আমার দু বছরের নাতি জানে কাজ আর অকাজের পার্থক্য। একটা ভিজে মোজা কিংবা ন্যাকড়ার টুকরো দিয়ে যখন আলমারি বা আয়না মুছতে থাকে তখন ‘কী করছ’ জিজ্ঞাসা করলে গম্ভীরভাবে উত্তর দেয় ‘কাজ করছি’। আবার যখন বারান্দার টব থেকে মুঠোভর্তি মাটি নিয়ে মেঝেয় ছড়াতে থাকে ‘কী করছ’, প্রশ্নের উত্তরে একই রকম গাম্ভীর্যে জবাব দেয় ‘অকাজ’। পর্যবেক্ষণ আর অনুশাসনের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে কাজ আর অকাজের বোধ পরিপক্ব হতে থাকে। বড়োরা যেটা করছে বা যেটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটাই কাজ, আর সে যেটা করে তিরস্কৃত হচ্ছে সেটা অকাজ। আর সবসময় সে তিরস্কৃত কাজকে অকাজ বলে মেনে নিতেও পারে না। তখন সে প্রতিবাদের সুরে বলে;
বড়ো বড়ো রুল-টানা কাগজকী উত্তর দেবেন? একজনের কাছে যেটা কাজ অন্যের চোখে তা অকাজ মনে হতেই পারে। কাজের ফল যদি হয় মূল্যপ্রাপ্তি তাহলে কাগজের নৌকো গড়া আনন্দলাভেই কর্ম পদবাচ্য। একটা গল্পের অবতারণা করা যেতে পারে। গ্রাম্য কিশোর স্কুলে না–গিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিপ ফেলে মাছ ধরছে পুকুরে। গ্রামে বেড়াতে আসা এক বিদেশি বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল তার কি কোন কাজকর্ম নেই। ‘এই তো কাজ করছি’—ছেলেটির উত্তর।
নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ।
আমি যদি নৌকো করতে চাই
অমনি বল ‘নষ্ট করতে নাই’।
সাদা কাগজ কালো
করলে বুঝি ভালো?
‘কেন, পড়াশুনা করো না? স্কুলে যাও না’?
‘পড়াশুনা করে কী হবে’?—ছেলেটি জানতে চায়।
‘ভালো চাকরি পাবে, টাকা রোজগার করবে, নিজের আনন্দের জন্য সেই টাকা খরচ করতে পারবে’।
অম্লানবদনে ছেলেটির উত্তর: ‘আনন্দ তো এখনই পাচ্ছি মাছ ধরে, তার জন্য ঘুরপথে এত মেহনত কেন করব!’
রোজ সকালে ক্যানভাস কাঁধে নিয়ে ভ্যান গগ মাঠের পাশে গিয়ে বসেন। লাল হলুদ রোদ্দুর, মাঠভর্তি হলুদ ফসল, ফসলখেতের উপর দিয়ে উড়ে-যাওয়া কাক—ক্যানভাসের গায়ে এগুলো ধরে রাখার চেষ্টা সারাদিন ধরে। কখনও সাফল্যের উল্লাস, কখনও বা ব্যর্থতার বিষাদে ক্যানভাস কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলা। পথচলতি লোকের মনে সংশয় চোখে অবজ্ঞা—লোকটার কি সারাদিনে কোন কাজ নেই! কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে অবজ্ঞাত অবিক্রীত ছবিগুলো এখন মিলিয়ন ডলারের সংগ্রহ সামগ্রী।
কালই যাচাই করবে কর্মফলের মূল্য। গীতায় ভগবান অর্জুনকে বলেছেন: ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন’— কর্মেই তোমার অধিকার, ফলের প্রত্যাশা কোরো না। আর, সেই কর্মসম্পাদনে অধিকারভেদ আছে। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়:, পরোধর্ম ভয়াবহ:’। অর্জুনকে তাঁর ক্ষত্রিয়ধর্মানুযায়ী শত্রুনিধন কর্ম সম্পাদন করতে হবে। আর কবি অকুন্ঠ আত্মবিশ্বাসে বলেন ‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি/ গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি’। কর্মসম্পাদনের সুকৃতিতে জীবাত্মার উত্তরণ, দুষ্কর্মে অবতরণ—
কাজের কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে কবি অকাজের
শান্তির আশ্রয় কামনা করেন:
'বিদায় দেহো, ক্ষমো আমায় ভাই/ কাজের পথে আমি তো আর নাই।/
এগিয়ে সবে যাও না দলে দলে/ জয়মাল্য লও-না তুলি গলে,/
আমি এখন বনচ্ছায়াতলে/ অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই’।