• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | গল্প
    Share
  • গানশিকারি সুনীলদা : তাপস মৌলিক


    ত পরশুদিন সন্ধেবেলা সুনীলদা আমার বাড়ি এসেছিলেন, উত্তরপাড়ায়। কাল সারাদিন ছিলেন। আজ রোববার সকালে ব্রেকফাস্ট করে রওনা হয়ে গেলেন। সুনীলদার পাল্লায় পড়ে আজ ভোরবেলা যে অসাধারণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম সেটা বলার জন্যই এই লেখা।

    আমি ‘সুনীলদা’ বলেই ডাকি বটে, কিন্তু ভদ্রলোক আমার চেয়ে চৌত্রিশ বছরের বড়। ওনার বয়স এখন আটাত্তর। সর্বদা ধুতিপাঞ্জাবি পরা শ্যামবর্ণ ছোটখাটো স্লিম চেহারাটা কিন্তু এখনও বেশ শক্তপোক্ত। যে কোনও সময় চার-পাঁচ কিলোমিটার অনায়াসে হেঁটে দেবেন। মাথার চুল এবং গোঁফজোড়া পুরোপুরি সাদা। গোঁফে ঝুলে থাকা স্মিত হাসিতে সুনীলদা সদাহাস্যময়। সবসময়েই বেশ মেজাজে আছেন।

    আমার সঙ্গে সুনীলদার আলাপ প্রায় বছর দশেক আগে আমার দাদার মাধ্যমে। আমার ছোড়দা থাকেন টালিগঞ্জের মুচিপাড়ায়। সুনীলদাও সে পাড়াতেই থাকেন। ছোড়দা ব্লাডসুগারের রুগী। প্রতিদিন ভোর পাঁচটার সময় উঠে হাঁটতে বেরোয়। সুনীলদা ছোড়দার হাঁটার সঙ্গী। হাসিখুশি আড্ডাবাজ মানুষ বলে পাড়ার সবার সঙ্গেই সুনীলদার বেশ খাতির। ভদ্রলোক ছিলেন কোনও এক স্কুলের হেডমাস্টারমশাই, অথচ খবরদারি করার স্বভাবটা ওনার একেবারেই নেই। জ্ঞান দেবার বাতিকটা অবশ্য পুরোপুরি যায়নি এখনও।

    আলাপ হবার পর সুনীলদার সঙ্গে যে আমার গভীর অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল, তার কারণ হল গান। সুনীলদা গানপাগল লোক। প্রায় ষাট বছর ধরে তিনি গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে আসছেন। যুগ পাল্টানোর তালে তালে রেকর্ডের সাথে ক্যাসেট এবং সিডিও যোগ হয়েছে। সুনীলদার দোতলা বাড়িটা একটা বিশাল পুকুরের সামনে। দোতলায় থাকেন সুনীলদার স্ত্রী, ছেলে, বৌমা এবং একটি ভয়ানক দুরন্ত নাতনী। একতলাটা সুনীলদার এলাকা। বাড়িতে ঢুকেই একতলায় একটা বেশ বড় হলঘর আছে। হলঘরটায় আসবাব বিশেষ নেই। মেঝেজোড়া মাদুর পাতা। একপাশে একটা ডিভানের ওপর একটা হারমোনিয়াম আর বাঁয়া-তবলা রাখা। দুটো দেওয়াল আলমারিতে থরে থরে ক্যাসেট সিডি সাজানো। একটা কাঠের আলমারি আছে রেকর্ড রাখার জন্য। তার পাশে একটা বড় টেবিলের ওপর একটা ফিলিপসের রেকর্ড প্লেয়ার, একটা সোনির সিডি কাম ক্যাসেট প্লেয়ার। এছাড়া মেঝেতেই একপাশে রাখা আছে এইচ এম ভি কোম্পানির একটা পুরনো দম দেওয়া গ্রামোফোন রেকর্ড প্লেয়ার। সুনীলদার কাছে একটা গ্রুন্ডিগ কোম্পানির পুরনো স্পুল টাইপ ফোর ট্র্যাক টেপ রেকর্ডারও আছে। সেটা সাধারণত কাঠের আলমারিতেই থাকে, মাঝেসাঝে বেরোয়। ভদ্রলোকের সারা দিনরাতই প্রায় গান শুনে কাটে। কেবল রেকর্ডের বা ক্যাসেটের গান শুনে ওনার খিদে মেটে না। ঘুণাক্ষরেও যদি উনি এমন লোকের সাক্ষাৎ পান, যে একটুআধটু সারেগামা করতে পারে, তাহলে তাকে নিজের বাড়িতে ধরে এনে তার গান না শোনা পর্যন্ত ওনার স্বস্তি নেই। হারমোনিয়ামটা রাখার উদ্দেশ্য সেটাই, তবলায় সুনীলদা নিজেই কোনরকম ঠেকা দেন।

    আমারও ছোটবেলা থেকেই গান শোনার নেশা। ছোটবেলায় একমাত্র ভরসা ছিল রেডিও। কলেজে উঠে একটা টেপরেকর্ডার হল। সেই থেকে পয়সা জমিয়ে ক্যাসেট কেনা শুরু। হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যা, লতা আর দেবব্রত, সুচিত্রা, কণিকা। চাকরিবাকরি শুরু করার পর থেকে প্রচুর ক্যাসেট আর সিডি কিনে চলেছি। কিন্তু পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ড আর পাই কোথায়! তাই সুনীলদার রত্নভাণ্ডারের খোঁজ পাওয়ার পর মাঝে মাঝেই ওনার একতলার হলঘরে হানা দেওয়া শুরু হল। সুনীলদার অবারিত দ্বার। সকাল-বিকেল বহু লোক ওনার বাড়ি আড্ডা মারতে আসে। আমি সাধারণত যেতাম ছুটির দিনে, শনি-রবিবার, ছোড়দার বাড়ি যাবার নাম করে। উইকএন্ডে সুনীলদার বাড়ি আড্ডাটা আরও জোরদার হয়। আমি গিয়ে চুপচাপ রেকর্ড প্লেয়ারে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড চাপিয়ে দিতাম, আর নিজের মনে শুনতাম। রেকর্ড রাখার কাঠের আলমারিটা যথেচ্ছ ঘাঁটাঘাঁটি করতাম। সুনীলদা কিছু বলতেন না। চুপ করে চেয়ে দেখতেন আর গোঁফের ফাঁকে মিটিমিটি হাসতেন।

    সুনীলদার ফিলিপস রেকর্ড প্লেয়ারে আমি তখন একের পর এক শুনে চলেছি পঙ্কজ মল্লিক, কে এল সায়গল, রাজেশ্বরী দত্ত, শচীন দেববর্মণ, আব্বাসউদ্দিন। রবীন্দ্রসঙ্গীত, পল্লীগীতি, আধুনিক গান, ভক্তিগীতি – যা পাচ্ছি তাই। এছাড়াও সুনীলদার সংগ্রহে ছিল হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতের বিশাল ভাণ্ডার। সেদিকে তখন হাত বাড়াতাম না, কেননা খুব একটা বুঝতাম না সেসব। তবে সুনীলদা যে বেশ সমঝদার সঙ্গীতপ্রেমী এটুকু বুঝতাম।

    বছর দুয়েক এভাবে চলার পর আমার নজর পড়ল মেঝেতে রাখা দম দেওয়া গ্রামোফোনটার ওপর। সুনীলদাকে জিগ্যেস করলাম, “এটা কি এখনও বাজে? এর তো অন্যরকম রেকর্ড, মোটা মোটা ভারী শেল্যাকের রেকর্ড, পিনও আলাদা। এতে বাজানোর রেকর্ড কিছু আছে?” সুনীলদা হাসতে হাসতে বললেন, “বাজবে না কেন? আলবাত বাজে। পিনও আছে স্টকে, বাগবাজার থেকে কিনে আনি। তোমার ওই কাঠের আলমারির সিলেবাস শেষ? তাহলে এসো, আমার সঙ্গে ধরো, হারমোনিয়ামটা একটু নামাতে হবে।”

    ডিভানের ওপর থেকে হারমোনিয়াম আর তবলা-টবলা নামিয়ে ফেলে চাদর আর গদিটা সরিয়ে সুনীলদা প্লাইউডের ঢাকনাটা উঠিয়ে দিলেন। দেখি ডিভানের ভেতরের বক্সের মধ্যে থরে থরে সাজানো গ্রামোফোন রেকর্ড। সেই পুরনো ভারী ভারী ৭৮ আর পি এমের রেকর্ড। আর কী সাংঘাতিক সব কালেকশন! মনে হয় একটার পর একটা শুধু শুনেই যাই। আমার উৎসাহ আর উল্লাস দেখে সুনীলদা বললেন, “আরও আছে, ভেতরের ঘরে। চলো তোমায় দেখাই।”

    সুনীলদার পেছন পেছন ওনার শোবার ঘরে ঢুকলাম। সে ঘরে একটা বিশাল টিনের সিন্দুক মতো রাখা, ওপরের ডালাটা খোলা। ভেতরে ডাঁই করে রাখা শুধু রেকর্ড আর রেকর্ড। এছাড়া দুটো বইয়ের র‍্যাকে ভর্তি শুধু সঙ্গীত বিষয়ক বই। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতচিন্তা, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, অমিয়নাথ সান্যাল থেকে শুরু করে সুধীর চক্রবর্তী পর্যন্ত। এছাড়া রাগসঙ্গীতের ওপর অনেক হিন্দি ইংরেজি বই আর অজস্র পত্রপত্রিকা।

    সুনীলদা বললেন, “বাইরের ঘরটা হল বাইরের ঘর। যারা আরও গভীরে যেতে চায় তাদের জন্য ভেতরের ঘর। তোমার ভেতরে যাবার উৎসাহ আছে দেখে নিয়ে এলাম।”

    সেই দিন থেকে সুনীলদার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বয়সের ফারাকটা আর কোনও ফারাকই রইল না। গান নিয়ে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারতাম। ফাঁকে ফাঁকে শুনে যেতাম একের পর এক রেকর্ড। দিলীপ রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কানন দেবী, পাহাড়ি সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় এনাদের গান প্রথম শুনেছিলাম সুনীলদার বাড়িতেই। তারপর শুনলাম গওহর জান, ইন্দুবালা, আঙ্গুরবালা, কমলা ঝরিয়া।

    কৌতূহলবশত একের পর এক সব রেকর্ডই শুনে যেতাম ঠিকই, কিন্তু সব যে আমার খুব একটা ভালো লাগত সেরকম নয়। একদিন গওহর জানের একটা রেকর্ড শুনতে শুনতে বেফাঁস বলে ফেললাম, “গলাটা খুব জোরালো, কিন্তু রেকর্ডিং-এর যা ছিরি!”

    সুনীলদা বললেন, “ঠিকই বলেছ। তখনকার রেকর্ডিং তো এত উন্নত ছিল না। সবে শুরু হয়েছে। মাইক্রোফোনের ব্যবহার শুরু হয়নি। একটা চোঙের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে গান করতে হত। তাও গলার জোয়ারিটা ঠিকই বোঝা যায়। তবে ভাগ্যি ভালো যে রেকর্ডিং হয়েছিল, তাই গওহর জানের গলাটা কেমন ছিল সেটা অন্তত আমরা বুঝতে পারছি। বাকিটা কল্পনা করে নিতে হয়। তার আগের যুগের মানুষদের গলা কেমন ছিল সেটা তো আর জানারও কোনও উপায় নেই। এই একটা ব্যাপারে মানুষ বড্ড দেরি করে ফেলেছে। লেখার পদ্ধতি তো হাজার হাজার বছর আগে চালু হয়েছে, ক্যামেরা আসার আগে মানুষ ছবি এঁকে রাখতে পারত, সুর ধরে রাখার জন্য স্বরলিপি ছিল, কিন্তু স্বর ধরে রাখার বেলায় মানুষ কেন যে এত গড়িমসি করল! গ্রামোফোন কোম্পানি কলকাতায় রেকর্ডিং শুরু করে ১৯০২ সালে। তার চেয়ে আর তিরিশ বছর আগেও যদি ব্যাপারটা শুরু হত তাহলে কী মারাত্মক হত বলো দেখি! বিবেকানন্দের গান আমরা শুনতে পেতাম। অথবা ধরো তরুণ বয়সের রবীন্দ্রনাথের গলা। বিবেকানন্দ যখনই রামকৃষ্ণদেবের কাছে যেতেন ঠাকুর প্রথমেই বলতেন – এই তো নরেন এসে গেছে, এবার একটা গান শোনা। নিশ্চয়ই খুব ভালো গাইতেন। অথচ আমাদের সেটা শোনার আর কোনও উপায় নেই। আগেকার দিনে কত নামকরা কীর্তনিয়া ছিলেন, টপ্পা গাইয়ে ছিলেন। সেগুলো যদি একবার শোনা যেত! একবার কল্পনা করে দেখ তো, শ্রীচৈতন্যদেব ভক্তদের সঙ্গে দলবেঁধে উদ্বাহু হয়ে পাগলের মত গাইতে গাইতে নগরসংকীর্তনে বেরিয়েছেন, আর আমরা আজ এখানে বসে সেটার রেকর্ডিং শুনছি।”

    বোঝো ব্যাপার! এই হচ্ছেন সুনীলদা। সুনীলদার ওখানে শুনে শুনে আমি হিন্দুস্থানী রাগসঙ্গীতেও ইন্টারেস্ট পেয়ে গেলাম। খেয়াল, ঠুমরী, টপ্পা সব শুনতে আরম্ভ করলাম। সেতার, সরোদ, বাঁশি, সানাই কিছুই বাদ রইল না। এক রোববার সকালে সুনীলদার হলঘরে বসে ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের ‘জাগো আলোক লগনে’ গানটি শুনছি। তারপর রেকর্ড ঘেঁটে ঘেঁটে চালালাম ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর গলায় ‘রামকেলি’। সুনীলদা দোতলা থেকে সকালের জলখাবার খেয়ে নেমে এসে শুনতে শুনতে গোঁফের ফাঁকের মুচকি হাসিটা হেসে বললেন, “এসব ঠিকঠাক শুনতে হলে তোমাকে লাইভ প্রোগ্রাম শুনতে হবে। রেকর্ডে অর্ধেকও ধরা পড়ে না। র‍্যাকের ওপর ওই বইটা আছে, নামাও দেখি। সন্তোষ সেনগুপ্তের লেখা ‘আমার সঙ্গীত ও আনুষঙ্গিক জীবন’। গ্রামোফোন কোম্পানির একজন বড়কর্তা হয়ে তিনি লিখছেন, কমবয়সে দেবব্রত বিশ্বাসের গলা এমন একটা দরাজ, বিশাল আর সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল যে গ্রামোফোন কোম্পানির বাপের সাধ্যি নেই তা রেকর্ডে ধরে রাখে।”

    বললাম, “আপনি অনেক লাইভ প্রোগ্রাম শুনেছেন, না?”

    “এককালে অনেক শুনেছি। নেশাগ্রস্তের মতো এই মিউজিক কনফারেন্স থেকে ওই মিউজিক কনফারেন্সে দৌড়ে বেড়াতাম। এখন আর যাই না।”

    “যান না কেন?”

    “এব্যাপারে আমি আমার মেয়ের মতো (সুনীলদার মেয়ের অনেকদিন বিয়ে হয়ে গেছে)। আমার মেয়ে ছোটোবেলায় ইলিশ এত ভালবাসত যে ইলিশ মাছ খাওয়ার পর মুখ ধুতো না, জিভ থেকে স্বাদ চলে যাবে এই ভয়ে। আমিও আমার কানে যেটা লেগে আছে সেটা সযত্নে বাঁচিয়ে রাখতে চাই ভাই।”

    সুনীলদার কথায় উৎসাহ পেয়ে আমিও লাইভ প্রোগ্রাম আর মিউজিক কনফারেন্সে যাওয়া শুরু করলাম। ফৈয়াজ খাঁকে আর পাব কোথায়! তবু চাকরিবাকরি সামলে যেটুকু ম্যানেজ করতে পারতাম কলকাতার নানা প্রেক্ষাগৃহে ক্লাসিকাল মিউজিকের অনুষ্ঠানগুলো শোনার চেষ্টা করতাম।

    সুনীলদাকে তবলায় ঠেকা দিতে দেখেছি কয়েকদিন, কিন্তু কোনোদিন কোনও গান বা সুর গুনগুন করেও গাইতে শুনিনি। ওনার গলার আওয়াজটা একটু ভাঙা ভাঙা, ঘড়ঘড়ে, উচ্চারণও জড়ানো। একদিন একটু মজা করার জন্যই বললাম, “সুনীলদা, আপনি যে এত গান ভালোবাসেন, নিজে কোনোদিন গাইতেন না? নিজের ভেতরে সুর না থাকলে কি ঠিকঠাক সুরের কদর করা যায়?”

    সুনীলদা তাঁর পেটেন্ট মুচকি হাসিতে খোঁচাটা ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ ব্লক করে বললেন, “গাইতাম কী বলছ গো? এখনও তো গাই! তবে শুধু বাথরুমে। বাইরে গাইলে প্রতিবেশীরা ভাববে সুনীলবাবু নিশ্চয়ই এবারে মঙ্গলগ্রহ থেকে রেকর্ড কিনে এনেছেন।”

    তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “এককালে একটু-আধটু গাইতাম আমিও। তেমন কিছু নয়। শচীনকর্তাকে নকল করার চেষ্টা করতাম। তারপর একবার মকর সংক্রান্তির প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় গানের খোঁজে হরিদ্বারের কুম্ভমেলায় গিয়ে ঘোরাঘুরি করে একসাথে ব্রঙ্কাইটিস, ফ্যারেঞ্জাইটিস, নিউমোনিয়া এসব বাধিয়ে এলাম। গলাটারও চিরতরে বারোটা বেজে গেল।”

    “গানের খোঁজে কুম্ভমেলায়? ইন্টারেস্টিং! কুম্ভমেলায় তো লোকে পুণ্য করতে যায়, ভগবানের খোঁজে!”

    “ভগবানের খোঁজেও বলতে পারো। যার যা ধর্ম আর কি! কেউ খোঁজে আল্লা, কেউ খোঁজে হরি, আমি খুঁজি গান। আমার ধর্ম হল সঙ্গীত, পৃথিবীর সবচেয়ে সনাতন, সবচেয়ে সর্বজনীন ধর্ম।”

    “তা ভগবানের দেখা পেয়েছিলেন?”

    “পাইনি মানে? সেবারে ভগবানকে ধরে একেবারে বন্দী করে এনেছিলাম, ক্যাসেট বন্দী। হৃষীকেশে সেবার এক সাধুর দেখা পেয়েছিলাম, ভোরবেলায় গঙ্গাতীরে বনের ধারে বসে গাইছিলেন। তার কী গলা গো! মনে হল যেন হিমালয় পর্বতটাই গান গাইছে। তখন আমার কাঁধের ঝোলায় সবসময় গ্রুন্ডিগ-এর টেপ রেকর্ডারটা থাকত। টেপ করে ফেললাম।”

    “সে ক্যাসেট আছে এখনও? শোনা যায়?”

    সুনীলদা একটু মুচকি হেসে বললেন, “শুনবে? শোনাই তবে। তোমাকে ভেতরের ঘরে ডেকে নিয়েছি, এবার মণিকোঠাটাও দেখাই।”

    এই বলে সুনীলদা ভেতরের ঘর থেকে একটা মাঝারি মাপের চামড়ার সুটকেস বার করে আনলেন। খোলার পর দেখি সেটার ভেতরে কুড়ি-পঁচিশটা পুরনো আমলের স্পুল টাইপ ক্যাসেট। একটা ক্যাসেট খুঁজে বার করে সুনীলদা গ্রুন্ডিগ-এর টেপ রেকর্ডারটা বার করলেন। সাধুবাবার গলা বেজে উঠল। ভৈরবীতে একটা ভজন।

    সুনীলদার মুড এসে গেছে। বলে চললেন, “ভারতবর্ষের আসল গান শুনতে হলে তোমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। রেকর্ডের গান তো সবে একশ দশ বছর হল। আমাদের দেশের আকাশে বাতাসে যে সব গান আবহমান কাল ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে সেগুলোর দেখা তুমি হাটে, মাঠে, নদীতে, মেলায় না ঘুরলে পাবে না। এই যে আমরা স্বর্ণযুগের গান, স্বর্ণযুগের গান বলে এত লাফালাফি করি, আমিও শুনি সে গান, কিন্তু একটু চিন্তা করে দেখো তো, সেগুলো সবই পেশাদার গীতিকারের ফরমায়েশি লেখা, পেশাদার সুরকারের সুর করা, দমবন্ধ স্টুডিওয় রেকর্ড করা, মানুষের মনোরঞ্জনের খাতিরে, ব্যাবসার জন্য। সেসবকে কি আর ঠিকঠাক জীবনের গান বলা চলে?”

    চুপচাপ শুনছিলাম। গলাটা ভালোই। গম্ভীর, দরাজ। রেকর্ডিং খুব একটা ভালো নয়। গঙ্গার জলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে ভালোই লাগছে, তবে ‘হিমালয় পর্বত গাইছে’ বা ‘ভগবানের গান’, আমার শুনে সেরকম কিছু মনে হল না। চামড়ার সুটকেসটা ঘাঁটাঘাঁটি করছিলাম। প্রতিটা ক্যাসেটের ওপর সুনীলদা খুব যত্ন করে লেবেল সেঁটে রেখেছেন। কার গান, কোথায় কবে রেকর্ড করা, সেসব লেখা আছে। অনেক লাইভ প্রোগ্রামের রেকর্ডিং আছে। বড় বড় শিল্পীর। রেকর্ডিং-এর সময়ের বিস্তার প্রায় তিরিশ বছর জুড়ে। আর জায়গার মধ্যে বেনারস, এলাহাবাদ, লখনউ, হরিদ্বার, হৃষীকেশ, রাজস্থান; বাংলার জয়দেবের কেঁদুলি, নবদ্বীপ, কোচবিহার; আসামের বিভিন্ন জায়গা, ত্রিপুরা, এমনকি বাংলাদেশের কুমিল্লা, ফরিদপুর পর্যন্ত আছে।

    বললাম, “আপনি তো দেখছি গানের খোঁজে দুনিয়া চষে ফেলেছেন। এসব তো অমূল্য জিনিস, রত্নভাণ্ডার। এগুলোকে এভাবে সুটকেসে বন্ধ করে রেখেছেন! কোনও রেকর্ডিং কোম্পানির নজর পড়লে তো তারা হাতে চাঁদ পাবে।”

    “তোমায় বলেছে! রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোর আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই কিনা! আরে ভাই, কটা লোকের এসবে উৎসাহ আছে? তোমার আছে, তাই তোমায় দেখালাম। মার্কেট ভ্যালু বলতে যা বোঝায়, এই সুটকেসটার তা এক কানাকড়িও নেই। আর, সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাতেও আমার বয়েই গেছে। আমি সারাজীবন গানের খোঁজে কাটিয়ে দিয়েছি, নিজের কানদুটো ধন্য করে নিয়েছি, ব্যাস ফুরিয়ে গেল। আমার মৃত্যুর আগে সুটকেসটা ওই পুকুরের জলে ফেলে দেব। যাক গে, এবারে এই ক্যাসেটটা শোনো। বেনারসের হিন্দু ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতর একটা বিশ্বনাথের মন্দির আছে। তার দোতলায় চট পেতে বসে এক বুড়ো অন্ধ ভিখিরি খালি গলায় ভজন গাইছিলেন, কেদার রাগে, সঙ্গে বসে তাঁর ন-দশ বছরের ছোট্ট নাতনী করতাল বাজাচ্ছিল। মন্দিরের বিশাল উঁচু ছাদে ধাক্কা খেয়ে সেই ভিখিরির গলা প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, গমগম করছিল। সে কী স্বর্গীয় সুর! মন্দিরে শয়ে শয়ে লোক আসে; বাচ্চা, বুড়ো, মহিলা, পুরুষ। কেউ টুঁ শব্দ করছিল না, পা টিপে টিপে হাঁটছিল। একটু শব্দ করলেই যদি তাল কেটে যায়, গান থেমে যায়, ভগবান পালিয়ে যান।”

    সুনীলদা আগের ক্যাসেটটা পালটে নতুন ক্যাসেট লাগিয়ে দিলেন।

    সুনীলদার সঙ্গে আমার যে কোনোদিন মতের অমিল হয় না তা নয়। একটা ব্যাপারে সুনীলদার বেশ গোঁড়ামি আছে। উনি পাশ্চাত্য সঙ্গীত একেবারেই পছন্দ করেন না। আমি বাড়িতে ইংরিজি গানও শুনতাম। জিম রিভস, জন ডেনভার, ক্লিফ রিচার্ডস, পল রোবসন ইত্যাদি। ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালও শুনতাম। বিঠোভেন, বাখ, মোজার্ট – বুঝি না বুঝি শুনতাম সবই। অথচ পাশ্চাত্য সঙ্গীত নিয়ে সুনীলদাকে কিছু বলতে গেলেই উনি বলতেন, “দূর, ওর মধ্যে আছে কী? ও তো সিঁড়িভাঙা অঙ্ক!”

    এমনিতে সুনীলদা বেশ খোলামনের লোক। প্রাচীনপন্থী একেবারেই নন। পুরনো সবকিছুই ভালো, আর নতুন মানেই খারাপ, সেটা সুনীলদা মানেন না। ওনাকে অনেকবার বলতে শুনেছি তিরিশ-চল্লিশের দশকের রবীন্দ্রসঙ্গীতের চেয়ে পঞ্চাশ-ষাটের দশকের রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড অনেক ভালো। অথচ হাল আমলের বাংলা গান নিয়ে সুনীলদার তেমন কোনও উৎসাহ দেখি নি। ১৯৯২-তে বাংলা গানের ধারাটাকেই ঘাড় ধরে পালটে দিলেন সুমন। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে সুমন তখন একটা ঘূর্ণিঝড়ের মত, ওঁর সমস্ত প্রোগ্রামে হুলুস্থুলু ভিড়। সুনীলদাও দেখতাম সুমনের ক্যাসেট কিনতেন। কিন্তু ওই নিয়ে কিছু আলোচনা করতে গেলে হুঁ হাঁ করে এড়িয়ে যেতেন। একবার সরাসরি জিগ্যেস করলাম, “সুনীলদা, সুমনের গান আপনার কেমন লাগে?” সুনীলদা প্রথমে ‘ভালোই তো’ বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। “ওটা কোনও উত্তর হল না, একটু খোলসা করে বলুন”, বলে চেপে ধরাতে বললেন, “সুমন বড্ড সিনিক। সঙ্গীত হল সুন্দরের উপাসনা। তবে ওর কয়েকটা গান আমার বেশ লাগে। যেমন – বাঁশুরিয়া বাজাও বাঁশি দেখি না তোমায়, গেঁয়ো সুর ভেসে বেড়ায় শহুরে হাওয়ায়।”

    আধুনিকতা নিয়ে এরকম একটা স্ববিরোধ সুনীলদার মধ্যে দেখি। সঙ্গীত নিয়ে ভারতীয়ত্বের বা প্রাচ্যের গণ্ডী উনি পেরোতে রাজি নন, অথচ বলেন সঙ্গীত হল সর্বজনীন ধর্ম। পুরনো সবই ভালো সেটা মানেন না, কিন্তু গান নিয়ে ওনার ভালোবাসা মেরেকেটে সেই সত্তরের দশক অবধি এগিয়ে তারপর থমকে গেছে। হিন্দি ফিল্মের গানের ক্ষেত্রেও দেখেছি পুরনো সুরকাররা – নৌসাদ, সি রামচন্দ্রন, ও পি নাইয়ার, এস ডি বর্মণ ওনার খুব প্রিয়। হেমন্ত, শঙ্কর-জয়কিষেণ, সলিল চৌধুরী এঁরাও। আর ডি বর্মণ? কিছু কিছু গান। এ আর রহমান? নৈব নৈব চ।

    বছর পাঁচেক আগে একদিন রাতে হঠাৎ সুনীলদার ফোন। আমি যেন সামনের শনিবার সন্ধেবেলা অতি অবশ্যই তাঁর বাড়ি যাই, রাতে তাঁর বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করতে হবে, থাকতেও হবে। খাওয়াদাওয়া করার পর দাদার বাড়ি চলে গেলে চলবে না।

    বেশ কৌতূহল নিয়ে গেলাম। “ব্যাপার কী, সুনীলদা?”

    “আরে বলব বলব, এত তাড়া কিসের? সবাই চলে যাক আগে।”

    সেদিন সুনীলদার নাতনীর জন্মদিন উপলক্ষে কয়েকজন নিমন্ত্রিত ছিলেন। আমার দাদা-বৌদিও ছিলেন। খাওয়াদাওয়ার পর সবাই চলে গেলে আমি আর সুনীলদা হলঘরটার শতরঞ্চিতে দুটো কোলবালিশ ঠেসান দিয়ে আরাম করে বসলাম। ঘরের বড় আলোগুলো নিভিয়ে দিয়ে শুধু একটা নীল রঙের নাইটল্যাম্প জ্বালিয়ে সুনীলদা বললেন, “তুমি বেনারসের বড়ী মোতি বাঈয়ের নাম শুনেছ? ঠুমরীর সম্রাজ্ঞী বলা হত যাঁকে? রেবা মুহুরীর লেখা ‘ঠুমরী ও বাঈজী’ পড়েছ?”

    বইটা আমার পড়া ছিল। বললাম, “পড়েছি। বেনারস ঘরানার ঠুমরী। সেরেছে! আপনি কি তাঁর রেকর্ড জোগাড় করেছেন নাকি? কিন্তু যদ্দূর জানি তাঁর গানের তো কোনও রেকর্ড নেই! হয় নি কোনোদিন!”

    “ঠিকই বলেছ। রেকর্ড কোনোদিন হয়নি ঠিকই। তবে উনি নিয়মিত রেডিওয় গাইতেন। আমার এক বহুদিনের বন্ধু বেনারসে থাকে। তাঁর জামাই, সেও বেনারসে থাকে, কাজ করে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে – সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। তাঁকে ধরেছিলাম বড়ী মোতি বাঈয়ের কোনও স্টুডিও রেকর্ডিং ওদের আর্কাইভে পাওয়া যায় কিনা খুঁজে দেখতে। সে ব্যাটা কাজের ছেলে আছে। চারটে সেশনের রেকর্ডিং ছিল, একটা সিডি করে আমায় পাঠিয়ে দিয়েছে।”

    “বলেন কী? এতদিন সেগুলো বেনারসের রেডিও স্টেশনে পড়ে পড়ে পচছে?”

    “বেনারসে নয়। বড়ী মোতি যখন গান গাইতেন তখনও বেনারসের রেডিও স্টেশন হয়নি। ওঁকে নিয়ে যাওয়া হত এলাহাবাদের রেডিও স্টেশনে। গানগুলো সেখানেই পাওয়া গেছে।”

    টেবিলের ওপর রাখা সোনির সিডি প্লেয়ারে সুনীলদা সিডিটা চালিয়ে ফের আয়েস করে বসলেন। বললেন, “নাইটল্যাম্পের আলোটাকেই পূর্ণিমার চাঁদের আলো কল্পনা করে নাও।”

    বড়ী মোতির অসাধারণ গলায় আরম্ভ হল তার বিখ্যাত ঠুমরী –

    ‘বুলাকে পরদেশমে চলে গ্যয় ছঁলিয়া
    আজি এ রাত যৌবন মদমস্ত ভারী’
    গানটা শেষ হবার পর সুনীলদা উঠে সিডি প্লেয়ারটা পজ করে রেবা মুহুরীর বইটা নিয়ে এলেন। “এই গানটা শুনে রেবা মুহুরীর কী মনে হয়েছিল শোন। ‘মনে হল – এইরকম চাঁদনী রাতে নদীর ধারে বসে আছি। আর গানের সুরবিস্তার নদীর ঢেউয়ের মতো ধীরে ধীরে, ঘুরে ঘুরে খালি যাতায়াত করছে।’”

    সারারাত আমরা বড়ী মোতির ঠুমরী শুনলাম। ‘না যাও বালম পরদেশ বা’, ‘বাজুবন্ধ খুল খুল যায়ে’। একই গান বারবার করে শুনলাম। তারপর ভোর সাড়ে চারটের সময় যখন বাইরে অল্প অল্প আলো ফুটতে শুরু করেছে, সুনীলদা নাইটল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে চালালেন একটা ভজন। রাগ ভৈরবীতে –

    ‘শিব পার কর মোরে নেইয়া
    আল্লা পার কর মোরে নেইয়া’
    একবার শোনার পর রিপ্লে টিপে সুনীলদা বললেন, “বড়ী মোতির শেষ জীবনটা কল্পনা করো। বৃদ্ধা হয়েছেন, রূপযৌবন চলে গেছে, কেউ আর পোঁছে না। একটা গোয়ালঘরে কোনওমতে দিন কাটান। পায়ে ফাইলেরিয়া, ভালো করে হাঁটতে পারেন না। কল্পনা করে নাও বেনারসের কেদার ঘাট। ভোরবেলা আলো সবে ফুটছে। বড়ী মোতি স্নান করে উঠে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেরিয়ে ঘাটের সিঁড়িতে বসেছেন। পাশে রাখা পেতলের ঘটিতে গঙ্গাজল। ভিজে চুল পিঠে ছড়িয়ে দেওয়া। সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়ে তিনি এই ভজনটি গেয়ে চলেছেন। ওনার দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পড়ছে জলের ধারা। এরপরেরটুকু রেবা মুহুরী তাঁর বইতে লিখেছেন – খুলে গেল অজস্র ঝর্নার মুখ, জ্বলে উঠল আলো, পৃথিবীতে দৈববাণী প্রচারিত হল।”

    সে রাতে বড়ী মোতির গান শুনে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম। তবে রেকর্ডিং কোয়ালিটি খুব একটা ভালো নয়। প্রচুর নয়েজ। পরদিন ফোন করে সুনীলদাকে সেটা বললাম। সুনীলদা বললেন, “আজকাল তো কম্পিউটারে সফটওয়্যার দিয়ে নয়েজ বা ডিস্টার্বেন্স রিমুভ করা যায়। পুরনো গানের সিডিতে দেখি লেখা থাকে ডিজিটালি রিমাস্টার্ড। তোমার তো অনেক জানাশোনা। দেখো না কিছু করতে পারো কিনা।”

    বললাম, “আমার এক বন্ধু জয়ন্ত এসব কাজ করে, দমদমে থাকে। তাকে বলে দেখছি। ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি আপনাকে কন্ট্যাক্ট করে নিতে। আপনি ভালো করে বুঝিয়ে দেবেন। তবে ভুল করেও কিন্তু ওকে আপনার অরিজিনাল সিডিটা দিয়ে দেবেন না। বলবেন কপি করে নিয়ে যাও।”

    এর প্রায় বছর দেড়েক পরে আবার একদিন সুনীলদার উত্তেজিত ফোন। এর মাঝেও অবশ্য আমি সুনীলদার ওখানে গেছি। তবে যাওয়াটা তখন বেশ কমে গেছে। পুরনো অনেক মিউজিক, যেগুলো আগে ৭৮ আর পি এমের রেকর্ড ছাড়া শোনা যেত না, তখন সিডিতে বেরিয়ে গেছে। সেসব সিডি আমি সংগ্রহ করতে শুরু করেছি। অফিসে আমার দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। লাইভ প্রোগ্রাম শোনার ফুরসৎ পাই না। বাড়িতেই সিডি প্লেয়ারে গান শুনি। তবে গ্রামোফোনে গান শোনার মেজাজটাই আলাদা, ভালো কোয়ালিটির সিডি শুনেও সে মেজাজ আসে না। সেই মৌতাতেই মাঝে সাঝে সুনীলদার হলঘরে হানা দেই।

    সুনীলদা ফোন করে বললেন, “আবার একটা শিকার ধরেছি। জব্বর শিকার। রোববার দিন অতি অবশ্যই চলে এস।”

    গেলাম। বললাম, “এবার আবার কার রেকর্ডিং উদ্ধার করলেন? কোন বাঈজির?”

    “আরে বাঈজি-টাঈজি নয়। আমাদের বাংলারই এক অতি সাধারণ মহিলা। একজন সনাতন গৃহবধূ। এখনও জীবিত। তিরানব্বই বছর বয়স। এই বয়েসেও কী গলা গো! না শুনলে বিশ্বাস করতে পারবে না। বয়েসকালে যে কী ছিল ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আর কী সব গান! বাপের জন্মে কোনোদিন শুনিনি।”

    “এনার খোঁজ পেলেন কোথায়? নাম কী?”

    “আমার নাতনীর সঙ্গে খেলতে আসে ওর এক বান্ধবী। তার মা সন্ধেবেলা এসে তাকে বাড়ি নিয়ে যায়। এই পাড়াতেই থাকে, অল্পস্বল্প গান-টান করে। আমার মেয়ের মত বয়েস। তার কাছে একদিন হঠাৎ একটা অদ্ভুত গান শুনলাম। গানের কথাগুলো এরকম –

    ‘কলির ভাবরঙ্গ দেইখে মইরে যাই/ ও কলির ভাবরঙ্গ দেইখে মইরে যাই।
    পরনে মোর ছিঁড়া ত্যানা/ নাই একপয়সার চিকদানা/ কথা কইলে ক্যান শুন না চানকপালির ভাই
    কলির ভাবরঙ্গ দেইখে মইরে যাই।
    আইচ্ছা বউদির মাইজঝা মাইয়া/ দাউদে গ্যাসে গতর খাইয়া/ চুল ছোপাইসে মেন্দি দিয়া ঢকের কানাই
    কলির ভাবরঙ্গ দেইখে মইরে যাই।’

    জিগ্যেস করলাম, এই গান তুমি কোথায় শুনলে? বলল ওর ঠাকুমা গায়, তিরানব্বই বছর বয়েস, বাগুইহাটিতে থাকে। বললাম চলো একদিন তোমার ঠাকুমার গান শুনতে যাবো। মেয়েটি তো খুব খুশি। আমার গ্রুন্ডিগটা দিয়ে তো আর চলবে না, ওটার ক্যাসেট আর পাওয়া যায় না। সোনির অত বড় গাবদা ক্যাসেট-সিডি প্লেয়ারটাও নিয়ে যাওয়া মুশকিল। তাই একটা ছোট্ট সোনির ওয়াকম্যান কিনে ফেললাম, রেকর্ডিং করা যায়।

    গেলাম একদিন বাগুইহাটি। ভদ্রমহিলার নাম হাস্যবালা মুখার্জী। কোনোদিন নাম শুনিনি। দেশের বাড়ি ছিল ফরিদপুর, শ্বশুরবাড়ি। সাতচল্লিশে এদেশে চলে এসেছেন। ওদেশে আশেপাশের গ্রামে গায়িকা হিসেবে বেশ নাম ছিল বললেন। এ গ্রাম ও গ্রামের বিয়েবাড়ি থেকে বিয়ের গান গাওয়ার জন্য ওনাকে ধরে নিয়ে যেত। একবার শ্যামাসঙ্গীত গায়ক হীরালাল সরখেল নাকি কোন এক বিয়েবাড়িতে ওনার গান শুনেছিলেন, খুব প্রশংসা করেছিলেন। অনেক গান শোনালেন। বয়েস হলে হবে কি! স্মৃতিশক্তি এখনও পাক্কা। তবে বেশিক্ষণ দম রাখতে পারেন না। পরপর তিনদিন গিয়ে প্রচুর গান রেকর্ড করে এনেছি। শোনো চালাই।”

    সুনীলদার কথা শুনতে শুনতেই আমার চোখ চলে গেছিল ডিভানের ওপর রাখা একটা সিডির ওপর। দেখি বড়ী মোতি বাঈয়ের সিডি। পেছন দিকটা পড়ে দেখি সেই তিনটে ঠুমরী আর একটা ভজন, যেগুলো সুনীলদা জোগাড় করেছেন, ‘মাইহার মিউজিক’ বলে একটা কোম্পানি থেকে বেরিয়েছে। খুব আনন্দ হল দেখে। বললাম, “বাঃ, এটা একটা কাজের কাজ করেছেন। বড়ী মোতির গান সবার শোনা উচিত। কিন্তু সৌজন্যে তো আপনার নাম দেখছি না?”

    “আমি তো করিনি! করেছে তোমার বন্ধু জয়ন্ত। এটা পড়ে দেখো। আমি তো এটা পড়েই কিনলাম,” বলে সুনীলদা একটা ইংরিজি ম্যাগাজিন আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। দেখি ওতে জয়ন্ত বড়ী মোতির ওপর একটা আর্টিকল লিখেছে, সিডিটার একটা প্রোমোশনাল আর্টিকল। বড়ী মোতির জীবন, কোথায় তাঁর গানের রেকর্ডিং পাওয়া গেল, সবই লিখেছে, কিন্তু সুনীলদার কোনও উল্লেখ নেই। লজ্জায় আমার মুখটা চুপসে গেল।

    সুনীলদা ব্যাপারটা আঁচ করে বললেন, “ভালোই তো করেছে। বড়ী মোতির গান সত্যিই সবার শোনা উচিত। আমার দ্বারা কস্মিনকালেও এ কাজ হত না। আমার কন্ট্যাক্টস কোথায়? নয়েজ রিডাকশনটাও ভালোই করেছে, তবে তারপর আবার সর্দারি করে ইকো-টিকো অ্যাড করে গানগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। অরিজিনাল সিডি এখনও আমার কাছেই আছে, সেটা অনেক ভালো। যাক গে ওসব ছাড়ো। এখন এনার গান শোনো।”

    সুনীলদা ক্যাসেটে হাস্যবালা দেবী চালিয়ে দিলেন। তিন-চারটে শ্যামাসঙ্গীত শুনলাম। ‘সাধে কি করুণাময়ী’, ‘কোন হিসাবে হরহৃদে’, তারপর ‘আমি মা মা বলে আর ডাকব না’। খুব মিষ্টি সুরেলা গলা। তারসপ্তকে উঠলে গলা ফলসেটোতে চলে যাচ্ছে, তবে সেটা হয়তো বয়সের জন্য; সুরের কোনও খামতি নেই। খুব দরদ দিয়ে গাওয়া। তিরানব্বই বছর বয়সে এরকম গাওয়া, সত্যিই ভাবা যায় না।

    সুনীলদা বললেন, “এগুলো তো তবু শোনা গান, এবারে একটা পল্লীগীতি শোনো।” বাজালেন ‘যখন তখন বাজাও বাঁশি মন তো মানে না রে কালা, সময় বুঝ না’। শুনেই বললাম, “এ তো শচীনকর্তার গান, শোনা গান।” সুনীলদা গোঁফের ফাঁকের মুচকি হাসিটা দিয়ে বললেন, “আরে শোনোই না। আমিও প্রথম শুনেই ওকথা বলেছিলাম। তাতে হাস্যবালা দেবী বললেন শচীনকর্তার গানটা উনি শোনেননি, এটা ওনাদের এলাকার খুবই প্রচলিত গান। শচীনকর্তা হয়তো ওখান থেকেই জোগাড় করেছিলেন। শচীনকর্তা তো শুধু দু’টো স্ট্যানজা গেয়েছেন, হাস্যবালা দেবী অনায়াসে সাত-আটটা স্ট্যানজা গেয়ে দিলেন। পুরোটা শুনলেই বুঝতে পারবে এটাই অরিজিনাল। এরপর যেগুলো শোনাবো সেগুলো তুমি কেন, আমিও কোনোদিন শুনিনি।”

    পরের প্রায় দু’ঘন্টা ধরে সুনীলদা বাজিয়ে চললেন হাস্যবালা দেবীর গাওয়া একের পর এক সব অশ্রুতপূর্ব গান। সব একেবারে বাংলার মাটির গান। গৌরবন্দনা, বিয়ের গান, ব্রতকথার গান, ছড়ার গান, পাঁচালির গান, তরজার গান, যাত্রাপালার গান – আরও কত কী!

    “এগুলোই বাংলার আসল গান, বুঝলে। রেকর্ডে আর কী শোনা যায়? কটা লোক আর রেকর্ড করার সুযোগ পেয়েছে? সে সুযোগ পেতে গেলে যোগাযোগ লাগে, শহরে আসতে হয়, ভাগ্য লাগে। আমাদের গ্রামের লোকেদের দ্বারা কি সেসব সম্ভব ছিল? বিশেষ করে যাঁরা মহিলা? মুসলমান মেয়েদের অবস্থা তো আরও খারাপ ছিল। আমাদের পল্লীবাংলার সনাতন গৃহবধূদের মধ্যে যে কত অসাধারণ শিল্পী লুকিয়ে ছিলেন, কে তার খোঁজ রাখে? আর, তাঁদের রেকর্ড করতে বয়েই গেছে। তাঁরা নিজের আনন্দে গান গাইতেন, রান্না করতে করতে, আলপনা দিতে দিতে, পুজো করতে করতে। শিল্পী নিজের মনে শিল্পসৃষ্টি করে যান। তোমার যদি গরজ থাকে তোমাকে শিল্পীর কাছে পৌঁছতে হবে, উনি নিজে থেকে তোমায় ধরা দেবেন না।”

    এরপর কিছুদিন সুনীলদা আবার গান শিকারের নেশায় তেড়েফুঁড়ে ওঠেন। নতুন কেনা সোনির ওয়াকম্যানটা বাগিয়ে চলে যান বিহারের দ্বারভাঙ্গায়। সেও এক মজার গল্প। ছোড়দার কাছে শুনেছি। একদিন ছোড়দা আর সুনীলদা সকালে মর্নিংওয়াক সেরে ফিরছিলেন। ছোড়দা হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে দেখে পাশে সুনীলবাবু নেই। খুঁজতে খুঁজতে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দেখে এক রাস্তার মোড়ে এক বিহারী রিক্সাওয়ালা তার রিক্সার পাদানিতে বসে হাতে খৈনি ডলতে ডলতে কী একটা গান গাইছে, আর সুনীলদা ঘাপটি মেরে রিক্সার পেছনে দাঁড়িয়ে একমনে শুনে যাচ্ছেন। গান শেষ হতে সামনে বেরিয়ে এসে সুনীলদা রিক্সাওয়ালাকে ধরলেন, “ভাইয়া, ইয়ে তো মৈথিলী গানা হ্যায়। ইয়ে তুম কাঁহা শুনা? তুমহারা ঘর কাঁহা হ্যায়?”

    “জি বাবু, বিহার, দ্বারভাঙ্গা। ই তো মেরা দেশ কা গানা হ্যায়। কাঁহা জাইয়েগা বোলিয়ে বাবু।”

    ভাগ্যি ভালো সুনীলদা সেই রিক্সাওয়ালাকেই ধরে বসেন নি সোজা দ্বারভাঙ্গা নিয়ে যাবার জন্য। তবে বাড়ি ফিরে ব্যাগ গুছিয়ে পরদিনই রওনা হয়ে গেলেন দ্বারভাঙ্গা। মাসখানেক পর ফিরে এসে ক’দিন পরে আবার গেলেন বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ঘুরতে, গানের খোঁজে। বুড়ো হাড়ে এত ধকল আর অনিয়ম কি আর সয়? ফিরে আসার পর সুনীলদার একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। তারপর থেকেই দেখি উনি কিরকম একটা ঝিমিয়ে পড়েছেন। সহজে বাড়ি থেকে নড়তে চান না।

    আমারও সুনীলদার বাড়ি যাওয়া ইদানীং একদমই কমে গেছে। অফিসের চাপ। তাছাড়া এখন ইউটিউবে নতুন-পুরনো সমস্ত গানই শোনা যায়। গওহর জানের গাওয়া এশিয়ার প্রথম রেকর্ডিং থেকে শুরু করে সুমনের লেটেস্ট গান – সবই ইন্টারনেটে মজুত। সাউন্ড কোয়ালিটি অবশ্য মোটেই ভালো নয়, কিন্তু একটা কম্পিউটার আর ইন্টারনেট থাকলেই হাতের কাছে সমস্ত গান হাজির, সেটাই বা কম কথা কী?

    গত রোববার ঘরে বসে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউবে গান শুনছিলাম। হঠাৎ একটা অদ্ভুত বাউল গান শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কোনও এক মেলায় এক বাউল গান গাইছে, একজন সেটার ভিডিও রেকর্ডিং করে ইউটিউবে আপলোড করে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সুনীলদার কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল কী ঘরে বসে বসে পচে মরছি, এসব মেলায়-টেলায় না ঘুরলে, বাউল-ফকিরদের গান না শুনলে আর কিসের গান শোনা?

    সোমবার ১৪ই জানুয়ারি ছিল পৌষ সংক্রান্তি। মনে পড়ল জয়দেবের কেঁদুলিতে সেদিন থেকে বাউল মেলার শুরু। অফিস ডুব দিয়ে ঘুরে এলে হয়! সুনীলদাকে ফোন লাগালাম, “যাবেন নাকি? গাড়ি করে নিয়ে যাব, নিয়ে আসব। কষ্ট হবে না।”

    “নাহ, তুমিই যাও ভাই, ঘুরে এসো। আগে যখন যাওনি কোনোদিন, তখন একবার অন্তত যাওয়া উচিত। আমি এককালে বহুবার গেছি, এখন আর এসব ভালো লাগে না।”

    বুঝে গেলাম সুনীলদা যাবেন না। সত্যি সত্যিই বুড়িয়ে গেছেন এখন। তাই আমার বন্ধু ভাস্করকে দলে টেনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সোমবার সকালে। সঙ্গে নিলাম আমার প্যানাসোনিক ডিজিটাল রেকর্ডার আর সোনির হ্যান্ডিক্যামটা।

    বাউল মেলায় দেখলাম মেলাই হৈচৈ, বড়ই গোলমাল। গান শুনলাম অনেকই। তার মধ্যে ভগবান দাস বাউল বলে একজনের গান খুবই ভালো লাগল। টেপ করলাম। ভিডিওতেও রেকর্ড করলাম। ভাবলাম, যাক, অ্যাদ্দিনে একটা কাজের কাজ করা গেছে।

    সুনীলদাকে আগে কোনোদিন বাড়িতে টেনে আনতে পারিনি। একবার উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্রের মিউজিক কনফারেন্সে ধরে এনেছিলাম, কিন্তু সেবারও উনি আমার বাড়ি আসেননি। সারারাত গান শুনে ভোরবেলা ট্রেন ধরে ফিরে গেছেন। তাই অনেকদিন ধরেই ওনাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে এনে একটু ভালমন্দ খাওয়ানোর ইচ্ছা ছিল। ওনার বাড়িতে এত গেছি, থেকেছি, চা-শিঙাড়া খেয়েছি। তাছাড়া আমার বন্ধু জয়ন্ত বড়ী মোতি বাঈয়ের গান নিয়ে সেই বদমায়েশিটা করার পর থেকে আমার মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ খচখচ করত। অবশ্য এটাও জানতাম, শুধুমাত্র নিমন্ত্রণ করে, কোনও গানের টোপ ছাড়া, সুনীলদাকে বাড়িতে ধরে আনা মুশকিল। উনি ঠিক কোনও না কোনও অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে যাবেন। বাউল মেলা থেকে গান রেকর্ড করে এনে তাই ভাবলাম এতদিনে একটা সুযোগ পাওয়া গেছে। ফোন করে বললাম, “সুনীলদা, কেঁদুলি থেকে ভগবান দাস বাউল নামে একজনের অসাধারণ গান টেপ করে এনেছি। শুক্রবার সন্ধেবেলা চলে আসুন। আমার বাড়ি শনি-রবি দু’দিন থেকে যান। গান শোনা যাবে। এতদিন আপনি ডেকে নিয়ে গিয়ে শুনিয়েছেন, এবার আমার পালা।” সুনীলদা তা না না না করে রাজী হয়ে গেলেন।

    শুক্রবার অফিস থেকে ফেরার পথে সুনীলদাকে গাড়ি করে নিয়ে এলাম। সন্ধেবেলা চা খেতে খেতে জিগ্যেস করলাম, “এখন কী শুনছেন? ক্লাসিকাল?”

    সুনীলদা আগের চেয়ে অনেক গম্ভীর হয়ে গেছেন, কিন্তু গোঁফের ফাঁকে হাসলে পরে আবার আগের মতোই লাগে। হেসে বললেন, “আর ক্লাসিকাল! কোনটা যে ক্লাসিক সেটাই আমার গুলিয়ে গেছে ভাই।”

    “কী রকম?”

    সুনীলদা গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, “গান আর আগের মত শুনি না। কমই শুনি। যেটুকু শুনি সবই পল্লীগীতি। বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া এসব। এগুলোও অবশ্য আসল গান নয়, সবই স্টুডিওয় রেকর্ড করা। বাজনা-টাজনা বাজিয়ে লোকজনের মধ্যে বসে গাওয়া। তবু এসব গানের কথার মধ্যেই একটু বাংলার মাটির ছোঁয়া পাই।”

    “আসল গান নয় কেন বলছেন? গানের সঙ্গে বাজনা থাকলে, ঠিকঠাক পরিমিতভাবে থাকলে ক্ষতি কী? আর বাজনা থাকলে বাদ্যযন্ত্রীরাও থাকবেন। তাঁদের মধ্যে বসে গাইলে কী অসুবিধে?”

    “তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমাদের বাংলার গান ঠিক লোকজনের মধ্যে বসে গাওয়ার গান নয়। সমবেত সঙ্গীত তো নয়ই। আমাদের গান নির্জন এককের গান। দেখ, মাঝি একা একাই মাঝদরিয়ায় ভাসতে ভাসতে গান গেয়ে যায়। আমার মা ঠাকুরঘরে পুজো করতে করতে একা একাই আপনভোলা হয়ে গান গেয়ে যেতেন। আসল গান কোনও শ্রোতার তোয়াক্কা করে না। তার কোনও হাততালির প্রত্যাশা নেই।”

    “আপনার সোনির ওয়াকম্যানটা ঠিক আছে তো? আসল গানের খোঁজ তো আপনার জানাই আছে। মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ুন। বললাম চলুন কেঁদুলি ঘুরে আসবেন, সে তো গেলেন না।”

    “আর অত ঘোরাঘুরি আমার পোষায় না ভাই। এককালে অনেক ঘুরেছি। ঘুরে বেড়িয়ে আর হবেটা কী ঘোড়ার ডিম? আমাদের দেশের গান মরে গেছে। সেবার আমার সোনিটা নিয়ে অনেক তো ঘুরলাম – দ্বারভাঙ্গা, বেনারস, হরিদ্বার, বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া। বেনারসের মন্দিরগুলোতে মাইকে সবসময় ‘জয় জগদীশ হরে’ বাজছে। হরিদ্বারে সবজায়গাতেই ক্যাসেটে বা সিডিতে একই গঙ্গাবন্দনা বাজছে – কী একটা ‘জয় জয় মা গঙ্গা’ না কী। দ্বারভাঙ্গা থেকে পুরুলিয়া – গ্রামের লোক তো শুনি সবাই হিন্দি-বাংলা ফিল্মের গান গাইছে।”

    সুনীলদা রাত ন’টার মধ্যেই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েন। কেননা প্রতিদিন ভোর পাঁচটার আগে উঠে হাঁটতে যাওয়া ওনার এখনও বাঁধা। ছুটির দিনে অত ভোরে ওঠার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। তার ওপর এই জানুয়ারি মাসের শীত। সুনীলদা একাই যাক হাঁটতে। ওনাকে তাই ফ্ল্যাটের দরজার আর সিঁড়ির নিচের কোলাপসিবল গেটের ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দিলাম। ভোরে উঠে উনি নিজেই বেরিয়ে যেতে পারবেন।

    গতকাল সকালে সাতটা নাগাদ উঠে চা খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখছি। এমন সময় সুনীলদা হাঁটা সেরে ফিরলেন। ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন, “তোমার কাছে একটা টেপরেকর্ডার আছে না? কোন কোম্পানির? ভালো? বাউল মেলায় ওটাই নিয়ে গেছিলে? কই দেখাও তো দেখি? কী করে চালাতে হয় দেখিয়ে দাও। ব্ল্যাংক ক্যাসেট আছে তো?”

    দেখি উত্তেজনায় ভদ্রলোক থরথর করে কাঁপছেন। হল কী ওনার? তাড়াতাড়ি ভেতরের ঘর থেকে প্যানাসোনিকের ডিজিটাল রেকর্ডারটা নিয়ে এলাম। এটা একটু আধুনিক আছে। সুনীলদাকে বোঝাতে শুরু করলাম। ভদ্রলোক অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, “এতো মহা খিটকেলে জিনিস! এসব আমার দ্বারা হবে না। কোনটা টিপতে কোনটা টিপে দেব! তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। একটা গানের খোঁজ পেয়েছি।”

    “যেতে হবে? কোথায়? কখন? কার গান?”

    “আজ আর হবে না। পাখি উড়ে গেছে। আবার কাল ভোরবেলা, একটা অ্যাটেম্পট নিতে হবে। তোমাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে।”

    ভদ্রলোককে শান্ত-টান্ত করে সোফায় বসিয়ে চা খাইয়ে ব্যাপারটা বুঝলাম। সকালে হাঁটতে বেরিয়ে উনি কোন এক মহিলার গান শুনেছেন। সে নাকি এক অসাধারণ গান। আগে কোনোদিন শোনেন নি। কাল সকালে সেটাই টেপ করতে হবে। বললাম, “আপনি কোনদিকে গেছিলেন হাঁটতে বলুন তো? আমাদের পাড়ায় যে সব মহিলা গান-টান করেন তাঁদের তো আমি মোটামুটি চিনি। হয়তো আজই গিয়ে টেপ করা যেতে পারে।”

    “না না, এ সেরকম গান না। মহিলাও সেরকম কোনও মহিলা নন, গরীব লোক। ঈশ, আমার সোনিটা কেন যে নিয়ে এলাম না। অবশ্য আনলেও আজ খুব একটা লাভ হত না। আমি যখন শুনতে পেলাম গানটা তখন মাঝপথে। মহিলা আমায় দেখতে পেয়ে গেলেন, সঙ্গে সঙ্গে কনশাস হয়ে গেলেন, গলার আওয়াজটা চেপে দিলেন। কাল কী আর একই গান গাইবেন? কী জানি? একটা অ্যাটেম্পট তো নিতেই হবে।”

    ঠিক হল কাল ভোরে (অর্থাৎ আজ ভোরে) আমি আমার প্যানাসোনিকটা নিয়ে সুনীলদার সঙ্গে হাঁটতে বেরোব। উনি বেশি কিছু আর বললেন না, বললেন ‘কাল শুনতেই পাবে’।

    সুনীলদাকে কেঁদুলি থেকে রেকর্ড করে আনা গানগুলো শোনালাম। ভিডিও রেকর্ডিংও দেখালাম। সুনীলদা দেখলেন শুনলেন সবই, মাঝে মাঝে একটু হুঁ হাঁ করা ছাড়া আর কিছু বললেন না। বললাম, “ভগবান দাস বাউলের গান কেমন শুনলেন?”

    সুনীলদা বললেন, “ভালোই। ভালোই তো! মিষ্টি গলা।”

    “ওটা কোনও উত্তর হল না, একটু খোলসা করে বলুন।”

    “দ্যাখো ভাই, এই বাউল মেলায়-টেলায় এদের খুব একটা চেনা যায় না। ওখানে তো এরা বিজ্ঞাপন করতে যায়। গেরুয়া পরে সঙ সেজে দু’হাত তুলে ঘুরপাক খাচ্ছে। সব দ্যাখনদারি। গানটাও খুব চিৎকার করে গায়। যে যত পারে চিৎকার করে। কার গলা কত চড়ায় ওঠে তার প্রতিযোগিতা। অথচ এঁদের অনেকেই কিন্তু জাত শিল্পী। প্রত্যেক শিল্পীরই শিল্পসৃষ্টির একটা অন্তরঙ্গ আত্মমগ্ন মুহূর্ত আছে। তোমায় দেখতে হবে কে কোথায় বসে গান বাঁধে। কেউ হয়ত কোনও নদীর পারে বসে গান বাঁধে, কেউ কোনও গাছের তলায়, কেউ বা তার নিকনো ঘরের দাওয়ায়। এঁদের গান শুনতে হলে তোমায় এঁদের নিজের নিজের ডেরায় গিয়ে শুনতে হবে। শিকারি গভীর জঙ্গলে বাঘের ডেরায় ঢুকে বাঘ শিকার করে নিয়ে আসে, সেটাই তো উত্তেজনা। সার্কাসের বাঘ নিয়ে শিকারির কোনও আগ্রহ নেই।”

    বুঝলাম সুনীলদাকে গান শুনিয়ে ইমপ্রেস করা আমার কম্ম নয়। তাও কিছু শোনালাম। কিন্তু উনি মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। ভোরবেলায় গানটা যে রেকর্ড করতে পারলেন না সে ব্যাপারে আফসোস করছিলেন। আড্ডা খুব একটা জমল না। দুপুরটা ঘুমিয়ে, আর সন্ধেবেলাটা বই-টই পড়ে সুনীলদা কাটিয়ে দিলেন। বার বার আমাকে মনে করিয়ে দিতে লাগলেন, “কাল কিন্তু খুব ভোরে উঠতে হবে তোমায়। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো। ঘড়িতে পৌনে পাঁচটায় অ্যালার্ম দেবে।”

    রোববার দিন ভোর পাঁচটার আগে বোধহয় আমি জীবনে কোনোদিন উঠিনি। তাও এই জানুয়ারি মাসের ঠাণ্ডায়। প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছিল। প্যানাসোনিকের টেপটার মধ্যে কী এমন হাতি ঘোড়া আছে! সুনীলদা ইচ্ছে করলে এটা অনায়াসে নিজেই অপারেট করতে পারতেন। কী আর করা যাবে! পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। তার ওপর অতিথি দেব ভবঃ। অ্যালার্ম শুনে উঠে জ্যাকেট, মাফলার সব চাপিয়ে বসার ঘরে এসে দেখি সুনীলদা তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছেন। বললেন, “টেপটায় ব্যাটারি তাজা আছে তো? ক্যাসেট লাগিয়েছ?”

    “সব ঠিক আছে সুনীলদা। ব্যাটারি চার্জ দেওয়া আছে। আর এতে ক্যাসেট লাগে না, মেমরি কার্ডে রেকর্ড হয়।”

    “তবু একবার টেস্ট রেকর্ডিং করে দেখে নাও। আজ মিস করলে আর হয়তো চান্স পাব না।”

    বিরক্ত হয়ে দু’তিনবার হ্যালো টেস্টিং হ্যালো টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি বলে রেকর্ড করে সুনীলদাকে শুনিয়ে দিলাম। সুনীলদা সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “ঠিক আছে, চলো এবার।”

    বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রচণ্ড কুয়াশা। তখনও অন্ধকার চারদিকে। আজ জানুয়ারি মাসের বিশ তারিখ। দিন বড় হতে শুরু করেছে। তবে সওয়া পাঁচটার আগে এখনও আলো ফোটে না মনে হয়।

    আমাদের বাড়ির কাছেই একটা বেশ বড় মাঠ আছে। ক্রিকেট ফুটবল খেলা হয়। সকাল-বিকেল অনেক লোক মাঠে হাঁটতে কিম্বা দৌড়োতে আসে। পুজোর সময় পাড়ার পুজোর প্যান্ডেল হয়। সুনীলদা দেখি সেই মাঠের দিকে চলেছেন। অবাক হয়ে বললাম, “ওই মাঠের মধ্যে গান!”

    সুনীলদা শান্তভাবে বললেন, “মাঠে নয়, মাঠটার ওপাশে, ওই অশ্বত্থ গাছটার নিচে।”

    মাঠটার দক্ষিণদিকে একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ আছে। গাছের তলাটা ফাঁকা, একদিকে একটা পরিত্যক্ত স্কুলবাড়ি, অন্যদিকে মাঠের বাউন্ডারি ওয়ালটা টানা চলে গেছে। দেওয়ালটা ঘুঁটের দাগে ভর্তি। গাছ আর দেওয়ালের মাঝে একটা ছোট্ট পাম্পহাউস আছে। সকাল-বিকেল মিউনিসিপ্যালিটির লোক এসে তালা খুলে পাম্প চালিয়ে যায়, আবার দু’ঘন্টা পর এসে বন্ধ করে। সুনীলদা বললেন, “আমাদের পজিশন নিতে হবে ওই পাম্পহাউসটার পেছনে। মহিলা এখানেই আসেন।”

    অবাক হয়ে বললাম, “মহিলা যদি গাছের তলায় আসেন তাহলে কিছুটা দূর হয়ে যাবে না? অত দূর থেকে রেকর্ডিং কি ভালো হবে?”

    “কিছু করার নেই। আমাদের দেখতে পেলে মহিলা হয়তো আর গানই গাইবেন না। লুকিয়ে থাকতে হবে। তোমার রেকর্ডারটা এমনভাবে সেট করো যাতে অ্যামবিয়েন্ট সাউন্ড ভালো আসে।”

    বাধ্য হয়ে পাম্পহাউসটার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু একটু আলো ফুটেছে এখন। চারপাশ দেখা যাচ্ছে। তবে কুয়াশা ভেদ করে সূর্য উঠতে দেরি আছে। দেওয়াল আর পাম্পহাউসটার মাঝে রাজ্যের আগাছা হয়ে আছে। জায়গাটা বেশ নোংরাও। টেপরেকর্ডারটা বার করে অ্যাডজাস্ট করতে করতে বিরক্ত গলায় বললাম, “এইভাবে কি আর ভালো রেকর্ডিং হয়? তার চেয়ে মহিলাকে ধরে গানটা গাইয়ে সামনাসামনি রেকর্ডিং করে নিলেই তো হত! কোয়ালিটি ভালো হবে।”

    এই কথায় সুনীলদা এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, যার মানে হয়, তোমাকে এতদিন ধরে আমি তাহলে কী বোঝালাম। বললেন, “চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘের ছবি তুলতে তো সবাই পারে। কোয়ালিটি ভালো হবে। গভীর জঙ্গলে বাঘের ডেরায় বাঘ যখন তার শিকার নিয়ে খেলা করছে সে ছবি ক’জন তুলতে পারে?”

    আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, সুনীলদা আমার হাতটা হঠাৎ চেপে ধরে একদিকে ইশারায় দেখালেন। দেখি সেই স্কুলবাড়িটার পাশ দিয়ে এক বয়স্কা মোটা মহিলা গাছটার দিকে এগিয়ে আসছেন। মহিলার বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে হবে। পরনে একটা পাড়দেওয়া নোংরা সাদা শাড়ি, গায়ে একটা ছাইরঙা চাদর। দেখেই বোঝা যায় খুব গরীব, মনে হয় বিধবা। হাতে একটা বালতিতে ভর্তি গোবর। তার মুখটা দেখে মনে হয় যেন বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি। গুনগুন করে কী একটা গান গাইতে গাইতে গাছ পেরিয়ে দেওয়ালের দিকে হেঁটে এলেন মহিলা।

    সুনীলদার আঙুলের খোঁচায় আমি টেপরেকর্ডারটা চালু করে দিলাম। মহিলা গোবরের বালতিটা দেওয়ালের পাশে নামিয়ে গোবর তুলে তুলে একটা একটা করে ঘুঁটে দেওয়া আরম্ভ করলেন। তার সাথে তাঁর গলার আওয়াজটা জোর হল। একটা অদ্ভুত গান তিনি গাইছিলেন। সুরটা কেমন টানা টানা, একঘেয়ে, ভোরেরই রাগিণী, সহজ সরল। আর তাঁর গলা কী! অদ্ভুত সুরেলা একটা আওয়াজ, সেরকমই জোয়ারি। কোনওদিকে তাঁর তখন ভ্রুক্ষেপ নেই, সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন হয়ে গান গেয়ে চলেছেন।

    গানের কথাগুলো পরে বারবার টেপ শুনে শুনে উদ্ধার করেছি। কথাও খুবই সহজ সরল। ব্যাপারটা যতটা পারা যায় পরিষ্কার করার জন্য এখানে পুরো গানটাই তুলে দিলাম –

    জাগো জাগো বন্ধু সবে     দেখো আঁখি মেলিয়া
    দুখরাতি পোহাইল     উঠে আলো ফুটিয়া।।

    দারা পুত্র পরিবার     এ জগতে কে বা কার
    কার ভাই কার বইন     কে তোমার, তুমি কার
    ঝরাও চক্ষের অশ্রু     কার তরে কান্দিয়া
    নিজ নিজ কর্মে চল     শোকতাপ ভুলিয়া।।

    দিন আসে রাইত যায়     আসে ঘুইরা ফিরিয়া
    গাছেরা ঝরায় পাতা     নবপত্র লাগিয়া।।

    যেমন জোয়ার-ভাঁটা     অমানিশা পূর্ণিমা
    দুঃখের হেইপারে সুখ     তেমনি দিছেন মা
    ওঠো গো শ্মশানযাত্রী     চলো ঘরে ফিরিয়া
    রাইখখা গেলা যারে এথি     যাইয়ো তারে ভুলিয়া।।
    আমার চোখ আপনা থেকেই বুজে গেল। সেখানে অন্ধকার পর্দায় প্রথমে ভেসে উঠল একটা ছবি। প্রায় আট বছর আগের কথা। গড়িয়ার শ্মশান। এরকমই এক কুয়াশামাখা শীতের রাত। আমার এক অত্যন্ত প্রিয়জন পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন সেদিন। দাহ করতে করতে রাত দু’টো পেরিয়ে গেছে। আমরা কয়েকজন খুব কাছের লোক একটা গাছের তলাকার বেদীতে চাদর মুড়ি দিয়ে গোল হয়ে বসে আছি। একে অন্যকে ধরে আছি। কেউ কোনও কথা বলছি না, কিন্তু চোখে ঘুম নেই কারও। নিঝুম হয়ে বসে আছি সবাই। একটু পরে আলো ফুটবে। সকাল হবে। গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করবে। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। স্নান-টান করে পরিষ্কার হয়ে আবার অফিস যেতে হবে।

    এরপর এই ছবিটা ডিজলভ করে গিয়ে পর্দায় ভেসে উঠল রবীন্দ্রনাথের চেহারা। একটা ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে বসে আছেন। ছেলে শমীর মৃত্যুতে শোকাতুর নিস্তব্ধ কবি ফিরে চলেছেন। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাঁর মনে হল, জগতে রূপ রস গন্ধে কোথাও তো কোনও কম পড়েনি! আকাশ ঠিক সেরকমই নীল, গাছপালা ঠিক সেরকমই সবুজ।

    সুনীলদার হাতের চাপে হুঁশ ফিরল। চোখ মেলে দেখি গান শেষ হয়ে গেছে। মহিলা খালি বালতি হাতে ঝুলিয়ে গুনগুন করতে করতে ফিরে চলেছেন। আমরাও চুপচাপ কোনও কথা না বলে বাড়ি ফিরে এলাম।

    সকাল আটটার মধ্যে দেখি সুনীলদা স্নানটান সেরে ধোপদুরস্ত ধুতিপাঞ্জাবী পরে বেরোবার জন্য তৈরি। বললেন, “বুঝলে, আমাকে এখনই বেরোতে হবে। আর দেরি করা যায় না।”

    “সে কী? বেরোতে হবে মানে? আপনার তো আজ সারাদিন এখানে কাটিয়ে বিকেলে যাওয়ার কথা!”

    “না না, আমায় বাড়ি ফিরতে হবে। এখনই।”

    “কী যে করেন সুনীলদা! দুপুরে আপনার জন্য আজ রেওয়াজি খাসির মাংস এনেছি। খেয়েদেয়ে বিকেলে যাবেন। আচ্ছা আপনাকে আমি গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে আসব।”

    “না না, আমি ট্রেনে চলে যাব। তুমি কিছু মনে কোরো না ভাই।”

    কিছুতেই সুনীলদাকে আটকানো গেল না। কোনরকমে সকালের জলখাবারটা খাইয়ে দিতে পারলাম। যাবার সময় বললেন, “আমাকে বাড়ি গিয়ে আবার বেরোতে হবে। আজই। জিনিসপত্তর গোছাতে হবে। সংসার গিন্নী সামলে নেবে। আমার অন্য কাজ আছে। আশাকরি চার-পাঁচ বছর আরও বাঁচব। কানটাও এখনও ভালোই আছে। যে ক’দিন বাঁচি প্রাণভরে গান শুনে নি। অনেক গান শোনা বাকি আছে আমার।”



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments