জায়গাটার নাম গাংমুড়ি। গঙ্গা দিয়ে মোড়া, গঙ্গা নদী ঘিরে থাকা গ্রাম। এখানে গঙ্গা অবশ্য ময়ূরাক্ষী। একটা শীর্ণকায়া নদী আছে, ভারী সুন্দর তার নাম। কুশকর্ণিকা। কুশকর্ণিকার জন্ম বীরভূম আর ঝাড়খণ্ডের সীমানায়। বীরভূমের চয়নপুরে আর ঝাড়খণ্ডের বাহিঙ্গায়। বীরভূমের সাহাবাদ, জাহানাবাদ দিয়ে বয়ে আসছে খেজুরঝুড়ি নদী, ভদ্রকালী হয়ে বয়ে এসে আড়ালির কাছে দুই নদীর সঙ্গম। তারপর দুই নদী একসঙ্গে গিয়ে মিলবে ময়ূরাক্ষীর সঙ্গে।
গাংমুড়ি ছাড়িয়ে এসে সাহাবাদ, জাহানাবাদ, লতাবুনি।
তিনটে গ্রামের মাঝ বরাবর এই মেলা। জটাধারী শিবের মেলা। কোনো শিবমন্দির নেই অবশ্য। বিরাট এক অশ্বত্থ গাছের নিচে একটা মস্ত ত্রিশূল। তেল সিঁদুর হলুদে মাখামাখি। খুব জাগ্রত। আশপাশের দশটা বিশটা গাঁয়ের লোক মানত করে। জটাধারী বাবার কাছে মানত রেখে কত মায়ের কোল আলো করে সন্তান এসেছে। সেই সব বিশেষ আশীর্বাদী সন্তানদের মাথায় পাঁচ বছর চুল রাখা হয়, যেন জটা পড়ে। তারপর এই মেলার সময় এসে চুল কেটে পুজো দেওয়া হয় ।
গাংমুড়ির সরস্বতী কী কুক্ষণে যে এই মেলায় এসে পড়ল। কুক্ষণ যে তা অবশ্য বোঝা যায় নি। বেশ শুভক্ষণ মনে হচ্ছিল।
আট বছর পর মা হবার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। সরস্বতী খুশি। খুশি শ্বশুরঘরের সবাই। সুলক্ষণা বৌমাকে শাশুড়ি নিজে মেলায় নিয়ে এসেছে। জটাধারী বাবার পুজো দিতে হবে। মেলায় এত আলো, এত ঝলমলে দোকান, মাইকে গান, আলকাপ, কীর্তন, কবিগান।
দূর দেশে থাকা বরের জন্যে সরস্বতীর মনখারাপ করছিল।
গ্রাম থেকে না-হোক বিশ বাইশ জনের একটা দল এসেছে। সারা রাত ধরে সিনিমা দেখবে। সাদা পর্দায় রঙিন সিনিমা। দূর দূর গ্রাম থেকে গরুর গাড়ি করে লোক আসছে। মরদগুলা সব লাইন দিয়ে টিকিট কিনতে গেল ।
কেউ গেল আলকাপের আখড়ায়। কেউ সাধুদের কীর্তনে। বউ-মেয়েরা সব সাঁঝবেলায় পুজো দিয়েছে। তারপর যে যার মতো মেলা দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। সরস্বতীও। চাল রাখার বড় মটকা, পাথরের শিল, বড় লোহার কড়াই, কাঠের হাতা, ছোট একটা বালতি। শাশুড়ি-বউ মিলে সব কিনেছে। বুড়ি শাশুড়ি বলল, ‘আর পারি না রে বউ, তু ঘুরে ফিরে দ্যাখ। আমি সব মালপত্তর নি বসছি। ‘লতাবুনির মহুল, সম্পর্কে শাশুড়ির বোনের ভাগনা-বউ, সেও শাশুড়ির সঙ্গে এসেছে। মেলায় এসে দুই বোনে দেখা, দুই বোনে মিলে বসে পড়ল। ‘তুরা যা, ঘুরে আয়।'
মহুলের সঙ্গে সরস্বতীর আরেকটা কাছের সম্পর্কও আছে। মহুল সরস্বতীর নিজের ছোটকাকার মেয়ে। বিয়ে হওয়া নিয়ে একটু দূর সম্পর্ক হয়েছে এখন। আসলে সীতানাথের সঙ্গে বিহা বসার কথা ছিল মহুলেরই। কিন্তু লক্ষীমন্ত সরস্বতীকে দেখে সীতানাথ জেদ ধরেছিল, আর কাউকে বিহা বসবে না। সে-নিয়ে ছোটকাকার বাড়ি থেকে অনেক কথা হয়েছিল। তারপর সীতানাথের মা-ই নিজের বোনের ছেলের সঙ্গে মহুলের বিহা দিয়ে সম্পর্কটা ভালো করেছে।
মহুল বলল, ‘ফটোক তুলবি সরসতী?’
সলমন খানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল মহুল। পেছনে সবুজ বাগান আর ফোয়ারা, সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলল সরস্বতীও। ঝাল ঝাল পাঁপড়, বেগুনী, মাংসের চপ, ঘুগনি। শাশুড়ির জন্যে চারটে বড় বড় জিলিপি নিল সরস্বতী। আর মহুলকে লুকিয়ে বরের জন্যে একটা লাল ডোরাকাটা লুঙ্গি। শহরে কাজ করে সীতানাথ, আসছে রবিবার আসবে।
অনেকক্ষণ ধরেই ঘুরঘুর করছিল তিনটে ছেলে, মহুল চোখ পাকিয়ে হি হি করে হেসে মজা পাচ্ছিল। ‘চল মহুল, উদিকপানে যাই’ বললেও শুনছিল না। বরং ‘আয় না সরসতী, কাঠি বরফ খাবি’ বলে হাত ধরে টানাটানি।
কখন থেকে যেন ছেলেগুলা সঙ্গে ঘুরতে লাগল।
হলুদ সবুজ মাথার পিন, রঙিন কাচের চুড়ি, পায়ের নূপুর। হি হি হেসে ছেলেগুলোকে দিয়েই সব কেনাকাটা করল মহুল। ওদের চোখ ভালো নয়, হলুদ দাঁতে ময়লা হাসি। ভয় করছিল সরস্বতীর। শাশুড়ি বসেছিল নাগরদোলার কাছে, ফটোক-তোলার জায়গাটার পাশে। কোথা দিয়ে গেলে যে সেখানে পৌঁছনো যাবে।
‘ডরিস নাই, আমি আছি তো। আমি তুর বহিন না? ই ছেলেগুলা ভাল রে, ডর করিস নাই’, মহুল হাত ধরে টানতে লাগল।
ফ্যানা ফ্যানা গ্লাস, লাল লাল জল নিয়ে সাধাসাধি করছিল ছেলে তিনটে, ‘এক চুমুকে খায়ে দ্যাখো। শরীল ঠাণ্ডা হবে।'
হেসে গড়িয়ে পড়ল মহুল, ‘বুঝি নাই, না? লিশা করাবে আমাদের?’
‘না গ দিদি, লিশার জিনিস নয়। নাচনী মেয়াগুলার হাতের তৈরি শরবত। বহুত মিঠা।'
নাচনী! সীতানাথ বলেছিল মেলার নাচনীদের কথা। এদিকের মেলার প্রধান আকর্ষণ এই নাচনী। গাংমুড়ি, লতাবুনি, সাহাবাদে ওদের বলে ঝুমরী। কুশকর্ণিকার ধারে গ্রামে ঝুমরী-বস্তী। বাহিঙ্গার দিকে ওদের নাম নাচনী।
দলে শুধুই মেয়ে। আট-দশ জনের দল। ওরা সারা বছর এর ওর বাড়ি দাসীবৃত্তি করে। আর মেলার সিজনে ঝুমরী, নাচনী। মেলায় মেলায় ঘুরে নাচে। সেই নাচের আসরেই ওদের এক রাতের জন্যে কিনে নেয় পুরুষ। রুমালে পয়সা বেঁধে ছুঁড়ে দেয়, টাকার মালা পরিয়ে দেয়। মেলার মরশুম শেষ হলে ঝুমরী মেয়েরা গ্রামে ফিরে যায়। ঘর সংসার করে আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতই। গাঁয়ে সে নিয়ে কোনো বাধা নেই। এই দেহ-পসারিণী বৃত্তি ওদের জাতি-ব্যবসা।
সরস্বতীর খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার ও মেয়েগুলাকে দ্যাখে। কেমনধারা মেয়েলোক, ওদের মরদগুলাই বা কেমনধারা। খুব রাগ করেছিল সীতানাথ।
‘খবরদার যাবি নাই। উ মেয়ারা জাদুটোনা জানে। ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে চলে যাবে। উয়াদের লতুন লতুন মেয়া চাই না ব্যবসার জন্যে?’
আগে আগে মেলায় এলেও সীতানাথের জন্যেই নাচনী দেখা হয় নি। এবার একবার দেখলে হয়। মহুলকে বলবে নাকি! না থাক, যা ঢলানি মেয়ে! উ ব্যাটাছেলাগুলাকে বলে না দেয়!
দোকানে দোকানে হ্যাজাকের আলো। ভটর-ভটর শব্দ করে কোথায় জেনারেটর চালু হল। অমনি সিনিমার তাঁবুতে, ফটোকের দোকানে বিজলী বাতি জ্বলে উঠল। আওয়াজে কাছের লোকের কথাও শোনা যাচ্ছে না। এদিকটায় অবশ্য তেমন লোকজন নেই। দোকানপাট কম। একটু দেখেই বুঝতে পারল কারণটা। দোকানে দোকানে নেশার জিনিস। মাতালের হল্লা। তাই অন্য দোকান নেই। তাড়াতাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে যেতে হবে।
যেতে পারলে তো! শক্ত করে হাত ধরে রেখেছে মহুল। মাতালের মতই এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে চলেছে। ‘উদিকপনে চল মহুল’, সরস্বতী ফিসফিস করে বলল।
হেসে গড়িয়ে পড়ল মহুল, ‘ডরিস ক্যানো? আমি আছি তো।'
কী বিপদেই না পড়া গেছে! কি যে করে সরস্বতী! বুড়ি শাশুড়ি খোঁজাখুঁজি করছে নিশ্চয়। গাঁয়ের সুধীর ঠাকুরপো, বীণার ভাই সুবল... এতক্ষণ সরস্বতীকে না দেখে একবার খোঁজ নেবে না!
‘উই দ্যাখ সরসতী। নাচনী।' মহুল হাত তুলে দেখালো যেদিকে, সেখানে অনেক লোক গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে।
‘লাচ দেখবি? আয়, দেখে নে। ইয়ার পর আর...' কথা শেষ না করে চোখের ইশারা করল।
হিমানী, পাউডার মেখে সাদা সাদা মুখ, তাতে গালে লাল লাল রুজ, কাজল টানা চোখ। মাথায় রঙিন ফিতে, খোঁপা। হারমোনিয়ামের আওয়াজ, তবলার বোল।
‘দেখ তো লিজ্জলকে ঘিরেই আছে পথকে দিব না দিব না আমি পরের দখলকে মানা করত তর খলকে যেন নাই ধরে আঁচলকে...’শিস দিয়ে দিয়ে নানারকম অঙ্গভঙ্গী। ছি ছি, এই দেখতে এত লোকের ভিড়!
এদিকে ঝুমরীরা ছাড়া কোনো মেয়ে-বউ নেই। সবাই অবাক চোখে ওদের দেখছে। মেলার সব লোক এইখানে এসে ভিড় করছে। ভিড়ের মধ্যে গাঁয়ের লোক খুঁজছিল সরস্বতী। চোখেও পড়ছিল, কিন্তু কাউকেই ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছে না।
এক একজন নাচনীকে বায়না করছে লোক। মোটা মত এক মহিলা, মুখভর্তি পান, নাকে বড় বড় নাকছাবি, পয়সা নিয়ে মেয়েদের নাম বলে দিচ্ছে। নাচ শেষ হলে রাতের মতো খদ্দেরের সঙ্গে চলে যাবে তারা।
এই পর্যন্ত মনে পড়ে সরস্বতীর। আর কিছু মনে নেই।
যখন জ্ঞান ফিরেছিল, তখনকার কথাও ঠিক মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে একটা আমবাগান, চারদিকে মদের খালি বোতল, বিড়ি-সিগারেটের স্তূপ, বিশ্রী গন্ধ। মনে পড়লেই গন্ধটা আজও পায় সরস্বতী।
উঠতে পারে নি। তলপেটে অসহ্য ব্যথা। সারা শরীরে ব্যথা। কারা যেন তুলে নিয়ে একটা গরুর গাড়িতে তুলে দিল। আকাশ ফর্সা হয়ে সাদা আলোয় ভরে উঠছিল চারদিক। সরস্বতীর চোখে আঁধার ।
সরস্বতী নাম এখানে কেউ বলে না। মাঝে মাঝেই ডাক দেয় বাতাসীদিদি, ‘এ সরসতিয়া, ইখানে আ।' মীনা, রূপা, লছমিয়া সবাইকে ডেকে ডেকে বলে, ‘সরসতিয়াকে দেখভাল কর তোরা।'
বাতাসীদিদি, নাকে বড় নথ, মুখভর্তি পান। ঝুমরীদের সর্দারনী। একেই সে রাতে দেখেছিল সরস্বতী।
তাছাড়া বাসন্তীমাসী আছে। বাতাসীদিদির পিসশাশুড়ি। আগে এ দলের সর্দারনী ছিল। এ বয়সেও বেশ বোঝা যায়, রূপ-যৌবনের কেমন টান ছিল তার। নাকে নোলক, হাতে মোটা তাগা, গলায় নাহোক সাত-আটখানা মাদুলি, কোমরে বিছে।
সব মেলায় যেতে পারে না, শরীলে জুত নেই আর। এখন লোকের বাড়ি কাজ করে, ধান ভেনে, বাচ্চাদের তেল মালিশ করে দিন গুজরান। তবু দাপট যায় নি। কাছেপিঠে মেলা হলে আসে। শরীর ভারী হয়েছে, আর নাচতে পারে না, লাঠি ধরে ধরে হাঁটে। কিন্তু গলা আজও একইরকম দরাজ, একইরকম মিষ্টি। মেলায় এলে আসরে প্রথম মাসীই গান ধরে ।
আসরের একধারে বসে থাকে বাতাসীদিদির সঙ্গে। একমুখ পান। জরদা আর পানপরাগের সুবাস। পাশে ইয়া বড় পেতলের পিকদানি। রোজ সকালে সেটা ঘষে ঘষে মাজে নিজেই ।
নিজের কানে শুনেছে সরস্বতী, মাসী বলছিল বাতাসীদিদিকে, ‘অমন ভরন্ত গড়ন, অমন বড় বড় বুক। দুধে আলতা রঙ। মাথায় কালো চুলে ঢেউ। লাচতে নামলে আসর ভাসি যাবে। আগুনের মত রূপ। এমন মেয়াকে বসায়ে রাখছিস?’
আগুনপারা রূপ। চোখের চাউনিতে মাদকতা, উত্তাল বুকে আগ্নেয়গিরি। স্বৈরিণী মেয়ের রূপ। দেখলেই লোভ হবে। পুরুষের লালসা জাগিয়ে তুলবে। প্রকৃতির আদিম নেশা। দেহ কামনার আবেগ। আগুনের মতো চেহারা, তাই তো ঝুমরী। এ দলের সব মেয়েরই সম্পদ ওই আগুনপারা রূপ। বিপদও বটে।
তবে গাঁয়ের সব মেয়েই কি আর ঝুমরী হতে পারে? নাচনী হয়ে পুরুষের যৌবনসঙ্গী হতে পারে? সর্দারনী বাসন্তী এ রূপ চেনে।
বাতাসীদিদি অবশ্য বলেছে, ‘ঝুমরী মোদের জাত-ব্যবসা। উয়ার তা নয়।'
‘তাতে কি? উ তো নষ্ট মেয়া। সাত পুরুষের ভোগের মেয়া। সমাজে নিবে নাই। বাপের ঘর, শ্বশুরঘর নিবে নাই। সম্ভ্রম নাই। কুনো পিছুটান নাই। ই মাল থাকলে বহুত লাভ। এমন মেয়াকে তুই কাজে লাগাবি নাই? কত দামে বিকবে, বুঝিস নাই? পাঁচ সাত বছরের টাকা ই এক মেয়া তুলবে।'
সতীত্ব। চরিত্র। ধর্ষিতা হয়েই সব শেষ হয়ে গেল? ভগবান জানেন, স্বামী ছাড়া কোনো পুরুষের দিকে তাকায় নি সরস্বতী । কতগুলো বাজে লোকের জন্যে আজ সবাই ঘেন্না করবে! সবার সামনে নাচতে গাইতে হবে?
আর পেটের ছোট্টটা? সে জন্ম নেবার পর কী বলবে? না না, মরে গেলেও নাচনী হবে না সরস্বতী। ববুয়ার মা হবে নদীর মতো পবিত্র। গাঁয়ের কুশকর্ণিকা নদীর মতো।
শান্ত কুশকর্ণিকা ইতিহাসের সাক্ষী। কিভাবে সেনবংশ ধ্বংস হল, পাঠানরা বীরভূমের একদা-রাজধানী রাজনগর অধিকার করল, রাজনগরের বীররাজাদের ধ্বংস, একসময় উড়িষ্যার রাজা নরসিংদেব বীররাজাদের হারিয়ে রাজনগরের অধিকার নিলেন। তুর্কি আক্রমণ, বর্গী আক্রমণ, ঢেকারো বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ।
শান্ত জলের রঙ কখনো রক্তে লাল, কখনো গাছের ছায়ায় সবুজ। কত ঘাট ধরেই তো বইতে হয় তাকে, নদী অশুদ্ধ হয় না। ববুয়ার মা হবে ওইরকম। শুদ্ধ, সুন্দর, পবিত্র। নদীর মতো।
‘শুন সরসতিয়া, মাসী যদি জানতে পারে, তুর পেটেরটার কথা, তুকে ছাড়বে নাই। শিকড় বেটে খাইয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দিবে। পাপের বাচ্চা দিদি রাখতে দিবে নাই।' অন্য মেয়েরা বুঝিয়েছে।
‘আমার বাচ্চা পাপের বাচ্চা নয়। উ এল বলেই তো আমি বাবার থানে পুজো দিতে আসছিলাম।'
মালতী সুর্মা সাবিত্রীরা সবাই বুঝিয়েছে, ‘এ দুনিয়ায় তুকে কেউ দেখবে না। কিন্তু রূপ থাকলে, যোবন থাকলে ভাবনা নাই। একবার বুকের কাপড় খুলে বসবি। অমনি সব তুর পায়ের কাছে পড়বে। টাকার বাণ্ডিল, শাড়ি, সোনা-চান্দি। কুথায় যাবি? একলা মেয়া দেখলে কত লোক ভোগ করবে। তার চেয়ে এই তো ভালো। মোদের জাত-ব্যবসা। গাঁয়ে সম্মান কত। আমরা মেয়ারা রোজগার করি বলে ক্ষেতিজমি, ঘরে লক্ষ্মী।'
‘হে ভগবান, হে জটাধারী বাবা, তুমি দিয়েছ, তুমিই রক্ষা কোরো’, সরস্বতী একলা ঘরে লুকিয়ে থেকেছে ।
রোজ কেঁদে ভাসিয়েছে, ‘আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমি নাচনী হব না।'
বাতাসী রাগ করেনি, চোখের জল মুছিয়ে বলেছে, ‘কেউ তোকে ঘরে নেবে না, কোথায় যাবি তুই?’
‘আমি গাঁয়ে ফিরব। আমার মরদ, আমার শাশুড়ি, আমার গাঁয়ের লোক। তারা আমায় ঠিক ঘরে নেবে।'
‘তোর মরদ তোকে ঘরে তুলবে না। উ লতাবুনি গাঁয়ের মহুলের বোনের সঙ্গে বিহা বসছে।'
বিশ্বাস হয় নি সরস্বতীর। একবার সীতানাথের কাছে গিয়ে সব বললেই সব আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তাছাড়া এখন শাশুড়ির কাছেও খাতির বেড়েছে। তার বংশের বাতি আসছে যে।
বাতাসীকে ঘেন্না করেছে সরস্বতী। নিজের স্বার্থে, নাচনী দলের একটা মেয়ে পাবার আশায় মিথ্যে কথা বলে আটকে রাখতে চাইছে বাতাসী।
হাজার লোকের মন ভোলানো! হাজার লোকের কাছে শরীর বিকোনো! ছি! তার আগে সরস্বতী মরেই যাবে।
তবু শেষরক্ষা হল না।
‘এ সরসতিয়া, তু নাকি আজ সকালে উল্টী করেছিস?’ মাসী একদিন টের পেয়েছে। ‘বেইমান, নিমকহারাম। মেয়া চরিয়ে ব্যবসা, আমাকে লুকাবি? আমি আগেই বুঝেছি, তু পোয়াতী। দু’বার অষুধ পাঠাইছি, খাস নি তু? এখানও খালাস হয় নি?’ বাসন্তীমাসী চুলের মুঠি ধরে মারল, ‘কেঁদে কেঁদে আর ঢং করবি নাই। এ প্রকাশ, এ ববুয়া, ই মেয়া যদি কথা না শুনে, তুরা আগে ভোগ করবি। দেখব, তারপর কত নাচ না করে থাকে।'
বাতাসীদিদি বলল, ‘না,সরসতিয়া ঝুমরী নয়। উয়াকে কেউ জোর করবি নাই। উ ঘর কে যেতে চায়, তাই যাক। উখানে যদি না থাকতে পেরে ফিরে আসে, তখন দেখা যাবে। উকে আমি কথা দিইছি। সরসতিয়া ভদ্দরঘরের বিটি, ভদ্দরঘরের বউ।'
‘তুইও তো বাপের বিটি। আমিও। ঝুমরী বাতাসীর সঙ্গে ভাইপোর বিয়া দিইছি আমি নিজে, দিই নাই? তুর কোলে যদি বিটি আসত, উকেও তুই ঝুমরী বানাতি নাই?’
‘ঝুমরী মোদের জাত-ব্যবসা। উয়ার তা নয়।'
মেয়েরা আড়ালে বলেছে, ‘দিদি জানে, তু ঘরে থাকতে পারবি নাই। তাই ই সকল কথা। তোকে যদি ঝুমরী না-ও বানায়, দলে ইকটা মেয়া থাকলে কত কাজ কাম হবেক। তুর যদি বিটি হয়, দিদি তাকে ঝুমরী বানাবে। মোদের গাঁয়ের নিয়ম। ছানা হলে বিক্রী করে দিবে।'
মেয়ে হলে ঝুমরী, ছেলে হলে কাউকে দিয়ে দেওয়া। কেন? আশ্রয় দেবার দাম এত?
ভয়ে সারা রাত জেগে থাকে সরস্বতী। নিজের জন্যে যত না ভয়, তার চেয়ে বেশি ভাবনা পেটের ছোট্টটাকে নিয়ে। কত সাধনার ধন। কত ঠাকুর মেনে, জটাধারী বাবার কাছে মানসিক করে পাওয়া। বাপ নিল না, ঘর বলে কিছু রইল না, কি যে আছে ওর কপালে কে জানে। আহা ববুয়া !
‘আমরা এখন ঝাড়গ্রামের মেলায় যাচ্ছি, তোর সঙ্গে যেতে পারব না। প্রকাশ তোকে গাঁয়ে পৌঁছে দেবে’, বাতাসী বলল একদিন। ততদিনে উঠে একটু একটু হাঁটাচলা করছে সরস্বতী ।
পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল, ‘তুমার কথা কুনোদিন ভুলব নাই।'
মাথায় হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল বাতাসী, ‘লতাবুনির মহুল তোর বহিন না? উয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রাখিস নাই। আমার কাছে উ তোকে তিনশ’ টাকায় বিকেছে।’
মহুল! তিনশ’ টাকায়! সরস্বতীর সঙ্গে মহুলের কিসের শত্রুতা! সীতানাথের সঙ্গে বিয়ার কথা হয়েছিল মহুলের। সেই রাগ! মহুলের বিয়েটা সুখের হয় নি, রঘুর নাকি শহরে আর একটা সংসার আছে। সেই হিংসে!
তবে সংসারী না হয়েও সমাজ সংসার যে বাতাসীর বেশ চেনা, তা বোঝা হয়েছিল গাঁয়ে ফিরে।
না, ফেরা হয় নি। গাঁয়ে ঢুকতেই পারে নি সরস্বতী। অসতী চরিত্রহীন মেয়ের গাংমুড়ি গাঁয়ে জায়গা নেই। বাপ-ভাই স্বীকার করে নি। খুদমলকে গাঁয়ের লোক কুলোয় বাতাস দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল।
খুদমলকে। ক্ষুদ্রমল্লিকা থেকে খুদমলকে। কুশকর্ণিকার উৎসস্থলের কাছের গ্রামের নাম ক্ষুদ্রমল্লিকা। গ্রামের এমন কাব্যিক নাম কে দিয়েছিল কে জানে। নামে কাব্য থাকলেও সে কাব্যে উপেক্ষিতা রইল গাঁয়ের মেয়ে সরস্বতী।
এতদিন ধরে অতীতের সাক্ষী কুশকর্ণিকা, আজ বর্তমানের সাক্ষী রইল, অসহায় একটি মেয়ের কান্নার সাক্ষী ।
প্রকাশের সঙ্গে ফিরতেও ইচ্ছে হয় নি। আবার নাচনীদের দলে ফিরে যাওয়া!
হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল সরস্বতীর। নির্জন নি:সঙ্গ নি:শব্দ যাত্রায়।
প্রকাশ অবশ্য একা যেতে দেয় নি।
প্রকাশ। প্রকাশের মা ললিতাও ঝুমরী ছিল। কিন্তু জাত-ব্যবসা কোনোদিন মানতে পারে নি। ললিতা ছোট্ট প্রকাশকে বলত, ‘তু পড়ালিখা শিখবি ববুয়া। তারপর আমাকে ই দাসত্ব থেকে মুক্তি দিবি। দিবি তো, বাপ?’
প্রকাশের বাবা ছিল না। মায়ের বাবা, প্রকাশের দাদু ললিতাকে বাতাসীর হাতে তুলে দিয়েছিল ।
‘আমি তো জানিই না, কে আমার জন্মদাতা বাপ। মা বলতে পারে নাই। একবার বলত সুধীর বায়েন নামের সেই ঢাকীটা, আবার বলত খুদমলকে গাঁয়ের রমজান শেখ।'
দীর্ঘ যাত্রাপথে এইসব গল্প করেছিল প্রকাশ, দলে থাকা সত্ত্বেও যাকে কোনোদিন ভালো করে তাকিয়ে দেখে নি সরস্বতী। ডুগি-তবলায় বসে থাকা, সবচেয়ে রোগা ছেলেটা। সর্বক্ষণ বাতাসীদিদির খিদমত খাটা ছেলেটা। নাচের আসরে বদমাশ চ্যাংড়া ছেলেরা যখন হাত ধরে, শাড়ি ধরে মেয়েদের টানাটানি করে, তখন হাতে লাঠি নিয়ে আসরে নামত প্রকাশ। সর্দারনী বাতাসীর মস্ত ভরসা।
‘ফুলেতে বসো না ভ্রমর ফুলের মধু দিব না ষোল বছর বয়স নাগর এ কলঙ্ক লিব না...'মা নাচতে শুরু করলে প্রকাশকে সরিয়ে নিত হিমুলিমাসী।
তারপর রাতভর মাকে নাচতে হত। পূব দিক সাদা হলে, পাখিরা ডাকতে শুরু করলে ললিতা-মা ক্লান্ত শরীর টানতে টানতে ফিরে আসত। মায়ের জন্যে বিছানা করে রাখত ছোট্ট প্রকাশ। সেই বিছানায় ভোরবেলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত ললিতা-মা। ছোট্ট প্রকাশকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে। মাযের গায়ের গন্ধে বমি পেত, মদের গন্ধ সেই ছোটবেলা থেকে চেনে প্রকাশ।
মা রোজ চোখের জল ফেলত, ‘তু কবে বড় হবি ববুয়া? পড়ালিখা শিখে আমাকে ছুটি দিবি তো বাপ?’
নীল রক্তের মাতনে রোগ, যন্ত্রণা। অসহ্য ব্যথায়, শারীরিক কষ্টে আলুথালু কান্না। একদিন ভোর সকালে ললিতা-মা ছুটি নিয়ে চলে গেল।
মাকে মুক্তি দিতে পারে নি প্রকাশ। কিন্তু আসন্নপ্রসবা রুগ্ন ভীরু মেয়েটাকে দেখে মাযের কথা মনে পড়েছিল। ‘তু পালা। নইলে আমার মাযের কপাল হবে তু' বলেছিল ।
কোথায় যাবে জানে না। গাঁয়ের বাইরের দুনিয়া প্রকাশও চেনে না। ঝুমরীদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরা, আর কখনো কখনো বন্ধুদের বিয়া দিতে কোনো জায়গায় ঘুরে আসা। এর বাইরের দুনিয়া প্রকাশ দেখে নি। তবু পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছে।
চাইলেই কি বাঁচা যায়! দীর্ঘ যাত্রা। এই চার পাঁচ মাস ধরে কত জায়গায় যে থাকা হল। রাস্তা তৈরী হচ্ছে, সেখানে মাটি কাটার কাজ। শাবল গাঁইতি দিয়ে চাক চাক মাটি কাটে প্রকাশ, মাথায় ঝুড়িতে সে মাটি বয়ে পৌঁছে দেয় সরস্বতী। বড় বাড়ি তৈরি হচ্ছে, রাজমিস্ত্রীর কাজ। ভারায় চেপে সিমেন্ট লাগায় প্রকাশ, বালি সিমেন্ট ইঁট মাথার ঝুড়িতে টেনে নিয়ে যায় সরস্বতী। বাংলা, বিহার, ইউপি।
অবশেষে এক শান্ত শহরে এসে বাস। নদীর ধারে একটা আশ্রম। শান্ত জায়গা। কত দূর থেকে লোক আসে তীর্থ করতে।
নদীর ফেরিঘাটে মাল ওঠা নামা করছিল প্রকাশ। বড় ভারি পেট নিয়ে ছুটে ছুটে মাল বইছিল সরস্বতীও। ‘আমার সঙ্গে চল। তুকে ইখন ই সব কাজ করতে নেই।' অনেকদিন পর মায়ার হাতে ওকে স্পর্শ করেছিল কেউ।
ফিরে তাকিয়ে ভয় পেয়েছিল। অতীত ফিরে এসেছে। বাতাসী হেসেছিল, ‘ভয় পাস নাই। আমি মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিলাম। ভাগ্যিস! তাই তো তুকে ফিরে পেলাম। হ্যাঁ রে সরসতিয়া, আমি তো বলেছিলাম, তুর কুনো ভয় নাই। বিশ্বাস করতে পারলি নাই?’
প্রকাশ এসে দাঁড়িয়েছিল অপরাধী মুখে। ‘কুথায় কুথায় ঘুরবি তুরা? ছানাটাকে পালতে হবে নাই? ইকটা ঘর পরিবার চাই না?’
বাতাসী বলেছিল, ‘তু আমাদের ঘিন্না করিস। কিন্তু ই আমাদের জাত-ব্যবসা। ই আমাদের করতেই হবে। আমাকে ই মেলায় নষ্ট করেছিল কে জানিস? আমার নিজের বাপ আর ঠাকুমা। এগারো বছর বয়সে বাপ তার এক বন্ধুর সঙ্গে আমাকে মেলায় বিকিয়ে দিয়েছিল। তাকে আমি খুড়া ডাকতাম। বাপ সাত সাতদিন উ খুড়ার সঙ্গে আমাকে পাঠাই দিইছিল। খুব কান্না করতাম আমি, বাপ লাঠি দিই মারত। তারপর খুড়ার সঙ্গে পাঠাই দিল।'
বাতাসীর বাপ বলেছিল, ‘কত পুণ্যির কাজ করছিস তু, জানিস না। খুড়ার শরীলে মস্ত বড় অসুখ, তুর সেবায় সারে যাবে। তুর পুণ্য হবে।' সাতদিন পরে ঠাকুমা একজোড়া রূপোর মল দিয়েছিল বাতাসীকে।
‘আমার পরথম রোজগার, বুঝলি?’ চিকচিকে চোখে হাসছিল বাতাসী।
‘তোর সঙ্গে আমি জবরদস্তি করব না। প্রকাশকে ছোট্ট বেলা থেকে পালছি। ললিতার বুকের ধন। তুরা মোদের আপন লোক। ফিরে চল গাঁয়ে। তোকে নাচনী বানাব না, কথা দিলাম। তুর ছানা বড় হবে, ইশকুলে পড়বে। ভয় নাই।'
‘শুন তোরা, সরসতিয়াকে আমি বিটি মানলাম।' মিদনাপুরের মেলায় ফিরে সবাইকে ডেকে বলেছিল বাতাসী। নাচনী বাতাসী বহিন হয়ে, মা হয়ে জড়িয়ে রইল। গঙ্গাধর, প্রকাশ, সদু, ভোলা... সব ছেলেদের সাবধান করেছিল, ‘খেয়াল রাখবি, কেউ উয়ার কাছে না পৌঁছায়।'
বাসন্তী মাসী কথা বলতেই পারে নি।
হা জটাধারী বাবা! এই মানুষকে ভুল বুঝে পালিয়েছিল সরস্বতী! নদীর মতো এই মানুষটাকে! কিছুই পাবার আশায় নয়, শুধুই দেবার জন্যেই ‘বিটি’ ডাকে আগলে রাখতে চায় যে। বাপ-মা ভাই-বহিন স্বামী-শাশুড়ি সবাই ত্যাগ করেছে। মহুল। পিসীর মেয়ে হোক, তবু বহিন তো বটে! সে পেরেছে ঝুমরীদের কাছে সরস্বতীকে বেচে দিতে। সেই মহুলের বোনকে বাড়ির বউ করে ঘরে তুলেছে শাশুড়িমা। যে শাশুড়ি দিনে দশবার ‘আমার লক্ষ্মী বউ’ বলে চিবুক ছুঁয়ে আদর করত! সবাই ত্যাগ করেছে।
নাচনী মেয়েটা শুধু খুঁজে বেড়িয়েছে অসহায় আরেক মেয়েকে। নাচনীর বুকের মায়ায় পথ-হারানো কুল-হারানো নদী আজ আশ্রয় পেয়েছে।
নদীর ধারে বাসা। ঘরের মাটির দেয়ালে ছবি। ঘরের সামনের আঙিনায় জবা, নয়নতারা, অপরাজিতা। একফালি উঠোনে তুলসীতলা। ছোট ছোট নিচু পাতকুয়ো। গরু, ছাগল। পায়রা, শালিখ।
কথা নেই, বার্তা নেই, কোথা থেকে এসে কুশকর্ণিকা নদীটা পাশে পাশে চলতে লাগল। নিস্তরঙ্গ শান্ত সর্পিল শীর্ণকায়া নদী। কেউ তাকে মনে রাখে না। এই নদীই যখন ময়ূরাক্ষীর কোলে গিয়ে মেশে, কত ঢেউ, কত লহরী। শান্ত নদীটা ঝর্ণার মতো হাসছে তখন । একা একা পথ চলার শেষে মায়ের কোলে আশ্রয় পেয়েই কি এত আনন্দ তার!
কুশকর্ণিকার মতোই সরস্বতীর জীবনেও নানা রঙ। কুশকর্ণিকার মতোই আজ সরস্বতীরও একটা আশ্রয় হয়েছে এখন। এই আশ্রয়ের দাম চায় নি বাতাসীদিদি। তাহলে কেন নদীর মতো আনন্দে বাঁচতে পারবে না সরস্বতী?
দাম নিতে চায় নি প্রকাশও। মানুষের দুনিয়ায় শিশুজন্মের সঙ্গে পিতৃপরিচয় জরুরী। এইটুকু ইচ্ছে তার। শুধু পরিচয় দেবার তাগিদ নয়, ববুয়া আর ববুয়ার মায়ের ভাগ্য যেন ঝুমরী ললিতা আর তার ছেলের মতো না হয়।
খুদমলকে গাঁয়ে সন্নিসী বাবাদের আশ্রম ছিল একটা। কুশকর্ণিকায় বান এসে গ্রাম বানভাসি হবার জোগাড় হলে, গাঁয়ে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি হলে, অসুখবিসুখ বিপদ-আপদ হলে ওই সন্ন্যাসীরা প্রাণের মায়া না করে গাঁয়ের লোকজনকে কতবার বুকে টেনে নিয়েছে। আশ্রমে আশ্রয় দিত।
প্রকাশকে ওই সন্নিসী বাবাদের মতো মনে হয় সরস্বতীর। ববুয়া এলে সন্নিসীর মনও কি একটু নরম হবে না? পিতৃপরিচয়ের চেয়েও পিতৃহৃদয় বেশি জরুরী হয়ে উঠবে না?
সরস্বতীর এখন একটাই সাধ। ববুয়াকে কোলে নিয়ে একবার গ্রামে যাবে, কুশকর্ণিকার ঘাটে বসবে, তারপর মাথা উঁচু করে চলে আসবে। গাঁয়ে গেলেই বাপের বাড়ির লোকও ঠিক খবর পেয়ে যাবে।
ছোট্ট ছেলেটাকে দেখে কি বলবে সীতানাথ? শাশুড়িমা নিশ্চয় কোলে নিতে চাইবে। যতই হোক, বংশের ব্যাটা তো! কিন্তু সরস্বতী কিছুতেই ববুয়াকে কোলে নিতে দেবে না।
তবে ববুয়াকে কোলে নিয়ে একবার গাঁয়ে যেতেই হবে ।
কে জানে, কবে সাধ পূর্ণ হবে! কবে ফেরা হবে!
আহা সরস্বতী! আহা কুশকর্ণিকা! প্রবাহ একবার শুরু হলে আর কি ফেরা হয়! নদীর শুধু বয়ে যাওয়াই নিয়ম। মানুষের জীবনের মতই। সরস্বতীর জীবনটাই বা অন্য রকম হবে কি করে!