আমি জানি
অনি আছে
আমার অদূরে
— ১৭ই মার্চ ১৯৭০
হলুদ হয়ে গেছে ডায়েরীর এই পাতাটা। অস্পষ্ট হয়ে গেছে হাল্কা নীল পেনের কালি। তবু পড়া যায় পরিষ্কারভাবেই। গোটা ডায়েরীটাতে কেবল এই একটি পাতাতেই লেখা। আর শুধু ওই কটি কথাই। এই সবুজ রঙের ডায়েরীটি অবিনাশের। যত্ন করে তুলে রাখা। তার ঘরের কাঠের প্রকাণ্ড আলমারীটিতে।
অবিনাশ ডায়েরীর পাতাটা উল্টিয়ে দেখলেন। বেশ খানিকক্ষণ ধরে। তারপর সেটিকে রেখেছিলেন তার যথাস্থানে। অর্থাৎ সেই আলমারীর অন্ধকারে। যেখানে সেটি রাখা ছিলো এতকাল ধরে। সযত্নে।
এর আগের দিন সন্ধের কথা—ঢং ঢং করে সাতটা বাজলো অবিনাশ ঘোষালের বসার ঘরের দেওয়াল ঘড়িটায়। ঘরে ঢুকলেন সন্তোষ গুহ। 'আজও একটু দেরী হয়ে গেলো'—অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে বললেন তিনি। কোনো উত্তর না দিয়ে তাঁকে ইশারায় সামনের চেয়ারে বসতে বললেন অবিনাশ ঘোষাল।
অবিনাশ ঘোষাল এক বিত্তবান বনেদী পরিবারের মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের অবসরপ্রাপ্ত এক বড়বাবু। বেলগাছিয়ায় এক প্রকাণ্ড বাড়িতে থাকেন তিনি আর তাঁর চিররুগ্ন স্ত্রী। সঙ্গে দীর্ঘকালের অনুচর বসন্ত। নানা রকমের অভিজাত সৌখীনতায় স্বচ্ছন্দে অবিনাশের জীবনযাপন। সেইসঙ্গে অবশ্য দুএকটি নিয়মিত সময় কাটানোর সম্পর্কও আছে। যেমন এই সন্তোষ গুহ।
সন্তোষ গুহ ছিলেন চাকরী জীবনে অবিনাশের অধস্তন কর্মচারী। ছাপোষা মধ্যবিত্ত মানুষ। রিটায়ার করার পরেও অবিনাশের সঙ্গে প্রভুভৃত্য সম্পর্কটি ধরে রেখেছেন। প্রায় প্রতি শনিবার সন্ধেয় এসে হাজির হন অবিনাশের বাড়ি। কথায় কথায় চেষ্টা করেন এমন কিছু বলতে যাতে অবিনাশ খুশী হন। কিংবা নিদেনপক্ষে উৎসাহিত হন। অবিনাশও সন্ধে থেকে বসে থাকেন সেই আত্মপ্রসাদের অপেক্ষায়।
অতএব এই সন্ধেবেলায় অবিনাশ বসে আছেন তাঁর একতলার বসার ঘরটিতে। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি। তাই পুরোনো হলেও ঘরের পরিবেশই আলাদা। ঘরে সেগুন কাঠের বিরাট বিরাট কয়েকটি চেয়ার। সামনে প্রকাণ্ড গোলটেবিল। পাশে বিরাট মাপের বইয়ের আলমারি। অনেক উঁচু সিলিং থেকে নেমে এসেছে কাঁচের ফুলকাটা আলোর শেড। পিছনের দেওয়ালে অবিনাশের পিতৃপুরুষদের ভারী ফ্রেমে বাঁধানো সার সার ছবি। আর তার বেশ কিছুটা নীচে স্টীলের ফ্রেমে বাঁধানো ছোটো একটা ছবি যেন কিছু বেমানানভাবে টাঙানো আছে এই পরিবেশে সঙ্গে।
ছবিটি একটি অল্পবয়েসী ছেলের। স্কুলের ইউনিফর্ম পরা। সাদা শার্ট। নীল প্যান্ট। একমাথা কোঁকড়া চুল। বড়ো বড়ো চোখ। পাতলা ধুলোর আস্তরণে কিছুটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে সেই ঝলমলে মুখটা।
সন্তোষ গুহ বসার ঘরে ঢোকার সাথেসাথেই প্রকাণ্ড হেলানো চেয়ারে আধশোয়া হয়ে থাকা অবিনাশ ঘোষাল খবরের কাগজটা মুখ থেকে নামিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। তাঁর গায়ের ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী তাঁর ফর্সা মুখ আর একমাথা রূপোলী চুলের সঙ্গে মানানসই রকমের পরিপাটি সুন্দর। সেই শুভ্রকান্তি ব্যক্তিত্বের সামনে নীল ডোরাকাটা শার্ট আর ঢোলা খয়েরী প্যান্টপরা টাকমাথার সন্তোষ যেন এক জীর্ণ বৃদ্ধ। যদিও অবিনাশ ঘোষাল সন্তোষের চেয়ে পাক্কা পাঁচ বছরের বড়ো। অবিনাশের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে সন্তোষ তাঁর সামনের চেয়ারে বসলেন অনুগত পাত্রের মতো।
'গতকাল একটা কথা শুনলাম। আপনারও খুব ভালো লাগবে জানলে'—ঠিক এইভাবেই শুরু করলেন সন্তোষ। অবিনাশ আলতো দৃষ্টিতে সন্তোষের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার খবরের কাগজের পাতায় চোখ রাখলেন। 'আপনার ছৌ নাচের উপরে লেখাটা ধ্রুববাবুর ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বলছিলেন ওনার পত্রিকার পরের সংখ্যায় ছাপাবেন'—সাগ্রহে বললেন সন্তোষ। অবিনাশ খবরের কাগজ নামিয়ে এক ঝলকে সন্তোষের দিকে তাকিয়েই যেন অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে উত্তর দিলেন—'বিষয়টা নিয়ে ইংরেজিতে লিখছি বড় করে। লণ্ডনের এক পাবলিকেশনের সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে গত মাসে।' এই বলে আবার খবরের কাগজটা মুখের সামনে মেলে ধরলেন তিনি।
সন্তোষের কাছে ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। সন্তোষ জানেন যে অবিনাশ দেখাতে চেষ্টা করেন যে হেন বিষয় নেই যার উপর তাঁর গভীর জ্ঞানের কমতি আছে। এতেই অবিনাশের মহা তৃপ্তি। আর সন্তোষও কৃতার্থ।
'তাই নাকি? এতো বিরাট ব্যাপার। বলেননি তো আগে?'—ইত্যাদি ইত্যাদি দুয়েকটি স্বাদু বাক্যের পর সন্তোষ প্রসঙ্গ পাল্টালেন। ছৌনাচ থেকে ইনডোর প্ল্যান্ট, ইনডোর প্ল্যান্ট থেকে ক্লাসিকাল মিউজিক কন্ফারেন্স এই ধরনের অসাধারণ বিষয় বৈচিত্র্যে প্রসঙ্গ বদলাতে থাকলো। সন্তোষ এতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ একটু বেশি পাণ্ডিত্য প্রকাশ করে ফেলেছেন অবিনাশ। আর তার ধাক্কায় সন্তোষ যেন সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন একটু তাড়াতাড়িই।
এই সময় হঠাৎই সন্তোষের দৃষ্টি চলে গেলো দেওয়ালে টাঙানো স্টীলের ফ্রেমের ছবিটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে সন্তোষের মনে হোলো—'আরে। আসল কথাটাই তো বলা হয়নি ওনাকে।' তখুনি সন্তোষ সাগ্রহে অবিনাশের মুখের দিকে চেয়ে বলে উঠলেন—'গত সপ্তাহে স্যার আমার মেয়ে আমার নাতিটাকে নিয়ে গিয়েছিল আর্মি স্কুলে। ওখানে ভর্তি করা তো ভীষণ শক্ত। আমার বেয়াইমশাই তো ডিফেন্সে ছিলেন, তাই ওনার ইচ্ছেতেই—সে যাই হোক। ওখানে গিয়ে তো আপনার ছেলের সম্বন্ধে —।' অবিনাশ আস্তে করে চোখ মেলে তাকালেন সন্তোষের মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যার জন্য সন্তোষ থতমত খেয়ে থেমে গেলেন।
অবিনাশ মুখ ফেরালেন অন্যদিকে। অন্যমনস্কের মতো। সন্তোষ আবার আস্তে করে বলতে শুরু করলেন—'আপনার ছেলের এই ছবিটা—'বলতে বলতে দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে সন্তোষ সোৎসাহে আবার শুরু করলেন—'ওরা টাঙিয়ে রেখেছে খুব যত্ন করে'। অবিনাশ আবার নিঃশব্দে সন্তোষের মুখের দিকে তাকালেন। সন্তোষ সেদিকে খেয়াল না করে কৃতার্থের মতো বলে যেতে লাগলেন—'কত কি লেখা আছে ওই ছবিটার নীচে। কবে কিসে কিসে সে ফার্স্ট হয়েছিলো—কি কি প্রাইজ পেয়েছিল—সব।'
সন্তোষ লক্ষ্য করলেন যে অবিনাশ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর মুখের দিকে। তখন থতমত খেয়ে সন্তোষ বললেন—'নাহ্—মানে—আসলে ওখানকার টিচাররাই বলছিলেন মানে ওঁদের মনে এখনও এতবছর বাদেও—'। অবিনাশ কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নামিয়ে খুব ধীরে ধীরে খবরের কাগজটা মুড়তে মুড়তে বললেন—'আজ একটু তাড়াতাড়ি শুতে যেতে হবে। খানিকবাদেই।' দেওয়াল ঘড়িটাতে ঢং ঢং করে নটা বাজলো। সন্তোষ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন—'হ্যাঁ স্যার—নিশ্চয়ই—নিশ্চয়ই—আপনার শরীর টরির কিছু? 'নাহ্। ঠিক আছে। তাহলে আজ—' বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন অবিনাশ ঘোষাল।
বেরিয়ে এসেই সন্তোষ বুঝলেন যে কাজটা খুব অনুচিত হয়ে গেছে তাঁর। ভেবেছিলেন ওই আর্মি স্কুলের টিচাররা এত দিন বাদেও ওনার ছেলেকে এভাবে মনে রেখেছে জানলে উনি খুশীই হবেন। কিন্তু নাহ্। খুশী তো উনি হনই নি। বরং হয়তো দারুণ আঘাত পেয়েছেন মনে মনে। ব্যাপারটা খুব বিশ্রী হয়ে গেল অজান্তেই। ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকের বাস ধরলেন সন্তোষ।
সন্তোষ গুহ বেরিয়ে যেতেই অবিনাশ তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর বসন্তকে ডাকলেন। 'এক কাপ কড়া চা দিয়ে যাও তো'—বলেই কিছুটা আনমনে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। বসন্ত চা নিয়ে এলে অবিনাশ বললেন—'আজ রাতে কিছু খাবো না। একটা জরুরী কাজে বসবো এখন। তাই আর ডাকবে না আমায়।' বসন্ত চলে গেলে ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের চেয়ারে এসে বসলেন অবিনাশ।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন স্টীলের ফ্রেমে বাঁধানো সেই ছবিটার দিকে। ছবিটার খুব কাছে এসে আলতো করে হাত দিয়ে মুছে দিলেন ছবির উপরের পাতলা ধুলোর আস্তরণটিকে। আবার জ্বলজ্বল করে উঠলো ছবিটা।
অনির্বাণ। অনির্বাণ ঘোষাল। অবিনাশ ঘোষালের একমাত্র সন্তান। এবং একান্ত অবলম্বন। ষোলো বছরের ঝলমলে ছেলে। দশ বছর আগে অবিনাশের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে সে। একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে।
যদিও অবিনাশের বিশ্বাস অন্যরকম। অবিনাশ কখনো মেনে নিতে পারেন নি তাঁর এবং তাঁর সন্তানের মধ্যে ঈশ্বর কিংবা নিয়তির সৃষ্টি করা এই বিচ্ছেদ। তাই শাস্ত্রসিদ্ধ শেষকৃত্যের পর বাড়ি এসে তিনি এই ছবিটির সামনে নিশ্চুপে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। আর তারপর একটি সবুজ রঙের ডায়েরী বার করে তিনি লিখলেন—
আমি জানি
অনি আছে
আমার অদূরে
— ১৭ই মার্চ ১৯৭০
তারপর কেটে গেল দশ বছর। দশ দশটা বছর পার হয়ে গেল দেখতে দেখতে। আর এই দশ বছর ধরে অবিনাশের সঙ্গে অনির কোনো দূরত্ব তৈরী হয়নি কখনো। বরং অবিনাশ প্রায়শই অনুভব করেছেন অনির আশ্চর্য অস্তিত্ব। প্রতিটি তুচ্ছ তুচ্ছ স্মৃতি—অজস্র অসংখ্য ছবি তিনি তাঁর মনে ধরে রেখেছেন পরমযত্নে। বহু বিচিত্র সৌখীনতা ও নানা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে বেঁচে থাকার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন এক তীব্র দহন। অন্তত অবিনাশ অনুভব করেন।
'কিন্তু এখন? এখন কি হোলো? একটু আগেই তো কতো কথা কতো স্মৃতি উসকে দিয়ে চলে গেলো সন্তোষ। আর এই মুহূর্তে—এই মুহূর্তে যখন চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে এক মাথা কোঁকড়া চুল আর বড়ো বড়ো চোখের দৃষ্টি মেলে তাঁর অনি —অথচ—অথচ কোথায় সেই যন্ত্রণার স্রোত? বেদনার পাথরভার?'—এসব কথাগুলি তোলপাড় করতে লাগলো অবিনাশের মনে। বিহ্বল হয়ে বসে অবিনাশ উপলব্ধি করলেন—এই নিশুত রাতে—নির্জন ঘরে—প্রাণপ্রতিম অকালমৃত সন্তানের ছবির সামনে সমস্ত স্মৃতি উথালপাথাল করেও একবিন্দু অশ্রুজলের সম্বল নেই তাঁর।
অবিনাশ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারলেন না নিজের এই ভয়ঙ্কর অস্তিত্ব। মাথা ঝুঁকিয়ে চোখ বন্ধ করে শরীরটাকে কুঁকড়ে থরথর করে কাঁপতে থাকালেন অবিনাশ। তার সেই শরীরটা যেন একটা নিষ্প্রাণ কাঠের টুকরোর মতো এলিয়ে পড়লো সেই চেয়ারে।
'তাহলে কি সময়? সময়ই শুষে নিলো সব শোক? সব চোখের জল? আমার অজান্তে? এইভাবে সময়ের কাছে হেরে গেলাম শেষ অবধি? সব কান্না সব যন্ত্রণা মিলিয়ে গেলো আমার? তাহলে কি নিয়ে এখন বেঁচে থাকবো আমি?'—এইসব ভাবতে ভাবতে কতক্ষণ কেটে গেলো কে জানে। তারপর অবিনাশ মাথা তুললেন। যেন অতিকষ্টে। তাঁর অবসন্ন শরীর থেকে মাথাটাকে টেনে সোজা করলেন। আর ক্লান্ত চোখে সামনের দিকে চাইলেন।
আর তখনই সামনে রাখা চায়ের কাপটির দিকে দৃষ্টি চলে গেলো তাঁর। তিনি দেখতে পেলেন—একটা পিঁপড়ে চায়ের মধ্যে সাঁতরাচ্ছে। হঠাৎ কি মনে করে অবিনাশ তাঁর ডান হাতের তর্জনীটা চায়ের কাপে ডুবিয়ে দিলেন পিঁপড়েটা একটা শক্ত শুকনো ডাঙা পেয়ে অবিনাশের আঙুল বেয়ে উঠে আসলো সঙ্গে সঙ্গে। পিঁপড়েটার এই উঠে আসাটাকে জীবন যুদ্ধের এক সার্থক সংগ্রাম বলে মনে হোলো অবিনাশের।
এইবার যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক হয়ে অবিনাশ ওই আঙুলে করেই পিঁপড়েটাকে ফের চুবিয়ে দিলেন চায়ের মধ্যে। পিঁপড়েটা আবার ডুবে গেলো চায়ে। এবং আরো প্রাণপণে সাঁতরাতে শুরু করলো। অবিনাশ ঠিক আগের মতোই তাঁর আঙুলটা ডুবিয়ে দিলেন পিঁপড়েটাকে উঠে আসতে সাহায্য করার জন্য। এবং পিঁপড়েটা একইভাবে উঠে এলো অবিনাশের আঙুল বেয়ে।
'চমৎকার'—মনে মনে বললেন অবিনাশ। মনে মনে প্রশংসা করলেন পিঁপড়েটার এই লড়াই করার ক্ষমতাটিকে। 'জীবন এইরকমই হওয়া উচিত। হার স্বীকার করতে নেই'—নিজের মনেই এই কথাগুলি বলতে বলতে আবার আঙুলে করে পিঁপড়েটাকে চায়ে চুবিয়ে দিলেন অবিনাশ। পিঁপড়েটা আবার অসহায়ভাবে তার পাগুলো নাড়তে থাকলো। অবিনাশ ঠিক আগের মতোই আঙুল ডুবিয়ে তুলে আনলেন পিঁপড়েটাকে। তারপর আঙুলের ডগা থেকে চায়ের ফোঁটাটা ঝেড়ে ফেললেন ডিশের উপর। আর সেই সাথে পিঁপড়েটাকেও। এইবার অবিনাশ লক্ষ্য করলেন যে পিঁপড়েটা আর নড়ছে না।
অবিনাশ একদৃষ্টে পিঁপড়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। 'হেরে গেলো। শেষপর্যন্ত হেরে গেলো।'—স্থির হয়ে যাওয়া পিঁপড়েটাকে হাতে নিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকলেন অবিনাশ। নিজের হাতের তেলোয় ফেলে পিঁপড়েটাকে চোখের আরো কাছে নিয়ে এলেন তিনি। কেমন একটা অদ্ভূত অনুভূতি হতে লাগলো তাঁর। মরা পিঁপড়েটাকে একটা কাগজের টুকরোয় নিয়ে যেন একটা ঘোরের মধ্যে দোতলায় নিজের ঘরে চলে এলেন তিনি।
তারপর সেই ঘোরের মধ্যে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গেলেন তাঁর শোয়ার ঘরে বিরাট পালঙ্কের দিকে। যার পাশে একটা শ্বেতপাথরের টেবিল—আর টেবিলের উপরে পিতলের টেবিলল্যাম্প—তার নীচে রূপোর ওভাল ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছোট্ট ছবি—অনির্বাণের।
অবিনাশ ছবিটির সামনে ওই কাগজের টুকরোটিকে রাখলেন। তারপর ড্রয়ার থেকে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট বের করে ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস জল দিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়লেন আলো নিভিয়ে। ঘরটিকে সম্পূর্ণ অন্ধকার করে।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানার পাশে তাঁর অনির ছবির সামনে রাখা কাগজটার উপর মরা পিঁপড়েটাকে লেপ্টে থাকতে দেখে অবিনাশ মনে করতে চেষ্টা করলেন কি ঘটেছিলো গতরাত্রে।
কিন্তু কতটুকু মনে পড়লো অবিনাশের?
অবিনাশের মনে পড়ে গেলো সবকিছু—সমস্ত ঘটনা—পরপর ছবির মতো হঠাৎ করে ভেসে আসতে লাগলো অবিনাশের চোখের সামনে। সেই সন্ধেবেলা—সেই সন্তোষ গুহ—আর অনির সেই ছবি। আর সেই পিঁপড়েটা—চায়ের কাপে পড়ে যাওয়া পিঁপড়েটা—বারবার সাঁতরাতে সাঁতরাতে তার আঙুল বেয়ে উঠে আসা—আর শেষে সেই আঙুলের ডগাতেই স্থির হয়ে যাওয়া—সব কথা।
সামান্য একটা পিঁপড়ের ব্যাপার তো ভুলে যাওয়ারই কথা। আর তাঁর অনির ছবিতেও ধুলো পড়ে গেছে যথেষ্ট। কারণ সময়টাতো নেহাৎ কম নয়। বারো বছর। আরো বারোটা বছর পার করে দিয়ে অবিনাশ এখন এক শয্যাশায়ী বৃদ্ধ। দুবছর আগে সেরিব্রাল অ্যাটাকের পর থেকে হাত পায়ের জোর একেবারে চলে গেছে। এছাড়া চিরকালের সাথী হাঁফানির কষ্টটা তো আছেই। পেচ্ছাপের নল—অক্সিজেনের নল—দরকার মতো স্যালাইনের নল—আর সেই সঙ্গে দুবেলা নার্সের ধমক-ধামক—এসব নিয়েই অবিনাশের এখন বেঁচে থাকা।
অতএব অবিনাশ এখন তাঁর দোতলার ঘরে হাসপাতালের মতো চাবি দেওয়া লোহার খাটে আধশোয়া হয়ে—সামনে একটা চাকাওয়ালা টেবিলের মতো জিনিস বুকে ঠেকিয়ে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন—হ্যাঁ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন— পিঁপড়েটা ঘুরছে। টেবিলের উপরে রেখে যাওয়া চায়ের কাপের কিনারা ধরে পিঁপড়েটা ঘুরছে।
নাহ্। কোনো দিবাস্বপ্ন বা দৃষ্টিবিভ্রম নয়। অতোটা তালগোল পাকিয়ে যায়নি তাঁর বোধবুদ্ধি। তাই অবিনাশ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন তাঁর সামনের দেওয়াল ঘড়িতে চারটে দশ—পাশের জানালা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে পায়ের কাছে—বুকের কাছে ঠেকানো টেবিলটায় হাল্কা সবুজ রঙের কাপ-ডিশ—ডিশে দুটো ক্রিমক্রাকার বিস্কুট—কাপে টলমল করছে সোনালী রঙের লিকার চা—অর্থাৎ কল্পনা সিস্টার রেখে গেছে একটু আগে—টের পান নি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলেন একটু—আর আধঘন্টার আগে দেখা পাওয়া যাবে না সিস্টারের—তাহলে ততক্ষণ—ততক্ষণ—চোখ চেয়ে দেখতে থাকবেন ওই পিঁপড়েটার গতিবিধি?
এইসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে অবিনাশ চোখ বন্ধ করলেন। আর তখনই তাঁর মনে পড়ে গেলো সবকিছু—বারো বছর আগের সমস্ত ঘটনা।
অবিনাশ ভাবতে থাকেন—কতকাল আগের ঘটনা— কিন্তু এখনও চোখে ভাসছে যেন জ্বলজ্বল করে। কেন? কে জানে?
ওই ঘটনার পর থেকেই কেমন যেন বদলে গিয়েছিল তাঁর জীবনটা। অনির সেই ওভাল ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা কোথায় গেলো কে জানে। অবিনাশ ভাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু মনে করতে পারেন না। চোখ খোলেন আর দেখতে পান পিঁপড়েটা অদ্ভুতভাবে একবার এদিক একবার ওদিক করে বেড়াচ্ছে চায়ের কাপের কিনারায়।
'আরে—এই করতে করতে পিঁপড়েটা পড়ে যাবে তো চায়ের মধ্যে'—ভাবতে ভাবতেই পিঁপড়েটা খসে পড়লো চায়ের কাপের মধ্যে। তারপর প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগলো উঠে আসার জন্য। ঠিক বারো বছর আগের ঘটনাটার মতো।
অবিনাশ দেখলেন। তারপর চোখ বন্ধ করলেন। পিঁপড়েটাকে স্পর্শ করার মতো কোনো শক্তিই তাঁর আজ নেই। ডান হাতটা কোনোক্রমে কিছুটা তুলতে পারেন। বাঁ হাতটা সম্পূর্ণ অকেজো। সামান্য নড়াচড়া করলেই শ্বাসকষ্ট হয়। অক্সিজেনের মাত্রা বাড়িয়েও কিছু লাভ হয় না। প্রাণটা হাপরের মতো ধড়ফড় করতে থাকে। অবিনাশ ভাবতে থাকেন—যদি কোনোক্রমে ডান হাতটাকে টেবিলের উপরে নিয়ে আসা যেতো—যদি কষ্ট করে আঙুলটাকে চায়ের কাপে ডোবানো যেতো—নাহ্। সবই কল্পনা। এসব কোনোকিছুই করার ক্ষমতা তাঁর আজ নেই। এইটুকু নড়াচড়াতেই শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে। অবিনাশ চোখ বুজিয়ে ফেললেন। দুগাল বেয়ে গড়িয়ে এলো তপ্ত চোখের জল।
চোখ বন্ধ করে একটা অদ্ভুত ব্যাপার মনে হোলো অবিনাশের। জীবনে তো বাজি খেলেছেন অনেক। হেরেছেন যেমন জিতেওছেন কম নয়। তাঁর জীবনটাই তো একটানা কতগুলো বাজি খেলার হিসেব। 'তাহলে'—ভাবলেন অবিনাশ—'তাহলে বাজি ধরা যাক এই পিঁপড়েটার উপর—নিজের শেষ সময়ের জন্য। এই পিঁপড়েটা—এই পিঁপড়েটা যদি পারে উঠে আসতে—ওই চায়ের মধ্যে থেকে কাপের বাইরে তাহলে—তাহলে এ যাত্রায় আমিও...'। ভাবতে ভাবতে অবিনাশের গাল বেয়ে গড়িয়ে এলো আরেক ফোঁটা চোখের জল।
আবার চোখ চাইলেন অবিনাশ। দেখলেন পিঁপড়েটা প্রায় উঠে এসেছে কাপের কিনারায়। তারপর তার সামনের পা দুটি দিয়ে কাপের কিনারাটা আঁকড়ে ধরে উঠে পড়লো কাপের উপরে। 'যাক্ পেরেছে! বেঁচে গেছে!'—নিজের মনেই বলতে বলতে এক আশ্চর্য স্বস্তিতে চোখ বোজালেন অবিনাশ। ভুসভুস করে অক্সিজেন চলছে অকেনক্ষণ ধরে। বুকটা একটু হাল্কা লাগছে এবার। চোখ চাইলেন একটু বাদে। এক অদ্ভুত তৃপ্তিতে। ভাবলেন—'যাক্ তাহলে এ যাত্রায়—'
'একি! পিঁপড়েটা এখনও কাপের বাইরে নেমে যায়নি তো! বরং একইভাবে ঘুরছে। ওই কাপের কিনারা বরাবর। কিছুতেই নামছে না কাপ থেকে'—অবাক হয়ে দেখলেন অবিনাশ। পিঁপড়েটা চক্কর মারতেই থাকে। আর অবিনাশ উদ্বিগ্ন হয়ে দেখতে থাকেন। হঠাৎই কাপের মধ্যে ফের পড়ে যায় পিঁপড়েটা। আর ফের সাঁতরাতে থাকে প্রাণপণে। 'পারবে—নিশ্চয়ই পারবে এবারেও পারবে'—চোখ বন্ধ করে নিজের মনকে বারবার বলতে থাকেন অবিনাশ।
আবার চোখ খোলেন তিনি। দেখতে পান পিঁপড়েটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে—সামনের পা দুটো দিয়ে মরিয়া হয়ে কাপের মসৃণ দিকটা আঁকড়ে ধরতে কিন্তু পারছে না—কিছুতেই পারছে না—কাপের কিনারায় পৌঁছেও পিছলে পড়ে যাচ্ছে বারবার।
অবিনাশের মনে হোলো পিঁপড়েটা- পিঁপড়েটা যেন হঠাৎ কেমন ঝাপসা লাগছে তাঁর চোখে। তারপর বুঝলেন শুধু পিঁপড়ে নয়—চায়ের কাপ-ডিশ-টেবিলের ধার- সবই যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তাঁর চোখের সামনে। অবিনাশ মাথা তুলে সামনের দিকে তাকাতে চেষ্টা করলেন। তখনই তাঁর মনে হোলো কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে সামনেটায়—একটা ছেলে—গায়ে সাদা শার্ট—চারিদিক বড়ো অস্পষ্ট—তবুও খুব চেনা মনে হচ্ছে তাঁর—
—এইবার চারিদিক হঠাৎ আরো ঝাপসা হয়ে গেলো—ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে অবিনাশ হঠাৎই নিশ্চিতভাবে চিনতে পারলেন ওই ছেলেটিকে—আর তখন চেষ্টা করতে লাগলেন—প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলেন তাঁর অক্ষম হাত দুটিকে ওই ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে দিতে—তাঁর যাবতীয় প্রাণশক্তি দিয়ে—সমস্ত শরীরটা তখন থরথর করে কেঁপে উঠলো তাঁর।
আর ঠিক সেই সময়েই পিঁপড়েটা কাপ থেকে উঠে এলো অব্যর্থভাবে—আর তার সামনের শুঁড় দুটো তুলে ধরলো অবিনাশ ঘোষালের সদ্য স্থির হয়ে যাওয়া আঙুলের অদূরে।
(কাহিনীটির প্রথমাংশ ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড-এর 'দ্য ফ্লাই' অনুসরণে)