• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | গল্প
    Share
  • পাজলের পিসগুলি : রিমা রায়


    জানালার পাশে রাখা রিক্লাইনের উপর পাটা তুলে বসেছিলেন রমিতা। কোলের উপর সঞ্চয়িতা খোলা। সকাল থেকে একটা লাইনও পড়তে পারেননি। মাঝেমাঝে এরকম হয়। কিচ্ছু পড়তে পারেন না। মনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে পড়ে। গুছিয়ে নিয়ে পড়া শুরু করার আগেই দিন ফুরিয়ে যায়। আবার একটা মন খারাপের রাত্রি এসে যায়, কিছু পড়া হলোনা বলে ঘুম আসে না। এটা নতুন হয়েছে আজকাল। ছোটন বা কলি কাউকেই বলেননি এখনো। ওরা শুনলেই ছোটা-ছুটি শুরু করে দেবে জানেন। সে আরেক ঝামেলা। বারবার শুধু মনে হয় ওদের কাজের সময় নষ্ট করে দিচ্ছেন তিনি। আবার এটা বললেও ওরা কষ্ট পাবে। তিনি জানেন ওরা দুজনেই ওঁকে নিয়ে কতটা ভাবে। সবসময় চিন্তা মা ঠিক করে খাচ্ছে কিনা, ঘুমোচ্ছে কিনা, ওষুধ খাচ্ছে কিনা। নিজেদের কাজের বাইরে পুরো সময়টা যেন মায়ের জন্যেই বরাদ্দ করা আছে। তারপর এইসব ছোটোখাটো উপসর্গ নিয়ে ওদেরকে ভাবনায় ফেলতে মন চায়না আর।

    ***

    তিনমাস ছয়দিন হলো এখানে আসা। এবারে আসার কথাই ছিল না কোনো। হঠাৎ করে সবকিছু ঘটে গেল। মনে হয় যেন এই সেদিনের ঘটনা। ছোটন কলি প্লেনের টিকেট কেটেই ফোন করেছিল যে এবারে পুজোর সময় ওরা কলকাতা আসছে। সেদিনও এরকম সঞ্চয়িতা হাতে জানালার পাশে বসেছিলেন তিনি। সন্দীপন ফোনটা ছেড়ে ওকে এসে জানিয়েছিলেন, "এবারে পুজোটা একা একা আর কাটাতে হবেনা। ওরা আসছে বুঝলে। ফোন করেছিল। " কোনো এক অসীম শূন্য জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরতে সময় লেগেছিল তার, "কে আসছে বললে? অঙ্কুর?" সন্দীপন চমকে উঠেছিলেন যেন! "কি বলছ তুমি! আবার ভাবছ ওসব! চলো, চলো বীণা খাবার দিচ্ছে, ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে।" খেতে বসে সন্দীপন আবার বলেছিলেন, "এবার পুজোতে ওরা এলে যাবে শান্তিনিকেতন ঘুরতে? একসাথে ভালো লাগবে। মিমিরও দেখা হয়ে যাবে ওর দিদানের প্রিয় জায়গাটা। যাবে?" রমিতা উত্তর দেননি কিছু। রাত্রে শুধু বলেছিলেন "তোমরা ঘুরে এস। এই জানলা ছেড়ে কোথাও যেতে আমার ভালো লাগে না।" সন্দীপন একটু যেন অসহিষ্ণু হয়ে বলেছিলেন "কি ভাব এত বলত! সারাদিন জানলার সামনে পথ চেয়ে থাকলে কি সত্যিটা মিথ্যা হয়ে যাবে। সত্যিকে মানতে শেখো রমি। এতগুলো বছর হয়ে গেল আমি তো বেরিয়ে এসেছি। তুমি কেন পারছ না বলত? জানি, জানি বড় কষ্ট হয়! সারাদিন জুড়ে থাকে ওদের মুখগুলো তবু তো জীবনের বহমানতাকে অস্বীকার করতে পারি না। বাজারে যাই, খবরের কাগজ পড়ি, নিউজ দেখি, হাঁটতে যাই, বন্ধুদের সঙ্গেও গল্প করি মাঝেমধ্যে। আর তুমি এই একটা ঘরে নিজেকে বন্দী করে ফেললে! কতদিন কোথাও যাওনি বলত? এভাবে চললে কি হবে তোমার! বড় ভয় হয় আমার।" রমিতা নিরুত্তর।

    ***

    যাকে নিয়ে এত ভয় পাচ্ছিলেন সন্দীপন সেই তাকেই রেখে দূর্গাপুজোর শুরুতেই, পঞ্চমীর সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন সন্দীপন, আর উঠলেন না। দুদিন আগেই ছোটনরা এসেছে। মিমির হাসি-খেলাতে বাড়িতে খুশির আভাস! দাদুর সাথে মাছ কিনতে যাওয়া থেকে শুরু করে হাজারটা কথায় বাড়ি সরগরম। সারাবছর ধরে সন্দীপন তো এদের পথ চেয়েই বসেছিলেন। অথচ যখন সময় এলো তখন সব ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। তারপর ছোটন-কলি রমিতাকে নিয়ে চলে এলো ওদের সাথে আমেরিকাতে। রমিতা মানা করেছিলেন। উনি জানতেন কোথাও গিয়ে মন টিঁকবে না কিন্তু ছেলে-বউ-এর কথা না শুনে পারেননি। ওরা ওই খালি বাড়িতে কিছুতেই মাকে ছেড়ে আসতে চায়নি। যদিও প্রমিস করেছে চার-পাঁচ মাসের বেশি ওনাকে আটকে রাখবে না। মিমির সঙ্গ পেলে মা ভালো থাকবে এটাই ওদের মনে হয়েছিল। যদিও ওরা জানত মাকে ভালো রাখা সহজ নয়। যে ভয়ংকর অন্ধকার রাত্রি মাকে নিঃশেষ করে দিয়েছে সেখান থেকে মা গত পঁচিশ বছরেও বেরোতে পারেনি। তাই বাবার মৃত্যু মাকে আলাদা করে একা করে দিয়েছে এটা ভাবতে ওরাও পারেনি। যে মানুষটা পঁচিশ বছর ধরেই একা তাকে নতুন কোনো দুঃখ আর স্পর্শ করে না। সন্দীপনের মৃত্যুতে রমিতা কাঁদেননি। শুধু মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন পরম মমতায় আর মনে মনে বলেছিলেন "ছেলে-মেয়ে দুটোকে কাছে রেখো তোমার। সামলে রেখো যতদিন আমি না আসি।"

    ***

    আজও ছোটনদের গেস্টরুমের জানালার সামনে বসে এটাই ভাবছিলেন সারাদিন ধরে রমিতা। সন্দীপন চলে যাবার দিন কেমন যেন হালকা লেগেছিল। কেউ শুনলে নিশ্চয় ওকে স্বার্থপর ভাববে। কিন্তু মনে হয়েছিল বাবার অভিভাবকত্বে তার অকাল প্রয়াত ছেলে-মেয়ে দুটো ভালো থাকবে। কি অগাধ বিশ্বাস তার মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি। এই গভীর ভাবনা তার আগে কখনো ছিল না। এত ভাবার সময় কখনই বা পেয়েছেন। অঙ্কুর আর মোম একসাথে এসেছিল পৃথিবীতে। কিছুটা দুর্বলতা আর অজানা আশঙ্কাতে বুক কেঁপেছিল বাবা-মা হিসেবে তাদের। প্রথম সন্তান তাও আবার দুটো একসাথে। অনভিজ্ঞ মাতৃত্ব ভীতি এনেছিল মনে যখন জানতে পেরেছিলেন দুই সন্তানের সম্ভাবনার কথা। সন্দীপন ভয় পেয়েছিলেন বেশি। বুঝতেই পারেন নি কিভাবে সব সামলাবেন। দুই পরিবারেই কোনো মা ছিলেন না। রমিতার মা ওর বিয়ের বছর দুই আগে মারা যান আর সন্দীপন তো ছোট থেকেই মাতৃহারা ছিলেন। একসাথে দুই ছেলে-মেয়ে। তাদের বড় করে তোলাই তখন রোজকার ভাবনা-চিন্তা। একজন ঘুমোয় তো অন্যজন জাগে। একজন কাঁদে তো অন্যজন খেতে চায়। কি ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে দিন চলে যেত। রাত জাগার ক্লান্তি নিতে না পেরে শেষে স্কুলের চাকরিটা রমিতা ছেড়ে দিলেন দুম করে। সন্দীপন বারণ করেছিলেন বারবার। সারাদিন বাচ্ছা নিয়ে আর সংসারের কাজে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখুন রমিতা তা উনি চাননি। কিন্তু রমিতার মনে হচ্ছিল ওই সময়টাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সাত বছর চাকরি করে তখন ক্লান্তিও এসে গেছিল। ছেলে-মেয়েকে বড় করার আনন্দ তাকে ভরিয়ে দিয়েছিল। ওদেরকে পড়াতে পড়াতে চাকরি ছাড়ার কথা ভুলেই গেছিলেন তিনি। অঙ্কুরটা বরাবর মেধাবী ছিল। একবার বুঝিয়ে দিলেই মুহূর্তে ধরে ফেলতে পারত। আর মোম শুরুর দিকে ফাঁকিবাজ থাকলেও যত বড় হয়েছে তত নিজেকে পাল্টেছে। এর মধ্যেই আকস্মিক ভাবে ছোটন এসে গেছে। ব্যস্ততা আরও বেড়েছে। নিজে শান্তিনিকেতন থেকে পড়াশোনা করেছিলেন। ওখানে হোস্টেলে থাকতেন। কলকাতার মেয়ে হলেও বাবা-মা কলেজ হিসেবে রবিঠাকুরের জায়গাটাকে বেছে নিয়েছিলেন। তার অবশ্যই একটা বড় কারণ ছিল তার গানের প্রতি আগ্রহ। তিন তিনটে বাচ্ছা মানুষ করতে গিয়ে গান থেকেও অনেক দূরে সরে গিয়েছিলেন আর সেটাই ছিল সন্দীপনের দুঃখ। উনি বরাবরই আধুনিকমনস্ক ছিলেন। মেয়েরা শুধু সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে আর নিজেদের সমস্ত শিক্ষা জলাঞ্জলি দিয়ে আটপৌরে হয়ে যাবে এটা তিনি মেনে নিতে পারতেন না। মাঝে মাঝেই দুঃখ করে রমিতাকে অন্তত গানটার চর্চা রাখতে বলতেন। রমিতা তখন ওকে থামিয়ে দিতেন এই বলে "এটা আমার গান গাওয়ার সময়ই বটে! আরে বাবা, একবার শেখা জিনিস মানুস কখনো ভোলে না এটা বোঝো না কেন তুমি... ওরা একটু বড় হলেই তো আমি আবার সব শুরু করতে পারব। এত ভেব না তো তুমি।" সত্যি সত্যিই তখন সময় বের করা কঠিন ছিল। আর ওদের পড়াশোনার ব্যাপারে তো তাঁকে কোনদিন দেখতেও হয়নি। সব রমিতা সামলেছেন। রমিতার মতে নিজের সাফল্যের চেয়ে ছেলে-মেয়ে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারাটা কোনো অংশে কম সাফল্য নয়। এই নেশাটাই তখন ওর কাছে বড় হয়ে উঠেছিল। সন্দীপন মেনে নিয়েছিলেন। তার পর মোম-এর সাথে রমিতা যখন আবার গানের চর্চা শুরু করেছিলেন সন্দীপন খুশি হয়েছিলেন খুব। আর মেয়েও মায়ের গর্বে গর্বিত হয়েছিল খুব। এখন সেই গানই তাঁর সঙ্গী। সকাল-দুপুর জানলার সামনে বসে থাকেন আর গানের লাইনগুলো মনে মনে আউড়ে যান। গাইতে পারেন না, গলা বুজে আসে, চোখে জল এসে যায়। স্মৃতিও কাজ করেনা ভালো। মাঝে মাঝে ভাবেন ডিমেনশিয়া হয়নি তো? ছোটন মাঝে মাঝে বলে হাঁটতে যেতে বাইরে। কিন্তু রমিতার ভয় হয় ভাবেন হয়তো রাস্তা ভুলে যাবেন। এক অকাল বার্ধক্য যেন ওঁকে গিলে নিচ্ছে দিনে দিনে। বুকের ভিতরে এক অবিরাম কান্না ঝরে চলে। প্রতিটা দিন ওদের মুখ গুলো ভিড় করে আসে। বর্তমানকে উপেক্ষা করে দিনরাত যেন এক গহীন অতীতের সাথে বাস করে যান তিনি। স্মৃতি এক্ষেত্রে কিন্তু বড় প্রকট। সেখানে প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ সর্বদা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। কখনো অঙ্কুরের গলা শুনতে পান, "মা--আ. আ...আ.. আমার জন্যে পাটিসাপটা রেখো কিন্তু... তুমি ওটা দারুণ কর... মোম যেন সব খেয়ে না নেয়।" আবার কখনো মোম বলছে "মা এবার বাড়ি গিয়ে আমি কিন্তু তোমার সাথে শোব... বাবাকে একদম ঘর থেকে আউট করে দেব আমরা.... কত দিন তোমার গায়ের গন্ধ পাইনা। ধ্যুস্‌!! আর ভালো লাগে না এত দূরে... আমি পড়া শেষ হলে সোজা কলকাতা চাকরি নিয়ে চলে যাব আর তোমার কাছে থাকব...।" যখনই ফোন করত তখনি বলত মেয়েটা। ওর কলকাতা ছেড়ে কোথাও মন টিঁকত না। এই নিয়ে ভাই-বোনে খুনসুটিও হত খুব... অঙ্কুর বলত, "তোকে দিয়ে কিস্যু হবে না বুঝলি!! হোমসিক হলে এত চলে না। তোর দরকার এমন একটা চাকরি যাতে তুই বাড়িতে থাকবি, ঘরে দুবেলা ভালো-মন্দ খাবি, মোটা হবি টুনটুনির মত! বুদ্ধু কোথাকার! মা তার চেয়ে বিয়ে দিয়ে ঘর-জামাই নিয়ে এস। এবারে ওকে রেখেই আমি বম্বে চলে যাব।" "ভালো হচ্ছেনা কিন্তু... আমি মোটেও টুনটুনির মত মোটা নই.... আর পড়া শেষ করব না বলিনি... তাই আমিও যাচ্ছি তোর সাথে। তবে হ্যাঁ, পড়া শেষ করে আমি হয়তো এখানেই থাকব.... তোর মত বাইরে বাইরে থাকতে আমার এত ভালো লাগেনা।" "তার মানে, ঘরজামাই-এর থিওরিটা পছন্দ হয়েছে... তাই তো?" অঙ্কুর বলে। "মা দেখনা, ওকে থামতে বল...." মোম চেঁচাতে থাকে। রমিতা দুজনকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, "কিরে, আজকে যাবি তোরা একসাথে এতটা রাস্তা, এর মধ্যেই শুরু করে দিলি... রাস্তায় কি করবি তবে! কাল থেকে তো আবার একজন বম্বে আর একজন পুনে…। উইকেন্ড ছাড়া দেখাও হবেনা... তখন তো আবার মন খারাপ করে ফোন করবি..."

    "ইশ! বয়েই গেছে ওর জন্যে আমার মন খারাপ করতে," বলতে বলতে ঠোঁট উল্টোয় মোম। তোমার আর বাবার জন্যে মন খারাপ করবে শুধু মা। ভাই-এর জন্যেও করবে কিন্তু তোমার হিরো ছেলের জন্যে নয়।"

    "টেঁপী রে" বলে মোমের গাল টা টিপে দেয় অঙ্কুর। আবার ভাই-বোনে মারপিট শুরু হয়ে যায়।

    ***

    "ঠাম্পু উ উউউ..." বহুদূর থেকে যেন কেউ ডাকছে মনে হলো রমিতার। সোফার পিছনে হেলান দিয়ে কখন যে চোখ বুজে গেছিল মনে নেই। হঠাৎ মিমির গলার শব্দে যেন ঘোর কাটল। জানালা দিয়ে মিমি ডাকছে.... চমকে উঠলেন রমিতা। আজ তো ওকে বাসস্টপ থেকে ঘরে আনার কথা ছিল তাঁর। কি করে ভুলে গেলেন। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে ওকে জড়িয়ে ধরলেন। "কার সাথে এলি?" "নিজে নিজে। তুমি ভুলে গেছিলে ঠাম্পু? মাকে বলনা, আমি তো বিগ গার্ল; এবার থেকে অল অ্যালোন আমি আসতে শিখে গেছি। তোমাকে আর যেতে হবেনা।" রমিতা ওকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন নিজের ভুলের কারণে। "একী ঠাম্পু কাঁদছ কেন? লুক, আমি সেফ আছি তো, কেন্দো না প্লীজ।" মিমির মুখের দিকে তাকালেই তিনি যেন ছোটবেলার মোমকে খুঁজে পান। সেই চোখ, সেই হাসি, আর সেই গা-লাগা স্বভাব। এখানে থাকার এটাই হয়তো একটা বড় টান তাঁর কাছে। সন্দীপনের সাথেও বড় ভাব ছিল মিমির। কতই বা দেখেছে কিন্তু দাদুভাই-এর কথা বলতে খুব ভালবাসে মেয়েটা। দূর্গাপুজোতে কি করত সেসব গল্প বড় প্রিয় ওর। রমিতা চোখ মুছে তাড়াতাড়ি মিমিকে দুধ গরম করে দেন। আর ওর অজস্র গল্প সমস্ত দুঃখবোধ থেকে যেন মুক্তি এনে দিতে থাকে। এ মেয়ে যেন গভীর ক্ষতে প্রলেপ দিতে এসেছে। "আচ্ছা ঠাম্পু, তুমি এভরি টাইম এত স্যাড থাক কেন? আমি খুব ভাবি তার জন্যে। তুমি আমার সাথে পার্কে যাবে? অনেক ফান হবে, যাবে?" রমিতা চমকে ওঠেন। মিমি তার জন্যে এত ভাবে...এত ছোটো একটা বাচ্ছা অথচ কি ভীষণ রকম পরিণত। "দাদুর কথা আমিও খুব ইমাজিন করি ঠাম্পু, আই মিস হিম আ লট..." রমিতা ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দেন আর বলেন, "তুমি কুকি খাবে দুধের সঙ্গে?" "আমি নিয়ে নিচ্ছি ঠাম্পু, আমি জানি কটাই আছে।” প্লেটে কুকি ঢালতে ঢালতে বলে মিমি, “জানো ঠাম্পু, বাবাও মাঝে মাঝে খুব স্যাড থাকে আর একটা গান করে, তুমি জানো কি গান করে? আমি জানি। টেগোরের গান... জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে বন্ধু হে আমার রয়েছো দাঁড়ায়ে... বাবা বলে এই গানটা করলে বাবার স্যাডনেসটা কমে যায়, তুমি এটা ট্রাই করেছ ঠাম্পু?" রমিতা কি বলবেন ভেবে পান না। এটা এক সময় তাঁর খুব প্রিয় গান ছিল। ছোটন কবে শিখে গেছিল শুনতে শুনতে। এখন এটাই তাঁর আত্মজর দহনজ্বালা দূর করে ভেবে মনটা ভারী হয়ে আসে।

    "ঠাম্পু, ঠাম্পু.. উউউ..., চলনা পার্কে, ভেরি নাইস ডে... চল প্লিজ।" এই প্রথম মিমি তাঁর উপর জোর করতে থাকে ভেবে রমিতা ওকে নিয়ে পার্কে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। বাইরে বেরিয়ে ঠাণ্ডা হিমেল হাওয়াতে সত্যিই মনটা হালকা হয়ে যায়। মিমি ছুটে ছুটে খেলতে থাকে, স্লাইড, সুইং করতে করতে অজস্র কথা বলতে থাকে আর রমিতার মনে হয় কতদিন পরে তিনি আবার বাল্যকাল দেখতে পাচ্ছেন। ছোটনের বড় হওয়াটা তাঁর ভুলে যাওয়া একটা অধ্যায়। দুই সন্তানের অকালপ্রয়াণের শোক যেন তৃতীয়টার বড় হয়ে ওঠার অধ্যায়টাকে পুরো ভুলিয়ে দিয়েছে। এর জন্যে ছোটনের মনে কোনো কষ্ট আছে কিনা কে জানে! হয়ত আছে, কিন্তু বড় চাপা ছেলে ও, কক্ষনো বলবে না। হয়ত পরিস্থিতি ওকেও ওভাবে তৈরি করে দিয়েছে। ভীষণ রকম যত্নশীল অথচ আপাতকঠোর একটা মানুষ। দাদা-দিদির এক সাথে চলে যাওয়া ওকে কিভাবে স্পর্শ করেছিল কোনদিন জানা হয়নি রমিতার। এই মুহূর্তে পার্কে বসে নিজেকে ভীষণ স্বার্থপর মনে হতে থাকে তাঁর। এতবছরেও ছোটনকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি কেন সেটা ভেবে অস্থির লাগে। কত বয়স ছিল ওর তখন? বারো বোধহয়। ক্লাস সেভেনএ ছিল। পরীক্ষার আগে আগেই ঘটেছিল ঘটনাটা। কিভাবে ও পরীক্ষা দিয়েছিল তাঁর মনে পড়ে না। তবে নিজে নিজেই চলে যেত স্কুলের বাস ধরে। ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে সকালে উঠে পড়ত কারণ জানত মা ডেকে তুলবেনা। ঘুমের ওষুধ খেয়েও সারারাত ছটফট করতে করতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়তেন রমিতা। কেউ ডাকত না তাঁকে। সারা সকাল ঘুমোতেন। দুপুরে ঘুম ভাঙলে বীণা ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে দিত। সন্দীপন মাস দুই পুরো বাড়িতে বসেছিলেন। একই ভাবে। সারাদিন ইজিচেয়ারে চোখ বুজে পড়ে থাকতেন। তারপরে আসতে আসতে অফিস যেতে শুরু করেছিলেন কিন্তু রমিতা পারেননি। অসার শরীর আর মন নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন দিনের পর দিন। প্রথম প্রথম কাছের মানুষেরা আসতেন বোঝাতে কিন্তু তাঁরাও একসময় ক্লান্ত হয়ে পরে আসা বন্ধ করেছিলেন। প্রাণহীন বাড়িতে শুধুমাত্র ছোটনের হাঁটা-চলা আর বীণার কাজ করার শব্দ ছাড়া আর কিছু ছিলনা। যে ছেলেটা ক্রিকেট-অন্ত প্রাণ ছিল সেও টিভিতে খেলা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিল মার অসুবিধা হবে ভেবে। শুধু সন্ধেবেলা মার বিছানার পাশে বসে থাকত আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। ওর নীরব উপস্থিতি চোখ বন্ধ করেই ওর হাতের স্পর্শে বুঝতে পারতেন রমিতা। মাঝে মাঝে চা নিয়ে এসে ওকে ধরে ধরে বসিয়ে নিজের হাতে চা খাইয়ে দিত। রমিতার দুই চোখ বহুদিন খুলতে কষ্ট হত। জল পড়ে পড়ে এত ফুলে গেছিল যে তাকাতেও পারতেন না ভালো করে। কত দিন, বছর এভাবে চলেছিল তাও ঠিক মনে পড়ে না। তবু এই পার্কে বসে মিমির হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে নিজের একমাত্র জীবিত সন্তানের জন্যে তাঁর বুকের মধ্যে হাহাকার করতে থাকে। বড় অবিচার হয়েছে ওর সাথে। শুধরে নিতে পারলে বেশ হত কিন্তু ওই সময়টাকে ফিরে পাওয়া যাবে না ভেবে তাঁর কষ্ট হতে থাকে।


    ***

    পুনের জার্মান বেকারিতে খেতে গেছিল উইকএন্ডে দুই ভাই-বোন। বাড়ি থেকে ফিরে যাবার দুই সপ্তাহ পরে। অঙ্কুর গেছিল মোমের সাথে দেখা করতে আর নতুন পাওয়া প্রমোশন সেলিব্রেট করতে। মুহূর্তের বিস্ফোরণে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিয়েছিল ওদের শরীরগুলো। রমিতা অনেকবার ভেবেছিলেন হয়ত আরও একটু ভালো করে খুঁজলে আরও কিছু অংশ পাওয়া যেত। উনি নিজে খুঁজতে চেয়েছিলেন। সুযোগ পাননি এত তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে পৌছানোর। অঙ্কুরের হাতের আঙ্গুল, মোমের জুতো, ব্যাগ আর কানের কিছুটা অংশ পাওয়া গেছিল। রমিতা চেয়েছিলেন কিছু না হোক ওগুলোই ফিরে পেতে, ছুঁয়ে দেখতে, পারেননি..... বহু শোকার্ত মানুষের ভিড় ঠেলে উন্মত্ত অবস্থায় যখন ওখানে পৌছেছিলেন কিছু আর দেখতে পাননি। শুধু সন্দীপন সনাক্ত করে এসেছিলেন বিধ্বস্ত অবস্থায়। রমিতাকে নিয়ে যাননি। ছোটন মাকে নিয়ে দিদির হোস্টেলের ঘরে বসে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর সন্দীপনের ফোন পেয়ে ওকেও যেতে হয়েছিল সনাক্তকরণের কাজে। রমিতা যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছোটনকে নিয়ে রমিতার দাদা চলে গেছিলেন ওঁকে মোমের ঘরে বসিয়ে রেখে। চারিদিকে মোমের জিনিস ছড়ানো ঘরময়। নতুন সুটকেসে তখন কলকাতা থেকে কিনে আনা নতুন জামা-কাপড় গুলো উঁকি দিচ্ছে। দেয়াল জুড়ে ওর ছবি। কোনটা ছোটবেলার আবার কোনটা সদ্য কলকাতা গিয়ে অঙ্কুরের নতুন ক্যামেরাতে তোলা। অচেনা অদ্ভুত এক শোকে পাথর হয়ে গেছিলেন রমিতা প্রথমে। টিভিতে খবরটা শুনে বিশ্বাস করতে পারেননি। ভাবেননি ওখানে তাঁর নিজের দুই সন্তান থাকতে পারে। ওরা কেউ তাঁকে বলেওনি ওখানে খেতে যাবার কথা। অঙ্কুর বলেছিল রাত্রে ফোন করবে। একটা ফোনের অস্থির আওয়াজ যেটা এসেছিল মোমের বন্ধুর কাছ থেকে, সেই ফোন থেকেই সন্দীপন জানতে পেরেছিলেন আর অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় টিভির চ্যানেল পাল্টে চলেছিলেন খবর শোনার জন্যে। ভয়ংকর, অন্ধকার সেই রাত্রেই প্লেনের টিকেট কেটে পুনে পাড়ি দেন সবাই। শোক পাথর হয়ে চেপে বসেছিল জীবনে। স্বাভাবিক, ছন্দময় যাপন থেমে গেছিল। কতবার, কতরকম ভাবে সন্দীপন নতুন, নতুন সূত্র বের করার চেষ্টা করেছিলেন। কেন, কিভাবে, কেন তাঁদের সঙ্গে কেউ এরকম করতে পারে। দুটো নির্বিবাদী ভালোমানুষ, যারা কোনদিন কারোর সাথে সামান্য মাত্র খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেনি, জনপ্রিয়, বন্ধুবত্সল বলে পরিচিত তাঁরা নিজেদের জীবনে কেন এরকম একটা ভয়ংকর কষ্টের সম্মুখীন হলেন হিসেব মেলাতে পারেননি। আর রমিতা হিসেব কষার অবস্থাতেই ছিলেননা। শুধু মাঝরাত্রে সন্দীপনের ঘরময় অস্থির পদচারণার মধ্যে দিয়ে উত্তর মেলানোর কষ্টটা চোখ বন্ধ করেই শুনতে পেতেন। টগবগে, তাজা দুটো সম্ভাবনা পৃথিবী থেকে ঝরে গেলেও রোজ সকাল হয়েছে নিয়ম মেনেই, কলকাতা গতিময় হয়েছে বেলা গড়ানোর সাথে সাথে, ঋতুর পরিবর্তন হয়েছে যথারীতি, পুজো এসেছে, পুজো গেছে কতবার শুধু ওই দুটো মুখ এক রকম ভাবেই ধরা আছে চোখের কো্ণে, বয়স বাড়েনি ওদের। প্রাণবন্ত, ঝরঝরে দুটো ফুল। বুকের মাঝে একই রকম একটা চাপ অনুভব করতে থাকেন রমিতা পার্কের বেঞ্চে বসে। বর্তমান ছেড়ে যখনি তাঁর মন এরকম অতীতে পা রাখে চারপাশ কেমন যেন ঝাপসা হয়ে যায়। মাথাটা হালকা হয়ে আসে, বারুদের গন্ধ আর জমাট বাঁধা রক্তের ভিতরে অবগাহন করতে করতে একটা ঝাঁকুনি আসে তীব্র ভাবে। অতীত আর বর্তমানে একটা সংঘর্ষ বাঁধে মাথার মধ্যে। বড় কষ্ট হয়, মাথাটা কাৎ করে বেঞ্চের একদিকে রেখে চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। মনে করতে পারেননা তিনি কি করে এখানে এলেন, কে নিয়ে এলো তাঁকে, কিছুক্ষণ চোখ বুজে মনে করার চেষ্টা করলেন, মনে পড়ছেনা, কিছুই মনে পড়ছে না, মুহূর্তের এই অন্ধকার তাঁর বেশ চেনা, এ মাঝে মাঝেই আসে অতিথির মত, আবার চলে যায় নিজের খুশিতে। বেশ লাগে তাঁর আজকাল, মনে হয় মৃত্যুর অনুভূতি কেমন সেটা যেন ক্ষণিকের জন্যে ধরা দিয়ে যায়। চারিদিকে অন্ধকার কিন্তু হালকা একটা সেন্স টিমটিম করে মনের মধ্যে। আত্মা আর দেহ নিয়ে অনেক ভেবেছেন তিনি। শরীর না থাকলে আত্মার অস্তিত্ব থাকে কিনা কিছুতেই বুঝতে পারেননা। কখনো ভাবেন থাকে আর সেই জন্যেই মনে মনে তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ের সাথে দিবারাত্রি কত কথা বলে যান। আবার যখন ওদেরকে বড্ড দেখতে ইচ্ছে করে তখন মনে হয় নেই নেই, কিছু নেই, কেউ কোথাও নেই, চারিদিকে শুধু অন্ধকার। এই দোলাচলতা তাঁকে তিলেতিলে শেষ করে দিতে থাকে। শুধু রবি ঠাকুর তাঁকে পথ দেখান এই অন্ধকারে। সব ভুলে যাওয়া মস্তিস্ক নিয়েই তিনি মৃদুস্বরে বলে যেতে থাকেন, "জীবনে আজও যাহা রয়েছে পিছে, জানি হে জানি তাও হয়নি মিছে। আমার অনাগত আমার অনাহত তোমার বিনাতারে বাজিছে তারা--জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।" মাঝে মাঝে এক একটা লাইন কিম্বা শব্দ নিয়ে অনেক ভাবেন রমিতা। যদি নতুন কোনো অর্থ উন্মোচিত হয়। এটা তাঁর প্রিয় একটা খেলা, মন খারাপের, মন ভালো রাখার সঙ্গী।

    ***

    "ঠাম্পু, ঠাম্পু-উ-উ-উ, তুমি আমাকে একটু পুশ করবে পিছন থেকে..." একটা স্পর্শ, দুটো কোমল হাত তাঁর কাঁধ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে থাকে। সম্বিৎ ফিরে পান যেন রমিতা। চোখ খুলে মিমিকে দেখে বোঝার চেষ্টা করেন তিনি কি ভাবে এখানে এলেন। "আর উ ওকে ঠাম্পু? ফিলিং টায়ার্ড? বাড়ি যাবে? লেট'স গো হোম।" আট বছরের মিমির কাছে কি ভাবে যেন তাঁর সব কষ্টগুলো ধরা পড়ে যায়। সে তাঁকে শক্ত করে ধরে ধরে বাড়ি নিয়ে আসে। মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়েনা পাছে তিনি পড়ে যান। ঘরে ফিরে দুজনে মিলে ঘড়িতে এলার্ম সেট করেন যাতে পরদিন থেকে মিমিকে আনতে যেতে তাঁর ভুল না হয়।

    রাত্রে বাড়ি ফিরে ছোটন বলে, "মা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে, শরীর ঠিক আছে তো?" রমিতা কিন্তু কিন্তু করে বাসস্টপ-এ যেতে ভুলে যাবার কথাটা বলে ফেলেন। কলি বলে ওঠে, "ওমা, এজন্যে এত ভাবছ কেন? মিমি কিন্তু বড় হয়ে গেছে, আর এইটুকু রাস্তা ওর সব বন্ধুরাই একা একা হেঁটে আসে, আমাদের পাড়াটাও তো ভালো... তুমি এত ভেবনা তো। আমার নতুন জবের টাইম চেঞ্জ না হলে আমিই তো ওকে নিয়ে ফিরতাম....তুমি থাকলে ওর ভালো লাগবে বলে যেতে বলেছিলাম...বরং আমার মনে হচ্ছে, তোমার একটা চেক-আপ করিয়ে নি, এরকম ভুলে যাওয়াটা তো ভালো কথা নয়। জাস্ট একবার দেখিয়ে নেবে ডাক্তার?"

    "না, না আমাকে নিয়ে তোমরা ব্যস্ত হয়ো না। এ আমার পুরোনো রোগ....নিত্যদিনের সঙ্গী...আমি ঠিক আছি। আর আমরা দুজনে মিলে ঘড়িতে এলার্ম লাগিয়ে নিয়েছি...এবার থেকে বাস আসার আগেই আমি বাসস্টপে চলে যাব।"

    "তুমি যখন চাইছ না তখন জোর করব না...কিন্তু একা একা থাক বাড়িতে তাই ভয় লাগে," কলি চিন্তিত গলায় বলে।

    ***

    ছোটন কিছু বলেনা, ও জানে মা যখন না বলেছে তখন সেটা আর হাঁ হবেনা। আর এও জানে মা নিজের জীবনের প্রতি কতটা নিরাসক্ত। তাই কিছুতেই কিছু যায় আসেনা তাঁর। মা যে এখন এই অবস্থায় তার সামনে বসে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে সেটাই ওর কাছে স্বপ্নের মতো মনে হয়। সেই ভেঙ্গে, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া মা এতদিন পরে যে এক সাথে তাদের সঙ্গে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে এটাই তো তার জীবনের বড় প্রাপ্তি। তার কৈশোর থেকে বড় হয়ে ওঠার অধ্যায় কেটে গেছে প্রায় মাতৃহীন হয়ে। মা যেন থেকেও ছিলনা। কোথাও সে মাকে খুঁজে পেতনা। তার পড়াশোনা, নাওয়া-খাওয়া, পরীক্ষার দুর্বিসহ চাপের মুহূর্তে কতবার ইচ্ছে হতো মাকে গিয়ে বলে একটু পাশে বসবে মা, পড়াটা দেখিয়ে দেবে কিম্বা বন্ধুরা আসতে চাইছে কিছু খাবার বানিয়ে দেবে? বলতেই পারেনি কখনো। বরং কোথা দিয়ে ও নিজেই মার ভরসা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। মাত্র বারো বছর বয়সেই সে যেন অনেক বড় হয়ে গেছিল। একটা ঘটনা, একটা টেলিফোন তার কৈশোরকে টেনে হিঁচড়ে পথে নামিয়ে দিয়েছিল। একটা ধাক্কা, অবিরাম বুকের মধ্যে বয়ে চলা শোকপ্রবাহ যা প্রকাশের পথ পায়নি কোনদিন, সেটাই তাকে নিয়ন্ত্রিত করেছিল বাকি জীবনের অনিবার্যতার দিকে। বারো বছর পর্যন্ত সে বুঝতেই পারেনি যে সে বাল্যকাল অতিক্রম করে কৈশোরে পা দিয়েছে। বয়সে দাদা, দিদির থেকে দশ বছরের ছোটো হওয়াতে বাড়ির সকলের আদর পেয়েছে। ওরা দুজন ছিল ওর দুনিয়া জুড়ে। মা-বাবার সঙ্গে যতটা না যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছিল দাদা, দিদির সাথে। আর দাদা খুব অল্প বয়সে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়াতে ওকে অনেক বেশি স্পয়েল করত। দুই হাত ভরে চাহিদা পূরণ করত। তবে সেই সঙ্গে পড়াশোনা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাও খেয়াল রাখত। বাড়িতে থাকলে তো নিজেই দেখিয়ে দিত আর বম্বে থাকলে ফোন করে ঠিক খোঁজ নিত ছোটন কি করছে না করছে। আর দিদি ছিল তার সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা। তাই বাবা মার কাছে যাবার দরকার পড়েনি ছোটনের কখনো। ওই ভয়ংকর রাত সারাজীবনের জন্যে ছোটনের আকাশটাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল যেন। ভিত আলগা হলে বাড়ি যেমন করে নড়বড়ে হয়ে পড়ে, ছোটনের মনে হয়েছিল পায়ের তলা থেকে একটা কংক্রিট কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। চোখ বুজলে শুধু চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেত আর ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাওয়া শরীরের টুকরোগুলো যা তাকে সনাক্ত করতে হয়েছিল। জীবনভর যে শুধু আনন্দ আর খুশির রূপ দেখে বড় হচ্ছিল সে যেন বাস্তবের কুটিল, বীভত্সতায় কুঁকড়ে গেছিল। বাবাও ছিল ওর সাথে কিন্তু বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনি। চোখ বন্ধ করে কেঁদে ফেলেছিল, শুধু ছোটন দাঁত চিপে, পুলিশের কথামত কাজ করে চলেছিল। বাড়ি ফিরে কত রাত ঘুমোতে পারেনি। ওই দৃশ্যগুলো চোখের সামনে অন্ধকার হলেই নেমে আসত। পাশের ঘরে বাবার বিড়বিড় করতে করতে পায়চারি করার আওয়াজ শুনতে পেত। খুব ইচ্ছে করত বাবার হাতটা ধরে বসতে বলে, চেপে ধরে ঘুম পাড়িয়ে দেয় সারারাত জেগে থাকা মাকে। কিন্তু পারেনি, নিজের শোক ভুলে ওদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যে যতটা শক্তি থাকার দরকার ছিল সেটা আনতে অনেক সময় লেগেছিল তার। কিম্বা কখনো হয়তো পারেইনি। নাহলে আজও কেন সেই অনুভূতি গুলো ভাগ করে নিতে পারেনা মায়ের সাথে। এ যেন তার একান্ত নিজস্ব, একা থাকার সঙ্গী, আনন্দ করতেই পারেনা সে আর। মাঝে কিছু বছর কলির সাথে বিয়ে থেকে শুরু করে মিমির জন্ম অবধি কিছুটা সময় ব্যস্ততার মধ্যে এই দহনজ্বালা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলেছিল। কিন্তু এখন আবার সে এই দুঃখের সঙ্গেই দিন-যাপন করে। এই বোধ যেন তার একটা অঙ্গ। একে বাদ দিলে সে একটা অসম্পূর্ণ মানুষ। যেটা বুঝতে পেরে কলিও এখন হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওদের দাম্পত্য তাই কোথায় যেন অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ও নিজেও বোঝে কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসার শক্তি নেই ওর। মিমিও ছোটো থেকে যেন এই বাবাকে বুঝে গেছে। মাঝে মাঝে ছোটনের মনে হয় দুঃখের আবর্তে থাকতে ওর এখন বেশ লাগে। এটা সম্পূর্ণ ওর নিজের একটা জায়গা। সারাদিন অফিসের কাজ আর বাড়ি ফিরে মা, মিমি, কলি সবার প্রতি সব দায়িত্ব সেরে যেটুকু নিজের সময় সেখানে এক গভীর আঁধারে তলিয়ে গিয়ে জীবনকে ফিরে ফিরে দেখা। প্রথম দিকের যন্ত্রণা যা তাকে তাড়া করে বেড়াত ক্রমাগত এখন সেখানেই তার নিত্য আনাগোনা। যদিও মাকে আজ পর্যন্ত বুঝতে দেয়নি সেটা। মার সামনে এত বছর ধরে একটা স্বাভাবিক নির্লিপ্ত জীবন-যাপন করে এসেছে। পঁচিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা একটা বাড়ির পরিবেশকে যেভাবে টালমাটাল করে দিয়েছিল তা ছোটনের গড়ে তোলা এই সংসারে এসে কেউ বুঝতেই পারবেনা। এখানে সেই ঝড়ের আপাত কোনো রেশ নেই। ভেঙে পড়া, শুয়ে পরা নিত্য বিলাপরত কোনো মানুস নেই, অন্ধকার ঘর নেই, নিজের ভিতরে রাগ দুখ্হ, যন্ত্রনায় কুকড়ে থাকা মানুস গুলো নেই। আছে এক সাজানো গোছানো সংসার, জীবনী শক্তিতে ভরপুর এক মা আর হাস্যোজ্জ্বল এক বালিকা। যার অনর্গল কথা সবাইকে সব কিছু থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। এই সংসার গড়ে তোলাটাই ছোটনের জীবনের আপাত সাফল্য। যে বাল্যকাল সে ফেলে এসেছে আর যে কৈশোর সে ইচ্ছে করে ভুলে যেতে চায় সেখান থেকে বেরিয়ে মাকে এই সাফল্য দেখাতে পারাটা তার কাছে একটা ভীষণ বড় ব্যাপার। যে মা শোকে পাথর হয়ে পড়েছিল পঁচিশ বছর ধরে তাকে একটু আনন্দের আবহে আনতে চেয়েছিল বহুদিন ধরে ছোটন। ভেবেছিল তার ভালো চাকরি পাওয়াটা মাকে একটু হলেও আনন্দ দেবে কিন্তু সেও ছিল বড় ক্ষণস্থায়ী। কলির সাথে ওর বিয়ের সিদ্ধান্তটা মাকে যখন জানিয়েছিল তখন মার চোখের তারাটা একই রকম নিস্পৃহ লেগেছিল ছোটনের। প্রথমে ভেবেছিল মা খুশি হয়নি কিন্তু পরে বুঝেছে ওটা মায়ের নিস্পৃহতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। মা কলির সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। যা কিছু মার শাড়ি গহনা ছিল বিয়ের সময় সব কলিকে দিয়ে দিয়েছিল। শুধু তারপর নিজেকে আবার একটা খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়েছিল। কোনও দিন কলির কাছেও মা নিজেকে খুলে ধরেনি। অথচ কলির দিক থেকে চেষ্টার কোনো ত্রুটি কিন্তু ছোটন দেখেনি। ওর মধ্যে প্রথম থেকেই তাদের পরিবারকে আগলে রাখার একটা তীব্র চেষ্টা ছোটন দেখে আসছে। আসলে কলি ওদের পাড়াতেই বড় হয়েছিল বলে ছোটো থেকেই ওদের পরিবারকে ভালো করে জানত। দাদা, দিদির সাথে ও কত খেলেছে ছোটবেলায়। ছোটন আর ও একই বয়সী হওয়াতে দিদি ওকে খুব ভাল বাসত। তাই ওদের অনুপস্থিতিতে কলিই কিভাবে যেন ওর একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। ওর ভেঙে পড়া কৈশোরকে শক্ত হাতে দাঁড় করানোর কৃতিত্ব কলি ছাড়া আর কেউ নিতে পারবে না। আর কলি নিজেও ভীষণভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে সচেষ্ট ছিল বরাবর। প্রত্যেকটা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাস করা থেকে শুরু করে এতদিনের চাকরি জীবনে কোথাও ওকে পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তাই আজকে ছোটনের এই জীবনটার জন্যে ও নিজেই কলির প্রতি ভীষণ রকম কৃতজ্ঞ সেখানে কোথাও ছোটন বাবা মার উপস্থিতি টের পায়না। দাদা, দিদির সাথে ও যেন ছোটবেলাতে বাবা মাকেও হারিয়ে ফেলেছে। এটা মনে হলেই বুক ভরা এক অভিমানবোধ ওকে একটা শিশুর মত অভিমানী করে তোলে যা ওর নিজের ব্যক্তিত্বের সাথে একেবারেই মেলেনা। একটা আপাত-কঠিন, গাম্ভীর্যের আড়ালে যে মানুষটা লুকিয়ে আছে তা কেউ জানেনা। কলিও না। মাঝে মাঝে মিমির সাথে কথা বলতে গিয়ে সেটা ও নিজে বুঝতে পারে। অর নিজের দৈত সত্ত্বা ওকে বিব্রত করে তোলে। আবার নিজেকে গুটিয়ে নেয় যেখানে ও শুধু দায়িত্ববান ছেলে, কলির নির্ভরতা আর মিমির খেলার আর গল্পের সাথী। বাবার এই হঠাৎ করে চলে যাওয়াটাও ছোটনের কাছে বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা। যে প্রতি মুহূর্তে তাদের কলকাতা যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে, ওরা যাবে বলে বাজার করেছে, অপেক্ষা করেছে সারা বছর ধরে মিমিকে দেখবে বলে সেই কিনা বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ করে চলে গেল পেপার পড়তে পড়তে। বারবার তার সাথেই কেন যে এই অঘটন গুলো ঘটে আজও ছোটন তার হিসেব মেলাতে পারেনি। তাই একটা ভয় ওকে সর্বদা বেঁধে রাখে। সব সময় মনে হয় এবার কি অঘটন ঘটবে ওর জীবনে। এই অবিরাম টেনসন কলি ধরে ফেলেছে এখন। যদিও ছোটন মুখে স্বীকার করেনি কলির কাছে। বরং ওর সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায় অবিরাম।

    ***

    আজ একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে কলি। বাড়ি এসে দেখে মা মিমির সঙ্গে বেশ জমিয়ে পাজল করতে বসেছে। দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। মা যে মিমির সঙ্গে আসতে আসতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে সেটাই তাদের বড় প্রাপ্তি। নিজের স্টাডিতে বসে দুই-একটা জরুরি ফোন করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় মিমির কান্নার শব্দ শুনতে পেল। মা ওকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে এটাও বুঝতে পারল। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে লিভিং রুমে এসে দেখে মিমি কাঁদছে আর মা কিছু খুঁজে চলেছে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে জানতে পারল ওর অতি প্রিয় পাজলের কিছু পিস মিসিং আর এটাই মিমির কান্নার কারণ। মা অনেক খুঁজেও কিছু না পেয়ে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলো, "কেঁদ না দিদিভাই, বাবা তোমাকে এনে দেবে আর নাহলে জিজ্ঞেস করে দেখো মা কোথাও রেখেছে কিনা।” কলি একটা সেমিনার নিয়ে দুদিন ভীষণ ব্যস্ত। আজকাল মিমির সাথে কিছু করার সময় পাচ্ছেনা। তাছাড়া মা আছেন বলে ও নিজেও একটু নিশ্চিন্ত হয়ে মিমির দিকটা ছেড়েই দিয়েছে। ওকে দেখে মিমির কান্না আরও বেড়ে গেল। কলি দুই-এক জায়গায় খুঁজে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছু চোখে পড়ল না। মিমিকে পরে খুঁজে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ও কিচেনে গিয়ে চা বানালো দুই কাপ। রমিতা চা খেতে ভালবাসেন কলি জানে। এই সময়টা অফিসেই থাকে বলে সেভাবে কখনো ওঁর জন্যে চা করা হয়না কলির। চা করতে করতে পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। কত ছোটবেলা থেকে ও সেন কাকিমাকে চিনতো নিজেই মনে করতে পারেনা। একই কমপ্লেক্স-এ থাকত ওঁরা মুখোমুখি ফ্লাটে। ছোটো থেকেই ছোটনের সাথে বন্ধুত্ব। অঙ্কুরদা আর দিভাইকে তো নিজের দাদা-দিদি বলেই জানত। ওদের কথা মনে হলে কলির বুকের ভেতরটা বড় ফাঁকা লাগে। ওর ছোটবেলা জুড়েও তো ওরাই ছিল। সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। সেন কাকিমা কত সুন্দর করে কথা বলতেন। ও ছোটো থেকেই রমিতার গুণমুগ্ধ ছিল। ওর মার সাথে কাকিমার সম্পর্কটা ছিল খুব সুন্দর। ওঁরা সব কিছু শেয়ার করতেন কিন্তু একটা মিনিমাম রেসপেক্ট রেখে পরস্পরের সাথে মিশতেন। আসলে সেন কাকিমার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যা তাঁকে অন্যদের থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয় করে রাখত। কমপ্লেক্স-এর বাচ্ছারা তাই যেমন ওর ফ্যান ছিল তেমনি মায়েরাও ওঁকে সম্ভ্রম করতেন। আর ছেলেমেয়েদের সুন্দর করে মানুষ করেছিলেন বলে সবাই ওঁকে অন্য চোখে দেখতেন। আজকের রমিতার সাথে সেই সেন কাকিমাকে মেলাতে পারেনা কলি। মাঝে মাঝে মনে হয় উনি ওর প্রতি বড় বেশি উদাসীন। হয়ত ওদের বিয়েটা ওঁর পছন্দ হয়নি। এটাই প্রথমে কলির মনে হত কিন্তু ওর মা ওকে বুঝিয়েছিলেন যে উনি মানসিকভাবে এতটাই নিস্পৃহ হয়ে গেছেন যে এসব তার কাছে মূল্যহীন। হয়ত কলির মাই ঠিক বলেন কিন্তু আজ পর্যন্ত কলি যে ওই মানুষটার কাছে একটুও পৌঁছাতে পারেনি সেটা ওর কাছে বিরাট একটা ব্যর্থতা বলে মনে হয়। ওর প্রতি পরীক্ষায় ভালো রেসাল্ট করাটা বা কেরিয়ার তৈরি করার অদম্য জেদ যা তাকে আজ একটা সুন্দর জীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে সেটাও কেমন যেন ফিকে লাগে। কোথায় যেন এক অপূর্ণতা, ছোটবেলার মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী এক প্রিয় মানুষের মনে ঠাঁই না পাওয়ার যন্ত্রণাটা ওকে বিদ্ধ করে চলে। অথচ যতটুকু জানে ও কিন্তু ছোট বেলায় সেন কাকু-কাকিমার প্রিয় পাত্রী ছিল। ওঁরা ওকে বেশ ভালবাসতেন। মোমদিদির ঘরে তো ওর অবারিত দ্বার ছিল। ওর সাথে খাওয়া, গল্প, ঘুম ছোটবেলায় অতি প্রিয় ছিল কলির। ও নিজে একটি সন্তান ছিল বলে দুই-বাড়ি থেকেই অবাধ মেলামেশায় কোনো রাশ ছিলনা কোনদিন। তবে ছোটনের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক পরে তৈরি হয়েছিল। অঙ্কুরদা মোমদি বেঁচে থাকলে হয়ত হতই না। কে কোথায় পড়াশোনা করতে চলে যেত! কিন্তু ওদের না থাকাটা ছোটনকে যে ভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল সেটাই কলিকে ওর কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। সেই ভেঙে পড়া ছোটনের চেহারাটা এখনো ভুলতে পারেনা কলি। পঁচিশ বছর অনেকটা সময় কিন্তু মনে হয় এই সেদিন ঘটল সব কিছু। মুখচোরা ছেলেটা দাদা-দিদিকে হারিয়ে কি ভীষণ একা হয়ে গেছিল সেটা কলিই একমাত্র জানে। পুরো পরিবারটা যখন বিপর্যস্ত, কেউ কারোর দিকে তাকানোর অবস্থায় নেই, ভেঙে পড়া বাবা-মা দুটো ঘরে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগহীন হয়ে ধুঁকতে থাকা বাড়িতে ছোটন কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, খাচ্ছে কিনা, পরীক্ষা দিতে গেল কিনা কারোর খেয়াল নেই সেখান থেকে একদিন জোর করে ওদের বাড়িতে ধরে এনেছিল কলি। আর মাকে বলেছিল ওকে তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দিতে। পরীক্ষার তখন আর মাত্র দুই-মাস। কলিও সেভেন-এই ছিল তখন। ওকে বলেছিল "তুই কেন স্কুল যাচ্ছ্সিনা? দুমাস পরে পরীক্ষা।" ছোটন সটান বলে দিয়েছিল "আমি পরীক্ষা দেবনা, পাস করার অবস্থায় নেই আমি।" “আরে তুই সারা বছর যা পড়েছিস তাতেই পাস হয়ে যাবি ছোটন, টপার হবার দরকার নেই, কিন্তু বছরটা নষ্ট করিসনা।" যখন কিছুতেই ওকে রাজি করানো যায়নি তখন বলে দিয়েছিল "দাভাই থাকলে তোকে মজা দেখিয়ে দিত, আমার কথা তো শুনছিস না।" কলির মা ওকে ইশারায় থামতে বলেছিলেন। ওর সামনে অঙ্কুরের কথা তোলাটা উচিৎ নয় বলেই ওদের কমপ্লেক্সের লোকজন মনে করত কিন্তু কলি জানত এতেই কাজ হবে। নাহলে ব্যাকবোন সোজা হবেনা ছোটনের। আর তাতেই কাজ হয়েছিল। ও নিজে নিজেই পরীক্ষা দিতে গেছিল। তারপর বহুদিন ওরা শুধু ভালো বন্ধু ছিল। দুজনেই খুব মিস করত অঙ্কুর আর মোমকে আর এটাই ওদের বন্ধুত্বের সেতু রচনা করেছিল। তারপর ছোটন যখন এখানে আসার কথা কলিকে জানিয়েছিল সেদিন প্রথম কলি বুকের মধ্যে একটা চাপা কান্না অনুভব করেছিল। ওই প্রথম ওর নিজেকে ছোটনের থেকে দুর্বল মনে হয়েছিল। আর ছোটন হঠাৎ করে বলে বসেছিল, "তুই যাবি আমার সাথে?" হকচকিয়ে গেছিল কলি। "আমি? কেন?" নিচু মুখে উত্তর দিয়েছিল কলি দমদম মেট্রোস্টেশনে দাঁড়িয়ে। "একা একা যেতে ইচ্ছে করছে না। তুইও দ্যাখ না ওখানে তোর জব অফার আছে কিনা।" ততদিনে কলি ভিজিটিং লেকচারার হিসেবে দুবার ইউএস ঘুরে গেছে। কিন্তু কোনদিন সেটল করার কথা ভাবেনি। বাবা-মাকে ছেড়ে, বিশেষ করে কলকাতা ছেড়ে এতদুরে ওর ভালো লাগত না। ছোটন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে বাঙ্গালোর কলকাতা করছে ততদিনে। কলির সাথে যোগাযোগ রেখে গেছে ক্রমাগত। মুখচোরা এক দায়িত্ববান ছেলে যে কিনা বাবা-মা ছাড়া সেভাবে কিছু জানে না। কলিই ছিল ওর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম। ঝড় ঠেলে কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয় কলি না থাকলে শেখা হতনা ছোটনের। তার পর একদিন মধ্য রাত্রে ফোন করে ছোটন ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কলির মনে হলো ও যেন এর অপেক্ষাতেই ছিল। মা কতদিন ধরে বিয়ের কথা বলছে, কিন্তু কলি সেভাবে সাড়া দেয়নি। পড়াশোনার অছিলা দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। আর আজ ছোটন যখন বলল ওর মনে হলো এটাই হবার ছিল সেটা যেন ও জানত। তাই শুধু বলেছিল "তুই বাবার সাথে কথা বলিস।" ছোটনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে কলির দিক থেকে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আজ কলির মনে হয় সেন কাকিমার হয়ত এরকম ইচ্ছে ছিলনা। যদিও ও জানে ওঁর সর্বস্ব উনি কলিকে দিয়ে দিয়েছেন বিয়ের পরদিন। কলি বারণ করেছিল কিন্তু উনি শোনেননি। যেন সব কিছু দিয়ে উনি মুক্ত হতে চেয়েছিলেন জাগতিক চাহিদার হাত থেকে। কলি যতদিন কলকাতার বাড়িতে ছিল রমিতা, আর সন্দীপনের খেয়াল রাখত ভীষণভাবে। জোর করে ওদের ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে কখন কি খাবেন না খাবেন তার চার্ট অবধি বানিয়ে দিয়েছিল। সন্দীপন বড় তাড়াতাড়ি ওকে মেনে নিয়েছিলেন। সেখানে কোনো আড়াল ছিলনা। মৃত মেয়ের জায়গায় বসাতে পেরেছিলেন উনি কলিকে। কিন্তু রমিতা পারেননি। কলির সেখানে কোনো আক্ষেপ নেই। ও জানে কেউ কারোর জায়গা নিতে পারেনা। আর মোমদির জায়গা তার নিজের জীবন জুড়েই অনেকখানি ছিল তাই সেখানে ঢুকতে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু রমিতা তার কাছে মনটাও কখনো খুলতে পারলেন না আজ অবধি। কলি চেষ্টা করেছিল ওঁকে একটু আপন করে নিতে। মনে হয়েছিল মন খুলে কথা বলতে শুরু করলে হয়ত ওঁর কষ্টটা কমবে। কিন্তু পারেনি। সেই একা ঘরে বসে থাকা মানুষটা তার বিয়ের এত বছর পরেও একা ঘরেই বসে সময় কাটান। কখনো সখনো ইচ্ছে হলে দুই-একটা কথা বলেন, কখনো বা বলেননা। কলি এখন আর চেষ্টা করেনা। ও স্পেস দিতে শিখে গেছে। বরং নিজের কাজ নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে বেশি করে। তবে সমস্ত দায়িত্ব পালন করেই নিজের কথা ভাবে সে এখনো।

    ***

    অনেক রাত্রে ঘুম আসে রমিতার। সন্ধে থেকে মিমির মনটা খারাপ ছিল। ওর পাজলপিস গুলো অনেক খুঁজেছেন দুজনে মিলে। তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করে শুতে এসেছিলেন রমিতা। ঘুমের মধ্যে ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নে পাজলপিস গুলো খুঁজতে থাকেন রমিতা। অনেক খোঁজেন, তন্ন তন্ন করে, এঘর, ওঘর, বিছানা, বালিশ, ড্রয়ার, বুকশেল্‌ফ। কিন্তু কোথাও নেই ওগুলো। টিনকার বেলের মুখের কিছুটা আছে আর পিটার প্যান এর মুখটা পুরোটাই অসম্পূর্ণ। স্বপ্নের মধ্যেই উপরনিচ করতে থাকেন দুজনে মিলে। ঘুম ভেঙে যায় রমিতার। উঠে জল খেতে খেতে মনে হয় ছোটনের ডেস্কের দিকটা খুঁজলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন তিনি। সবাই ঘুমোচ্ছে তাই পা টিপে টিপে ছোটনের অফিসের দিকে চলতে থাকেন রমিতা। মিমি এসে মাঝে মাঝে এখানেও বাবা না-থাকলে খেলা করে হয়তো ভুল করে ফেলে গেছে। ডেস্কের উপরে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে তো কিছু নেই। ছোটন উইকএন্ড ছাড়া পরিষ্কার করার সময় পায়না। তাই অনেক কাগজপত্র জমে গেছে। ওগুলো সরিয়ে খুঁজতে থাকেন রমিতা। তারপর ডেস্কের ড্রয়ার খুলে খুঁজতে থাকেন। একটা ড্রয়ার একটু পরিষ্কার, কাগজপত্রের স্তূপীকৃত জঞ্জাল নেই। তবু যদি কিছু থাকে এই ভেবে রমিতা হাতড়াতে থাকেন। হঠাৎ করে হাতে উঠে আসে অনেক পুরনো একটা ছবি। রমিতা চশমা না পরে এসেছেন বলে ভালো বুঝতে পারেননা। টেবিলের উপরে রাখা ল্যাম্প এর সুইচটা আর একটু ঘুরিয়ে আলোটা বাড়াতে চান। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মোম আর অঙ্কুরের মুখ দুটো। রমিতা কোনোভাবে চেয়ার টেনে বসে পড়েন। চলে যাবার পর থেকে ওদের সব ছবি বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন সন্দীপন, ভুলে থাকার জন্যে। কিন্তু আজ এতদিন পরে ছোটনের ডেস্কে এগুলো পেয়ে তিনি হাত বোলাতে থাকেন ওদের মুখগুলোর উপর। ভালো করে দেখতে থাকেন ওদের। অঙ্কুরের আঙুল, মোমের কানের উপরে হাত রেখে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকেন বারবার। এগুলোই তো পড়েছিল শেষে। বাকি পিসগুলো হারিয়ে গেছিল মিমির পাজলপিস গুলোর মতন। কোথায় যেন একাকার হয়ে যায় ওদের ছবি আর মিমির পাজল। মনে হয় রমিতাও হারিয়ে ফেলেছেন তার পাজলের পিস গুলো। তিনিও খুঁজছেন, কত দিন, কত বছর ধরে, মনে মনে কল্পনায় খুঁজে চলেছেন রমিতা। দুই হাতে মাথা চেপে ধরেন রমিতা।

    "মা।" ছোটন দরজা থেকে ডাক দেয়। "কি করছ? জেগে আছ?"

    "খুঁজছি, ছোটন....পাজল পিসগুলো।" রমিতা উত্তর দেন।

    ছোটন দ্রুতপায়ে কাছে আসে, "এখানে কি করে পাবে মা? চল শুতে যাবে...."

    "তুই ভালো করে খুঁজে ছিলিস ছোটন? আসেপাশে কোথাও কিচ্ছু ছিল না?"

    "কাল সকালে উঠে দেখবে ও সব ভুলে গেছে। এখন চল শুতে যাবে।"

    "আমিও তো খুঁজছি ছোটন, তুইও কি আমার মত খুঁজিস? মুখগুলো কোথায় হারিয়ে ফেললি বলত?" রমিতার হাতের মধ্যে ছবিটা চোখে পড়ে ছোটনের। ও এতক্ষণে বুঝতে পারে মা কোন পাজলের কথা বলছে। ছোটন মাকে শক্ত করে চেপে ধরে পিছন থেকে। "তুমি বিশ্বাস কর আমি সব খুঁজেছিলাম মা, পাইনি। শুধু পোড়া গন্ধ আর তালগোল পাকানো মাংসপিণ্ড ছিল মা..."

    ছোটন ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। রমিতা ওকে সামনের কার্পেটে বসিয়ে দেন। মায়ের দুই হাঁটুর উপরে মাথা রেখে ছোটন কাঁদতে থাকে। আর রমিতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। রমিতার কান্না পায়না আর। ছোটনের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে এই প্রথম বার তাঁর মনে হয় কতদিন পরে তিনি আবার কারোর মা হতে পারছেন, তাঁর কোল কারোর আশ্রয় হয়ে উঠছে। বড় মুখচোরা এই ছেলেটাকে আরও কাছে টেনে নিতে মন চায় তাঁর। সারারাত ওভাবেই কেটে যায়। ছোটন মার কোলে মাথা রেখে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরের দিকে রমিতা তাকে ডেকে তুলে ঘরে পাঠান আর মনে করিয়ে দেন মিমির জন্যে একটা নতুন পাজল এনে দিতে। নিজের ঘরে যাবার সময় ছবিটাও হাতে করে নিয়ে যান। এবার থেকে এরা তাঁর সামনেই থাকবে...ড্রয়ারের অন্ধকারে নয়....



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments