আমি বরাবরই একটু কম কথা বলি। অকারণে বোকার মত বকরবকর করতে আমার ভালো লাগে না। লোকে যে কী করে এত কথা বলতে পারে আমার মাথায় ঢোকে না। ট্রেনে, বাসে, রাস্তায়, অফিসে, ফোনে, টিভিতে, এফ এমে—সর্বত্র শুধু কথা আর কথা। কথা না বললে বাঙালির পেটের ভাত হজম হয় না। পেট ফুলে ওঠে। কথা বলার সঙ্গী বাছাইয়েরও কোনও ছিরিছাঁদ নেই। সেলুনে গিয়ে কর্পোরেট অফিসের বস দিব্যি নাপিতের সাথে একঘণ্টা গেঁজিয়ে এলেন। অথবা বাসে অচেনা অজানা সহযাত্রীর সঙ্গে কেউ গোটা রাস্তা রাজনীতি কপচে গেলেন। আসলে আমার মনে হয়, আমরা কথা বলি নিজেদের জাহির করার জন্য। চুপচাপ থাকলে ভাবি আমাদের কেউ গুরুত্ব দিচ্ছে না, কেউ আমাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। বাচ্চারা যেমন সবসময় বাবা-মা বা বড়দের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যায়—হেসে, কেঁদে, বায়না করে—সেরকম আমরাও অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ব্যাকুল। অফিসে বস ভাবেন হম্বিতম্বি না করলে তাঁকে কেউ মানবে না, আর কর্মচারী ভাবে চুপচাপ থাকলে বস অন্যায়ভাবে সমস্ত কাজ ঘাড়ে চাপিয়ে দেবেন, আর ইনক্রিমেন্টের সময় ভুলে মেরে দেবেন। সুতরাং অনর্গল কথা বলে যেতে হবে। কখনও আমরা ভেবে দেখি না, এই যে আমরা এত এত কথা বলি, তার কটা কথা ঠিকঠাক কাজের কথা। বাজে কথাগুলো না বললে কত পার্সেন্ট এনার্জি সেভ করা যেত; সেই সেভ করা এনার্জি দিয়ে আরও কত কাজের কাজ করা যেত। আরও ভেবে দেখি না, এত যে আমরা কথা বলে যাচ্ছি, সেগুলো ঠিকঠাক শুনছে কে? অন্যেরা যা বলে যাচ্ছে সেগুলোই কি আমরা মন দিয়ে শুনছি? অধিকাংশ কথাই যে মাঠে মারা যাচ্ছে। এই নিয়ে কবীর সুমনের একটা গানও আছে—‘মানুষ কথা বলে যায়, কথার কথা বলে যায়, কথা বলে কথা না শুনে, কথা শোনে কথা না শুনে, কথার মানে থাকে না, থাকে না কথার কোনও দাম।’
একেবারে ঠিক কথা। আমি এতক্ষণ ইনিয়েবিনিয়ে যা বলার চেষ্টা করছি, কবি এককথায় তা বলে দিয়েছেন। কবিরা এরকমই। আমরা সাধারণ মানুষেরা একঘণ্টা কথা বললে তার মধ্যে সার কথা থাকে পাঁচ মিনিট। আর কবিদের এক একটা কথা নিয়ে একঘণ্টা ধরে ভাবা চলে। আমিও ভাবছিলাম। কথা বলার চেয়ে ভাবতে আমি বেশি পছন্দ করি। নিজের মনে ভাবতে ভাবতেই আমার সময় কেটে যায়। কথা বলার দরকার পড়ে না।
এসব কথা ভাবছিলাম কামরূপ এক্সপ্রেসের মিলিটারি কম্পার্টমেন্টে বসে। কলকাতার একটা অফিসে কাজ করি। উত্তরপাড়ার একটা বাড়িতে চার বন্ধু মিলে শেয়ার করে ভাড়া থাকি। বাড়ি বর্ধমানের কালনায়। শনিবার অফিসের পর বাড়ি চলে যাই। রোববার বিকেল কি সোমবার সকালে ফের ফিরে আসি। এই আমার রুটিন। শনিবার বাড়ি যাবার সময় কামরূপ এক্সপ্রেসটা ধরতে পারলে খুব সুবিধে হয়। অনেক তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছনো যায়। কামরূপ হাওড়া থেকে ছাড়ে বিকেল পাঁচটা পঁয়তিরিশে। মাঝখানে শুধু ব্যান্ডেলে একবার দাঁড়ায়, তারপরেই কালনা, সাতটা দশ-পনের নাগাদ কালনায় ঢুকে যায়। সেখানে লোকাল ট্রেনে গেলে অনেক সময় লাগে, কেননা ওগুলো সমস্ত স্টেশনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে যায়। ব্যান্ডেল আর কালনার মাঝে প্রায় ন’দশটা স্টেশন আছে যেগুলোয় দাঁড়ানো মানে আমার সময় নষ্ট। কামরূপে একটাই যা অসুবিধে। দূরপাল্লার ট্রেন বলে প্রায় সবকটা কামরাই রিজার্ভড। আনরিজার্ভড কামরা একটা আছে বটে, কিন্তু তাতে এমন গাদাগাদি ভিড় হয় যে আমার ওঠার সাধ্য নেই। ওতে ওঠার অবশ্য কোনও দরকারও নেই। প্রচুর ডেলিপ্যাসেঞ্জার কামরূপ ধরে রোজ কালনা ফেরে, সময় বাঁচানোর জন্য। তারা সব রিজার্ভড কামরাগুলোতেই ওঠে। কালনা, নবদ্বীপ, কাটোয়া ইত্যাদি গন্তব্য অনুযায়ী ওরা নিজেদের মধ্যে এক একটা কামরাও নির্দিষ্ট করে নিয়েছে, যাতে চেনাজানা লোকজন একসাথে যাওয়া যায়। কামরূপ যদিও এক্সপ্রেস ট্রেন, এইসব ডেলিপ্যাসেঞ্জারদের কোনোদিন এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় না। সাধারণ টিকিট কেটেই এরা কামরূপে ওঠে। ট্রেনের টিটিই এদের বিলক্ষণ চেনেন, কখনও কিছু বলেন না। তাছাড়া এদের মধ্যে ইউনিটি এমনই মজবুত যে টিটিই এদের এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন। যাঁরা সিট রিজার্ভ করে কামরূপ, গৌহাটি বা এনজেপি যাচ্ছেন, নিজেদের রিজার্ভ করা সিটে এরকম উটকো লোকেদের বসতে দেখলে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে একটু রেগে যান, গজগজ করেন। কিন্তু একটু পরেই সবাই বুঝে যান যে প্রতিবাদ-টতিবাদ করার চেয়ে চুপচাপ মুখ বুঁজে থাকাই ভালো। সহযাত্রীদের তাঁরা এই বলে সান্ত্বনা দেন, ‘একটু কষ্ট করে বোসো এখন, এনারা তো এই দু’ঘন্টার মধ্যেই নেমে যাবেন, তখন আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যাবে।’
আমি অবশ্য কোনও দিন সাধারণ টিকিট কেটে কামরূপে উঠিনি। এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটই কাটি। কী দরকার খামোখা অপরাধবোধে ভুগে! আমি ডেলিপ্যাসেঞ্জারও নই যে টিটিই আমার মুখ চিনবেন। তাছাড়া ঐ ক’টা টাকা বাঁচিয়ে কী আমার এমন হাতিঘোড়া হবে? তার চেয়ে ঠিকঠাক টিকিট কাটাই ভালো। প্রথম প্রথম সাধারণ রিজার্ভড কামরাতেই উঠতাম, চেষ্টা করতাম কালনার দলটার মধ্যে ভিড়ে যেতে। কিন্তু দেখলাম, সেসব কামরায় বসার জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। ওদের নিজেদের লোকজনের জায়গা মোটামুটি ঠিক করাই থাকে, তারপরে রিজার্ভ টিকিটের যাত্রীদের বসার সুযোগ দিলে জায়গা খুব একটা পড়ে থাকে না। তিন-চারদিন হাওড়া থেকে কালনা ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসেছি। তারপর গত সপ্তাহে এই মিলিটারি কম্পার্টমেন্টের সুবিধেটা আবিষ্কার করলাম।
প্রায় সমস্ত দূরপাল্লার ট্রেনেই একটা করে মিলিটারি কামরা থাকে; আর্মি, এয়ারফোর্স বা নেভির লোকেদের যাতায়াতের জন্য। আর্মির লোকজনই তাতে বেশি যাতায়াত করে। কেউ হয়ত এখান থেকে ওখানে বদলি হয়ে যাচ্ছেন; কেউ আবার ছুটিতে বাড়ি ফিরছেন। যাদের রিজার্ভেশন নেই সেরকম সাধারণ লোকেরা বা ডেলিপ্যাসেঞ্জাররা এই মিলিটারি কামরায় সাধারণত ওঠে না। তাই বসার জায়গা পাওয়া যায়। গত সপ্তাহেও আমি পুরো রাস্তা বসে বসে গেছি। আজও উঠেই একেবারে জানালার ধারের একটা সিট দেখে জুত করে বসে পড়লাম। কামরাতে সবাই যে ইউনিফর্ম পরা ফৌজি এমন নয়। ফৌজিদের পরিবারের লোকজনও এই মিলিটারি কামরাতেই চলাফেরা করে। তবে আজ দেখলাম বেশির ভাগই ফৌজি লোকজন। আমার দিকে দু’একজন একটু আড়চোখে তাকালেও আমি খুব একটা পাত্তা না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখায় মন দিলাম।
কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেও তার উত্তর আমার তৈরিই আছে। আমার বাবা আর্মিতেই ছিলেন। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে এই মিলিটারি কামরায় প্রচুর যাতায়াত করেছি। বদলির চাকরি। এখান থেকে ওখানে ট্রান্সফারের সময় বা বছরে একবার কালনায় বাড়ি আসার সময় লটবহর নিয়ে ভরসা সেই মিলিটারি কামরা। বাবা ছাড়াও আমার এক জ্যাঠামশাই এবং এক কাকাও আর্মির লোক। সে হিসেবে আমাকেও ফৌজি ফ্যামিলির লোকই বলতে হয়। সুতরাং কেউ প্রশ্ন করলেও আমার কোনও অসুবিধে নেই। অবশ্য বাবার অনুপস্থিতিতে আমি একা একা এই মিলিটারি কামরায় চাপার হকদার কিনা সেটা আমার জানা নেই। এটা যদিও জানি যে মিলিটারি কামরায় উঠতে হলেও আগে থেকে ফৌজি কোটায় রিজার্ভেশন করতে হয়। এলাম, আর একটা এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট কেটে উঠে পড়লাম, ব্যাপারটা সেরকম নয়। তবে অন্য রিজার্ভড কামরার চেয়ে এই কামরায় উঠলে দেখেছি আমার অপরাধবোধটা অনেক কম হয়। এখন অবধি কেউ তো কিছু জিজ্ঞাসা করে নি, যদি করে তখন দেখা যাবে। আগ বাড়িয়ে নিজে থেকে কিছু বলতে যাওয়ার চেয়ে চুপচাপ থাকাই ভালো।
আমার সিটটা কামরার দরজা দিয়ে উঠে প্রথম খোপেই। সেখানে আমি ছাড়া আরও একজন আমার মত সিভিলিয়ান আছেন। সেই ভদ্রলোককে দেখেই বাঙালির বাচালতা নিয়ে আমার ভাবনাচিন্তার সূত্রপাত। ট্রেনে ওঠার পর থেকেই ভদ্রলোক অনবরত বকবক করে চলেছেন। বয়স চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। হাইট বেশি না, পাঁচ ফিট ছ’ইঞ্চি মত, গোলগাল নরমসরম চেহারা, মাথার চুলগুলো অধিকাংশই পাকা, মুখখানা বেশ শার্প ও বুদ্ধিদীপ্ত। কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল ভদ্রলোক ব্যবসা করেন, বেশ বলিয়ে-কইয়ে মানুষ। তবে আমার মত ওনার নিশ্চয়ই খুঁটির জোর নেই। তাই ফৌজি কামরায় উঠে প্রথম থেকেই জনসংযোগে মন দিয়েছেন, পাছে কেউ দুম করে কিছু বলে বসে। কামরার সমস্ত ফৌজিদের সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়ে গেছে। শ্রীরামপুর পেরোতে না পেরোতে দু’বার চা খাওয়া হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার আমাদের খোপের সবাইকেই খাওয়ালেন। আমাকেও অফার করেছিলেন, আমি কোনও কথা না বলে হাত নেড়ে মিষ্টি হেসে বুঝিয়ে দিলাম আমার দরকার নেই।
এরপরে কামরায় খাবার জিনিস যাই আসুক না কেন তা ওনার খাওয়া চাই। এই লাইনে প্রচুর হকার। আমাদের কামরাটা ভেস্টিবিউল দিয়ে পাশের কামরাগুলোর সঙ্গে জোড়া নয়। তাও পরপর ঝালমুড়ি, শোনপাপড়ি, শশা ইত্যাদি ইত্যাদি এসেই চলেছে, আর ভদ্রলোকও মনের আনন্দে কিনে চলেছেন; পাশের ইচ্ছুক ফৌজিদেরও খাওয়াচ্ছেন। ওনার কল্যাণে কয়েকজন ফৌজির হালহকিকত জেনে ফেলা গেল। দু’জন যাবেন এনজেপি অবধি, হাসিমারায় নতুন পোস্টিং হয়েছে। একজন জলপাইগুড়িতে বাড়ি ফিরছেন ছুটিতে। বাকিরা গৌহাটি বা আরও দূরের যাত্রী।
হাসিমারায় যে দু’জনের পোস্টিং হয়েছে তাঁদের একজন বছরখানেক সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে ছিলেন। সেখানকার গল্প আরম্ভ হল। সিয়াচেনের ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা, পাকিস্তানের ফৌজিদের গুলি ছোঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদি ভদ্রলোক রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলেন, আর ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের লোকদেখানো অতি-আগ্রহে ও প্রশংসায় সেই গল্পের রঙে পোঁচের ওপর পোঁচ পড়তে লাগল।
আমাদের পাশের খোপের ফৌজিদের মধ্যে তাস খেলা আরম্ভ হয়েছে। তাঁদের নিজেদের মধ্যে চেঁচামেচি আর উল্লাসে আমাদের খোপের কথাও মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সেখানে মনে হল একজন উচ্চপদস্থ অফিসার, মেজর কি ক্যাপটেন গোছের কেউ আছেন। সবাই তাঁকে স্যার স্যার বলে সম্বোধন করছে। তাঁর গম্ভীর গলাই সবচেয়ে উঁচুতে শোনা যাচ্ছে, যেন গলা দিয়েই ভদ্রলোককে প্রমাণ করতে হবে যে তিনি একজন উচ্চপদস্থ অফিসার, আর সবার চেয়ে আলাদা, আর সবার চেয়ে উঁচুতে।
আমি যে বেশি কথা বলি না তার আরেকটা কারণ, নিজে কথা বললে এইসব বিচিত্র লোকজনকে ঠিকমত পর্যবেক্ষণ করা যায় না। আমি শুধু দেখি, আর শুনি। কত নানারঙের লোকজন চলতে ফিরতে অনর্গল বকবক করে চলেছে। পাঁচ-দশ মিনিট পর্যবেক্ষণ করেই একেকজনের নাড়িনক্ষত্র জেনে ফেলা যায়। দেখছিলাম আর ভাবছিলাম যে আমার তত্ত্বটায় কোনও ভুল নেই। প্রত্যেকে ব্যস্ত নিজেকে জাহির করার জন্য। প্রত্যেকে ব্যস্ত অন্যকে ইমপ্রেস করার জন্য, তা সে দু’ঘন্টার সহযাত্রীই হোক কি সহধর্মিণীই হোক। বেশি কথা বললে যে অনেক বাজে কথা বলা হয় সেটা স্বাভাবিক। সে সম্বন্ধে এরা কেউ ভাবে বলে বোধ হয় না। অপরপক্ষে, কম কথা বলার জন্য আমার যে কোনোদিন অসুবিধে হয়েছে, তা তো মনে হয় না। বরং লোকে তাতে অনেক সম্মান করে, একটু সমীহ করে চলে। যখন স্কুলে পড়তাম, তখনও আমি খুব কম কথা বলতাম। তাতে রেজাল্ট তো কোনোদিন খারাপ হয় নি, বরং শান্ত ছেলে হিসেবে আমার একটা পরিচয় ছিল। তারপর কলেজ লাইফ কাটল, চাকরীতে ঢুকলাম। কখনওই কম কথা বলি বলে কিছু আটকায় নি।
ভাবতে ভাবতে ব্যান্ডেল চলে এল। আগস্ট মাসের বিকেল। সওয়া ছ’টা বেজে গেলেও বাইরে এখনও সন্ধে হয় নি। এখানে আমাদের কামরার এতক্ষণের হকাররা নেমে গিয়ে আরেকদল নতুন হকার উঠল। তাতে ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের খাওয়াদাওয়া ফের নতুন উদ্যমে চালু হল। ফৌজিদের মালপত্রের কোনও অভাব নেই। প্রতিটা খোপেই সিটের তলায় ঢোকানো আছে জলপাই সবুজ রঙের বড় বড় ট্রাঙ্ক। ওপরের বার্থে তোলা আছে সবুজ রঙের হোল্ড-অল। এছাড়াও প্যাসেজে এবং দুই সারি সিটের মাঝে নানারকম সাইজের লোহার বাক্স, ক্যাম্বিসের ব্যাগ ইত্যাদি রাখা। প্যাসেজ দিয়ে যাতায়াতের যথেষ্ট অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও হকাররা অদম্য। চা, কফি, চানাচুর, ঝুরিভাজা, টর্চ, চিরুনি, ফোলানো বালিশ, রুমাল, গামছা, রাজভোগ, সিঙাড়া—ইত্যাদি কতরকম জিনিস যে ফিরি হয়, দেখতে মজাই লাগে। ফৌজিদের ক্রয়ক্ষমতাও মনে হয় সাধারণ যাত্রীদের চেয়ে বেশি, তাই এই কামরাটা হকারদের কাছে খুব আকর্ষণীয়।
ব্যান্ডেল ছাড়ার পরে ট্রেনটা সবে স্পিড নিয়েছে, তখন পাশের খোপে একদল ফৌজির জিনিসপত্র নাড়াচাড়ার একটা আভাস পেলাম। তাস খেলায় মনে হল সাময়িক ছেদ পড়েছে। একটু পরেই বোঝা গেল একজন ফৌজি তাঁর পরিবার নিয়ে ত্রিবেণীতে নামবেন। লোকাল ট্রেনে গেলে ব্যান্ডেলের পরের স্টেশন বাঁশবেড়িয়া, তারপরেই ত্রিবেণী। কিন্তু কামরূপ তো ত্রিবেণীতে দাঁড়ায় না! অথচ ফৌজিটি দেখলাম একহাতে ট্রাঙ্ক ঝুলিয়ে, বগলে হোল্ড-অলটা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে সি অফ করার জন্য পেছন পেছন এলেন সেই মেজর সাহেব। বিশাল সাড়ে ছ’ফুটি চেহারা, গলার সঙ্গে মানানসই বটে।
আমার জানালার ধারের সিটটা থেকে দরজার আর বাথরুমের প্যাসেজটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। সেখানে দেখি কোথা থেকে এক চাষাভুষো বুড়ো উঠে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। নিশ্চয়ই ব্যান্ডেল থেকে উঠেছে। খালি গা, ময়লা সাদা একটা খাটো ধুতি পরনে, কোঁচকানো চামড়ায় মালুম হয় যথেষ্ট বয়েস হয়েছে। বুড়োর সঙ্গে আবার দুটো কাপড়ের পুঁটলি। মেজর সাহেব বুড়োটাকে দেখেই হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উঠলেন, “আরে এ বুঢঢা, হট যা, হট যা ইঁহাসে। ইধর কিঁউ বৈঠা তু? ইয়ে আর্মি কম্পার্টমেন্ট হ্যায়। পতা নেহি কেয়া? ভাগ হিঁয়াসে, নেহি তো উঠাকে ফেঁক দেঙ্গে।”
বুড়োর ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল সে হিন্দি মোটেই বোঝে না, আর আর্মি কম্পার্টমেন্টটা যে কী বস্তু, খায় না মাথায় মাখে, সেটা ওর ধারণার বাইরে। তবে ওকে যে সরে যেতে বলা হচ্ছে সেটা ও বুঝল। পোঁটলাপুঁটলি নিয়ে সে দুদিকে দুই বাথরুমের মাঝখানের প্যাসেজের একেবারে শেষপ্রান্তে গিয়ে গুটিসুটি মেরে ফের বসে পড়ল। এদিকে ট্রেন তখন ত্রিবেণী স্টেশন ক্রস করছে। মেজর সাহেব ‘আরে আরে, চলা গয়া, চলা গয়া’ করতে করতে হ্যাঁচকা মেরে অ্যালার্ম চেনটা টেনে দিলেন। ট্রেন থেমে গেল। ফৌজি কামরাটা ট্রেনের একদম শেষপ্রান্তে। এর পেছনে ডাকের কামরা, তারপরই গার্ডের কেবিন। চেন টেনে দাঁড় করাবার ফলে বহুদূরের ইঞ্জিন থেকে ড্রাইভার ঘন ঘন হুইসল দিচ্ছে। ত্রিবেণীতে যাঁর নামার কথা সেই ফৌজি ভদ্রলোকটি মেজর সাহেবকে ধন্যবাদ দিতে দিতে বউ-বাচ্চা-ট্রাঙ্ক-হোল্ড-অল সমেত ধীরেসুস্থে নেমে গেলেন। ইতিমধ্যে গার্ড সাহেব ট্রেন থেকে নেমে চলে এসেছেন। মেজর সাহেব তাঁকে ইংরিজিতে কীসব বুঝিয়ে দিতে উনি সন্তুষ্ট হয়ে ফের নিজের কেবিনে চলে গেলেন। ট্রেনও ছেড়ে দিল।
পাশের খোপে আবার তাসের আড্ডা আরম্ভ হল। মেজর সাহেবের হম্বিতম্বিও চলল। ভদ্রলোক মাঝেমাঝেই একটা সবুজ রঙের চ্যাপটা ওয়াটার বটল থেকে সিপ করে কোনও পানীয় খাচ্ছিলেন যেটা জল বা অরেঞ্জ জ্যুস বলে ঠিক বিশ্বাস হল না। আমাদের খোপের ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের এদিকের সিলেবাস কমপ্লিট হয়ে গেছে, উনি ওই খোপে গিয়ে মেজর সাহেবের চ্যালাদের পাশে বসলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন মেজরের সঙ্গে আলাপ জমানোর। উনি নাকি তাঁর নিজের ফ্যাক্টরিতে কীসব মালপত্র বানিয়ে নেভিতে একবার সাপ্লাই করেছিলেন; আর্মিতে সাপ্লাই করার প্রসিডিওরটা কী তা তাঁকে মেজর সাহেবের কাছ থেকে আজই জেনে ফেলতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে মেজর সাহেবকে চারচারটে রাজভোগ খাইয়ে দিলেন—“খাইয়ে সাব, বঙ্গাল কা রাজভোগ, বহুত বড়িয়া চিজ, দিল্লী কা লাড্ডু ঔর বঙ্গাল কা রসগুল্লা। অ্যান্ড দিস রাজভোগ ইজ দি এল্ডার ব্রাদার অব রসগুল্লা, স্যার।”
আমি বসে বসে ভাবছিলাম, এই যে মেজর সাহেব ঐ বুড়ো লোকটার ওপর চ্যাঁচালেন, সেটা কাকে ইমপ্রেস করার জন্য? বুড়োটাকে ইমপ্রেস করার জন্য নিশ্চয়ই নয়। তাহলে নিশ্চয়ই ট্রেনে তাঁর অধস্তন কর্মচারীদের ইমপ্রেস করার জন্য, এবং যে ফৌজিটি ত্রিবেণীতে নেমে গেলেন তাঁর বৌকে ইমপ্রেস করার জন্য। চেন টেনে ট্রেন থামাবার আয়োজনটাও তাঁকে ইমপ্রেস করার জন্য হতে পারে। কিন্তু, এই যে গণ্ডায় গণ্ডায় হকার কামরা জুড়ে দৌড়োদৌড়ি করছে আর কানের গোড়ায় চিলচিৎকার করছে, এঁদের তো মেজর সাহেব কিছু বলছেন না! ভাবতেই মাথায় এল, সেটা মেজর সাহেব কী করে বলবেন? উনি ভালোই জানেন এই হকাররা লোকাল লোক এবং যথেষ্ট সঙ্ঘবদ্ধ। এঁদের কাউকে খারাপ কিছু বললে এঁরাও ছেড়ে কথা বলবে না।
বেচারি বুড়োটা বাথরুমের ধারে বসে বসে ঝিমোচ্ছে। কোলের ওপর নোংরা সাদা কাপড়ে মোড়া একটা বেশ বড় পুঁটলি, তার ওপর হাত দুটো জড় করে রাখা। বাঁ পায়ের নিচে আরেকটা পুঁটলি, একটা কোলবালিশের খোলের মধ্যে ব্যাটা জিনিসপত্র পুরেছে। বকুনি খেয়েছে বলে তার ঘুমের বিন্দুমাত্র ব্যাঘাত হচ্ছে মনে হল না। এর কাছে টিকিটের প্রত্যাশা না করাই ভালো, এমনকি জীবনে কোনোদিন ট্রেনের টিকিট কেটেছে কিনা তাই নিয়েই সন্দেহ আছে। টিটিই উঠলেও একে যখনতখন নামিয়ে দিতে পারেন। অথবা টিটিইর ধমক খেয়েও এ এরকমভাবেই ঝিমোতে থাকবে, হয়ত আরেক কোণে সরে যাবে, অথবা নিদেনপক্ষে পরের স্টেশনে নেমে অন্য কোনও কামরায় উঠবে। এদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না। আইনের দিক দিয়ে দেখলে মেজর সাহেব অন্যায় কিছু করেন নি। এই মিলিটারি কামরায় ওঠার কোনও অধিকার ওই বুড়োর নেই।
সন্ধে হয়ে গেছে। জানালার বাইরের দ্রুত পিছিয়ে যাওয়া ধানক্ষেত আর বাঁশবাগানগুলো আবছা অন্ধকারে ঢেকে গেছে। ঝম ঝম করে বেহুলা নদীর ব্রিজ পেরিয়ে গেল। তারপর দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত দে’কুলের বিল, ভরা বর্ষার জলে থৈ থৈ করছে। এরপর গুপ্তিপাড়া স্টেশন, তারপরই কালনা। আমি ওপরের বাঙ্ক থেকে ব্যাগটা নামিয়ে কোলে নিয়ে বসলাম। নামতে হবে সামনে, তৈরি হয়ে থাকা ভালো।
সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোকও কালনায় নামবেন। আমাদের খোপে এসে তাঁর নিজের অ্যাটাচি কেসটি ওপর থেকে নামিয়ে নিলেন। মেজর সাহেবকে ইতিমধ্যে তিনি কিছুটা হলেও মনে হয় ইমপ্রেস করতে পেরেছেন, কেননা ওনার পেছন পেছন মেজর সাহেবও উঠে এলেন। তারপর বাথরুম যাওয়ার জন্য এগিয়ে গেলেন। বুড়োটা তখন ঘুমের ঘোরে প্রায় বেহুঁশ, বাথরুমের দরজাটার দিকে তার মাথাটা হেলে পড়েছে। মেজর সাহেব বাথরুমে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলেন বুড়োর সেই কোলবালিশের মত পোঁটলাটায়, তাঁর মাথাটা ঠক করে বাথরুমের দরজার পাল্লায় ঠুকে গেল। আর যায় কোথায়! তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন তিনি, “তু অভি ভি ইধর বৈঠা হ্যায়? বোলা না ইয়ে আর্মি কম্পার্ট হ্যায়, উঠাকে ফেঁক দেঙ্গে? বাত সমঝতা নেহি কেয়া?” আহা, বুড়োটা নামবে কী করে? কামরূপে তো ব্যান্ডেলের পরে কালনার আগে আর কোনও স্টপ নেই। ত্রিবেণীতে তো মেজর চেন টেনে ট্রেন দাঁড় করিয়েছিলেন। তখন অবশ্য বুড়োটা নেমে যেতে পারত। মেজরের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসে সে পোঁটলাদুটো আগলে প্যাসেজের আরও ভেতরের দিকে গুটিয়ে বসতে গেল। তাতে মেজর সাহেব আরও ক্ষেপে গেলেন। “আরে, ফির ইধর বইঠ রহা হ্যায়? কুত্তা কাহাঁকা,” এই বলে এক হ্যাঁচকা টানে একপাশের দরজাটা খুলে ফেললেন। তারপর আরও দুটো হ্যাঁচকা টানে বুড়োর কোল থেকে পোঁটলাদুটো ছিনিয়ে নিয়ে দরজা দিয়ে ছুঁড়ে বেমালুম বাইরে ফেলে দিলেন। বুড়োটা হাঁ হাঁ করে পোঁটলাগুলোর পেছন পেছন দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মেজর সাহেব ‘উতর যা হিঁয়াসে’ বলে বাথরুমে ঢুকে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আরে আরে বুড়োটা করছে কী? দেখি দরজা দিয়ে বেরিয়ে সে পাদানি দিয়ে দু’ধাপ নেমে পড়েছে। পোঁটলাগুলোর জন্য কি ও চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেবে নাকি? এখন ট্রেন যে রকম স্পিডে চলেছে তাতে ঝাঁপ দিলে বুড়োকে আর বাঁচতে হবে না। কী এমন হাতিঘোড়া আছে ওই পোঁটলাদুটোয়? সোনাদানা যে নেই সে তো আন্দাজই করা যায়। আমার মুখ দিয়ে এই প্রথম ‘আরে আরে’ করে দুটো মাত্র শব্দ বার হয়ে এসেছিল। নিজের অজান্তে আমি দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। বুড়োটাকে ভাবলাম বলি ‘আরে ঝাঁপ দিও না, ঝাঁপ দিলে আর বাঁচবে না’, কিন্তু অনভ্যস্ত গলা দিয়ে কোনও স্বরই বেরোল না। তাছাড়া মেজর সাহেব এখনই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসবেন।
বুড়ো অবশ্য ঝাঁপ দিল না। মনে হয় ভয় পেয়েছে, বুঝেছে ঝাঁপ দিলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। ট্রেন প্রায় কালনায় ঢুকছে তখন। সৌভাগ্যবশত প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সিগনাল না পেয়ে ট্রেনটা স্টেশনের বাইরেই থেমে গেল। স্পিড একটু কমতেই বুড়ো নেমে পড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল পেছনদিকে, ওর সাত রাজার ধন মানিক পোঁটলাদুটো উদ্ধারের আশায়। বোকাটা জানে না যেখানে মেজর পোঁটলাদুটো ছুঁড়ে ফেলেছিল সেই জায়গা থেকে এতক্ষণে ট্রেনটা কিছু না হলেও কম করে তিন-চার কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে। এই অন্ধকারের মধ্যে রেললাইনের ধারে ধু-ধু মাঠে আর জলায় কোথায় সে তার পোঁটলা খুঁজে পাবে কে জানে। দরজা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখলাম বুড়ো প্রাণপণে দৌড়তে দৌড়তে সন্ধ্যার অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
মেজর সাহেব বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেয়া, ভাগা হ্যায় উও বুঢঢা?” আমার পেছন থেকে সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, “হাঁ হাঁ সাব, উও উতর গিয়া।” মেজর গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে গেলেন, “শালা, গন্দা কাহাঁকা। অভি কুছ দের বাদ হি বাথরুম গন্দা করতা থা।”
আমার হয়তো অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু কিছুই বললাম না। চুপচাপ ওখানেই ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। সিগনাল পেয়ে গিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিল। রেললাইনের ধারে ধু-ধু মাঠের পাশে সন্ধের অন্ধকারে আমি একা একা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বুড়ো যেদিকে দৌড়ে গেল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ধীরে ধীরে লাইন ধরে হাঁটা দিলাম স্টেশনের দিকে।
আমি বরাবরই একটু কম কথা বলি। অকারণে বোকার মত বকরবকর করতে আমার ভালো লাগে না। তবে আজ, এই প্রথম, কোনও কথা না বলতে পারার জন্য মনে মনে আমার অনুশোচনা হল। কাকেই বা কী বলব? অন্ধকার ধু-ধু মাঠের মাঝে রেললাইনের ধারে কেউ কোত্থাও নেই যাকে ইমপ্রেস করা যায়।