• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • অপরূপ অরুণাচলে : রাহুল মজুমদার

    ষোলোই মে, দু'হাজার চোদ্দো, সকাল এগারোটা বত্রিশ-

    গুয়াহাটি এয়ারপোর্টের সামনে রথ তৈরি ছিল, উঠে বসলাম। সারথি হরিহর মসৃণ হাইওয়ে ধরে দুরন্ত বেগে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

    বেলা দু-টো

    চোপরাস, জাগি রোড, নেলি, রহা হয়ে পৌঁছলাম নওগাঁ। গা জ্বালানো গরম থমকে রইল গাড়ির বাইরে।

    বেলা তিনটে কুড়ি -

    অসংখ্য সুপারি (গুয়া) গাছ জানিয়ে দিচ্ছে গুয়াহাটি নামের সার্থকতা। পথে আমনিতে পেটপুজো সেরে মিছা হয়ে কলিয়াবর থেকে বাঁদিকের পথ ধরল গাড়ি।

    বেলা পাঁচটা-


    ভালুকপং

    ব্রহ্মপুত্রকে পার করে নলতলি, চুলুং, গোটলং পেরোতেই পাহাড়েরা দেখা দিতে শুরু করল। বালিপারা, চারিদুয়ার, নামোরি গেট পেরিয়ে ভালুকপং পৌঁছে গাড়ি ডানদিকে গোঁৎ মেরে ধড়মড়িয়ে উঠে এলো অসম ট্যুরিজমের প্রশান্তি কটেজে। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেললাম ভালুকপংকে। অরণ্যের মাঝে অপূর্ব বাগানঘেরা কতগুলো কটেজ। পাশেই বাঁক খেয়ে বয়ে চলেছে মনভরানো জিয়াভরলি। তার ওপারে সবুজ পাহাড় বিশ্রাম করছে। প্রজাপতি, মথ আর ভোমরারা ফুলের ওপর নেচে নেচে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো।

    রাত ন-টা -

    ভালুকপংয়ের সৌন্দর্যে মন ভরানোর আগেই মেঘের ভ্রুকুটিতে ভয় পেয়ে নেমে আলো আঁধার। অন্ধকার দেখে ভয় পেয়েই বোধহয় আকাশ কাঁদতে বসল।

    সতেরোই মে, সকাল দশটা -


    ভালুকপং

    বিদায় নেবার আগে প্রাণ ভরে দেখে নিলাম ভালুকপং আর জিয়াভরলিকে। এবার আমরা রাজ্য বদল করব — অসম থেকে ঢুকব অরুণাচলে। আমাদের ইনার-লাইন পারমিট আর গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষার পর ছাড়পত্র পাওয়া গেল। ওপার থেকে সবুজপাহাড়ী অরুণাচল হাতছানি দিয়ে ডাকছে। অরুণাচলে এসেই জিয়াভরলি ঝটপট নাম পালটে কামেং হয়ে নাচ জুড়েছে।

    সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ -

    টিপি অর্কিড রিসার্চ সেন্টার। অর্কিড নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় মেতে রয়েছেন বৈজ্ঞানিকেরা।। কত শত রকমের অর্কিড! কাকে ছেড়ে কাকে দেখি! প্যাফিওপেডিলাম, ভেনব্রোডিয়াম, এরিডেম, ক্যাকলিয়া, সিম্‌বিডিয়াম, ফ্যালিনপসিস, ভান্‌ডা, সার্কোগ্‌লিফিস, ওবেরোনিয়া, কিরোস্টাইলিস — আর সবার ওপরে নেপেন্থিস, যাকে আমরা চিনি কলস উদ্ভিদ হিসেবে। অর্কিডোলজিস্ট বিকাশ ভৌমিক আমাদের অর্কিডের জ্ঞানের বিকাশ ঘটালেন। মুগ্ধ হয়ে বেরিয়ে এলাম — বহুদূর যেতে হবে। না গেলেই নয়। 'ওয়েলকাম টু কামেং' — তোরণ স্বাগত জানাল।

    'সকাল' এগারোটা চল্লিশ -

    সেস্‌সা। সবুজেরা আরও ঘনিয়ে এলো। ঘনিয়ে এলো মেঘও। কামেং-য়ের নাচ চলছেই।

    'সকাল' এগারোটা পঞ্চান্ন -

    একটা বিজ্ঞপ্তি — Foggy Zone starts here. তার ওপারে মেঘের ভারি পরদা।

    বেলা বারোটা কুড়ি -

    মেঘসাম্রাজ্য ফুঁড়ে চলতে চলতে হঠাৎই এক 'ঝরণা ঝরণা, সুন্দরী ঝরণা'। মেঘ আবার সব গিলে নিল। মেঘের দেশে কখনও কখনও কয়েকটা গাছ বা দু-একটা মানুষের ছায়াশরীর ভূতের মতো দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আলো ভোরের থেকেও কম। 'প্রায় নেই' দেশ ধরে ছুটছে গাড়ি।

    বেলা বারোটা বেয়াল্লিশ -

    নেচীফু। মেঘের পরদা দু মিনিটের জন্য একটু হালকা। দেখা দিয়ে গেল কিছু বাড়িঘর।

    বেলা বারোটা পঞ্চান্ন -

    মেঘরাজত্ব শেষের ইঙ্গিত বিজ্ঞপ্তিতে — Foggy Zone ends here.

    বেলা একটা এগারো -


    টেংগা

    টেংগা নদীকে পেরোলাম। পুলের ধারে একটু ওপরে নাগমন্দির।

    বেলা সোয়া একটা -

    এপারে নাগমন্দির বাজার বা নিউ কসপি। পারমিট পরীক্ষার ফাঁকে চা চাপানো গেল। সামনের পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের ছবিকে পাহারা দিচ্ছে অগুনতি ছাতার মতো মৌচাক; বিশাল তাদের আকার।

    বেলা দুটো দশ -

    দাহুং পেরিয়ে এলাম টেংগা। নদীর নামে নাম। চিনা আক্রমণে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল ৬২তে। সৈন্যশিবির।

    বেলা দুটো কুড়ি -

    চুগ পুল পেরিয়ে চড়াই শুরু।

    বেলা দুটো পঁয়ত্রিশ -

    দুখুমপানি। কার দুঃখে কে জানে!

    বেলা তিনটে -


    বমডিলা গুম্‌বা

    বমডিলা। দিব্যি শহর। তবে এই মুহূর্তে মুহ্যমান। খুব উঁচুদরের একজন লামার স্বর্গলাভ হয়েছে। শোকপালন চলছে। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। স্টেডিয়ামে অবশ্য ফুটবল প্র্যাকটিস চলছে। বৌদ্ধ গুম্‌বায় সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। তার বাগানে ফুলের কলোনি।

    আঠারোই মে, সকাল পৌনে ছ-টা -

    রাত পালিয়েছে চারটেয়। মেঘেরা দিনের আলোকে প্রাণপণে আটকাতে ব্যস্ত। বমডিলার ঘুম এখনও ভাঙেনি। একটু ভুল হলো। পাখিরা বেরিয়ে পড়েছে প্রভাতফেরিতে। তাদের গানে আমার মতো দু-পাঁচজনই সাড়া দিয়েছে। বাকিরা কানে গুঁজেছে তুলো, মাথা গুঁজেছে বালিশে।


    বমডিলা

    সকাল আটটা পনেরো -

    আজ ল-ম্‌-বা পাড়ি। তাই ছুটল গাড়ি। বমডিলা পেরোতেই সবুজের ডাক।

    সকাল সাড়ে ন-টা -

    মুন্না। ভাই কিনা জানি না।

    সকাল ন-টা চল্লিশ -

    নীচে নদী, ওপরে বসতি। দিরাং। নয়নাভিরাম।

    সকাল দশটা সাতাশ -

    রামা, সপ্পার পার করে পথের ধারে ঝোরার ধারে ছোট্ট পদ্মা হোটেলে চা-পান। বাড়তি পাওনা মা-মেয়ের মধুর ব্যবহার, রানির আদুরে লেজনাড়া।

    সকাল দশটা পঞ্চাশ -

    ডাক দিল ন্যুকমাদং ওয়ার মেমোরিয়াল - দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগ করা জওয়ানদের স্মৃতিসৌধ। গম্ভীর অথচ সুন্দর। অদ্ভুত প্রশান্তি বিছিয়ে রয়েছে।

    দুপুর বারোটা বাজতে পাঁচ-

    মন, ডুণ্ডরি পেরিয়ে দশহাজারি সেংগে ক্যাম্প।

    বেলা বারোটা দশ -

    বৈশাখী ক্যাম্প। এখানে হাতে গোনা বসতি ছাড়া সবই সেনাশিবির।

    বেলা বারোটা চল্লিশ -

    চলেছি রডোডেনড্রন সরণি বেয়ে। লাল, গোলাপী, সাদা, হলুদ এমনকী কমলা! কমলা রংয়ের রডোডেনড্রন আগে কখনও দেখিনি। মেঘেরা কিন্তু আকাশের দখল ছাড়েনি। তাদের আন্দোলনে হুমকি উঁকি মারছে।

    বেলা একটা পাঁচ -

    উঠে এলাম ১৩৭০০ ফুট উঁচু সেলা পাসে। তোরণে তাওয়াং জেলায় প্রবেশের আহ্বান। সব দোকানপাট বন্ধ। এখানে সেখানে তুষারের রাজত্ব। দুরন্ত হাওয়ায় শান্তির প্রতীক রঙীন পতাকারা দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যেতে চাইছে। পথের ধারে সবুজের বুকে ছোট ছোট হলুদ তারার মেলা। ছোট্ট একটা জলাশয় গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে।

    বেলা একটা পঁচিশ -

    খানিক এগিয়ে দেখি বিশাল সেলা লেক এখন লজ্জায় মেঘের বোরখার আড়ালে। একটামাত্র খোলা দোকানে পেটপুজোর ব্যবস্থা। দাঁতের কত্তাল শুরু হয়ে গেছে। শূর্পনখা হওয়ার ভয়ে ঘন ঘন নাক ঘষতে হচ্ছে।

    বেলা দুটো পঁচিশ -

    নুরানাং ক্যাম্প। এখানেই ৬২ সালে চিনাদের সঙ্গে অসম যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছিলেন দেশপ্রেমী তিন সৈনিক, যাঁদের অন্যতম ছিলেন যশোবন্ত সিং। একা তিনদিন রুখে দিয়েছিলেন বিশাল চিনা বাহিনীকে।

    বেলা তিনটে বারো -

    যশোবন্তগড়। শহীদ যশোবন্ত সিং আর তাঁর দুই সাথীর স্মৃতিতে গড়া স্মৃতি মন্দির। শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। সেই দুঃখের দিনগুলোর স্মরণেই বোধহয়, আকাশ কাঁদতে বসল।

    বেলা সোয়া চারটে -

    বেশ কিছুক্ষণ কেঁদেও আমাদের থামাতে না পেরে আকাশ কান্না থামিয়েছে। পারমিট পরীক্ষার ফাঁকে দূর থেকে জংপ্রপাতের প্রতাপ দর্শন করলাম। ফেরার সময় তার সঙ্গে মোলাকাত করা যাবে প্রাণভরে।

    বেলা চারটে পঞ্চাশ -

    তাওয়াং চু-কে পেরোলাম।

    বেলা পাঁচটা আট -

    লাউ। সাধের কিনা কে জানে! ডুগডুগি হওয়ার আগেই আমরা পগার পার।

    বেলা পাঁচটা আঠারো -

    খীরমু বস্তি পার করে বামপন্থী হওয়া গেল। মাইলফলক বলল, তাওয়াং আর ১৮ কি.মি.। পথ হঠাৎ ঝাঁকুনি থামিয়ে খয়েরি থেকে কালো হয়ে গেল।

    বেলা পাঁচটা পঁচিশ -

    বমডির। তাওয়াং আর ঘন্টাখানেকের পথ।

    বেলা ছ-টা কুড়ি -


    তাওয়াং

    অবশেষে চলার শেষ। দশ হাজারি তাওয়াং স্বাগত জানালো। পরলোকগত লামার স্মরণে মোড়ে মোড়ে মোমবাতির শ্রদ্ধাবর্তিকা।

    সন্ধ্যা সাতটা -

    অপূর্ব আরামদায়ক ঘর পেয়ে শরীর আরাম চাইল। এরই মধ্যে মেঘের ফাঁক দিয়ে তাওয়াং গুম্‌বা একঝলক উঁকি দিয়ে গেছে। সম্ভ্রম জাগানো রূপ তার।

    উনিশে মে, সকাল ছ-টা -

    বাইরে বেরোতেই ফনা তুলে অভ্যর্থনা জানালো একসারি কোবরা লিলি। তাদের আর পাখিদের সঙ্গে দেখা করে, ঘুমন্ত তাওয়াংয়ের মেঘের কাঁথামুড়ি দেওয়া চেহারা দেখে, তাওয়াং গুম্‌বাকে দূর থেকেই হাত নাড়লাম। আজই ওর সঙ্গে মোলাকাত হবে।

    সকাল ন-টা -

    আগামীকালের বুমলা ভ্রমণের পারমিটের জন্য ছবি কাগজপত্র জমা দিলাম। এই সুযোগে তাওয়াং ঘুম ভেঙে বৃষ্টির জলে মুখ ধুয়ে নিল।

    সকাল দশটা -

    ইদিক উদিক দেখব বলে হরিহরের ঘাড়ে, থুড়ি গাড়িতে চাপলাম।

    সকাল দশটা সতেরো -


    তাওয়াং গুম্‌বা

    পাহাড়ী বাঁকা পথে এসে পৌঁছলাম সুপ্রাচীন, অন্যতম বৃহৎ তাওয়াং গুম্‌বায়। যার পুরো নাম তাওয়াং গালদেন নামগে লাৎসে, যার মানে হচ্ছে 'ঘোড়ার পছন্দ করা স্বর্গীয় সুষমাময় স্থান'। অনেকখানি জায়গা জুড়ে রীতিমতো সম্ভ্রম আদায় করে দাঁড়িয়ে আছে সে।

    সকাল এগারোটা এগারো -

    সবথেকে পুরোনো অংশটায় সারাই চলছে। মূল গুম্‌বায় ২৬ ফুট উঁচু করুণাঘন বুদ্ধমূর্তির পায়ের কাছে দলাই লামার ছবি। গুম্‌বার ভিতরের সাজ, চার দেয়াল জোড়া অপূর্ব সব ছবি — সিলিংয়েও তাই। শিল্পের পরাকাষ্ঠা ছবি আর মূর্তিগুলোতে। একপাশে অনির্বাণ দীপ। ভাবগম্ভীর পরিবেশে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম। দূরে নিচের থেকে তাওয়াং শহর উঁকি মারছে। জানা গেল ১৬৮১ সালে দলাই লামার নির্দেশে লামা লোদবে গ্যায়াৎসো এই গুম্‌বার প্রতিষ্ঠা করেন।

    বেলা এগারোটা বাহান্ন -

    এসেছি তাওয়াং-এর ওয়ার মেমোরিয়ালে। বৌদ্ধ স্তূপের আদলে গড়া অরুণাচলে (তখনকার নেফা) শত্রু আক্রমণে প্রাণ দিয়ে দেশ রক্ষা করা বীরদের স্মৃতি সৌধ। তাঁদের বীরত্বগাথা শুনতে শুনতে আর অগুনতি নাম গুনতে গুনতে চোখ ভিজে উঠল।

    বেলা পৌনে দু'টো -

    এবার এলাম আরও প্রাচীন খিন্‌মি গুম্‌বায়। মনপাদের এই গুম্‌বা তৈরি হয়েছিল ১৪৪০ সালে। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা এই গুম্‌বার বৈভবও কম নয়। দেখে মন ভরে গেল।

    বেলা দু'টো পঞ্চাশ -

    ফিরে এলাম। আজকের কথা ফুরোলো।

    বিশে মে, সকাল সাতটা -

    বুমলার জন্য তৈরি, শুধু আকাশটা কান্না থামালে হয়।

    সকাল সাড়ে সাতটা -

    আকাশের ফ্যাঁচফ্যাঁচানি থামলেও মুখ গোমড়াই রইল।

    সকাল আটটা পাঁচ -

    জয় বাবা বুমলানাথ। জয় বাবা হরিহর।

    সকাল আটটা কুড়ি -

    প্রথমবার পারমিট পরীক্ষা। দু-জন জওয়ান সঙ্গী হলেন — যাবেন Y ক্যাম্প পর্যন্ত। Y ক্যাম্প! Why এমন নাম?

    সকাল আটটা বাইশ -

    গোবিন্দগড় ক্যাম্প। কাঁচা রাস্তা শুরু।

    সকাল সাড়ে আটটা -

    ১২৪০০ ফুট ক্যাম্প। আবার পারমিট পরীক্ষা। গাড়ি হিপ হপ ডান্স শুরু করে দিয়েছে। পথের ধারে বরফের উঁকিঝুঁকি এখন অবস্থান ধর্মঘট।

    সকাল সাড়ে ন'টা -

    আবার পারমিট পরীক্ষা। এই ক্যাম্পে রয়েছে পৃথিবীর সবথেকে উঁচুতে অবস্থিত আর্টিলারি রেজিমেন্ট। নিষ্করুণ তুষারমোড়া প্রকৃতির মাঝে নিরন্তর অগ্নিপরীক্ষা দিচ্ছেন আমাদের জওয়ানেরা।

    সকাল ন'টা সাতচল্লিশ -

    মেঘের ফাঁক দিয়ে একঝলক উঁকি দিয়ে গেল কেলেম বারুয়া সো হ্রদ। পথের ঝাঁকুনি অব্যাহত।

    সকাল ন'টা পঞ্চাশ -


    Y ক্যাম্প

    Y ক্যাম্প। এখানে পথ দু-ভাগে ভাগ হয়েছে Y এর মতো। একটা গেছে বুমলার দিকে, অন্যটা মাধুরী লেকের দিকে। এতক্ষণে Y ক্যাম্প নামের রহস্য ভেদ হলো। পারমিট পরীক্ষা করতে করতে মোমো দিয়ে শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করলাম। গাড়ি থেকে বেরোতেই শূন্য ছুঁই ছুঁই ঠাণ্ডা জাপটে ধরল। হবে না! ১৫০০০ ফুট বলে কথা। বরফের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে পাথর আর মাটি হেথা হোথা উঁকি মারছে। পথেও এখন কাদামাটির থেকে পাথর বেশি। রডোডেনড্রনেরা এখানে ঝোপঝাড়ে পরিণত।

    সকাল দশটা দশ -

    পথের দৌলতে গাড়ির গতি এখন ঘন্টায় বারো কি. মি. — প্রায় হাঁটি হাঁটি পা পা।

    সকাল দশটা পঁচিশ -

    একটু দূরে বাঁদিকে বিরাট এক তুষারক্ষেত্রের ওপর বৌদ্ধমন্দিরের ধাঁচে শহীদ যোগীন্দর সিংয়ের স্মৃতিসৌধ রঙীন পতাকায় সেজে দাঁড়িয়ে। সামনে বরফ ফুঁড়ে জলধারা ছুটে এসে ঝাঁপ দিয়েছে নিচে। এখানে ওখানে বামন রডোডেনড্রনের ঝোপ। ডানদিক পথ হঠাৎ খাড়া হয়ে ছুট মেরেছে বুমলার দিকে। হুই ওপরে বুমলা ক্যাম্পের সাদা বাড়িগুলো উঁকি মারছে। খাড়া পথটায় দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে। প্রথমটা ওঠার ব্যর্থ চেষ্টা করছে; দ্বিতীয়টা অপেক্ষা করছে। স্বর্গে এসে রথ থামিয়ে দিল হরিহর।

    সকাল দশটা পঞ্চাশ -

    অপেক্ষাই সার। ওপরের গাড়িটা ন যযৌ ন তস্থৌ।

    সকাল এগারোটা দশ -

    নড়েছে! গাড়িটা নড়েছে।

    সকাল এগারোটা বারো -

    হা হতোস্মি। খানিক উঠেই আবার স্ট্যাচু।

    সকাল এগারোটা কুড়ি -

    পেরেছে। প্রথম গাড়িটা ওপরে উঠে চলেছে। দ্বিতীয়টাও স্টার্ট দিয়েছে।

    সকাল এগারোটা পঁচিশ -

    এবার আমাদের পালা। হরিহর হরিনাম জপে ইঞ্জিন স্টার্ট করল।

    সকাল এগারোটা বত্রিশ -

    পুরো দম নিয়ে হরিহর গাড়ি তুলে নিয়ে চলেছে। চাকার নিচে এখন জলের ধারা আর আলগা নুড়ি — চাকায় গ্রিপই ধরছে না।

    সকাল এগারোটা পঁয়ত্রিশ -

    সর্বনাশ! বিশাল একটা পাইপ টপকাতে গিয়ে গাড়ির ঊর্ধ্বগতি স্তব্ধ। সর্বশক্তি দিয়েও হরিহর গাড়ি তুলতে পারছে না এক ইঞ্চিও। বরঞ্চ গাড়ি পিছু হটছে ঢাল ধরে। আকাশ এখন ছিঁচকাঁদুনে।

    সকাল এগারোটা চল্লিশ -

    গাড়ির চাকায় পাথর দিয়ে গড়ানো বন্ধ করা গেছে। কিন্তু এগোনো অসম্ভব। হিমঠাণ্ডা বৃষ্টির ফ্যাঁচফ্যাঁচানি চলছেই।

    সকাল এগারোটা বাহান্ন -

    হার মানতে হলো হরিহরকে। গাড়ি গরম হয়ে গেছে। কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। গাড়ি এক ইঞ্চিও এগোয়নি। অতএব অওর নেহি ব্যস্‌ অওর নেহি।

    বেলা বারোটা দশ -

    আমার নির্দেশের ওপর ভরসা করে হরিহর ব্যাক গিয়ারে গাড়ি নামিয়ে আনল অপেক্ষাকৃত নিরাপদ জায়গায়। আবার আমাদের মুখে হাসি ফুটল, আবার চারদিকের দৃশ্য সুন্দর লাগতে লাগল।

    বেলা বারোটা পঁয়ত্রিশ -


    নাম না জানা হ্রদ

    মুগ্ধতার বোধ ফিরে পেয়ে অপূর্ব সব হ্রদের রূপে মুগ্ধ হতে হতে ফিরে এলাম Y ক্যাম্পে। কফি আর মোমো খেয়ে বুমলা না দেখার দুঃখ পুরোপুরি দূর হলো।

    বেলা পৌনে একটা -

    এবার সাংগেৎসর (মাধুরী) লেকের পথে। একই রকম পথ। তবে চড়াই টড়াই নেই। পথ বরং একটু একটু করে নামছে।

    বেলা বারোটা সাতান্ন -

    পেরোলাম নাক্‌য়ো ক্যাম্প।

    বেলা একটা দশ -

    মেঘের দেয়াল ভেদ করেও দেখতে পাচ্ছি একটা ছোট্ট কিন্তু দুরন্ত নদীকে, রডোডেনড্রনদের সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে। নদী আর রডোডেনড্রন এই আছে, এই নেই।

    বেলা সোয়া একটা -

    পথ নেমেছে অনেকটাই। কারণ, আবার পাইনের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দেখা দিয়েছে।

    বেলা একটা কুড়ি -

    সাংগেৎসর লেক — ১২৪৮৭ ফুট। সামনে সাজানো বাগান। লেক ঘিরে বেড়াটা নতুন। তার গায়ে রঙীন ধর্মীয় নিশান। লেক মেঘের লেপের তলায়।

    বেলা দু'টো -

    মেঘের দেয়াল ফুঁড়ে যতটা সম্ভব দেখলাম 'মাধুরী লেক'কে। একসময় এখানে নাকি একটা গ্রাম ছিল। একটা রাতের বিপর্যয়ে সেই গ্রাম এখন হ্রদ। তার সাক্ষী লেকের ওপর জেগে থাকা অসংখ্য গাছের মৃতদেহ। বীভৎস অথচ সুন্দর। আমাদের সঙ্গী সেই নদীর ধারা এসে পড়েছে লেকে, তারপর অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। একটা সাঁকো পেরিয়ে গিয়ে দেখে এলাম রডোডেনড্রনের মহানগর। সময় কম, ফিরতে হবে, তাই লেক পরিক্রমা করা গেল না। মেঘেদের বদমাইসি চলছেই।

    বেলা দুটো কুড়ি -

    সুন্দর কাফেটেরিয়ায় কফি আর মোমো দিয়ে প্রাণ রক্ষা করা গেল।

    বেলা দুটো চল্লিশ -

    মেঘের কাছে হার মেনে মাধুরী লেকের আবছা ছবি দেখেই ফেরার পথ ধরতে হলো।

    বেলা তিনটে ষোলো -

    আবার Y ক্যাম্প। হালকা বরফ পড়ছে।

    বেলা তিনটে পঁয়তাল্লিশ -

    নাগুলা লেক।

    বেলা তিনটে বাহান্ন -

    প্যানকাংতেং সো বা পিটিসো। ছোট্ট অথচ সুন্দর। রঙীন পতাকা আর রডোডেনড্রনের দৌলতে তার রূপ আরও খুলেছে। বৃষ্টি চলছেই, তবে জোর তেমন নেই।

    বেলা চারটে চল্লিশ -

    ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে ফিরে এলাম তাওয়াংয়ে।

    একুশে মে, সকাল পৌনে ন'টা -

    বিদায় তাওয়াং।

    সকাল দশটা পঁয়ত্রিশ -

    জং প্রপাত। আমরা হতবাক। এত সুন্দর, এত বিশাল! প্রায় আড়াইশো ফুট উঁচু থেকে অসীম জলরাশি প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কতক্ষণ যে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম বলতে পারব না। মন আর ভরে না। এর আসল নাম নাকি নুরজারংপ্রপাত। পাশের গ্রাম জং-য়ের নামেই এখন সে পরিচিত।

    সকাল দশটা পঞ্চাশ -

    অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ ফেরাতে হলো। আজকের পথ বড্ড লম্বা।

    সকাল দশটা পঞ্চান্ন -

    জং।

    ভরদুপুর -

    মুগ্ধ হতে হতে চলেছি। আসার সময় মেঘের এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে দেয়নি। মনের মেমরি চিপে আঁটলে হয়!

    বেলা বারোটা পঁয়ত্রিশ -

    মেঘমুক্ত সেলা লেক সাদর অভ্যর্থনা জানালো। সে ডাক কি হেলাফেলা করা যায়!

    বেলা বারোটা সাতচল্লিশ -

    আবার সেলা পাস। পবনদেবের পরাক্রমে দাঁড়ানো দায়।

    বেলা একটা পঁচিশ -

    বৈশাখী ক্যাম্প। ক্যানটিন দেখেই পেটের ছুঁচোগুলো সালসা শুরু করে দিয়েছে।

    বেলা দুটো পাঁচ -

    ছুঁচোদের নাচ থামিয়ে আবার পথে নামা হলো।

    বেলা তিনটে পঁয়ত্রিশ -

    দিরাং। আবার এখানে থাকতে না পারার দুঃখ পেলাম।

    বেলা পাঁচটা -

    বমডিলা। চা খাওয়ার বুড়ি ছোঁওয়া।

    বেলা পাঁচটা চল্লিশ -

    দুখুমপানি। এত সুন্দর জায়গায় দুখ কীসের কে জানে! অনেকটা নেমে এসেছি।

    বেলা ছ'টা -

    দিনভর ছুটে অবশেষে টেংগা।

    বেলা ছ'টা দশ -

    এ কেমন জায়গা! হোটেল আছে লোক নেই। ইলেকট্রিক লাইন আছে, ইলেকট্রিসিটি নেই। সারাদিনের ধকলের পর শরীর ভীষণভাবে বিশ্রাম চাইছে। মেজাজটা খিঁচড়ে গেল।

    সন্ধ্যা ছ'টা কুড়ি -

    হরিহরই আবার পরিত্রাতার ভূমিকায়। কোথা থেকে খুঁজে পেতে হোটেলের লোককে ঠিক ধরে নিয়ে এলো। ঘরও জুটল। এবার টেংগার সৌন্দর্যও চোখে পড়তে লাগল। টেংগা নদীর বাঁক, তার ওপরের দোমড়ানো ব্রিজটা, একটু দূরের ছোট্ট সাঁকোটা ছোট্ট পোস্ট অফিস —

    রাত আটটা -

    মোমবাতির ভরসায় সময় কাটছে।

    রাত সোয়া আটটা -

    কারেন্ট এলো। ধড়ে প্রাণ এলো।

    রাত সাড়ে আটটা -

    খাবার এলো।

    বাইশে মে, সকাল ন'টা দশ -

    টেংগা বাসের ইতি।

    সকাল দশটা সতেরো -

    নেচী ফু। আবার Foggy Zone শুরু।

    সকাল এগারোটা বারো -

    Foggy Zone শেষ। এবার কামেং ধরে দৌড়।

    ঠিক দুপ্পুরবেলা -

    ভালুকপং। বিদায় অরুণাচল। বিদায় কামেং। স্বাগত জিয়াভরলি।

    বেলা বারোটা বাহান্ন -


    নামেরি

    নামেরি সংরক্ষিত অরণ্যে ঢুকলাম বাঁয়ে মোচড় মেরে।

    বেলা একটা -

    নামেরি ইকো ক্যাম্প। মনোরম অরণ্যবাস।

    বেলা সাড়ে চারটে -

    এসেছি জিয়াভরলি নদীর ধারে। ভালুকপংয়ের তণ্বী এখানে যুবতী।

    বেলা পৌনে ছ'টা -

    আঁধারের ভয়ে ফিরে এলাম ঘরে।

    রাত সাড়ে আটটা -

    এখানেও লোডশেডিং, তবে জেনারেটর আছে।

    রাত সোয়া ন'টা -

    অরণ্যঘেরা বারান্দায় বসে ডিনার! অনবদ্য।

    তেইশে মে, সকাল আটটা -

    শেষের শুরু। আজ ফেরার পালা।



    অলংকরণ (Artwork) : স্কেচঃ রাহুল মজুমদার
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments