আকাশবাণীর 'ছায়াছবির গান' শুনতে শুনতে একটা খুশির গান কানে এল: 'হঠাৎ ভীষণ ভালো লাগছে/মনে হয় উড়ে যাই, দূরে দূরে যাই'। ভীষণ ভালো, ভীষণ সুন্দর, ভীষণ আনন্দ আমরা অহরহই ব্যবহার করে থাকি দারুণ কিংবা খুব বোঝাতে। কিন্তু ভীষণ শব্দটির মূল অর্থ হল — ভয়ঙ্কর, ভীতিজনক। রামায়ণের বিভীষণ নাম এই অর্থই বহন করছে। রবীন্দ্রনাথের গানে পাচ্ছি 'ভীষণ আমার, রুদ্র আমার/নিদ্রা গেল ক্ষুদ্র আমার'। তাঁর 'বর্ষশেষ' কবিতায় 'যে পথে অনন্ত লোকে চলিয়াছে ভীষণ নীরবে'ও এই ভয়ঙ্কর ভাবের দ্যোতনা আছে। নতুন প্রজন্মের মুখে শোনা যাচ্ছে 'বীভৎস সুন্দর'। সেখানেও বীভৎস তার আদি অর্থ হারিয়েছে। তেমনি, অপরূপ শব্দটি আমরা ব্যবহার করি সুন্দর বোঝাতে। কিন্তু এর মূল অর্থ হল অপকৃষ্ট রূপ অর্থাৎ কুরূপ, কুৎসিত চেহারা। অথর্ববেদে এই অর্থে শব্দটির ব্যবহার আছে। সেরকম আর একটি শব্দ কাপুরুষ, যার মূল অর্থ কুদর্শন পুরুষ, অথচ ব্যবহৃত হয় সাহসহীন দুর্বল ব্যক্তি বোঝাতে।
শব্দের মূল অর্থ বলতে বোঝায় তার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বা প্রকৃতি প্রত্যয়াদি থেকে লব্ধ অর্থ। যেমন, সংস্কৃত অদ্ (খাওয়া) ধাতুতে ক্ত প্রত্যয় যোগে এসেছে অন্ন শব্দটি। অতএব এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল 'যা খাদিত হয়', অর্থাৎ যে-কোনো খাদ্যবস্তু। কিন্তু অর্থসংকোচের ফলে অন্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশেষ খাদ্যবস্তু ভাত। তনয় শব্দ এসেছে সংস্কৃত তন্ (বিস্তার করা) ধাতুতে অয়্ প্রত্যয় যোগ করে। এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'যে (বংশ) বিস্তার করে', অর্থাৎ পুত্র পৌত্রাদি সকল উত্তরপুরুষ। এক্ষেত্রেও অর্থসংকোচ ঘটে তনয় হয়েছে শুধুমাত্র পুত্র। আবার, তন্ ধাতুতে ক্ত প্রত্যয়যোগে হয় তাত, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ 'যিনি নিজেকে (পুত্ররূপে) বিস্তার করেন, 'অর্থাৎ পিতা। কিন্তু পিতৃতুল্য যে-কোনো গুরুজনই 'তাত' সম্বোধিত হতে পারেন। মধুসূদনের মেঘনাদ বিভীষণকে ভর্ৎসনা করে বলছেন: 'হায় তাত! উচিত কি তব এ কাজ?' এক্ষেত্রে তাত শব্দটির ঘটেছে অর্থ সম্প্রসারণ বা অর্থবিস্তার। পূর্বে উল্লিখিত ভীষণ ও কাপুরুষ শব্দ দুটি মূল অর্থ থেকে সরে এসেছে সম্পূর্ণ অন্য কিছু অর্থ প্রকাশ করতে। ভাষাতত্ত্বের ভাষায় এর নাম অর্থ সংশ্লেষ। অপরূপের ক্ষেত্রে অর্থের উন্নতি ঘটেছে। অর্থের অবনয়নও হয়ে থাকে অনেক সময়। গণ্ড শব্দের এক অর্থ বৃহৎ বা প্রধান। গণ্ডগ্রাম শব্দের মূল অর্থ তাই হওয়া উচিত বৃহৎ বা সমৃদ্ধ গ্রাম। এক্ষেত্রে অর্থের অবনতি ঘটে অর্থ দাঁড়িয়েছে শহরাঞ্চল থেকে দূরে অবস্থিত ছোট্ট গ্রাম, যাকে বলা হয় অজ পাড়াগাঁ। কিন্তু উল্লেখ্য, 'অজ' কথাটাও এসেছে 'আদ্য' থেকে, যার অর্থ আদি বা প্রথম।
অর্থসংকোচ বা অর্থপ্রসারণ, অর্থোন্নতি বা অর্থাবনয়ন, কিংবা অর্থসংশ্লেষ যাই হোক না কেন, মূল অর্থ থেকে সরে এসেছে এমনকী বিপরীত অর্থবাহী হয়ে পড়েছে বাংলাভাষার বহু শব্দ। সব ভাষাতেই এটা হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যেতে পারে অসুর শব্দটিকে। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলে প্রাণপ্রদ শ্রেষ্ঠ দেবতা সূর্যকে 'অসুর' বলা হয়েছে। পারস্যীয় জেন্দ্ অবেস্তায়ও 'অহুর' (অসুর>অহুর) শব্দের অর্থ 'জীবনের অধিষ্ঠাতা দেবতা'। কিন্তু ঋগ্বেদেরই দশম মণ্ডলে অসুর দেবদ্বেষী বলে আখ্যাত হয়েছে, এবং অ-কারের নঞর্থ ধরে অসুর হয়ে দাঁড়িয়েছে দেবশত্রু। ভাষাবিদ্রা তাই বলেন শব্দের কোনো বাঁধাধরা নির্দিষ্ট অর্থ নেই। অনেক শব্দেরই একাধিক অর্থ হয়ে থাকে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে অনেক শব্দের অর্থের রূপান্তর ঘটে যায়। বেদে 'উষ্ট্র' শব্দের অর্থ ছিল বুনো মোষ। কালক্রমে তা থেকে বুনো ষাঁড়, এবং পরবর্তীকালে উট। অথর্ববেদে 'কিশোর' শব্দটির অর্থ ছিল অশ্বশাবক, পরবর্তীকালে হয়ে দাঁড়িয়েছে নবযুবা। অন্য ভাষা থেকে আগত বহু শব্দ, তা' সে সংস্কৃত থেকে হোক বা আরবি-ফারসি থেকে হোক, বাংলায় ভিন্ন অর্থবাহী হয়ে পড়েছে। শব্দার্থের এই বিকিরণ বা বিচিত্রগামিতার উৎস সন্ধান ও ব্যাখ্যা নিয়ে গড়ে উঠেছে ভাষাবিজ্ঞানের বাগর্থতত্ত্ব (Semantics) শাখা।
বাগর্থতত্ত্বের এই যৎকিঞ্চিৎ ভূমিকাকে আশ্রয় করে আমাদের অতি পরিচিত কিছু শব্দের বিপথমুখিতার অনুধাবনে প্রবৃত্ত হওয়া যাক। শুরু হোক অনুধাবন শব্দটি নিয়েই। মূল অর্থ পশ্চাৎধাবনকে পশ্চাতে ফেলে অনুধাবন বোঝায় নির্ধারণ বা মনোনিবেশ। অর্থসংশ্লেষের এ-এক উদাহরণ। অর্থসংশ্লেষের অনেক উদাহরণের থেকে আরও কয়েকটা তুলে আনা যাক। 'অনর্থ কী বকছ?' বললে অনর্থের অর্থহীনতা প্রকাশ পায়, কিন্তু 'সে এক অনর্থ বাধিয়ে বসেছে' বললে অনর্থের অর্থ হয়ে যায় আপদ বা বিপত্তি। 'আত্মসাৎ-এর মূল অর্থ আত্মবশ। চৈতন্যভাগবতে আছে: 'ভক্তি দিয়া জীবে প্রভু কর আত্মসাৎ'। বর্তমানে আত্মসাৎ বলতে বোঝায় অন্যায়ভাবে অপরের ধনসম্পত্তি অধিকার। উত্যক্তের বুৎপত্তিগত অর্থ পরিত্যক্ত বা পরিবর্জিত, সমকালীন ব্যবহারে বিরক্ত বা জ্বালাতন। কবিকুলের রাজা ইত্যর্থে চৈতন্য চরিতামৃতের কবি কৃষ্ণদাস বিভূষিত হয়েছিলেন 'কবিরাজ' উপাধিতে, কিন্তু তাবৎ কবিরাজ নেহাতই আয়ুর্বেদীয় চিকিৎসককুল। 'উৎকণ্ঠ আমার লাগি যদি কেহ প্রতীক্ষিয়া থাকে/সেই ধন্য করিবে আমাকে' লেখার সময় 'শেষের কবিতা'র লাবণ্য শোভনলালের উন্নত বা ঊর্ধ্বগত গ্রীবার কথা ভাবে নি, ভেবেছিল উদ্বিগ্ন দয়িতের কথা। উদ্গ্রীব বললে তার ব্যঞ্জনা এই একই হতো।
উদাহরণ এসেই যাচ্ছে। আমরা চক্রান্তের শিকার হই, ভয়ে তটস্থ হই, সতর্ক হই, কিন্তু সোচ্চার হতে পারি না বেশির ভাগ সময়। ভেবে দেখেছি কি চক্রান্ত তটস্থ সতর্ক বা সোচ্চারের মূল অর্থ কী? চক্রান্ত হল চক্রের শেষভাগ, তটস্থ মানে নদীকূলবর্তী, সতর্ক হল তর্কযুক্ত, আর সোচ্চারের মূল অর্থ সশব্দ বমন। বিষম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল — অসম, সমত্বহীন। 'আমরা' কবিতায় সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন: 'বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়াছে বিয়া'। তবে বিষমের প্রচলিত অর্থ দারুণ, অতিশয়। 'তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া' (রবীন্দ্রনাথ)। আবার, খাওয়ার সময় গলায় খাদ্য আটকে হাঁসফাঁস অবস্থাকে বলা হয় 'বিষমলাগা'। নামটা এসেছে সম্ভবত তৎকালীন কষ্টের প্রবলতার অনুষঙ্গে। অর্থসংশ্লেষে ইতি টানা যাক মিষ্টি এক উদাহরণ দিয়ে। ছানা চিনি থেকে নয়, সম্-পূর্বক দিশ্ ধাতুতে ঘঞ্ প্রত্যয়ে সন্দেশের উৎপত্তি, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সম্যকরূপে দিক্নির্দেশ বা সঠিক বিষয় জ্ঞাপন। একসময় আত্মীয়স্বজনের খবরাখবর দেওয়ানেওয়ার জন্যে লোক পাঠানো হতো। খালি হাতে পাঠানো অভদ্রতা বলে সঙ্গে মিষ্টি খাবার। কালক্রমে সেই যে-কোনো মিষ্টি খাবার, পরবর্তীকালে এক বিশেষ মিষ্টি খাবারই সন্দেশ হয়ে দাঁড়াল।
এবারে আসা যাক কিছু অর্থসম্প্রসারণ আর অর্থসংকোচের উদাহরণে। তাত, তনয়, অন্ন আগেই উল্লিখিত হয়েছে। কদর্য বলতে আমরা বুঝি কুৎসিত — কদর্য চেহারা, কদর্য অঙ্গভঙ্গি, কদর্য কথাবার্তা ইত্যাদি। সংস্কৃতে কু মানে কুৎসিত, এবং অর্য মানে স্বামী। সুতরাং কদর্য শব্দটির অর্থ ছিল কুৎসিত স্বামী, অর্থাৎ স্ত্রীপুত্রকন্যা নিপীড়নকারী অথবা দায়িত্বজ্ঞানহীন স্বামী। স্বামীর গণ্ডী ছাড়িয়ে শব্দটির বিস্তারলাভ ঘটেছে অন্যান্য ক্ষেত্রে। আর এক উদাহরণ — গবেষণা, যা এসেছে গো+এষণা থেকে; অর্থাৎ কিনা গোরু খোঁজা। গোরু না-খুঁজে গবেষণা এখন নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্যে খোঁজ, হয়তো প্রয়োজনীয় প্রয়াস দুক্ষেত্রেই প্রায় সমপর্যায়ের বলে।
সরকারী পূর্ত বিভাগ নামটির সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট পরিচয় আছে। পূর্ত কথাটার মানে কী? পূর্ (পূরণ করা)+ ক্ত প্রত্যয়ে এসেছে পূর্ত, যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পূরিত বা পূর্ণ। সংস্কৃতে শব্দটির অর্থ জনহিতার্থে জলশয়াদি খনন। এই বিশেষ কাজ ছাড়াও পূর্ত বিভাগের কর্মকাণ্ডের মধ্যে পড়ে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ। পূর্ত কথাটির অর্থের বিস্তার লাভ ঘটেছে। পঙ্কে যা জন্মায় তা-ই পঙ্কজ হওয়া উচিত। তার পরিবর্তে পঙ্কজ হল পদ্মফুল। যোগরূঢ় শব্দ নামে অভিহিত হলেও এটি অর্থসংকোচনের এক উদাহরণ। আহার শব্দটি এসেছে আ-পূর্বক হৃ ধাতুতে ঘঞ্ প্রত্যয় থেকে — যার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ আহরণ, সংগ্রহ বা সঞ্চয়। মন, বুদ্ধি আর ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যা-কিছু ভিতরে আসে বা সংগৃহীত হয় তা-ই আহার। অর্থসংকোচে আহারের অর্থ দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র খাদ্যগ্রহণ বা ভোজন। সুকুমার রায় অবশ্য আহারে বসিয়ে যে সব খাদ্য পরিবেশন করেছেন সেগুলো আহারের মূল সংজ্ঞাকে ছাপিয়ে গেছে।
অর্থোন্নতি আর অর্থাবনতি? 'ইতিকথা'র মূল অর্থ নিরর্থক কথন, অর্থশূন্য বাক্য। পরিবর্তিত অর্থ কাল্পনিক কথা। তা' থেকে পূর্বকথা, ইতিহাস। অর্থের উন্নতি ঘটেছে। 'মন্দির' আর এক উদাহরণ। শব্দটির মূল অর্থ ছিল গৃহভবন। 'এ ভরা বাদর/মাহ ভাদর/শূন্য মন্দির মোর' (বিদ্যাপতি)। অর্থোন্নতিতে মন্দির বলতে এখন বোঝায় শুধুমাত্র দেবগৃহ বা দেবালয়। অর্থাবনতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ মহাজন। মহাজন শব্দের বাচ্যার্থ মহৎ ব্যক্তি। বৈষ্ণব পদকর্তারা মহাজন বলে স্বীকৃত। এখন মহাজন বলতে বোঝায় সুদখোর ব্যাপারী। 'জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়' (নজরুল)। 'মুনিস' কথাটা এসেছে মানুষ থেকে, অথচ তার উদ্দিষ্ট খেটে-খাওয়া নিচুতলার মানুষ। অবশ্যই অর্থাবনতি। সংস্কৃতে ভণ্ড হল যে লঘু পরিহাস করে, বাংলায় ভাঁড়। তবে বাংলায় যখন কপট অর্থে ভণ্ড ব্যবহৃত হয় তখন তা' অর্থাবনতি। পচন বলতে আমরা বুঝি গলন, বীজদূষণ। অথচ সংস্কৃত পচ্ ধাতু উদ্ভূত শব্দটির মূল অর্থ রন্ধন, পাক। শুনলে অবাক লাগবে সংস্কৃতে পচা শব্দের অর্থ ছিল রাঁধুনি বা রন্ধনকর্ত্রী। বাংলায় এই শব্দগুলির অর্থবিকৃতি বা অর্থবিপর্যয় ঘটেছে।
এতাবধি আলোচনায় স্থান পেয়েছে সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় আগত অজস্র শব্দাবলির কয়েকটি। কিন্তু বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে রয়েছে অজস্র আরবি-পারসি থেকে আগত শব্দ, অন্যান্য বিদেশি শব্দ, আর অজস্র অনার্য দেশি শব্দ যেগুলোর উৎস মূলত সাঁওতালি, মুণ্ডারি আর দ্রাবিড় ভাষাসমূহ। বাংলা ভাষায় এই সব শব্দের আত্মীকরণ ঘটেছে কখনও অবিকল অবস্থায়, কখনও বা কিছুটা পরিবর্তিত রূপে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বিশেষত আরবি-ফারসি শব্দের ক্ষেত্রে, অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে বিপুলভাবে; এমন কী সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থবাহী হয়ে। এগুলোরই কয়েকটা উদাহরণের অবতারণা করা যাচ্ছে পরবর্তী আলোচনায়। পাঠকরাই স্থির করবেন কোথায় ঘটেছে অর্থসংশ্লেষ, অর্থবিস্তার, অর্থসংকোচন, অর্থোন্নতি, অর্থাবনতি বা অর্থবিকৃতি।
আজগুবি — ফারসি 'আজ'-এর সঙ্গে আরবি ঘঈ বী'- যুক্ত হয়ে শব্দটি সৃষ্ট। ঘঈবীর অর্থ স্বর্গীয়। স্বর্গীয় মানেই অভিনব। তা' থেকে অবাস্তব বা অদ্ভুত।
আদায় — আরবি 'অদা' থেকে, যার অর্থ সম্পাদন বা সাধন। 'নমাজ আদা করা'। বাংলায় পরিবর্তিত অর্থে উসুল বা সংগ্রহ — চাঁদা আদায়, কর আদায়।
আমলা — আরবি 'আমিল' থেকে, (অর্থ রাজস্ব আদায়কারী)। বাংলায় বোঝায় যে-কোনো উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী।
আসবাব — আরবিতে 'আসবাব'-এর অর্থ কারণ সমূহ। তা' থেকে জিনিস সমূহ। তা' থেকে গৃহসজ্জার সামগ্রী।
ইলাহি/এলাহি — আরবি শব্দের মূল অর্থ ঈশ্বর বা ঈশ্বর সম্বন্ধীয়। বাংলায় বড়ো রকমের কিছু — এলাহি ব্যাপার, এলাহি খরচ। এলেম — আরবি 'ইল্ম্' থেকে। মূল অর্থ জ্ঞান বা বিদ্যা। বাংলায় পরিবর্তিত অর্থ দক্ষতা বা ক্ষমতা।
কারসাজি — ফারসি 'কারসাজ' শব্দের অর্থ ভাঙাগড়ার নিয়ামক অর্থাৎ ঈশ্বর; কারসাজি হল সৃষ্টিকর্তার কাজ। বাংলায় শব্দটি ব্যবহৃত হয় চতুরতা বা জুয়াচুরি অর্থে।
ক্যাবলা — বাংলায় বোকা বা হাবাগোবা অর্থে ব্যবহৃত শব্দটির উৎস আরবির 'ক্কাবিল' শব্দ - যার অর্থ সমর্থ, নিপুণ, পণ্ডিত।
খুন — ফারসিতে 'খুন' মানে রক্ত। 'বাঙালির খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর' - নজরুল। রক্ত অর্থে লিখলেও বাংলায় প্রচলিত অর্থ হত্যা।
খুব — ফারসিতে 'খূব্'-এর অর্থ ভালো, সুন্দর - খূব সূরত, বহুৎ খূব। বাংলায় অর্থ বদলে হয়েছে বেশি, অত্যন্ত। 'খুব, ভালো' বলা হয় অনায়াসে।
গুলজার — 'নরক গুলজার' বলতে বোঝায় একদল অভব্য লোকের কোলাহলপূর্ণ আসর। ফারসি 'গুলজার' শব্দটির অর্থ কিন্তু ফুলের বাগান। বাংলায় ব্যবহারটি অবশ্য বিদ্রূপাত্মক।
গোলাপ — আমাদের প্রিয় ফুল গোলাপ ফারসিতে 'গুল্'। গুল+আব (জল), ফারসির 'গুলাব', হল গোলাপজল।
চাঁদা — ফারসি 'চন্দহ্'-এর অর্থ সামান্য, অল্পস্বল্প। বাংলায় হয়েছে জনগণের কাছ থেকে তোলা অর্থ - স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়।
জাঁহাবাজ — ফারসি জহান্ (বিশ্ব)+ বাজ (জ্ঞানী), অর্থাৎ বিশ্বজ্ঞানী, মহাপণ্ডিত। বাংলায় বোঝায় ধড়িবাজ, মতলববাজ।
তামাশা — ফারসি 'তমাশহ্' থেকে, অর্থ - দৃশ্য বা প্রদর্শনী। অর্থ পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় মজা, কৌতুক, রগড়, ঠাট্টা।
দরদ — ফারসি 'দর্দ্' শব্দের অর্থ ব্যথা, বেদনা, পীড়া। বাংলায় দরদ বলতে বোঝায় সমবেদনা, সহানুভূতি, করুণা।
নাকাল — আরবিতে 'নকাল্' মানে শাস্তি। বাংলায় নাকাল বলতে বুঝি হয়রান, জব্দ, অপদস্থ।
ফক্কড় — আরবি 'ফিক্কর্হ' থেকে, যার অর্থ প্রতারক, ধূর্ত। বাংলায় অর্থ দাঁড়িয়েছে বাচাল, ছ্যাবলা।
ফাজিল — আরবি 'ফাজ্বিল' শব্দের অর্থ বিদ্বান, পণ্ডিত। তার থেকে উদ্ভূত বাংলায় ফাজিল বলতে বোঝায় বাচাল বা বখাটে।
বরাবর — ফারসিতে 'বরাবর' শব্দের অর্থ সমান, তুল্য। হিন্দিতেও তাই। বাংলায় ব্যবহৃত হয় 'সর্বদা' বোঝাতে (এটা বরাবর ঘটে আসছে), অথবা 'সামনের দিকে' বোঝাতে (নাক বরাবর যাওয়া)।
বাদা — মূলে আরবি শব্দ 'বাদিয়হ' যার অর্থ মরুভূমি। বাংলায় বাদা হয়ে গেছে জলাভূমি।
বুজরুক — ফারসি 'বুজুর্গ' শব্দ থেকে বাংলায় বুজরুক। বুজুর্গ শব্দের অর্থ মহৎ বা সাধু ব্যক্তি। বাংলায় বোঝায় পাণ্ডিত্যের ভানকারী, প্রতারক, ঠগ।
ভিস্তি — ফারসি 'বিহিশ্তী' থেকে, যার অর্থ স্বর্গীয় বা পরম পবিত্র কাজ। বাংলায় আসার পরে শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে জলবাহক। 'মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি' (জুতা আবিষ্কার - রবীন্দ্রনাথ)। চর্মনির্মিত জলাধারটিকে (মশক) ভিস্তি বলা হয়।
মস্ত — ফারসি 'মস্ত্' হল মত্ত, মাতাল। বাংলায় বোঝায় বিরাট বা বিশাল।
মিছিল — আরবি 'মিছ্ল্' থেকে ফারসিতে 'মিস্ল', বাংলায় হয়েছে মিছিল। মূল অর্থ ছিল মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত নথিপত্রাদি।
শায়েস্তা — বাংলায় এর অর্থ জব্দ। কিন্তু মূল ফারসি 'শাইস্তহ্' শব্দের অর্থ শিষ্ট, শিক্ষাপ্রাপ্ত, শোভন। বাংলার এককালীন নবাব কারও কাছে জব্দ হয়ে শায়েস্তা খাঁ নাম পাননি সেটা বোঝা যাচ্ছে।
সোফা — গদি-আঁটা লম্বা চেয়ারের সোফা নামের উৎস আরবির 'সফ্ফাঃহ', যাতে বোঝায় বসবার জন্যে চওড়া শান-বাঁধানো জায়গা।
শেষ করা যাক ইংরেজি দিয়ে। ইংরেজি থেকে আগত শব্দ বাংলায় প্রচুর, যারা প্রায় হুবহু ব্যবহৃত হয়, যেমন — টেবিল, চেয়ার, স্কুল, কলেজ, ব্যাংক, রেল, রেডিয়ো ইত্যাদি। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকটির রূপ আর অর্থের পরিবর্তন ঘটেছে। গার্ড (Guard) শব্দের বিকৃত রূপ গারদ। মূল অর্থ পাহারাদার বা পাহারা দেওয়া। অর্থ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রহরাধীন কক্ষ বা বাড়ি। জাঁদরেল শব্দটির উৎস শনাক্ত করা কঠিন। এটি এসেছে জেনারেল (General) থেকে। জেনারেল সেনাবিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ভাষান্তরিত হয়ে তার অর্থ হল জবরদস্ৎ মেজাজি ব্যক্তি। প্রযুক্তি আর কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত বর্তমান যুগে আরও অনেক ইংরেজি শব্দ আমরা হুবহু ব্যবহার করছি আমাদের কথাবার্তায় আর লিখিত বিবরণে। এই নবাগত শব্দদের মধ্যে মাউস (mouse) এক বিশিষ্ট উদাহরণ। ওয়াকিফহাল সকলেই বুঝতে পারেন এটি কমপিউটার ব্যবহারের এক অপরিহার্য সরঞ্জাম - ইঁদুর নয়।
গ্রন্থ সহায়তা :
বাগর্থ অভিধান - বিমলেন্দু দাম, যোগমায়া প্রকাশনী, কলকাতা, ১৪২০ বঙ্গাব্দ