এটা কোনো গল্প নয়। গল্প আমি লিখতে পারিনা। যা যা ঘটেছিল সেই দিনগুলোতে, পরপর লিখে যাচ্ছি খালি। এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পাই সেই পলেস্তরা খসা দেওয়াল, চটে যাওয়া আয়না, ঝুল-কালিতে কালো হয়ে যাওয়া পিতলের কল—ঘুলঘুলি থেকে ঠিকরে পড়া এক চিলতে রোদ্দুর—তার মধ্যে ভেসে বেড়ানো অসংখ্য ধূলোর কণা আর বাকি ঘরটাতে জমে থাকা গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার। দেখতে পাই সেই ঘুণধরা বিশাল কালো কাঠের দরজা, হ্যাচবোল্টে ঝোলানো কবেকার কালচে মেরে যাওয়া তালা, মাকড়সার জাল আর লম্বা সরু ঝুপসি করিডর। আর—আর সেই জ্বলন্ত স্থির দুটো বিন্দু।
গলাটা শুকিয়ে গেছে। একটু জল খাই। জল খেয়ে আবার লিখছি।
তখন পড়ি কলেজে। আমাদের কলেজটা ছিল অন্যরকম। কলকাতার পুরোনো বিশাল বাড়িগুলোর মধ্যে একটা। লম্বা টানা বারান্দা, মোটা মোটা থাম, সারি সারি ঘর। সেই দেড়তলা উঁচু ঘরের মধ্যে দেড়মানুষ সমান জানলার পাশে বসে আমরা ক্লাস করতাম। আর দুই ক্লাসের মধ্যে কিম্বা টিচার না এলে ঐ জানলারই তাকে বসে পা ঝুলিয়ে আড্ডা দিতাম। টিপিনের সময় ক্যান্টিনের নড়বড়ে কাঠের বেঞ্চিতে বসে রুটি আর আলুরদম খেতে খেতে একে অন্যের গায়ে জল ছুড়তাম, তুচ্ছ কারণে হেসে গড়িয়ে পড়তাম আর তারপর হাতে চা নিয়ে সামনের দালানে গোল হয়ে বসে পরমানন্দে গান-বাজনা করতাম। এখন ভাবলে কেমন একটা লাগে। এই দিনগুলোও কোনোদিন সত্যি ছিল আমার জীবনে!!! হয়তো বা।
প্রথম ঘটনাটা ঘটলো একটা বৃহস্পতিবার। আমার মনে আছে। শনিবারের বারবেলা শুনেছি। কিন্তু সেদিন বৃহস্পতিবারের বারবেলায় আমরা ক্লাস করছিলাম মন দিয়ে। এম.জি.-র ক্লাস, মন দিয়ে না করে উপায়ও নেই। একটু ঘাড় ঘুরিয়েছি কি ঠাণ্ডা চোখে তাকাবেন। কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠেনা। যে-ঘরে তখন আলপিন পড়লেও শব্দ হবে, সেই ঘরে শব্দটা যেন হাতুড়ির মতো মাথায় এসে পড়লো। আমরা সবাই চমকে তাকালাম। কে একটা প্রাণপণে দরজা ধাক্কাচ্ছে। ধাক্কিয়েই যাচ্ছে। ঠকঠক ঠকঠক। এম.জি. খুব বিরক্ত তেতো মুখে দরজা খুললেন। আমরা ভাবছি কার এত বড় সাহস যে এম.জি.-র ক্লাসে দরজা ধাক্কায়!! ক্লাসে আসতে এক মিনিট দেরি হলেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়, সেদিন বাইরে বসে কাটাতে হয়—আর এ কে যে দেরি করে এসে আবার দরজা পেটাচ্ছে!!
কিন্তু না, বাইরে কেউ নেই—যেই হোক না কেন ভয় পেয়ে চলে গেছে। হতেও পারে কলেজের কোনো নন-টিচিং স্টাফ। কোনো দরকারে এসেছিল।
সবে একটা ইকুয়েশন সল্ভ হয়েছে, পরেরটা ধরতে যাবেন স্যার, আবার সেই ধাক্কার আওয়াজ। যেন কেউ দরজাটা খোলার জন্য আকুতি করে যাচ্ছে। আর এবারও কেউ নেই। নিশ্চয় কেউ বদমায়েশি করছে।
তৃতীয়বার যখন আওয়াজ টা হল স্যার গটগট করে করিডরে বেরিয়ে গিয়ে হুঙ্কার ছাড়লেন। আমরা থ হয়ে গেছি। কারণ আওয়াজটা এখনো হচ্ছে। আগের দুবারের মতো বন্ধ হয়ে যায়নি। দড়াম দড়াম করে কেউ পাগলের মতো দরজায় আছড়াচ্ছে। কড়া নাড়ছে। তাহলে কি কেউ কোথাও আটকা পড়ে গেছে? আমরা ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। দু-চারজন অন্য লোকও জমা হয়েছে। মনে হল আওয়াজটা আসছে করিডরের এক্কেবারে শেষ দিকটা থেকে। ওদিকটায় কেউ তেমন যায়না। যত রাজ্যের কাঁচ ভাঙা পাল্লাখোলা আলমারি, তার মধ্যে বাতিল হওয়া যন্ত্রপাতি, টেস্টিং বেঞ্চ এইসব হাবিজাবি রাখা থাকে। আলমারিগুলোর উল্টোদিকে একেবারে শেষ ঘরটা একটা অব্যবহৃত লেডিস টয়লেট। এমনি কেউ যায়না, তবে সুইপাররা মাঝে মধ্যে বালতি, ঝাঁটা এসব রাখে-টাখে। তারই ঝুল-কালি মাখা দরজাটা ভেতর থেকে কেউ মরিয়া হয়ে ধাক্কাচ্ছে।
ব্যাপারটা বোঝা গেল। কলেজে কতোরকম লোকজন আসে। তারই মধ্যে নতুন কোনো মহিলা বোধহয় টয়লেটে ঢুকেছেন, সুইপাররা কেউ বুঝতে না পেরে বাইরে থেকে হ্যাচবোল্ট লাগিয়ে দিয়েছে।
দরজা খুলতে গিয়ে কিন্তু দেখা গেলো দরজায় তালা লাগানো। ভেতর থেকে তখন পাওয়া যাচ্ছে শুধু গোঙানির শব্দ। আমরা বাইরে থেকে মহিলাকে চেঁচিয়ে আশ্বস্ত করছি—ভয় পাবেন না, এক্ষুনি দরজা খোলা হচ্ছে। চাবি আনতে গেছে। মহিলার তখন আর কথা বলারও ক্ষমতা নেই। শুধু মাঝেমধ্যে দরজাটায় একটু ধাক্কা দিচ্ছেন আর কাতরাচ্ছেন। ওদিকে যারা চাবি আনতে গিয়েছিল অফিসে, তারা অনেক খুঁজেপেতে একটা চাবির গোছা নিয়ে ফিরেছে। ততক্ষণে এই তলার সুইপার দুলালদাও এসে গেছে। সবাই তো তাকে এই মারে কি সেই মারে।
‘ভেতরে লোক আছে না দেখেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছো! এখন যদি কিছু হয়।'
দুলালদা কিন্তু প্রবলবেগে ঘাড় নাড়ছে—‘নাহি সাব আজ আমি এ দরজাই হাতই দিইনি।'
‘ঠিকাছে ঠিকাছে, আগে চাবিটা বেছে দরজাটা শীগগিরি খোলো।’
ওদিকে ভেতর থেকে আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। ওই গুমোট ঘরে এতক্ষণ ধরে বন্ধ থেকে আতঙ্কে, ভয়ে ভদ্রমহিলা বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন। কি সাঙ্ঘাতিক! দুলালদা বিড়বিড় করতে করতে তালাটা খুলে দরজা ঠেললো। কিন্তু দরজা খুললো না। খুলতে গেলেই বারবার আটকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেতর থেকেও দরজার ছিটকিনি দেওয়া। আমরা চেঁচালাম ‘দিদি ছিটকিনিটা খুলুন। দিদি –' কিন্তু না—কোনো সাড়া শব্দ নেই, মহিলার বোধহয় সত্যিই আর জ্ঞান নেই। অগত্যা ঠিক হল সবাই মিলে দরজা ভেঙে ফেলা হবে। কিন্তু আগেকার দিনের মজবুত কাঠের দরজা। ভেঙে ফেলা কি এতই সহজ! অনেক ঠেলাঠেলির পর ভেতরের ছিটকিনি ভেঙে পড়লো। আমরা মেয়েরা আগে ঢুকলাম। কিন্তু—কিন্তু কোথায় কি, ভেতরে কতগুলো বালতি-ঝাড়ন ছাড়া আর কিছুই নেই। প্যাঁচকাটা কল থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে, মাকড়সা হেঁটে বেড়াচ্ছে মেঝেতে, একটা ভাঙা কাঠের আলমারিতে ফিনাইলের বোতল, দড়িন্যাতা, মগ হ্যানত্যান রাখা। কিন্তু কোনো মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। একদিকে একটা বড় লোহার রড দেওয়া জানলা। জানলার উল্টোদিকে ক্যান্টিনের খাঁড়া সিমেণ্টের দেওয়াল উঠে গেছে। জানলার এদিকে বা ওদিকে সব ফাঁকা। আমরা ছাড়া অন্য কেউ নেই।
পুরো ব্যাপারটা কেমন ধাঁধা মতোন লাগলো। তাহলে কেই বা শব্দ করছিলো, কারই বা গোঙানির আওয়াজ শুনলাম আমরা। কিছুই বুঝতে পারলাম না। এম.জি. বললেন ‘তুচ্ছ ব্যাপার, বিড়াল-কুকুর কিছু জানলা দিয়ে ঢুকে দরজায় শব্দ করছিলো। এছাড়া আর কিই বা হবে? কিম্বা দেখো সুইপার-টুইপারদের কোনো বাচ্চা ছেলে রডের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়েছিলো।’
ঘটনাটার আর কোনো ব্যাখ্যা পেলাম না। জানলাটা ভালো করে দেখলাম। রডের ফাঁকগুলো এমন কিছু বড় নয় যে তার মধ্যে দিয়ে বাচ্চা ঢুকতে পারে। বিড়াল-কুকুর হয়তো পারে, কিন্তু বিড়াল-কুকুর কি এমন পাগলের মতো শব্দ করতে পারে? কি জানি। আর বিড়াল-কুকুর যদি শব্দ নাই করে তবে কি হাওয়ায় শব্দ করছিলো? তা কি করে হয়!
টিক টিক টিক টিক।
চমকে উঠে উপরে তাকালাম। সামনে পলেস্তরা-খসা দেওয়ালে একটা ধূসর রঙের বড়ো টিকটিকি। তার নিষ্পলক কালো চোখদুটো আগুনের মতো জ্বলছে। দেওয়ালের গায়ে কতদিনের নোনা ধরে কি রকম যেন অদ্ভুত সব ছাপ হয়ে আছে। আবছা আবছা কি সব জানি ফুটে উঠেছে। টিকটিকিটা লম্বা সরু লেজটাকে কেমন ভাবে নাড়াতে শুরু করলো। গা শিরশির করছে। আমি বেরিয়ে এলাম।
এরপর ছ'মাস কেটে গেছে। প্রথম দিকে বিকেলের আড্ডায় এই নিয়ে খুব আলোচনা হত। এমন কি আমরা কলেজের পিছন দিকে গিয়ে ঐ টয়লেটের জানলাটা অব্দি আবিষ্কার করেছিলাম। ক্যান্টিনেও খোঁজ নিয়েছিলাম কোনো বাচ্চা ছেলে-টেলে আছে কিনা। কলেজের ফোর্থক্লাস স্টাফরা তো অনেকেই বৌ-বাচ্চা নিয়ে কলেজের আওতার মধ্যেই থাকেন, তো তাদের কোনো বাচ্চা কিনা। কিন্তু না, সেরকম কাউকে পাওয়া যায়নি আর তাছাড়া ঐ জানলাটা গলে সত্যিই কোনো বাচ্চার পক্ষেও ঢোকা সম্ভব নয়।
আস্তে আস্তে ঘটনাটা ভুলে গেলাম। পরীক্ষার ঝামেলা তো ছিলই, তার উপরে আরো পাঁচটা লাফালাফি, হৈ চৈ। প্রতিটা দিন উৎসবের মতো কেটে যেত। কোনো একটা জিনিস নিয়ে পড়ে থাকার মতো সময় ছিলোনা। আজ ভাবি কোথায় গেলো সেসব রঙিন সকাল, উচ্ছ্বসিত দুপুর, মনখারাপের বিকেলবেলা, স্বপ্নময় রাত্রি।
আর আর সেই দমবন্ধ করা ভয়, রক্তের মধ্যেও ঢুকে পড়া অজানা আতঙ্ক। নিস্তব্ধ দুপুর আর পলেস্তরা-খসা নোনাধরা দেওয়াল।
বইটাও খুঁজে পেয়েছিলাম দুপুরবেলা। সেদিন কার যেন ক্লাস হয়নি, লাইব্রেরি গিয়েছিলাম। আমাদের কলেজের লাইব্রেরিটা ছিল দারুণ ভালো। টেক্সট বুক ছাড়াও আনাচে কানাচে কত ভালো ভালো পুরোনো বই থরে থরে সাজানো থাকতো। আর যেহেতু আমি বরাবর বইএর পোকা, সময় পেলেই ওখানে ছুটে যেতাম। লাইব্রে্রিয়ান ভদ্রলোকের অনেক বয়েস হয়েছিল। আমায় এতোটাই স্নেহ করতেন যে ইচ্ছামতোন বই ঘাঁটার ঢালাও অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন। লাইব্রেরির এক্কেবারে পিছনের দিকের তাকে ধুলোমাখা গাদার মধ্যে বইটা ছিল। এরকম আগেও অনেক পুরোনো পোকায়-কাটা বই বার করে পড়েছি। ঐ টাও সেরকমই। ‘বাঙলার লোকবিশ্বাস।’ এই ধরনের ও অন্যরকম বই পড়া ছিল আমার নেশা। এই একটা জিনিস সেদিনও যা ছিল এখনো তেমনই আছে। সবই তাহলে পালটে যায়না।
সেইদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বইটা পড়তে গিয়ে কিন্তু হকচকিয়ে গেলাম। কেউ বইটাকে তার ব্যাক্তিগত ডায়েরি হিসাবে ব্যাবহার করেছে। পাতায় পাতায় মার্জিনে মার্জিনে এক-দু লাইন করে লেখা। কোথাও কোথাও তারিখ আছে, কোথাও কোথাও নেই। এক্কেবারে প্রথম পাতায় লেখা
‘মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডে কলম ডুবিয়ে লিখছি আর সাদা পাতাগুলো আর্ত চিৎকার করছে।’
সঙ্গে প্রায় ১২ বছর আগেকার একটা তারিখ।
কথাটা ধক করে বুকে এসে লাগলো।
আরেকটা জায়গায় একটা নতুন অধ্যায় যেখানে শুরু হচ্ছে, তার পাশে লেখা—
‘প্রতিদিন দাঁতে দাঁত চিপে ভাবি আর যাবোনা আমি ঐ বাথরুমে। কিন্তু আমার উপায় নেই। কি যেন একটা টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় আমায়। ও কে আমি জানিনা। নিজেকে অনেক বুঝিয়েছি অলৌকিক বলে কিছু হয়না। আসলে আমি ভয়টাকেই ভয় পাচ্ছি। কিন্তু তাও ঐ বাথরুমটায় ঢুকলেই আমি ওর অশরীরী অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। নোনাধরা দেওয়ালটার মধ্যে আঁকিবুঁকি কিসের যেন ছবি ফুটে ওঠে। মনে হয় কেউ যেন একটা অমানুষিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একফালি রোদের মধ্যে ধুলোর কণাগুলো ঘুরে বেড়ায়। ধুলোর কণা নাকি ঐ? আমার নাক-মুখ সব কিছু দিয়ে ধুলোগুলো ভেতরে ঢুকে গিয়ে আরও ছড়িয়ে পড়ে আমার রক্তের মধ্যে, শিরায় শিরায়। আমি জানি আমি বদলে যাচ্ছি।’
পাতা উলটে চললাম। বেশ কিছুক্ষন কোনো লেখা নেই। তারপর একজায়গায় কয়েকটা লাইন— ‘আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। মানুষ কি নিজেকে কখনো ভয় পায়? আমি নিজেকে ভয় পাচ্ছি। কাল রাতে শোয়ার আগে আয়নার সামনে চুল আঁচড়াতে গিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে ভেতরটা আতঙ্কে হিম হয়ে গেলো। আমার চোখের মধ্যে থেকে ঐ চোখ দুটো তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি নিষ্ঠুর হিংস্র দৃষ্টি! ঠোঁটের কোণে জ্বলন্ত ব্যঙ্গ। আমি বুঝতে পারছি আমি আর বাঁচতে পারবোনা। ও আমাকে আর বাঁচতে দেবেনা। ওর হাত থেকে আমার নিস্তার নেই।’
মেয়েটার কি কোনো কারণে মাথায় গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল? বুঝতে পারলাম না। মার্চ মাসের একটা তারিখ দিয়ে লেখা—
‘আজ সকালে লালীকে মেরে ফেলেছি! আমি! আমার অত আদরের লালীকে। কি ভয়াবহ মৃত্যু। কি নিষ্ঠুরভাবে আমি ওকে শাবলটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারলাম। লালীর অবাক চোখদুটো থেকে জল পড়ছিলো। তাও আমার মনে একটুও মায়া হলোনা। অথচ এই বিড়ালটাকে আমি নিজের কোলে নিয়ে ঘুমাতাম।’
লেখাগুলো বিশ্বাস করবো কি করবো না ঠিক বুঝতে পারলাম না। কোনো ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে লেখেনি তো?
‘আমি আজ কিছুতেই বাথরুটা থেকে পালাতে পারছিলাম না। কালো কালো চাপ চাপ অন্ধকার আমায় ঘিরে ধরছে। আমার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। অসীম অন্ধকারের মধ্যে আমি আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছি। চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে যাচ্ছে। অথচ দেওয়ালের ঐ—ঐ ভয়ঙ্কর দৃষ্টি একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চাইলেও চোখ সরাতে পারছিনা। আতঙ্কে আমার হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। আমি দরজাটা খুলতে চাইছি কিন্তু টিকটিকিটা ঠিক ছিটকিনির উপর বসে আছে। স্থির চোখে পাহারা দিচ্ছে।’
টিকটিকিটা! ঐ টিকটিকি টাই নাকি? না—টিকটিকি এতদিন বাঁচে না নিশ্চয়। পাতা উলটে গেলাম।
‘আমি কেমন একটা হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে আর চিনতে পারিনা। কলেজে ওরা সবাই আমার ভয় দেখে হাসাহাসি করছিলো। ওরা জানেনা কি ভয়ঙ্কর জিনিশ আমার মধ্যে বাসা বেঁধেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। ভাইএর বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। হাত দুটো নিশপিশ করে, মনে হয় গলাটা টিপে ধরি ওর? ও ছটফট করবে, তারপর দেহটা আস্তে আস্তে নিথর হয়ে যাবে। আঃ কি আরাম।’
‘হয় ও আমায় মারবে নয়তো আমাকেই ওকে মারতে হবে। এছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। নইলে ও আমার বাবা-মা-ভাই-বন্ধু সব্বাই কে মেরে ফেলবে লালীর মতোন। কিন্তু ওকে কি করে মারবো আমি? কি করে? ও তো আমার মধ্যেই ঢুকে বসে আছে। আজ দুপুরে আমি পেন্সিল দিয়ে ঘষে ঘষে ঐ চোখ দুটোকে ঢেকে দিতে চাইছিলাম দেওয়াল থেকে। কিন্তু যতবার ঢেকে দিচ্ছি, ততবার ঠিক বেরিয়ে আসছে। কি অসহায় লাগছে আমার। কি অসহায় লাগছে। আমি বুঝতে পারছি ও আমার মধ্যে থেকে হাসছে এটা পড়ে। নিঃশব্দ শয়তানী হাসি, অন্ধকারের হাসি।’
এর পরে আর কোনো এন্ট্রী নেই। পরের পাতাগুলো জুড়ে খালি পেনের হিজিবিজি দাগ। কেউ যেন প্রচণ্ড আক্রোশে ব্যর্থতায় যন্ত্রণায় প্রাণপণে পাতার উপর দাগ কেটেছে। এত জোরে দাগগুলো টানা যে কয়েকটা পাতা দাগ বরাবর ছিঁড়েও গেছে।
একেবারে শেষের দিকে একটা পাতায় একটা অদ্ভুত এন্ট্রী।
“পৃথিবীর দেওয়ালের পরে আঁকাবাঁকা অসংখ্য অক্ষরে একবার লিখিয়াছি অন্তরের কথা
আলো আর অন্ধকারে মুছে গেছে সে সব ব্যর্থতা।"
---- আমার হঠাৎ করে এই লাইনটা কেন মনে হচ্ছে কে জানে। জীবনানন্দ পড়তে এত ভালোবাসতাম।'
বইটা বন্ধ করে দিলাম। আর কিছু পড়ার নেই।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। রাত তিনটে বাজে। জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। কিন্তু উঠে যে সেটা বন্ধ করবো, হাত-পায়ে কোনো সাড় নেই মনে হচ্ছে।
পরেরদিন সকালবেলা লাইব্রেরিতে গেলাম খোঁজ করতে। এই বইটা বেশি কেউ তোলেনি। আমার আগে শেষ এন্ট্রীটা ১২ বছর আগেকার, মানে খুব সম্ভবত ঐ কথাগুলো যে লিখেছে তারই হবে। কার্ড নাম্বার দেওয়া ছিল। স্যারকে অনেক বলে-কয়ে পুরোনো ঝুলে-ভরা খাতা থেকে নামটা বার করলাম। দীপশিখা দত্ত। বাঙলা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ।
লাইব্রেরিয়ান ভদ্রলোক কিন্তু দীপশিখা দত্ত কে মনে করতে পারলেন না। কত ছাত্র-ছাত্রী আসে যায়, তাও এত বছর আগেকার—কে মনে রাখে। কিন্তু দীপশিখা দত্তের কি হয়েছিল তা জানতেই হবে। পায়ে পায়ে সেই ভাঙা বাথরুমটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আজ আর তালা দেওয়া নেই। আজ কি কারণে ক্লাস সাসপেণ্ডেড আছে। এই দিকটায় কেউ নেই। নির্জন নিস্তব্ধ দুপুর। ক্যাঁচ করে একটা আওয়াজ করে দরজাটা খুলে গেল। একফালি রোদের মধ্যে ধুলোর কণাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানে যা ছিল তা কি দীপশিখার সাথেই চলে গেছে? পলেস্তারা-চটা দেওয়ালে কত জন্মের ঝুলকালি জমে আছে। কিন্তু কোথায় দেওয়ালের কোনখানটা দীপশিখা পেন্সিল ঘষে ঢাকার চেষ্টা করতো, খুঁজে পেলাম না। আদৌ কি সেরকম কিছু আছে ? ভাঙা আয়নার পেছন থেকে টিকটিকিটা নিষ্ঠুর নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। যেন আমার এইখানে ঢো্কাটা ওর ঠিক পছন্দ হচ্ছেনা। লেজটা চাবুকের মতো বাঁকাচ্ছে। ভাঙা কল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। দেওয়ালের কোণে কোণে মাকড়সারা জাল বুনছে। কি জানি কতক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি আমি টিকটিকিটার দিকে। গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। ঢোক গিলতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কেন জানি পারছিনা। ব্যাগে একটা জলের বোতল ছিল না? টিকটিকিটার দিক থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। মনে হচ্ছে চোখ সরালেই কি যেন একটা হয়ে যাবে, ঐ টা আমার গায়ে লাফ দেবে। ব্যাগের দিকে না তাকিয়েই বোতলটা বার করার চেষ্টা করছি। উফফ—পাচ্ছি না কেন? বাইরে কোথায় যেন অদ্ভুত স্বরে একটা কাক ডাকছে। কোথায় যেন ধপ করে একটা শব্দ হল। হঠাৎ কোথথেকে একটা দমকা হাওয়া এসে জানলার পাল্লাটায় আছড়ে পড়লো। হাওয়ার তোড়ে বাথরুমের মধ্যে ধুলোর একটা ঘূর্ণি তৈরি হয়েছে। কতদিনকার ঝুল-কালি-মাকড়সার জাল সব আমার নাকে মুখে ঢুকে যাচ্ছে। রুমালটা দিয়ে নাক চাপা দিলাম কিন্তু তাও দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। না, এখানে আর দাঁড়ানো যাবেনা। জলের বোতলটাও খুঁজে পাচ্ছিনা। টিকটিকিটার থেকে চোখ না সরিয়েই আড়চোখে দরজার দিকে এগোলাম। বুকের মধ্যে ধড়াস করে একটা শব্দ হল। দরজাটা কখন হাওয়ার ধাক্কায় বন্ধ হয়ে গেছে। পুরনো কব্জা, একবার চেপে বন্ধ হয়ে গেলে আর খোলা যায়না। আমি হাতলটা ধরে টানাটানি করছি। দরজাটা ধাক্কাচ্ছি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার কপাল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে। দরজাটা কিন্তু খুলছে না। গলা শুকিয়ে গেছে, কতক্ষণ জল খায়নি। চেঁচাতেও পারছিনা। একরাশ কালো কালো ধুলোর বলয় আমার চারিপাশে পাক খাচ্ছে। আস্তে আস্তে আরো গাঢ় হচ্ছে। অন্ধকার হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। শেষের দিকে মাথাটা বোধহয় আর কাজ করছিলো না। মনে আছে আমি পাগলের মতো রুমাল দিয়ে ধুলোর বলয়টা কে ভাঙবার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা সড়াৎ সড়াৎ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম টিকটিকিটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। কালচে স্থির চোখদুটো নিষ্ঠুর ব্যঙ্গে জ্বলছে। লেজটাকে একবার পাকিয়ে ঝপাত করে লাফ দিল আমার গায়ে। তারপর আর কিছু মনে নেই।
বিকেলে দুলালদা ফিনাইল নিতে এসে যখন আমায় উদ্ধার করে তখন নাকি জলের বোতলটা আমার পাশেই ঢাকনা খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল। কি জানি আমি তখন কেন খুঁজে পায়নি। সেই দিন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো। বেহুঁশ মতো হয়ে গেলাম। অল্প অল্প মনে আছে মা মাথায় জল ঢালছে আর বাবা চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি নাকি জ্বর নিয়েই কলেজ গিয়েছিলাম আর তাই প্রেসার নেমে গিয়ে বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর ডাক্তার, রক্তপরীক্ষা, রাশি রাশি ওষুধ। প্রায় এক মাস পরে সেরে উঠে কলেজ গেলাম। ওই বাথরুমের দিকে আর যাইনি। শুধু মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে টিকটিকিটার জ্বলন্ত চোখদুটো দেখতাম। আর চেঁচিয়ে উঠতাম।
ফাইনাল পরীক্ষা চলে এলো। রিটেন হয়ে গেছে, প্র্যাক্টিকাল বাকি। কলেজে একদিন গেছি কিছু জেরক্স করাতে। পিছনের গেট দিয়ে শর্টকাট করতে যাব, দেখি দুলালদা ওর কোয়ার্টারের সামনে বসে আছে। সঙ্গে ছেদিলালদা। দুলালদার বাবা, যিনি এর আগে কলেজের সুইপার ছিলেন। দুলালদার ছেলে এবার মাধ্যমিক দেবে, বইপত্র পুরোনো কিছু আছে, দিয়ে দেব তাহলে—এইসব কথা হচ্ছে। হঠাৎ কি মনে হল ভাঙা বাথরুমটার কথা জিজ্ঞেস করলাম।
দুলালদা বিশেষ কিছু বলতে পারলো না কিন্তু ছেদিলাল-দাদু একটা অদ্ভুত কথা বললো।
‘ওই কোরিডরের শেষ মাথার জেনানা বাথরুমটা তো দিদি? যেটায় তুমি মাথা ঘুরে পড়ে ছিলে? ঐ টা তো?
‘হ্যাঁ ঐ টায়।’
'ও দুলাল কি জানবে, ও তো বহুতদিন আগে বাতিল হয়ে গেছে।’
‘তুমি ছিলে তখন?’
‘আরে আমরাই তো দরওয়াজা ভেঙে ওই দিদিকে বার করেছিলাম। দিদি তো বেঁহুশ হয়ে পড়েছিল তোমার মতো, মুখ থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছিলো—তারপর হাসপাতাল, ডাক্তার –'
‘তাই নাকি! আমার মতো! চিনতে তুমি মেয়েটা কে? ঠিক কি হয়েছিল জানো?’
‘আরে মুখ চিনা ছিল, নামটা মনে নাই। বাঙলা পড়তো। বাংলার হেড ও তাপসী-ম্যাডাম নিজের গাড়ীতে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো।’
‘কি হয়েছিল ওর ছেদিলালদা?’
‘আরে ওই তোমারই মতো। দিদিও বাথরুমে গিয়েছিল তো কি করে দরজা জাম হয়ে গেছিলো। পুরানা বাথরুম, বেবোহারই হতোনা তেমন। তো দিদি দরজা খুলতে না পেরে ধাক্কাছিলো। তারপর আমরা যখন দরজা তোড়লাম দেখলাম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।’
‘তারপর?’
‘তারপর তো হাসপাতালে জ্ঞানই ফেরেনা। দিদির মায়ের কি কান্না। উনার ছেলেও তখন কি করে মাথা ফেটে হাসপাতালে ভর্তি।’
‘এতদিন আগেকার কথা তোমার তো পরিষ্কার মনে আছে বাবা’ - দুলালদা বলল।
‘আরে মনে থাকবেনা? উস্কা সাত দিন বাদ ও দিদি গলায় রশি দিয়ে ফ্যান থেকে ঝুলে পড়েছিলো।’
‘দীপশিখা দত্ত আত্মহত্যা করেছিল!’
‘দীপশিখা—হাঁ এহি কুছ নাম থা। তুমি কি করে জানলে দিদি? ইয়াদ হে, উস কে বাদ উস বাথরুম মে এক কিতাব মিলা থা। লাইব্রেরী কা সিল থা, তো জমা কর দিয়া।’
দু' বছর পর। কলেজে সার্টিফিকেট আনতে গেছি। কি মনে হল বাথরুমটার সামনে দাঁড়ালাম। মেরামতির কাজ চলছে। এই বাথরুমটা ভেঙে নতুন করে তৈরি হবে। দরজা খোলা। আলমারিটা সরিয়ে বাইরে নিয়ে গেল লেবার রা। আলমারির পিছনের দেওয়ালটায় বেশ খানিকটা পলেস্তরা খসে গেছে। তার উপর অনেকটা জায়গা জুড়ে পেন্সিলের আঁজি আঁজি কালো কালো দাগ। দেওয়ালের গায়ে কেউ যেন কিছু লিখেছে, আবার গিজিগিজি করে কেটে দিয়েছে, আবার লিখেছে, কিছু একটা প্রাণপণে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছে -- ঝুলকালিতে ভরে গেছে, কিন্তু এখনও একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যায়।
কত দূর থেকে কার যেন বিষণ্ণ গলায় কানে ভেসে এল একটা বাংলা কবিতার দুটো লাইন। হঠাৎ করে খুব শীত করতে লাগলো।