• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • খেলার নাম কল্পনা : সুব্রত সরকার


    পু ইমাজিনেশানে 'বি' পেয়েছে। ছিঃ ছিঃ। এটা কি করে সম্ভব? মা তো রেগে আগুন। বাবাও ভীষণ বকছে, তুমি সব সাবজেক্টে এ পেয়েছো। ইংরাজী, ম্যাথস্‌-এ 'এ প্লাস'। ইমাজিনেশানে বি! কেন? হোয়াই আর ইউ পুওর ইন ইমাজিনেশান?

    অপু ভয়ে চুপটি করে বসে আছে। মার পাশে দাঁড়িয়ে বাবা আরও বলে যাচ্ছে, তুমি কি কিচ্ছু ভাবতে পারো না? কল্পনা করতে পারো না? নিজের মনে মনে ভাববে। খেয়াল করবে। মনটাকে ভাসিয়ে দেবে। অপু ইমাজিনেশান ছাড়া জীবন অসম্পূর্ণ। অর্থহীন। তুমি কিছুই আবিষ্কার করতে না পারলে মজা পাবে না। আনন্দ পাবে না। জানো তো, ইমাজিনেশান ইজ দ্য ফাদার অফ অল ইনভেনশান।

    মা এবার অপুর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তুমি যেমন জেনেছ, জাঙ্ক ফুড খেতে নেই। ফাস্টফুড ভালো নয়। কালার কোল্ড ড্রিংকস্‌গুলো খুব খারাপ ওগুলো সব নট গুড ফর হেলথ। তুমি যেমন বল, রাতে ব্রাশ করে শোওয়া উচিত। নাহলে দাঁতে ক্যাভিটি হয়। দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। হাত না ধুয়ে কখনো খাওয়া উচিত নয়। স্যানিটাইজার ইউজ করা উচিত। ঠিক তেমন তোমাকে শিখতে হবে, ভাবতে হবে, কল্পনা করে করে বলতে হবে এমন সব কথা, এমন সব স্বপ্ন যা শুনে অন্যেরা বলবে, বাঃ বেশ তো বলেছে অপু! কি সুন্দর ওর ইমাজিনেশান। কি দারুণ ওর ড্রিমগুলো! আন্টিরা তখন আর তোমাকে 'বি' দেবে না। তোমাকে 'এ' পেতেই হবে অপু। নাও স্টার্ট, ইউ ইমাজিন, তুমি আজ ক্লাসে 'এ' পেয়েছো। বন্ধুরা সবাই ক্লাস দিচ্ছে। আন্টি থ্যাঙ্ক ইউ বলছে। তোমার কেমন লাগছে অপু?

    অপু ঝর ঝর কেঁদে ফেলে। ওর চোখদুটো ভিজে লাল টকটকে হয়ে যায়। ফুঁপিয়ে ওঠে। বাবা তখন অবাক হয়ে বলে, একি তুমি কাঁদছো কেন? হাউ সিলি!...

    মা বলে, অপু জানো তো মানুষ খুব বড় সাফল্য পেলে, কোনও কিছু অ্যাচিভ করলেও কাঁদে। সামটাইমস্‌ সাকসেস্‌ ব্রিংস্‌ টিয়ার্স! তুমি কি তার জন্য কাঁদছো?

    ঠাম্মা ছিল পাশের ঘরে। সে এসে অপুকে জড়িয়ে ধরে। বুকে টেনে নেয়। অপুও ঠাম্মার কোলে মুখ লুকিয়ে চুপ করে যায়।

    আজ আকাশে চাঁদ উঠেছে। মস্ত বড় এক গোল চাঁদ। অপু ঠাম্মার সঙ্গে ছাদে এসেছে। চাঁদের আলোয় ছাদটাকে খুব সুন্দর লাগছে। কোথাও কোনও অন্ধকার নেই। আলোয় ঝলমল করছে ছাদ। অন্ধকার থাকলেই যত ভূত-পেত্নিরা সব চলে আসে। লুকিয়ে থাকে। আরশোলারাও উড়ে বেড়ায়। পেত্নিগুলো খুব পাজি। লুকিয়ে লুকিয়ে ভয় দেখায়। জিভ ভেঙ্গায়। নাকি সুরে কাঁদে। আর সুযোগ পেলেই ঘাড়ে চেপে বসে!

    তাই ভূত-পেত্নিরা চাঁদকে খুব ভয় পায়। ওরা একদম সহ্য করতে পারে না চাঁদের আলো। অপু ভাবে আহা, রোজ কেন চাঁদমামা ওঠে না? চাঁদমামাকে বলতে হবে, তোমার কোনও ছুটি নেই। নো সানডে। নো হলিডে। তুমি রোজ উঠবে আকাশে। জোছনা দেবে আমাদের। তাহলে কত ভালো হবে। আমাদের রান্নার দিপালীমাসিরও আর কষ্ট হবে না। রোজ রাতে অন্ধকার রাস্তায় যেতে মাসির খুব কষ্ট হয়। অন্ধকারে পড়ে যায়। পায়ে ব্যথা পায়। বাবা একটা টর্চ লাইট কিনে দিয়েছে। কিন্তু দিপালী মাসি এমন ভুলো যে সেই টর্চলাইট আনতেই ভুলে যায়। কিন্তু রোজ যদি এমন চাঁদের আলো থাকত, ঝলমল করত ছাদ, রাস্তা তাহলে তো আর টর্চ লাগত না। মাসিরও কষ্ট হত না। ভূত-পেত্নিগুলোও জব্দ হত খুব!

    ঠাম্মা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে অপুকে বলল, আচ্ছা অপু, বল তো আকাশে ওই যে ঝলমল করে জ্বলছে ওগুলো কি?

    ওগুলো তো তারা। টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটিল স্টার। অপু এক নিমেষে বলে দিল।

    তারা তো আমিও জানি। ঠাম্মা অপুর হাতটা ধরে বলল, কিন্তু তুমি একটু ভেবে বল তো আর কি হতে পারে?

    অপু ভাবছে। আর তারা ভরা আকাশটার দিকে চেয়ে আছে। ঠাম্মা মিটিমিটি হেসে বলল, ভাবো। কল্পনা করো। ইমাজিনেশান বাড়াও। দেখবে অন্য আরও কিছু না কিছু তোমার মনে হবেই হবে।

    অপু একটু ভেবে আস্তে আস্তে এবার বলল, ছোট ছোট ফুল।

    বাঃ। এই তো তুমি পেরেছো। ঠাম্মা খুশি হয়ে বলল, কোন ফুলের কথা তোমার মনে হচ্ছে?

    অপু হাসতে হাসতে বলল, আমাদের বারান্দার টবে ফুটেছে থোকা থোকা সাদা ফুলগুলো। কি যেন নাম ফুলগুলোর?

    ঠাম্মা বলল, বেল ফুল।

    অপু বলল, ওই তারাগুলোকে মনে হচ্ছে সব বেলফুল। ঠাম্মা বেলফুলের গন্ধ কি সুন্দর। আচ্ছা ঠাম্মা, তারাদের গায়েও কি গন্ধ হয়?

    হয় তো। ঠাম্মা খুব হাসছে। অপুও মজা পেয়ে হাসছে। হাসি থামিয়ে ঠাম্মা একসময় বলল, তুমি কি আর অন্য কিছু ভাবতে পারছো ওই তারাগুলোকে?

    অপু আবার চুপ করে ভাবে। ঠাম্মা ওর দিকে চেয়ে থাকে। অপু এবার চোখ বড় বড় করে বলল, নীল আকাশটা একটা বড় চাদর। তারাগুলো সব খই-মুড়ি। ওরা ছড়িয়ে আছে চাদরে।

    বাঃ। দারুণ দারুণ বলেছো। খুব সুন্দর কল্পনা। ঠাম্মা অপুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বলল, আচ্ছা অপু ঐ চাঁদটাকে তোমার অন্যরকম কি মনে হতে পারে? বল, কল্পনা করো।

    অপু খুব মজা পেয়ে যায়। হেসে হেসে বলে, কি মনে হচ্ছে বলব? তুমি হাসবে না তো?

    না। না। বলো।

    মনে হচ্ছে যেন ঐ চাঁদটা একবাটি দুধ। মা আমাকে যখন রোজ বাটি ভর্তি দুধ খেতে দেয় ঠিক সেরকম।

    দারুণ। দারুণ। ভেরি গুড। ঠাম্মা অপুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, এটাকেই বলে কল্পনা। ইমাজিনেশান। তোমাকে এভাবেই অন্যরকম করে ভাবতে হবে। কল্পনা করতে হবে। দেখবে কত নতুন নতুন সব জিনিস তুমি ভাবতে পারছো। কল্পনায় কত কিছু চলে আসছে। যত সুন্দর করে ভাবতে পারবে, তত বেশী আনন্দ পাবে।

    অপু খুশিতে মেতে উঠে বলল, ঠাম্মা আমরা রোজ এই খেলাটা খেলব। ....

    ন্তরা আন্টি ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাসে সবাই চুপ করে আন্টির পড়া শুনছে। সুনয়না, ঈশান, মায়াঙ্ক, অনুভব, আদৃত, কিয়ারা, আশির, বিতস্তা সবাই কেমন চুপ করে আন্টির কথাগুলো শুনছে। অপুও খুব মনোযোগী। আন্টি বোর্ডে খুব সুন্দর একটা পাখি এঁকেছে। পাখিটার দুটো বিরাট ডানা। মাথায় রঙিন ঝুঁটি। ঠোঁটটা খুব লম্বা। আন্টি সবার দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছবিটা নিশ্চয় তোমরা সবাই বলতে পারবে।

    সবাই একসঙ্গে হৈ হৈ করে উঠল, ইয়েস, ইয়েস ওটা বার্ড। পাখি। পাখি। আদৃত শুধু বলল, ওটা চিড়িয়া।

    ভেরি গুড। অন্তরা আন্টি এবার বলল, ধর, এই পাখিটাকে তোমায় দিয়ে দেওয়া হল। তুমি কি করবে পাখিটাকে নিয়ে? বলো। কল্পনা করে বলো। .....

    মায়াঙ্ক সবার আগে বলল, আন্টি আমি ওকে পুষব। খাঁচায় রেখে দেব।

    সুনয়না বলল, আমি ওকে খুব করে সাজাব। গয়না পরাব। আদর করব।

    ঈশান বলল, রোজ ওকে আমি ছোলা খাওয়াব। ম্যাগি খাওয়াব।

    অনুভব বলল, পাখিকে খাঁচায় রাখতে নেই। ওকে আমি আমাদের ছাদে ঘর বানিয়ে দেব। ও থাকবে।

    বিতস্তা বলল, আমি ওকে কোলে করে নিয়ে ঘুমোব।

    অন্তরা আন্টি সবার কথা শুনছে আর ঠোঁট টিপে টিপে হাসছে। মুখে বলছে, বেশ বেশ। খুব ভালো। বল আর কে কি ভাবছো বল তোমরা। তোমাদের কল্পনার কথা, ইমাজিনেশান-এর কথাই তো জানতে চাইছি।

    কিয়ারা খুব শান্ত। ধীরে ধীরে বলল, ওকে আমি গান শেখাব। কথা বলা শেখাব। ওর নাম দেব পুপু।

    আশির আর চুপ করে থাকতে পারল না। বেশ হৈ হৈ করে বলল, আন্টি আমি ওকে গেম শেখাব। চেজ। তারপর দুজনে রোজ খেলব। দাবা ইজ মাই ফেভারিট গেম।

    আদৃত বলল, আমি ওকে নিয়ে ফুটবল খেলব।

    অপু কিছুই বলছিল না। শুধুই শুনছিল সবার কথা। আর আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে কল্পনার জগতে হারিয়ে গেছিল। অন্তরা আন্টি ওকে অন্যমনস্ক থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলল, অপূর্ব, তুমি কি করবে বল তো শুনি?

    অপু আরও একটু চুপ করে থেকে কেমন উদাসীভাবে বলল, আমি ওর ডানায় চড়ে বসব। ওকে নিয়ে উড়ে যাব।

    ওমা! তাই বুঝি? অন্তরা আন্টি ভীষণ খুশি। হাসতে হাসতে জানতে চাইল, কোথায় উড়ে যাবে?

    — অনেক দূরে।

    কত দূরে?

    ঐ চাঁদের দেশে। নীল আকাশের কাছে।

    বাঃ বেশ তো মজা। চাঁদের দেশে গিয়ে কি করবে?

    চাঁদমামাকে নিয়ে চলে আসব।

    হা-হা-হা। তাই? এতো দারুণ ব্যাপার! কিন্তু তুমি চাঁদকে এনে কি করবে?

    চাঁদমামাকে আর যেতে দেব না। বলব, আমাদের এখানেই থাকো। রোজ আলো দাও। জোছনা দাও। অন্ধকার ভালো লাগে না। ভয় করে। ভূত-পেত্নিরা লুকিয়ে লুকিয়ে ভেংচি কাটে। আরশোলারা উড়ে উড়ে গায়ে এসে পড়ে। ঘেন্না করে। কিন্তু রাস্তায়, ছাদে সব সময় চাঁদের আলো থাকলে আর ভয় করবে না। ভূতগুলো সব পালিয়ে যাবে। পেত্নিগুলো আর আসবে না। দিপালী মাসিরও আর বাড়ি যেতে কষ্ট হবে না।

    থ্যাঙ্ক ইউ। অন্তরা আন্টি ভীষণ খুশি। হাসতে হাসতে আন্টি বলল, তোমরা সবাই জোরে একবার ক্লাপ দাও। আজ অপূর্ব ইমাজিনেশানে এ' পেয়েছে। নাও উই সেলিব্রেট। থ্যাঙ্ক ইউ অপূর্ব। মেনি মেনি থ্যাঙ্কস।

    বন্ধুরা সবাই হাততালি দিচ্ছে। হাসছে।

    অপু তখন মনে মনে ভাবছে, কখন আমি ছুট্‌টে গিয়ে মাকে বলব, মা, মা আমি আজ ইমাজিনেশানে 'এ' পেয়েছি। ঠাম্মা, তোমার সঙ্গে ছাদে গিয়ে আমি আরও খেলব!....



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments