• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | গল্প
    Share
  • অযথা : দিবাকর ভট্টাচার্য


    —'অযথা'

    — 'সম্পূর্ণ অযথা এই হয়রানি'

    নিজের মনেই বলছিলেন তিনি।

    ****

    মাঝরাত। একটি অখ্যাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম লোকজন নেই বললেই চলে। মাঝেমাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে ইঞ্জিনের আওয়াজ। প্ল্যাটফর্মের ভাঙাচোরা রেলিঙের সামনে একটি বেঞ্চ। সামনে টিমটিম করে জ্বলছে একটি আলো। সেই আলোর নীচে ওই বেঞ্চের দুপাশে দুজন লোক। এদের একজন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। অল্প আলোতেও তার ধবধবে শার্টের জেল্লা দেখা যাচ্ছে। দেখেই বোঝা যায় যে ইনি সম্পন্ন ও সুখী মানুষ। বাড়ি কোলকাতায়। একটি সিমেন্ট কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার। এনার নাম সিদ্ধার্থ সেন। পাশের লোকটি ক্ষয়াটে চেহারার। পরনের পোষাক আসাকও সেইমতো। এনার চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন ধরনের। চারিদিক গিলে খেতে চাইছে। দেখে মনে হয় শিক্ষিত। কিন্তু ভবঘুরে টাইপের। অথচ স্টেশনের পাশেই এনার বাড়ি। ইনি সিদ্ধার্থের অপরিচিত।

    উপরের কথাগুলি নিজের মনে নিজেকেই বলেছিলেন সিদ্ধার্থ। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে প্যান্টের পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাহারী পানের কৌটো বের করলেন। খুব যত্ন করে তার থেকে একটা পান বের করে মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে অপরিচিত লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন — 'দুমিনিট। জাস্ট দুমিনিটের জন্য। বুঝলেন।' অপরিচিত লোকটি দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন - 'হুঁ:।' সিদ্ধার্থ বললেন - 'হুঁ: মানে?' অপরিচিত লোকটি একভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন — 'এই রাত্তিরটা বেশ সুন্দর। আর ওই আকাশটা'। 'দূর মশাই! বলছিএকটুর জন্য ট্রেনটা মিস করলাম' - বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে উত্তর দিলেন সিদ্ধার্থ। অপরিচিত লোকটি কেমন একটা বিদ্‌ঘুটে দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন সিদ্ধার্থের মুখের দিকে। সিদ্ধার্থ মুখের মধ্যে আধ-চিবোনো পানের ঢেলাটা একদিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠলেন — 'কি বুঝলেন?' তখন স্থির দৃষ্টিতে সিদ্ধার্থের মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটি উত্তর দিলেন — 'বিরাট ক্ষতি হয়ে গেলো আপনার ওই দু-মিনিটের জন্য।' ঠিক তাই চিন্তা করুন। এখন রাত একটা। তার মানে আরো পাক্কা তিনটে ঘন্টা এখানে এইভাবে বসে থাকা। আর এই লটবহর নিয়ে।

    এরপর তাঁদের কথাবার্তাগুলো এই মতো হতে থাকলো —

    অপরিচিত: তা এতো জিনিসপত্তর নিয়েছেন কেন মশাই?

    সিদ্ধার্থ: আর বলবেন না। বাড়ির আবদার। এখানকার হাতে তৈরী কিছু কিছু জিনিস তো অসাধারণ। এসব আমাদের ওখানে তো আকাশছোঁয়া দাম।

    অপরিচিত: এসব আপনার পছন্দের?

    সিদ্ধার্থ: (একটু গর্বিতভাবে হেসে) আসলে আমার স্ত্রী এইসব জিনিসের দারুণ সমঝদার। ইন্টিরিয়র ডিজাইনিঙের দারুণ সব আইডিয়া সারাক্ষণ ওর মাথায় ঘোরে। তাই একটা ডোকরার দুর্গা আর দুটো মুখোশ আর —

    অপরিচিত: বুঝেছি বুঝেছি ঘর সাজানোর জিনিস সব।

    সিদ্ধার্থ: (অবাক হয়ে অপিরিচিতের মুখের দিকে তাকিয়ে) ঘর সাজানো কি বলছেন মশাই? ঘরের পরিবেশটা মানে আবহাওয়াটা—মানে মেজাজটা একেবারে বদলে দেওয়া একটা বিরাট আর্ট। আর আমার স্ত্রী এটা বলতেই হবে (খুব কৃতার্থের মতো হেসে) যে এ ব্যাপারে রিয়েলি গ্রেট। (একটু থেমে, ঘাড়টা সামান্য তুলে) সেইজন্য কোনো কার্পণ্য করিনি মশাই। যতটা সম্ভব সংগ্রহ করেছি। নিয়ে যেতে একটু কষ্ট হবে। তা হোক। (আবার একটু থেমে, গর্বিতভাবে হেসে) আফটার অল আমার প্রিয়জনের মুখে হাসি তো ফুটবে। কি বলেন? লাইফ শুড বি লাইক দ্যাট।

    অপরিচিত: তাই?

    সিদ্ধার্থ: নিশ্চয়ই। নয়তো এতো কষ্ট করে রোজগার করছি কি জন্যে? নিজে খাবো দাবো আর ভোগ করবো? বলুন? (বলতে বলতে কৌটো থেকে আরেকটি পান বার করে মুখে পুরে দেন।)

    অপরিচিত: তা বটে।

    সিদ্ধার্থ: (পান চিবোতে চিবোতে) জিনিসগুলোকে কেবল সাবধানে নিয়ে যেতে হবে। মনে হয় ওরা ভালোভাবেই বেঁধে দিয়েছে। কি বলেন?

    অপরিচিত: নিশ্চয়ই। ওরা খুব ভালোভাবে বেঁধে দেয় সবসময়ই। একটা মোটা কাগজের ঠিক মাঝখানে জিনিসটাকে রেখে চারদিক থেকে সমান করে কাগজের কোনাগুলো তুলে একেবারে নিখুঁত করে মিলিয়ে দেয়। আর তারপর নিমেষের মধ্যে পুরো মাপসই দড়ি কেটে টানটান ক্করে বেঁধে দেয় চারদিক থেকে। এতটুকু ঢিলে হয় না কোথাও। আপনি আমি পারবই না এভাবে মুড়তে।

    সিদ্ধার্থ: (একটু অবাক হয়ে অপিরিচিতের মুখের দিকে তাকিয়ে) আপনি তো খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছেন ব্যাপারটা।

    অপরিচিত: (একটু ম্লান হেসে) ওটাই যে আমার কাজ।

    সিদ্ধার্থ: তার মানে?

    অপরিচিত: ওই খুঁটিয়ে লক্ষ্য করা ওদের এইসব কাজগুলো।

    সিদ্ধার্থ: ও। তার মানে আপনার ওইসব দোকান আছে। তাই না?

    অপরিচিত: (নির্বিকারভাবে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে।) নাহ্‌।

    সিদ্ধার্থ: (বিস্মিত হয়ে) সেকি? তাহলে কিভাবে এসব করেন? আর কেনই বা করেন?

    অপরিচিত: (মুখ নামিয়ে সিদ্ধার্থের দিকে তাকিয়ে, আস্তে করে) আসলে কি জানেন? এটা করতে আমার খুব ভালো লাগে। এই যে আমার চারদিকে যারা আছে যারা আসছে যাচ্ছে—তাদের সব্বাইকে খুব খুঁটিয়ে দেখি আমি কিভাবে কাটাচ্ছে তারা তাদের জীবনের মুহূর্তগুলো।

    সিদ্ধার্থ: কেন?

    অপরিচিত: বেশ লাগে দেখতে। ওদের জীবনের সঙ্গে, ওদের প্রত্যেক মুহূর্তের বেঁচে থাকার সঙ্গে কল্পনায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে বেশ লাগে।

    সিদ্ধার্থ: বুঝলাম নাতো।

    অপরিচিত: বুঝলেন না? বুঝলেন না তো? বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই যেমন ধরুন আপনি। আপনাকেও আমি এইভাবে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি। এই যে দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে এলেন। তারপর ট্রেন মিস করলেন। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে এসে এই বেঞ্চিতে বসলেন। তারপর জিনিসপত্তরগুলোকে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে—

    সিদ্ধার্থ: (কিছুটা রুষ্ট ও অসন্তুষ্টভাবে) সে কি মশাই! এইভাবে চুপিসাড়ে একজনকে এভাবে ফলো করে যাচ্ছেন? তা এরপরে কি করবেন?

    অপরিচিত: কল্পনা—কল্পনা করব।

    সিদ্ধার্থ: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) অ্যাঁ?

    অপরিচিত: হ্যাঁ। কল্পনায় দেখছি—আপনি বাড়ি ফিরলেন—আপনার স্ত্রী হৈ হৈ করে প্যাকেটগুলো খুললেন—তারপর ওই ডোকরার দুর্গাটা আপনাদের বসার ঘরের কোণায় একটা হাল্‌কা হলুদ আলোর নীচে একটা গোল কাঁচের টেবিলের উপর—

    সিদ্ধার্থ: (অপরিচিতের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে) বাপরে। আপনি পারেন বটে।

    অপরিচিত: হ্যাঁ পারি। শুধু এইভাবেই পারি বেঁচে থাকতে। অন্যের বেঁচে থাকার সঙ্গে লেপ্টে থেকে। অবশ্যই কল্পনায়। নয়তো— (হঠাৎ সচকিত হয়ে) ওই শালা! ওই শালা আবার এসেছে। এবার মারবো এই ইঁটটা ছুঁড়ে (বলতে বলতে পায়ের তলা থেকে একটা বড়ো ইঁটের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়তে যান রেলিঙের পাশের ঝোপটির দিকে।)

    সিদ্ধার্থ: (ঘাবড়ে গিয়ে) ওকি? ওকি? কি করছেন? কে ও?

    অপরিচিত: (উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে) দেখলেন না? দেখতে পেলেন না? ওই যে রেলিঙের পাশ দিয়ে উঁকি মেরেই লুকিয়ে গেলেন এক মহিলা।

    সিদ্ধার্থ: (আরো বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে) মহিলা? আর তাকে আপনি ইঁট মারতে যাচ্ছেন?

    অপরিচিত: হ্যাঁ—আমার স্ত্রী।

    সিদ্ধার্থ: (নিজের মাথায় হাত দিয়ে) কি সব্বোনাশ! নিজের স্ত্রীকে মারতে যাচ্ছেন? কেন? কি করেছেন উনি? আপনি তো সাংঘাতিক লোক মশাই!

    অপরিচিত: কি করেছে? কি করেছে জানেন? পাহারা। পাহারা দিচ্ছে আমায়। সারাক্ষণ এইভাবে পাহারা দেয় আমায়। যদি আমি কিছু করে ফেলি। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ি ট্রেনের তলায়। কিংবা—

    সিদ্ধার্থ: (হতভম্বের মতো তাকিয়ে) তা বলে তাকে মারতে হবে?

    অপরিচিত: (প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে) হ্যাঁ মারতে ইচ্ছে করে। প্রচণ্ড মারতে ইচ্ছে করে ওকে। (একটু হেসে) ও কি চায় জানেন? একটা সুন্দর ঘর। সুন্দর বিছানা। ফিটফাট জামা পরে আমি বসে থাকি ওই ঘরে। ওই বিছানায়। ওর কাছে।

    সিদ্ধার্থ: (অত্যন্ত অবাক হয়ে) সেটাই তো স্বাভাবিক। আর তার জন্যে তাকে মারতে যাবেন?

    অপরিচিত: হ্যাঁ। শুধু মারতে নয়। খুন করতে। (প্রচণ্ড উত্তেজনায় হাঁফাতে হাঁফাতে) সেদিন মনে হচ্ছিল ওর মাথাটা থেঁতলে দি। কেন জানেন? ও আমায় চুমু খেতে এসেছিল। কোথায় জানেন? (আঙুল দিয়ে উপরের ঠোঁটের দিকে দেখিয়ে) এইখানে-এইখানে। (বলতে বলতে অপরিচিত ব্যক্তিটি তাঁর মুখটি নিয়ে আসেন সিদ্ধার্থের মুখের খুব কাছে, তারপর বলতে থাকেন) তারপর নিজের ঠোঁটটা ব্লেড দিয়ে কাটতে গিয়েছিল যাতে ও চলে যেতে পারে মৃত্যুর দোরগোড়ায়—আমার মতো।

    সিদ্ধার্থ: (ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে পেছিয়ে এসে) মানে?

    অপরিচিত: মানে? (বলেই সিদ্ধার্থের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে নিজের উপরের ঠোঁটটা উলটে দেখায়—সেখানে একটা চেরী ফলের মতো লাল টুকটুকে মাংসল ঢিবি) লোকটি বলে ওঠে—দেখলেন? দেখলেন ওটাকে? ভারী মিষ্টি নাম—'এপিথেলিওমা'—আমার মৃত্যুর দ্বার —দেখে নিন ভালো করে (সিদ্ধার্থ হতভম্বের মতো অপরিচিতের দিকে তাকিয়ে থাকেন) (অপরিচিত লোকটি আস্তে করে খুব নরম গলায় বলতে থাকেন) মনে হয় ভারী সুন্দর একটা ফুলের নাম। তাই না? তা ফুলই বটে। রোজ একটু একটু করে ফুটে উঠছে। যতক্ষণ না আমি ঝরে যাই। (একটু থেমে ম্লান হেসে) এই দিয়ে আমি আমার বৌকে চুমু খাবো জড়িয়ে ধরবো বিছানায়—কি বলেন?

    সিদ্ধার্থ: না মানে—

    অপরিচিত: (আস্তে করে ঠাণ্ডা গলায় বলতে থাকেন) ভাবুন তো ওই হিরোসিমার লোকগুলোর কথা। পারতো ওরা? পারতো? পরিষ্কার করে বিছানা পেতে বসে থাকতে? প্লেট ধুয়ে ঝকঝক করে খেতে বসতে? মুখে পাউডার মেখে সুন্দর করে চুল বেঁধে পাশের লোকটির গলা জড়িয়ে ধরতে? যখন তারা জানতে পেরে গেছে আর কয়েক ঘন্টা মাত্র কয়েক ঘন্টা তার আয়ু? বলুন? বলুন?

    সিদ্ধার্থ: (আমতা আমতা করে) না তা নয় তবে—

    অপরিচিত: তবে কি? (একটু থেমে) তবে কি জানেন? তখন মনে হয় আশেপাশে যারা বেঁচে থাকবে—তাদের প্রত্যেকের মাথা গুলো ভেঙে চুরমার করে দিই—সে আমার প্রিয়জন হোক কিংবা আপনি।

    সিদ্ধার্থ: (আঁতকে উঠে) সে কি?

    অপরিচিত: (খুব হাল্‌কাভাবে) আরে না না—অতো ভয় পাবেন না—তা বলে আমি সত্যি সত্যি আপনাকে মারতে যাচ্ছি নাকি? আর আমার বৌয়ের ব্যাপারেও আপনাকে অত উদ্বিগ্ন হতে হবে না (একটু থেমে) ও আমায় বড়ো ভালোবাসে জানেন ওর ইচ্ছে যে ও আমার সঙ্গেই মরবে (আবার একটু থেমে) পাগলী একটা—সারা দিন কিছু খায় না—ঘুমোয় না—এই করে চেহারাটা হয়েছে যেন সত্তর বছরের বুড়ি—অথচ ওর বয়স কতো জানেন—মাত্র পঁয়ত্রিশ (আবার একটু থেমে) কিন্তু আপনি ওরকমভাবে সিঁটকে বসে আছেন কেন মশাই? এখনো ভাবছেন নাকি আমি যদি এই পায়ের নীচ থেকে একটা আধলা ইঁট তুলে চাপিয়ে দিই আপনার মাথায়— (একটু হেসে) আরে না না অত ভয় পেলে হবে? বাড়ি যেতে হবে না? বাড়িতে আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করে আছে (একটু থেমে) আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আপনার ঘরের কোণে ডোকরার দুর্গা মূর্তিটি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছেন আপনার স্ত্রী—তার সামনে একটা ছোটো কাঁচের টেবিল—একটা সাদা পাথরের বাটিতে জল দিয়ে উনি ভাসিয়ে দিচ্ছেন কতগুলি হলুদ রঙের ফুল—আর আপনি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছেন সেই ফুলগুলির দিকে। (সিদ্ধার্থ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন অপরিচিতের মুখের দিকে, আর অপরিচিত ব্যক্তিটি সিদ্ধার্থের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে যান—) হ্যাঁ, সত্যি বলছি—আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি (এইবার একটু থেমে খুব আস্তে করে বলে ওঠেন) আপনি তখন একটা কাজ করবেন প্লিজ? আমার হয়ে একটা কাজ করবেন? আপনার স্ত্রীকে বলবেন একটু বেশি করে ফুল সাজিয়ে দিতে—(সিদ্ধার্থ অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে; একইভাবে অপরিচিত ব্যক্তিটি বলে যান) গুনে দেখবেন তো ভালো করে গুনে দেখবেন তো কটা ফুল ভাসছে ওই পাথরের বাটিতে—ঠিক করে গুনবেন কিন্তু কারণ যে কটা ফুল ভাসবে সে কটা মাসই বোধহয় আমার আয়ু— (এই কথার মাঝে দূর থেকে ট্রেনের আওয়াজ শোনা যাবে—অপরিচিত ব্যক্তিটি বলে উঠবেন) আরে ওই ট্রেন এসে গেল আপনারা রেডি হোন রেডি হোন আর মিস করবেন না। (ট্রেনের আওয়াজ ক্রমশ বাড়তে থাকবে) যান যান সাবধানে বাড়ি যান—আর ভালো থাকবেন খুব ভালো থাকবেন ফূর্তিতে থাকবেন খুশিতে থাকবেন স্ত্রীর সঙ্গে পরিবারের সঙ্গে। বলতে বলতে অন্ধকারে কোথায় যেন চলে গেলেন লোকটি।

    সিদ্ধার্থ হতবাক হয়ে লোকটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্য। কারণ তখনই ঝমঝমিয়ে ট্রেনটা ঢুকে পড়লো স্টেশনে।

    'এবার মিস করলে চলবে না'—ভাবতে ভাবতে হুড়মুড় করে প্রায় ফাঁকা ট্রেনের কামরাতেই উঠে বসলেন সিদ্ধার্থ। বসলেন জানালার ধারে। ফাঁকা জায়গায়। বসতে না বসতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো তাঁর। সেই ঘুমের ঘোরেই তাঁর চোখের সামনে ভাসতে থাকলো সেই টকটকে লাল ফুলের মতো 'এপিথেলিওমা'।

    তখনই মনে হোলো সিদ্ধার্থের কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে। ঢোঁক গিলতে আর শ্বাস নিতে কেমন একটা কষ্ট হচ্ছে। বাকি রাতটা জেগেই কাটালেন সিদ্ধার্থ। দম আটকানোর আতঙ্কে আর গলার ওই অস্বস্তিটাকে নিয়ে।

    ***

    তারপর?

    তারপর সিদ্ধার্থ বাড়ি পৌঁছোবেন। পরের দিন সকালে। একটু দেরিতে। বাড়ি ফিরতেই শুরু হবে তাঁর স্ত্রীর যথারীতি হৈ হৈ। তারপর প্যাকেট খুলে জিনিসপত্র বের করা। আর সেই নিয়ে আরেক দফা ধিন্‌ ধিনা ধিন্‌। সিদ্ধার্থের মাথাটা দপ্‌ দপ্‌ করতে থাকবে যন্ত্রণায়। সিদ্ধার্থ বাথরুমে যাবেন। বাথরুমে ঢুকতেই হুড় হুড় করে বমি হয়ে বেরিয়ে যাবে গতরাতের হজম না হওয়া সমস্ত খাবার। চোখেমুখে জল দিয়ে ভালো করে মুখ কুলকুচি করবেন সিদ্ধার্থ। মনে হবে গলার অস্বস্তিটা যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। এই সঙ্গে মুখে এসে জুটেছে কেমন একটা বিস্বাদ ভাব। 'জর্দা পানটা ছেড়ে দেবো কাল থেকে'—ভাবতে ভাবতে পায়ে জল ঢালতে থাকবেন তিনি।

    এরপর নিয়মমাফিক খাওয়ার টেবিলে এসে বসবেন সিদ্ধার্থ। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করবে না তাঁর। খুব সামান্য একটু ভাত মুখে নেবেন। সেই মতো অতি অল্প একটু তরকারি। সিদ্ধার্থের স্ত্রী জিজ্ঞাসা করবেন—'কি হোলো শরীর খারাপ নাকি?' 'নাহ্‌। তেমন কিছু নয়'—বলে সিদ্ধার্থ উঠে পড়বেন খাওয়ার টেবিল থেকে। তারপর শোয়ার ঘরে এসে বিছানায় শরীরটা ফেলে দেবেন কোনোক্রমে। হাত বাড়িয়ে জ্বালাবেন বিছানার পাশে ছোট্ট কাঁচের টেবিলে রাখা বাহারী ল্যাম্পটাকে। হাল্কা হলুদ আলো গোল হয়ে নেমে আসবে তাঁর বিছানার পাশে। আর ঠিক তখনই তাঁর চোখে ভেসে উঠবে একটি টিমটিমে আলো। আর সেই আলোর পিছনে ঘোলাটে অন্ধকার। সেই আধো অন্ধকারে একটি ভাঙাচোরা রেলিং আর সেই প্ল্যাটফর্ম।

    'অসহ্য!' মনে হবে তাঁর। তখনই হাত বাড়িয়ে নিভিয়ে দেবেন আলোটা। নরম অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারিদিক। 'ওই স্টেশনের ত্রিসীমানায় আর যাব না কোনোদিন। মার্কেটিং এর কাজে যদি যেতেই হয় ওদিকটায় তাহলে দুটো স্টেশন এগিয়ে নামবো। কিংবা ...'—ভাবতে ভাবতে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসবে সিদ্ধার্থের। আধোঘুমে তিনি টের পাবেন বিছানায় তাঁর স্ত্রীর কোমল সান্নিধ্য।

    ঘুম থেকে ওঠার পর সিদ্ধার্থের মনে হবে যে অনেক ফ্রেশ হয়ে গেছেন তিনি। মুখের বিস্বাদ ভাবটা আর নেই। গলার অস্বস্তিটাও সেভাবে আর বোঝা যাচ্ছে না। সন্ধেয় বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে কষতে থাকবেন পরের দিনের রিপোর্টিং— টার্গেট-অ্যাচিভমেন্টের হিসেব নিকেশ।

    অতো সহজে কিন্তু সিদ্ধার্থ রেহাই পাবেন না। গলার অস্বস্তিটা মাঝেমাঝেই ফিরে আসবে। বিশেষত সিদ্ধার্থ যখন একা থাকবেন। হঠাৎ হঠাৎ তাঁর মনে হবে মুখটা যেন বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে। ঢোঁক গিলতে আটকাচ্ছে। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠবে সেই বীভৎস মুখটা। আর সেই লাল থলথলে 'এপিথেলিওমা'। মুখে চোখে জল দিয়ে আসবেন সিদ্ধার্থ। মুখ কুলকুচিও করবেন বারবার। তারপর খানিকটা ধাতস্থ হবেন।

    এইভাবে কেটে যাবে বেশ কয়েক মাস। এর মাঝে সিদ্ধার্থের প্রমোশন হবে। খুশিতে ভরপুর সিদ্ধার্থ স্ত্রীকে নিয়ে ছুটবেন পার্কস্ট্রীটের অভিজাত রেস্টুরেন্টে। হাসি ঠাট্টা গল্পে শুরু হবে পছন্দমতো অর্ডারে সাজানো রাতের ডিনার। খাবারের প্রথম চামচটি নিয়ে হাতে করে স্ত্রীর মুখে তুলে দেবেন সিদ্ধার্থ। সিদ্ধার্থের স্ত্রীও হাসতে হাসতে একইভাবে খাইয়ে দিতে যাবেন সিদ্ধার্থকে। ঠিক সেই সময়েই সিদ্ধার্থের কানে কাছে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে উঠবে—'আনন্দে থাকুন পরিবারের সঙ্গে খুব খুশিতে আর ফূর্তিতে'। সিদ্ধার্থের মনে হবে গলাটা যেন টিপে ধরলো কেউ হঠাৎ। প্রচণ্ড বিষম খেয়ে মুখের খাবারটা বেরিয়ে আসবে সিদ্ধার্থের মুখ থেকে। 'কি হোলো? শরীর খারাপ লাগছে? চলো আজই ডক্টর সেনকে একবার দেখিয়ে আসি'— উদ্বিগ্ন হয়ে বলবেন সিদ্ধার্থের স্ত্রী। একটুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপ করে থাকবেন সিদ্ধার্থ। তারপর আস্তে করে বলবেন—'ও কিছু না। ঠিক আছে।'

    কিন্তু সিদ্ধার্থ নিজেই বুঝবেন যে সব ঠিক নেই। কোথাও যেন কি একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

    এর দুদিন বাদেই সিদ্ধার্থ এসে হাজির হবেন একটি বেসরকারী হাসপাতালের আউটডোরে। শরীরের যতরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে বিশাল একটা ফাইল হাতে বসে থাকবেন এক বিখ্যাত চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে।

    'কেমন আছেন? আমি রতন। চিনতে পারছেন তো?'—শুনে চমকে উঠবেন সিদ্ধার্থ। তাকিয়ে দেখবেন পাশে বসা রোগা কালো ক্ষয়াটে মার্কা লোকটা তাঁর পুরোনো প্রতিবেশী। লোকটি নিজের মনেই বলে যাবে—'আমার তো শেষ অবস্থা। সবদিক দিয়েই। গতবছর লক্ষ্মীপুজোর দিন সকালে...।' সিদ্ধার্থের কানে ঢুকবে না কিছুই। দাঁতে দাঁত চেপে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকবেন তিনি।

    'তা আপনি ভালো আছেন তো?'—নিজের দুঃখের কাহিনী বলার পর খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষে একথাটি বলবেন ওই রতন নামের লোকটি। সিদ্ধার্থ এবার তাঁর মুখের দিকে তাকাবেন এবং লক্ষ্য করে দেখবেন যে এই লোকটির চোখেও যেন ফুটে উঠছে গিলে খাওয়া এক চাউনি।

    এক অদ্ভুত অস্থিরতায় সিদ্ধার্থ ঢুকবেন সেই ডাক্তারবাবুর চেম্বারে। তারপর একটি একটি করে রিপোর্টের কাগজ এগিয়ে দেবেন ডাক্তারবাবুর হাতে। ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে দেখতে থাকবেন সেইসব কাগজপত্তর। তারপর বলে উঠবেন—'নাহ্‌। রিপোর্টে খারাপ কিছুই পাওয়া যায় নি। তবে...।' বিরাট একটা ভার নেমে যাবে সিদ্ধার্থের মাথা থেকে। 'টেনশন করবেন না। ফূর্তিতে থাকুন। খুশি মনে থাকুন। সবার সঙ্গে।'—ডাক্তারবাবুর শেষের কথাগুলি আবার বিশ্রীভাবে কানে এসে বিঁধবে সিদ্ধার্থের। কোনোক্রমে চেম্বারের বাইরে এসে শ্বাস নেবেন লম্বা করে। আমার এই অস্বস্তিটা এবার আমি নিজেই সারিয়ে নেবো মনের জোরে—তখনই নিজেই নিজেকে বলবেন সিদ্ধার্থ। আর বাড়ি পৌঁছোনোর আগেই স্থির করে নেবেন যে কাজ কাজ আর কাজের মধ্যে থাকলেই এইসব ভূতুড়ে ব্যাপার সাফ হয়ে যাবে তাঁর মন থেকে।

    অতএব শুরু হবে আরো বেশি করে যেচে কাজের দায়িত্ব নেওয়া—অর্থাৎ অনেক বেশি দৌড়ঝাঁপ—বাইরে যাওয়া ক্লায়েন্ট মিট করা—ইত্যাদি ইত্যাদি।

    সেই সূত্রেই তাঁকে হঠাৎই এক শীতের রাতে উঠে বসতে হবে একটি ট্রেনের কামরায়। কারণ পরদিন সকালেই পৌঁছোতে হবে এক দূরবর্তী শহরে। ট্রেনের প্রায় ফাঁকা সেই কামরার সিটে শুয়ে কিভাবে কাজগুলি গোছাবেন তাই ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যাবে তাঁর চোখে। কিন্তু সেই ঘুম ভেঙে যাবে হঠাৎই। যখন তিনি বুঝতে পারবেন যে ট্রেনটা আর চলছে না।

    তারপর উঁকিঝুঁকি মেরে জানতে পারবেন যে যান্ত্রিক গোলযোগে ট্রেনটা রাতে আর নড়বে না। সিদ্ধার্থ দেখতে পাবেন অন্যান্য প্যাসেঞ্জাররাও টুপটাপ নেমে পড়ছে এদিক সেদিক। সিদ্ধার্থ বুঝে উঠতে পারবেন না কি করা উচিত। নেমে পড়বেন না বসেই থাকবেন। লোকের মুখে শুনতে পাবেন যে ট্রেনটা আটকে গেছে একটা ছোটো স্টেশনের খুব কাছেই। হেঁটে যেতে মিনিটখানেক।

    সিদ্ধার্থ ভাববেন কি হবে সেখানে গিয়ে। তার চেয়ে ট্রেনে থাকাই ভালো। সেই ভেবে সটান শুয়ে পড়বেন চাদর মুড়ি দিয়ে। কিন্তু একটু পরেই সেই বেয়াড়া অস্বস্তিটা ঘিরে ধরবে সিদ্ধার্থকে। আবার মনে হবে গলার কাছে কি একটা দলা পাকিয়ে শ্বাসটা আটকে দিচ্ছে তার। অনেক কষ্টে যে অস্বস্তিটাকে দাবিয়ে রেখেছেন তিনি ইদানীংকালে, সেটা আবার এই সময় মাথা চাড়া দেবে।

    'নাহ্‌। এর চেয়ে ট্রেনের বাইরে যাওয়াই ভালো। হোক্‌গে অজানা অচেনা বনবাদাড়। কিন্তু খোলা আকাশের নীচে তো হবে'—এই ভাবতে ভাবতে ট্রেন থেকে নেমে পড়বেন সিদ্ধার্থ। পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন নেমে পড়া আরো কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। ওই স্টেশনের দিকে।

    কিন্তু আরেকটু এগোতেই সিদ্ধার্থ বুঝতে পারবেন যে ওটি সেই স্টেশন যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার সেই বিশ্রী অভিজ্ঞতা। অর্থাৎ সেই ভাঙা রেলিং সেই টিমটিমে আলো—আর সেই বেঞ্চ!

    শীতের রাত থমথম করবে সর্বত্র। সঙ্গের লোকগুলো সব কোথায় চলে যাবে কে জানে। সিদ্ধার্থ সেই প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াবেন। বলা যায় দাঁড়াতে বাধ্য হবেন। শরীরটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকবে তাঁর। তিনি বুঝতে পারবেন এই অবস্থায় অন্ধকারে রাস্তা চিনে ওই ট্রেনের কামরায় ফেরৎ যাওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাই সিদ্ধার্থ অসহায়ের মতো বসে পড়বেন প্ল্যাটফর্মের সেই বেঞ্চিটিতে। ওই টিমটিমে আলোর নীচে। ওই ভাঙাচোরা রেলিঙের সামনে।

    আর তখন ভাবতে থাকবেন—এইবার-এইবার আবার এসে হাজির হবে সেই বীভৎস মুখটা—পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলবে—'ভালো থাকবেন - খুব ভালো থাকবেন।'—আর তখনই যেন গলা বন্ধ হয়ে শ্বাস আটকে আসবে তাঁর।

    তাই প্রতিটি মুহূর্তেই সিদ্ধার্থের মনে হবে সময়টা যেন নড়তে চাইছে না কিছুতেই। অথচ তাকে বসে থাকতেই হবে সেই দিনের আলো ফোটা পর্যন্ত। আর এর মধ্যে যে কোনো সময়ে তাঁর সামনে ঠোঁট উলটে এসে হাজির হতে পারে সেই 'এপিথেলিওমা'! তাহলে?

    তাহলে সে চিৎকার করে বলতে বাধ্য হবে—'যান তো মশাই - যান তো আমার সামনে থেকে'। কিংবা একটা ঘুষিতে ফাটিয়ে দেবে লোকটার মুখটা। অথবা লোকটার হাত দুটো ধরে বলবে—'প্লীজ! প্লীজ। আমায় একটু একা থাকতে দিন'।

    তারপর সিদ্ধার্থের মনে হবে—এই ক'মাসে লোকটি নিশ্চয়ই আরো অসুস্থ হয়ে যাবে—আঙুরের সাইজের টিউমারটা নিশ্চয়ই আরো বড়ো হয়ে যাবে—তাহলে—তাহলে তো সেটা আর ঠোঁটের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে না—হয়তো মুখের বাইরে বেরিয়ে এসে ঝুলবে বীভৎসভাবে।

    এইসব ভাবতে ভাবতে সিদ্ধার্থ চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকবেন ঠিক মড়ার মতো।

    কিন্তু নাহ্‌। কেউ এসে বসবে না সিদ্ধার্থের পাশে। কেউ এসে বলবে না—'ভালো থাকবেন। সব্বাই ভালো থাকবেন'। বরং খানিক বাদে সিদ্ধার্থ হঠাৎ শুনতে পাবেন একটি পাখির ডাক। তারপর আরো কয়েকটির। বুঝবেন ভোর হচ্ছে। তখন ভয়ে ভয়ে চোখ খুলবেন তিনি। অতি সন্তর্পণে তাকাবেন এদিক ওদিক। এবং নিশ্চিত হবেন যে কেউ নেই। কেউ কোত্থাও নেই।

    একটু দূরে ওই স্টেশন চত্বরেই একটা চায়ের দোকান দেখতে পাবেন। সিদ্ধার্থ পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবেন সেইদিকে। এক মহিলার দোকান। সদ্য জ্বলে ওঠা উনুনের আঁচ ধাপে ধাপে উঠছে উপরের দিকে। সিদ্ধার্থ সেই আঁচের সামনে এসে দাঁড়াবেন। বলবেন—'একটা চা।' সিদ্ধার্থ টের পাবেন তাঁর গলাটা আবার বুজে আসছে ক্রমশ। তাই কোনোক্রমে এক ভাঁড় চায়ে গলা ভিজিয়ে বিদেয় হতে চাইবেন এই বিশ্রী জায়গা থেকে।

    চায়ের ভাঁড় মুখে নিয়ে দোকানের ভিতরে তাকাতেই দেখতে পাবেন সেই মুখটি! সেই চোখ! আর সেই দৃষ্টি! কিন্তু ফ্রেমে বাঁধানো। চন্দনের ফোঁটা দেওয়া। উনুনের ধোঁয়ার পিছনে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সিদ্ধার্থ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন সেই ছবিটির দিকে। শুনতে পাবেন ওই মহিলার কণ্ঠস্বর—'আমার স্বামী। গতমাসে চলে গেছে। চিনতেন নাকি?' সিদ্ধার্থ কোনোক্রমে উত্তর দেবেন—'হুঁ'। ফুটন্ত জলের শোঁ শোঁ আওয়াজে সেই উত্তর বোধহয় মহিলার কানেই যাবে না। শীর্ণ হাতে চা ঢালতে ঢালতে তিনি নিজের মনেই বলে যাবেন—'খুব কষ্ট পাচ্ছিল—যন্ত্রণা হোতো—রক্ত বেরোতো গলগল করে'। তারপর একটু থেমে যেন চোখ মুছতে মুছতে বলবেন—'এখন ওর আর কোনো কষ্ট নেই—এখন শান্তি।'

    'এখন শান্তি'—কথাটা সিদ্ধার্থের কানে এসে বাজবে অদ্ভুতভাবে। তখনই সিদ্ধার্থ মুখটা ঘুরিয়ে তাকাবেন দূরের ওই বেঞ্চিটির দিকে। তারপর চায়ের ভাঁড়টি হাতে নিয়ে ফিরে আসবেন ওই বেঞ্চিটায়। ভাঁড়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে টানটান হয়ে বসবেন ওখানে। ঘাড় উঁচু করে তাকাবেন সামনের দিকে। তারপর ডাইনে, বাঁয়ে এবং আবার সামনের দিকে।

    তখন সিদ্ধার্থের চোখের সামনে থাকবে প্ল্যাটফর্মের ওপারের একসার টালির ঘর। মাঝে মধ্যে দু একটা রাধাচূড়া গাছের মাথা। তার পিছনে চাপ চাপ কুয়াশায় ঢাকা ঘোলাটে সূর্য।

    এইভাবে ভোর আসবে ওই অখ্যাত স্টেশনের উপর। আর সিদ্ধার্থ কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবেন ওই সবকিছুর দিকে।

    তখন—ঠিক তখন সিদ্ধার্থের মনে হবে—ওই দূরের গাছের পাতার মধ্যে সূর্যটা যেন কমলা রঙের টিপের মতো আটকে রয়েছে—গাছের শুকনো কোঁকড়ানো পাতাগুলো ভোরের নরম হলুদ আলোয় যেন সোনার পাতের মতো ঝরে পড়ছে—দূরের টালির ঘরের লালচে মাথাগুলো সদ্য-আঁকা ছবির মতো জ্বলজ্বল করছে। এই সবকিছুর উপর 'এখন শান্তি' কথাটা যেন মসৃণভাবে বিছানো রয়েছে।

    নিজের অজান্তেই চায়ের ভাঁড়ে বেশ লম্বা করে একটা চুমুক দিয়ে ফেলবেন সিদ্ধার্থ। আর বলে উঠবেন—'আঃ।' তাঁর ঠোঁটে জিভে মুখে ঘন হয়ে লেগে থাকবে এক তৃপ্তির আস্বাদ। আর তখনই হঠাৎ তিনি বুঝতে পারবেন গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে থাকা সেই অস্বস্তিটা আর নেই।

    আর সেই সময়েই গত রাতের আটকে যাওয়া ট্রেনটা ঝমঝম আওয়াজ করে ঢুকে পড়বে স্টেশনের ওই প্ল্যাটফর্মে। কোত্থেকে কয়েকটা লোক দুদ্দাড় করে এসে হাজির হবে ট্রেনের সামনে। আর ঝপাঝপ উঠে পড়বে ওই ট্রেনে। আর সিদ্ধার্থ?

    সিদ্ধার্থ তখনও ভাবতে থাকবেন এতদিনের ওই অস্বস্তিটা হঠাৎ কিভাবে উধাও হয়ে গেল। আবার বড়ো চায়ে চুমুক দেবেন তিনি। বারবার ঢোঁক গিলে দেখবেন গলার চাপচাপ ভাবটা ফিরে আসছে কিনা। কিন্তু নাহ্‌। অস্বস্তিটা আর নেই। নিশ্চিতভাবেই।

    ঠিক তখনই যেন সিদ্ধার্থ শুনতে পাবেন সেই পরিচিত স্বর—'চমৎকার—ভারী চমৎকার—আজকের সকালটা—কি বলেন?'

    মনে হবে কথাগুলি যেন ভেসে আসছে তাঁর বাঁ পাশ থেকে। শুনে চমকে উঠবেন তিনি। চেষ্টা করবেন বাঁ দিকে তাকাতে—আড়ষ্টভাবে। ততক্ষণে হুসহাস শব্দ করে ট্রেনটা বেরিয়ে যাবে প্ল্যাটফর্ম থেকে। সিদ্ধার্থ দেখবেন—নাহ্‌। কেউ নেই তাঁর পাশে বসে।

    তাহলে?

    আবার মনের ভুল?

    এর মাঝে সিদ্ধার্থের ট্রেনটা মিস্‌ হয়ে যাবে আবার।

    সকালবেলা।

    একটি অখ্যাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম।

    প্ল্যাটফর্মে একটিমাত্র বেঞ্চ।

    আর সেই বেঞ্চে বসে আছেন একটি হৃষ্টপুষ্ট ফিটফাট ব্যক্তি। প্ল্যাটফর্মে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে দুচারটি লোক। এই লোকটিকে দেখে মনে হয় তিনি বসে আছেন নিশ্চিন্ত হয়ে।

    হয়তো ভাবছেন—

    —আজ সকালটা বেশ সুন্দর।

    —আরেক ভাঁড় চা নিয়ে আসি।

    —আর দুটো বিস্কুট।

    —অনেক ভোগান্তি গেল।

    —অযথা।

    (কাহিনীটির প্রথমাংশ বিখ্যাত নাট্যকার লুইজি পিরানদেলোর 'দ্য ম্যান উইথ দ্য ফ্লাওয়ার ইন হিজ্‌ মাউথ' অনুসরণে)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments