বনে জঙ্গলে বাঘ দেখার ইচ্ছা আমার বহুদিনের। একবার করবেট জঙ্গলের নিষিদ্ধ 'কোর' এলাকায় ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে রাস্তা হারিয়ে নদী নালা পাহাড়ে ঠোক্কর খেতে খেতে আট ঘন্টার পর বেরুবার রাস্তা খুঁজে পেয়েছিলাম। সেখানেও অনেক সময় মনে হয়েছিল বাঘ হয়তো রাস্তার পাশেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু ঐ পর্যন্ত্ই। সাক্ষাৎ দর্শনের সৌভাগ্য হয়নি।
|
তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। আমি অন্যান্য জঙ্গলে গণ্ডার, সিংহ, হাতি, ভালুক ইত্যাদি অনেক দেখেছি, কিন্তু বাঘ দেখা এ-পর্যন্ত হয়নি। এদিকে বাঘেদের সংখ্যা বিপজ্জনকভাবে কমে যাচ্ছে। এভাবে চললে চিড়িয়াখানা ও সার্কাস ছাড়া কোত্থাও আর বাঘ দেখা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে মধ্যপ্রদেশে কান্হা-বান্ধবগড়-পেঞ্চ এলাকাতেই সবথেকে বেশি সংখ্যায় বাঘ এখনও দেখা যায়। গরমের সময়েই নাকি দেখার সুবিধা, তখন জল খেতে দলে দলে সবাই বেরিয়ে আসে। কিন্তু আমাদের নরম শরীরে আবার গরম সয় না। তাই শীতেই যাওয়া ঠিক করলাম। কিন্তু গড়িমসি করে আগে থেকে রিজার্ভেশন করিনি। জানতাম না ভারতীয়রা এত প্রকৃতিবিলাসী হয়ে উঠেছেন। বুক করতে গিয়ে দেখি "ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই"--কান্হা, বান্ধবগড় এমনকি পেঞ্চেও সব ভর্তি।
একজন প্রকৃতিবিদের পরামর্শে তাডোবা বলে একটা জায়গায় শেষ চেষ্টা করলাম। অবশেষে ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। এর আগে কখনও জায়গাটার নামও শুনিনি। গুগুল্ দেবীর কল্যাণে জানলাম পুরো নাম তাডোবা-আন্ধেরী ব্যাঘ্র প্রকল্প (Tndoba-Andheri Tiger Project)। ঠিক কান্হা পেঞ্চের প্রতিবেশী দক্ষিণপূর্ব মহারাষ্ট্রের এলাকায়। ওখানকার রুক্ষ জঙ্গলই বাঘেদের পছন্দ। এরা সুন্দরবনের পশু নয়। তাডোবা রিজার্ভ অন্যান্য জায়গার তুলনায় নতুন। ১৯৯৫ সালে এর প্রতিষ্ঠা। ভারতের একচল্লিশ-তম প্রকল্প, আয়তনে মহারাষ্ট্রের সবথেকে বড় পার্ক। প্লেনে নাগপুর থেকে দু-তিন ঘন্টার রাস্তা। পরিসংখ্যান মতে এইখানেই ইদানীং সবথেকে বেশি বাঘের সমাবেশ।
আন্ধারী নদী এঁকে বেঁকে চলে গেছে পার্কের মধ্য দিয়ে। নদীর আশেপাশে স্থানীয় গোঁদ আদিবাসীদের গ্রাম। ওদের পূজ্য দেওতা তাডু। তিনি নাকি বাঘের মুখে মারা পড়েন। তাঁর নামে একটা ছোট্ট মন্দিরও আছে। শীতকালে মেলা টেলাও বসে সেখানে।
|
ভারতবর্ষের ম্যাপের ঠিক মধ্যবিন্দুতে এই পার্ক। বিন্ধ্য পর্বতমালার একটি শাখা চিনুর পাহাড়ের কোলে এর অবস্থান। জঙ্গলে আছে প্রচুর টিক, অর্জুন, আঁই, বহেড়া, মহুয়া, পলাশ ইত্যাদি।
|
আর আছে ঘন বাঁশের ঝাড়। 'কোর' এলাকায় ৪৩টি বাঘ ও আশেপাশের এলাকা মিলিয়ে আশি-পঁচাশির মত সংখ্যা। অন্যান্য রিজার্ভের তুলনায় এখানে এরা বেশ সুরক্ষিত।
|
চারিদিকে প্রচুর মুখরোচক খাবার — সম্বর, চিতল, নিলগাই, স্পটেড হরিণ, বার্কিং হরিণ ইত্যাদি। এছাড়াও আছে গওর (বুনো মোষ), হায়েনা, স্লথ, ভালুক, ঢোল (বন্য কুকুর), বাঁদর, লঙ্গুর, বেজী ও নানারকম সাপ। কেউটে, গোখরো তো আছেই, অবশ্য শীতকালে এদের দেখা মেলেনা। লেক ও নদীর জলে আছে কুমীর ও কচ্ছপ। আকাশে ওড়ে প্রায় দু'শো রকম স্থায়ী ও পরিযায়ী পাখির দল। ফিশ ইগল, সার্পেন্ট ইগল, হক ইগল, ময়ূর ইত্যাদি।
|
আদিবাসী গ্রামগুলি বাইরে থেকে দেখে বেশ বর্ধিষ্ণু মনে হয়। অনেক বাড়িই পাকা ও তাতে টিভি অ্যান্টেনা লাগানো। বাচ্চাদের স্কুলও আছে। জঙ্গলের গাইড, ড্রাইভার ও অন্যান্য কাজের লোকেরা সব এইসব গ্রামের বাসিন্দা। এইজন্যই পোচিং প্রায় নেই বলা যায়। কখনো সখনো আদিবাসীরা দু চারটে হরিণ মারে — খাওয়ার জন্য।
তা বলে বাঘেরা গ্রামে কখনো কখনো পোচিং করে বইকি। বাঘের চেয়েও বেশি দুষ্টু লেপার্ড। প্রায়ই গরুবাছুরের ওপর হামলা চালায়। কয়েকটা লেপার্ড ধরে খাঁচায় রাখা হয়েছিল। অন্য জায়গায় পাচার করার জন্যে।
|
পার্কে ঢোকার বন্দোবস্ত কড়া। গাইড ছাড়া ঢোকা মানা। পায়ে হেঁটে চলাও মানা। তিনটি গেট দিয়ে গুনে গুনে দর্শক ঢোকানো ও বের করা হয়। তাই আগাম রিজার্ভেশন ছাড়া এক পা-ও যাবার উপায় নেই। ঘুষ টুষ দিয়েও কোনো লাভ নেই। পোচিং আর ঘুষ, দুটোই নেই দেখে অবাক হয়েছিলাম আর খুব ভালোও লেগেছিল। আশা করি ভবিষ্যতেও এমনি থাকবে।
|
এইবার আমার কপাল ভালো ছিল। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল, দুই সাফারীতেই আমি বাঘের দেখা পেয়েছিলাম। আমার প্রথম দর্শন — হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে আছে, যেন জায়গাটা ওর নিজের বৈঠকখানা। আজকাল প্রত্যেক ড্রাইভার ও গাইডের পকেটে মোবিল ফোন। চটপট বার্তা ছড়িয়ে গেল অন্য সব গাইডদের গাড়িতে। দেখতে দেখতে দশ বারোটা জীপ বাঘটার দুপাশে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই ফটাফট ফোটো তুলতে ব্যস্ত। বাঘিনীর কোনো হেলদোল নেই। ধীরে সুস্থে, দু তিনটে হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে সে চলল উলটো দিকের মাঠে। মাঠে একদল হরিণ চরছিল। বোঝা গেল জলখাবারের সময় হয়েছে। যাবার সময় বাঘটি আমাদের জীপের এত কাছ দিয়ে গেল যে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যেত।
|
উলটো মাঠে, লম্বা ঘাসের মধ্যে প্রায় অদৃশ্য বাঘিনী বসেই রইল অনেকক্ষণ। আমরাও শিকার দেখার আশায় অপেক্ষমান। বেশ কিছু সময় পর সে উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে নিঃশব্দে এগুতে লাগল। কী অসীম ধৈর্য! একটা পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচুর মত। আমরাই অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম। তারপর কোন্ অজানা সুযোগ দেখে চোখের পলকে দৌড়।
|
উঁচু ঘাসের মধ্যে শুধু ল্যাজের ডগাই দেখা যাচ্ছিল। হরিণরাও চারিদিকে ছড়িয়ে দৌড় লাগিয়েছে। দু সেকেণ্ডে শিকার ও শিকারী দুই-ই ঘন জঙ্গলে অদৃশ্য। শিকার ধরবার দৃশ্য দেখার অতটা সৌভাগ্য ছিল না। ও সবের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকতে হয়।
|
দুপুর বেলা এক জোড়া বাঘ দেখলাম লেকের জলে গা ডুবিয়ে আরাম করছে। এরা জীপ গাড়ির তোয়াক্কা করে না মোটেই। তবে গাড়ি থেকে নামলে অবশ্য অন্য কথা।
কোর এলাকার বাইরেও বাঘ দেখেছি — আমাদের হোটেলের খুব কাছেই। সন্ধের আবছা অন্ধকারে হঠাৎ সরে গেল। সবাই বলল নিশ্চয়ই হায়েনা। বাইনকুলার দিয়ে দেখলাম হলুদ ডোরা কাটা। সেদিন আমরা কেউই হোটেলের বাইরে বেরুলাম না।
এত বাঘের ছড়াছড়ি সত্ত্বেও সাক্ষাৎ চোখে দেখা অনেকটাই ভাগ্যের ব্যাপার। অনেক জীপই বাঘের দৃশ্য মিস করে ফেলে। ফোনে ডাকাডাকি সত্ত্বেও, যতক্ষণে অকুস্থলে আসা, ব্যাঘ্রবাবাজী ততক্ষণে পাশের জঙ্গলে অদৃশ্য। লুকোনো বাঘের স্বভাব। খুব কাছে থাকা সত্ত্বেও হলুদ শুকনো ঘাসের সঙ্গে হলুদ ডোরা কাটা শরীর এমনভাবে মিশে যায় যে খুঁজে বার করে কার সাধ্য! আমাদের সঙ্গের গাড়িতেই অনেকে বারবার বাঘ মিস করে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। আমার মতে কোনো রকম আশা নিয়ে জঙ্গলে না যাওয়াই ভালো; তাহলে আর হতাশ হতে হয় না।
|
|
|
আমার অবশ্য সেদিক দিয়ে সুবিধা আছে। বাঘের দেখা না পেলেও আমি আশে পাশে অগুনতি পাখি দেখে আরামসে সময় কাটিয়ে দিই। তাই খুব একটা মনখারাপ হয় না।
|
|
পার্কের বাইরে কাছাকাছি দু তিনটি লজ বা হোটেল। আমরা ছিলাম সেরাই লজ (Serai) নামে একটি জায়গায়। ঘরের বদলে তাঁবুর ব্যবস্থা — দশ বারোটি তাঁবু পাকাপাকি ভাবে খাটানো — মাঝখানে একটু লন বাগান। তাঁবু হলেও সব আধুনিক সুবিধা আছে। সঙ্গে লাগানো বাথরুম, ইলেকট্রিক বাতি, পাখা, এয়ার কণ্ডিশন ইত্যাদি। চারপাশে খোলামেলা প্রকৃতি। দুবেলা রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থাও চমৎকার। ভোরে সাফারী যাত্রীদের জন্য প্যাকেটে জলখাবার - স্যাণ্ডুইচ বা পুরি তরকারী। (সঙ্গে কিন্তু চা বা কফি দেয় না - সেটা দিলে আরও ভালো হত)। দুপুরে বাসায় ফিরে নিরামিষ হালকা লাঞ্চ। রাতে জবরদস্ত ডিনার, আমিষ - একেক দিন একেকরকম পদ। একদিন এক বাঙালী গেস্টের তদারকে রাঁধুনীরা বেশ সর্ষে বাটা দিয়ে মাছের ঝোলও খাইয়েছিল।
দিনে দুটো করে ট্রিপ (ইচ্ছা হলে না গিয়ে লজে আরাম করাও যায়) — ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই যাত্রা। ফিরে আসতাম লাঞ্চের সময়। তারপর খাওয়া ও একটু আরাম করে চারটে নাগাদ আবার যাত্রা, ফেরৎ সন্ধের পর। জীপে বেশ আরামে ছ-সাতজন বসা যায়। রাস্তা কিন্তু কাঁচা, খানাখন্দর ও লাল মাটির ধুলোয় ভর্তি। খোলা জীপে একটুর মধ্যেই চুল, পোষাক ক্যামেরা সবকিছু ধুলোয় লাল হয়ে যায়। পরে ক্যামেরা ও মুখচোখে রুমাল বেঁধে নিয়েছিলাম।
> |
গাড়ী ও ড্রাইভার নির্দেশ মত হোটেল থেকেই তুলে নিত আমাদের। তারপর পার্কের গেটের কাছে নামধাম লিখিয়ে পয়সাকড়ি দিয়ে একজন গাইড সঙ্গে নিতে হত। প্রত্যেকবার আলাদা নতুন গাইড। এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ হয়নি। অন্যান্য পার্কে পুরো ট্রিপের জন্য একই গাইড বাঁধা থাকে। তাতে বেশ আলাপ পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তাডোবা গাইডরা সবাই ভাষায় সমান দক্ষ নন। ইংরাজী হিন্দী দুই-ই কাঁচা। কথাবার্তা বুঝে ওঠা মুশকিল। স্থানীয় গ্রামীণ মারাঠীতেই এদের সুবিধা। তবু এরা সবাই বনজঙ্গলের লোক। পার্কের সব কিছু এদের নখদর্পণে। তারা সবাই দর্শকদের অন্ততঃ একবার বাঘ দর্শন করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ট্যুরিস্ট সেই উদ্দেশেই আসেন। আমি অবশ্য পাখি নিয়ে ঘন্টার পর অলস ঘন্টা কাটাতে পারি। তাই বোধহয় আমার ভাগ্যেই বারবার বাঘের দর্শন হয়েছিল।
> |
তাই বলি, ঘুরে আসুন বনের বাঘ বনে দেখার এমন সুযোগ আর কোথাও পাবেন না।
> |