মস্কোয় লোকে যায় ক্রেমলিন, রেড স্কোয়্যার ইত্যাদি দেখতে। আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু শেষ দিনে গাইড আমাদের নিয়ে চললো মাটির তলায়। মস্কোর মেট্রো নাকি সত্যিই দেখবার মতো। আমি নিউ ইয়র্কের গ্রাফিটি-খচিত মেট্রোয় অভ্যস্ত। মস্কোরটা হয়তো নতুন বা পরিষ্কার। এ আর কি দেখবার মতো? তাই একটু দ্বিধা নিয়েই চললাম।
|
এর আগে মস্কোর মেট্রো সম্বন্ধে কোনো ধারণাই ছিলো না। গুগ্ল্ বা উইকি-তেও কোনো খোঁজখবর করিনি। তাই প্রথম স্টেশনটি দেখেই চমকিত! প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয় কোনো মিউজিয়াম বা প্রাসাদ। বিরাট গোলাকৃতি, মার্বেল থাম দিয়ে ঘেরা। এটা আমাদের হোটেলের কাছেই (নামটা ঠিক মনে নেই)। কিন্তু অন্যান্য মেট্রো স্টেশনের মতো নয়।
|
ভিতরটা অত্যাধুনিক। সাঁ সাঁ করে হাই-স্পীড এস্কেলাটরগুলি নেমে যাচ্ছে দোতলা, তিনতলা। অনেক স্টেশনেই উপরে ও নীচে দু'তলার ট্রেন লাইন। উপরের ব্রিজের দু'পাশে তার-লাগানো বেড়া। অনেকেই উপর থেকে নীচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করতেন, সেইজন্যেই ওই বেড়ার ব্যবস্থা।
|
প্রতি মিনিটে ঝড়ের মতো ট্রেন আসছে, যাচ্ছে। প্রতিটি ট্রেন, কামরা, দেয়াল, প্ল্যাটফর্ম ঝকঝকে পরিষ্কার। গ্রাফিটি তো দূরের কথা, একটি বিজ্ঞাপন পর্যন্ত সাঁটা নেই কোথাও। সত্যিই চোখের আরাম। মস্কোর মেট্রো পুরোপুরি সরকারি সাহায্যে চালিত। অন্য কোনো সাহায্যের দরকার পড়ে না।
|
ট্রেনের চেয়েও বেশি দেখার জিনিস হলো মেট্রোর স্টেশনগুলো। বিপ্লবের পর ১৯৩০ সাল নাগাদ স্টালিনের কল্পনা অনুযায়ী তৈরি। তিনি চেয়েছিলেন এই মেট্রো শিল্পে ও সৌন্দর্যে পৃথিবীর অন্যতম হোক। এবং তা করতে সমর্থও হয়েছিলেন।
|
শোনা যায় তাঁর মতামত ছাড়া এক ফুট লাইনও পাতা যেতো না। প্রতিটি কারুকার্য, প্রতিটি মূর্তি তাঁর অনুমতি নিয়েই তৈরি। এর জন্য শত শত শিল্পী ও বৈজ্ঞানিকদের মস্কোয় আনা হয়েছিলো দেশের দূর-দূরান্ত থেকে। মার্বেল ও দামি পাথর আমদানি হয়েছিলো উরাল পর্বতমালা, বাকু, সাইবেরিয়া, ইউক্রেন আরও কতো জায়গা থেকে। প্রথমদিকে লন্ডন থেকে কয়েকজন মেট্রো-পারদর্শী বৈজ্ঞানিকদেরও আনা হয়েছিলো কিন্তু কাজ শেষ হওয়া মাত্র সন্দেহবাতিক স্টালিন তাঁদের গুপ্তচর মনে করে নির্বাসিত করেছিলেন।
|
শোনা যায় ১৯৪-টা স্টেশনের প্রতিটি আলাদা রকমের। ৭৬-টা স্টেশন বহুতল গভীর; দু'-তিন তলা লাইন পাতা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় অন্যান্য মেট্রোর মতোই মস্কোর স্টেশনগুলি বোমাবর্ষণ থেকে রক্ষা পাবার জন্য নাগরিকদের আপৎকালীন আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কয়েকটি গোপনীয় স্টেশনে দেশের নেতাদের সমাবেশ ও যুদ্ধচালনার কাজেও লাগানো হয়েছিলো। সেগুলি যুদ্ধের পরেও, এখনো অবধি গোপন রয়ে গেছে। সেখানে দর্শকদের আনা হয় না। কোনো ট্রেনও চলে না, শুধু গোপন মন্ত্রণার কাজেই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।
|
প্রায় দু'শ' স্টেশনের মধ্যে আমি দেখেছি মাত্র তিন-চারটে। তাদের কথাই বলি।
|
১) নভস্লবদস্কায়া:গালভরা রাশিয়ান নামগুলি--লেখা বা উচ্চারণ, দুইই কঠিন। এই স্টেশনটি রঙিন কাচের (stained glass) কারুকার্যের জন্যে বিখ্যাত। স্টেইন্ড গ্লাসের চল রাশিয়াতে আগে ছিলো না। মাটির উপরে বড়ো বড়ো গির্জাগুলিতেও তাদের দেখা যায় না। এই স্টেশনেই স্টালিনের সময় থেকে রঙিন কাচশিল্প শুরু হয়। এমনিতেই রাশিয়ান ছবি, স্থাপত্য সবেতেই কম্যুনিস্ট প্রোপাগান্ডার ছড়াছড়ি। সবেতেই মা-রাশিয়া ধনধান্যভরা খামারে পা বাড়িয়ে চলেছেন। পাশে কাস্তে-কুড়াল সমেত শ্রমিক ও সৈন্যদল। সাধারণ গৃহস্থদের ছবি বা কেউ বিশ্রামরত বা 'বুর্জোয়া' কাজে ব্যস্ত এমন বিষয় দেখাই যায় না। তাই এই স্টেশনে রঙিন কাচে পিয়ানোবাদকের ছবি একটু চমকে দেয়। পিয়ানো বাজানোর মতো এমন 'লাভহীন' কাজ স্টালিনের সময় পাত্তাই পেতো না। হয়তো এই সঙ্গীতজ্ঞ পিয়ানো বাজিয়ে সেই সময়ে সৈনিকদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। রাশিয়ার বুর্জোয়া সামাজিক প্রথার এটাই একমাত্র চিহ্ন।
|
২) কমসমলস্কায়া: আরেকটা দাঁতভাঙা নামের স্টেশন। আমি একটু একটু সিরিলিক (Cyrillic) পড়তে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ওই স্টেশনগুলোর নাম পড়তে পড়তেই আমার ট্রেন মিস হয়ে যেত। এই স্টেশনটির মেঝে, দেয়াল ও ছাদ ভর্তি সূক্ষ্ম কারুকার্য--মার্বেল ও মোজাইক-এ। এমনকী যাত্রীদের বসার বেঞ্চ পর্যন্ত মার্বেলে তৈরি ও ভারি সুন্দর কারুকার্যে ভর্তি। গাইডের কাছে শুনলাম এ-সবই নাকি নানা গির্জা থেকে তুলে আনা হয়েছে। স্টালিনের সময়ে রাশিয়ার অনেক চার্চ ভেঙে নষ্ট করা হয়েছিলো। বেশিরভাগই গুঁড়িয়ে রাস্তা ও বাড়িঘর তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর ভালো খোদাইএর কাজ, থাম, মূর্তি ইত্যাদি এইসব স্টেশন সাজানোর কাজে লাগানো হয়েছিলো। তাও তো একরকম টিঁকে রইলো। একেবারে গুঁড়ো হয়ে যাওয়ার থেকে এ-ও ভালো।
|
এই স্টেশনেই আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের বিশিষ্ট ছবি--খুদে খুদে রঙিন পাথর দিয়ে তৈরি বিরাট মোজাইকের ছবি--মা-রাশিয়ার পায়ের তলায় দলিত জার্মানদের স্বস্তিকা-চিহ্নিত পতাকা।
|
৩) প্লোশাড রেভলুইৎসি: এই স্টেশনটা ব্রোঞ্জ মূর্তিতে ভরা। প্রত্যেকটি মূর্তি রাশিয়ান জনসাধারণ--ছেলে, বুড়ো, মেয়ে, পুরুষ, নানা কাজে ব্যস্ত। সৈনিক, শ্রমিক, চাষী, শিক্ষক, শিকারি, পাহারাদার, নানা স্তরের নানারকম লোকের নিখুঁৎ প্রতিকৃতি। কাজগুলোর ডিটেল দেখবার মতো। এর মধ্যে আছে একটি বন্দুকধারী শিকারির মূর্তি, হাঁটু গেড়ে বসে, সঙ্গে কুকুর। কুকুরের মাথায় হাত বুলোলে ইচ্ছাপূরণ হয় নাকি। তাই যেতে আসতে শত শত লোক প্রতিদিন এই কুকুরটির মাথায় হাত বুলোন। ফলে মাথাটি বেশ চকচকে হয়ে রয়েছে। আরেকটি সৈনিকমূর্তিএ বেল্টে গোঁজা নিখুঁতভাবে তৈরি পুরোনো স্টাইলের পিস্তল। অনেকেই নাকি পিস্তলটি চুরি করেন স্যুভেনিরের জন্যে। আমি দেখলাম এবার নতুন পিস্তলটা শক্ত করে স্ক্রু-বোল্ট দিয়ে আটকানো। তবু কতোদিন এটা থাকবে কে জানে? রাশিয়াতেও তাহলে এরকম চুরি হয়!
|
অনেক স্টেশনে আছে লেনিনের মূর্তি বা ছবি। কিন্তু স্টালিনের নামগন্ধও নেই। স্টালিন সত্যিই জাতীয় পরিত্যক্তদের দলে। ক্রুশ্চেভের সময় থেকেই স্টালিনের নাম ও ছবি সব মোজাইক, সব ছবি, সব স্থাপত্য থেকে যত্ন করে খুঁটে খুঁটে তুলে ফেলে তার জায়গায় নিরপেক্ষ সাদা পায়রা, ফুল ইত্যাদি যোগ করা হয়েছে। কাজগুলো এত সুন্দরভাবে করা যে খুব কাছে থেকেও ধরা যায় না।
আরও অনেক স্টেশনের অনেক ইতিহাস, সব তো আমার দেখাই হয়নি। পাঠকরা যদি কখনো মস্কো যান, মেট্রোটা নিশ্চয়ই দেখবেন।