নদীমাতৃক বাংলাদেশ দেখার স্বপ্ন নিয়ে ২২শে মে, ১৯৮৮ সালে রওনা হয়েছিলাম। বাংলাদেশ যাচ্ছি, তাই পুত্র ঋতবান কার সঙ্গে দেখা করে কি বলতে হবে, কি তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কাদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে ইত্যাদি প্রচুর ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে এক স্যুটকেস বই। প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করে দিতে হবে।
একটি বিমান বন্দর থেকে আরেকটি বিমান বন্দর পৌঁছতে মাত্র সময় লাগে আধ ঘন্টা! এত কাছে ও এত দূরে। বহু বছর পরে একটি দীর্ঘ অবকাশ ও একটি বিশ্রাম। অবগাহন করলাম বাংলাদেশের প্রিয়জন (জানা ও অজানা), পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ইছামতী, করতোয়া, গড়াই এবং ওই দেশের প্রকৃতি এবং তিতাস একটি নদীর নামের মধ্যে।
'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবিটির শুটিংয়ের সময়ে আমি বীরভূম, সাঁইথিয়ায় চাকরি করতাম। এতদূর থেকে আসা সম্ভবপর হয়নি। শুটিং শেষ হবার পর ভয়ানক অসুস্থতার খবর পেয়ে ঢাকায় গিয়েছিলাম, হাসপাতালেই তখন সকাল থেকে রাত অবধি দুই তিন দিন ছিলাম। এইবার গিয়েই সব জানবার ও বুঝবার সুযোগ হল।
ফিল্ম ডেভালপমেন্ট কর্পোরেশনে গিয়ে দেখা করলাম ল্যাবরেটরী-ইন-চার্জ খোকা ভাইয়ের সঙ্গে। ল্যাবরেটরী ও আর্কাইভের জন্যে বই, ছবি, পোস্টার ইত্যাদি দিয়েছি। খোকা ভাই খুবই সজ্জন খাঁটি মানুষ, দক্ষ কলাকুশলী। প্রণাম করে ওদের ঋত্বিকদা সম্বন্ধে অনেক কথা বললেন, ভেবেছিলেন আমাকে প্রবন্ধাকারে লিখে দেবেন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় পারেন নি।
ওখানেই দেখা করলাম ডিরেক্টর (F.D.C) সালাউদ্দীন জাকিরের সঙ্গে। খুবই শিক্ষিত, ভদ্র ও সুন্দর চেহারা, '৭৫ সালে পুণা ছিলেন এবং ওদের ঋত্বিকদার সঙ্গে দেখা হয়। মৃত্যুর পরে পুণাতে একটি সেমিনার করেন। বোম্বের থেকে কুমার সাহানি, মণি কউল, অরুণা দেশাই (এডিটর), গিরীশ কার্নাড প্রভৃতিকে ডেকেছিলেন। ওই সময়ে ওদের ঋত্বিকদার ওপরে একটি ইংরেজি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, প্রবন্ধটির বাংলা অনুবাদ আমাকে দিয়েছেন। আমি বই, পোস্টার ইত্যাদি দিয়েছি।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিকে বই দিয়েছি, সম্পাদক - নজরুল, হুদা, মিন্টু। সানোয়ার মুর্শেদকে বই দিয়েছি, উনি ছিলেন তিতাসের এগ্জিকিউটিভ প্রোডিউসার, প্রোডিউসার হাবিবুর রহমানকেও দেবার জন্য সানোয়ারকে বই দিয়েছি।
ওখানেই তিতাসের চিফ্ অ্যাসিস্ট্যান্ট ফকরু হোসেন বৈরাগীর সঙ্গে দেখা হল। অনেক তথ্য জানবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু একটি ছবি পরিচালনা ও অভিনয়ের ব্যাপারে খুবই ব্যস্ত ছিলেন। আলম কোরাসী পরে এডিটিং করেন।
তিতাসের ক্যামেরম্যান বেবী ইসলামের বাড়ি গিয়েছিলাম। ওর স্ত্রী শ্রীমতী তন্দ্রা ইসলাম ভারী মমতাময়ী ও স্নেহময়ী। ওদের ঋত্বিকদা তিতাস ছবিটির সময়ে কিছুদিন ওদের বাড়িতে ছিলেন। ওদের ছেলে তখন ছিল খুবই ছোটো। তন্দ্রা খুবই যত্ন করে ওদের ঋত্বিকদাকে রান্না করে খাওয়াতো। রোজ একটি আস্ত ইলিশমাছ খেতেন। কাজের পর ছোট্টো জয়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়তেন। শেষ বলেছিলেন, 'তোকে আমি কি দেবো?' জয় তিতাস ছবিটির শেষ দৃশ্যে ধানের ক্ষেতে দৌড়ে দৌড়ে বাঁশি বাজিয়েছে। তন্দ্রা অনেক কথা বলল—কিন্তু আমার টেপ রেকর্ডারটি তখন খারাপ হয়ে পড়েছিল।
বেবী ইসলামের বাড়িতে আলাপ হল ছবিটির ডিস্ট্রিবিউটর লোকমান ফকীরের সঙ্গে। ছবিটি ভারতে ও বিদেশে এক্সপোর্ট করার ব্যাপারে তিনি কিছু কথা বলেন, "ভারত ও বিদেশে দেখানোর জন্য '৭৪ সালের ২২শে জানুয়ারি ঋত্বিকবাবু ও আমি দিল্লী যাই। প্রধানমন্ত্রীর সচিব (Secretary) ঊষা ভগত ছিলেন। তথ্যসচিব (Secretary of Infromation) হরিশ খান্না Calcutta Censor Board-কে লিখলেন, Titas should be released commercially. কিন্তু বাংলাদেশের তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী তাহেরুদ্দীন ঠাকুর অব্জেকশন দিলেন যে এক্সপোর্ট হবে না। সংস্কৃতিপ্রেমিক হিতৈষীরা থাকা সত্বেও দুই সরকারের মতবিরোধের ফলে তিতাস বিদেশে ও ভারতে গেল না। পরে ওরা মুজিবর রহমানের কাছেও গিয়েছিলেন, উনি বলেন, "তাহেরুদ্দীন যা বলবেন তাই হবে"। আমার ভাগ্নিও বলেছে তখন "মামা বঙ্গবন্ধুকে বলেন আপনি যদি এইটুকু না বলতে পারেন, তাহলে কিভাবে দেশ চালাইবেন?"
লোকমান ফকীর বলেন, "মনের ভেতরে ছিল একটি অন্তরজ্বালা ও বিক্ষোভ"। ছবিটির প্রারম্ভিক প্রসঙ্গে বলেন — ১৯৭১, ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবসে সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক আসেন ঢাকায়। ২১শে ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় ছিলেন, ঋত্বিকবাবু ছিলেন না। উনি ২২শে ফেব্রুয়ারী নারায়ণগঞ্জ চাষাড়ে ময়দানের অনুষ্ঠানে চীফ গেস্ট ছিলেন। অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা ও সঙ্গীত রচনা করেন লোকমান ফকীর। সেই অনুষ্ঠানেই ঋত্বিকবাবু বলেন — "বাংলাদেশে তিতাস করার ইচ্ছা। তুমি সাহায্য করতে পারো কিনা?" ফকীর বলেন, "আমি চেষ্টা করব", তিতাস উপন্যাসটির Trust-এ ছিলেন সত্যজিৎ রায়। হাবিবরা প্রথমে যায় সত্যজিৎ রায়ের কাছে। কিন্তু উনি বলেন — "এই সাব্জেক্ট আমার না"। তখন ঋত্বিকবাবু ছিলেন কলকাতায় বরুণ বক্সীদের গ্যারেজে। হাবিবরা তখন ইন্টারেস্টেড হয় ও ছবি আরম্ভ করে।
লোকমান ফকীরের উপর ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্ব পড়ে। বাংলাদেশে তিতাস অল্পদিনের জন্য মুক্তিলাভ করেছিল। পরে বাংলাদেশে প্রথম পুরস্কার পায়। কিন্তু তিতাস বিদেশের পাসপোর্ট পেল না, একটি মহাকাব্য। বাংলাদেশের প্রতি শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলী। অসুস্থ অবস্থায় ছবিটির এডিটিং নিজে শেষ করতে পারেন নি। সুস্থ হবার পর ঢাকায় গিয়ে আবার এডিটিং করে একটি প্রিন্ট কলকাতায় নিয়ে আসেন, আমরা সেটা ৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত মাঝে মাঝে দেখেছি, তারপরে প্রিন্টটি হারিয়ে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি প্রিন্ট কিনেছিলেন, বছর দুই সময় লেগেছিল। অহীন্দ্রমঞ্চে খরাত্রাণের সময় ছবিটি দেখেছিলাম, টাইটেল ছিল না। এখন আমাকে F.D.C-তে জাকির বললেন — পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিঠি এসেছে ওরা এক্সপার্ট পাঠাবেন, কোটেশন পাঠাতে। কিন্তু খোকা ভাই ও েগ্জিকিউটিভ প্রোডিউসার সানোয়ার মুর্শেদ বললেন — ওরা ফুল লেন্থ অব্ পিকচার পাঠিয়েছে, পরে আবার টাইট্ল-ও পাঠিয়েছেন। সুতরাং গোলমালটা কোথায় আমরা জানি না। ঢাকা থেকে ফিরবার আগে আমি ছবিটি দেখে এসেছি, সম্পূর্ণ ছবি - তবে প্রিন্ট অনেক খারাপ হয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী ছবিটি দেখতে উন্মুখ।
বেবী ইসলামের বাড়িতেই দেখা হয় ওহাইদুল হকের সঙ্গে। ছবিটি শেষ করার সময় বেবী ইসলাম ও উনি রি-রেকর্ডিংইত্যাদিতে সাহায্য করেছিলেন। বাবার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কাজী আবুল খয়ের মহাম্মদ মহেবুর রহমান। ওখানেই অনেক কথা বলেন — "আরিচা ঘাটে শুটিং করার সময় যখন সবাইকে নিয়ে ঋত্বিকবাবু ছিলেন, তখন একদিন রাত্রে সিরাজউদ্দীনের দোতারা সহ গান শুনে বৃদ্ধটিকে নিয়ে আসতে বলেন। অনেকক্ষণ ওর গান শুনে বলেন - এই দোতারার সুরই থাকবে আবহ সঙ্গীতে"। তিতাসের আবহ সঙ্গীতে আছে এই দোতারা সহ গানের সুর।
|| ২ ||
আমাদের ভ্রমণসূচি আরম্ভ করবার আগে একদিন কুমিল্লায় গিয়েছিলাম, দুবার মেঘনা পেরিয়ে যেতে হয়। প্রথম মেঘনা দেখলাম, নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিরাট নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা — শুধু তো নামই শুনেছি। বাংলাদেশের রূপ উন্মোচিত হতে লাগলো এই ভ্রমণসূচির পরিক্রমায়।
ফিরে আসার পর আমাদের সিলেট যাবার কথা ছিল, কিন্তু প্রচণ্ড বন্যার জন্য টিকিট বাতিল করা হল। সিলেট হল না, ভাগ্নী বলল — "চল মামিমা আমার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া"। প্রথমে ব্রহ্মপুত্র ও পরে ভৈরব নদ পেরোলাম।
আমার সঙ্গে পরিচয় হল ওখানকার নাট্য সংস্থার সম্পাদক মনজুরুল আলমের সঙ্গে, আরও ছিলেন ক্যামেরাম্যান প্রাণতোষ চৌধুরী, কর্মকর্তা জেলা শিল্প একাডেমী। পরে আসেন মুক্তদল নাটকের সম্পাদক, মনজুরুল বললেন - ব্রাহ্মণবেড়িয়া থেকে কিছুদূরে গোকর্ণ ঘাটে তিতাস একটি নদীর নাম-এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণের দেশ। গিয়ে দেখলাম তিতাস নদীটি আবছা ভাবে। ওরা খুবই থাকতে বললেন, থাকা সম্ভব হয়নি। সুতরাং কাছে গিয়ে তিতাস নদীটি দেখলেও - নদীর জল স্পর্শ করতে পারিনি। কিন্তু না থাকলেও অদ্বৈত মল্লবর্মণ সম্বন্ধে জানলাম অনেক কিছু।
মনজুরুল বলেন — "তিতাস আমাদের কাছে একটি আদৃত উপন্যাস, উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিয়েছিলাম। যখন শুনলাম উপন্যাসটির চলচ্চিত্রায়ণ হবে, ইউনিট এসেছে গোকর্ণ ঘাটের কাছে শুটিং করতে - আমি গেছি। নদীর ধারে টিলার ওপরে ১৫-২০ জন লোকের মধ্যে ঋত্বিকদা বসে ছিলেন। ওনার পরনে ছিল পাজামা পাঞ্জাবী ও চটি জুতো, বিড়ি খাচ্ছিলেন। দূর থেকে দেখে চিনতে পেরে কাছে গেছি, পরিচয় দিলাম ও ধন্যবাদ জানালাম। যাত্রাবাড়ির ঠেক জায়গাটা কোথায় আছে, জানি কিনা জিজ্ঞেস করলেন। স্বপ্ন দেখেছিল তিতাস শুকিয়ে গেছে - এবং এই যাত্রাবাড়ির ঠেকেই জাল ফেলে কিছু পায়নি, স্রোত সোজা হয়ে চলে, কিন্তু স্বপ্নে দেখে স্রোত উলটো হয়ে চলছে।
"এখানের সমস্ত খবর নিলেন। আমার মনে হয় নদীর অবস্থান বোঝার জন্য, আত্মস্থ করার জন্য এসেছিলেন। আমরা নিজেদের মনে করি তিতাসের সন্তান, তিতাস নদীটিকে একটা টোটেমের মতো মনে করি। শিল্পকৃষ্টি সংস্কৃতি তিতাসের সঙ্গে সঙ্গে শুকিয়ে গেছে। তিতাসের পাড়ে শচীনদেব বর্মণ পঁচিশ বছর কাটিয়েছেন। বহু গানের সুর এখানে রচনা করেছেন। ঋত্বিকদা উপন্যাসটির অন্তর্নিহিত দর্শনটা বুঝবার জন্য এসেছিলেন"।
তিতাসের অনন্তের চরিত্র - অদ্বৈত মল্লবর্মণের চরিত্র। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পড়াশোনা করে কুমিল্লায় ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়েন - চাঁদা তুলে গ্রামের লোকজন পাঠায়। কলকাতায় গিয়ে নবশক্তিতে কাজ করেন। মহাম্মুদি পত্রিকায় প্রথম তিতাস লিখতে আরম্ভ করেন ধারাবাহিক ভাবে। কয়েক কিস্তি লেখার পরেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। পরে আবার লেখেন। অকৃতদার ছিলেন। নিজে কষ্ট করে চলতেন, কলকাতায় আত্মীয়স্বজন জেলে পরিবারদের সাহায্য করতেন। যক্ষায় অসুস্থ হবার পর কাঁচড়াপাড়া হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরে তিতাসের পাড়ে এসেই মারা যান। ভাগ্নি আমাকে দূর থেকে জায়গাটা দেখিয়েছিল। মনজুরুল সর্বশেষে বলেন — "একই মেরুর লোক ছিলেন লেখক ও পরিচালক"। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে আসি।
|| ৩ ||
|
আমাদের ভ্রমণসূচির পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এরপরে টাঙ্গাইল রওনা হলাম। মৌলানা ভাসানীর বাড়ি দেখতে গিয়ে - সন্তোষ ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয় দেখলাম। বিরাট বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও থাকতে পারলাম না, মন চলে গেছে তখন সাজাদপুর, পাবনা, কুষ্ঠিয়ার দিকে। সকালেই সাজাদপুর রওনা হলাম। বাসে কিছুদূর গিয়ে যমুনা নদী লঞ্চে পেরোতে হল। বিরাট নদী কিন্তু মাঝখানে চর পড়েছে। দেড় ঘন্টা পরে সিরাজগঞ্জে এসে আবার বাসে সাজাদপুর বা শাহজাদপুর। নদীমাতৃক বাংলাদেশকে দেখছি, মন ভরিয়ে দিচ্ছে আকাশ, বাতাস, মাটি জল। সাজাদপুরেও ছিলাম আত্মীয় বাড়িতে। বিকেলেই রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে গেলাম। বিরাট বাড়ি, এখন মেরামত করা হচ্ছে। দূরে একটি বকুলগাছের নীচে বসে কবিতা লিখতেন। 'আমাদের ছোটো নদী', কবিতাটি এইখানে বসেই লিখেছিলেন। এখন অবশ্য নদী দেখলাম না। আর 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে' যে বিরাট তালগাছ দুটি দেখে লিখেছিলেন এখনও আছে। রবীন্দ্রনাথের যুগকে স্মরণ করলাম। সন্ধ্যা আলো ছায়ায় করুণাপ্রসাদ কুঠি বাড়ির সামনে ছবি তুললেন।
|
পরদিন সকালে করতোয়া নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করে এলাম। ভারী সুন্দর দৃশ্য, ছবির মতন। বাড়ির ছেলেদের মা নিয়ে গিয়েছিলেন নদীতে। এখানেও যৌথ পরিবার ও খুব আন্তরিক ব্যবহার। চলে আসবার সময় খুব খারাপ লাগছিল।
বাসে মাত্র দু'ঘন্টা--পাবনা এসে পৌঁছলাম। রাস্তায় ইছামতী নদী দেখলাম, ইছামতী ও করতোয়া একসঙ্গে মিশে পরে যমুনার সঙ্গে মিলেছে। দুধারে সবুজ ধানক্ষেত, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, কয়দিন যাবৎ বৃষ্টি হয়নি। মনটা ব্যথিত হচ্ছিল এই ভেবে যে দেশটা আমাদের নয়। আকাশ এতো নীল, ধানের ক্ষেত এতো সবুজ, আর পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীমাতৃক বাংলাদেশ স্নিগ্ধ সুন্দর অপরূপা। এই রূপসী বাংলা, সোনার বাংলাকে আমরা হারিয়েছি। সব কিছু এই আকাশ, মাটি, জল একটা সুন্দর ছবির মতো মনের মণিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে।
|
পাবনায় কোনোদিন আসতে পারবো ভাবিনি, পাবনা জেলার যমুনা নদীর কাছে ছিল আমার শ্বশুরবাড়ির দেশ - নতুন ভারেঙ্গা গ্রামে। ম্যাপে দেখেছিলাম পদ্মা, রাজশাহী, চলনবিল ও যমুনা নদীর ধারে ভারেঙ্গা গ্রাম। কিছুই দেখা হল না। পরদিন দেখতে গেলাম শীতলাইয়ের জমিদার বাড়ি। বিরাট প্রাসাদ, বিরাট মাঠ, বাগান ইত্যাদি। সিকিউরিটি-র জন্য ছবি তোলা গেল না। প্রাসাদোপম অট্টালিকার পেছনে ইছামতী নদী। পরিষ্কার জল, কিন্তু আটকিয়ে রেখেছে। এখানেই রবীন্দ্রনাথ নেমে এই বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, তখন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্র খুবই ছোটো। পাবনা থেকে বাসে ঈশ্বরদী, সেখান থেকে ট্রেনে পোড়াদহ জংশন এসে জানলাম ট্রেন দেরীতে আসবে। দু'ঘন্টা বসে থাকার পর আমরা অবশেষে রিক্সা ভ্যানে করে রওনা হলাম। সেই রাত্রের কথা আজও মনে পড়ে। আকাশ ভরা তারা, রেল লাইনের ধার দিয়ে আমরা চলেছি। কুষ্ঠিয়ায় অপেক্ষা করছেন সাংবাদিক সনৎ দত্ত। রাত দশটায় আমরা পৌঁছোবার পরে আমাদের নিয়ে গেলেন নাসের মাহমুদের বাড়িতে।
|| ৪ ||
|
বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি - আরম্ভ হল অঝোরে বৃষ্টি। সনৎ ও নাসের বলল আপনারা বৃষ্টি নিয়ে এসেছেন। পরদিন সকালে রওনা হলাম শিলাইদহের দিকে। সাইকেল রিক্সায় যাই গড়াই নদীর পাড়ে, ভারী সুন্দর নদী। কিন্তু জল কমে গেছে, মাঝে মাঝে বালির চর। কিছুক্ষণ নৌকায় গিয়ে হেঁটে পার হই। দুদিকে গ্রাম, মানুষজন, নৌকো। তারপরে গিয়ে রিক্সাভ্যানে করে অনেকদূর যেতে হয়। দুধারে ফিকে সবুজ, গাঢ় সবুজ রঙের ধানক্ষেত, এই সবুজ এই দেশ ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। গ্রামটির নাম গট্টে ও আরও গ্রাম আছে। বাঘাযতীন ছিলেন এইদিকেরই একটি গ্রামে। আমাদের সঙ্গে ছিল খৈয়াম বাসার, খৈয়াম জিজ্ঞেস করল, "দিদি! কি পার্থক্য এই দেশের সঙ্গে ওই দেশের?" বললাম, "ভাই! এ সবুজ, এ নীল অন্য কোথাও দেখা যায় না"। মনে পড়ে ছোটোবেলায় দেশের বাড়ি, মামার বাড়ি যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। পুজোর ছুটি ও শীতের ছুটির সময়।
সামনেই শিলাইদহের কুঠি বাড়ি। কুঠি বাড়ি সেদিন বন্ধ ছিল। কাছারি বাড়ি পেরিয়ে আমরা তখন রওনা হলাম পদ্মার দিকে। ঝুমিয়ে এলো বৃষ্টি কিন্তু তখন ছুটছি, ছুটছি। পেছন থেকে সনৎ, নাসের, খৈয়াম ডাকছে। বাতাসে উড়ছে চুল ও উড়ছে শাড়ির আঁচল। সামনে বিশাল বলিষ্ঠ পদ্মা। দূরে নীল সমুদ্রের রঙের জলে সাদা ফেনা, সামনে গেরুয়া রঙের জলরাশি। কিছুদূরে চর পড়েছে, এরপরে আবার নদী এবং ওইপারে পাবনা।
গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে ফিরে আসতে হল, নদীর ওই বিশালতার ছবি মনে নিয়ে। কুঠি বাড়ির কর্মচারী বা কেয়ারটেকার তখন ফিরে এসেছে। অল্পসময়ের জন্য খুলে দিলেন - প্রত্যেক ঘরে কবির আঁকা ছবি; দুটি পালকি, পড়ার টেবিল, চেয়ার, খাট, আলনা ও স্পীডবোট দেখলাম। দোতলা ও ছাদে উঠলে চোখে পড়ে পদ্মা।
|| ৫ ||
বিকালে বাড়ি আসার পর নাসের মাহমুদের বাড়িতে জাতীয় কবিতা পরিষদের পক্ষ থেকে একটা সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে। জাতীয় কবিতা পরিষদের উদ্দেশ্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ও শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা লেখা। সভাপতি শামসুর রহমান। সম্পাদক কবি মহম্মদ রফিক, সৈয়দ আতিকুল্লা, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ। নাসের কুষ্ঠিয়ায় জাতীয় কবিতা পরিষদের ৬৪তম শাখার সম্পাদক। প্রতি বছর পরিষদের উদ্যোগে শিলাইদহে রবীন্দ্র জয়ন্তী জন্মোৎসব ও বিরাট মেলা হয়, অগণিত জনসমাবেশে দিনটি উদ্যাপন করা হয়। এবার ঠিক হয়েছিল নদীর পার থেকে আলপনা এঁকে নিয়ে আসা হবে, কিন্তু বৃষ্টির জন্য হয় নি।
মনে পড়ে ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদের সম্পাদক তানভীর মোকাম্মেল এসেছিল ইন্টারভিউ নিতে। এরপরে উদীচী ও ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ গান, কৈবর্ত (শ্রুতিনাটক), ও একটি যাত্রার অংশবিশেষ অভিনয় করে দেখায়। একটি সংস্কৃতিক সংস্থা হিসেবে উদীচী নিয়মিত গান, নাটক, যাত্রা ইত্যাদি করে যাচ্ছে। তানভীর মোকাম্মেলরা ছোটো ছোটো ফিল্ম তৈরি করছে, একটি জায়গা ঠিক করে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফিল্মগুলো প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে, এতে লাভ না হলেও লোকসান হয় না ও নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।
নাসেরদের বাড়ির চারদিকে পুকুর, মাঠ বৃষ্টির জলে ভর্তি হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট বর্ষণসিক্ত, কিন্তু আমাদের তো রওনা হতেই হবে। বৃষ্টির মধ্যে নাসের ও সনৎ রিক্সা করে তিতুমীর এক্সপ্রেসে উঠিয়ে দেয়। তিতুমীর এক্সপ্রেসে গোয়ালন্দ ঘাট এসে রিক্সা করে ফেরীতে এসে উঠলাম। দেড় ঘন্টায় গোয়ালন্দ পেরিয়ে আরিচা ঘাটে এসে বাসে উঠলাম। আরিচা ঘাটে তিতাস ছবিটির শুটিং হয়েছে।
বৃষ্টিতে ভিজে হাসান ইমাম, সানোয়ার মুর্শেদ, শমসের প্রভৃতির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বই দিয়েছি, সন্ধ্যার সময় কলিম সরাফীর বাড়ি গিয়ে না পেয়ে বই দিয়ে এসেছি। রাত্রে ফোন করেন, আঠারো তারিখ সন্ধ্যায় দেখা হল।
রাত্রে হাসান ইমামের বাড়িতে গেলাম ও অনেক তথ্য তিতাস ছবি সম্বন্ধে জানলাম। বেবী ইসলামের বাড়িতে তন্দ্রার ভাই রঞ্জিত ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা হল, সুবলের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। অনেক বড় হয়েছে মোঃ সাফিকুল ইসলাম - ওর কাছেও শুনলাম তিতাসের শুটিং সম্বন্ধে।
হাসান ইমাম স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে আমাদের চাইনিজ খাওয়াতে নিয়ে গেলেন, পথে আমরা ভাগ্নি বুয়াকে তুলে নিলাম। দুজনেই ভারী অমায়িক ও আন্তরিক। হাবিবুর রহমানকে ফোন করেছিলাম, আতিকুল্লা সাহেবের সঙ্গে আগেই দেখা করেছিলাম। একদিন নেমন্তন্ন খেলাম, তন্দ্রাও একদিন যত্ন করে খাইয়েছে। বারবার বলেছে, "আমাদের বাড়িতে এসে থাকবেন"।
|| ৬ ||
|
পরদিন গেলাম নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ স্কুলেই দেখা হল কালীপদ সেনের সঙ্গে। তিতাস ছবিটিতে জেলের অভিনয় করেছিলেন। "আলু উদ্ধারের সময় — অনন্ত যেতে চাইল, আমরা আপত্তি করলাম। শ্যাওলা বা কচুরিপানা ভেসে গেল" — ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোকর্ণ ঘাটে তিতাসের পাড়ে হয়েছে।
অনেক তথ্য জানলাম। আমার 'ঋত্বিক' বইটি লেখার পর এক যুগ বা বহু বছর কেটে গেছে। ইতিমধ্যে অনেক তথ্য সংগ্রহ হয়েছে — তাই আরেকটি বই লিখছি, এতেই তিতাসের সব তথ্য মিলবে। প্রত্যেকের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে দৃশ্যের পর দৃশ্য ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে।
বিকেলে শান্তনু কাইজার এসেছিলেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ওপরে অনেক লিখেছেন। বারো বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অধ্যাপক ছিলেন, গত দুই বছর কুমিল্লায় আছেন। মালোদের সম্বন্ধে অনেক বললেন। দুটো বই দিয়েছি। তার লেখা বই ও প্রবন্ধ বাংলা একাডেমীতে পেয়েছি। জাকিউল হক জেরক্স করে দিয়েছেন। 'অদ্বৈত মল্লবর্মণ - জীবনী ও সাহিত্য', 'তিতাস একটি নদীর নাম' প্রবন্ধ। তিতাসের শুটিং সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না, অনেক জানলাম। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর নিজের জন্মভূমি, মাতৃভূমি এলাম — অনেক স্মৃতি — অনেক দুঃখ কিন্তু মন প্রাণ ভরে গেছে। অনুভব করেছি সমস্ত বাংলাদেশ একটি প্রতিজ্ঞায় দৃঢ় — সে হল সাংস্কৃতিক আন্দোলন, লড়াই, চেষ্টা। উদীচী, মুক্ত নাটক দল, ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ, ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটিজ, জাতীয় কবিতা পরিষদ আরও নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, রবীন্দ্র-নজরুল জন্মোৎসব ইত্যাদি ইত্যাদি। এবং এ সব কিছুর পটভূমিকায় আছে বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। এক সুটকেস বই নিয়ে গিয়েছিলাম, এক সুটকেস বই ও উপহার নিয়ে ফিরে এলাম।