[গ্রামের হাট - বিভিন্ন জন নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে নানারকম জিনিসপত্র বিক্রি করছে। জ্যোতিষী, নাপিত এরাও থাকতে পারে। খেলনার দোকানের সামনে ছোট ছেলেমেয়ে থাকতে পারে। রতন জোলা বসেছে ধুতি শাড়ি গামছা নিয়ে। এমন সময় ঢুকবে মানিক আর তার সাগরেদ পাঁচু। তারা হাটুরেদের নানা জিনিস দেখতে দেখতে রতনকে দেখতে পায়।]
মানিক: আরে রতন না!
পাঁচু: হ্যাঁ গো দাদা, তাই তো মনে হচ্ছে।
মানিক: চল ওর মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে কটা জিনিস নিয়ে আসি। (রতনের কাছে এসে)
মানিক: আরে রতন যে – কেমন আছিস? বাঃ বেশ গামছা। দেখি দেখি – এই সবুজটা – কত দাম রে?
রতন: পাঁচ সিকে।
মানিক: পাঁ-আ-আ-চ সিকে। আর ধুতিগুলো?
রতন: সোয়া সাত।
মানিক: ইইই – সো-ও-য়া সাত। কী বলিস রে রতন! আমি কি তোর আজকের বন্ধু? দাম শুনে যে আমার চোখ ছলছল করছে। বুঝলি পাঁচু, রতনের মত মানুষ –
পাঁচু: লাখে একটা –
মানিক: তাও পাবি না। ওর মনটা এত ভালো না – আর আমাকে অ্যা-অ্যা-ত্তো ভালোবাসে। নাঃ রতন, সবুজটা থাকগে – ঐ নীলটা দে দিকি, আর ঐ নরুনপাড় ধুতিটা– বেশ বেশ – শাড়িখান কত রে?
রতন: সাড়ে দশের কম হবে না।
মানিক: সা-আ-ড়ে দশ। সাড়ে সর্বনাশ বল। শোন পাঁচু, রতন কী বলে। হবে না - আরে হওয়ালেই হবে, অসম্ভব বলে কিছু –
পাঁচু: হয় নাকি?
মানিক: মানুষ চেষ্টা করলে -
পাঁচু: কী না হয়?
মানিক: তবে? তা এই শাড়িখানও - কত হল রে?
রতন: সোয়া সাত আর পাঁচ সিকে – সাড়ে আট – আর সাড়ে দশ – একুনে উনিশ টাকা – আচ্ছা নাহয় আঠেরোই দে, এক টাকা ছেড়ে দিলাম।
মানিক: ধুর বোকা – অমন বলতে আছে? দাঁড়া ঠিকঠাক হিসেব করে দিই – শাড়ি আর ধুতি – মিলে তোর –
পাঁচু : বারো টাকা ছ আনা।
মানিক: আর এক টাকা তো ছেড়েই দিলি – তাহলে হল –
পাঁচু: ন টাকা চার আনা ।
মানিক: তা এই চার আনা রাখ, বাকি তোকে দিয়ে দেব খন। তাহলে তুই ন টাকা পাবি – পাঁচু সব হাতে করে দাঁড়িয়ে কেন – এই নে, গামছাটা দিয়ে বেঁধে ফেল -
রতন: বারো টাকা ছ আনা, বারো টাকা ছ আনা – আরে গামছার দামটা?
মানিক: গামছা? আরে এক টাকা ছেড়ে দিলি না? আর এই যে সিকিটা দিলাম - ওটাই তো গামছার দাম -
রতন: এক টাকা? (মাথা চুলকোয়) কিন্তু দুটো নিলি তো -
মানিক: আরে ধুর, সবুজটা কিনলাম নাকি? ওটা তো অন্যগুলো বাঁধবার জন্য। এই দড়ির মত। দড়ির আবার দাম নেয় নাকি?
রতন: (মাথা চুলকোতে চুলকোতে গুণতে বসে) বারো টাকা কত যেন, ন টাকা কী একটা - ধুত্তোর, সব হিসেব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। যাক গে, কিছু তো বিক্রি হয়েছে। যাই বাড়ি যাই। (যেতে যেতে জিলিপির গন্ধে দাঁড়িয়ে যায়) নিধুময়রার জিলিপি – আঃ – (খেলনা হাতে একটি ছোট ছেলে ও মেয়ের প্রবেশ)
ভাই: দিদি, জিলিপি –
দিদি: না সোনা, এখন জিলিপি খায় না। মা পিঠে বানাবে বলেছে না? বাড়ি চল, পিঠে খাব।
ভাই: পি-ঠে? পিঠে পিঠে পিঠে! (দিদিকে টানতে টানতে বেরিয়ে যায়)
রতন: পিঠে! আহা পিঠে পিঠে! আহা পুলিপিঠে খেতে ভারি মিঠে প্রাণ করে খাই খাই / আর দেরি নয় হয়েছে সময় এইবেলা বাড়ি যাই।
[রতনের বাড়ি। রতনের বৌ খেন্তি ঝাঁট দিচ্ছে, রতন ঢোকে গাঁটরি নিয়ে।]
রতন: খেন্তি ও খেন্তি, একটু জল দে –
খেন্তি: ফিরলে? (জল নিয়ে এসে) তা কিছু বিক্রি হল? নাকি –
রতন: আরে হয়েছে হয়েছে। বিক্রি হবে না – হুঁ:? পাঁচটা গামছা, দুটো ধুতি, একটা শাড়ি – তুই যে বলিস আমি নাকি বেচতেই পারি না - হেঃ হেঃ –
খেন্তি: কিন্তু গামছা আরেকটা কই?
রতন: না – মানে ওটা বিক্রি হয়নি, নিয়ে গেছে। (খেন্তি কটমট করে তাকায়) ইয়ে - বেঁধে নিয়ে গেছে তো, আবার বেঁধে এনে দেবে। (খেন্তি গম্ভীরভাবে হাত পাতে)
রতন: কী?
খেন্তি: টাকা কই?
রতন: এই যে – রাখ –
খেন্তি: (টাকা গুণে) এই? মোটে এগারো টাকা দু আনা!
রতন: ইয়ে, মানে বাকিটা পরে দিয়ে দেবে। মানকের কাছে টাকা ছিল না তো, তাই। পরে দিয়ে দেবে। বন্ধুলোক। (খেন্তি হতাশ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। রতন ঢকঢক করে জল খায়)
রতন: তোর হাতের জলটাও কী মিঠে রে খেন্তি। বলছিলাম কি – আজ একটু পিঠে করবি? কতদিন খাইনি –
খেন্তি: খাওয়াচ্ছি পিঠে! ঝাঁটাটা কোথায় গেল আমার? (ঝাঁটা খোঁজে)
রতন: ঝাঁটা কী হবে? ঝাঁট দিলি তো।
খেন্তি: (ঝাঁটা নিয়ে) পিঠে দিয়ে পিঠে খাওয়াব। পিঠে খাওয়ার শখ! পিঠে খাবে!
রতন: ওরে বাবা রে - (পলায়ন)
খেন্তি: (চেঁচিয়ে বলে) ঘরে কিছু নেই, এই দোকানদারির ছিরি, আবার পিঠে খাবে। পরে নাকি টাকা দেবে। বন্ধুলোক। দিয়েছে কখনো আগে? হায় ভগবান। (খৈনি ডলতে ডলতে জমিদারের পাইকের প্রবেশ)
পাইক: আরে রত্তন, রত্তন আছে?
খেন্তি: কী হয়েছে?
পাইক: ও রত্তনকে বহু, রত্তন কিধার হ্যায়?
খেন্তি: ফেরার হয়েছে। যা বলার আমাকেই বল।
পাইক: হাঃ হাঃ – ফারার হোবে তো হম পাকড় লিবে। আচ্ছা তুম হি শুনো। ইস পূর্ণিমায় মাইজি ব্রাহ্মণভোজন করাইবেন, উসকো ধোতি দিবেন, গামছা দিবেন। বারা ধোতি ঔর গামছা বানাকে রাখনা। জমিদারবাবু আভি ইয়ে রুপেয়া আগাম দিয়েছেন। (টাকা দেয়) সব ঠিকসে বানানা, নিন্দাউন্দা নেহি হোনা চাহিয়ে। তৈয়ার রাখনা, হাঁ। (যেতে যেতে ঘুরে) মাইজিকা কাম হ্যায় রে বাবা, বাবুকা নেহি - পানসে চুন খসেগা তো সত্যনাশ হোগা।(প্রস্থান)
খেন্তি: (টাকাটা মাথায় ঠেকিয়ে) যাক বাবা, কিছু তো এল ঘরে। যাই, খাবার করি গে। লোকটা আবার গেল কোথায়? পিঠে-পিঠে করছিল, নির্ঘাত তা-ই খুঁজে বেড়াচ্ছে। হ্যাংলার হদ্দ। খোঁজো, খোঁজো – (প্রস্থান) (রতন ঢোকে। উঁকিঝুঁকি দেয়, চারপাশে চুপিচুপি দেখে)
খেন্তি: থাক, আর উঁকি মারতে হবে না। ঘরে এসে চাট্টি খেয়ে উদ্ধার করা হোক। (রতন সুড়সুড় করে যায়, তারপর আনন্দে লাফাতে লাফাতে আসে)
রতন: একি পিঠে! তুই পিঠে বানিয়েছিস? দেখি দেখি – একটা, দুটো, তিনটে – সাতটা পিঠে! আহা তোর মুখে পোলাওপায়েস পড়ুক রে খেন্তি, তোর সোনার হাতাখুন্তি হোক – (নাচতে নাচতে) একটা খাব দুটো খাব তিনটে খাব চারটে খাব –
খেন্তি: আরে নাচবেই যদি, খাবে কখন?
রতন: খাব কি এখানে? খাব তো সেইখানে, যেখানে সবাই দেখতে পাবে। সেই হাটের মাঝখানে। একটা খাব দুটো খাব –
খেন্তি: আরে শোনো শোনো –
রতন: একটা খাব দুটো খাব সাত ব্যাটাকেই চিবিয়ে খাব (বারবার বলতে বলতে নাচে। নাচতে নাচতে গাছের পেছনে চলে যায়। পেছন থেকে সামনে সাতটা ভূত আসবে।)
ছানা ভূত: ও দাদু, এটা আবার কে এল গো? চিবিয়ে খাবে বলছে।
কর্তা ভূত: অ্যাঁ! সাত ব্যাটাকেই – আমরা সাতজন আছি তাও জানে।
ছানা ভূত: তাও জানে -
ছেলে ভূত ২: ওরে বাবা রে –
গিন্নি ভূত: ওগো আমাদের এখন কী হবে গো? চিবিয়ে খেয়ে নিলে আমরা যে মরে যাব গো –
মেয়ে ভূত: মরে গেলে আমার যে আর বিয়ে হবে না গো –
বৌ ভূত: শাঁকচুন্নি ঠাকুরঝির বিয়েতে পরব বলে যে হাড়ের নেকলেসটা বানালাম সেটা আর পরা হবে না গো –
মেয়ে ভূত: অপঘাতে মরে ভূত হব গো –
ছেলে ভূত ১: ওফ - আর কবার ভূত হবি, অ্যাঁ? যত্ত মড়াকান্না। মা থামো, একটু ভাবতে দাও। ও বাবা, কিছু ভাবো না।
কর্তা ভূত: ঠিক। অ্যাই চুপ, চো-ও-প। (সবাই থতমত খেয়ে চুপ করে) কী করা যায় – (পায়চারি) হ্যাঁ পেয়েছি –
ছেলে ভূত ১ ও ২: কী পেয়েছ?
মেয়ে ভূত ও বৌ ভূত: কী?
কর্তা ভূত: খাই খাই করছে যখন, তখন ওতেই হবে।
ছানা ভূত: ওতেই হবে।
ছেলে ভূত ২: আরে কী বলবে তো?
কর্তা ভূত: হাঁড়ি। ঠাকুর্দার সেই হাঁড়ি। ওটা পেলে ও নিশ্চয় ছেড়ে দেবে আমাদের –
ছেলে ভূত ১: কিন্তু ওটা দিয়ে দিলে আমাদের শাঁকচুন্নির বিয়েতে সবাইকে খাওয়াব কী?
কর্তা ভূত: ওরে আগে প্রাণে বাঁচলে তবে তো বিয়ে। (হাঁড়ি নিয়ে আসে) যা এটা দিয়ে আয় –
ছেলে ভূত ১: যা তো বোনটি - আমার কানটা কেমন কটকট করছে –
মেয়ে ভূত: আমার লজ্জা করছে - (ছেলে ভূত ২ কে) তুই যা না –
ছেলে ভূত ২: উঃ – পেটটায় মোচড় দিল - বৌদি – যাও না গো –
বৌ ভূত: আ-আমি বউমানুষ, মা –
গিন্নি ভূত: ওগো আমার কপালে এই ছিল গো - (হাঁড়ি কর্তাভূতকে ধরিয়ে দেয়)
কর্তা ভূত: (একটু এগিয়ে পিছিয়ে আসে) আচ্ছা সবাই একসঙ্গে যাই চল। কথায় বলে দশের হাঁড়ি একের বোঝা। সাতে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ। (রতন নাচতে নাচতে সামনে আসে, সব ভূতেরা তার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে )
ছেলে ভূত ২:ওগো মশাই গো, আমাদের ছেড়ে দাও গো -
গিন্নি ভূত: আমরা কিছু জানি না গো, কিছু করিনি গো –
ছেলে ভূত ১:– দোহাই মশাই
মেয়ে ভূত: আমাদের খেয়ো না গো – (রতন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে)
কর্তা ভূত: দোহাই মশাই, এই হাঁড়ি দিচ্ছি, এটা নিয়ে আমাদের ছেড়ে দিন বাবা – আমাদের খাবেন না –
ছানা ভূত: আমরা খেতেও ভালো না –
রতন: হাঁড়ি? হাঁড়ি কী হবে? হাঁড়ি তো আমার আছে –
কর্তা ভূত: আহা এমন হাঁড়ি কখনো দেখেননি – পোলাও পায়েস সব পাবেন -
রতন: সে তো পাওয়াই যায়, খেন্তি বানালেই পাব – দ্যাখো কেমন পিঠে – ও, সব তো শেষ –
কর্তা ভূত: আহা তা নয়, এর কাছে যখন যা খেতে চাইবেন, তাই পাবেন –
রতন: যা চাইব, তাই খেতে পাব?
ছেলে ভূত ২: তাই পাবেন।
ছেলে ভূত ১: চেয়ে দেখুনই না।
রতন: উঁ – আমার এখন জিলিপি খেতে ইচ্ছে করছে – আয় তো জিলিপি (হাঁড়িতে হাত দেয়) আরে এ তো সত্যি – বাব্বাঃ কী গরম – খাব? (এদিক ওদিক তাকায়, তারপর খায়) কী ভালো খেতে রে! (চোখ বুজে খায়, ভূতেরা একটু দেখে ধীরে ধীরে চলে যায়)
রতন: (চোখ খুলে) আহা কী খাওয়ালে বাবা হাঁড়ি। তোমরা বেঁচে থাকো, সুখে থাকো – আরে এরা সব গেল কোথায়? আচ্ছা ওরা সব কারা ছিল? কেমন যেন – কালো কালো, ছায়া ছায়া – অ্যাঁ, ভূত নয় তো? ওরে বাবা, রাম রাম রাম রাম – আ–আমি এখন বাড়ি যাব কী করে? কী করি ? (একটু ভেবে) মানকেদের বাড়িটা কাছাকাছি – ওকেই বলি একটু এগিয়ে দিতে। রাম রাম রাম রাম – কিন্তু বেশ হাঁড়ি। ভূতের হোক আর যাই হোক । হাঁড়ি আমার মাথায় থাকুন। হাঁড়িবাবা, হাঁড়িমামা, হাঁড়িচাচা। রাম রাম রাম রাম –
রতন: মানিক, মানিক বাড়ি আছিস? ও মানিক –
মানিক: কে রে – এই রাতদুপুরে – আরে রতন – কী হল? টাকাটা পরে দেব বলেছি তো।
রতন: আরে না টাকা না, বলছি কি – আমাকে একটু বাড়ি অবধি এগিয়ে দিবি?
মানিক: মানে? তুই কি বাড়ি ভুলে গেছিস নাকি?
রতন: না তা নয়, গা টা কেমন ছমছম করছে – চল না একটু –
মানিক: অ্যাঁঃ – হ্যাঃ – ভয় – ভূতের ভয়? হোঃ হোঃ হোঃ হোঃ –
রতন: (চটে গিয়ে) এতে হাসার কী হল শুনি? ভূতকে সবাই ভয় পায় –
মানিক: (হাসতে হাসতে) ভূত? ভূত আবার কী? ভূত বলে কিছু নেই। যা নেই তার ভয়ও নেই – যা বাড়ি যা।
রতন: নেই? বললেই হল নেই? নেই তো এটা কী শুনি?
মানিক: ওটা আবার কী – ওটা তো একটা হাঁড়ি – হাঁড়িভূত নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ –
রতন: না, হাঁড়িবাবা, হাঁড়িমামা, হাঁড়িচাচা।
মানিক: হাঁড়িচাচা?
রতন: হুঁঃ হুঁঃ, হাঁড়ি, চা চা – কী খেতে চাস - চা।
মানিক: চা? না আমি রাতবিরেতে চা খাই না।
রতন: আরে না না – এ খোদ ভূতের দেওয়া হাঁড়ি – যা খেতে চাইবি, তাই পাবি। (মানিক হেসেই চলে) কী বিশ্বাস হচ্ছে না? কী খাবি বল – রসগোল্লা, পান্তুয়া? আয় তো রসগোল্লা – (হাঁড়ির ভেতর থেকে মিষ্টি বের করে দেয়), আয় তো পান্তুয়া – (আবার বের করে দেয়)
মানিক: (হাসি থেমে যায়, হাঁ করে তাকায়) খাব?
রতন: খা, খা –
মানিক: (একটু ভেঙ্গে খায়, লোভে চোখ চকচক করে) (স্বগতঃ) আরিব্বাস, এ তো দারুণ জিনিস। এটা বাগাতেই হচ্ছে। (জোরে) নাঃ – ঠিকই বলেছিস রতন, সত্যি ভূত আছে। এত রাতে তোর আর বাড়ি ফেরা ঠিক হবে না, তুই থেকে যা, কাল বাড়ি যাস।
রতন: কিন্তু খেন্তি –
মানিক: খেন্তি ঠিক থাকবে, তোকে আমি জেনেশুনে ভূতের খপ্পরে যেতে দিতে পারব না রে – চল চল – (রতন এক কোণে ঘুমোচ্ছে, মানিক হাঁড়ি বদলে দেয়) (পরদিন সকাল)
রতন: চলি ভাই। তুই আমার খুব উপকার করলি।
মানিক: আরে ঠিক আছে ঠিক আছে। (স্বগতঃ) তুই যে আমার কী উপকার করলি তা তো জানিস না – হিঃ হিঃ – (প্রস্থান)
রতন: খেন্তি অ খেন্তি, দ্যাখ কী এনেছি। শিগগির আয়।
খেন্তি: কী ব্যাপার, ছিলে কোথায়?
রতন: পরে বলছি। আগে দ্যাখ কী এনেছি – (হাঁড়ি দেখায়)
খেন্তি: বাঃ বেশ সরেস হাঁড়িখান। দাও ভাঁড়ারঘরে তুলে রাখি।
রতন: ওরে ভাঁড়ারঘরে নয়, ভাঁড়ারঘরে নয়, ঠাকুরঘরে।
খেন্তি: সে আবার কী?
রতন: ইনি স্বয়ং অন্নপূর্ণা রে। (গান)
হাঁড়ি আমার স্বয়ং মা অন্নপূর্ণা তুমি পায়েস পোলাও যা চাও তাই পাও চাও তো পাও কালিয়া কোর্মা হাঁড়ি আমার স্বয়ং মা অন্নপূর্ণা।(গড় করে) হাঁড়িওম তৎসৎ। আর তোকে হাত পুড়িয়ে রাঁধতে হবে না, যা খেতে চাইব তাই পাব।
খেন্তি: কী বকছ কী? মাথাটা বিগড়োল নাকি?
রতন: আরে দ্যাখই না। কী খাবি বল। পোলাও, কালিয়া, লুচি? আয় তো লুচি – (হাঁড়ি দেখে, কিছুই নেই), আয় তো মণ্ডা (হাঁড়ি দেখে), আয় তো কালিয়া, জিলিপি – (কিছুই আসে না, হতভম্ব হয়ে যায়)
খেন্তি: এদিকে আমার ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে, আর সারারাত কোন গোবরগাদায় কাটিয়ে উনি এসেছেন মশকরা করতে। ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিতে হয় – হুঁ: – (প্রস্থান)
রতন: এটা কী হল? কাল তো দিব্বি – আজ আসছে না কেন? আমাকে ঠকাল! ইইই- ভূতেরাও আমাকে ঠকাল! নাঃ, আমি ছাড়ব না। আজ আবার যাব। দেখাচ্ছি ভূত ব্যাটাদের। একটা খাব দুটো খাব -
রতন: (গাছের পেছনে) একটা খাব দুটো খাব, সাত ব্যাটাকেই চিবিয়ে খাব।
ছানা ভূত: ও দাদু, আবার এসেছে গো।
কর্তা ভূত: তাই তো, হাঁড়িটা দিলাম, তাতেও হল না?
ছেলে ভূত ২: বেশ রেগে আছে মনে হচ্ছে।
গিন্নি ভূত: ওগো আমাদের কী হবে গো, আমরা বুঝি এবার ধনেপ্রাণে গেলাম গো –
মেয়ে ভূত: হায় হায় গো –
বৌ ভূত: কী সর্বনাশ গো –
ছেলে ভূত ১: ওঃ আবার সেই সানাইয়ের পোঁ – তোমরা থামবে?
কর্তা ভূত: (ভেবে) খাবারে তো হল না, এখন টাকাপয়সা দিয়ে যদি কিছু হয়। মা ছাগলটা আন, ওটা নিয়ে যদি এবার ছেড়ে দেয় আমাদের –
ছানা ভূত: যদি ছেড়ে দেয় - (রতন সামনে আসে, রেগে রেগে হুঙ্কার দেয়)
রতন: একটা খাব, দুটো খাব –
ছেলে ভূত ২: দোহাই মশাই –
মেয়ে ভূত: খাবেন না দয়া করে –
কর্তা ভূত: এই নিন, এই ছাগলটা নিন, এটা নিয়ে এবারের মত মাফ করে দিন।
রতন: ছাগল? ছাগল কী করব? আমি ছাগলের কারবার করি না।
কর্তা ভূত: এ যে সে ছাগল নয় মশাই, এ হাসলে হয় কী – একবার হাসিয়েই দেখুন –
রতন: বোকা পেয়েছ আমায় না? ছাগল কখনো হাসে?
ছেলে ভূত ১: হাসে হাসে। এ ছাগল হাসে।
ছেলে ভূত ২: হাসিখুশি ছাগল।
রতন: আচ্ছা বেশ। (নানা অঙ্গভঙ্গি করে, বাঁদরের মত গা চুলোকোয়, ছাগল হাসে না। তখন ছাগলকে বলে) মনে কর একজন লোক আসছে, তার এক হাতে কুলপি বরফ, আরেক হাতে সাজিমাটি, আর লোকটা কুলপি বরফ খেতে গিয়ে ভুলে সাজিমাটি খেয়ে ফেলেছে – হেঃ হেঃ – কী হল ? আচ্ছা এইটা শোন – একজন লোক ছিল, সে ভয়ঙ্কর নাক ডাকাতো, একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদ্দম মারতে লেগেছে – হাঃ হাঃ হাঃ – (আস্তে আস্তে হাসি থামিয়ে ভূতেদের দিকে তাকায়)
কর্তা ভূত: আরে কাতুকুতু দিয়েই দেখুন না –
রতন: বলছ? দেখি – (কাতুকুতু দেয়, ছাগল হাসে, মোহর পড়ে, রতন অবাক) – মোহর? হাসলেই মোহর? (ভূতেরা ঘাড় নাড়ে, রতন আবার কাতুকুতু দেয়, মোহর পড়ে, ভূতেরা আস্তে আস্তে চলে যায়)
রতন: বাঃ, দারুণ তো! হেঃ হেঃ ছাগল কেমন হাসে, হেঃ হেঃ। কূর্ম বরাহ সব হয়েছিলেন, এবার এই একাদশ অবতার – অজাবতার । এটা মানকেকে দেখাতেই হচ্ছে। আসুন, ছাগল ঠাকুর, চলুন – আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।
রতন: মানিক মানিক -
মানিক: ইয়ে, রতন, মানে তোর টাকাটা পরে –
রতন: আরে রাখ তোর টাকা। ঐ কটা টাকার আমার আর দরকার নেই।
মানিক: সে কী! হঠাৎ কী হল? গুপ্তধন পেলি নাকি?
রতন: হুঁ হুঁ, গুপ্তধনের বাবা –
মানিক: বলিস কী! কী জিনিস রে?
রতন: এই যে ছাগল –
মানিক: আহা, বেশ পাঁঠা। যেমন কচি, তেমনি নধর –
রতন: ওরে না না। এ সে ছাগল নয়, শ্রী শ্রী একশো আট বাবা অজাবতার –
মানিক: অজাবতার?
রতন: আরে অবতার বুঝিস না? এ একটিবার হাসলেই – হুঁ হুঁ –
মানিক: ছাগল হাসবে? (স্বগতঃ) নাঃ মাথাটা সত্যিই বিগড়েছে। হবে না? হাঁড়ির শোক। (রতনকে) তুই বোস, একটু শরবৎ খেয়ে ঠাণ্ডা হ। (রতন ছাগলকে কাতুকুতু দেয়, ছাগল হাসে, মোহর পড়ে, শব্দ শুনে মানিক ফিরে তাকায় এবং অবাক হয়ে যায়। তার চেহারা দেখে রতন বেশ হাসিহাসি মুখ করে পায়ের ওপর পা তুলে নাচাতে থাকে)
মানিক: একী! আমি কি স্বপ্ন দেখছি? (চোখ কচলে দেখে) নাঃ। (নিজেকে চিমটি কাটে) উঃ! না না, জেগেই তো আছি। ওঃ কত মোহর! নাঃ, এটা ছাড়া চলবে না। (জোরে) রতন, তুই ঠিকই বলেছিস রে – এ সাক্ষাৎ ছাগ বাহাদুর। এর পায়ের ধুলো নিলেও পুণ্য। (পায়ের ধুলো নেয়) তা ভাই, রাত হল – কী খাবি বল। উনিই বা কী খাবেন?
রতন: আহা ও কি একটা ব্যস্ত হবার জিনিস? আমি কি তোর কাছে পোলাও মাংস খেতে চাইব? যা হয় দে। ওকেও দুটো ঘাসপাতা দিলেই হবে।
মানিক: আহা, যেন ভোলানাথ। বেলপাতাতেই তুষ্ট। যাই দেখি, কী ব্যবস্থা হয়। (একটু পরে খাবার নিয়ে ফেরে)
রতন: অ্যাঁ! এ কী রে! এ যে সত্যিই পোলাও মাংস।
মানিক: আহা, তুই মুখ ফুটে বললি –
রতন: (খেতে খেতে) তুই সত্যি আমার বন্ধু রে মানিক। কত ভালবাসিস আমাকে।
মানিক: সে আর বলতে – তোকে, (ছাগলের দিকে তাকিয়ে) ওকে। তাহলে তুই শুয়ে পড়, আমি ওকে ভেতরে নিয়ে যাই –
রতন: হ্যাঁ হ্যাঁ। [সকালবেলা। রতন ঘুম থেকে উঠে আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ কচলায়। ]
রতন: এঃ হে, দেরি হয়ে গেল। [তৈরি হতে হতে] মানিক, মানিক –
মানিক: [নেপথ্যে] আসছি। [এসে ঢোকে] চললি?
রতন: ছাগলটা –
মানিক: হ্যাঁ, নিয়ে আসি, আর মায়া বাড়াব না – [ছাগল নিয়ে আসে]
রতন: বাবাঃ – এ তো বড় হয়ে গেল দেখছি –
মানিক: হ্যাঁ, বাড়ের বয়স কিনা –
রতন: এক রাত্রে এতটা –
মানিক: বাড়ে রে রতন, বাড়ে। এই আমাদের কথাই ধর – পাঠশালায় কেমন ছোট্টটি ছিলাম – আর এখন দ্যাখ –
রতন: বাড়ে, না?
মানিক: বাড়ে বৈকি। তার ওপর এ হল গে তোর ভৌতিক ছাগল –
রতন: (বোকা হেসে) হে হে, তাই এমন বর্ধিষ্ণু – [মানিক পিঠে হাত বুলিয়ে দড়িটা ধরিয়ে দেয়। রতন রওনা হয়।]
রতন: খেন্তি, অ খেন্তি – শিগগির আয় –
খেন্তি: ও মা – কী পুরুষ্টু পাঁঠা গো। কিন্তু শুধু পাঁঠা আনলেই হবে? তেলমশলার জোগাড় কে করবে শুনি?
রতন: বালাই ষাট বালাই ষাট। কুনজর দিস না খেন্তি, মনে অমন পাপচিন্তা ঠাঁইও দিস না। (ছাগলকে জড়িয়ে) আমার যেমন পাঁঠা তেমনি রবে নজর দিও না / ওগো নজর দিও না গো কোপ বসিও না –
খেন্তি: এ আবার কী রঙ্গ? পুষবে নাকি?
রতন: পুষব? পুষব কী রে – ইনিই আমাদের পুষবেন –
খেন্তি: ইনি? অ। কাল তো অন্নপূর্ণা এসেছিলেন – ইনি এবার কিনি?
রতন: কমলা –
খেন্তি: কমলা কোথায়? এ তো কুচকুচে কালো –
রতন: জ্যান্ত মা লক্ষ্মী। আর আমাদের অভাব থাকবে না রে – এবার শুধু হাসিখানি মিষ্টি, মোহরের বৃষ্টি –
খেন্তি: (কপাল চাপড়ে) আমার অদৃষ্টি! কিসের হাসি, কিসের মোহর – তুমি কি এবার গাঁজা ভাঙ ধরলে নাকি – এ গুণ তো ছিল না। [ঝাঁটা তোলে]
রতন: না না, কী মুশকিল। [গোপন কথা বলার মত] এই যে ছাগল – এ যখনই হাসে, মোহর পড়ে। (গান)
ফিরে যাবে মোদের বরাত দিলে সুড়সুড়ি হেসে ঝুড়ি ঝুড়ি পড়বে ঝন ঝন ঝনাৎ কত মোহর চাই শুধু বল – হাজার – লাখ?
খেন্তি: (গান)
আহা মরি মরি কী কথার ছিরি শুনে লেগে যায় তাক পাঁঠা নাকি হেসে দেবে ভালোবেসে মোহর লাখ লাখহ্যাঃ, মাসীর গোঁফ গজালে মামা হবে। ঘোড়ার ডিম ফুটে পক্ষিরাজ বেরোবে। ছাগল হাসবে, তাতে মোহর ঝরবে। রোসো, তোমার নেশা ছোটাচ্ছি –
রতন: আহা আহা, অবিশ্বাসের কী, এই দ্যাখ – [কাতুকুতু দেয় – একবার, দুবার, বারবার] – হল কী গো – ঠাকুরের মুখখানি ভার কেন – বাবা হাসো তো দেখি বাবা হাসো তো দেখি বাবা হাসো তো দেখি – হল কী – একটু হাসুন কত্তা, হাসিমুখটি দেখতে বেশ – হাসো বাপধন, ওরে হাস রে, এই তোর খুরে খুরে দণ্ডবৎ - হাস মানিক, ভালো চাস তো হাস বলছি, আরে শোন না – একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়েখাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে – [ছাগল ‘ব্যা’ গর্জন করে লাথি মারে। রতন উল্টে পড়ে। ছাগল তেড়ে এসে ঢুঁসোয়। তারপর দরজার দিকে যায়। গিন্নি ধরবে বলে এগোয়। ছাগল ঘাড় ঘুরিয়ে গর্জন করে। গিন্নি পিছিয়ে আসে। ছাগল বেরিয়ে যায়।]
রতন: উরে বাবা রে। মা রে। পিসতুতো দাদা রে। আমার নাক থেঁতলো করে দিল রে। মেরে ফেলল রে। মরে ভূত হয়ে গেলাম রে । হুঁ হুঁ ভূত – এ ভূতের তেজ না হয়ে যায় না। হতভাগারা আমাকে আবার ঠকাল। আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব – উঃ – গেলাম রে –
রতন: একটা খাবো দুটো খাবো সাত ব্যাটাকেই চিবিয়ে খাবো [নাকে হাত বুলোতে বুলোতে হুঙ্কার দিয়ে পায়চারি করতে করতে পেছনে যায়]
ছেলে ভূত ২: ও বাবা –
কর্তা ভূত: শুনেছি।
ছানা ভূত: শুনেছেন।
গিন্নি ভূত: ওগো বার বার তিনবার, এবার আর রক্ষে নেই গো –
বৌ ভূত: আচ্ছা মা – ওরা কি আমাদের কাঁচা খায়, না রসুনমরিচ দিয়ে ঝোল করে -?
গিন্নি ভূত: হায় হায় এ কাদের বাড়ির মেয়ে গো – কী সাংঘাতিক কথা গো –
মেয়ে ভূত: আমার হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধুচ্ছে গো –
ছেলে ভূত ১: শুধু হাত পা কেন – আপাদমস্তক পুরোটাই পেটে সেঁধুবে, ঐ মানুষটার পেটে –
কর্তা ভূত: নাঃ, এর একটা ফয়সালা দরকার।
ছানা ভূত: ফয়সালা দরকার।
ছেলে ভূত ২: কিন্তু এবার আমরা কী দেব? আর কী আছে?
ছেলে ভূত ১: না না – দিয়েও তো নিস্তার পাচ্ছি না। এ তো দৈনিক বিপদ।
কর্তা ভূত: রোজ রোজ এই শাসানির চোটে খিদে ঘুম সব যেতে বসেছে।
ছানা ভূত: যেতে বসেছে।
ছেলে ভূত ১: (ছানার কান ধরে) মোটেও যেতে বসেনি। বেম্মদত্যি ঠাকুরের টোলে গিয়েও ঘুমোচ্ছিলি। হ্যাঁ চলো – একটা এসপার ওসপার হয়ে যাক। [রতন একদিকে। ভূতেরা দল বেঁধে সেদিকে যায়। আবহে সুরঃ চল চল চল]
রতন: না না না, আমি কোন কথা শুনতে চাই না। ভূত হয়ে প্রতারণা? ছি ছি। ভূতের ওপর বিশ্বাসটাই চলে গেল।
কর্তা ভূত: প্রতারণা? কী বলছেন মশাই?
রতন: চালাকি করে লাভ হবে না হ্যাঁ – আমি সব ধরে ফেলেছি। প্রমাণও আছে।
ছেলে ভূত ২: প্রমাণ?
রতন: এই যে আমার নাক। ও হো হো, ছাগলকে কাতুকুতু দিয়ে কী হেনস্থা –
ছেলে ভূত ১: বলেন কী! আমাদের ছাগল?
রতন: উঃ এ তো আমার চেয়েও হাঁদা। আবার কার ছাগল?
কর্তা ভূত: আমাদের ছাগল! উঁহু, ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে ঠেকছে। মশাই সব খোলসা করে বলুন তো কী কী হয়েছে? [রতন হাত পা নেড়ে মানিকের বাড়ি যাওয়া, হাঁড়ি দেখানো, ঘুম, হাঁড়িতে ফক্কা, খেন্তির ঝাঁটা, ছাগল, মাণিকের বাড়ি, মোহর, পোলাও মাংস, ছাগলের হাসি বন্ধ, লাথি সব দেখায়। ভূতেরা শুনেটুনে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নেয়।]
কর্তা ভূত: অ – এই ব্যাপার। এ তো সব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
রতন: কী? কী বোঝা যাচ্ছে? কোথায় বোঝা যাচ্ছে?
ছেলে ভূত ১: কেন ঐ পোলাও-মাংসতেই তো সব বোঝা যাচ্ছে।
রতন: দেখো বাপু, এই রাতদুপুরে ঠাট্টা তামাশা মোটেও ভাল লাগছে না। একে মরছি নাকের জ্বালায়। উল্টোপাল্টা হেঁয়ালি না করে সিধে কথাটা কও দেখি। না হলে –
কর্তা ভূত: আহা চটেন কেন, একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুনই না –
রতন: কী ভাববটা কী?
কর্তা ভূত: আচ্ছা – ঐ রাতদুপুরে আপনার বন্ধু হঠাৎ পোলাও মাংস পেল কোথায়?
রতন: পেল কোথায়? (চিন্তা করে) আরে তবে কি, তবে কি হাঁড়িটা –
ছেলে ভূত ২: অ্যা-ই। আর হাঁড়ি যার কাছে, ছাগলও তারই কাছে। [রতন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।]
কর্তা ভূত: আহা, ভেঙে পড়ছেন কেন মশাই? হাঁড়ি, ছাগল সব ফেরত পাওয়ার ওষুধও আমাদের কাছে আছে।
রতন: ওষুধ?
কর্তা ভূত: (ছেলের দিকে তাকিয়ে) যা, ওইটে নিয়ে আয় তো (হাতে লাঠি দিয়ে মারের ভঙ্গি) –
ছেলে ভূত ১: ওইটে! না না ওইটে দিয়ে দিলে আর (ছানাকে দেখিয়ে)এইটেকে মানুষ করা যাবে না। এর পরকালটি ঝরঝরে হয়ে যাবে।
কর্তা ভূত: হুঁ, ওই দিয়ে যদি মানুষ করা যেত তাহলে তুই আর এমন আকাট হলি কেন! যা যা, মেলা বকিস না। নিয়ে আয় ঝটপট । [ছেলে বেজারমুখে ‘লাঠি’ নিয়ে আসে।]
রতন: এ কী! মারবে নাকি?
কর্তা ভূত: আহা আপনাকে না, আপনাকে না। এটা নিয়ে যান। একে শুধু বলবে্ন “লাঠি লাগ তো” আর “লাঠি থাম তো”।
ছেলে ভূত ২: তারপর মজাটা দেখবেন।
রতন: হে হে - তাই? ভারি মজা? লাঠি – [লাঠি টানটান হয়ে যায়]
সবাই: আরে আরে এখানে না, এখানে না – [লাঠি আগের মত হয়ে যায়]
কর্তা ভূত: আপনার ওই বন্ধুর বাড়ি – কেমন – বন্ধুর বাড়ি –
রতন: মানিক, মানিক, বাড়ি আছিস?
মানিক: কে? ও রতন, আয় আয়।
রতন: আজ এমন একটা জিনিস এনেছি না – আমি হলফ করে বলতে পারি – এমনটা তুই কক্ষণো দেখিসনি।
মানিক: (লোভী চোখে) তাই? কই দেখা দেখা।
রতন: দেখাব বলেই তো আসা। (লাঠি এগিয়ে ধরে)
মানিক: অ। একে ঝাঁকালেই মোহর পড়বে? (ধরে ঝাঁকায়, রতন ঘাড় নাড়ে) তবে? খাবারদাবার? (রতন ঘাড় নাড়তে থাকে) তাহলে?
রতন: এই দ্যাখ। লাঠি – (লাঠি টানটান) – লাগ তো। [লাঠি মাণিকের ওপর পড়ে। মানিক পালায়, লাঠি তাড়া করে মারতে থাকে। মানিক পেছনে হেলে, লাঠি তার ওপর ঝুঁকে একটু দোল খায়, তারপর মারে । চলতে থাকে।]
মানিক: এ কী! এ কী! উঃ আঃ – ওরে বাবারে, মেরে ফেলল রে, বাঁচাও –
রতন: বল আমার হাঁড়ি কোথায়, বল আমার ছাগল কোথায়?
মানিক: আমি – আমি জানি না – উরে বাবারে – মরে গেলাম রে –
রতন: সত্যি কথা বল, নইলে লাঠি থামবে না।
মানিক: উঃ আ, বলছি বলছি। আমিই নিয়েছি। উরে বাবারে, নিয়ে যা ভাই – তোর হাঁড়ি, ছাগল সব নিয়ে যা, এই সর্বনেশে লাঠিকে থামা। উ আঃ বাবারে –
রতন: উঁহু, আগে আন আমার হাঁড়ি, আন আমার ছাগল।
মানিক: আনছি আনছি – (ভেতরে যায়, নিয়ে আসে) – এই নে ভাই তোর জিনিস – ওরে বাবা – তোর পায়ে পড়ি, এবার থামা বাপ।
রতন: দাঁড়া দাঁড়া আগে দেখি সত্যিই এগুলো সেগুলো কিনা, তোকে বিশ্বাস নেই। আয় তো আমার জিবেগজা (বার করে) – হে হে – সত্যি – আঃ দিব্বি খেতে। (ছাগলকে একটু দূর থেকে সাবধানে কাতুকুতু দেয়, মোহর পড়ে, এবার কাছে গিয়ে নিশ্চিন্তে দেয়) হে হে, এটাও সত্যি। (বসে বসে চোখ বুজে জিবেগজা খায়)
মানিক: থামা রে –
রতন: হ্যাঁ, যাঃ তোকে ছেড়ে দিলাম – লাঠি থাম তো। (লাঠি থেমে গিয়ে রতনের কাছে চলে আসে)
মানিক: (বসে বসে কাতরায়) উঃ আঃ উঃ –
রতন: যার যা ওষুধ, কী করবি বল? চল মা অন্নপূর্ণা, চল মা লক্ষ্মী – (প্রস্থান)
খেন্তি: কী কাণ্ড! আর আমাদের অভাব থাকবে না গো। এতদিনে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন।
রতন: উঁহু উঁহু, ভগবান নয়, ভূত, ভূত। হ্যাঁ, তবে বলতে পারিস ভূত ভগবান। আঃ পেটভরে খেতে পাব রে।
খেন্তি: জমিদারগিন্নির ধুতি গামছার কী করবে?
রতন: কী আবার করব? বানাব। ভূতে তো আর কাপড়ের থলে দেয়নি। একটা কথা ভাবছি –
খেন্তি: কী?
রতন: মানে গিন্নি মা ব্রাহ্মণভোজন করাচ্ছেন, আমরাও একটু ভোজন করাই না। কাল যদি সবাইকে একটু নেমন্তন্ন করে খাওয়াই –
খেন্তি: ভালোই তো, আমাকে তো আর রাঁধতে হবে না, হাঁড়ি তো আছেই।
রতন: না না, নিজের হাতে কিছু না করলে চলবে কেন? সবই ভূতের রান্না? এক কাজ কর, তুই সবার জন্য ইয়ে বানা –
খেন্তি: কী?
রতন: কী বল তো?
খেন্তি: কী?
রতন: পিঠে, পিঠে – (খেন্তি হাসে) – আমার জন্য সাতটা – (দুজনে হাসতে থাকে)
(গান)
আর আমাদের ভাবনা নাই খিদের মুখে খাবার পাই দুয়ারখানা খোলাই আছে দল বেঁধে সব আয় রে আয় সব ভালো যার শেষ ভালো লোভের থাবা মিশকালো সেই থাবাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে হাত ধরে সব চল দাঁড়াই[সব কুশীলব সামনে এগিয়ে আসে। সার বেঁধে দর্শকদের অভিবাদন জানায়।]
[পর্দা]