• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৯ | এপ্রিল ২০১৫ | গল্প
    Share
  • দুটি গল্প : সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়



    কেঁচো কিংবা জয় বাবা তারকনাথ

    || ১ ||

    র্নিং শিফটে যাবার সময়ই ট্রেনের দেওয়ালে সাঁটা কাগজটার দিকে চোখ পড়েছিল তারকের। “আপনি কী জীবনে বিশ্বাস হারিয়েছেন? তা’হলে নীচের ঠিকানায় অবিলম্বে যোগাযোগ করুন।” সোজাসুজি তাকাতে একটু লজ্জাই লাগছিল। লোকে কী ভাববে! আড়ে আড়ে দেখে ঠিকানাটা মুখস্থ করে রাখল। উত্তরপাড়ার ঠিকানা। পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যার সমাধান সিদ্ধাচার্যর হাতের মুঠোয়। সাড়ে তিনটের সময়, শিফট করে ফেরার পথে উত্তরপাড়ায় নেমে পড়ল তারক। খোঁজ খবর করে সাইকেল রিক্সা নিল। রিক্সা থেকে নেমে মোড়ের পানের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিল জায়গাটা। বেশ ভিড়। কাঠের হাতলওলা বেঞ্চি ছাপিয়ে সামনের ফাঁকা মাঠে লোক দাঁড়িয়ে আছে। নাম লিখিয়ে, ঠেলে গুঁজে বারান্দার বেঞ্চিতেই বসল তারক। এত মানুষ যখন আসে তখন তারও নিশ্চয় কিছু একটা উপায় হবে।

    তারকের জীবনে অনেক সমস্যা। তার মধ্যে প্রধান সমস্যা হল বয়সের সাথে সাথে সে কেমন ম্যাদা মেরে যাচ্ছে। মালতী আজকাল প্রায়ই হ্যাটা দেয়, বলে, “তুমি কি একটা মানুষ, না মেরুদণ্ডহীন কেঁচো?” আসলে ঘরে বাইরে এত বিভিন্ন রকমের ঝামেলা, সামলাতে সামলাতে তারক ন্যাজেগোবরে হয়ে আছে। বেশ কিছুদিন ধরেই বাড়িওলার সঙ্গে বনছে না। ওরা একতলায় দুটো ফ্যামিলি, বাড়িওলা পুরো দোতলাটা নিয়ে থাকে। সামনে এক ফালি উঠোন। মালতী এক কোণে একটা তুলসী গাছ লাগিয়েছিল। রোজ সন্ধেবেলা জল দিয়ে, মাটিতে ধূপ গুঁজে, শাঁখ বাজায়। দোতলার কাজের মেয়েটা তার ওপর রেগুলার আবর্জনা ফেলে। মালতী বলতে গিয়েছিল। বাড়িওলার বৌ তাকে দুটো কথা শুনিয়ে দিল। তারা নাকি বাড়ি ভাড়া দিয়েছে, উঠোন নয়। মালতী ফোঁস ফোঁস করতে করতে এসে তারকের ওপর ঝাল ঝাড়ল, “তোমার বিয়ে করা বৌকে যা নয় তাই বলবে, আর তুমি চুপ করে থাকবে।” তারক মাথা নিচু করে বসে থাকে। ঝগড়াঝাঁটি করার মত মানসিক জোর কুলিয়ে উঠতে পারে না। ফ্যাক্টরিতেও তথৈবচ। শিফট ইন-চার্জ জনার্দন আগাপাশতলা ধেঁতিয়ে যেতে না যেতেই ফোরম্যান সুখলাল টেবিলের ওপর ধাঁই করে হেলমেট নামিয়ে রেখে যায়। তারক কাউকেই কিছু বলতে পারে না। সে ফ্যাক্টরি যায়, বাড়ি ফেরে। ভেতরে ভেতরে কাঁটা হয়ে থাকে। এই বুঝি কিছু নতুন উপদ্রব শুরু হল। তারক বোঝে কিছু একটা করা দরকার। এ ভাবে আর চলছে না।

    পাশে বসা সিড়িঙ্গে গোছের মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “প্রথমবার?”

    তারকের বেশি কথা বলার ইচ্ছে ছিল না। তবু ভদ্রতার খাতিরে বলল, “হ্যাঁ, আপনি?”

    “এই নিয়ে তিন বার। মাঝখানে কমে গিয়েছিল। ইদানিং আবার বেড়েছে।”

    “কি?”

    “অর্শ। খুব জ্বলুনি, বুয়েচেন।” বলতে বলতে তিনি বেঞ্চিতে নড়ে বসলেন।

    তারক আর কথা বাড়াল না। তার ডাক আসতে সন্ধে হয়ে গেল। একটু সঙ্কোচের সঙ্গেই ঘরে ঢুকল তারক। সিদ্ধাচার্য ঢুলু ঢুলু চোখ তুলে তাকালেন। তারক ভেবেছিল তার সমস্যার কথাটা সাতকাহন করে খুলে বলতে হবে। সিদ্ধাচার্য সে সবের ধার দিয়েই গেলেন না। বাঁদিকের নক্সা কাটা কাঠের হাতবাক্স খুলে এতটুকু একটা মাদুলি দিলেন তারকের হাতে। তারক একটু হতাশই হল।

    “বাবা এতে কী হবে?”

    সিদ্ধাচার্য তাকে আশ্বস্ত করলেন, “হবে বাবা তারকনাথ, হবে। যে সে নয়, এ হল মদনভস্ম মাদুলি। এই মাদুলি পরে বোবা চোপা করে, মাকুন্দর গোঁপ গজায়। আর তোমার হবে না?”

    “কদ্দিন পরতে হবে বাবা?”

    “ও তোমায় ভাবতে হবে নি কো। কাজ হলে উনি এমনিই চলে যাবেন।” সিদ্ধাচার্য হাত নেড়ে তারককে খারিজ করে দিলেন। মাদুলিটা বুক পকেটে রেখে, কড়কড়ে এক হাজার এক টাকা গুণে দিয়ে তারক এগোল। দেরি করে বাড়ি ফেরা নিয়ে মালতী না রসাতল করে।

    ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দেখল বাড়িওলার ছেলে রতন বাইরের ঘরে বসে চা খাচ্ছে। মালতী তার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। রতনের ধান্ধা সুবিধের নয়। ঠারে ঠোরে তারক তাকে বলেওছে, যখন তখন তার বাড়িতে ঢোকা তারকের পছন্দ নয়। চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল তারকের। রতনের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে, তাকে খুব খানিক কড়কে দিল। মালতী কিছু বলতে গিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। রাত্তিরে শোবার আগে মাদুলিটা তাগা করে হাতের ওপর পরল তারক। অনেক রাত পর সেদিন মালতী তার কাছ ঘেঁষে এল। সিদ্ধাচার্যর মাদুলিতে সুখ আছে। বলতে নেই মাদুলিটা সত্যিই কাজ দিল। ফ্যাক্টরিতে লোকজন ছাঁটাইয়ের সময় জনার্দন বরখাস্ত হয়ে গেল। বড়সাহেব তারককে ডেকে জনার্দনের জায়গায় জুতে দিলেন। শিফট ইন-চার্জ হয়ে প্রথম দিনই সুখলালকে ইডিয়ট বলে ধমকে দিল তারক। ভেবেছিল ঝামেলা হবে। কিন্তু ইউনিয়নের নেতা নেতাইয়ের সঙ্গে সুখলালের অলরেডি পাঙ্গা থাকায় তেমন কিছুই হল না। তারকের জীবনে নিরবচ্ছিন্ন সুখ ফিরে এল। || ২ ||

    বেশ চলছিল মাস তিনেক। হঠাৎ একদিন ট্রেনে ওঠার সময় ধাক্কাধাক্কিতে মাদুলিটা খুলে রেল লাইনে পড়ে গেল। পরের স্টেশনে নেমে তারক ফিরে এল। কিন্তু ওইটুকু জিনিষ, সে কী আর পড়ে থাকে। একবার ভাবল সিদ্ধাচার্য তো নিজেই বলেছিলেন, সময় হলে মাদুলিটা একদিন এমনিই চলে যাবে। হয়ত তার আর মাদুলিটা গায়ে পরবার দরকার নেই। তবু মনটা কু গাইছে। ফ্যাক্টরি যাবার রিস্ক না নিয়ে সোজা উত্তরপাড়া চলে এল তারক। রিক্সা থেকে নেমে মাথায় হাত। সিদ্ধাচার্যর ঘরে একখানা গামা সাইজের তালা ঝুলছে। সামনে বেঞ্চির ওপর কুণ্ডলি পাকিয়ে একটা কুকুর শুয়ে আছে। পানের দোকানে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতে বলল তাগা তাবিজ দিয়ে বুজরুকি করার জন্য সিদ্ধাচার্যকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তারপর পানে চুণ মাখাতে মাখাতে তারকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কত গেল?”

    কত গেল, কী গেল তাকে আর কী বোঝাবে তারক? সে ফুটপাথেই বসে পড়ল। সে এখন কী করবে? সে কী তা’হলে আবার কেঁচো হয়ে যাবে? সব আবার আগের মতন হয়ে যাবে। সুখলাল নেতাইকে মাল খাইয়ে হাত করে ফেলবে। বাড়িওলার ছেলে রতন এসে তারককে দাবড়ে দিয়ে যাবে। মালতী রতনের সঙ্গে রিক্সা করে ম্যাটিনী শোয়ে সিনেমা দেখতে যাবে। ভাবতে ভাবতে তারক শিউরে ওঠে।

    মাদুলির শোকে কাঁহাতক ফুটপাথে বসে থাকতে পারে মানুষ। তারক উঠে দাঁড়ায়। মাথাটা একটু টলটল করছে। পানের দোকান থেকে একখানা ঠাণ্ডা খায়। হাত তুলে একটা খালি রিক্সা ডেকে চড়ে বসে। লুঙ্গি পরা একটা জোয়ান ছেলে রিক্সা টানছে। গেঞ্জির ওপর দিয়ে তার কাঁধের পেশী ফুলে উঠছে। গঙ্গার থেকে ঝড়ের মতন হাওয়া আসছে। আস্তে আস্তে তারকের মাথাটা ছাড়তে থাকে। এমনও তো হতে পারে যে সিদ্ধাচার্য সত্যি সত্যিই ধাপ্পাবাজ। তা হলে তো মাদুলিটা ফালতু। সে আদৌ কেঁচো নয়।

    তাছাড়া সিদ্ধাচার্যর ব্যাপারটা সে আর পানের দোকানের ছেলেটা ছাড়া তো আর কেউ জানে না। তারক ভাবল মাদুলি পেয়ে হারানোর গল্পটা সে কোনদিন কাউকে বলবে না। দেখাই যাক না কী হয়! মাদুলি ছাড়া তার মেরুদণ্ড আবার লাউডগা হয়ে যায় কী না। ক’দিন না হয় একটু সামলে সুমলে থাকবে। শিফট ইন-চার্জ হবার পর অফিস থেকে রিষড়ের কাছে কোয়ার্টার দেবে বলেছে। সেখানেই উঠে যাবে। কোয়ার্টারের এক চিলতে বারান্দায় গোটা কতক ফুলের টব করবে। জুঁই, বেলি, টগর। মালতী সাদা ফুল খোঁপায় দিতে ভালবাসে। সন্ধেবেলা মালতীকে নিয়ে কলোনীর মধ্যে হাঁটতে বেরোবে। অন্ধকার আকাশে একটা একটা করে তারা ফুটবে। মালতীর সুগন্ধী তেল মাখা চুলে ফুটে থাকা ফুলের মতন। হাঁটতে হাঁটতে দুজনে তারা দেখবে।

    এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে তারকের মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। মনে হল এতদিন মাদুলিটা যেন পাথর হয়ে বুকে চেপে বসে ছিল। সেটা চলে যাওয়াতে শরীরটা বেশ হালকা হয়ে গেছে। আজ আর ফ্যাক্টরি যাবে না তারক। ঘরে ফিরে ভাত খেয়ে মালতীকে জাপটে নিয়ে টানা ঘুম দেবে। মালতী একটু অবাক হবে। হোক গে।



    টিকটিকি




    অনাদি

    বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ লাগছিল। কথায় কথায় মুখ ঝামটা। রাত্তিরে গায়ে হাত দিতে গেলে নানা বাহানায় সরে যাচ্ছিল সুমতি। কোনদিন তার মাথা ধরে। কোনদিন বাসন তুলে, রান্নাঘর সেরে আসতে আসতে রাত ঘুরে যায়। গা করছিলাম না। মাগ-ভাতারে এমন তো মাঝে মধ্যে হয়েই থাকে। রাতবিরেতে অশান্তি ভাল লাগে না। রোদ নেই, বাদল নেই, সারা দিন রিক্সা টানা। রাতে ফিরতে ফিরতে গা গতর ভারি হয়ে আসে। চোখ চট চট করে। এ তো আর কেরোসিন তেলে চলা অটো নয়। হ্যাণ্ডেল মারো আর চালাও। প্যাডেল ঠেলতে ঠেলতে হাঁপ ধরে যায়।

    সন্ধের ঝোঁকে মদনের চুল্লুর ঠেকে গিয়ে বসেছি। মদনের বউ কালো ছোলার চাট বানায়। নঙ্কা পিঁয়াজ দিয়ে মাখো মাখো করে। খাসা খেতে। মদনের বউ পান চিবুচ্ছিল। কচ কচ করে। বোঁটার ডগা থেকে চুণ নিয়ে জিভে ঠেকাল। পান খয়েরে তার জিভটা টকটকে লাল হয়ে আছে। উবু হয়ে বসে, একটা বড় ডেকচি থেকে শাল পাতার ডোঙায় চাট ঢেলে দিচ্ছে। চেয়ে চেয়ে তাই দেখছিলুম। মাটির ভাঁড়ে চোলাই ঢালতে ঢালতে মদন বলল, “অনাদি, ঘর সামলা। দুপুরে তোর বউকে দেখলুম নরোত্তমের অটোতে। আরেকটা মেয়ের সঙ্গে। খুব খিল্লি দিতে দিতে যাচ্ছিল।”

    ঘরে ফিরে দেখি সুমতি নেই। অন্ধকারেই কোনমতে চাবি খুলে ঢুকলুম। একানে একখানা কামরা, রান্না ঘর, কল পায়খানা। সুমতির জবরদস্তিতেই একরকম, ধার দেনা করে তোলা। আলো জ্বালতেই দেওয়ালে টিকটিকিটা ঘাড় তুলে দেখল। বললাম, “ঘরে থাকিস, একটু নজর তো রাখতে পারিস বৌটার ওপর, সারাদিন কী ইল্লুতি করে বেড়ায়। আগেও তো বলেছি। আমার কী আর পয়সা দিয়ে গোয়েন্দা রাখার সামর্থ্য আচে?”


    সুমতি

    রে ঢুকতে না ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় গিয়েছিলি?” পিত্তি জ্বলে যায়। দিনভোর তো চুল্লু খেয়ে পড়ে থাকো। খোঁজ নেবার ফুরসৎ হয় না। রাতের বেলা সোহাগ উথলে ওঠে। সারা দিনমান কেমন কাটে তার হদিশ রাখো? একা একটা বাঁজা মেয়েছেলে, কি করি? ঘরের মধ্যেই এটা নাড়ি, ওটা সরাই। দুজন মনিষ্যির রান্না করতে আর কত সময় লাগে? তাও সে আদ্দেক দিন গলা অবদি গিলে ফেরে, ভাত নেড়ে চেড়ে উঠে পড়ে। হাতের কাজ সেরে আসতে না আসতে ঘুমে বেহুঁশ। আজ দেখি হাঁড়িপানা মুখ। খাটের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে আছে, দেওয়ালের দিকে চেয়ে।

    আর হয়েছে এই টিকটিকিটা। সারা দিনমান দেওয়াল থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখছে। হোক না মনুষ্যেতর প্রাণী। অস্বস্তি হয় না? একটা তো মোটে ঘর। উঠছি, বসছি, রান্না করছি, নজরের বাইরে যাবার জো নেই। এমনকি চানের সময় কলঘরেও। কাপড় চোপড় ছেড়ে গায়ে জল ঢেলে পারি নি, দেখি দরজার নীচে দিয়ে উঁকি মারছে। ম্যা গো! দিয়েছি গায়ে এক মগ জল ঢেলে।

    দুপুর বেলা পাশের ঘরের শোভা এসে বললে, “বৌদি সিনেমায় যাবে?” জিজ্ঞেস করলুম, “কি বই?” বললে, “চলই না”। তাড়াতাড়ি মুখটা পরিষ্কার করে, শাড়ী বদলে বেরুলুম। গলির মোড়ে নরোত্তমদার অটো। বললে, “কোথা যাবি? চল ছেড়ে দিচ্ছি।” দোনা মোনা করছিলুম। নরোত্তমদার নজর ভাল না। অনাদির সঙ্গে তেমন সদ্ভাবও নাই। আগে নরোত্তমদাও রিক্সা টানত। অনাদির সঙ্গে এক গেলাসে মাল খেত। তখন ভাল আলাপ ছিল। গঞ্জের দিকে থাকে। বৌটা শান্ত শিষ্ট। কী যেন নাম ছিল। হ্যাঁ, সরমাদি। চারটে বাচ্ছা হবার পর হাসপাতালে কাটাকাটি করাল। তখন টিপিন কৌটো করে অনাদির হাতে দু একবার ভাত রেঁধেও পাঠিয়েছি। সেবার ভোটের সময় পার্টির হয়ে খুব খাটল নরোত্তমদা। পঞ্চায়েত প্রধান অটো কেনার জন্য লোন বার করে দিলেন। পুরোন রিক্সাটা বেচে, অটো কিনে নরোত্তমদা এখন বাবু হয়ে গেছে। খাকি রঙের সাফারী পরে অটো চালায়।

    শোভাটা একটু ঢলানি আছে। পট্ করে অটোয় উঠে পড়ল। জানে নরোত্তমদা ভাড়া নেবে না। মস্করা করে বলল, “কী গো নরোত্তমদা, তুমি কী আমাদের জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিলে নাকি?” এয়ার্কি ভাল লাগছিল না। বাইরে তাকিয়ে ছিলুম। জি টি রোডে উঠতেই শোভা কনুই দিয়ে কাঁকালে খোঁচা মারল। চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখাল, নরোত্তমদা আয়নার মধ্যে দিয়ে দেখছে। তাকাতেই চোখ সরিয়ে নিল।


    নরোত্তম

    ঞ্চলটা বদলে যাচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি। শুনছি কর্পোরেশন হবার কথা চলছে। মানুষের হাতে সময় কমছে। সবাই চটজলদি গন্তব্যে পৌঁছে যেতে চায়। ট্রেন থেকে নেমে ষ্টেশনের বাইরে আসলে দেখবে শেয়ার অটোর জন্যে লম্বা লাইন পড়েছে। আগে রিক্সাওলাদের প্যাঁক প্যাঁক, ডাকাহাঁকিতে কান পাতা যেত না। এখন কেবল দু একটা সাইকেল রিক্সা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক।

    দুপুর বেলা অনাদির বউটাকে দেখলুম গলির মোড়ে একটা মেয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। অনাদিকে অনেকবার বলেছি, “পার্টি অফিসে আয়।” কিন্তু নবাবজাদা কানে কথা তোলে না। বলে, “এই বেশ। ছেলে নাই, পুলে নাই। কার জন্যি করব?” মর তা হলে শুকিয়ে। সবাই রিক্সা ছেড়ে অটোর লাইনে ঢুকছে, তুই একা সিটের ওপর পা তুলে বসে থাক। সওয়ারি ছিল না। সুমতিকে জিজ্ঞেস করলুম, “কোথা যাবি?” সঙ্গের মেয়েটা তড়বড়ে, বলল, “জ্যোতি সিনেমা”। ওই দিকেই যাচ্ছিলুম। মাণিকদা একটা চিঠি দিয়েছে ভদ্রেশ্বর ষ্টেশনের কাছে একজনের হাতে দেবার জন্য। বললুম “চল্ ছেড়ে দিচ্ছি।” সুমতি দাঁড়িয়েই ছিল। মেয়েটা উঠে এল।

    সুমতির গড়ন একটু ভারির দিকে। তবে ছেলেপুলে হয় নি বলেই বোধয়, বুক পাছা এখনও বেশ টাইট টাইট। দেখলে গা ছন ছন করে। সরমা তো বিইয়ে বিইয়ে কাদার তাল। যেমন খুশি ঠাসো কোন হ্যাতক্যাত নাই। মেয়েমানুষ পেয়ারার মত। একটু ডাঁটো না হলে দাঁতের সুখ হয় না। কথাটা ভাবতে ভাবতে পেটের থেকে ভুর ভুর করে একটা হাসি আসছিল। হাসি চেপে আয়নায় চোখ রাখলাম। সুমতি বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, অন্যমনস্ক হয়ে। অনাদিটাকে কি করে সহ্য করে কে জানে? হঠাৎ চোখ ফেরাল। মনে হল একটু বিরক্ত। নামার সময় বললাম, “একদিন আসতে তো পারিস। দূর নয় তো বেশি।” সুমতি কিছু বলল না। হাঁটা দিল। সঙ্গের মেয়েটা বলল, “আসি নরোত্তমদা। পৌঁছে দেবার জন্যে থ্যাঙ্কু।” ধুত্তেরি, তোর থ্যাঙ্কুর নিকুচি করেছে।


    টিকটিকি

    মেয়ে মানুষের এত দেমাক ভাল নয়। বেশ নধর একটা ত্যালাপোকা দেখে কলঘরে উঁকি দিয়েছি, দিলে হড়াস করে জল ঢেলে। ত্যালাপোকাটা তো উড়ে গেলই, পেটের মধ্যে এতখানি জল ঢুকে আইঢাই। লোকটা ভাল। মিশুকে। মাঝে মধ্যে আমায় ডেকে কথা বলে। কুশল নেয়, “কী স্যাঙাৎ, খাবার দাবার ঠিকঠাক জুটছে তো?” তা বলতে নেই, পোকা মাকড়ের অভাব নেই ঘরে। আজ দেখি অন্যরকম। কেমন ভ্যাবার মত বসে আছে। বালিশটা তুলে একবার নাকের কাছে নিয়ে গিয়ে শুঁকল। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ঘরে নরোত্তম এসেছিল না কী রে?” দুপুর থেকেই মাথাটা গরম হয়ে আছে। বৌটাকে জব্দ করার এই সুযোগ। ঘাড় নেড়ে বল্লাম, “ঠিক, ঠিক, ঠিক”। দেখলাম মানুষটার মুখটা কেমন কাল হয়ে গেল।

    না বললেই হত। বউটা ফিরতেই শুরু হয়ে গেল। অবশ্য এদের লেগেই থাকে নিত্য দিন। আজ দেখলাম চরমে উঠেছে। লোকটার মেজাজ একেবার টঙে, “নরোত্তমের সঙ্গে বেরিয়েছিলি?” বৌটা জবাব না দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা বৌটাকে জোর করে হাত ধরে, নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিল, “বল হারামজাদি, গেছিলি?” বৌটা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “বেশ করেছি গেছি। আবার যাব।” “বড় বাড় বেড়েছে তোর। দাঁড়া, ঘোচাচ্ছি তোর আসনাই।” ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিল বউটার গালে। শিরা ওঠা পাঁচটা আঙ্গুলের দাগ পড়ে গেল।

    বৌটাও কম যায় নাকি। ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে, নখ দিয়ে খিমচে রক্ত বার করে দিলে গা! সাক্ষাত রণচণ্ডী। চোখ জ্বলছে। বুকের আঁচল মেজেতে লুটোচ্ছে। লোকটা সামলাতে পারছে না। এই দেখ! বেশ তো চলছিল। আবার কাঁদে কেন বুকের ওপর ঢলে পড়ে? মরণ! ঢং দেখে বাঁচি না।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ নক্ষত্র চক্রবর্তী
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments