• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • ছবির দেশে কবিতার দেশে : সুবোধ কান্তি বড়ুয়া


    ফ্রান্সকে বলা হয় ছবির দেশ কবিতার দেশ। এদেশের অগণিত কবি সাহিত্যিকদের কবিতা, লেখনী আর শিল্পীদের আঁকা ছবি, গড়া ভাস্কর্য বিশ্বের সাহিত্য আর শিল্পকলা ভাণ্ডারকে এতটাই সমৃদ্ধ করেছে যে সারা বিশ্বের শিল্পরসিক এবং সাহিত্যমোদীরা এখনো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তাঁদের শুধু স্মরণই করেনা, সারা বছরব্যাপী ঘুরে বেড়ায় শিল্প আর সাহিত্যের তীর্থভূমি ফ্রান্স। কে যেন বলেছিলেন প্রত্যেক শিল্পীরই দু'টি মাতৃভূমি—একটি হলো যেখানে সে জন্ম নেয়, আর অন্যটি হলো ফ্রান্স।

    ষাটের দশকের শেষের দিকে কর্মজীবনের শুরুতে ইষ্টার্ন রিফাইনারীতে কর্মরত অবস্থায় কয়েকজন ফরাসী বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়। তখনই কাজের সুবিধার্থে কিছুটা বাধ্য হয়ে কিছুটা শখের বসে বেশ কিছু ফরাসী শব্দ এবং বাক্য রপ্ত করি, যার বেশ কয়েকটা এখনো স্মৃতি থেকে একেবারেই মুছে যায়নি। কোমল, মিষ্টি এবং শ্রুতিমধুর ভাষা হিসেবে ফরাসী ভাষার সুনাম পৃথিবী-জোড়া। বলা হয়ে থাকে ফরাসীরা অত্যন্ত ভাষা-অভিমানী; নেহাত বাধ্য নাহলে জানা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি মুখেই আনবে না, বাইরে সুসম্পর্ক দৃশ্যমান হলেও বহু শতাব্দী ধরে ফরাসী আর ইংরেজদের চলমান ঝগড়া এখনো তলায় তলায় রয়েই গেছে।

    বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের পর আরেক নন্দিত লেখক আমার অত্যন্ত প্রিয়—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সুনীলের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস "ছবির দেশে কবিতার দেশে" আমি বিশ বছর আগেই পড়েছি। পড়ার পর থেকেই ফরাসী দেশটির প্রতি আমার আকর্ষণ এবং দুর্বলতা আরো বৃদ্ধি পায়। বইটি পড়ার সময় লেখকের চোখ দিয়ে বারবার দেশটি কল্পনায় দেখে নেয়ার চেষ্টা করতাম এবং মুগ্ধ হতাম আর মনে মনে ভাবতাম জীবনে যদি একবার এই সুন্দর দেশটি ঘুরে দেখার সুযোগ পেতাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেদিন আমেরিকা থেকে ফ্রান্স ছুটে গিয়েছিলেন প্রিয় বান্ধবী মার্গারিটের আমন্ত্রণে; অন্য কথায় তীব্র আকর্ষণে, সুনীলবাবুর মত ফরাসী বান্ধবী সকলের কপালে জোটে না। মিথুন রাশির রোমান্টিক জাতক হওয়া সত্ত্বেও জীবনে কোনো বান্ধবী জুটলোইনা। যাহোক আমার প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন কি একবারও ভেবেছিলাম এ ধরনের একটা অযাচিত সুবর্ণ সুযোগ হঠাৎ আমার দরজায় এসেও কড়া নাড়তে পারে?

    বহুদিন থেকেই ক্যালিফোর্নিয়ায় আমার আসা-যাওয়া, বলা যায় এখানে আমার দ্বিতীয় বাড়ি। গত মার্চ মাসে আবারও আসা হলো, থাকি শহর থেকে দূরে কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি স্যান হোজের এক আবাসিক এলাকায়, জুনের মাঝামাঝি একদিন দুপুরে আমার ছোট ছেলে সৌমেন শিকাগো থেকে ফোন করলো, "আমরা আগামী গ্রীষ্মে ইউরোপ ভ্রমণে যাচ্ছি, আপনি আর মাও আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন, তৈরি থাকুন। আমি দু'এক দিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। সান ফ্রান্সিস্কোর জার্মান কন্স্যুলেট থেকে সেঙ্গেন (Schengen) ভিসা নিতে হবে।" Schengen Visa হলো এমন একটি সুন্দর ভিসা-ব্যবস্থা যা দিয়ে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের ২২ সদস্য রাষ্ট্র ছাড়াও আইসল্যাণ্ড, নরওয়ে এবং সুইজারল্যাণ্ড--এর যে কোনো এক দেশের ভিসা নিয়ে অনায়াসে এক দেশ থেকে অন্য দেশ ভ্রমণ করা যায়।

    ভ্রমণের প্রতি আমার আকর্ষণ চিরদিনের তবে সময় ও সুযোগের অভাবে তা হয়ে ওঠেনা। শুধু কি তাই? পকেটভর্তি অর্থের যোগানও তো চাই। আর তাই ভ্রমণের শখ মেটাই অন্য লেখকের ভ্রমণকাহিনী পড়ে। ইউরোপ ভ্রমণের একটা সুপ্ত বাসনা বহুদিন থেকে মনের মধ্যে লালন করে আসছি। খবরটা জানার পর থেকেই এক ধরনের মিষ্টি ভালোলাগা আমাকে সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। কথামত ঠিক ৩/৪ দিন পরই ডাকযোগে একগাদা কাগজপত্র-সহ একটা বড় খাম হাতে পেলাম। ভিসার দরখাস্ত, ইন্স্যুরেন্স, প্লেনের টিকেট, হোটেল বুকিং, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ইত্যাদি। ২ জুলাই বিকেল ৩টায় সান ফ্রান্সিস্কোর জার্মান কন্স্যুলেটে ইন্টারভিউর জন্য এপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় কন্স্যুলেটে হাজির হয়ে ভিসা ফি, ফটো-সহ কাগজপত্র সব জমা দেওয়া হলো। খুব বেশি কিছু জানতে চাওয়া হয়নি, পাসপোর্ট রেখে দেওয়াতে কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ভদ্রমহিলা জানালেন এক সপ্তাহ পরে FedEx-এ পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ইউরোপের ভিসা দেবে কিনা খুব শঙ্কিত ছিলাম। কেননা ঘরে বাইরে চলমান জঙ্গী তৎপরতার কারণে পশ্চিমবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ যথেষ্ট সংকটের সম্মুখীন, বাংলাদেশীদের খুব একটা ভালো চোখে দেখা হয়না। এক সপ্তারও কম সময়ে ভিসা সহ পাসপোর্ট হাতে পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

    ঠিক হলো আগস্টের ২৭ শিকাগো থেকে প্যারিস রওনা দেব। তাই এর আগের দিন স্যান হোজে থেকে আমরা শিকাগো গিয়ে পৌঁছলাম। সন্ধ্যা ৬ টায় প্যারিসগামী ফ্লাইট, হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে দুপুর আড়াইটার সময় বাসা থেকে রওনা হলাম। বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু লোকের শান্তিতৎপরতার কারণে পৃথিবীব্যাপী বিমানবন্দরগুলিতে নিরাপত্তার নামে যা করা হয় তা অত্যন্ত বিরক্তিকর ও ন্যক্কারজনক। জ্যাকেট-কোট, বেল্ট-জুতো, ওয়ালেট, কলম, ঘড়ি, মহিলাদের হাতের গলার স্বর্ণালঙ্কার, ল্যাপটপ সব খুলে স্ক্যানিং-এ দিতে হবে। হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, পরিধানের প্যান্ট-অন্তর্বাসও খুলে স্ক্যানিং-এ দিতে হতে পারে, শান্তিকামী ভাইদের ধন্যবাদ, সন্ত্রাসবাদের জয় হোক!

    প্রায় আট ঘন্টা বিমানভ্রমণের পর পরদিন ২৮ আগস্ট সকাল ৯টায় প্যারিসের চার্লস দ্যগল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছি। প্লেন থেকে নামার সময় এক অদ্ভুত আনন্দানুভূতিতে আপ্লুত হয়ে পড়ি, তাহলে সত্যি সত্যি কি আজ আমি আমার বহুদিনের স্বপ্নের শহর প্যারিসে এসে পড়েছি? উজ্জ্বল চাকচিক্যময় না হলেও বিমানবন্দরের স্থাপত্যশৈলী খুবই আকর্ষণীয়। এক ভিয়েতনামী টেক্সিড্রাইভার হোটেল পৌঁছে দিল তখন ঘড়িতে প্যারিস সময় বেলা সাড়ে এগারোটা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মাঝে মাঝে রোদের ছটা, আর ঝির ঝির বৃষ্টি দিয়েই শুরু আমার প্যারিস ভ্রমণ।


    আইফেল টাওয়ার

    আইফেল টাওয়ার

    পাঁচ-তারা হোটেল Pullman Paris Tour Eiffel, প্যারিসের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। আমাদের মত সাধারণ ট্যুরিস্টদের ফাইভ ষ্টার হোটেলে থাকার কথা নয়, প্রয়োজনতো নয়ই। সৌমেনের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা, এর নীচে নামতে তার রুচিতে বাধে। আমরা মোট ৫ জন--আমি, আমার স্ত্রী, ছোটছেলে সৌমেন, তার স্ত্রী ও তাদের একমাত্র সন্তান সাইরাস। দীর্ঘ আকাশযাত্রায় ক্লান্তি তো আসবেই। পাশাপাশি দুটি রুম পেলাম ৮ তলায়, ব্যালকনি থেকে প্যারিস শহর অনেকটা দেখা যায়, পুরো আইফেল টাওয়ারও পরিষ্কার দেখা যায়। আমার হোটেল থেকে হেঁটে গেলে পাঁচ মিনিটের বেশি কিছুতেই লাগবেনা।


    টিকিটের লাইন--আইফেল টাওয়ার

    ফরাসী ইঞ্জিনিয়ার গুস্তাভ আইফেল ১৮৮৯ এই টাওয়ারটির পরিকল্পনা ও ডিজাইন করেন, পরে তাঁর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় আইফেল টাওয়ার। প্রথম দিকে ফ্রান্সের প্রথম শ্রেণীর শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা ১০৬৩ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন এর লৌহ নির্মিত ঝাঁঝরি সদৃশ নির্মাণশৈলীর কারণে যথেষ্ট সমালোচনা ও নিন্দার সম্মুখীন হতে হলেও বর্তমানে এটা পৃথিবীর দর্শনীর বিনিময়ে সবচেয়ে বেশি পরিদর্শিত স্মৃতিস্তম্ভ। পৃথিবীব্যাপী এর নাম আইফেল টাওয়ার হলেও ফরাসীরা বলে Tour Eiffel। টাওয়ারকে ট্যুরিস্টদের জন্য ৩ স্তরে ভাগ করা আছে, প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে রেস্টুরেন্ট আর তৃতীয় স্তরে রয়েছে পর্যবেক্ষণাগার (Observatory Deck)।

    সন্ধ্যা ছটায় আইফেল টাওয়ারের প্রথম স্তরের 58 Tour Eiffel Restaurant এ ডিনার, সৌমেন এক মাস আগে থেকেই রিজার্ভেশন দিয়ে রেখেছে, এই সময়ে রিজার্ভেশন পাওয়াই ভাগ্যের ব্যাপার। ফুটপাতের রেষ্টুরেন্ট তো নয়, আইফেল টাওয়ারের রেষ্টুরেন্ট বলে কথা, কাজেই পোশাক-আশাকে কিছুটা আভিজাত্যে তো দরকার হবেই। আমরা সন্ধ্যা ছটার বেশ আগেই আইফেল টাওয়ার চত্বরে গিয়ে হাজির। এতদিন ছবিতে, টিভিতে যাকে বহুবার দেখেছি লোকমুখে শুনেছি এর যত কথা, আজ সশরীরে তার সামনে দাঁড়িয়ে — একটু অন্য রকমের অনুভূতি লাগতেই পারে। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারে এসেছি তাই এদিক-ওদিক থেকে নানাভাবে ছবি না নিলে কি হয়? বিরাট খোলামেলা চত্বর, হাজারো মানুষের ভিড়। আকাশতো সকাল থেকেই গোমড়ামুখো, এখন একটু একটু বৃষ্টিও হচ্ছে আমাদের দেশে আমরা যাকে বলি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। লোকজন অনেকে ছাতা মেলে ধরেছে। রেষ্টুরেন্টের রিজার্ভেশন ছিল বলে সাধারণ লাইনে দাঁড়াতে হয়নি, আলাদা করে টিকেটও কাটতে হয়নি, ডিনারের সাথে যোগ করা আছে, কাজেই সরাসরি লিফট নিয়ে একেবারে রেষ্টুরেন্টের দোরগোড়ায় উপস্থিত।


    আইফেল টাওয়ারের উপর থেকে প্যারিস

    আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে গিয়ে বসলাম। ওয়েটার এসে অভ্যর্থনা জানালো, রেড ওয়াইন ও স্যামপেইনের পুরো দুটো বোতল রেখে গেল টেবিলে। ডিনারের মূল্য আগে থেকেই পরিশোধ করা আছে, প্রত্যেকের জন্য এপিটাইজার বা স্টার্টার, মেইন ডিশ ও ডেজার্ট অর্ডার করা হলো। স্যামপেইন ও রেডওয়াইনের স্বাদ আমার জন্য খুব মুখরোচক না হলেও চেখে দেখতে অসুবিধা কোথায়? অনেকক্ষণ পর এলো স্টার্টার, তারপর একে একে এল মেইন ডিশ ও সবশেষে ডেজার্ট। এখানে বাঙালির ডাল-ভাত তো নয় যে হাত দিয়ে গাপুস-গুপুস করে দশ মিনিটের মধ্যে শেষ করা যাবে, কাঁটা চামচ আর ছুরি দিয়ে কেটেকুটে, টুং-টাং ছন্দোময় শব্দ তুলে খুব আস্তে আস্তে খেতে হবে। খুব একটা অভ্যস্ত না হলেও স্যামপেইন আর রেডওয়াইনও সঙ্গে চালাতে হলো। না হলে যে খারাপ দেখায়। কথায় আছে না—যস্মিন দেশে যদাচার বা be Roman while in Rome। গল্প আর খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আমরা চারজনে মিলে কখন যে স্যামপেইন আর রেডওয়াইনের পুরো দুটো বোতল খালি করে ফেলেছি টেরই পায়নি। রেষ্টুরেন্টের প্রফেশনাল ক্যামেরাম্যান এসে প্রত্যেকটা টেবিল ঘুরে ঘুরে ফটো তুলে নিল, কিছুক্ষণ পরে প্রিন্টও নিয়ে এলো, সুদৃশ্য স্যুভেনির হিসেবে অত্যন্ত চমৎকার, দেখলাম লোকজন বেশ চড়া দাম দিয়ে কিনেও নিচ্ছে। অবশেষে প্রায় দুই ঘন্টা সময় নিয়ে ডিনার শেষ হলো, তখন মাত্র রাত আটটা। এরপর ফার্ষ্ট লেভেল থেকে লিফট নিয়ে সরাসরি উঠে গেলাম পর্যবেক্ষণ ডেকে (Observatory Deck), সেখান থেকে রাতের প্যারিস শহর অবলোকন করার অনুভূতিই যেন অন্যরকম, এর মোহনীয় রূপে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না, রীতিমত রোমাঞ্চকর। আলোকে আলোকময়, দৃষ্টিনন্দন চমৎকার সে দৃশ্য। প্যারিস শহরের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বহে গেছে সেইন নদী (River Seine), নদীর জলে জ্যোৎস্নার আলো প্রতিফলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানেও দর্শনার্থীদের প্রচণ্ড ভিড়। একদল নামছে তো আরেক দল উঠে আসছে। সবাই প্যারিসের মোহনীয়রূপ ক্যামেরাবন্দি করায় তৎপর। আমরাও চারিদিকে অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম আলোয় ঝলমল রাতের প্যারিস, হলাম অভিভূত, তারপর একসময় নেমে এলাম। ফিরে এলাম হোটেল, হোটেল ব্যালকনি থেকে আলোক সজ্জিত রাতের আইফেল টাওয়ারকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। এক ঘন্টা পর পর শুরু হয় আলোক সজ্জার নতুন আরেক রূপ; চলে প্রায় পাঁচ সাত মিনিট। যে কয়দিন ছিলাম প্রতিদিন রাতের বেলা ব্যালকনিতে বসে আলোকমালায় সজ্জিত আইফেল টাওয়ারের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকি।


    সেইন নদীতে নৌকা

    শার্লেমেন, নোত্‌র-দামের প্রাঙ্গণে

    আজ ২৯ আগষ্ট ২০১৪, আমরা একটু সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। পর্যটকদের ভ্রমণের সুবিধার্থে বিভিন্ন কোম্পানির hop on hop off বাসের ব্যবস্থা আছে। খোলা ছাদের উপরে বসে নগর ভ্রমণের চমৎকার সে আয়োজন, পৃথিবীর সব বড় বড় শহরে এরকম ব্যবস্থা আছে। বাসগুলি তাদের নির্ধারিত রুটে ঘুরে চলে। টিকিট কিনে সুবিধামত যখন তখন যেখান থেকে খুশি ওঠা যায় আবার নামাও যায়। সৌমেন আমাদের জন্য দুই দিনের টিকেট কিনে নিল, হালকা সবুজাভ রঙের বাসে উঠে ছাদে গিয়ে বসলাম ডানে বাঁয়ে, সামনে পিছনে, প্যারিস আমার চোখের সামনে। সুন্দর নয়নাভিরাম শহর হিসেবে প্যারিসের সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া আর আজ তা তো নিজের চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে। বাস এগিয়ে চলেছে, চোখতো মাত্র দুটোই, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি, আমার মত অন্যান্য বিদেশীরাও উচ্ছ্বসিত। সামনেই সেইন নদী, একেবারে প্যারিসের মাঝখান দিয়েই প্রবাহিত, নদীর দুপাড়ই আগাগোড়া সুন্দরভাবে বাঁধানো, কিছুদূর পর পর অনেকগুলি সেতুবন্ধন এ পাড়ের সাথে ও পাড়ের যোগাযোগ করেছে সুদৃঢ় এবং চলাচল করেছে নির্বিঘ্ন। বিখ্যাত এই নদীকে সুন্দরভাবে কাজে লাগানোর ফলে প্যারিসের সৌন্দর্য অনেক বেশি বিকশিত, প্রশংসিত। রাস্তার দুপাশেই সারিবদ্ধ উনিশ শতকের ভিক্টোরিয় যুগের স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত পুরনো বিল্ডিং, পুরনো বটে তবে দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয়। ছয় সাত তলার চেয়ে উঁচু বিল্ডিং আমার চোখের দৃষ্টিসীমায় আসেনি। রাজপথ খুব প্রশস্ত নাহলেও ছিমছাম সুন্দর, আঁকাবাঁকা বা এলোমেলো নয়। দু'পাশেই রয়েছে গাছপালায় আচ্ছাদিত অনেক সবুজ উদ্যান দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, মন নেচে উঠে আনন্দে। নগর পরিকল্পনায় রয়েছে রুচিবোধ ও পরিমিতিবোধ, সব কিছুতেই রয়েছে সুন্দর গুছানো, শৈল্পিক পরিচ্ছন্নরূপ, যার জন্যে নগর পরিকল্পনাবিদদের অকুণ্ঠ প্রশংসা করতেই হয়। রাস্তার মোড় ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপিত মার্বেল পাথরের নান্দনিক ভাস্কর্যগুলো প্যারিসের শোভা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। যেন মিষ্টি, স্নিগ্ধ এক কমনীয় রূপ সারা রাজধানী জুড়ে।


    নোত্‌র-দাম গির্জা

    বাস চলেছে, নির্দিষ্ট স্টপেজে থামে, যাত্রীরা নামে উঠে, এভাবে ঘুরে ঘুরে আমরা নোত্‌র দাম ক্যাথিড্রাল (Notre Dame Cathedral) এ এসে নেমে পড়লাম। বিখ্যাত এই ক্যাথিড্রাল প্যারিসের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং সুন্দর স্মৃতিসৌধ। ফরাসী স্থাপত্যশিল্প ও ভাস্কর্যের এক উজ্জ্বল এবং গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। এর দর্শকপ্রিয়তা আইফেল টাওয়ারকেও ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিবছর প্রায় ১৩ লক্ষ লোক এখানে আসে। ১১৬৩ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১২৩০ সালে প্রায় শেষ হয়, এরপরও বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু নতুন অংশ সংযোজিত হয়ে বর্তমানের দৃষ্টিনন্দন অবস্থায় রূপ নিয়েছে। হাজার ভক্তদের ভিড়, লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। ক্যাথিড্রাল-এর অভ্যন্তরে বিরাজ করছে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ ও পিনপতন নীরবতা। বৈদ্যুতিক কোনো আলো নেই, সাধারণ মোমবাতির আলোয় যতটুকু দেখা যায়। এখানে মোল্লা-খাদেম, পুরোহিত-পূজারী বা পাণ্ডাদের কোন উৎপাত নেই, নেই কোনো হট্টগোল, যেমনটা আমরা সচরাচর দেখতে পাই অন্য ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থানে। দক্ষিণা বা ছদকার নামে ভক্তদের নিয়ে মোল্লা বা পুরোহিতের টানাটানি এখানে নেই, নেই দানবাক্সে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি বা পূজার কোন উপাচার। মাইকে কান ঝালাপালা করা ভক্তিমূলক সঙ্গীত কিংবা তথাকথিত বিরক্তিকর ধর্মদেশনার ব্যবস্থাও নেই এখানে। সামনে মঞ্চে ঝুলানো আছে অতি পরিচিত ক্রুশবিদ্ধ যীশুখ্রীষ্টের মূর্তি, ভক্তরা কাঠের তৈরি অতি সাধারণ বেঞ্চে বসে নীরবে একাগ্রচিত্তে কেবল ঈশ্বরের নিকট আত্মসমর্পণ ও কৃত অপকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনায় নিমগ্ন। আদর্শ তীর্থস্থানের পরিবেশ এরকমই তো হওয়া উচিত, নয় কি?


    হপ-অন্‌ হপ-অফ্‌ বাস

    এখান থেকে বের হয়ে আমাদের নির্দিষ্ট hop on hop off বাস ধরে আবারো চলতে লাগলাম। ফ্রান্সে প্রায় সারা বছরই বৃষ্টি থাকে, তারপরও মাঝে মাঝে এক আধটু বৃষ্টি হলেও আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাস হলো পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে উত্তম সময়। আকাশ পরিষ্কার ঝকঝকে রোদ আর এই রকম আবহাওয়ার জন্যই এই সময় সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা এসে প্যারিসে সাঙ্ঘাতিক ভিড় জমায়। দিনের বেলায় বাসের ছাদে বাসে সুন্দর প্যারিস শহর ঘুরে বেড়াচ্ছি কিছুটা রোমাঞ্চিত তো হবই। না আজ বৃষ্টি নেই, মেঘমুক্ত সুন্দর নীল আকাশ, ঠিক যেন ভালো মানুষের মন। ঘুরতে ঘুরতে আমরা এসে পড়লাম Champs Elysees Avenueতে, বলা যায় প্যারিসের সবচেয়ে সুন্দরতম এভিনিউ এইটি। এর পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ফ্রান্সের অন্যতম ল্যাণ্ডমার্ক Arc De Triomphe আর এর পূর্বপ্রান্তে আছে বিশ্বনন্দিত Louvre Museum। বিশ্ববিখ্যাত নামী-দামী কোম্পানীগুলির শোরুম এভিনিউর গুরুত্ব এবং সার্বিক শ্রীবৃদ্ধিতে নিঃসন্দেহে সহায়তা করেছে। দুদিকেই রয়েছে প্রায় রাস্তার সমান প্রশস্ত ফুটপাত, ফুটপাতেই লাগানো হয়েছে দু'সারি করে গাছ আর এর মাঝখানেই আসন পেতে বসে গেছে সুন্দর ভাবে সাজানো চারিদিক খোলা অস্থায়ী রেস্তোরাঁ ও পানশালা। ধূলা-বালি নেই, নেই কোন প্রকারের দূষণ, তাই সবধরনের লোকজন আরাম আয়েশে বসে খাচ্ছে, গল্প-গুজবে মেতে আছে।


    "হাজার হাজার লোক ফুটপাত দিয়ে চলাফেরা করছে"

    হাজার হাজার লোক ফুটপাত দিয়ে চলাফেরা করছে। হঠাৎ কেন জানিনা আমার বুকে জেগে উঠলো এক দীর্ঘশ্বাস "ফুটপাত তো আমাদের দেশেও আছে, আমরা কি কোনদিন এভাবে হাঁটতে পারব?" এ ধরনের দুঃখ জাগানিয়া কিছু ভাবনা বিলাস। হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখের সামনেই প্যারিসের আরেক বিখ্যাত স্মৃতিসৌধ Arc De Triomphe; বাংলায় বিজয়স্তম্ভ বলা যায়। ১৮০৬ সালে নির্মিত, উচ্চতায় ৫০ মিটার, প্রস্থে ৪৫ মিটার, মার্বেল পাথরে তৈরি এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ। ফরাসী বিপ্লবের সময় যে সমস্ত বীরযোদ্ধা ফ্রান্সের জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাঁদের সম্মানে তৈরি এই বিজয়স্তম্ভ। এর ভিতরে-বাইরের দিকে তাদের নাম উৎকীর্ণ আছে। পরে ধনুকাকৃতি এই খিলানের নীচে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) নিহত নাম না জানা সৈনিকদের সমাধি স্থাপিত হয়। ১২টা ব্যস্ত রাস্তার সংযোগস্থলে অবস্থিত বলে রাস্তা পার হয়ে এই বিজয়স্তম্ভে পৌঁছানো এক কথায় প্রায় অসম্ভব, চারিদিক থেকে অনবরত গাড়ি আসছেই। তাহলে উপায়? অবশেষে খুঁজে পেলাম underpass আর তার ভিতর দিয়ে আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। দেশের বীর যোদ্ধাদের সম্মানে প্রজ্জ্বলিত আছে গ্যাসের অনির্বাণ শিখা, রাখা আছে তাজা পুষ্পস্তবক, বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো। ফুটপাতের এক রেষ্টুরেন্টে বসেই লাঞ্চ সেরে হোটেল ফিরে এলাম।


    আইফেল কাফে

    দুপুরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার বেরিয়ে পড়লাম, ঘুরে বেড়ালাম আইফেল টাওয়ার চত্বর আর সেইন নদীর পাড়ে পাড়ে বেশ কিছুদূর। নৌকা নিয়ে দলে দলে পর্যটকরা ঘুরে বেড়াচ্ছে নদীতে আর উপভোগ করছে দুপারের অপূর্ব শোভা। নদীর ধারে একটি রেষ্টুরেন্টে বসে আমরাও খেয়ে নিলাম, এখানেও খাবারের সঙ্গে রেডওয়াইন এলো। প্রবাদ আছে ফ্রান্সে চাষা-মজুররাও দুপুর ও রাতে খাবারের সঙ্গে রেডওয়াইন নেবেই। রাতে নদীর ধারে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি হঠাৎ দেখা হলো স্বামী-সন্তান সহ স্নেহভাজন ডালিয়ার সাথে, তারাও প্যারিস ভ্রমণে এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। পরে সবাই মিলে Cruise নেওয়া হল। জাহাজের ছাদে বসে রাতের প্যারিস দেখতে দেখতে এক ঘন্টা ঘুরে বেড়ালাম সেইন নদীতে, সে এক অপূর্ব অনন্য অভিজ্ঞতা। রাত বারোটা, তখনো নদীর দুধারে লোকজনের আড্ডা, চলছে নাচ-গান, আনন্দ-উল্লাস। প্যারিসকে এমনিতেই বলা হয় রাত জাগা শহর।


    ল্যুভ্‌র-প্রাঙ্গণ*

    ৩০ আগস্ট ২০১৪, আজ ল্যুভ্‌র মিউজিয়াম দেখতে যাব। বিশ্ববিখ্যাত এই মিউজিয়ামের কথা অনেক শুনেছি, শুভার্থীরা আগেভাগেই বলে দিয়েছে এই মিউজিয়াম যেন কিছুতেই মিস্‌ না করি। ৯টার মধ্যেই হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কোম্পানীর বাস ধরে ঘুরে ঘুরে অবশেষে পৌঁছে গেলাম মিউজিয়াম প্রাঙ্গনে। আবহাওয়া অনুকূল বলে সারা প্যারিস জুড়ে এখন পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড়, এখানেও তাই। ফরাসী বিপ্লবের সময় (১৭৮৯-১৭৯৯) জাতীয় সংসদই তখনকার রাজপ্রাসাদ ল্যুভ্‌রকে যাদুঘরে পরিণত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৬০,৬০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে আজকের একবিংশ শতাব্দীর ৩৫,০০০ প্রদর্শনীয় বস্তুর বিশাল সংগ্রহ নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী পরিদর্শিত যাদুঘর এই ল্যুভ্‌র। প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন লোক এই যাদুঘর পরিদর্শনে আসে। জনপ্রতি ১২ ইউরো করে টিকেট কাটা হলো। মিউজিয়ামের বিশেষ আকর্ষণই যেন মোনালিসা। ইটালিয়ান শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চির ১৫০৩ থেকে ১৫০৬ সালের মধ্যে আঁকা এই ছবিটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিচিত, সবচেয়ে বেশি দেখা শিল্পকর্ম এবং যাকে নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর। ছবিটি বেশ কয়েকবার চুরি হয় এবং রঙ ছিটিয়ে ও অন্যভাবে নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়। তবে এখন glass casket ও barricade বসানোর ফলে অনেকটা সুরক্ষিত। ল্যুভ্‌র মিউজিয়ামে এসে মোনালিসার সাথে ছবি তোলা হলো না, এই অতৃপ্তি নিয়ে কেউ ঘরে ফিরতে নারাজ,


    "...সামনে অস্বাভাবিক ভিড়"

    তাই এর সামনে অস্বাভাবিক ভিড়, সবার একান্ত ইচ্ছা মোনালিসাকে নিয়ে ছবি তোলা। সবার মত আমরাও ছবি নিলাম অনেক কষ্টে। একটি সাধারণ ছবি এর মধ্যে কী বিশেষত্ব লুকিয়ে আছে তা আমার মত সাধারণ দর্শকের পক্ষে বোঝা কঠিন। গ্রীস ভাস্কর্য, পুরাকীর্তি, শিল্পকলা এবং মিশরীয় পুরাকীর্তি ও ঐতিহ্য নিয়ে রয়েছে পৃথক গ্যালারি। বিখ্যাত ফরাসী শিল্পীদের গড়া নন্দিত সব ভাস্কর্য ও আঁকা পেইন্টিংস নিয়ে রয়েছে আলাদা গ্যালারি। এসব দেখে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা, প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সত্যি বলতে কি ল্যুভ্‌র মিউজিয়াম-এর বিশালত্ব এবং বৈচিত্রময় বিশাল সংগ্রহের কারণেই এর পৃথিবীজোড়া সুনাম সুখ্যাতি। মিউজিয়াম আমাদেরকে অতীতের সাথে যোগাযোগ করে দেয়, কোথাও কোথাও আমি দাঁড়িয়ে অতীতের সাথে কথা বলতে চাইলেও আমার সঙ্গী-সাথীদের তাড়ায় তা পারিনি। তাছাড়া এত বড় মিউজিয়ামের পঁয়ত্রিশ হাজার আইটেম মাত্র তিন চার ঘন্টা কেন তিন চার দিনেও শেষ করা প্রায় অসম্ভব। তবুও তাড়াহুড়োর মধ্যেও বেশ কিছু ভাস্কর্য, পেইন্টিংস, মিশরীয় মমি এবং আরো কিছু আইটেম মনের তাগিদে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দেখে নিয়েছি।


    গ্রীক ভাস্কর্য*

    ভিনাস ডি মিলো*

    ল্যুভ্‌র মিউজিয়ামে সংগৃহীত শিল্পীদের গড়া নগ্ন মার্বেল মূর্তি বা ভাস্কর্য এবং পেইন্টিংস এর বিরাট একটা অংশ নগ্নতা বা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট হতে পারতো, তা তো হয়নি, বরঞ্চ উৎকৃষ্ট শিল্পকলা হিসেবে বিশ্বব্যাপী হয়েছে সমাদৃত, নন্দিত এবং পেয়েছে বিদগ্ধজনের অকুণ্ঠ প্রশংসা। প্রতিদিন হাজার হাজার পুরুষ-মহিলা, যুবক-যুবতী আসছে, দেখছে, কারো মনে কোন বিকার নেই, নেই কোন উদ্বেগ, এ ব্যাপারে নেই কোন প্রশ্নের অবতারণা বরঞ্চ মগ্ন হয়ে উপভোগ করছে চোখজুড়ানো অনুপম সৌন্দর্য, আর ছবি তুলে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে তার স্মৃতি। ভারতের বিখ্যাত মন্দিরগুলোর দিকে তাকালেও একই দৃশ্য চোখে পড়ে। নগ্নতার মধ্যে যে স্বাভাবিক সৌন্দর্য বিদ্যমান থাকে তা আমরা সাধারণ মানুষের সাধারণ চোখে ধরা না পড়লেও


    "...শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য"

    শিল্পী তার কল্পনা আর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ঠিকই দেখেন এবং দেখেন বলেই নারী ও পুরুষ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য পরম নিষ্ঠায় রঙ-তুলি কিংবা হাতুড়ি-বাটালির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন অপরূপ শিল্পসুষমা। ভারতের মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত অজন্তা, ইলোরা গুহা, উড়িষ্যার কোনারকের সূর্যমন্দির এবং মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহো মন্দিরের দেওয়ালে হাজার বছরের পুরনো রঙিন চিত্র এবং কঠিন পাথরের বুক চিরে তুলে আনা প্রেমনিবেদনমূলক নারী-পুরুষের মিলিত বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মিথুন চিত্রগুলি আজ বিশ্বনন্দিত শিল্পকর্ম। শুধু তাই নয় UNESCO কর্তৃক World Heritage হিসেবেও স্বীকৃতি প্রাপ্ত। আমরা জানি প্রজননের মধ্য দিয়েই জীবজগতের উৎপত্তি, যার মূলই হলো নারী-পুরুষের যৌন সঙ্গম। তাই একজন শিল্পী বা শিল্পপ্রেমিক দর্শকের কাছে এগুলি মোটেই অশ্লীলতা নয় বরঞ্চ অনাবৃত অসংস্কৃত সৌন্দর্য। তাই প্রতি বছর ভারতের এই অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন শিল্পকলার আকর্ষণে সারা পৃথিবী থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার শিল্পরসিক পর্যটক।


    প্যারিস--সিটি অব লভ

    প্যারিসে এসে এই শহরের প্রেমে পড়েনি এরকম লোক বিরল। তাই একে অনেকে বলেন City of love। পৃথিবীর বুকে প্যারিস আজও সবচাইতে রোমান্টিক শহর হিসেবেই পরিচিত। যে যাই বলুক না কেন এর কোনটাই মিথ্যা বা অতিরঞ্জিত মোটেই নয়। প্যারিসকে সবাই ভালোবাসে তাই এখানে কেউ কখনো বোমা ফেলেনি। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও প্যারিস ছিল অক্ষত, কেননা শত্রুরাও এই শহরটিকে ভালোবাসে হয়তো বা তাই। এই শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর মিউজিয়াম রয়েছে কিন্তু একমাত্র ল্যুভ্‌র ছাড়া আর একটিও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ক্যাফেগুলোও দারুণ প্রাণবন্ত তার উপর এর বাড়তি আকর্ষণ রেডওয়াইনতো আছেই।


    ল্যুভ্‌রের মধ্যে শিল্পী

    আমার এই লেখাটির শিরোনাম "ছবির দেশে কবিতার দেশে"--এর চেয়ে উত্তম, অর্থপূর্ণ, ব্যঞ্জনাময় ও সুন্দর কাব্যিক নাম হতে পারে না বলে আমার ধারণা তাই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নামটি ধার নিয়েছি বলে লেখকের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম, সেই সঙ্গে পাঠকদের কাছেও মার্জনা প্রার্থনা করতেই পারি।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক(*) ও সমীর ভট্টাচার্য
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments