• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৬০ | আগস্ট ২০১৫ | প্রবন্ধ
    Share
  • কাজ অকাজ : উদয় চট্টোপাধ্যায়


    মার দু বছরের নাতি জানে কাজ আর অকাজের পার্থক্য। একটা ভিজে মোজা কিংবা ন্যাকড়ার টুকরো দিয়ে যখন আলমারি বা আয়না মুছতে থাকে তখন ‘কী করছ’ জিজ্ঞাসা করলে গম্ভীরভাবে উত্তর দেয় ‘কাজ করছি’। আবার যখন বারান্দার টব থেকে মুঠোভর্তি মাটি নিয়ে মেঝেয় ছড়াতে থাকে ‘কী করছ’, প্রশ্নের উত্তরে একই রকম গাম্ভীর্যে জবাব দেয় ‘অকাজ’। পর্যবেক্ষণ আর অনুশাসনের মাধ্যমে শিশুর মধ্যে কাজ আর অকাজের বোধ পরিপক্ব হতে থাকে। বড়োরা যেটা করছে বা যেটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে সেটাই কাজ, আর সে যেটা করে তিরস্কৃত হচ্ছে সেটা অকাজ। আর সবসময় সে তিরস্কৃত কাজকে অকাজ বলে মেনে নিতেও পারে না। তখন সে প্রতিবাদের সুরে বলে;

    বড়ো বড়ো রুল-টানা কাগজ
    নষ্ট বাবা করেন না কি রোজ।
    আমি যদি নৌকো করতে চাই
    অমনি বল ‘নষ্ট করতে নাই’।
             সাদা কাগজ কালো
             করলে বুঝি ভালো?
    কী উত্তর দেবেন? একজনের কাছে যেটা কাজ অন্যের চোখে তা অকাজ মনে হতেই পারে। কাজের ফল যদি হয় মূল্যপ্রাপ্তি তাহলে কাগজের নৌকো গড়া আনন্দলাভেই কর্ম পদবাচ্য। একটা গল্পের অবতারণা করা যেতে পারে। গ্রাম্য কিশোর স্কুলে না–গিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ছিপ ফেলে মাছ ধরছে পুকুরে। গ্রামে বেড়াতে আসা এক বিদেশি বিস্মিত হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল তার কি কোন কাজকর্ম নেই। ‘এই তো কাজ করছি’—ছেলেটির উত্তর।

    ‘কেন, পড়াশুনা করো না? স্কুলে যাও না’?

    ‘পড়াশুনা করে কী হবে’?—ছেলেটি জানতে চায়।

    ‘ভালো চাকরি পাবে, টাকা রোজগার করবে, নিজের আনন্দের জন্য সেই টাকা খরচ করতে পারবে’।

    অম্লানবদনে ছেলেটির উত্তর: ‘আনন্দ তো এখনই পাচ্ছি মাছ ধরে, তার জন্য ঘুরপথে এত মেহনত কেন করব!’

    রোজ সকালে ক্যানভাস কাঁধে নিয়ে ভ্যান গগ মাঠের পাশে গিয়ে বসেন। লাল হলুদ রোদ্দুর, মাঠভর্তি হলুদ ফসল, ফসলখেতের উপর দিয়ে উড়ে-যাওয়া কাক—ক্যানভাসের গায়ে এগুলো ধরে রাখার চেষ্টা সারাদিন ধরে। কখনও সাফল্যের উল্লাস, কখনও বা ব্যর্থতার বিষাদে ক্যানভাস কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলা। পথচলতি লোকের মনে সংশয় চোখে অবজ্ঞা—লোকটার কি সারাদিনে কোন কাজ নেই! কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে অবজ্ঞাত অবিক্রীত ছবিগুলো এখন মিলিয়ন ডলারের সংগ্রহ সামগ্রী।

    কালই যাচাই করবে কর্মফলের মূল্য। গীতায় ভগবান অর্জুনকে বলেছেন: ‘কর্মণ্যেবাধিকারস্তে, মা ফলেষু কদাচন’— কর্মেই তোমার অধিকার, ফলের প্রত্যাশা কোরো না। আর, সেই কর্মসম্পাদনে অধিকারভেদ আছে। ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়:, পরোধর্ম ভয়াবহ:’। অর্জুনকে তাঁর ক্ষত্রিয়ধর্মানুযায়ী শত্রুনিধন কর্ম সম্পাদন করতে হবে। আর কবি অকুন্ঠ আত্মবিশ্বাসে বলেন ‘তোমার যজ্ঞে দিয়েছ ভার, বাজাই আমি বাঁশি/ গানে গানে গেঁথে বেড়াই প্রাণের কান্নাহাসি’। কর্মসম্পাদনের সুকৃতিতে জীবাত্মার উত্তরণ, দুষ্কর্মে অবতরণ—
    ‘কিয়ে মানুষ পশু পাখি কিয়ে জনমিয়ে/ অথবা কীটপতঙ্গ,
    করম বিপাকে গতাগতি পুনপুন/ মতি রহুঁ তুয়া পরসঙ্গ’।
    এটা কাজ বা অকাজের মুল্যায়ন নয়, মূল্যায়ন কর্ম আর অকর্ম বা কর্মহীনতা অথবা অপকর্মের। যা স্বধর্মবিরুদ্ধ তার সম্পাদনই অপকর্ম। শিশু তার স্বধর্মে কাগজের নৌকা কিংবা কেয়াপাতার নৌকা গড়ে জলে ভাসাবে। কবিও তাঁর স্বধর্মে পাতার ভেলা নীরে ভাসাবেন, কিন্তু তাঁর আরব্ধ জীবনদর্শন তাঁকে পরমুহূর্তেই উচ্চারণ করাবে ‘কর্ম আমার বোঝাই ফেলা’। কর্মে অর্জিত কীর্তিকে পিছনে ফেলে জীবনের রথে এগিয়ে যাওয়াও তো কর্ম। কর্মই জীবজগতের চালিকাশক্তি, কিন্তু সেই কর্ম কাজ আর অকাজের মিশ্রণ। খাদ্যসংগ্রহ আর বাসাবাঁধার কাজের ফাঁকে পাখি অকাজের গান গায়, ‘রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি’। যন্ত্র শুধু কাজই করে যায়, অকাজের ধার ধরে না। মানুষ কখনও কখনও অকাজ ভুলে যন্ত্রবৎ হয়ে পড়ে —কাজের নেশায় হয়ে পড়ে নেশাগ্রস্ত—workaholic। অকাজের তৈলনিষেকের অভাবে তার কর্মচক্রে সকরুণ আর্তনাদ ওঠে—নেশাগ্রস্তের কানে তা পৌঁছায় না। তখন বাইবেল মনে করিয়ে দেয়, Man cannot live by bread alone, কবি সরস তিরস্কারে বলেন: ‘কেজো লোকদের করি ভয়,/ কবজিতে ঘড়ি এঁটে শক্ত করে রেখেছে সময়’।

    কাজের কোলাহল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে এসে কবি অকাজের শান্তির আশ্রয় কামনা করেন:
    'বিদায় দেহো, ক্ষমো আমায় ভাই/ কাজের পথে আমি তো আর নাই।/
    এগিয়ে সবে যাও না দলে দলে/ জয়মাল্য লও-না তুলি গলে,/
    আমি এখন বনচ্ছায়াতলে/ অলক্ষিতে পিছিয়ে যেতে চাই’।

    কিংবা স্বস্তিবচনের মতো উচ্চারণ করেন: ‘এবার না হয় কাটুক বেলা/ অসময়ের খেলা খেলে’। তবে কর্মজগত থেকে কবির এই আত্মনির্বাসন সাময়িক এবং প্রতীকী। বীজের মধ্যে সংগুপ্ত প্রাণের স্পন্দনের মতো তাঁর মননে চলে সৃষ্টির কাজের খেলা, যা তাকে নিয়ে যেতে চায়—নিয়ে যায়—‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে’। কাব্যজগত থেকে বাস্তবজগতে ফিরে আসতেই হয়। কবির কথাতেই বলতে হয়, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। কবিকে অনুসরণ করলে আমজনতার চলে না, সমাজ কিংবা দেশেরও চলে না। সেই বাস্তবতায় হাজার কাজের মধ্যে ডুবতে হবে, আর মাঝে মাঝে ভেসে উঠতে হবে অকাজের হাওয়ায় ফুসফুস ভরে নিতে। একটা কার্টুন চোখে পড়েছিল। সচিত্র উদাহরণে বার্তা ছিল—যদি কয়েকঘন্টার সুখ চাও তাহলে একটা পানীয় নাও, যদি একদিনের সুখ চাও সপ্তাহান্তের ছুটিতে বাইরে বেরিয়ে পড়ো, যদি একমাসের সুখ চাও দেশ কিংবা বিদেশভ্রমণের পরিকল্পনা নাও, যদি এক বছরের সুখ চাও বিয়ে করে ফেলো, আর যদি সারাজীবনের সুখ চাও তাহলে ভালোবেসে তোমার কাজ করো। শেষ উপদেশটার সঙ্গে ছিল এক কাঠুরিয়ার ছবি—যে কাঠ কাটছে আর তার কপাল থেকে ঘাম ঝরে পড়ছে, মুখে কিন্তু প্রশান্তির ছাপ।





    অলংকরণ (Artwork) : ">ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments