• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রতিবাদের কবিতা: নবারুণ ভট্টাচার্য : রাজীব চৌধুরী

    প্রথম কবিতার বইটি প্রকাশের আগেই কাব্যগ্রন্থের নাম-কবিতাটি রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে এক যুবক কবিকে সেদিন বাংলার পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছিল। পরে হিন্দিতে এই বইটির কবিতাগুলি অনুবাদ হয়ে যখন প্রকাশিত হল, তার সূচনায় কবি মঙ্গলেশ ডবরাল লিখেছিলেন, রাষ্ট্রসত্তার দ্বারা সৃষ্ট আতঙ্ক এবং সাধারণ মানুষের জীবনকে অমানবিক পরিস্থিতির মুখোমুখি করে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাগ এবং যুদ্ধঘোষণা করেছেন নবারুণ।

    মানুষের পরাজয়, দুর্ভোগ আর তারই হাত ধরে মৃত্যু এবং আত্মহত্যার একের পর এক আলেখ্য নবারুণ এঁকে চলেন তাঁর কবিতায়—পাশাপাশি গল্পে বা উপন্যাসেও। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা অগণিত মানুষ; যারা সর্বহারা মানুষ—তাদের যাপনচিত্র, তাদের টিঁকে থাকার স্বপ্ন বা বেঁচে থাকার আশ্চর্য কৌশলগুলিও তাঁর কবিতা জুড়ে। শুধু মানুষ কেন, এই প্রাণমণ্ডলের উদ্ভিদ বা প্রাণী— যারা যেভাবে যেখানে বিপন্ন, নবারুণের কবিতা তাদেরই পক্ষে। 'শীতে জমে মরে যাওয়া বুড়ো ভিখিরির গান' কবিতায় লিখেছেন:

    এন.জিও-রা কি জানে যে আমার আর দরকার নেই সহৃদয় কম্বল বা সাহেবদের বাতিল জামার সবারই কি শীত করছে এমন না শুধুই আমার গাছেদের কি শীত করছে এমন কুকুরদেরও কি শীত করছে এমন রাস্তা, সিনেমাহল, টিপকল, রেস্তোরাঁ, বিউটি পার্লার সকলেরই কি শীত করছে এমন মথ, পাখিষ মেঘ, মদ, গ্রহ সবারই কি শীত করছে এমন—
    'কর্পোরেট সোসাল রেসপন্সিবিলিটি'র মতো সোনার পাথরবাটিকে প্রত্যাখ্যান করে তাঁর কবিতার সর্বহারা মানুষ। লুব্ধক উপন্যাসে শহরের কুকুরেরা অসহিষ্ণু মানুষদের ছেড়ে দল বেঁধে চলে যায়—যারা পরিবেশ-বান্ধব সেজে সেমিনার করে, তাদের!

    এদের পাশে কি মধ্যবিত্তেরা রয়েছে? মানুষ ভুলে যাচ্ছে এদের হয়ে প্রতিবাদ করতে। বেশি সোচ্চার প্রতিবাদের ভাষাও যে এরকম সময়ে ভোঁতা মেরে যায়—নবারুণ তা জানেন। নবারুণের প্রতিবাদের কথাগুলি তাই গুপ্তঘাতকের ছুরির মতো। একটা নিষ্ঠুর সময়ে নিষ্ঠুরতর মৃত্যুর বর্ণনাগুলিকে এমনভাবে কবিতায় তুলে ধরেন, যেন তাতে কারোরই কোনো তাপ উত্তাপ নেই। আর এটাই তো আমরা করে থাকি! এই চেনা ভাষাকেই যখন কবিতায় ধরে আমাদের হাতে ফিরিয়ে দেন তখন বিস্মিত হয়ে দেখতে হয়—তা কতটাই অচেনা হতে পারে! আমাদেরই অভ্যাস, আমাদেরই নিষ্ক্রিয়তাকে আমাদের কাছে সমর্পণ করে বুঝিয়ে দেওয়া হয় প্রতিবাদের কবিতা কেমন হতে পারে!

    তাঁর লেখা 'রেস্তোরাঁর খাদ্যতালিকা'টির একাংশ—

    আমিষ: শিশুদের টাটকা চোখ, আঙুল, নিহত হরিজনের ঝলসানো মাংস, ভূপাল থেকে আনা নীলাভ বাছুর, ফলিডলে মারা মাছ, রাস্তায় সংগৃহীত চাপ চাপ রক্ত, প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া হাড়, অর্ধদগ্ধ করোটি অ্যাকসিডেন্টের ঘিলু, তরুণ চর্বি, আস্ত বনসাই মানুষ মিষ্টান্ন: বিষুব অরণ্যের কান্নাভরা ক্লান্ত অধঃপতিত আঙুর মৃত প্রেম যা মিষ্টি চিউইংগামের মতো খাওয়া যায় নরম ক্যাসেট বা রেকর্ড, যে সুন্দরীরা খবর পড়েন, চিত্রতারকা, মিছরি মেশানো মদ, ধুরন্ধর বিপ্লবী নেতার তৈরি সন্দেশ, এইডস চুম্বন
    নগরায়নের স্রোতে মানুষ যারা রেস্তোরাঁয় প্রায়শই খেতে যান, খেতে গিয়ে আগে দেখেন খাদ্যতালিকাটিকে—সেই পরিচিত খাদ্যভাষাশৈলীকে উপস্থাপিত করা হয় তাদেরই সামনে—এইভাবে।

    'মৃত্যু উপত্যকা'-য় একটা অদ্ভুত চিত্রকল্প ছিল একটি কবিতায়—'ম্যাচবাক্সের মানুষ'। মানুষেরা যেখানে দেশলাইয়ের বাক্সে এক একটা দেশলাইকাঠির মতো।

    ফ্যাকাশে অনেক মানুষ এখানে থাকে অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ।... বদরাগী এরা মিশকালো সেই রাগ জমাট আঁকড়ে রয়েছে তাদের মাথা।
    কিন্তু এই রাগের পরিণতি অদ্ভুত—
    বারুদ মাখানো তাদের ঘরের দেওয়াল সেই দেওয়ালেতে মাথা ঠুকে কী যে চায় অর্থহীন ও নিতান্ত বরবাদ ফ্যাকাশে আগুনে নিজেরাই জ্বলে যায়
    মাথা জুড়ে যে বারুদের মতন ক্ষোভ আর রাগ জমে, যারা বারুদেরই দেওয়ালে মাথা ঠোকে তাদের বারুদে 'ভেজা-ভাব' ধরে গেলে সেই ফ্যাকাশে আগুন শেষে তাদেরই পোড়ায়! এই বারুদ এই আগুন আর দেশলাই নিয়ে পরেও নবারুণ লিখবেন পরবর্তী 'মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা' কাব্যগ্রন্থে। সেখানে তাঁর 'পাঠকের কাছে প্রশ্ন'—
    মানুষ যদি বিদ্রোহ করতে ভুলে যায়                 তখন তাকে মনে করিয়ে দেওয়া                                           কি পাপ?... কত জায়গায় তো ফেলি আমি দেশলাই                 একবারও ভুল করে নয়                          যদি কেউ আগুন জ্বালায়। ভয় করে, এর পরে হয়তো একদিন                মানুষ আগুন জ্বালাতে ভুলে যাবে।
    পুলকেশ মণ্ডল ও জয়া মিত্র সম্পাদিত 'সেই দশক' নামে সত্তর দশকের স্মৃতি স্মরণিকাটিতে নবারুণ একটা ছোট্ট গদ্য লিখেছিলেন 'পেট্রল দিয়ে আগুন নেভাবার স্বপ্ন'। এই বিরোধাভাসপূর্ণ নামটির আড়ালে রয়েছে তাঁরই একটি কবিতা, নাম 'পেট্রল আর আগুনের কবিতা'। পরে 'পারিজাত ও বেবি. কে' সিরিজের গল্পগুলিতে বিশ্ব অর্থনীতির খেলাঘরে এই তরলটিকে নিয়ে সিরিয়াস ছেলেখেলার মতো যাদু বাস্তবকে তিনি অন্যভাবে তুলে ধরবেন। কিন্তু এই কবিতায় সেই পুড়ে যাওয়া বারুদ মানুষদের এক এক টুকরো আগুনের ফুলকিতে তিনি ঢেলে দেন আশ্চর্য অগ্নিনির্বাপক তরল! প্রতিবাদের এই বক্রোক্তি মনে করায় যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের এতটাই নিরাপদ স্থিতিবাচক শীতঘুমের মধ্যে থেকেই ঘটে আকস্মিক বিস্ফোরণ! যেমন ঘটেছিল 'হারবার্ট' উপন্যাসের শেষে!
    ধুলোর ঝড়ের মধ্যে চোখ বন্ধ করে আমি হাঁটতে শিখিনি একদিন পেট্রল দিয়ে সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব সব আগুন আমি নিভিয়ে দেব পেট্রল দিয়ে
    ধুলোর ঝড়ে যে চোখ খুলে হাঁটে—সেটাই তাঁর প্রতিবাদের চিত্রকল্প। 'পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট'-এর মতো গল্পের পটভূমিকা ২০২০, অর্থাৎ যে সময় এখনও আসেনি সেই সময়ের গল্প। সেখানে নবারুণ দেখছেন পৃথিবীর শেষ কমিউনিস্ট মারা যাচ্ছেন—অর্থাৎ একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় বামপন্থার পরিসম্পাতিসূচক পূর্ণচ্ছেদচিহ্নটির। কিন্তু কাহিনির শেষে প্রায় এক ইস্তাহারেরই সমাপ্তিসূচক আশাবাদী ঘোষণার মতো তিনি দেখেন সমগ্র বিশ্ব জুড়ে তার পুনরভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে সাধারণ মানুষ; কোণঠাসা মানুষ—তারা প্রতিবাদ করবেই। 'লাল কার্ড হাতে ছোট-ছোট ফুটবল দলের গান' কবিতায় তাই এরা সোচ্চারে বলবে—
    আমাদের মার খাওয়াটাই তো ইতিহাস আর আমাদের মারাটাই যেন নিয়ম... আমাদের রোগা রোগা কোচ, মুষ্টিমেয় সমর্থক ছেঁড়া বুট, নড়বড়ে তাঁবু, ভেজা বল হাঁটুর তলায় কালশিটে, কপালে ফেট্টিবাঁধা কিন্তু ভাবুন তো একবার কতদিন ধরে কী লড়াইটাই না আমরা চালিয়ে যাচ্ছি সবাই এক হলে লড়াই-এর চেহারাটাই তো পালটে যাবে সত্যি কথা লুকিয়ে রাখতে আমরা ঘৃণা বোধ করি তাই স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিচ্ছি যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে যারা লাথি খায় তারাই হাতমুঠো ক'রে উঠে দাঁড়ায়
    মার খাবার আর বঞ্চিত, প্রতারিত হবার কথা নানাভাবে লিখতে লিখতে ১৯৯৫-তে নবারুণ লিখলেন 'ফ্যাতাড়ু' নামের গল্প। জন্ম নিল এক কবি পুরন্দর ভাট ও তার কবিতা। তথাকথিত ভদ্রলোক এবং রুচিশীলতা আঘাতপ্রাপ্ত হলে—প্রতিবাদী কবিতার এক অন্য স্বরকে উন্মোচিত করলেন নবারুণ। প্রতিবাদী কবিতার প্রতিবাদের ভাষাও কখনো গতবাঁধা কোনো কোনো চেনা রাস্তার পথিক হয়ে ওঠে। নবারুণও স্বীকার করেছেন যে এ ধারায় তিনি অধমর্ণ। একটি দৈনিক পত্রিকায় নিজের প্রথম বই, অর্থাৎ 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না' কাব্যগ্রন্থটির সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন—

         মৃত্যু উপত্যকা লেখার সময় আমি জানতাম, যে রাস্তায় আমি পা দিয়েছি, সেই রাস্তায় অনেক জ্যোতিষ্ক, অনেক মহাজন হেঁটে গিয়েছেন; দেশে ও বিদেশে।

    এদের নিয়ে বা এদের উৎসর্গ করে নবারুণ লিখেছেন কবিতা। 'বিদেশি ফুলে রক্তের ছিটে' বইতে তিনি অনুবাদও করেছেন ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, পাবলো নেরুদা, নাজিম হিকমেত এবং আরও অনেক প্রিয় কবির রচনা। বইয়ের মুখবন্ধে তিনি পাঠককে মনে করিয়ে দেন এই অনুবাদের ভাষার শৈলীতে কিভাবে মিশে রয়েছে তাঁর নিজেরই কাব্যভাষা! অনুবাদ করার জন্য কবিতা যে কবি-পাঠকটি নির্বাচন করে নেন—সেখানেও তিনি স্বধর্ম পালনেরই পক্ষে! অনন্য রায় তাঁর বন্ধু, সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর সুভাষকাকা, কবি সমীর রায় বা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে ওসিপ মান্দেলস্তাম, ভ্লাদিমির মায়াকোভ্‌স্কি সকলকেই তিনি টেনে নিয়েছেন নানাভাবে তাঁর কবিতার মৃত্যু উপত্যকা থেকে প্রতিবাদ জানাবার বৃত্তে। আর সেখান থেকেই শুরু পুরন্দর ভাটের পথচলা। যে কবি ঘোষণা করেছেন যে, কথাসাহিত্যিক বলে লোকে তাকে একটু আধটু চিনলেও তিনি আসলে একজন কবিই। নবারুণের কথাসাহিত্য থেকেই তাই বোধহয় জন্ম নিল পুরন্দর ভাট। যার অপভাষাসরিৎসাগর যুগপৎ নিন্দিত ও নন্দিত। এই মুহূর্তে তা থেকেই কিছুটা রেখেঢেকে অথচ তার স্বাদের পরিচয়বাহী একটি প্রতিবাদী কবিতা—

    বিশ্ব ধ্বংস নিউক্লিয়ার যুদ্ধে বিশ্ব যেবার ধ্বংস হয়ে যায় গোটা মানব সংসারই যখন ছাইয়ের গাদা সব দেশ যখন শেষ তারও পরে বেরিয়েছিল শারদীয়া 'দেশ' অপ্রকাশিত, এক আঁটি রাণুকে ভানুদাদা
    নজরটান দেওয়া যেতে পারে ওই 'এক আঁটি' শব্দদুটির ওপরে।
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments