কয়েক বছর আগে আমি ইন্টারন্যাশন্যাল ইনস্টিট্যুউট অফ অ্যান্টিক্যানসার রিসার্চ নামক এক সংস্থা থেকে তাদের অষ্টম ক্যান্সার রিসার্চ কনফারেন্সে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। মিটিংটা হবে গ্রীস দেশের অন্তর্ভুক্ত ক্রীট দ্বীপে। ডেমোক্রাসীর জনক এই দেশে আমি আগে কোনদিন যাই নি। তার ওপর উপরি পাওনা ক্রীট দেখা যাবে। ইউরোপের সবচেয়ে দক্ষিণ-প্রান্তিক দেশ গ্রীস মেডটেরিনিয়ান সী বা ভূমধ্যসাগরের দিকে একটা বুড়ো আঙুলের মত এগিয়ে আছে, আর সেই আঙুলের শেষ প্রান্ত ঘিরে আছে কয়েক হাজার দ্বীপ। তাদের মধ্যে আয়তন (প্রায় সাড়ে আট হাজার বর্গ কিলোমিটার) ও গুরুত্বে (জনসংখ্যা ৬৫০,০০০) সবচেয়ে বড় হল ক্রীট। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে আরও একটা আশ্চর্যজনক তথ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তা হল ভূমধ্যসাগরে ক্রীটের অবস্থান এমন একটা জায়গায় যেখানে আফ্রিকা, এশিয়া ও ইউরোপ তিনটি মহাদেশ তাকে চারদিক থেকে ঘিরে রয়েছে। এই অসাধারণ ভৌগোলিক অবস্থান বার-বার ক্রীটের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করেছে। সে কথায় পরে আসছি।
সায়েন্টিফিক মিটিং-এ যাওয়ার একটা মস্ত আকর্ষণ হল একটা নতুন দেশ বা জায়গা দেখতে পাওয়া। তাই স্বপ্না, অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে বলতেই সে একপায়ে খাড়া। ক্রীটে যাওয়ার উপায় অ্যাথেনস-এ এরোপ্লেন পালটিয়ে সেখান থেকে ক্রীটের সবচেয়ে বড় শহর হিরাক্লিয়নে যাওয়া। অথবা অ্যাথেনস-এর বন্দর পিরেউস থেকে জাহাজে চেপে হিরাক্লিয়ন। জাহাজ ছাড়ে সন্ধে আটটায় আর হিরাক্লিয়ন বন্দরে পৌঁছতে ভোর ছটা। এই লম্বা সময়টা মেনে নিতে পারলে যাতায়াতের খরচাও বেশ খানিকটা কম পড়ে। তাছাড়া আগে কোনদিন জাহাজে চেপে কোথায় যাই নি। সুতরাং এই ভাবেই যাওয়া ঠিক হল। বস্টন থেকে কন্টিনেন্টালের ফ্লাইট অ্যাথেনস-এ গিয়ে পৌঁছল দুপুরে। এয়ারপোর্টটি ভারী চমৎকার — পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। ইনফরমেশন ডেস্কে জিজ্ঞাসা করতে তারা বলে দিল কোন বাসে করে পিরেউসে যাওয়া যাবে। এয়ারপোর্টে কিছু ডলার ভাঙিয়ে ইউরো নিয়ে আমরা বাসে চড়লাম। এটা ইউরোপ, অ্যামেরিকা নয় তাই শহরের লোকেদের বাস ও আণ্ডারগ্রাউণ্ড চড়ে যাতায়াত করাই রীতি। কিন্তু বাসটি দেখলাম ঝকঝকে পরিষ্কার, লোকের গুঁতোগুঁতি নেই, আর ভাড়াও বেশ কম। সেই বাসে চড়ে আমরা দেখতে দেখতে চললাম পিরেউসের দিকে। অ্যাথেনস ইউরোপের যে কোন বড় শহরের মত, খালি থেকে থেকে মস্ত-মস্ত থাম-ওলা বিশাল সব বাড়ি এই দেশের গর্বিত ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখন এই বাড়িগুলোর কোনটা মিউজিয়াম আর কোনটা সরকারী অফিস। আর অনেক দূর থেকে দেখা গেল এক ছোট পাহাড়ের চূড়োয় পৃথিবীর আটটা আশ্চর্যের অন্যতম পার্থিননের থামওয়ালা অপূর্ব স্থাপত্যের হাতছানি।
|
বাস থেকে নেমে অল্প হেঁটে পিরেউস বন্দরে যখন পৌঁছলাম তখন অক্টোবরের প্রথম দিকের অপূর্ব বিকেল। সামনে ঝকঝকে নীল আকাশ আর তার সাথে মিশে যাওয়া নীল মেডিটেরেনিয়ান সী-র অন্তর্ভুক্ত আয়োনিয়ান সী। নীল আকাশের গায়ে উড়ে বেড়াচ্ছে ঝাঁক-ঝাঁক সাদা আর ধুসর মেশানো সী-গাল। এই পুরো বন্দর অঞ্চলটাই তাদের এক্তিয়ারে, কেউ কেউ খাবার ছুঁড়ে দিচ্ছে আর তাই নিয়ে হুটোপুটি আর কর্কশ স্বরে ডাক দিয়ে তারা সেই খাবার মুহূর্তে শেষ করছে। সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় নানা আকৃতির জাহাজ ও অন্য জলযান। তার মধ্যে আছে সাদা-লাল রঙের মস্ত জাহাজ মিনোয়ান লাইনস — আমাদের রাতের বাহক। টিকিট আগেই কাটা ছিল। ঢোকার মুখে সাদা ধবধবে জামা-কাপড় আর মাথায় সোনালী-নীল রিবন লাগানো টুপি পরে জাহাজের ক্রু-রা করমর্দন করে আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। একটা এস্কালেটরে চেপে আমরা জাহাজের চারতলায় গিয়ে পৌঁছলাম, সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা। থাকা মানে একটা মস্ত ঘরে সার-সার ফুট-রেস্ট-সহ চেয়ার পাতা, প্রত্যেকের সামনে একটা ছোট টি-ভি স্ক্রীন। ততক্ষণে সন্ধে নেমেছে, দেখা যাচ্ছে পিরেউস শহরের আলোর মালা। আর সামনে খোলা সমুদ্রে যেন কেউ নীল কালি ঢেলে দিয়েছে। রাত ন'টার দিক করে জাহাজ ছাড়ল। ইতিমধ্যে আমরা জামা-কাপড় পালটে জাহাজের অন্য তলাগুলো দেখতে বেরিয়েছি। এটা একটা লাক্সারী লাইনার। দোতলায় গিয়ে দেখি এক এলাহী কাণ্ড — খাওয়ার জায়গাই গোটা পাঁচ-ছয়েক, আর বেশ কয়েকটি বার, নানারকম দোকান, যেখানে জামা-কাপড়, পারফিউম থেকে ইলেকট্রনিক জিনিসও কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। আর এসব ঘিরে সার-সার টেবিল-চেয়ার দেওয়া মস্ত আড্ডা দেওয়ার জায়গা। জায়গাটা একেবারে লোকে লোকারণ্য। কেউ খাচ্ছে, কেউ ড্রিঙ্ক করছে, কেউ স্রেফ চেয়ারে বসে ঢুলছে। আর লোকজনের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে যেন মৌমাছির চাক, আর সিগারেটের ধোঁয়ায় লোকদের মুখগুলো একেবারে আবছা।
কিছু খেয়ে নিয়ে ওপরে নিজেদের সীটে যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখি নির্জন এক কোণে কয়েকজন মেয়েপুরুষ বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। আমাদের ভারতীয় অভিজ্ঞতায় মাটিতে শোওয়া কিছুই ব্যাপার নয়, কিন্তু ইউরোপ-অ্যামেরিকায় মাটিতে শোওয়া খুবই নিচু চোখে দেখা হয়। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া মাটিতে শোওয়া নৈব-নৈব-চ। এদের জামা-কাপড়ও বেশ রুক্ষ ও ধূলিমলিন। আগে শুনেছিলাম, তাই বুঝতে পারলাম এরা হচ্ছে ইউরোপীয়ান জিপসী, অথবা চলতি কথায় রোমা। যুগ-যুগ ধরে সারা ইউরোপের প্রত্যেকটি দেশে এরা অত্যাচারিত হয়েছে। তাদের গরু-ছাগলের মত তাড়ানো হয়েছে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায়। এখনও তাই। চকিতে সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা মনে পড়ে গেল। রোমাদের উৎপত্তি আমাদের দেশেই। সেখান থেকে তারা এশিয়া-ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আবার মনে এলো আলিদার লেখায় সেই মেয়েটির কথা, যে নিজের 'জাতভাইয়ের' সাথে সখ্যতা জমানোর চেষ্টা করেছিল। এরা কিন্তু আমাদের দেখে বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, কিন্তু তাদের হাব-ভাব দেখে পাশ কাটিয়ে আমাদের বসার জায়গায় চলে গেলাম। সারাদিনের ঘুরে বেড়ানোর ক্লান্তি ও জেট-ল্যাগ ইত্যাদি--সীটে বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু'চোখ ভরে ঘুম।
পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমের সজোর ঘোষণায় ঘুম ভেঙে দু-ফাঁক - গুড মর্নিং, এখন পাঁচটা বাজে, আর আধ ঘন্টার মধ্যে জাহাজ হিরাক্লিয়ন পোর্টে পৌঁছবে। জানলার মধ্য দিয়ে দেখলাম কালিমা কেটে গিয়ে অল্প-অল্প লাল আভা দেখা যাচ্ছে। আকাশ আর সমুদ্র একেবারে একাকার। আর তার মাঝে সারা দিগন্ত লালে-লাল করে সূর্যদেব প্রকাশিত হচ্ছেন। মুখ-টুখ ধুয়ে, বাথরুম সেরে আসতে আসতেই আবার পি-এ সিস্টেমে ঘোষণা হল — গুড মর্নিং, ওয়েলকাম টু ক্রীট।
হিরাক্লিয়ন শহরটা তখন সবে ঘুম ভেঙে উঠে আড়মোড়া ভাঙছে, কিন্তু ট্যাক্সি পেতে কোন অসুবিধে হল না। সেখান থেকে আমাদের গন্তব্যস্থল সমুদ্রের একেবারে ধারে হারসিনোসোর-এর এক হোটেল। সেখানে স্নান করে জামা-কাপড় পালটেই ছুট-ছুট। মিটিং-এর সেসন্ আরম্ভ হবে হারসিনোসোস-এর হল অফ্ কংগ্রেসে সাড়ে আটটায়। সেখানে রেজিস্ট্রেশন করে, আমার সেসন চেয়ার করে, আমার টক্ (স্লাইড-সহ কথা-বলা) দিয়ে এগারোটার মধ্যে আমার প্রাথমিক কাজ শেষ। তিন দিনের কনফারেন্স, কিন্তু বুঝলাম যে রথ দেখা ও কলা বেচা, অর্থাৎ কনফারেন্সে থাকা আর ক্রীট দেখা দুটো একসাথে হবে না। সেদিনের কনফারেন্স অ্যাটেণ্ড করে বিকেলে আমরা পায়ে হেঁটে দেখতে বেরোলাম। ক্রীট একেবারে ট্যুরিস্টের জায়গা। আর হবে নাই বা কেন — একদিকে সমুদ্র আর অন্যদিকে পাম গাছে সাজানো শহর আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট। সী বীচে সার-সার মেয়ে-পুরুষ বসে সান-বেদিং করছে। বেশ কয়েকজন মহিলার উর্দ্ধাঙ্গে এক টুকরো সুতোও নেই। এটা অ্যামেরিকায় অনেক ঘুরে বেড়িয়েও কোথাও দেখি নি। ইউরোপের চেয়ে অ্যামেরিকা যে অনেক বেশি রক্ষণশীল তা আবার প্রমাণিত হল। রাস্তার ধারে ধারে নানান দোকান, তার মধ্যে আছে ট্যুরিস্ট অফিস। সেখানে টিকিট কিনে জাহাজে করে অন্য দ্বীপে যাওয়া যায়, অথবা একদিনের বাস নিয়ে ক্রীটের কণ্ডাকটেড ট্যুর নেওয়া যায়। এরকম একটা অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে জানা গেল যে মাথা পিছু দেড়শো ইউরো দিলে ক্রীট দেখার জন্য সারাদিনের বাস ট্রিপ পাওয়া যাবে, আর পাওয়া যাবে ইংরেজি-বলা গাইড। কিনে ফেললাম দুটো টিকিট। আর দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার।
পরের দিন সকাল আটটায় হোটেলের বাইরেই বাস পাওয়া গেল। বাস একেবারে ভর্তি। সবই প্রায় আমাদের মত ট্যুরিস্ট, কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, আর হাতে ট্যুরিস্ট অফিস থেকে পাওয়া ক্রীটের ম্যাপ ও গাইড বুক। এর মধ্যে বুদ্ধি করে আমি ক্রীটের ইতিহাস নিয়ে একটা বই কিনে ফেলেছি। বাস চলেছে উত্তর-পূর্বে সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে, আর আমি পড়ে চলেছি ক্রীটের ইতিহাস, আর মাঝে-মাঝে চোখ তুলে দেখে নেওয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। সেই চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের বাস চলেছে এঁকে-বেঁকে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে। কোন কোন বাড়ি যেন সমুদ্রের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে। তাদের জানলায় জানলায় টবে নানান রঙের ফুলের সমারোহ। কোথাও কোথাও বারান্দায় লোক দাঁড়িয়ে। তারা বাসের যাত্রীদের হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
পেশায় বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক হলে কি হয়, ইতিহাসে আমার উৎসাহ অসীম। আমি হাতের বই পড়ে চলেছি। হোমারের অডেসীতে ক্রীটের উল্লেখ আছে — 'ঘন নীল সমুদ্রের মাঝে ক্রীট নামে এক দ্বীপ আছে। সমুদ্র চারিদিক থেকে তার বন্দনা করে। এই সুন্দর দ্বীপে আছে ৯০-টা শহর, যেখানে বাস করে বহু লোক'। হোমারের জন্ম ৮০০ বা মতান্তরে ১২০০ খ্রীস্টপূর্বে। ক্রীটের ইতিহাস আরো আরো অনেক পুরোনো। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই দ্বীপ খনন করে অন্ততঃ ১০০,০০০ বছর আগের (মধ্য প্যালিয়োলিথিক যুগ) ব্যবহৃত জিনিস পেয়েছেন। কিন্তু প্রথম চাষ-আবাদের উদাহরণ পাওয়া যায় প্রায় ৫০০০ খ্রীস্টপূর্বে। তার কিছু আগে থেকে মিনোয়া (মিনোয়ান) সভ্যতার শুরু (৪০০০-১৫০০ খ্রীস্টপূর্ব)। প্রত্নতাত্ত্বিক আর্থার এভানস্ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ক্রীট দ্বীপের কোনোসোস-এ (আমাদের যাত্রার প্রথম স্টপ) মাটি খুঁড়ে এক উন্নত ও অগ্রসর সভ্যতা আবিষ্কার করেন। তিনি একটা ব্যাপার লক্ষ করে ভারি আশ্চর্য হন। তা হোল ওই প্রাসাদের নকশা কেমন যেন গোলকধাঁধার (ল্যাবিরিন্থিয়ান) মত। গ্রীক পুরাকাহিনী (মিথোলজি) থেকে জানা যায় যে রাজা মিনোসের সাথে গোলকধাঁধা বা ল্যাবিরিন্থ-এর প্রবাদ জড়ানো আছে। ক্রীটের প্রথম রাজা মিনোস দেব-দেবীদের কাছে তৎকালীন গ্রীক প্রথামত একটি তুষার-শুভ্র ষাঁড় উৎসর্গ করতে নারাজ হন। তাতে দেব পসাইডন ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে মিনোসের রাণী এক ষাঁড়ের প্রেমে পড়বে। সেই কথাই সত্যি হয়, আর তাদের মিলনে জন্ম হয় মানুষ ও ষাঁড় মেশানো বিকট চেহারার ও বিশাল শক্তিশালী মিনোটোরের। মিনোটোর-এর ইচ্ছে সারা ক্রীট জুড়ে ধ্বংসের তাণ্ডবে মাতে। তাই রাজা মিনোস তৈরী করান এক বিশাল গোলকধাঁধার, যার থেকে মিনোটোর কোনদিন বেরোতে পারে নি। নয় বছর ধরে গ্রীস থেকে প্রতি বছর সাতজন যুবক-যুবতীকে মিনোটোরের গোলকধাঁধায় পাঠানো হত তার ভোগ্য ও খাদ্য হিসাবে। শেষ পর্যন্ত মিনোটোরের মৃত্যু হয় থীস্যুস নামে এইরকম একজনের হাতে।
|
মিনোয়ারা লিখতে জানতো, কিন্তু দেওয়ালের গায়ে বা মাটি ও তামার পাতে তাদের লেখা আজও বোধগম্য হয় নি। তাই তারা নিজেদের কী নামে ডাকতো তা কেউ জানে না। তাই কোন উপায় না দেখে প্রত্নতাত্ত্বিক এভানস সেই গ্রীক পুরাকাহিনী মাথায় রেখে সদ্য-আবিষ্কৃত সভ্যতার নাম দেন মিনোয়ান সভ্যতা। এই অবধি পড়ে আমি বই থেকে মাথা তুলে দেখি আমাদের বাস চলেছে একেবারে সমুদ্রের ধার দিয়ে। একদিকে নীল সমুদ্র। কিন্তু এ কী শুধু নীল - নীল থেকে সবুজের মধ্যে যত রঙ আছে তাদের মিলিয়ে-মিশিয়ে কোন এক দক্ষ শিল্পী সমুদ্রের গায়ে রঙ বুলিয়েছেন। এই রঙের বিবরণ দেওয়া অসম্ভব — কোথাও আকুয়ামেরিন, কোথাও ল্যাপিস ল্যাজুলি, কোথাও অ্যাজুর, আবার কোথাও ছাত্র বয়সে কেমিস্ট্রির ল্যাবে দেখা কপার কার্বোনেটের নীলচে-সবুজ রঙ। কোথাও সমুদ্র আর আকাশ মিলে-মিশে একাকার, আবার কোথাও হাল্কা নীল আকাশের কোলে এলিয়ে রয়েছে ঘন নীল সমুদ্র। উল্টোদিকে আবার সাদা বালির সমুদ্রতট, সেখানে পাম (খেজুর) গাছের সার দেওয়া পথ। অনেক দূর পর্যন্ত এই গাছের সার এগিয়ে চলেছে। তার পরেই সাদা-সাদা-বাড়ি আর লাল ছাদ-ওলা ছোট্ট শহর, দূরের উঁচুনীচু পাহাড়ের গায়ে শুয়ে আছে মায়ের কোলে সুবোধ ছেলের মত।
লাল রং-এর উলটানো থামের পিছনে রঙিন ফ্রেস্কো |
এবার বাসটা সমুদ্রের পথ ছাড়িয়ে ভিতরের দিকে এগোলো। ক্রমশঃ আমরা পাহাড়ি পথ ধরে উঁচুতে উঠছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মিনোয়ান সভ্যতার কেন্দ্রস্থল কোনোসোস-এ পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে নেমে আমাদের যাত্রীরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল গেল এক জার্মান-বলা গাইডের সঙ্গে। এই প্রথম বুঝলাম যে আমাদের বাসের প্রায় অর্ধেক লোক জার্মান। আমাদের সঙ্গে থাকল এক ইংরেজি-বলা ভদ্রমহিলা। টিকিট কেটে নিয়ে সেই গাইডকে সামনে রেখে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে আরম্ভ করলাম। রাস্তাটা ক্রমশঃই খাড়া হতে আরম্ভ করেছে, আর সেই ছোট্ট পাহাড়ের চুড়োয় অনেকখানি জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিনোয়ান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে লম্বা-লম্বা লাল থামওয়ালা মস্ত এক প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। তার চারধারে ছোট-বড় নানা মাপের, নানা আকৃতির সাদা ইঁটের পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে প্রাসাদের বিশাল আকারের সাক্ষী হিসাবে। তার মধ্য দিয়ে সরু পথ আরেক পাঁচিলের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে, অথবা ঢুকে গেছে ছাদওলা কোন ঘরে। এই দেখে আমার সেই গোলকধাঁধার (ল্যাবিরিন্থ) কিংবদন্তীর কথা মনে পড়ে গেল। একটা ঘরের কোণে সার-সার দাঁড় করানো আছে মাটির বিরাট-বিরাট জালা। গাইড জানালো যে এতে রাখা হত নানারকম শস্য, অলিভ, তেল ইত্যাদি। এবার আমাদের প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার পালা। বিশাল-বিশাল ঘরে কোথাও হত রাজকার্য, কোথাও শোওয়া-বসার জায়গা, কোথাও রান্নার ব্যবস্থা। একটা ঘরে একটা মস্ত চেয়ার বা সিংহাসন কি ভাবে কালের হাত এড়িয়ে বেঁচে আছে। একটা মজার ব্যাপার দেখে আশ্চর্য হলাম। প্রাসাদের মধ্যে বিভিন্ন ঘর বিভিন্ন উচ্চতার। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের দেহলী বাড়ির কথা, উনি তখনকার শান্তিনিকেতনের স্থপতি সুরেন্দ্রনাথ কর মশাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেই বাড়ির ঘরগুলো যেন বিভিন্ন সমতলে হয়।
বাইরে বেরিয়ে চোখে পড়ল প্রাসাদের চারদিক ঘিরে জলের নালা বা অ্যাকোয়াডাক্ট ও পয়ঃপ্রণালী। তাদের নানান শাখা-প্রশাখা প্রাসাদের চত্বরের মধ্যে ঢুকেছে বা বেরিয়েছে। গাইড জানালো যেহেতু জায়গাটা পাহাড়ের ওপরে এখানকার অধিবাসীদের জলের জন্য কাছাকাছি কোন ঝর্ণা থেকে জল বয়ে আনা বা বৃষ্টির জল ধরে রাখা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। যদিও স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা বিশাল রোমান অ্যাকোয়াডাক্টের কাছে এটা কিছুই নয়, কিন্তু বোধহয় 'জলই জীবন' কথাটা মনে রেখে মিনোয়ারা এই বিস্তৃত অ্যাকোয়াডাক্টের ব্যবস্থা করে। গাইড ভদ্রমহিলা এও জানালো যে প্রাসাদে রাণীর জন্য আলাদা করে স্নানের ব্যবস্থা (বাথ) ও ফ্লাশিং টয়লেটের ব্যবস্থাও ছিল। এতে বোঝা যায় হাইড্রলিক এঞ্জিনীয়ারিং-এ মিনোয়াদের যথেষ্ট দক্ষতা ছিল।
|
মিনোয়া প্রাসাদের অধিকাংশই ভেঙে পড়েছে, খালি কোন কারণে সামনে ও পিছনে বিশাল বিশাল থামওলা ছাদের কিছু অংশ একেবারে অটুট রয়েছে। থামগুলোর আকৃতি ভারি অদ্ভুত। গ্রীক বা রোমান স্থাপত্যে থাম হয় এক ব্যাসের অথবা তলায় মোটা থেকে ওপরে সরু হয়ে যাওয়া। কিন্তু এখানকার থামগুলো ঠিক উলটো। আরো অদ্ভুত এই থামগুলোর গায়ের রঙ। এ রকম লাল রং-এর থাম সহজে অন্য কোথাও দেখা যায় বলে মনে হয় না। থামের পিছনের দেওয়ালে লাল-নীল-হলুদ রং-এ আঁকা নিসর্গ চিত্র। ভিতরে একটা দেওয়ালে দেখেছি এই একই রঙের মিশ্রণে আঁকা পুরুষ মানুষের ছবি। রাজার জন্য পানীয় নিয়ে চলেছে সুদৃশ্য নানা আকৃতির পাত্রে। আশ্চর্য হলাম যে এ ধরনের আঁকা মানুষের প্রতিকৃতি ও এই রঙের ব্যবহার বইতে দেখেছি মিশরের পিরামিডের দেওয়ালের গায়ে অথবা প্যাপিরাসে আঁকা ছবিতে। মাথায় প্রশ্ন জাগলো — যেহেতু মিশরের সভ্যতার পত্তনের অনেক আগে মিনোয়ান সভ্যতার শুরু তাহলে কী মিনোয়ান শিল্পীরা তাদের প্রভাবিত করেছিল? কিন্তু মিশরে তো এরকম ওলটানো লাল থাম দেখতে পাওয়া যায় না!
|
প্রাসাদ থেকে একটু নিচে নামতেই পড়লো একটা বেশ বড়সড় মাঠ। তার একদিকে উঁচু করে স্টেজ মতো করা। বহু জায়গায় ভেঙে গেছে, কিন্তু বোঝা যায় এখানে লোকেরা জমায়েত হত। আমাদের গাইড বলল বিশেষ-বিশেষ দিনে এখানে গান-বাজনা ইত্যাদি হত। একটা ব্যাপার দেখে আমি বেশ একটু অবাক হয়েছিলাম, কোনোসোস-এর প্রাসাদে কোথাও অত্র-শস্ত্র-যুদ্ধবিগ্রহের কোন উল্লেখ নেই। তাছাড়া এই প্রাসাদের পরিধি ঘিরে কোন পাঁচিলের ভগ্নাবশেষেরও কোন চিহ্ন দেখতে পেলাম না। তাহলে কী তাদের শত্রু বলে কিছু ছিল না! গাইডকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম যে মিনোয়াদের কয়েক হাজার বছরের সভ্যতা সম্বন্ধে যতটুকু জানা গেছে, তাতে যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা বিশেষ নেই, অর্থাৎ মিনোয়ারা সাধারণভাবে ছিল শান্তিপ্রিয় জাতি। পৃথিবীর আদিম সভ্যতা সুমের, মেসোপটেমিয়া, হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো, চীন, মিশর ইত্যাদির মধ্যে যুদ্ধ-রক্তপাত পরের রাজ্য আক্রমণ ইত্যাদির কথা বিশেষ শোনা যায় না। তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ করে সময় ও সম্পদ নষ্ট না করে শিল্প-সংস্কৃতি-শিক্ষা-স্থাপত্যের উন্নতির দিকে বিশেষভাবে নজর দিয়েছিল। তাহলে হিংসা-পরশ্রীকাতরতা কী 'সভ্য' মানুষের অবদান! বা একটু ঘুরিয়ে বলা যায় হিংসা কী সভ্য থেকে সভ্যতর হয়ে ওঠার আনইনটেন্ডেড কনসিক্যোয়েন্স বা অবাঞ্ছিত ভবিতব্য!
এবার আমাদের ফেরার পালা। আমি বাসে উঠলাম বেশ কিছুটা মনের দোলাচল নিয়ে। বর্তমানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অগ্রসরতা নিয়ে বর্তমান পৃথিবীর মানুষের গর্বের শেষ নেই। হয়তো আরো কয়েক হাজার বছর বাদে পৃথিবীর নতুন বাসিন্দারা আমাদের সভ্যতা খুঁজে বার করবে মাটি খুঁড়ে। তখন আমাদের মতো অনেকেই মনে মনে ভাববে — বাঃ, জাতি হিসাবে এরা তো বেশ অগ্রসর ছিল। মহাকালের অমোঘ গতির শিকার আমরা।
আমাদের বাস চলল রেথীম্নো নামে এক শহরের দিকে আর আমি আবার ডুবে গেলাম বইয়ের পাতায়। মিনোয়ার সভ্যতা ক্রীট ছাড়াও অন্যান্য পার্শ্ববর্তী দ্বীপেও ছড়িয়ে পড়ে। ফাইস্টোস, মালিয়া, জ্যাক্রোস ইত্যাদি দ্বীপেও মিনোয়া সভ্যতার বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে আমাদের দেখা কোনোসোস-এর প্রাসাদই এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অটুট রয়েছে।
মিনোয়া সভ্যতা সম্বন্ধে সঠিক জানার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের 'লিনিয়ার এ' লেখা বোঝার অক্ষমতা। তার ফলে মিনোয়াদের সম্বন্ধে দিন-ক্ষণ, সমাজ-ব্যবস্থা, আচার-ব্যবহার ইত্যাদি ব্যাপারে প্রত্নতাত্ত্বিকদের বাক্বিতণ্ডা প্রবাদপ্রতিম। তবে এটা সবাই স্বীকার করে যে তারা ছিল চাষ-বাস ও বাণিজ্য করা শান্তিপ্রিয় জাতি। তাদের তৈরী করা নানা আকৃতির, নানান নক্সা আঁকা তৈজসপত্র (পটারী) ও বিভিন্ন প্রাসাদের গায়ে আঁকা ছবি থেকে জানা যায় যে তারা চিত্রশিল্প ও স্থাপত্যে যথেষ্ট উন্নত ছিল। মিনোয়ারা ব্রোঞ্জ বা তামার ব্যবহার জানত। মাটি খুঁড়ে দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা তামার পাত ও নানান দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। মতান্তর থাকলেও জানা যায় যে মিনোয়াদের ছিল মাতৃকেন্দ্রিক সমাজ। তাদের পূজ্য দেব-দেবীদের মধ্যে দেবীর দিকেই পাল্লা অসম্ভব ভারী। মিনোয়াদের নৌ-বহর মেইন-ল্যাণ্ড গ্রীস থেকে সাইপ্রাস, ইজিপ্ট, মেসোপটেমিয়া, আর পশ্চিমে স্পেন পর্যন্ত যাতায়াত করতো। কিন্তু কোথাও কোন যুদ্ধ-বিগ্রহের চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়নি, পাওয়া যায়নি এমন অস্ত্রশস্ত্র যা দিয়ে যুদ্ধ করা যায়। তবে প্রকৃতিদেবীই মিনোয়াদের প্রধান শত্রু হয়ে দাঁড়ান। যতদূর জানা যায় বিভিন্ন সময়ে তিন তিনবার ভয়ংকর অগ্নুৎপাত ও সুনামী মিনোয়া সভ্যতার ইতি টানে সবকিছু মাটির তলায় পাঠিয়ে দিয়ে অথবা জলে ভাসিয়ে দিয়ে।
ইতিমধ্যে আমাদের বাস রেথীমনোয় এক মস্ত দুর্গের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। গাইডের কথায় জানা গেল যে প্রায় ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দে তখনকার ক্রীটের অধিকর্তা ভেনেসিয়ানরা উত্তরে হিরাক্লিয়ন আর দক্ষিণে হানিয়া (বা চানিয়া)-র মধ্যে সমুদ্রের ধারে এক বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়। সেই প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি হিসাবে তারা রেথীমনোয় গড়ে তোলে এক দুর্গ (যেটাতে আমরা ঢুকতে যাচ্ছি), তোরণ, ফোয়ারা, চমৎকার ভেনেসিয়ান স্টাইলে বাড়ি, রাস্তা-ঘাট ইত্যাদি। আমি গাইডকে জিজ্ঞাসা করলাম ভেনেসিয়ানরা আবার এলো কোথা থেকে? তার উত্তরে গাইড বললে সে কথা বলতে গেলে ক্রীটের ইতিহাস বলতে হয়। আর তাতে সারা দিন চলে যাবে। ইতিহাসের গন্ধ পেয়ে আমি গাইডের সাথে সবাইকে দুর্গের ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে বই খুলে বসলাম। এখানেই আমাদের দেরীর লাঞ্চ (লেট লাঞ্চ) খাওয়ার কথা। সুতরাং সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করবে তখন আমি দুর্গের ভিতরে ঢুকে দেখে আসবো।
ক্রীটের ইতিহাস পড়তে পড়তে আমার বার-বার ভারতবর্ষের ইতিহাসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মিনোয়ারা শান্তিপূর্ণ হলে কী হবে, তাদের আশেপাশের লোকেদের ইচ্ছা ছিল অন্যরকম। মিনোয়াদের শেষের দিকে (প্রায় ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে) গ্রীসের এক শক্তিশালী জাত মায়াসিন-রা মিনোয়াদের যা অবশিষ্ট ছিল তা শেষ করে ক্রীট দখল করে নেয়। তাদের দখলকৃত জায়গার মধ্যে অন্যতম ছিল আমাদের দেখা কোনোসোসের প্রাসাদ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল। মায়াসিনদের পরে ক্রীট দখল করে গ্রীসের আর এক শক্তিশালী জাত, ডোরিয়ান। এদিকে খ্রীষ্টপূর্ব ৩ শতাব্দী থেকেই রোম ইটালীর বাইরে তার প্রভাব বাড়াতে আরম্ভ করে। আর রোমানদের আগ্রাসনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় জুয়েল ওফ্ দ্য এজিয়ান সী - ক্রীট। অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাতের পর খ্রীষ্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান সৈন্যাধক্ষ্য ক্যুইনটাস সিসিলিয়াস মেটেলাসের হাতে ক্রীটের শেষ প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। রোমান (বা বাইজেন্টাইন) এম্পায়ারের শাসনে ক্রীটে শান্তি থাকে প্রায় আটশো বছর। উল্লেখযোগ্য যে বোধ হয় গ্রীক প্রভাবে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও ক্রীটের প্রধান ধর্ম ছিল খ্রীষ্টিয়ানিটি, রোমান পেগানিসম নয়।
৮২৪ সালে স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের কয়েক হাজার মুসলমান জলদস্যু ক্রীট আক্রমণ করে ও অনেক রক্তক্ষয়ের পর ক্রীট দখল করে নেয়। শীঘ্রই ক্রীটে 'পাইরেট এমিরেট' স্থাপিত হয় ও জলদস্যুদের নেতা আবু হাফ্স্ নিজেকে তার প্রথম আমির (এমির) হিসাবে ঘোষণা করে। এই মুসলমান শাসকরাই দ্বীপের উত্তরে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধার জন্য হিরাক্লিওন (হাণ্ডাক) শহরের পত্তন করে। রাতারাতি হাইন্যা ও ক্রীটের অন্যান্য শহরের খ্রীষ্টিয়ান চার্চ মসজিদে রূপান্তরিত হয়। এদিকে রোমানরাও ক্রীট হারিয়ে বসে নেই। প্রায় একশো বছর ধরে ক্রীটের ওপর ঢেউয়ের মত চলে তাদের একের পর এক আক্রমণ। শেষে ৯৬১ সালে এম্পেরর রোমানোস ২ এর আমলে ক্রীট আবার রোমান বা বাইজেন্টাইন শাসকদের হাতে চলে যায়। দ্বীপের সমস্ত মসজিদ ভেঙে, অধিকাংশ মুসলমানদের মেরেকেটে শেষ করা হয়। যারা বেঁচে থাকে তাদের হতে হয় ক্রীতদাস অথবা অল্প কিছু ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টিয়ান।
১২০৪ সালে ইস্টার্ন অর্থোডক্স চার্চ আর রোমান ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে প্রবল বিরোধে চতুর্থ ক্রুসেডের সৈন্যদের হাতে বাইজেন্টাইন এম্পায়ার-এর সমাপ্তি ঘটে, ও এই সাম্রাজ্য ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে যায়। যার ফলে ক্রীট চলে যায় রিপাব্লিক অফ্ ভেনিসের হাতে। হাণ্ডাক বা হিরাক্লিওন হয় দ্বীপের রাজধানী। হানিয়া, রেথীমনো ইত্যাদি শহরে গড়ে তোলা হয় সুদৃশ্য তোরণ, অস্ত্রাগার, দুর্গ ইত্যাদি। বিভিন্ন শহরকে সাজানো হয় সুসজ্জিত বাড়ি ঘর, রাস্তা-ঘাট, ফোয়ারা ইত্যাদি দিয়ে। মিনোয়াদের পর ভেনেসিয়ান শাসনের সময় ক্রীটে আবার শান্তি ফিরে আসে ও ইটালিয়ান রেনেসাঁর প্রভাবে ভেনেসিয়ান ক্রীটে শিক্ষা ও শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়। বিখ্যাত ক্রেটান শিল্পী এল-গ্রেকোর এই সময় ক্রীটে জন্ম ও এখান থেকেই তার খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে ভেনেসিয়ান রাজত্বে ক্রীটের উন্নতি ও সমৃদ্ধি নজর কাড়ে মহা শক্তিশালী অটোমান সাম্রাজ্যের। ১৬৪৫ সালে শুরু হয় অটোমান নৌবহরের আক্রমণ। খুব অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ক্রীটের অধিকাংশ অঞ্চল চলে যায় অটোমানদের হাতে। কিন্তু রাজধানী হিরাক্লিওনের পতন হতে লাগে আরো প্রায় কুড়ি বছর। তার কারণ পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশ খ্রীষ্টিয়ানিটির বিপদ দেখে সৈন্য, অস্ত্র-শস্ত্র, নৌ-বহর ইত্যাদি দিয়ে ভেনেসিয়ানদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু ১৬৬৯ সালে অটোমান সৈন্যদের হাতে হিরাক্লিওনের পতন হয় ও ক্রীটে আবার মুসলমান রাজত্ব আরম্ভ হয়। এই মোটামুটি শান্তিপূর্ণ রাজত্ব চলে বিংশ শতাব্দী অবধি। অটোমান এম্পায়ারের পতনের পর ১৯১৩ সালে এক আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে ক্রীটকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে যুক্ত করা হয় গ্রীসের সাথে।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ক্রীট আবার আন্তর্জাতিক পটভূমিকায় চলে আসে ১৯৪১ সালের মে মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। গ্রীস থেকে জার্মান সৈন্যদের হাতে বিতাড়িত হয়ে অস্ট্রেলিয়া ও অক্ষশক্তির প্রায় ৩০,০০০ সৈন্য অল্প কিছু অস্ত্র নিয়ে ক্রীটে আশ্রয় নেয়। কিন্তু শীঘ্রই জার্মান লুফত্ওয়াফ্ থেকে প্যারাট্রুপার বাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে। স্থানীয় গ্রীক পুলিশের সহযোগিতায় তারা কয়েকদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও শেষপর্যন্ত তারা জার্মান শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে রেথীমনো ও হিরাক্লিওনে।
|
আমার ক্রীটের ইতিহাসে ডুবে থাকতে থাকতে আমাদের দলের সবাই রেথীমনো দুর্গ দেখে ফিরে এসেছে। এবার লেট লাঞ্চ খাওয়া। তারপর যাত্রা দ্বীপের একেবারে দক্ষিণে হানিয়ায়। হানিয়ার ইতিহাস বহু পুরোনো। কোনোসোসের মত এখানেও মিনোয়া সভ্যতার নানান নিদর্শন পাওয়া যায়। এদিকে আবার কয়েক হাজার বছর ধরে বিভিন্ন শাসকের হাত বদলানোর সময় হানিয়ার ও রূপের পরিবর্তন হয়েছে। ভেনেসিয়ানদের থেকে অটোমানদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর তুর্কী শাসকরা অধিকাংশ স্থানীয় চার্চ মসজিদে রূপান্তরিত করে। আবার অটোমান শাসনের শেষে সেই সব মসজিদ আবার পুনর্মূষিক ভবঃ হয়ে ভোল পালটে চার্চ হয়ে যায়। তাই হানিয়ার বহু চার্চে মুসলমান স্থাপত্য ও শিল্পের ছাপ একেবারে পরিস্ফুট। এ ছাড়া হানিয়ায় দেখার জিনিস একটা চমৎকার লাইট হাউস। ক্রীট দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে নীল সমুদ্রের ওপরে একপায়ে দাঁড়িয়ে সে যেন ভাবছে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
|
ততক্ষণে সন্ধে ছ'টা বাজে। ওখানেই অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে বাসে উঠলাম। বাস চলতে আরম্ভ করতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখে নেমে এল ঘুম। হোটেলে পৌঁছতে রাত প্রায় দশটা। ইতিমধ্যে হার্সিনোসোসের দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। সঙ্গে যা ছিল খেয়ে নিয়ে বিছানায় চলে যাওয়া। পরদিন সকালে উঠে দেখি আকাশের মুখ একেবারে থমথমে। হাওয়ার জোর বেড়েছে। বৃষ্টিও নামবে মনে হচ্ছে। দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিয়ে আবার বাসে চড়া। এবার হিরাক্লিওনে। ওখানকার পোর্ট থেকে জাহাজ ধরে অ্যাথেনস, সেখানে দুদিন থেকে প্লেন ধরে বস্টন। কিন্তু জাহাজ ঘাটায় গিয়ে জানা গেল সমুদ্র খুবই অশান্ত। নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ ছাড়বে না। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখি আকাশ আর জলের রঙ ধূসর আর কালোয় মাখামাখি। কালো আকাশের গায়ে সীগালের দল ভেসে বেড়াচ্ছে কেমন যেন অসহায় ভাবে। এদিকে অশান্ত সমুদ্র যেন ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, আর মাঝে-মাঝেই শাসাচ্ছে সাদা দাঁতের সারি দেখিয়ে। সামনেই নোঙ্গর করা আমাদের অ্যাথেনস নিয়ে যাওয়ার সারথী। কিন্তু এখন তার অবস্থা বানের জলে ভাসা মোচার খোলার মত।
'তবে কখন জাহাজ ছাড়বে?' আমাদের উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
'কেউ বলতে পারে না। যখন সমুদ্র শান্ত হবে। কয়েকদিনও লাগতে পারে।'
'তাহলে আমরা কি করে অ্যামেরিকায় ফিরবো?' আমরা প্রায় অসহায়ভাবে ককিয়ে উঠেছি।
লোকটা একটু হেসে বলল — 'তাহলে সমুদ্রের দেবতা পসাইডনকে স্মরণ করুন।'
কিভাবে যে সেবার ক্রীট থেকে অ্যাথেনস-এ এসে, সেখান থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম সে কথা বলতে গেলে আর এক গল্প হয়ে যায়।