বই ব্যবসা ও পাঁচ পুরুষের বাঙালী পরিবার; রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়; দেব সাহিত্য কুটীর প্রা লি, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০২; ISBN: নেই
‘পেঙ্গুইনে’র প্রবাদপ্রতিম প্রতিষ্ঠাতা এলেন লেন-এর জীবনী লিখেছিলেন তাঁর বেয়াই শ্রীমান জ্যাক মরপার্গো। তাঁর একটা সুবিধে ছিল, লেন-সাহেব নিজ-প্রকাশনালয়ের বই বড় একটা পড়তেন-টড়তেন না। আর, প্রায় তিন শতাব্দী প্রাচীন প্রকাশনালয় ‘লংম্যান’-এর ব্রিগস-লিখিত ইতিহাস নিজেই তো এক ইতিহাস। কিন্তু, যে-দেশে ও যে-ভাষায় শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কোনো ইতিহাস লেখা হয়নি, লেখা হয়নি মহামতি ডেভিড হেয়ারের জীবনী বা কলকাতা ফুটবলের কোনো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস, সে-ভাষায় ‘দেব সাহিত্য কুটীর’-এর এক দু’শো পৃষ্ঠার ইতিহাস লেখা হচ্ছে---সেটা একটা খবর বটে। হোক্ না সে কমিশন্ড্ ইতিহাস, সে-তো ‘প্রিন্স’ও মেডিচিদের স্তুতিতে লেখা হয়েছিল। বেশ! তথ্য হাতে নেই, তবু অনুমান, বিক্রির হিসেবে বাঙলা বই বিশ্বব্যাপী বই-বাজারের (কাগুজে ও ই-বই মিলে) এক শতাংশও বোধহয় হবে না---সেখানে কলকাতার এক পরিবার বিগত প্রায় দেড়শ’ বচ্ছর ধরে শুধুমাত্র বাঙলা বইয়ের প্রকাশনাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, শুধু বেঁচে নেই, রমরম করে বাড়ছে---এটা কি কম কথা? মান নিয়ে তর্ক এখন থাক্। আজকের ভারতে হিন্দি বা তেলুগু ভাষার প্রকাশনার ভল্যুম বাংলার চেয়ে বেশি হতে পারে, কিন্তু তাদেরও দেড়শ’ বছরের পুরনো কোনো প্রকাশনালয় নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে, এ’হেন এক প্রকাশনালয়ের ইতিহাস লিখে বর্তমান লেখক বাংলাভাষায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন করেছেন, মানতে হবে।
সিপাহি বিদ্রোহের ধাক্কায় উত্তরভারত তখন টালমাটাল। সেই ধাক্কা বাংলাদেশে তেমনভাবে অনুভূত না হলেও, ব্যারাকপুর তো এখানেই। সেই সময় নাগাদই হাওড়ার এক অখ্যাত গ্রাম থেকে যুবক বরদাপ্রসন্ন ভাগ্য বিপর্যয়ে ঠেলে এসে উঠলেন কলকেতা শহরে, ঝুড়িমাথায় পাঠ্যপুস্তক ফিরি করতে। শ্রীরামপুর প্রেস বা স্কুল বুক সোসাইটির দৌলতে কলকাতা তখনই ছাপা বইয়ের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। সূচনা হয়ে গেল এক যুগের, যার ধারা চতুর্থ পেরিয়ে পঞ্চমপুরুষে এসে ঠেকেছে এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। ‘দেব সাহিত্য কুটীর’! এ’ তারই ইতিহাস।
এই ‘দেব’ কে? এ কী দেবাদিদেব? না, এনারা তো হলেন দক্ষিণ রাঢ়ী কায়স্থ। আদিপুরুষের যে নাম পাওয়া যায়, নবাব আলিবর্দির সমসাময়িক, তিনি শোভারাম দে, পাণ্ডুয়ার (জিলাঃ হুগলি) নবাবি সেরেস্তায় মুন্সি ছিলেন, মানে হিসাবরক্ষক। মুন্সিয়ানার সঙ্গে সে কাজ করে ‘মজুমদার’ হলেন, যে উপাধি আজও তাঁর বংশধরগণ বয়ে চলেছেন। শোভারামের প্রপৌত্র আশুতোষই (১৮৬৬-১৯৪৩) নিজ পদবী ‘দে মজুমদার’ থেকে ‘দেব মজুমদার’ করলেন, আর তাঁর সময় থেকেই হাউজের রমরমার শুরু—এ টি দেবের অভিধান ও মানেবই বেচে। শ্রীমধুসূদন মজুমদার ছিলেন এ টি দেবেরই পৌত্র।
উনিশশ’ ষাট-সত্তরের দশকে আমাদের ছেলেবেলা কেটেছিল যে স্বপ্নরাজ্যে তার চার উন্মুক্ত দ্বার ছিল ‘শুকতারা’, ‘সন্দেশ’, ‘আনন্দমেলা’ আর ‘কিশোর ভারতী’। ভোরের কাগজের সঙ্গে থপাস্ করে ‘শুকতারা’খানি এসে পড়লে ভাইবোনেরা মিলে দৌড়ে গিয়ে কাড়াকাড়ি করে আগে ‘বাঁটুল’ বা ‘হাঁদা-ভোঁদা’ না পড়ে নেওয়া পর্যন্ত শান্তি নেই। কে তার লেখক, কে তার প্রকাশক ছোট্ট খোকাখুকু তার কী জানত? বাট্, বাঁটুল ইজ বাঁটুল---তার তুলনা কৈ? এই আনন্দের পশারি ছিল যে প্রকাশনালয়, আজ তার ইতিহাস পড়ে জানতে পারি, দেশবিভাগ-পরবর্তী কোন্ সমস্যার মোকাবিলায় তাঁদের এই উদ্যোগ (‘শুকতারা’)! ফের, ষাটের দশকের গোড়ায় এ টি দেবের নোটবইয়ের রমরমা ব্যবসা মার খেয়ে যেতে ওঁরা যে পত্রিকা (‘নবকল্লোল’) বের করলেন, সেও এক ইতিহাস! তারাশঙ্কর, বনফুল, শৈলজানন্দ থেকে প্রফুল্ল রায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় হেন সাহিত্যিকের প্রতিনিধিস্থানীয় বহু বহু গল্প-উপন্যাস নবকল্লোলেই প্রকাশিত হয়েছে।
শুকতারা-নবকল্লোলের মত দুই নামি পত্রিকা যাঁর প্রশস্ত স্কন্ধে ন্যস্ত ছিল তিনদশকব্যাপী, মজুমদার-বংশীয় সেই মধুসূদনবাবু ছিলেন দৃষ্টিহীন। যদিও দৃষ্টিহীনতা তাঁর এক মস্ত শিল্পী-সাহিত্যিক পরিমণ্ডল গড়ে তোলার পথে অন্তরায় হয়নি। উদয়শঙ্কর থেকে পি সি সরকার, সৈয়দ মুজতবা আলি থেকে আশাপূর্ণা দেবী---ছিলেন মধুসূদনবাবুর সেই পরিমণ্ডলের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দৃষ্টিহীন মধুবাবু কলকাতার সিনেমা-নাটক মহলের এক নিয়মিত দর্শক ও গুণগ্রাহী ছিলেন, চমৎকার সমালোচনা লিখতেন নবকল্লোলের পাতায়, ‘শ্রীদর্শক’ ছদ্মনামে। উত্তমকুমারকে প্রথম আত্মজীবনী লিখতে তিনিই উদ্বুদ্ধ করেন, নবকল্লোলের পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর’। ছোটদের জন্য নিয়মিত লিখতেন ‘অমর বীর কাহিনী’।
কেবলমাত্র শিশুদের জন্য নিবেদিত গোটা একটা মোটাসোটা পুজোবার্ষিকী এঁনারাই প্রথম প্রকাশ করেন, সম্ভবতঃ পঞ্চাশের দশকের গোড়া থেকে। কিংবদন্তির ঘনাদার আত্মপ্রকাশ এখানেই। প্রেমেনবাবু সেকালে সম্বৎসর একখানিই মাত্র ঘনাদা-কাহিনি লিখতেন এই পত্রিকায়। আর, কী তার মান! শিশুসাহিত্যের কার্নেগি পুরস্কার বাংলাভাষাতেও দেবার চল থাকলে ‘মশা’, ‘টল’ বা ‘ঢিল’-কে দু’টো দু’টো এওয়ার্ড দিতে হত! ‘অপরূপা’, ‘পূরবী’ বা ‘বলাকা’-র মত পুজোবার্ষিকী আজও হাতে নিলে চোখে জল এসে যায়, বয়স যায় কমে এক লাফে চার দশক! এ’ সবই সম্ভব হয়েছিল এই হাউসের কল্যাণেই।
বিদেশী সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ সিরিজ এনাদের আরেক উল্লেখযোগ্য অবদান, মূলতঃ শিশুদের কথা মাথায় রেখেই। আবার লিখি, মানের কথা উহ্য রেখেও, কেবল প্রচার ও পরিচিতির দিকটা দেখলেও এই সিরিজকে কক্ষনো উপক্ষা করা যাবে না। ‘আইভ্যান হো’, ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’, ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ বা ‘ট্রেজার আইল্যান্ড’-এর নামই বা বাঙলা মিডিয়মে পড়া বালকটি শুনতো কোত্থেকে সুধীন্দ্রনাথ রাহা না থাকলে?
আর শেষে এঁদের প্রকাশনার আরেকটি অসাধারণ দিকের কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না, সেটা হল ইলাস্ট্রেশন! প্রতুল বন্দ্যোপাধায়, বলাই রায় বা শৈল চক্রবর্তীর ছবির মান যে কোন্ উচ্চস্তরে বাঁধা ছিল---তার সঠিক মূল্যায়ন এখনও হয়নি। এ’তো আর আজকের গ্রাফিক-নভেল নয়, যে বহু বহু ছবি আঁকার স্কোপ থাকবে। একটি কিংবা দু’টি ছবির মাধ্যমে (বেশিরভাগই সাদাকালো) গল্পটির চরিত্রগুলির সঙ্গে বা ঘটনাবলীর সঙ্গে শিশুমনের আলাপ করিয়ে দেওয়া----বাকিটা সে নিজেই ভেবে নেবে। এই তো এক ইলাস্ট্রেটরের কাজ---তিনি তো কোনো চলচ্চিত্রের পরিচালক নন। অভিনেতা চিরঞ্জীতকে প্রথম পরিচয়ে সত্যজিৎ রায় আলিঙ্গন করেছিলেন শৈল চক্রবর্তীর পুত্র জেনেঃ “তোমার বাবা ছিলেন তাঁর কালে ভারতের শ্রেষ্ঠ ইলাস্ট্রেটর!” এ’সব সম্ভব হয়েছিল দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশনালয়ের সৌজন্যে ।
এটি, বস্তুতঃ, কোনো জুতসই ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’ লেখা হচ্ছে না, কারণ নৈর্ব্যক্তিকতা ভুলে বড় আবেগতাড়িত হয়ে পড়া গেছে---বাস্তব ও ব্যক্তিগত কারণে। এ’ইতিহাস-বইটিকে লেখার মানে দশে পাঁচের বেশি দেওয়া গেল না---কোনো ইতিহাসবিদের লেখা নয় এ’, সাহিত্যমানেও মামুলি। তথ্যের ভুল, প্রয়োগের ভুল, বানান ভুল যথেষ্ট চোখে পড়েছে। স্টাইলটা কোথাও কোথাও বৈঠকি---তা, সাহিত্য-আড্ডার গপ্প তো ‘পরবাস’-এর পাঠককুল ভালোই বাসেন [উদা. ভানু রায়ের কলেজস্ট্রিট (প.বা.-৪৮), বা বু.ব.-র পরিমণ্ডল (প.বা.-৫৫), বা সাগরময়ের ‘দেশীয়’ আড্ডা (প.বা.-৫৬)]।
প্রচ্ছদখানি অতীব উপাদেয় হয়েছে।
প্রচেষ্টাখানি সৎ এবং বইখানি সংগ্রহে রাখার মতো---শেষে এ’কথা দু’টোই ধরা থাক।
প্রথম পুরুষ—দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায়; পত্র ভারতী, কলকাতা-৯; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০০০; তৃতীয় মুদ্রণ: আগস্ট ২০১২; ISBN: 81-86986-21-9
ঊনিশশ’ ষাট-সত্তরের দশকে কোনো বাঙালি কিশোর দীনেশ চট্টোপাধায় (১৯১৭-৯৫) মশায়ের ‘দুরন্ত ঈগল’ বা ‘নাম তার ভাবা’ পড়ে মুগ্ধ হয়নি---এমন খুঁজে পাওয়া যাবে কি? কী প্রগাঢ় ইতিহাসপ্রীতি, শিশুমন বোঝার ক্ষমতা ও তদনুযায়ী তরতরে লিখনে পারঙ্গম হলে যে একখানি ‘নীল ঘূর্ণি’ লেখা যায়, তা যে-কোনো কলমের কারবারিই বুঝবেন। ব্যক্তিগত জীবনে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য, প্রমোদ দাশগুপ্তের সুহৃদ, ‘কিশোর ভারতী’-র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক দীনেশচন্দ্রের জীবনী পড়তে উৎসাহী হওয়াই তো স্বাভাবিক। কিন্তু মলাটে কী দেখিয়ে অন্দরে কী দিলেন লেখক-কাম-প্রকাশক মশাই? দোহাই, দয়া করে ক্রেতা-পাঠককে ঠকাবেন না। ক্রেতা সওয়া-শ’ টাকা খরচ করলেন দীনেশচন্দ্রের জীবনী পড়তে, তাঁর পিতৃদেবের নয়।
বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে যশোহর জেলার এক দরিদ্র ব্রাহ্মণসন্তান লেখাপড়া শেখার আগ্রহে অজ পাড়াগাঁ ছেড়ে শহরের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। তারপর, যেটাকে তাঁর ‘আশ্চর্য যাত্রা’ বা নিরলস জীবনসংগ্রাম বলে চালাতে চেয়েছেন লেখক সেটা না সেকালের নিরিখে ইউনিক কিছু ছিল, না গল্পের পরতে পরতে তা খুলে গিয়ে কোনো লড়াইয়ের গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। বস্তুতঃ, এমন প্রতিঘাতহীন নিস্তরঙ্গ গোল গোল জীবনকাহিনিই কম পড়তে পাওয়া যায়। যেমন, বালকটি বাড়ি থেকে পালাতে না পালাতে স্টীমারে আলাপ হয়ে গেল তার জীবনদেবতার সঙ্গে, যিনি তাকে বাকি জীবন আগলে আগলে নিয়ে চললেন। এমন মানুষ পাওয়া তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। এর জন্য, কৈ ‘জীবনসংগ্রাম’ তো কিছু করতে হল না? তার পরেও বালকটির জীবনের পথ তো, এই কাহিনি অনুযায়ি, যথেষ্টই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল—তিনি ছিলেন ‘প্রথম ভাগ’-এর গোপালের মতই ভালো ছেলে---যাহা পায় তাহাই খায়, যাহা পায় তাহাই পরে (ধুতির দৈর্ঘ্য আটহাতের স্থানে আধহাত হলেও---দ্র. দ্বিতীয় প্রচ্ছদ)। এঁর সময়ের প্রায় পৌন-শত বছর পূর্বে রামতনু লাহিড়ি মশায়কে কলকাতায় পড়তে এসে দ্বিগুণ জীবনসংগ্রাম করতে হয়েছিল। ফিকশনেও দেখুন, ‘অপরাজিত’ অপুকে করতে হয়েছে, চতুর্গুণ সংগ্রাম। আর, বর্তমান কাহিনিটি কী? লেখক মুখবন্ধের প্রথমেই বলে দিলেন যে এ’টি ‘ঠিক কল্পকাহিনি নয়’। আবার শেষেই বললেন এ’টি তাঁর পিতামহের জীবনী! তাঁকেই ‘প্রথম পুরুষ’ বলার পেছনে এক ধরনের দম্ভ কাজ করে, কারণ তিনিই নাকি প্রথম ‘অন্ধকার থেকে আলোর দিকে’ এসেছিলেন! কিন্তু এ’-উপন্যাসে নায়কের পিতৃদেবের যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায় চিঠিপত্রের উল্লেখে, তাতে তাঁকে যথেষ্ট সৎ, ভদ্র, পরিশীলিত মানুষ বলেই মনে হয়---জমিদারি সেরেস্তায় ছোট চাকুরি করলেই অন্ধকারের মানুষ হয়ে যেতে হয় না, না ইংরিজি পড়ে পাশ দিলেই আলোকপ্রাপ্ত হয়।
সারা বইখানি জুড়ে চরিত্র-চিত্রায়ণে, মুখের ভাষায়, অঙ্গসজ্জায় ১৯১০-২০ নয় , ১৯৯০-এর দশক ফুটে বেরিয়েছে---এতই অপ্রযুক্ত আধুনিকতা। কোথাও কোথাও তো হাস্যকর রকমঃ যেমন, ১৯১৩-১৪ নাগাদ গোলদিঘিতে ছোটছোট ছেলেমেয়েরা সাঁতারের পোশাক পরে জলে ঝুপঝাপ ঝাঁপাচ্ছে; বা ১৯১৪-র ২৮শে জুলাই কলকাতার বসুমতী পত্রিকার হেডিংঃ ‘প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হইল’ (যেন তখনই জানা ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বলেও আরও একটা কিছু হবে ভবিষ্যতে!)!! ১৯০৯-১০ নাগাদ যশোরের প্রত্যন্ত গ্রামের এক ডাক্তারবাবু টনিক দিচ্ছেন রোগিকে (পৃ ১১৩)! ১৮৫৩-তেই হিন্দু কলেজ প্রেসিডেন্সি কলেজে রূপান্তরিত হয়ে গেলেও ত্রিদিববাবুর এ’উপন্যাসে ১৯১৪-তে হিন্দু কলেজের ছাত্ররা পথে পথে গান গেয়ে বেড়ায় (পৃঃ ১৬৪)। নীল-ঘূর্ণি বা ভাবার লেখকের হাত দিয়ে এতো কাঁচা কাজ বেরোতেই পারে না---কোথায় ‘না’ লিখতে হবে, আর কোথায় ‘নাহ্’---সেটাও জানা নেই। গল্প বলা একটা অতি উচ্চস্তরের আর্ট যা বর্তমান লেখকের নেই। প্রকাশক বলেই লেখক হওয়া যায় না।
চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই-কাগজ বইখানির। যদিও তার অন্দরে যে এ’হেন বস্তু খুঁজে পাওয়া যাবে, তা কে জানত? বানান ভুলও বেশ কিছু চোখে পড়েছে। শিল্পী সুদীপ্তর স্টাইল মৌলিক না হলেও বেশ, তবে অনেকখানেই অপ্রযুক্ত হয়েছে। যেমন, প্রচ্ছদের ছবিটি কোনো কিশোর বা যুবকের নয়, এক প্রৌঢ়ের---যাকে দীনেশচন্দ্রের জীবনী বলে ভুল করেই ক্রেতা বইটি কিনবেন। কিন্তু, উপন্যাসখানি সমগ্রতঃ যাঁকে নিয়ে লেখা, সেই অবনীভূষণের ২০-২২ বছর বয়সেই কিন্তু কাহিনির পরিসমাপ্তি। প্রতি অধ্যায়ের শুরুতে পুঁটলি বগলে যে ছবিটি, সেটি এক দীর্ঘাঙ্গ যুবকের হয়ে গেছে, ঘরপালানো কিশোরের নয়। মাস্টারমশায়ের কাঁধের ঐ শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ ১৯১০-এর দশকে হতে পারে না (পৃঃ ৩১)। সুদীপ্ত, ইলাস্ট্রেটরের কাজ শুধু ছবি আঁকা নয়, কাহিনিকে তার মাধ্যমে বাঙ্ময় করে তোলা।
শেষে প্রাঞ্জল করি, কোনো ব্যক্তিবিশেষের অসম্মান করা এ’লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার পিতামহ বা প্রপিতামহ আমার কাছে নিশ্চয়ই পূজনীয়। কিন্তু যখনই আমি আর্থিক বিনিময়মূল্যে তাঁর জীবনী নিয়ে বই লিখে পাঠক-ক্রেতার সামনে রাখবো, তখনই এই প্রশ্ন অনিবার্য আসবে যে পাঠক তাঁকে সমান মর্যাদায় মাথায় তুলে নেবেন কেন---পরিবারের গণ্ডি ডিঙিয়ে তাঁর উচ্চতর কোনো গ্রহণযোগ্যতা না থাকলে?
সব মিলিয়ে মনে হয়, এ’কাহিনি ছেপে না বেরোলেই ভালো হত।
নদীপথে—অতুলচন্দ্র গুপ্ত; আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯; প্রথম সংস্করণ: আষাঢ় ১৩৪৪, সপ্তম মুদ্রণ: আষাঢ় ১৪২০; ISBN: 81-7756-267-3
সত্যি, এ’রকম কত ক্লাসিকই যে আগে পড়িনি!
ক্লাসিক? পৃষ্ঠা সংখ্যায় তো মাত্র ষাট: ১৯৩৮-এর প্রকাশনার ২০১৪-রিপ্রিন্ট এ’খানি। কিন্তু কেবল সময়ের নিরিখই নেব? যে দিন হারিয়ে গেছে, যে পথ, যে দেশ আজ আর ‘আমার’ নয়, তার গাথা যে কথামালায় গাঁথা সুললিত চলিতে---তার নিজেরই একটা আকর্ষণ নেই? প্রমথ চৌধুরী মশায় ‘সবুজপত্রে’ এই প্রাঞ্জল বীরবলী-বাঙলার যে শুরুয়াৎ করেছিলেন, বন্ধুবর অতুলচন্দ্রের হাতে তা এক মোহময়ী রূপ পেয়েছিল। তাকে তো হারিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। ‘নদীপথে’ তাই বাঙলা ভ্রমণসাহিত্যের এক বিস্মৃতপ্রায় ক্লাসিক---বিষয়ে, ভাষায়, আঙ্গিকে। কোনো ক্লাসিক বাণিজ্যসফল না হতে পারে, না হতে পারে জনপ্রিয়ও, থেকেই যেতে পারে তা প্রচারের আড়ালে (এই যেমন আমরা এখন পরবাসের পাতায় ঁদিবাকর ভট্টাচার্যের লেখা পড়ছি)। তাতে তার আন্তরিক যে ধার, সেটা তো ক্ষুণ্ণ হয়না। কালান্তরে রয়ে যায় তার আবেদন। কে যেন বলেছিলেন, অন্নদাশঙ্কর যদি আর একটি লেখাও না লিখতেন, কেবলমাত্র ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে’-র জন্য বাঙলাসাহিত্যে চিরকালীন ঠাঁই পেয়ে যেতেন। ওটা একটা একপৃষ্ঠার ক্লাসিক!
এত ওজরের কোনো দরকার ছিল কী?
১৯৩৪-‘৩৫-’৩৬-র তিন শীতে লেখক বোটে চড়ে পুববাঙলা-আসামের নদীপথেপথে বেরিয়েছিলেন। পত্রাকারে লিখে গেছেন সে কাহিনি। এ’ সে-ই বই।
দিন তখন চলতো বড় ঢিমে তালে। শীতের ছুটিতে আরও নিস্তরঙ্গ জীবন। ধীরে সুস্থে পিঠে শীতের রোদ্দুর লাগিয়ে বিদ্যাধরী-পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের উজান বেয়ে চলা। কলকাতা থেকে যাত্রা শুরু করতেই দেরি হয়ে গেল, কয়েক ঘন্টা নয়, একটা দিন। কারণ বিলিতি ডাক-জাহাজ এসে পড়ায় হাওড়ার পুল খোলাই যায় নি! তারপরেও, কখনও কলকাতা-মেইলকে (ট্রেন না, স্টিমার) পাশ দিতে এক রাত্তির সুন্দরবনে আটকে থাকা, কখনও বা ভারি কুয়াশার কারণে। কোথাও এক ইংরিজিনবিশ হরবোলা এসে শ্যাল-কুকুরের ডাক শুনিয়ে মনোরঞ্জন করে গেল তো কোথাও রোমান-সেনটরসদৃশ শুভ্রকেশী মিঞাসাহেবকে ফ্রি আইনি পরামর্শ দেওয়া হল। বরিশালে নেমে চিঠি ডাকে দিয়ে আসা বা ধুবুড়ি শহরে রাত্রিবাস ও গ্রামসভায় ভাগ নেওয়া। কত কত জাহাজী শব্দ ও রীতিনীতির উল্লেখঃ ‘ফ্ল্যাট’ মানে স্টীমারের সঙ্গে বাঁধা চ্যাটালো গাধাবোট; বা নদীপথে চলতে চলতে অপর কোনো জলযানে ঠোক্কর মারলে সারেংকে নিকটবর্তী থানায় রিপোর্ট করে আসতে হয়। বর্ণনা পড়তে পড়তে কখনও মনে হয় ‘বিষবৃক্ষ’-র শুরুটা পড়ছি চলিতে, কোথাও যেন লেখার মধ্যে ভেসে আসে আব্বাসউদ্দিনের সুর। অপূর্ব! কী চমৎকার চমৎকার স্থান নাম---ফুলছড়ি, চিলমারি, যাত্রাপুর, বিলাসীপাড়া, পলাশবাড়ি, উমানন্দভৈরব---কবিতার মত, বা জলতরঙ্গের টুংটাং! ভাবলে মন খারাপ হয়, এ’সব কোথায় হারিয়ে গেছে, এ’স্থান আর ‘আমার’ নয়। তাই? না গো, এ’ও আমারই। বৃহত্তর বাঙলারই।
কিছুদিন আগে এক চমৎকার বই পড়ছিলামঃ বার্লিনবাসী বিহারী-ভূমিপুত্র নীতিন সিন্হার অসাধারণ স্কলারলি কাজ Communication & Colonialism in Eastern India। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দির পটভূমিকায় লেখা। তার সম্বন্ধে পরে কখনও ‘পরবাস’-এর পাতায় বলার ইচ্ছে রইল। অতুলচন্দ্রের এই বই পড়তে পড়তে এখন সেটির কথা মনে পড়ে গেল তথ্য ও টেকনিক্যাল মিল প্রসঙ্গে। সুললিত সাহিত্য হলেই যে তার ভিত্তি ভূমিতে না হয়ে কেবল হাওয়ায় হাওয়ায় হবে, তা তো নয়। অতুলচন্দ্র নিজ লেখায় সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন।
আরেকটি প্রসঙ্গ এইভাবে ভাবা যাক্: সম্মুখম চেট্টি বা শচীন চৌধুরী বা ননি পালকিওয়ালা---তাঁদের নিজ নিজ কালের ভারতশ্রেষ্ঠ আইনজ্ঞগণ কেউ সাহিত্যকর্ম করেছেন বলে কখনও শুনিনি। আবার, এস. ওয়াজেদ আলির মত প্রথিতযশা সাহিত্যিক ব্যারিস্টার হিসেবে তেমনটা ছিলেন না। (জবাহরলাল ব্যতিক্রম)। সেদিক দিয়ে, ১৯৩০-এর দশকে ভারতের শ্রেষ্ঠ ব্যবহারজীবি অতুলচন্দ্র ‘কাব্যজিজ্ঞাসা’ বা এই ‘নদীপথে’-র মত উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকৃতি রেখে গেছেন---এটা বড় কম কথা নয়। প্রমথ চৌধুরী বয়সে তাঁর চাইতে ১৫-১৬ বছরের জ্যেষ্ঠ হলেও অতুলচন্দ্রকে সুহৃদবৎ দেখতেন ও লেখায় উৎসাহ দিতেন। ‘সবুজপত্র’-এর পাতায় নিয়মিত হাজির থাকতেন ভারতশ্রেষ্ঠ এই আইনজ্ঞ---না, আইনের কচকচিভরা কোনো কলাম লিখতে নয়, নিখাদ সাহিত্যচর্চার তাগিদে। অতুলনীয় রুচিবোধ ও দেখার চোখ নিয়ে লিখে গেছেন অতুলচন্দ্র। যেমন, এই বইয়ের একস্থানে তাঁর ভিক্টোরিয় ভদ্রতাবোধ কেমন প্রকাশ পেয়েছে দেখুনঃ কবিকঙ্কণ লিখেছিলেন, শুকনো ডাঙায় মাছ ও পরনারীর লোভ জয় করা কঠিন। অতুলচন্দ্রের কলমে পরনারী উহ্য রয়ে যায় ‘আরও একটা জিনিস’ হয়ে। অন্য একটি স্থানে অবশ্য এ’হেন উচ্চমার্গীয় সাহিত্যিকের পক্ষ থেকে অজান্তেই একপ্রকার বাঙালিসুলভ উন্নাসিকতা প্রকাশ পেয়ে গিয়েছে, যেটি বড্ড এলিটিস্ট, এবং আপত্তিজনক। গুয়াহাটি শহরকে লেখক অসমিয়াদের ‘সাহিত্য-প্রচেষ্টার কেন্দ্র’ বলেছেন! ‘সাহিত্য-প্রচেষ্টা’ কেন, ‘সাহিত্য-কৃতি’ নয় কেন? অহমিয়ারা কি কেবল সাহিত্যপ্রচেষ্টাই করে গেছেন, আসল সাহিত্য করেননি? অসমিয়া ভাষায় ‘রামায়ণ’ যে লেখা হয়েছিল কৃত্তিবাস-তুলসীদাসেরও আগে! গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এ’হেন চিন্তনের ঊর্ধে ছিলেন না, যিনি সমবয়সী ভাইঝি-জামাই ও আধুনিক অসমিয়া সাহিত্যের প্রাণপুরুষ লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়াকে ‘আঞ্চলিক বাঙলা’ ছেড়ে মূলস্রোতে আসতে উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সংস্কৃতজ ভাষাগোষ্ঠির মধ্যে অসমিয়া তো এক স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভাষা। আর গুয়াহাটি তার এক প্রধান চর্চাকেন্দ্র ছিল ঊনবিংশ শতক থেকেই। কোথাও যেন একটু টেকনিক্যাল ভুল চোখে পড়েঃ ১৯৩৪-৩৫ দু’বছরই বড়দিনের সময় রোজার উপবাস কী করে হয়? হিজরি সনের হিসেব চান্দ্রমাসে, তাই পরের বছর তো ঈদ মাসখানেক এগিয়ে আসবেই। যুগন্ধর শিল্পী পরিতোষ সেনমশায়ের ইলাস্ট্রেশন এখানে মন কাড়লো না, যেন পুরোটা দেননি। প্রাণটা এখানে নন্দলাল নন্দলাল চাইছে। প্রচ্ছদে কৃষ্ণেন্দু অনবদ্য।
অসহযোগ আন্দোলনকালে এখানে এসে গান্ধীজি আসামকে বলেছিলেন bewitchingly beautiful country. সেই জাদুকরী দেশের কথা তো এমন জাদুকরী ভাষাতেই হওয়ার কথা।
Explorations in Connected History---Mughals and Franks—Sanjay Subrahmanyam, Oxford University Press, New Delhi-1; First published in 2005, second impression 2012; ISBN: 13: 978-0-19-807717-6
চট করে দেখলে আজ তাঁকে ঋষি টলস্টয় বলে ভ্রম হয়---দীর্ঘ শ্মশ্রুগুম্ফের কারণে।
ওমা, এ-ই সেই ডেলহি স্কুলের সঞ্জয়, একই জন্মদিন বলে ফর্ম ফিল-আপের দিনে যার সঙ্গে আলাপ সেই আশির দশকের গোড়ায়? সঞ্জয় হল দুঁদে আমলা কে. সুব্রহ্মণ্যমের পুত্র (যিনি ছিলেন ১৯৫০-এ প্রথম বছর আই এ এস পরীক্ষার ফার্স্ট বয়)---এ’খবর তখনই শোনা! ........এক প্রায়-সহপাঠির স্মৃতিতে ধরা আছে এ’সব পুরনো ছবি। আজ এ’বই পড়তে পড়তে ভাবি, ভাগ্যিস সঞ্জয় তাঁর বাপ-দাদাদের মত ভারতীয় ফরেন বা এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে জয়েন করেননি। করলে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস চর্চার মস্ত ক্ষতি হয়ে যেত।
সঞ্জয় সুব্রহ্মণ্যম আজ প্রাক্-আধুনিককালের ভারত ও দক্ষিণ এশিয় ইতিহাসচর্চার এক প্রধান পুরুষ---বহুভাষাবিদ্, পড়ান ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। মধ্য-পঞ্চাশের অধ্যাপকমশায়ের ঝুলিতে এখনই গোটা পনেরো গভীর গবেষণাধর্মী পুস্তক---তার মধ্যে দু’টি হল মেলবন্ধনের ইতিহাস। তারই একটি সবেমাত্র পড়ে উঠে এই লিখতে বসলামঃ
কেন এই বই পড়ে বড় ভালো লেগে গেল?
ভারতের মাটিতে মোগল-প্রবেশের সিকি শতাব্দী পূর্বেই সটান সমুদ্রপথে পর্তুগিজ-পদার্পণ। তারা যখন কালিকট-সুরত-চট্টগ্রাম ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে পা রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, উত্তরভারতে তখন তুঘলক-লোদিরা মিইয়ে আসছে, ফরঘনার এক কবি-নৃপতি কামান নিয়ে পানিপথের দোরগোড়ায় উপস্থিত। এরপরের প্রায় দু’শ বছরের ভারতেতিহাস তো সেই তৈমুরীদেরই কীর্তিকলাপে ভরা, য়ুরোপীয়রা তখন মার্জিনের বাইরে, তাদের কব্জা এঁটে বসতে অষ্টাদশ শতাব্দী শেষ হয়ে যাবে।
আচ্ছা, ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী এই তিনশ’ বছর ইয়ুরোপীয়রা ভারতে করছিলোটা কী? স্থলপথে আর্মেনিয়রা বা জেসুইট পাদ্রীগণ তার অনেক আগে থেকেই লাহৌর-দিল্লি-আগ্রায় এসেছিলেন, মোগল দরবারে তাঁদের যথেষ্ট প্রভাবও ছিল। কিন্তু, রাজশক্তিতে-শক্তিতে টানাপোড়েন? সেটা কী টমাস রো-র আসাতেই সূত্রপাত? পাশাপাশি, ভারতে মোগল শাসন চলাকালীন ঐ সময়ের আগেপিছেমধ্যে পারস্যে তো সাফাভি রাজবংশ ও তুরস্কে অটোমান-সম্রাট সুলেমান এর রাজত্ব চলছিল। তাদের সঙ্গে মোগল দরবারের কেমন সম্পর্ক ছিল, কী ভাবের আদানপ্রদান চলেছিল? এই ‘সম্পর্কিত ইতিহাস’-ই শুনিয়েছেন সঞ্জয় তাঁর এই অসাধারণ পুস্তকে। এই ‘সম্পর্কের ইতিহাস’ ও ‘ভাববিনিময়ের ইতিহাস’ সাধারণতঃ উপেক্ষিতই থেকে যায়। ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকে মোগল ইতিহাস আমরা পড়ি, তো মোগলেরই ইতিহাস পড়ি, যা ভারতের ভূগোলে সীমাবদ্ধ। কিন্তু দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে পর্তুগিজ ভূমিকা বা ভারত মহাসাগরীয় বাণিজ্য কীভাবে মোগল অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে তুলতো--সে-সবও তো মস্ত ইতিহাস। কলেজিকালে অশীনবাবুর বইয়ের পাতা একটু ওলটানো ছাড়া এ’বিষয়ে আর কিছু জানতাম না। সঞ্জয়ের এই বই পড়ে তাই যুগপৎ জ্ঞানবৃদ্ধি হল ও মুগ্ধ হলাম।
এ’বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে চোখ বোলালে রেঞ্জটা স্পষ্ট হয়ঃ ‘ভারতমহাসাগরীয় বাণিজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস ১৫৪৬-৬৫’, ‘মোগল গুজরাত ও স্পেনিয় বদ্বীপ’, ‘দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে পর্তুগিজ’ বা ‘কোম্পানি, মোগল ও রো’। একটি উপভোগ্য অধ্যায় সুলতান বুলাকি-কে নিয়ে। সুলতান বুলাকির নাম শোনেন নি? আমিও শুনিনি। ‘সন্ন্যাসী রাজা’-র গল্প মনে আছে, বা সিনেমা? এ’ সেই কেস। জাহাঙ্গিরের জ্যেষ্ঠপুত্র খশরু তো পিতামহের মসনদ পেতে বাপের সঙ্গে টক্কর দিয়েছিলেন বিশ বছর বয়স না পুরোতেই। পরাজিত খশরু যখন লাহৌরে বন্দী, পাটনায় এক ফকির নিজেকে জেল-পালানো খশরু পরিচয় দিয়ে শাহি-খাজানা দখল করে বসেন। সে-বিদ্রোহীকে কোতলের এক দশক পরেও ইস্পাহানের দরবারে কোনো এক ‘সুলতান বুলাকি’ গিয়ে ঠেলে ওঠে, যে নিজেকে আসল শাহ্জাদা খশরু পরিচয় দিয়ে সম্রাট শাহ্জাহানের গদি ওল্টাতে সমর্থন চায়। চমৎকার পাঠ। জাল রাজা প্রতাপচাঁদ বা ভাওয়াল সন্ন্যাসীরা তাহলে যুগে যুগে ছিল!
শ্রেষ্ঠ অধ্যায়টি অবশ্যই স্যর টমাস রো (১৫৮১-১৬৪৪)-কে নিয়ে। রো-কে আমরা বৃটিশ-ভারত বাণিজ্যের অগ্রদূত ভাবতেই অভ্যস্ত। লেখক কিন্তু চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে রো নিজের হোমওয়ার্ক ভালো করে করে আসেননি, এবং নিজের মিশনেও তাঁর কাছে অধিকতর আশা ছিল। মানছি, সপ্তদশ শতকের আগে য়ুরোপে ফার্সিভাষার চর্চা শুরুই হয়নি। অক্সফোর্ডের প্রাক্তনী রো-ও এ’ভাষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হয়েই ভারতে দূতিয়ালি করতে চলে এসেছিলেন। ভাঙাভাঙা স্প্যানিশে, ইতালিয় ও তুর্কি দুই দোভাষীর মাধ্যমে সম্রাট জাহাঙ্গিরের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। বাণিজ্য-হেন এক নগণ্য বিষয়ের প্রতি ইংলন্ডেশ্বরের কেন এতো আগ্রহ---সম্রাট সেটাই বুঝতে চান নি। বোঝো!
বস্তুতঃ, এ’বইয়ের সমালোচনা করার বিদ্যে আমার নেই। পড়ে আনন্দ পেলাম, ভাবলাম ‘পরবাস’-এর পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। সঞ্জয়ের আলোচনায় অনায়াস এসে গেছে শেক্সপিয়র থেকে কুরোসাওয়া থেকে অশীন দাশগুপ্তের প্রসঙ্গ। ভাবি, কী বিরাট ইজেলে এই মেলবন্ধনের ইতিহাস এঁকেছেন শ্রীসুব্রহ্মণ্যম। সাধু সাধু। আগামী দিনে তাঁর কাছ থেকে মেলবন্ধনের আরও ইতিহাস পড়তে পাবো, এই আশা রাখি।
একটা কথাঃ মধ্যযুগীয় ভারতের সঙ্গে চিন ও দূর প্রাচ্যের সম্পর্ক কি একেবারে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল? ‘মেলবন্ধনের ইতিহাস’-এর এই দিকটা নিয়ে কবে লেখা হবে?