিল থেকে পঙ্কজ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দুই চোখ দিয়ে তার পিঠের খোলা যায়গাটা জরীপ করে। ফিরে তাকালেই চোখ সরিয়ে নেয়। কখনো বা অস্বস্তি কাটাতে বলে, “সুজাতা, আজ এই নীল শাড়ীটাতে তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। ”

    সুজাতা প্রশ্রয় দেয়। আহা দেখুক গিয়ে। কেউ তো দেখছে। সুগতর তার দিকে তাকাবার সময় নেই। দুজনেই ব্যস্ত, ঘরে বাইরে। কেবল লাঞ্চ করতে যাবার সময় সুগত কিউবিকলের বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ডাকে। রোজ একই সময় সুগত আসে। অসহিষ্ণু হয়ে হাত নাড়ায়। যতক্ষণ না সুজাতা মুখ তুলে তাকায়। সুজাতা লাঞ্চ-বক্সটা তুলে নিয়ে এগোয়। সকাল সকাল দুজনের রান্না করে লাঞ্চ-বক্সে ভরে নিয়ে আসে। একটু তাড়াহুড়ো হয়। তবে ক্যান্টিনের হাবিজাবি খাবার খাওয়ার থেকে ভাল। দুজনে ক্যানটিনে গিয়ে বসে। লাঞ্চ-বক্স খুলে নিরামিষ রুটি সবজি খায়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনেকে হাত নেড়ে যায়। ওরাও হাত নাড়ে। হয় তো চেনা কেউ এসে বসে। তখন দুটো একটা কথা বার্তা হয়। না হলে দুজনে চুপচাপ রুটি চিবোয়।

    সুগত এগিয়ে গিয়ে সাত বছরের পুরোন বৌয়ের হাত ধরে। নদীর ধারে উবড় খাবড়, পাথর, ছড়ানো ছিটানো। সুজাতা প্রায়ই পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গে। সুজাতা একটু অবাকই হয়। একবার সুগতর দিকে ফিরে তাকায়। আসার সময় সুগত একটা ঢলঢলে বেমানান টি শার্ট পরে আসছিল। সুজাতা হলুদ চেক-কাটা বুশ শার্টটা বের করে দিল। ডেনিম জিনসের ওপর ভাল লাগছে। বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সুগত আর সুজাতা হাঁটে। দমকা হাওয়া দেয়। বৃষ্টি খুব ঝেঁপে আসে। জলের ঝাপটায় দুজনের মুখ থেকে ধীরে ধীরে ব্রণর দাগ, বিষাদের দাগ মুছে যায়। চোখ বুজে আসে। সুগতর মনে হয় সুজাতা তার হাত ধরে গভীরতর বৃষ্টির মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছ। হাঁটতে হাঁটতে দুপুর শেষ হয়ে আসে। মেঘ কেটে রোদ ওঠে। সুজাতা চশমার কাঁচ থেকে আঁচল দিয়ে জল মোছে। দুজনে একটা বাঁজা ক্ষেত পার হয়। একটা মোটাসোটা মেঠো ইঁদুর এক গর্ত থেকে বেরিয়ে অবলীলায় অন্য গর্তে সেঁধিয়ে যায়। দূরে নদীর বাঁকে শ্মশান। একটা মানুষ মাটি খুঁড়ছে। পাশে একটা খালি রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি জামা খুলে ফেলেছে। ঘামে গা চক চক করছে। তারা পাশ দিয়ে যাবার সময়ও তাদের দিকে তাকায় না। সুজাতা বলে, “পঙ্কজ না?”

    সুগত ডাক দেয়, “পঙ্কজ, পঙ্কজ!”

    লোকটি সাড়া দেয় না। ওরা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। এই লোকটি পঙ্কজ না। পঙ্কজ ওদের সাথে আজ পিকনিকে আসে নি। পঙ্কজের স্ত্রী গত সপ্তাহে একটি মৃত সন্তান প্রসব করেছে। বেশি দিন নয়। বছর খানেক হল ওদের বিয়ে হয়েছে। সুজাতার মায়া হয় পঙ্কজের জন্য। ওরা পঙ্কজের বাসায় গিয়েছিল। পঙ্কজের স্ত্রী মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসে ছিল। কথা বলছিল না। হয় তো শোকে স্তব্ধ বা ভাষার আড় কাটেনি এখনও। ওরা জোর করে নি। পঙ্কজের মায়ের মুখটা রাগী রাগী। রাগটা বহু মৃতবৎসা বলে না কি বেটাকে ভোর রাত্তিরে একা একা গিয়ে একটি মৃত শিশুটিকে দাফনাতে হয়েছে বলে, বোঝা যায় না। পঙ্কজ অবশ্য বন্ধুবান্ধব কাউকে কিছু বলে নি। ওরা পরে জানতে পেরেছে।

    দূরে একটা একচালা অনাথালয়। এসবেস্টসের শেডের ওপর নাম লেখা – কমলালয়। বাচ্ছারা খেলছে বাইরে। হাতে পায়ে ধুলো মাখছে। তাদের পার হয়ে ওরা বিকেলের দিকে হেঁটে যায়। দুটি শিশু ওদের সঙ্গ নেয়। সুজাতা ছোটটাকে কোলে তুলে নেয়। অনেকবার বলেছে সুগতকে। সুগত ডাক্তার বদ্যি করতে চায় না। বলে, “এই তো বেশ আছি। নির্ঝঞ্ঝাট!” ছেলেটা ছটফট করে। কোল থেকে নেমে যেতে চায়। সুজাতা তাকে মৃদু শাসন করে। পান সিগারেটের দোকান থেকে চকোলেট কিনে দেয়। ছেলেটা এক গাল হেসে দৌড় লাগায়। সামনেই একটা মন্দির। সুজাতা চটি খুলে রেখে মন্দিরের ভিতরে ঢোকে। সুগত স্যু-জুতো খুলতে হবে বলে যায় না। বাইরে দাঁড়িয়ে পাখ-পাখালি দেখে, সিগারেট ধরায়।

    অন্ধকার নামছে। ওরা ফিরে যাচ্ছে। শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে। সুজাতা শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিল। ওভারনাইট পিকনিক। আজ রাতটা ওরা ফার্ম হাউসে থাকবে। ফার্ম হাউসটার চারদিকে ব্যাঁকারির ফেন্সিং। তার ওপর বুনো লতার আচ্ছাদন। ভিতরে আট দশটা কটেজ। সন্ধেবেলা সবাই মিলে হুল্লোড় হবে। সামনের খোলা যায়গাটায় কাঠকুটো জুটিয়ে আগুন জ্বালা হচ্ছে। আগুন ঘিরে খানকতক প্লাস্টিকের চেয়ার সাজানো। একটু পরেই আড্ডা জমবে, অল্প-স্বল্প মদ্যপান। হেঁড়ে গলায় বেসুরো গান গেয়ে উঠবে কেউ কেউ। সুগত একটা চেয়ার টেনে বসল। সুজাতা এলো না। ফেন্সের ধারে গিয়ে একা দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। শহরের আলো এড়িয়ে সন্ধ্যারাত্রির নিকষ কালো আকাশে একটা একটা করে তারা ফুটছে। নক্সি কাঁথার মত অতি ধীরে ধীরে পৃথিবীকে ঢেকে দিচ্ছে। হ্যাণ্ডব্যাগে রাখা মোবাইলে টুং করে একটা মেসেজ এল। সুজাতা শুনতে পায়। কিন্তু ইচ্ছে হয় না ব্যাগ খুলে মোবাইলটা বার করার।

    সুগতর একটু শীত শীত করছে। জামার কলারের নীচটা এখনও ভিজে ভিজে আছে। জ্বর আসছে। মাথাটা ভার ভার লাগছে। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিলে হত। জ্বর হলে সুগত বাচ্ছা ছেলের মত হয়ে যায়। অনবরত আহা উহু করতে থাকে। সুজাতা ফিরে এসে পাশের চেয়ারটায় বসে। সুগতকে জবুথবু হয়ে বসে থাকতে দেখে কপালে ঠাণ্ডা হাত রাখে। সুগতর রোগা শরীরটা একবার কেঁপে ওঠে। সুজাতা অনুযোগ করে, “এখনও ভিজে পোষাকে বসে আছো?” সেই সময় সুজাতার মোবাইলটা বেজে ওঠে। পঙ্কজ ফোন করছে। সুজাতা কথা বলার জন্য উঠে যায়। এখানে নেটওয়ার্ক নেই ভাল। কথা শুরু করার আগেই ফোনটা কেটে যায়। তখনই দেখে মেসেজটা। পঙ্কজ লিখেছে, “কেমন এনজয় করছ তোমরা? আমিও চলে আসব নাকি?” অনেকটা হেঁটে এসে সুজাতার কেমন ক্লান্ত লাগে। উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না।

    ফার্ম হাউসটা চালান এক বয়স্ক দম্পতি। কর্নেল রাণা এবং তাঁর সহধর্মিণী। হাতে হাতে সাহায্য করার মত জনাকয়েক লোকাল লোকজন আছে। তারা গৃহকর্ত্রীর নির্দেশনায় সামনের টেবিলে মুখোরোচক খাবারের প্লেট, তরলের গ্লাস সাজিয়ে রাখছে। প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো একটা দুটো করে দখল হচ্ছে। অফিসের মানুষজন এসে বসছে। দু এক টুকরো ভাজা মাছ, চিকেন পাকোড়া মুখে দিচ্ছে। নিজের নিজের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। কর্তাটি বেশ মিশুকে। মাথায় একরাশ কাঁচাপাকা চুল। সবার সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছেন। কাছাকাছি একটা পাহাড়ি ঝর্ণা আছে। রাতে চাঁদের আলোয় অপূর্ব দেখায়। দুপুর বেলা সুজাতারা যেদিকে গিয়েছিল তার উল্টো মুখে। আজ একটু পরে চাঁদ উঠবে। তখন ইচ্ছে করলে দল বেঁধে যাওয়া যায়। অনেকেই ফিরে তাকায়। ফার্ম হাউসটার পিছন দিকে একটা টিলা। উপরে ঝুপসি অন্ধকার, জঙ্গল। কর্নেল আশ্বস্ত করেন এমনিতে ভয় নেই। তবে কখনো সখনো দু একটা চিতা এসে পড়ে। গ্রাম থেকে ছাগল ধরে নিয়ে যায়। দলছাড়া না হলে মানুষের ওপর তারা সাধারণত উপদ্রব করে না।

    এই পিকনিকটা আয়োজন করেছেন শঙ্করদা। মোটামুটি একা হাতে। কর্নেল রাণার সঙ্গে ইন্টারনেট দেখে যোগাযোগ করা, বাস ভাড়া করা। সবাইকে নিয়ে একটা ইভেন্ট অর্গানাইজ করা মুখের কথা নয়। বাকিরা চাঁদা দিয়েই খালাস। শঙ্করদা হুল্লোড়ে মানুষ। উঁচু গলায় কথা বলেন। জোকসের অফুরন্ত ভাণ্ডার। মজার মজার কথা বলে অফিসের সব পার্টি মাতিয়ে রাখেন। আজকেও শঙ্করদার কথায় সবাই হাসছে। সব থেকে বেশি হাসছে আইভি। ওকে শঙ্করদাই জোর করে টেনে এনেছেন। আসতে চাইছিল না। আইভি আপাতত পূর্ণগর্ভা। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ওর ওঠা-হাঁটা করতেও অসুবিধে হচ্ছে। এসে থেকে একটা চেয়ারেই থুম্বু হয়ে বসে আছে। হাতের রুমাল দিয়ে চোখের কোণের জল মুছছে। হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেছে। ক্যাম্প ফায়ারের আলোয় তার ঠোঁট সামান্য সাদা দেখায়। গর্ভাবস্থায় মেয়েরা অনেক সময় রক্তাল্পতায় ভোগে। সুগত ভাবল। সেই জন্যই হয় তো। সুজাতাকে লুকিয়ে মাঝে মধ্যে ইন্টারনেট ঘাঁটে সুগত। তার না হোক, ছেলে মেয়ে হয়নি বলে সুজাতার মনে একটা শূন্যতা আছে। সেটার হদিস সে রাখে না এমন নয়। সেই সময়ই চোখে পড়েছিল আর্টিকলটা। গর্ভসঞ্চার হলে মেয়েদের চেহারায় কী ধরনের পরিবর্তন হয়। কৌতূহলী হয়ে পড়ে ফেলেছিল। ভরভরন্ত হলে সুজাতাকে কেমন দেখাবে? মনে মনে একটা ছবিও তৈরি করা আছে।

    সুজাতার মোবাইলটা বাজছে। সুজাতা উঠে গেল। পঙ্কজ ফোন করেছে আবার, “আমি আসছি।”

    “কী ব্যাপার পঙ্কজ? এই রাত দুপুরে এতটা রাস্তা ড্রাইভ করে আসবে? সকালে এলে না কেন?”

    “তোমাকে এক্ষুণি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি রওনা দিয়ে দিয়েছি।” পঙ্কজ হঠকারির মত বলে। সুজাতার মনে হয় ও নেশা করে আছে।

    “পাগলামি কোরো না, পঙ্কজ।”

    সুজাতা ফোনটা কেটে দেয়। পঙ্কজ আবার ফোন করে। সুজাতা ধরে না। ফোনটা সাইলেন্টে করে এসে বসে। সুগত জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়, “কার ফোন?” সুজাতা উত্তর দেয় না। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। শঙ্করদার জোকসে মন দেয়। আধখানা জোকস শুনেই হাসে।

    কর্নেলের কথামত ঠিক পঁইতিরিশ মিনিট পরে ফার্ম হাউসের ফেন্সের বাইরে, খোলা মাঠের অন্যপ্রান্তে বগি থালার মত একখানা চাঁদ ওঠে। তার মেটে রঙ, লাল আর তামায় মেশানো। সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তাদের অজান্তেই তাদের হাতের তরল পানীয়তে চাঁদ ছলকায়। শঙ্করদাও কথা বলতে ভুলে যান কিছক্ষণের জন্য। তারপর হুজুগ তোলেন সবাই মিলে পাহাড়ি ঝর্ণা দেখতে যাবার। শঙ্করদাকে বাধা দিয়ে কোন লাভ নেই। কারো কথা তিনি আদতে শোনেন না। চল চল করে সবাইকে তাড়িয়ে তুললেন। কর্নেলও হাসতে হাসতে মদত দিলেন। বললেন, “যান, দেখে আসুন। দেবভোগ্য দৃশ্য। না দেখলে জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।”

    সবাই দল বেঁধে এগোল। এমন কী আইভিও। চাঁদ এখন দিগন্তরেখা থেকে অনেকটা উপরে উঠে এসেছে। কর্নেল রাস্তা বলে দিয়েছেন। জ্যোৎস্নায় পথ চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হচ্ছে না। একটা পায়ে চলা পথ ঝোপ ঝাড় ঘাস পাথর পিছনে ফেলে কুমারী মেয়ের সিঁথির মতন টিলার ওপরে উঠে গেছে। সুগতর মাথায় অল্প যন্ত্রণা হচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করছে। সুজাতা অন্যদের সঙ্গে অনেকটা এগিয়ে গেছে। সুগতর চড়াই ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে। সে হাঁপিয়ে পড়ছে। আইভি সঙ্গে হাঁটছিল। তার অবস্থাও তথৈবচ। বলল, “সুগত দা, একটু বসি, শ্বাস নিয়ে আবার উঠব।” সুগত না করল না। দুজনে ভিজে ঘাসের ওপরই বসে পড়ল।

    সুজাতা ততক্ষণে সবার সঙ্গে টিলার ওপরে পৌঁছে গেছে। টিলার মাথাটা অনেকখানি সমতল, গাছপালায় ঢাকা। তাদের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে চাঁদের আলো ঠিকরোচ্ছে। চত্বরটার অন্যপ্রান্তে হেঁটে যেতে যেতেই ওরা দেখতে পেল অপার্থিব ঝর্ণাটাকে। টিলাটা যেখানে শেষ হয়েছে তার দু তিনশ গজের মধ্যেই আরো একটা পাহাড়। খাড়া উঠে গেছে। কালো পাথরের গা বেয়ে নেমে আসছে দুধ-সাদা জল। ঝাঁপিয়ে পড়ছে অতলান্ত খাদে। জ্যোৎস্নার আলোয় এমন দৃশ্য দেখলে গা ছম ছম করে। সুজাতা সম্মোহিতর মত হাঁটছিল। তার হাতের তালুতে রাখা ফোনটা ভাইব্রেট করছে। সুজাতা অনুভব করতে পারছে না। তীব্র দৃষ্টিসুখ পেয়ে তার বাকি বোধগুলো সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। অন্যরা ফেরার রাস্তা ধরছে। শঙ্করদা ডাকাডাকি করে সবাইকে নিয়ে নীচে নামছেন। সুজাতার ইচ্ছে হচ্ছে অনন্তকাল এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এই রূপের মহিমা বুকের মধ্যে নিতে হলে কিছুক্ষণ একা থাকা দরকার।

    পিছন থেকে কে তার কাঁধে হাত রাখল, ভারী গলায় ডাকল, “সুজাতা।”

    ঠিক তখনই সুগত একটা শাল গাছের গুঁড়ির আড়ালে নীল রঙের মোটর বাইকটাকে দেখতে পেল। নাম্বার প্লেটটা ওর চেনা। সুগতর মাথার যন্ত্রণাটা তীব্র হচ্ছে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে রাখতে হচ্ছে। সে দেখছে মোটর বাইকটা রঙ বদলাচ্ছে। নীল রঙ ফ্যাকাসে হতে হতে হলুদ। তাতে পাটকিলে ছোপ ধরছে।

    “সুগতদা কী হল? আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?” আইভি ভয় পাচ্ছে।

    গাছের আড়ালে দুটো ক্রূর চোখ। একটু আগেও ওখানে পঙ্কজের মোটর বাইকটা দাঁড় করানো ছিল। চিতাটা গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে। আইভি কি দেখতে পাচ্ছে না? চিতাটা এগিয়ে আসছে। এবার লাফ দেবে। আইভি সরে যাও। সুগত হাত তুলে দুজনকে আড়াল করে। চিতাটা ওদের দিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করে লাফ দিয়ে ওদের পার হয়ে যায়। ঝোপ ঝাড় ভেঙ্গে দ্রুত চড়াই বেয়ে উঠতে থাকে।

    “সুগতদা, দাঁড়ান, কোথায় যাচ্ছেন?” আইভি আর্ত স্বরে ডাকল।

    সুজাতা নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে। পারছে না। দুটি পেশীবহুল হাত জোর করে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। কাছে টানছে। পঙ্কজের নিশ্বাসে মাদক-গন্ধ পাচ্ছে সুজাতা। সে আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে। কিছুটা অপরাধবোধে। সুগতর প্রতি নয়। তার মনে হচ্ছে এই অপরূপ সৌন্দর্যের সামনে শরীর শরীর খেলা মানায় না। সে চিরজীবন দোষী থেকে যাবে। কিন্তু তার প্রতিস্পর্ধা শিথিল হয়ে আসছে। হয় তো নিজের প্রতি অবিশ্বস্ততায়।

    ঠিক সেই মুহূর্তে পঙ্কজের কাঁধের ওপর দিয়ে অন্ধকারে সুজাতা দুটি জ্বলন্ত চোখ দেখে আঁতকে উঠল। কর্নেল ঠিক বলেছিলেন। এই জঙ্গলে চিতা আছে। তারা দলছুট মানুষ খোঁজে। চিতাটা ঝোপের বাইরে এসে দাঁড়াল। চাঁপা রঙের আলো তার পিঙ্গল ত্বক বেয়ে পিছলে পড়ছে। তার অবয়বের পেশল সৌষ্ঠব দেখে সুজাতার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল। শ্বাপদটা সামান্য নীচু হল। তারপর আচমকা সামনের জোয়ান মানুষটার ওপর ঝাঁপ দিল। মুহূর্তে সুজাতার বাহুর ওপর চাপ শিথিল হয়ে গেল। জন্তুটা রাগে গজরাচ্ছে। পঙ্কজকে মাটিতে পেড়ে ফেলে নখ আর দাঁত দিয়ে তার সারা শরীর ছিন্নভিন্ন করছে। সুজাতা চিৎকার করতে পারল না। অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকল।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments