• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৮ | নভেম্বর ২০১৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • পিতৃস্মৃতি : তথাগত ভট্টাচার্য


    "প্রথিতযশা প্রৌঢ় হওয়ার থেকে/অপমানিত বালক হওয়া ভালো"। সেই অপমানিত বালক যখন নিজের বাবা, ভালো লাগা ছাড়াও একটা গর্বের অনুভূতিও হয় বইকি। তার সঙ্গে একটা ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধও কাজ করে। এই পাঁচমেশালী ঝালমুড়ি ব্যাপারটা এই কারণে নয় যে আমার বাবার একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে নামডাক ছিল বা থাকবে। কারণটা আলাদা। এরকমও তো হতে পারত যে এ বাড়িতে আমার জন্ম হল না। সেই বাড়িতে কেউ বই পড়ত না। সেই বাড়ির ছেলেকে হয় ডাক্তার নয় মোক্তার হতে হত। রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিন্তা ভোটের ইভিএম মেশিনে-ই বন্ধ হয়ে থাকত। সেটা যে হয়নি, এটা আমার বাপের ভাগ্যি।

    আমার বাবা আমায় কোন বেদবাক্য বা বাণী দিয়ে যায়নি। একটা জিনিস তাকে দেখে শিখেছি যে প্রথাগত ব্যাকরণ যদি ভাঙতে হয়, নিজের জীবনটা নিয়েও কিছুটা ছিনিমিনি খেলার প্রয়োজন। আমার জীবনের লক্ষহীনতা নিয়ে অনেকেই অনেক সময়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা এই নৈরাজ্যের সিস্টেমটা ধরতে পারেননি।

    আমার জীবনে আমার বাবা বা মা কোনওদিনও কোন লাগাম পরায় নি। পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল যা খুশি করার। বাবা শুধু একটাই কথা ছোটবেলায় বলে দিয়েছিল। এটা আমার দাদু বিজন ভট্টাচার্য বাবাকে বলে গিয়েছিলেন। আমার ছেলের বয়স নয়। সেও এটা জেনে গেছে। "জীবনে সবকিছু করবে। যা ইচ্ছে তাই। তবে এমন কিছু করবে না যে দিনের শেষে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে পারছো না।"

    ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে যখন গ্রেপ্তার হই, অনেক সতীর্থরাই পুলিশের থেকে বাড়ির রোষের ভয়ে বেশি কেঁপেছিল। সৌভাগ্যবশত সেই চাপ আমায় নিতে হয়নি।

    বাবার পড়াশুনোর পরিধি ছিল অভাবনীয়। তার কিছুটা হয়তো একটা জৈব বা মৌলিক কারণে পেয়েছি। ওই চরিয়েই আমি খাই। এই একটা ব্যাপারে বাবার অনুপস্থিতি আমায় ভোগাবে। "এখন কি পড়ছিস?" এটা আর কেউ বোধহয় জিজ্ঞেস করবে না। বইয়ের পাঁজা নিয়ে আমার দিল্লীর বাড়ি থেকে ট্রেনে চেপে ফিরবে না। আমাকেও আমার গলফগ্রীনের বাড়ি থেকে বই নিয়ে যেতে কোন অনুমতি নিতে হবে না। বাবার একটা বড় আফশোষের জায়গা ছিল। বাংলা সাহিত্যে এই মিডিওক্রিটির মিছিলের মূল কারণ বাবা ভাবত বই না পড়ার ফল। পৃথিবী এবং ভারতের বিভিন্ন কোণে কি ধরনের ভাবনা-চিন্তা হচ্ছে এবং লেখকেরা কিরকম লেখাতে মন দিচ্ছেন, এ বিষয়ে বাবার গভীর পড়াশুনো ছিল। কিছুটা সেই জায়গা থেকেই ২০০৩ সালে আমরা 'ভাষাবন্ধন' পত্রিকা শুরু করি। বাবার লেখায় যে একটা সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রার আন্তর্জাতিক, আধুনিক ও নগরীয় স্বাদ আছে, তা অগাধ পড়াশুনো ছাড়া আসে না। ভালো সাহিত্য পড়লে একটা ব্যাপার হয়। নিজেকে যা-তা লেখার থেকে আড়াল করা যায়।

    বাবার লেখার মধ্যে লোকে প্রতিবাদকে বেশি করে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তার মধ্যের স্বপ্নের মৌলিক ব্যাপারটা অনেকেই ধরতে পারেননি। একটা আমূল পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে যে বড় হয়েছিল, তার যখন স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, জীবনে বহু অপমান, প্রত্যাখ্যান, কষ্ট, দুঃখ যার সাথী, তার মধ্যে একটা পিছিয়ে পড়া বা কষ্ট পাওয়া মানুষদের জন্য একটা সহমর্মিতা তৈরি হয়। এই সহমর্মিতা আমাদের মজ্জাগত। এর জন্য আমাদের কোন প্রশিক্ষণ শিবিরে যেতে হয়নি। জীবনের নানা ছোট-বড় ঘটনা ও উপলব্ধি থেকে এটা আসে। এই সহমর্মিতা থেকেই তৈরি হয় ঠিক-বেঠিকের ধারণা। এর থেকেই তৈরি হয় ঋজু মেরুদণ্ড, না বিকিয়ে যাবার আত্মপ্রতিশ্রুতি। ওখান থেকেই বাবার লেখা আসত। আর তাই বাবা শব্দকে আতসবাজির মতো ফাটাতে আর কখনও ফুলের মতো ফোটাতে পারতো।

    আমার বাবার জীবনে আমার মার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা যদি না সামাল দিতেন, তবে বাবার চাকরি যাবার পরে আমরা খড়কুটোর মতো ভেসে যেতাম। তখন সংসারে আমাদের আর্থিক টান, আমি তখন স্কুলে পড়ি। বাবা মনের দিক থেকেও ভেঙে পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাবাকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছিল। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারত না। ওই সাংঘাতিক বেদনার থেকেই 'হারবার্ট' এর জন্ম। বাবা লিখছে, হাউ হাউ করে কাঁদছে। এর থেকে একটা জিনিস আমি বুঝেছি। ভালো কোন কাজ নিরাপদ অবস্থান, আরাম ও মনের শান্তির থেকে আসেনা।

    ওসব ভাত-ঘুমের সাহিত্যচর্চা করা বাবার কাজ ছিল না। বাবা যেসব লেখকদের কদর করতেন, তারাও সেরকম সাহিত্যে বিশ্বাসী ছিলেন না। যে বই শেষ করে পাঠক নিশ্চিন্ত মনে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, তার মলাটে তাই বাবার নাম কখনও দেখা যায়নি।

    বাবা এই সিস্টেমের অংশীদার হিসেবে নিজেকে কখনও দেখেনি। রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক মহল থেকে একাধিকবার সমঝোতার বার্তা এসেছে। সেগুলো বাবা কাউকে বলতও না। যে সিস্টেমে তার কোন বিশ্বাস ছিল না, তার থেকে কিছু পাওয়ার আশা বা নেওয়ার ইচ্ছে বাবার ছিল না। বাবা তাই শুধু সেই সিস্টেম বা তার দমন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কলম ধরেনি, তার লেখার মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলেছিল এক "alternative reality" যেখানে লাথি-ঝাঁটা খাওয়া মানুষরা শুধু রুখে দাঁড়াতেই পারে না, বরং সিস্টেম এবং তার অংশীদারদের খলখলে করেও ছেড়ে দিতে পারে। এই স্বপ্ন চিরন্তন। এই স্বপ্ন ইতিহাসের পর্যায়ে পর্যায়ে ফিরে এসেছে। নবারুণ ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে এই স্বপ্ন শেষ হবে না। তাই বাবা বেঁচে থাকবে। যতদিন সমাজের 'কেউ না রা' তাদের মর্যাদার লড়াই জারি রাখবে, বাবার লেখাও ততদিন থাকবে।



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ "দ্য হিন্দু" থেকে
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments