কুইজ কন্টেস্টের পোস্টারটা দেখে রিকি নিনাদকে খুঁজতে ছুটল। নিনাদ ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছেলের সঙ্গে কথা বলছিল।
এমন সময় রিকি হাঁপাতে হাঁপাতে ওখানে পৌঁছে বলল, “এই নিনাদ শোন, তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে!”
অন্য ছেলেগুলোকে কী একটা বলে ওদের কাছ থেকে সরে রিকির কাছে এসে নিনাদ বলল, “কী হয়েছে?”
“একটা কুইজ কন্টেস্টের পোস্টার দেখলাম!”
“তাতে কী?”
“অক্টাগন কম্পানি থেকে আর প্রাইজটা কী বল তো?”
“কী?”
“অনেক টাকা!”
“ও!”
“হ্যাঁ, দুজনের টিম। আমরা দুজন যদি অংশগ্রহণ করি তাহলে জিতে টাকাটা ঘোষালদাদুকে দিয়ে দিতে পারব, আর খেটে খেটে রোজগার করতে হবে না টাকাগুলো! ওই টাকা দিয়ে ওনার কাচ সারাই ভাল ভাবেই হয়ে যাবে।"
নিনাদ রিকিদের ফ্ল্যাটের কমপ্লেক্সেই থাকে। কিছুদিন আগে রিকি আর নিনাদরা ক্রিকেট খেলছিল। যেখানটায় খেলছিল সেখানে ওদের খেলা বারণ কারণ বাড়িগুলো বেশ কাছে আর বল লেগে যে কোন সময় দরজা জানালার কাচ ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু অন্য খেলার জায়গাগুলো বড় ছেলেরা দখল করে রাখলে ওরা কী করবে? সারা বিকেল না খেলে কী থাকা যায়? নিনাদ ওদের দলের সব চেয়ে ভালো ব্যাটসম্যান। খেলা শুরু হওয়ার আগেই ওরা ঠিক করে নিয়েছিল যে জোরে মারা চলবে না কারণ তাহলে বিপদ হতে পারে কিন্তু যারা ভালো খেলে তাদের কী আর সব সময় ওই সব কথা মনে থাকে? থাকে না!
রিকি একটা শর্টপিচ বল করে বলল, “এই নে তোকে ছক্কা মারার বল দিলাম!” আর নিনাদ দিল জোরে ব্যাট চালিয়ে!
ব্যাস আর যাবে কোথায়! বল উঁচুতে উঠে গিয়ে দোতলায় ঘোষালদাদুদের শোওয়ার ঘরের জানালার কাচ ঝন ঝন করে ভেঙে ভিতরে ঢুকে গেল!
তারপর থেকেই যত গণ্ডগোল শুরু হল। নিনাদ আর রিকির মা বাবা ঘোষালদাদুকে কাচ সারাবার পয়সা দিয়ে দিতে চাইছিলেন কিন্তু দাদু নিতে রাজি হলেন না।
বললেন, “না, আপনাদের ছেলেদের একটু শিক্ষা হওয়া দরকার! ওই ভাঙা কাচ সারাবার পয়সা ওদের নিজেদের রোজগার করে আমাকে দিতে হবে! রিকি বল করেছে, নিনাদকে উসকেছে আর নিনাদ ব্যাট চালিয়েছে। তাই আমি মনে করি ওরা দুজনেই সমান ভাবে দায়ী!”
পয়সা রোজগার করে দিতে হবে শুনে নিনাদ আর রিকি বলেছিল, “বারে! তা কী করে হয়? আমরা কী চাকরি করি নাকি?”
দাদু টাক মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “চাকরি না করো অন্যভাবে উপার্জন করবে! রোজ বিকেলে স্কুলের পর আমার গাছগুলোতে এসে জল দিয়ে যাবে, তার জন্যে আমি এক টাকা করে দেবো! এই রকম ভাবে আর কী!”
ওদের মা বাবা আর কী বলবেন, রাজি হলেন। সেই ভাবেই চলছিল। ঘোষালদাদুর ফাইফরমাশ খেটে এক-টাকা দু-টাকা রোজগার করে জানালার কাচ সারাইয়ের টাকা শোধ করতে আজন্মকাল লেগে যাবে সেটা ওরা বুঝতে পারছিল।
রোজ স্কুল থেকে ফিরেই ঘোষালদাদুর বাড়ি যেতে হয় বেচারা নিনাদ আর রিকিকে। দাদু ওদের দেখে ভারি খুশি হন। কোনদিন বলেন, “নিনাদ-রিকি খোকনের দোকান থেকে আমার পাঞ্জাবিটা এনে দাও! এক টাকা পাবে!” কোনদিন হাঁক পাড়েন, “আমার বইটা মনে হয় ছাদে ফেলে এসেছি ওটা এনে দাও। পঞ্চাশ পয়সা!”
এই করে করে অর্ধেক দিন ওদের খেলা-টেলা কিছু হয় না। দাদুর কাজ করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে যায় আর তখন বাড়ি ফিরে যেতে হয়। অন্য বন্ধুরা খুব বিরক্ত হয়। নিনাদ না খেললে ওদের টিম সব সময় হারে তাই সবাই চায় ঘোষাল দাদুর ধারটা যেন তাড়াতাড়ি শোধ হয়ে যায় আর নিনাদ খেলতে পারে।
কুইজের ব্যাপারটা শুনে নিনাদ এক গাল হেসে বলল, “ভালো উপায় বাতলেছিস তো! যদি জিততে পারি তাহলে সেটা তো আমাদের রোজগার, তাই না?”
“হ্যাঁ, একশোবার!”
“চল তাহলে পড়াশোনা করি!”
দুজনে কুইজে নাম দিয়ে জোর কদমে পড়াশোনা শুরু করল, লক্ষ একটাই – ধার শোধ!
থ্রি সির প্রিয়ব্রতকাকু যে অক্টাগনে চাকরি করেন সেটা রিকি বা নিনাদ কেউই জানত না। উনি মনে হয় কিছু দিন আগেই চাকরি বদল করে অক্টাগনে ঢুকেছেন। সেদিন ঘোষালদাদু নিনাদ আর রিকিকে একটা বই ফেরত দিতে প্রিয়ব্রতকাকুর বাড়িতে পাঠালেন। বেল দিতে কাকিমা দরজা খুলে দিলেন।
ওদের দেখে হেসে বললেন, “আরে নিনাদ আর রিকি! এসো এসো!
“এই বইটা ঘোষালদাদু দিলেন কাকুকে ফেরত দেওয়ার জন্যে।"
“ও হো! আমি তো আটা মাখছিলাম। আমার হাতে তো আটা, ছি ছি দরজাতেও লাগালাম। তা তোমরা তো কাকুর স্টাডিটা চেনো, ওখানেই রেখে দিয়ে এসো না হয় বইটা। আমি ওকে বলে দেবো।"
কাকুর স্টাডিতে বইটা রাখতে গিয়েই হঠাৎ খামটা দেখতে পেল রিকি। কম্পিউটারের পাশেই রাখা। ওই কম্পিউটারে মাঝে মাঝে ওদের ভিডিও গেম খেলতে দেন কাকু। খামটার ওপর বড় বড় হরফে লেখা – অক্টাগন ইন্টার-স্কুল কুইজের প্রশ্ন। অর্থাৎ ওরা যে কুইজের জন্যে নাম দিয়েছে তার প্রশ্নগুলো এখন কাকুর কাছে রয়েছে!
“ওই দেখ নিনাদ! কাকু নিশ্চয়ই এখন অক্টাগন কম্পানিতে চাকরি নিয়েছেন!”
নিনাদও দেখে চমকে উঠল। কাকুর কাছে কুইজের প্রশ্ন থাকাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। কাকু বরাবরি কুইজ কন্টেস্ট ইত্যাদি কন্ডাক্ট করেন। এখন অক্টাগন তাই ওনাকে ওদের কুইজ কন্টেস্টটার ভার দিয়েছে।
দুই বন্ধুতে মুখ চাওয়া চাওয়ি করল। একবার খামটা খুলে প্রশ্নগুলো দেখে নিয়ে প্রাইজটা ওদের হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর তেমন পড়াশোনা করতেই হবে না!
পরক্ষণেই নিনাদ বলল, “না রে রিকি! জিতলে আমরা নিজেদের চেষ্টা আর ক্ষমতার জোরেই জিতব, চুরি করে নয়! চুরি করলে আর কেউ না জানুক আমরা তো জানব!”
রিকি বলল, “ঠিক বলেছিস! অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতেই হয়! আর সত্যি কথা কী বলতো আমরা যদি প্রাইজ নাও পাই তাহলেও কিছু এসে যাবেনা। দুজনে মিলে কাজ করে দেখবি একদিন ঠিক দাদুর ধার শোধ করে ফেলব!”
“হ্যাঁ, একদম ঠিক কথা বলেছিস!”
বই রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ওরা দুজনে। চেঁচিয়ে বলল, “কাকিমা, বই স্টাডিতে রেখে দিয়েছি, এবার আমরা আসছি।"
কাকিমা বললেন, “ওমা, চলে যাচ্ছ! একটু কিছু খেয়ে যাবে না?”
“না কাকিমা, আজ থাক । পরে একদিন আবার আসব", বলে রিকি আর নিনাদ বেরিয়ে পড়ল।
কুইজের দিন দুই বন্ধু জোর পড়াশোনা করে গেল কিন্তু তাও ফার্স্ট হতে পারল না, থার্ড হয়ে গেল। অবিরাম আর সুকৃৎ ফার্স্ট হয়ে গেল। ওরা ক্লাসেও ফার্স্ট সেকেন্ড হয়, ওদের মাথাই আলাদা!
প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশানের সময় দুই বন্ধু মনমরা হয়ে বসেছিল। বলেছিল বটে যে প্রাইজ না পেলে কিছু হবে না কিন্তু আশা তো করেছিল মনে মনে। মোটে দুটোই প্রাইজ, ফার্স্ট আর রানার্স আপ।
প্রিয়ব্রত কাকু আর ওনার এক সহকর্মী মিলে প্রাইজ দিচ্ছিলেন। সবাইকে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়ে যেতে প্রিয়ব্রতকাকু বললেন, “একটি বিশেষ ঘোষণা আছে! ক্রিকেটে যেমন ফেয়ার প্লে ট্রফি হয় কিছুটা সেই রকম একটা প্রাইজ আমরা দিতে চাই!”
“রিকি আর নিনাদ আমার বাড়িতে এসে কুইজের প্রশ্নের খামটা দেখেও নিজেদের সততা বজায় রেখেছে, চিটিং করেনি! আর ওদের পাড়ায় থাকার দরুন আমি জানি যে ওদের প্রাইজের অর্থটা খুবই দরকার ছিল! ওদের এই বাহবা দেওয়ার মতন ব্যবহারের জন্যে ওদের দুজনকে একটা স্পেশাল প্রাইজ দেওয়া হচ্ছে!”
রিকি আর নিনাদ ভীষণ খুশি হয়ে স্টেজে উঠে প্রাইজটা নিল। একটা খাম! সবাই খুব হাততালি দিল।
ওরা ভেবেছিল খামে বুঝি টাকা আছে কিন্তু খামটা খুলে দেখল ভিতরে রয়েছে ঘোষালদাদুর সই করা একটা চিঠি! তাতে লেখা রয়েছে –
স্নেহের রিকি আর নিনাদ, তোমাদের সততার পুরস্কার স্বরূপ তোমাদের কাচ ভাঙার সব ধার আমি শোধ বলে ধরে নিলাম! জানালার দামের জন্যে তোমাদের আর আমার জন্যে কোন কাজ করতে হবে না। আশীর্বাদ করি যেন তোমরা বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হও! ইতি, ঘোষালদাদু