এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আশফাক আহমেদের মনে হল তিনি হাতিদের কথা বুঝতে পারেন। তার এই মনে হওয়া অনেকটাই অবাক করার মত। তিনি জীবনে কোনদিন হাতি দেখেন নি সরাসরি। কিন্তু এমনভাবে তার মনে হতে লাগল তিনি হাতিদের কথা বুঝতে পারেন যে তিনি তা পুরোপুরি বিশ্বাস করে ফেললেন।
আশফাক সাহেব কোনক্রমে নাস্তা করেই বেরিয়ে পড়লেন। তার মনে ভয় আর দুশ্চিন্তা। এখন একটা হাতিকে পেতে হবে। তারপর হাতির সামনে গিয়ে তিনি দেখবেন সত্যি সত্যি হাতির কথা বুঝতে পারেন কি না।
তিনি প্রথমে গেলেন শহরের মূল চিড়িয়াখানায়। সেখানের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, এই চিড়িয়াখানায় কি হাতি আছে?
দারোয়ান বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, না, নেই। হাতির গরম সহ্য হয় না। তাই এখানে কোন হাতি নেই।
আশফাক সাহেব বললেন, হাতির গরম সহ্য হয় না এটা কে বলেছে?
দারোয়ান বলল, কেউ বলে নাই। এটা নিয়ম। সবাই জানে।
আশফাক সাহেব বললেন, শোন, হাতির গরম সহ্য হয় না এটা ভুল কথা। গরম এলাকাতেও হাতি থাকে। শুষ্ক এলাকাতেও তাদের দেখা যায়। সুতরাং তোমার এই কথাটি ভুল।
দারোয়ানের মেজাজ খারাপ হল। সে প্রায় রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করল, হাতি সম্পর্কে আপনি আমার থেকে বেশি জানেন?
আশফাক সাহেব শান্তভাবে উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। বেশি জানি। তবে এ নিয়ে তোমার সাথে আর কথা বলতে চাই না।
এই কথা বলে তিনি দ্রুত চিড়িয়াখানার গেট ত্যাগ করে অন্যদিকে হাটা দিলেন। এখন কি করবেন তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। এই চিড়িয়াখানায় হাতি পাওয়া গেল না। তাই হাতি পাওয়াটা একটা সমস্যা হয়ে গেল। এখন কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে যদি থাকে তাহলে পাওয়া যাবে। এই কথা মনে হওয়ার সাথে সাথে আশফাক সাহেব পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন। তার বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিত করিৎকর্মা লোকদের ফোন দিয়ে দিয়ে তিনি কোথায় হাতি পাওয়া যাবে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে লাগলেন।
একেকজন একেকরকম উত্তর দিতে লাগল। কোন সমস্যায় না পড়লে বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতরা কতটা সাহায্য করতে পারে তা ঠিক বুঝা যায় না। আশফাক সাহেব সমস্যায় পড়ে বুঝলেন। তাকে কেউ হাতির খবর দিতে পারল না। তিনি হতাশ হলেন।
কয়েকজন বন্ধু তাকে বলেছিলো অন্য শহরের চিড়িয়াখানায় হাতি আছে। কিন্তু এই উত্তর দিয়ে তার কাজ হবে না। কারণ হাতি তার আজই দেখতে হবে। আজ না দেখলে দুশ্চিন্তায় তিনি ঘুমাতে পারবেন না।
আশফাক সাহেব সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেন। একেকজনের কথায় একেক জায়গায়। বিকেলের দিকে পরিশ্রান্ত হয়ে তিনি বাসায় ফিরলেন।
বাসায় ফিরে দেখেন ড্রয়িং রুমে বসে আছেন এক ভদ্রলোক। তাঁর হাতে ক্যামেরা। তিনি কোলের উপর ক্যামেরাটাকে রেখে টেবিলের উপর রাখা পত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আশফাক সাহেব ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে বললেন, স্লামালিকুম। আপনি নিশ্চয়ই আশফাক সাহেব?
আশফাক সাহেব অবাক হওয়ার মত মুখ করে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ। আমিই আশফাক আহমেদ।
ক্যামেরাওয়ালা ভদ্রলোক তখন ক্যামেরা রেখে উঠে এসে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি এনিয়েল্লো। আপনার জন্য সেই কতক্ষণ ধরে বসে আছি।
আশফাক সাহেব বসতে বসতে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো?
ভদ্রলোক বললেন, আমি ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম সোসাইটির পক্ষ থেকে এসেছি। আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে আপনাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারী ফিল্ম বানানোর।
আশফাক সাহেব এবার অবাক না হয়ে পারলেন না। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। তিনি কোনক্রমে জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে নিয়ে?
ভদ্রলোক মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ আপনাকে নিয়ে। এই ডকুমেন্টারী ফিল্মের আইডিয়াটাও আমরা পেয়েছি আপনার কাছ থেকে। নাম হবে, “সেই মানুষ, যিনি হাতির সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।”
আঁৎকে উঠলেন আশফাক সাহেব। তিনি ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন, আমি হাতির কথা বুঝতে পারি এটা আপনারা জানলেন কীভাবে?
ভদ্রলোক হাসিমুখে জবাব দিলেন, জানবো না কেন? নেচার ম্যাগাজিন আমরা খুব গুরুত্ব নিয়ে পড়ি। এই দেখুন গতসংখ্যায় আপনাকে নিয়ে ওরা ফিচার করেছে। তাই শুধু আমরা কেন আপনার কথা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জানে।
আশফাক সাহেব ঢোঁক গিললেন। তাঁর সব কিছু কেমন যেন অসম্ভব মনে হল। এ কেমন হচ্ছে? তিনি কি তাহলে সত্যি সত্যি হাতির কথা বুঝতে পারেন? কোনদিন কি হাতির সাথে কথা বলেছেন? তাঁর সঠিক কোন কিছুই মনে পড়ল না।
তিনি টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে পানি খেলেন। কিছু পানি পড়ে তাঁর বুকের দিকের কিছু অংশ ভিজে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তিনি ক্যামেরাওয়ালা লোকটির দিকে তাকালেন। লোকটির হাতে সত্যি নেচার ম্যাগাজিন। সেখানের প্রচ্ছদে দেখা যাচ্ছে আশফাক সাহেবের ছবি। ছবিতে একটা হাতি মুখ নিচু করে তাকে যেন কিছু বলছে।
আশফাক সাহেব তাকিয়ে আছেন দেখে ভদ্রলোক বললেন, আমাদের গত ডকুমেন্টারী ফিল্মটি একাডেমি এওয়ার্ড মানে অস্কার পেয়েছিল। এবারেরটাও ভালো হবে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি কাহিনী তিনটি অংশে ভাগ করেছি। চলেন আপনাকে দেখাই।
আশফাক সাহেব একটু আগ্রহ অনুভব করলেন। দেখাই যাক না ব্যাপারটা। তিনি ভদ্রলোকের কাছে বসে পড়লেন। আর ক্যামেরাওয়ালা ভদ্রলোক স্ক্রিপ্ট বের করে তাকে বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন ছবির বিভিন্ন অংশ। আশফাক সাহেবের সমস্ত শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে দরদর করে। তবুও তিনি একমনে শুনে যাচ্ছেন লোকটির কথা। ছবির গল্প তাঁর ভালো লাগছে। একটা লোক হাতির সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এটা নাকি আবার তাঁর জীবনেরই সত্যি গল্প। আশফাক সাহেবের গা দিয়ে বইতে শুরু করল উষ্ণ রক্তের স্রোত। রক্তে চরম উত্তেজনা।
আর এদিকে তাঁর স্ত্রী, কন্যা ও দুই পুত্র মাঝে মাঝে দরজার পর্দা ফাঁক করে তাঁকে দেখছিলেন। তারা অবাক না। অনেকটা ভাবলেশহীন। কারণ এই ঘটনা দেখে তারা অভ্যস্ত। আজ প্রায় পাঁচ বছর হল। আশফাক সাহেব মনে করেন তিনি হাতির কথা বুঝতে পারেন, আবার তার মনে সংশয় আসে “সত্যি পারেন তো?” তারপর দিনের শেষে তাঁর চোখে দৃশ্য ও জগতের কাছে অদৃশ্য কারো সাথে গভীর আলোচনায় বসে পড়েন।
কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি নিশ্চিত হতে পারেন না, হাতির কথা সত্যি সত্যি তিনি বুঝতে পারেন কি না। কিন্তু তাঁর মনে হয় তিনি পারেন। এবং একসময় অনিশ্চিত অবস্থাতেই তিনি রাত দশটার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন।