পত্রবিহীন উলঙ্গ গাছগুলোর কালো শাখা-প্রশাখার ভেতর দিয়ে বয়ে যায় হিমেল হাওয়া। নিচে সাদা তুষারের পুরু আস্তরণ। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গাছের পেছনের ইমারতের আলোকসজ্জা দেখি। ব্যালকনি জুড়ে হরেকরকম ও রংয়ের আলো। অথচ কী দীপ্তিহীন তারা, চারপাশের তমসাকে যেন আরো গাঢ় করে তুলছে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে এই আলোকসজ্জাটাকে দেখি। শীতার্ত রাতের পটভূমিকায় এই আলো বিমর্ষ আবহের জন্ম দেয়। এরা ঝাড়বাতি বা জোরালো বাল্বের আলো নয়; লতানো রঙিন ক্রিসমাস ডেকোরেশন বাল্ব। অপরিমেয় অন্ধকারের অবজ্ঞার চাহনি বড় লজ্জা দিচ্ছে এই অনুজ্জ্বল বাতিগুলোকে।
ওদেরকে জ্বলতে দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়, আবার এরা জ্বলা বন্ধ করে বিদেয় নিলেও ভেতরটা অস্থির হয়ে ওঠে। ক্রিসমাস পর্ব সমাপ্তির পরও কিছুদিন জ্বলে যায় এরা। এই আলোগুলোর একটা মিল খুঁজে পাই ছোটোবেলায় সাঁঝের বাতি জ্বলবার সময়ের সাথে—যেন অতীতকালের অব্যক্ত অনালোকিত অধ্যায় পাণ্ডুর চোখ মেলে চেয়ে আছে।
এইপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে হাড্ডিসার কালো গাছগুলো, তারই সমান্তরালে লাল-সাদা-সবুজ-নীল-হলুদ-ম্যাজেন্টা বাতিগুলো ধুঁকে ধুঁকে জ্বলছে।
একরাতে যা কখনও ঘটেনি, তাই ঘটল। আলো নিভে গেল। এ তো আর বাংলাদেশ নয় যে বারবার লোডশেডিং হবে আর মোমবাতি জোগাড় করে রাখতে হবে। মোমবাতি ছিলনা। রাতটা নিকষ কালো আঁধারে কাটতে লাগল। সেলফোন উঠালাম রাত্রিকে ফোন করব বলে। সেলফোনে সময় দেখলাম, রাত দু'টো। ফোনটা করলাম না; রাত্রি ঘুমিয়ে থাকতে পারে। এখন ভরসা ও যদি নিজ থেকে ফোন দেয়। রাত্রির কাছে দুনিয়ার খবর থাকে। সে সিবিসি নিউজ দেখে, ফেসবুকে বসে থাকে। অনলাইনে বাংলাদেশের পত্রিকা পড়ে।
সোয়া দু'টোয় সেলফোন বেজে উঠল। রাত্রি ফোন করেছে। 'তোমার বাসায় ইলেক্ট্রিসিটি আছে?'
'না', বললাম, 'এমন তো কখনও হয়নি। ইলেক্ট্রিসিটি তো যায় না!'
'তুমি বাসায় কখন থেকে?'
'কেন অফিস থেকে ফিরে এসে বাসাতেই তো আছি। মানে ন'টায় ফিরে এসেছি। আরো আগেই আসতাম, কলিগের সাথে বাইরে ডিনার সেরে এসেছি...।'
'অত কিছু শুনতে চাচ্ছিনা...। জানতে চাইছি, তুমি তো ন'টা থেকে ঘরে, তাইতো?'
'কেন জরুরি কিছু? ইন্টারভিউ নেবে নাকি?'
'তোমার ইন্টারভিউ নেয়া উচিৎ। সবাইকে জানানো দরকার—টরোন্টো কেন অন্ধকারে ডুবে গেছে আমাদের রেজা সাহেব জানেন না।'
'কেন ডুবে আছে?'
'স্টর্ম হয়েছে। আইস স্টর্ম। ওভারহোয়েলমিং, গত দেড় দশকে এমনটি ঘটেনি।'
রাত্রির কথা শুনে আমিও ওভারহোয়েলম্ড হয়ে গেলাম। দুইটি পদার্থের ওপর আমার মেজাজ খারাপ হলো। এই রিপোর্টার মহিলা আর টরোন্টোর আবহাওয়ার ওপর। দু'টিকেই আমার খুব দেমাগি মনে হয়। একজন নিজেকে জাহির করবে, আর অন্যজন উইণ্ড-এর নানাপ্রকার তেলেসমাতি দেখাবে।
'কী হলো কথা বলছো না যে!'
'পরে বলব। মন ভালো নেই। সকালে জামাল ভাইকে হসপিটালে দেখতে যাব। উনার স্ত্রী ফোন করেছিলেন। অবস্থা খুব একটা ভালো না।'
রাত্রির আচরণ মাঝেমধ্যে আমাকে আহত করে। সে প্রায়ই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যায়। ওর অনুসন্ধিৎসু মন, জার্নালিজম পড়ে শেখা টেকনিক অকাতরে আমার ওপর প্রয়োগ করে। টু বি সেফ, এসব ক্ষেত্রে কনফ্লিক্টগুলো এড়িয়ে চলি।
সকালে বাইরে বের হয়ে তড়িতাহত হলাম। এমন দৃশ্য দুই চোখ সার্থক করে দেয়, যদিও রাতটা ছিল বিভীষিকাময়। আইস স্টর্মে অনেক ক্ষতি-ভোগান্তি হয়ে গেছে। আধো জাগরণে, আধো ঘুমে রাতভর পটকাবাজি শুনেছিলাম কিন্তু ভাবতে পারিনি টরোন্টোর কতটা ক্ষতি হয়ে গেছে। দমকা হাওয়ায়, তীব্র ঠাণ্ডায় গাছের ডালগুলি পটপট শব্দে ভেঙেছে সারারাত।
ঘরের উষ্ণতায় বসে বাইরের তাণ্ডব টের পাওয়া যায়না। যাবে কী করে। সর্বক্ষণই জোরালো উইণ্ড প্রবাহিত হয়। মোটা স্লাইড গ্লাসের ওপারে সংহারী উইণ্ড গাঁ গাঁ শব্দে জীবন বিষিয়ে তোলে। এখন প্রতিদিনের এই উইণ্ড যে আইস স্টর্মে পরিণত হয়েছিল রাত্রে, তা কী করে বুঝব?
সূর্য ওঠেনি কিন্তু একটা আভা ছড়িয়ে আছে প্রকৃতিতে। চারিদিকে কাচের উৎসব। পত্রশোভিত ও পত্রবিহীন-দুইরকম গাছই গায়ে ক্রিস্টালের জড়োয়া জড়িয়ে নিয়েছে। গাছপালার কালো ডালগুলোতে কাচের আবরণ। মনে মনে নাম দিয়ে দিলাম কাচ গাছ। সাইড-ওয়াকে, রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়েছে। বৈদ্যুতিক পোল নুয়ে পড়েছে। সাইড-ওয়াকের পাশে দাঁড়ানো দুয়েকটি গাড়ি গাছচাপা পড়ে দুমড়ে গেছে।
মাইনাস আঠারো তাপমাত্রায় (আসলে ঠাণ্ডা-মাত্রায়) বেরিয়েছি। গাড়ি নিলাম না। এখন গাড়ি চালানো আর আত্মহত্যা করা এক জিনিস। রাস্তায় দেখলাম আটকে পড়া গাড়িগুলো আপাদমস্তক বরফে ঢেকে গেছে।
সাবওয়ে ট্রেনে চেপে কলেজ স্টেশনে নামলাম। মিনিট দশেক হেঁটে প্রিন্সেস মার্গারেট ক্যান্সার সেন্টারে পৌঁছালাম। অনেকদিন থেকেই জামাল ভাইকে আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছিল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম বিছানার সাথে মিশে আছেন জামাল ভাই। তিনি চোখ বুজে আছেন, কিংবা ঘুমিয়ে আছেন। মুখটা ফ্যাকাশে, গ্রহণ-লাগা চন্দ্রের মতো নিষ্প্রভ। পুষ্প ভাবি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, 'আজ ডাক্তাররা এসে সব জানিয়ে গেছে।'
'কী জানিয়ে গেছে ভাবি?' উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালাম।
'ওকে নিয়ে যেতে বলেছে। তিনমাস সময় বেঁধে দিয়েছে...।' ভাবি হু-হু কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কী বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কান্না থামিয়ে ভাবি বললেন, 'তুমি আমাদের টিকিটটা করে দিতে পারো রেজা?' জামাল চাচ্ছে বাংলাদেশ যাবে। যা হবার সেখানেই হোক।'
বললাম, 'নিশ্চয় ভাবি। আমি টিকিট কাটব। কবে যাবেন?'
'পরশু'।
'ঠিক আছে।'
'আর...।' পুষ্প ভাবি একটা হাত সামনে বাড়িয়ে আমার দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে আবার থেমে গেলেন।
'কিছু বলবেন ভাবি? আপনি একদম ইতস্তত করবেন না।'
'মানে, আমার অ্যাপার্টমেন্টের জিনিসগুলো...।'
'আপনার ফার্নিচার, মালামাল—যা আছে সব বিক্রি করে বাংলাদেশে আপনার কাছে টাকা পাঠিয়ে দেব।'
ভাবি চোখ বুজে কিছুক্ষণ আমার দুইহাত ধরে থাকলেন। আমার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠল। দ্রুত ঘুরে সরু প্যাসেজ ধরে ছুটলাম।
রাত্রি আমাকে একের পর এক আঘাত দিয়ে চলল। গত কিছুদিন যাবৎ সে আমার সাথে ভালো ব্যবহার করছে না। রাত্রি কি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে চাইছে!
তারপর রাত্রি সেদিন আমাকে ডেকে নিয়ে অপমান করল। ওর অ্যাপার্টমেন্টে আমাকে কফি দিয়ে বরণ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে জানাল আমার নাকি নায়াগ্রা সিনড্রোম আছে। আমি অন্ধের মতো অন্যকে অনুসরণ করি। বিশ্বাস করি!
'গত তিনবছরে কয় ডলার তুমি জমিয়েছো? সব তো দিয়ে দিয়েছ কী যেন নাম—পুষ্প ভাবিকে। পরোপকার করে বেড়াও আর সঞ্চয়ের নামে ঘন্টা। তোমার সাথে আমার পরিচয়ের পর থেকে যত টাকা তুমি মানুষের পেছনে খরচা করেছ, সেটা হিসেব করলে নেট চল্লিশ হাজার ডলার হয়।'
'বুঝতে পারছি, তোমার সাথে আমার হিসেবের গরমিল হয়ে গেছে।'
'তোমাকে একটু সংযত হতে বলেছিলাম।'
'আমি পারিনি। ভাবি কিছু টাকা চাইলেন... চিকিৎসার পেছনে জামাল ভাই আর ভাবির সব টাকা শেষ হয়ে গেছে।'
'জামাল ভাইকে আরো টাকা দিতে হবে?'
'না। তাদের টাকা নেবার পালা শেষ। উনারা বাংলাদেশে চলে গেছেন। যেদিন শেষবার উনাকে ডাক্তাররা দেখতে এসেছিলেন, সেদিন জামাল ভাইকে নব্বুই দিন সময় দিয়ে দেয়া হয়। সেটা তিনদিন আগের ঘটনা। এখন উনার আয়ু আছে সাতাশি দিন।'
'সাতাশি দিন!' রাত্রি অস্বাভাবিক দৃষ্টি মেলে তাকাল। তারপর যেন ফিরে পেল নিজেকে, 'শেষ দেখা হলো না! বিশ্বাস করো, আমি উনাকে দেখতে যেতে চাইনি তা নয়, আমি ভাবতে পারিনি... এত তাড়াতাড়ি, মানে উনারা নেই! তুমি আগে বলোনি কেন!' রাত্রি উদ্ভ্রান্তের মতো তাকাল।
রাত্রিকে ধাতস্থ হতে সময় দিলাম। সময় নাকি সবচেয়ে ভালো নিরাময়কারী। আমার নিজের ক্ষেত্রেও তো তাই ঘটেছে। তিনদিন আগে পুষ্প ভাবি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন, আমিও দু'ফোঁটা অশ্রু ঝরিয়েছিলাম। কই তারপর তো আর কাঁদিনি! আমার স্ত্রী যেদিন চলে গেল, সেদিন আমি বুকে পাথরের ভার অনুভব করেছিলাম। অথচ আজ চারটি বছর তো সেই ভার আর অনুভব করিনি। কেবল মাঝেমধ্যে বুকটা কেমন টনটনিয়ে উঠত। আজকাল তা-ও হয়না।
রাত্রি বলল, 'আমাকে ভুল বুঝো না। আসলে ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়। যেদিন থেকে তোমাকে ঘিরে স্বপ্নে বিভোর হয়েছি, সেদিন থেকে তোমার খরচের বহর দেখে আমার মনে হয়েছিল বোধহয় আবার কোনো ভুল করতে যাচ্ছি।'
রাত্রির চুলে হাত বুলিয়ে দিলাম। বললাম, 'আর তো কোথাও খরচ করতে পারব না। চলো বিয়ের আগে ক্যানেডিতে তোমার সেই স্বপ্নের বাড়িটি কিনে ফেলি।'
রাত্রি বিহ্বল চোখে তাকাল আমার দিকে। রাত্রি ফুঁপিয়ে উঠল। আমি অবাক হলাম। ওর কাছে এলে বা ওর সাথে সংলাপে গেলে প্রতিবারই অবাক হই। বিভ্রান্তিতে পড়ি। রাত্রিকে অচেনা মনে হয়। এক অতি চেনা মেয়ের অচেনা রূপ দেখে অস্বস্তি নিয়ে ফিরে আসি। ফের ছুটে যাই।
'ভয় হয়, রেজা।'
'কেন ভয় হয়!'
'যদি তোমার কোনোদিন মন ঘুরে যায়। যদি কোনোদিন আমাকে উচ্ছ্বিষ্ট ভাবো।'
হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলাম। রাত্রি এমন করেই বলে। আগেও বলেছে। কিছু বলতে গেলাম, কিন্তু কণ্ঠ দিয়ে স্বর বেরুল না। রাত্রির চোখে কৌতুক নাকি বিপন্নতার ছায়া! সেদিকে তাকিয়ে বললাম, 'একথা আগেও বলেছ।' তারপর ঘুরে দাঁড়ালাম। রাত্রি দৌড়ে এসে বাইরের দরজা আগলে দাঁড়াল।
দরজার দিকে এগুলাম আমি। রাত্রি দুইহাতে চোখ ঢেকে দরজার গায়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে পিছলে পড়ল। তারপর কোলের ওপর মাথা নুইয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
...রাত্রির মায়াময় মিষ্টি মুখখানা আমাকে দারুণ ভাবে টানত। আমি হারিয়ে যেতে চাইতাম ওর পাখির নীড়ের মতো চাহনিতে। কিন্তু সে-রাতে সব কেমন এলোমেলো লাগল।
তীরবেগে ছুটে এসে রাত্রি ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। তারপর কাঁদতে লাগল আইস স্টর্মের বেগে। আমাকে জাপটে ধরে থাকল। আমি ওর শরীর আর চুলের মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিলাম।
'আমাকে চিরদিন তোমার কাছে রাখবে তো?'
রাত্রি যেন ওর অস্তিত্ব নিংড়ে কথাটা বলল। আমার চোখের সামনে থেকে অতীতের কুঞ্চন চিত্রগুলো একে একে বিদেয় নিল। ক্যানেডির কেনা অ্যাপার্টমেন্টে একত্রে বসবাস করার সুখস্বপ্নে বিভোর হলাম। মনে হলো, রাত্রির মতো একটা মেয়েকে বুঝতে পারাটা স্বর্গ জয় করার মতো। ওর ভূতপূর্ব স্বামী ডা. আজমল হোসেন মানুষের শরীর নিয়ে নাড়াচাড়া করত। মন নিয়ে নয়। পসার হয়ে যাবার পর রোগীর গলা কাটত। পয়সার মোহে সে ঘরসংসার-ভালোবাসা, দায়িত্ব—সব বিসর্জন দিল। তিনটি বছর সে ভুল করেও রাত্রিকে কোনো সময় দেয়নি। রাত্রি স্বপ্নেও ভাবেনি তিনবছরের বিপুল পরিমাণ অর্থের ছিটেফোঁটাও তার ভাগ্যে জুটবে না। সমস্ত অর্থ ব্যয়িত হয়ে গিয়েছিল পরকীয়ায়। লোকটা একান্ত সেবায় সারিয়ে তোলা এক রূপসী রোগিনীর প্রেমে মজে গিয়ে একসময় নিঃশেষিত হয়ে মদ ধরেছিল।
লজ্জায়-ঘৃণায়-অপমানে রাত্রি শেষ পর্যন্ত এমন একটা পিশাচকে ত্যাগ করে। সে চলে আসে এদেশে...।
তা রপর ক্যানেডির এক আলোকোজ্জ্বল কমিউনিটি সেন্টারে আমার আর রাত্রির মহামিলন ঘটে গেল।
চারধারের অত্যুজ্জ্বল বাতিগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার কেবলই জামাল ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। এদেশে তিনি এসেছিলেন আমার আসার বহু আগে। আমি তখন সবে এসেছি। একটা কাজ পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম। সেইসময় বাঙালি এলাকায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে জামাল ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। নানা বিষয়ে তাঁর সাথে মতের মিল হয়ে গেল। তারপর থেকে জামাল ভাই নিয়মিত আসতেন আমার অ্যাপার্টমেন্টে, দু'জনে হুইস্কি খেতাম। আমি এক শীতার্ত সন্ধেয় সেই আলোকসজ্জাটাকে দেখিয়ে বলেছিলাম, 'জামাল ভাই, আলোগুলোকে দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়।' জামাল ভাই চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন, 'এই আলো মন খারাপ করে দেয়, কারণ এরা ক্ষণস্থায়ী।'
জামাল ভাই এখানকার এক বাঙালি বন্ধুকে ধরে আমাকে একটা গ্রোসারি স্টোরে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন সেই কাজটা না পেলে মহাবিপদে পড়তাম। জামাল ভাই সিকিউরিটি সুপারভাইজারের কাজ করতেন। নিজেই ড্রাইভ করতেন এবং কোম্পানির সুনজরে ছিলেন। তবে তিনি অতিরিক্ত পরিশ্রম করতেন—ওভারটাইম, উইকএণ্ডে কাজ, কোনোটাই বাদ দিতেন না। আর গিলতেন হুইস্কি।
তারপর একদিন আমি দেশে এনভায়রনমেন্টে চাকরি ও বিদেশে ট্রেনিংয়ের সুবাদে এখানে কাগজপত্র দাখিল করে প্র্যাক্টিকাম সমাপ্ত করলাম। চাকরি পেলাম টরোন্টোর একটা প্রতিষ্ঠান এনভায়রনমেন্ট অ্যাণ্ড জিও সার্ভিসেস ইনক-এ। সমস্ত দিন ব্যস্ত থাকতাম কাজেকর্মে। বাসায় ফিরে আমার নিয়মিত মন খারাপ হতো। আর গত তিনটি বছরে আমার বেলকনি থেকে দেখা সেই জঙ্গল আর পেছনের বিষণ্ণ বাতি আমাকে অতীতে টেনে নিয়ে যেত। জামাল ভাই আর দুয়েকজন ছাড়া কারুর সাথে মিশতাম না আমি। আসলে সময় পেতাম না। উইকএণ্ডে মাঝেমধ্যে ওটাওয়া যেতাম ভাগ্নির বাসায়। আর বিশেষ পর্বে, মানে পহেলা বৈশাখ বা একুশের অনুষ্ঠানে যেতাম। বাঙালি-অধ্যুষিত ক্রেসেন্ট টাউনের পহেলা বৈশাখের এক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছিল একটি মেয়ে—রাত্রি। আমি প্রশংসা করছিলাম রাত্রির গানের। এভাবেই পরিচয়, পরে অভিসার এবং সবশেষে আমাদের স্থান হলো ক্যানেডি রোডের তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে।
সাতাশি দিন পেরিয়ে গেল কিনা বলতে পারব না। আমার আর রাত্রির আনন্দ-আবেশের সময়টাতে দিনরাত্রির হিসেব ছিল না। মনে হল, সাতাশি দিন পেরিয়ে গেছে। ভাবি ফোন করেছিলেন একদিন। জানিয়েছিলেন, জামাল ভাই খুব কষ্ট পাচ্ছেন। এক শনিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো ভাবিকে একটা ফোন করা উচিৎ।
এসময় রাত্রি এসে সামনে দাঁড়াল। দু'জনেরই বন্ধু। রাত্রি স্নান সেরে এসেছে। গাউনের ফিতা লাগাতে লাগাতে বলল, 'তুমি তখন ঘুমিয়ে ছিলে। পুষ্প ভাবি ফোন করেছিলেন...।'
'জামাল ভাই নেই, তাইনা?'
'হ্যাঁ, ভাবি বললেন, জামাল ভাই নাকি অমানুষিক কষ্ট পাচ্ছিলেন। কিন্তু যাবার সময় তিনি খুব শান্তভাবে চলে গেছেন।'
স্তব্ধ হয়ে রইলাম। রাত্রি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বিড়বিড় করে বললাম, 'জামাল ভাই নেই, তাইনা? অথচ তিনি ছিলেন। গত সাতাশিটি দিন তিনি ছিলেন।'
'চলো আজ কোথাও বেড়িয়ে আসি। তুমি না বলেছিলে টরোন্টো আইল্যাণ্ডস-এ যাবে।' রাত্রি বলল।
'থাক রাত্রি। মন ভালো নেই আমার।'
রাত্রি আবার বলল, 'তবে থাক। আজ তোমার জন্য ভুনা খিচুড়ি করব। তুমি একটু আরাম করো। বেলকনিতে যাও, বাইরে চেয়ে দেখ কাঠাবেড়ালিগুলো কেমন লাফালাফি করছে।'
মিটিমিটি হাসছে রাত্রি, ওর হাতে সিগারেটের প্যাকেট। সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, 'বেলকনিতে সিগারেট টানো গিয়ে। আমি ততক্ষণে তোমার জন্য খিচুড়ি করে ফেলি।'
রাত্রি আমার সিগারেট খাওয়া একেবারেই পছন্দ করেনা; বাসায় তো প্রশ্নই আসেনা। সেই রাত্রিই সিগারেট বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। বেলকনিতে চলে এলাম। বাইরেটা রোদে উজ্জ্বল। টরোন্টোর ইতিহাসে আরো একটা সামার যোগ হলো। আমার চোখে ভাসে আগের অ্যাপার্টমেন্টের সেই জঙ্গলটা আর তার আড়ালের অনুজ্জ্বল বাতিগুলো।
হঠাৎ মনে হলো কেন ওই বাতিগুলো দেখলে আমার মন খারাপ হতো। যেদিন ও চলে গেল, সেদিন পাশের বাড়িতে একটা বিয়ে হচ্ছিল। দুইরাত ধরে তেজের সাথে জ্বলে একদিন বাতিগুলো কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল। উত্তর খুঁজে পেয়েছি। রাত্রিকে জানাব বলে বেলকনির চেয়ার ছেড়ে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে ওকে ডাক দিতে গিয়েও দিলাম না। কিছু কিছু কথা থাকে, যা কাউকে বলা যায়না।
সেই ক্ষণিকের আলো আর একটা অভিশপ্ত অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একদিন পাড়ি দিয়েছিলাম অন্য একটি দেশের উদ্দেশে।