• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | গ্রম্থ-সমালোচনা
    Share
  • গ্রন্থ-সমালোচনা: আঠারো পর্ব, The Harappa Files, ইসলামি বাংলা সাহিত্য ও বাংলার পুঁথি, যম দত্তের ডায়ারী : ভবভূতি ভট্টাচার্য

    || আরে, এ’ যেন এক নয়া ছুটিখানি মহাভারত! ||

    আঠারো পর্ব; শামিম আহমেদ; সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা এল এল পি, বাগনান, জিলাঃ হাওড়া, পিনঃ ৭১১৩১২; ISBN 978-1-62590-034-0

    এ’হল ষোড়শ শতাব্দির প্রথমার্ধের কথা। গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের অমাত্য চট্টগ্রামপতি পরাগল খাঁ মহাভারতের কাহিনি শুনে অভিভূত হন! আদেশ দিলেন সভাকবি শ্রীকর নন্দীকেঃ বাঙলায় এ’ মহাকাব্য লিখতে হবে। পরাগল নিজে এ’ কাব্যের শেষ দেখে যেতে পারেননি। পুত্র ছুটি খান বাপের এই অভিলাষ পূর্ণ করান। সভাকবি পেলেন ‘কবীন্দ্র পরমেশ্বর’ উপাধি। অমর হয়ে রইল ‘ছুটিখানি মহাভারত’। কাশীরাম দাসের আবির্ভাবের প্রায় এক শতাব্দি পূর্বের কথা এ’।

    বৃদ্ধ শ্রীকর সম্পূর্ণ মহাভারতের অনুবাদ করতে সময় পাবেন না জেনে নবাব তাঁকে কেবল ‘অশ্বমেধ পর্ব’-টি ভিত্তি করেই অনুবাদের হুকুম দেন। আমাদের আজকের আলোচ্য গ্রন্থকার শামিম আহমেদের নবাব হুকুম দিয়েছেন মহাভারতের আঠেরোটি পর্বের কথা মাথায় রেখে আঠেরোটি স্বল্প-আলোচিত চরিত্রের গল্প শোনাতে, পয়ারে নয়, একবিংশ শতকের বাঙলা গদ্যে। এ’ মহাভারতে তাই ভীষ্ম-দুর্যোধন-শকুনি-অর্জুন নন, শিরোনাম পান ছন্দোদেব-শিখন্ডী-হিড়িম্বা-দেবিকা। আর, শামিমের নবাব যেহেতু শামিমের মনেই, তাই ‘একটি হাদিস ও মহাপ্রস্থান’ বা ‘শব মিলন’--- এমন অধ্যায় থাকতেও বাধা নেই।

    সবচেয়ে প্রথম প্রাপ্তি এই পরিকল্পনাটাই---মহাভারতের কয়েকটি স্বল্প-পরিচিত চরিত্র বেছে নিয়ে তাদের নিবিড় গল্প। মহাভারত যে শামিমের বিলক্ষণ পড়া আছে ছত্রে ছত্রে তার প্রকাশ পেয়েছে, নৈলে ঐ অনুপুঙ্খতা নিয়ে ‘দুঃশলা’ ‘তক্ষক’ বা ‘অশ্বত্থামা’-র মত অধ্যায়গুলি লেখা যায় না। ভীমপত্নী হিড়িম্বা তো পরিচিতা, কিন্তু যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবের পত্নীনাম (যথাক্রমে, দেবিকা-করেণুমতী-বিজয়া) জানতাম না; জেনে, অভিধান ঘেঁটে, শামিমের মুন্সিয়ানা মেনে নেওয়া গেল। রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে যুগে যুগে ভাষ্য তো কিছু কম লেখা হয়নি, আজও লেখা চলেছেঃ ‘মহাভারতে যৌনতা’ বা ‘ইসলাম ও মহাভারত’---এমন শীর্ষক রচনাও চোখে পড়েছে। এ’সবের মাঝে শামিম আহমেদের ‘আঠারো পর্ব’ পাকা জায়গা করে নেবে। নবীন লেখকের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি কামনা করি।

    ‘অশ্বত্থামা’ ও ‘দেবী হিড়িম্বা’ অধ্যায় দুটি সবচেয়ে মন কেড়েছে। ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ মধ্যগগনে থাকাকালীন অশ্বত্থামার যোদ্ধৃপ্রতিভা চাপা পড়ে ছিল। বিনাশকালের নিকটে এসে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠতে গিয়ে যে পথ তিনি নিলেন, এ’কালের গেরিলাযুদ্ধের নিরিখেও তাকে ঘৃণ্য মানতে হবে। তাই মস্তকে অনারোগ্য ক্ষত নিয়ে অমরত্বের আশীর্বাদ নয়, অমরত্বের অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি। চমৎকার এঁকেছেন শামিম অশ্বত্থামার বেদনা।

    কুন্তীদেবীর সবচে’ বড় বৌমা হলেন হিড়িম্বা, পুত্র ঘটোৎকচ তাই সর্বজ্যেষ্ঠ রাজকুমার। কিন্তু এ’ ম্যাগো, বৌ যে মাংসখেকো রাক্ষস! মা-বেটা তাই উচ্চ আর্যঘরে কখনই কল্কে পেলে না, বনে বনেই জীবন গেল। দ্রৌপদী ঘরে আসার পর থেকে ভীমও হিড়িম্বার প্রতি আকর্ষণ হারাল। ভারতের নিজস্ব আদিবাসী মানুষ, যাঁরা বিদেশী ধলা আর্যদের দাপটে জঙ্গলের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের ‘রাক্ষস’ নাম দিয়ে জনজীবনের মূলস্রোতের বাইরে ঠেলে দেওয়াটা সেই মহাকাব্যের কাল থেকেই শুরু হয়েছিল যে! চমৎকার ফুটিয়েছেন শামিম হিড়িম্বার মনোবেদনা। একই কুশীলব নিয়ে লেখা পরশুরামের ‘পুনর্মিলন’ গল্পটি মনে পড়ায়।

    এ’প্রসঙ্গে একটা মহা আপত্তির কথা বলতেই হয়, সেটা শামিমের লেখার ঢং-এ’, যেটা কোথাও কোথাও ভয়াবহভাবে প্রকট হয়ে পড়েছে--উদা:, “গণেশ লেখার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলেন। সঙ্গে তাঁর মাউস। গণেশ ভীষণ স্মার্ট। ব্যাসদেবকে বললেন, আমার টাইম ভীষণ শর্ট। তাড়াতাড়ি বাড়ি না ফিরলে বউ বড্ড ঝামেলা করবে.....” বা, “পরীক্ষিত বললেন, তাহলে মিস্টার স্যাটেলাইটকে খবর দিন। গণেশ তাঁর মাউস স্ক্রোল করে প্রথম পাতায় চলে গেলেন...”। কী সুধী পাঠিকা, বড্ড ছ্যাবলামির গন্ধ এসে যাচ্ছে না কী? কী বললেন? মহাভারতের গল্প মানেই গুরুগম্ভীর হতেই হবে? তা কে বলেছে? পরশুরাম কী ‘রেবতীর পতিলাভ’ বা ‘ধুস্তুরি মায়া’ লেখেননি? সাহিত্যমানে কত উচ্চে তাদের স্থান, ভাবুন তো? শামিম, চটক দিয়ে রূপচাঁদ পক্ষী হওয়া যায়, একটা ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লেখা যায় না। তার জন্য গভীরতা চাই।

    কয়েকটি প্রাসঙ্গিক আপত্তি এই ধরা থাকঃ ‘ঋষ্যশৃঙ্গ’ অধ্যায়টি এই কেতাবে স্থান পেল কী করে? কারণ দশরথের জামাই ঋষ্যশৃঙ্গ তো রামায়ণের চরিত্র, মহাভারতের নয়। ‘একটি হাদিস ও মহাপ্রস্থান’ অধ্যায়টি পুরো ট্যান গেছে। ব্লার্বে প্রকাশক লিখেছেন, ‘মহাভারত ভারতবর্ষের দ্বিতীয় মহাকাব্য’। এতো সহজে ‘দ্বিতীয়’ লিখে দিলেন? রোমিলা থাপার-হেন ঐতিহাসিক তো মহাভারতকে রামায়ণের চাইতেও প্রাচীনতর বলে মেনেছেন। ব্লার্বে এ’ও লেখা হয়েছে যে লেখক মহাভারতের একটি ‘তাত্ত্বিক মতাদর্শে বিশ্বাসী’ এবং তাকে ভিত্তি করেই বর্তমান গ্রন্থখানি রচনা করেছেন। আমরা কিন্তু আঠেরোটি লেখা পড়ে তাঁর এ’হেন কোনো ফল্গুবাহী মতাদর্শের হদিস পাইনি।

    তরুণ কবি ও চিত্রি রোহণ কুদ্দুস মশায় প্রকাশনা ব্যবসায়ে নেমে চিরাচরিত ‘প্রাঃ লিঃ কোং’ না খুলে ‘এল এল পি’ খুলেছেন দেখেই বেশ চমক লাগল। ঠিকানাও কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় নয়, বাগনান। এইখানেই দেখ আজকের প্রযুক্তির জয়, বাগনানের এক আনকোরা প্রকাশনালয় চমৎকার ছাপাই-বাঁধাই ও এক নয়া বাঙলা ফণ্টে কী প্রেজেন্টেব্‌ল বই নিয়ে এসেছেন, যেটা আমি উত্তর ভারতে বসে কিনলাম আমাজন ডট ইন থেকে। এটা ই-বুক ফর্মেও পাওয়া যায়! বেশ বেশ। এই তো চাই। ব্যবসায়-বুদ্ধি না থাকলে সাহিত্যরস অতি শীঘ্র শুকিয়ে যায় যে---‘বঙ্গদর্শন’ উঠে যাবার পর ঋষি বঙ্কিম এটা বুড়ো বয়সে বুঝেছিলেন। আর হুগলির যুবক রোহণদাদা ব্যাঙ্গালোরে বসে এখনই বেশ বুঝে নিয়েছেন। সাবাস।

    সব মিলিয়ে নতুন লেখক নতুন প্রকাশকের সওয়া শ’ পৃষ্ঠার কেতাবখানি ভাল লেগেছে। তার শুরু রোহণকৃত প্রচ্ছদটি থেকে। শামিমের শামিম (সুগন্ধ) আরও দূরতর বিস্তৃত হৌক---এই শুভেচ্ছা রইল।



    || উপেন্দ্রকিশোরীয় ধারার আধুনিক প্রতিনিধি---নাথ-ই যাঁর সার ||

    The Harappa Files—Sarnath Banerjee; Harper Collins Publishers, India; New Delhi; ISBN: 978-93-5029-031-6

    ‘ভালো লাগা’ বিষয়টা কি ছোঁয়াচে? নৈলে, কোনো শিল্পীর একটা কাজ মনে ধরে গেলে অন্যটাও সহজে ভালো লেগে যায় কেন, তাতে নৈর্ব্যক্তিকতা ক্ষুণ্ণ হলেও? মানে, বলতে চাইছি, সারনাথ ব্যানার্জির আগের ‘চিত্র-উপন্যাস’ (graphic novel) “বার্ন আউল......”-এর নালেঝোলে রিভিউ তো পরবাস৪৯-সংখ্যায় বেরিয়েছিল। দ্বিতীয় উপন্যাস “দ হরপ্পা ফাইলস”-এর কথা শোনাবার কথাও দেওয়া ছিল। এদ্দিন পরে ‘হরপ্পা’ পড়ে সেই ভালো লাগাটা বেড়ে গেল, নবীন শিল্পীর সামনে মাথা এলো ঝুঁকে ।

    ‘Graphic novel’-এর গেম-রুলটা কিন্তু অতি কঠিন। এ’ কমিক্‌স নয়, এতে ছবিই প্রাধান্য পায় না। কাহিনির বুনোটও অতি জোরালো হওয়া চাই, তা দিয়েই ছবিকে বেঁধে রাখা। সারনাথের দেখার ক্ষমতা কত্ত পাকা, চোখের এবং মনের, পাতায় পাতায় তার প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। সেই কারণেই উনি এক সার্থক চিত্র-ঔপন্যাসিক।

    যে কোনো শিল্পী তাঁর স্থানকাল দিয়ে বাঁধা। তিনি কী চোখে সেটাকে দেখেন ও তার প্রকাশ ঘটান কলমে বা তুলিতে বা ফিল্মে---সেটাই তাঁর জাত চেনায়। যেমন, ব্যঙ্গে ঊনবিংশ শতকের বাঙলাকে ঈশ্বর গুপ্ত একভাবে এঁকেছেন, টেকচাঁদ আরেকভাবে। সারনাথের স্টাইলটা অনেকটা আলালি। বেশ। একবিংশ শতকের এক বাঙালি যুবক আলালি চোখে দেশের সেই পুরনো সমস্যাগুলোকে দেখছেন, আঁকছেন, আর দুটোরই তলে তলে ফল্গুবাহি তীব্র ব্যঙ্গ বয়ে চলেছে। এটাই সারনাথের স্টাইল। এটাই মন কাড়ে। এতেই পুনর্জয়! আমলাতান্ত্রিক ফাঁস, জানিনা, হরপ্পার কালেও ছিল কিনা, কিন্তু এ’ উপন্যাসের টিকি হরপ্পাতে বেঁধে দিয়ে সারনাথ বস্তাপচা ধারণাবলী, ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা আর দৈনন্দিন জীবনের ক্লেদগ্লানির মতো আদি সমস্যাগুলো আঁকতে চেয়েছেনঃ ঢং টি মনকাড়া। Greater Harappa Rehabilitation, Reclamation & Redevelopment Commission (GHRRRC)-এর দুঁদে সেক্রেটারি শ্রীসুদর্শন মিত্তল, আই এ এস, তাঁকে সেই বরাতই দিয়েছেন যে!

    আর, এ’কাজেই সারনাথের মানুষ দেখা শুরু। তাতে যেমন কলের মিস্তিরি ভৃগু, আরকিওলজিস্ট রাখালদাস বা ভোজপুরি ঘিউ-ওয়ালা জগত বাহাদুর রয়েছেন, তেমনি আশি-নব্বুইয়ের দশকের জনপ্রিয় বুলওয়ার্কার-ভিক্কোবজ্রদন্তি-লাইফবয় সাবানও আছে। কী নস্ট্যালজিক! চমৎকার একেকটি অধ্যায়ের শিরোনামঃ Department of Surplus Emotion, City of Gates, Seven Samurais, থেকে Ho Chi Minh!

    হো চি মিন একবার তাঁর সাধের নুরটি কামিয়ে ফেলাতে সে চুলগুলো যেখানে পড়েছিল সে-মাটিতে ফাটল ধরে গিয়েছিল, জানতেন? বা জার রাশিয়ায় কসাকসভায় সুতোয় ঝোলানো এক খণ্ড চিনিকিউব ইনটার্ন চেটে চেটে নিয়ে চা-পানের আসর চলত? বা, চে গেভারা আফ্রিকায় নতুন বলিভিয়া খুঁজতে গেলে বন্ধু গামাল নাসের বলেছিলেন ‘আমাদের নতুন এক টারজনের দরকার নেই’? বটে! এই এই ঠেসগুলো ধরতে গেলে কেতাবখানি যে পড়তে হবে মামা, এই সমালোচকের অক্ষম কলমে আর কতটুকু?

    সারনাথ নিজের মূল যে উত্তর-কলকাতা থেকে উপড়ে ফেলতে পারেননি (বা, ফেলেননি) এবং তাঁর লেখায়-রেখায় বাঙালিজীবন যেমন পরতে পরতে জড়িয়ে আছে, সেটা অবাঙালি পাঠকের জন্য রসহানির কারণ ঘটাতে পারে (এ’ বইয়ের ভাষা ইংরিজি যে)---এ’ আশঙ্কা “বার্ন আউল...”-এর সমালোচনায় ধরা ছিল (পরবাস ৪৯)। “হরপ্পা”-তেও এ’ কলকাত্তাইয়া জীবন নিরবচ্ছিন্ন। পুনরায় ভাবি, এ’ কি লেখকের সীমাবদ্ধতা? তা কেন হবে? এ’ই তো জীবনে জীবন যোগ করা। যে স্থানকালপাত্র আমি চিনিজানি তা নিয়ে লিখবো না তো কী মঙ্গল গ্রহ নিয়ে লিখবো [রেফ. কুমারপ্রসাদ]? বেশ, বেশ, থাকুক, থাকুক। ফোড়নটা চেনা হলে ব্যান্ননের তারটা বাড়ে যে!

    হার্পার কলিন্সের প্রোডাকশন। খুঁত ধরার জো নেই। পৃষ্ঠচিত্রটি প্রচ্ছদের চেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে।

    কেবল, উৎসর্গপত্রটি ট্যান গেছে। জোড়াছেলের মায়েদের এখানে কী বিশেষ ভূমিকা, বুঝলুম না।

    দশে আট দেওয়া যাক্‌ হরপ্পাকে।



    || .. সে-অগাধ সাগরের নিপুণ মাল্লা---ইসলামি বাংলা ও ওসমান গনী ||

    ইসলামি বাংলা সাহিত্য ও বাংলার পুঁথি—ড. ওসমান গনী; প্রকাশনালয়ঃ ‘বুক্‌স্‌ ওয়ে’, কলকাতা-৭৩; ISBN: 978-93-80145-29-7

    গত সংখ্যায় বাঙলা নথি নিয়ে লিখতে গিয়ে, এ’সংক্রান্ত আরও কিছু জানতে-পড়তে ইচ্ছে হল। ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে, একে-ওকে শুধিয়ে, বেশ কয়েকটি বইয়ের সন্ধান পাওয়া গেল, তার মধ্যে এ’খানির কথা বলতে ইচ্ছে করছে। এই গ্রন্থে ইসলামি বাংলা সাহিত্যের কথা বলা হয়েছে, সে-প্রসঙ্গে এসেছে পুঁথির কথা। পশ্চিমবঙ্গে বসে আমাদের যে বাঙলাভাষা চর্চা চলে, সেটা অবশ্যই ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট। মুসলমান সাহিত্যিকগণ অন্যায্যভাবে এখানে উপেক্ষিত হন, উপেক্ষিত থেকে যান/গেছেন---এ’কথা আমরা আগেও বলেছি (উদা. পরবাস- ৫২ গ্রন্থ-সমালোচনা)। নৈলে, অসিত বন্দ্যো.র চালু ‘বাঙলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’-গ্রন্থে মুন্সী কায়কোবাদ বা ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মত কবির নামোল্লেখমাত্র থাকে না? নাম নেই এ’পারের জনপ্রিয় ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান’-এও। উপরন্তু, ‘ইসলামি বাঙলা’ বা ‘ইসলামি সাহিত্য’ বলে আলাদা করতেই বা হবে কেন? বৌদ্ধ-ইসলামি-হিন্দু-নিম্নবর্গ (উদা. নাথ-সাহিত্য)---এ’সকলকে নিয়েই না সমগ্র বাঙলা সাহিত্য? এই ঔদার্য ও সামগ্রিকতাবোধ থাকলে বাঙলা ভাগ হত না। বর্তমান বইখানি হাতে পেয়ে, পড়ে প্রথমেই এই অনুভূতিটা এলো---ভাবলাম, আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিই।

    যা হোক্‌, প্রথমেই বিতর্কে চলে না গিয়ে চমৎকার বইখানি সম্বন্ধে দু’কথা বলা যাক। জ্ঞানতাপস ডক্টর ওসমান গনী-সাহেবকে আমরা দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর করিডর দিয়ে ধীর পদক্ষেপে হেঁটে যেতে দেখেছি, বাঁ-বগলে বইয়ের তাড়া। সুনীতি চট্টো-সুকুমার সেনের প্রিয় ছাত্র---বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের জ্ঞানসাগর, বিশেষতঃ ইসলামি-বাঙলাসাহিত্যের---এ’কথা তখনই শুনতাম। মানুষটি যে হুগলি-বর্ধমানের, তা তাঁর ‘গেলুম’ ‘খেলুম’ শুনেই বোঝা যেত। নিঃশর্ত দোষস্বীকার, ওঁর কোনো লেখা আগে পড়িনি, বর্তমানখানি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মুগ্ধতা, মূলতঃ, তাঁর জ্ঞানের পরিব্যাপ্তি ও গভীরতায়। বিগত সাড়ে তিনদশক ধরে গনিসাহেব বাঙলাভাষায় তেরো প্লাস দশ খণ্ডে দুই মহা সিরিজ লিখে চলেছেনঃ ‘ইসলামের ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ এবং ‘ইসলামের ধারাবাহিক রাজনৈতিক ইতিহাস’। এ’বই পাঠের মুগ্ধতা ও প্রণতি জানাতে স্যরকে ফোন করে জানি, ‘শেষ’ খণ্ডের কাজ এই অশীতিবর্ষে অদম্য করে চলেছেন। তবে সেটাই যেন ‘শেষ’ না হয়, এই শুভকামনা জানিয়ে ফোন রাখি। এ’সিরিজে যেমন ‘কোরয়ান শরীফ বঙ্গানুবাদ’ ও ‘কোরয়ানের অভিধান’-এর মত গ্রন্থ রয়েছে, তেমনই রয়েছে ‘ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘ইসলাম ও নারীসমাজ’-শীর্ষক গ্রন্থও। এ’বইগুলো হাতে পাইনি। পাবার ও পড়ার ইচ্ছে তাই রয়েই গেল।

    বর্তমান গ্রন্থপ্রসঙ্গে আসা যাকঃ সপ্তপর্বব্যাপী সূচীপত্রখানি দেখেই ব্যাপ্তির ইঙ্গিত মেলে। এতে মধ্যযুগ থেকে আধুনিককাল পর্যন্ত পর্বে পর্বে আলোচিত হয়েছে পীরসাহিত্য থেকে মর্সীয়া, বিষাদসিন্ধু থেকে কারবালা। দীর্ঘ এক সরলরৈখিক ইতিহাস নয়, ‘থিম্যাটিক্যালি’ আলোচনা করেছেন গনীসাহেব, যেমন, ‘প্রণয়গাথা’ (চতুর্থ পর্ব) বা ষষ্ঠ পর্বে বাঙলাভাষায় ইসলামের ইতিহাস---এই রকম। কয়েকটি অধ্যায় বিশেষ ঔৎসুক্য জাগায়, যেমন ‘ইসলামি দোয়া-তাবিজ ও হাকিমিশাস্ত্র’। এখানে রীতিমত ছবি-সহযোগে ‘ছোলেমানি তালেনামা’ বা ‘আজায়েব ছোলেমানি’-র মত হাকিমিগ্রন্থের কথা শুনিয়েছেন লেখ। বাঙলাভাষায় লেখা এ’হেন গ্রন্থের হদিস তো কৈ আগে পাইনি। এ ও তো জানতাম না, (যেন) বাৎস্যায়নের বাঙলা ভার্সন---ঊনবিংশ শতকেই লেখা হয়েছিল ‘ছহি এলাজে লোকমানি’---যেখানে আছে নরনারীর গুপ্তাঙ্গের আলোচন, ছিল নরনারীর মিলনে চূড়ান্ত যৌনসুখ পাবার হদিশও?! তবে যে বলে ইসলামি সাহিত্য অত্যন্ত রক্ষণশীল, কেবল ধর্মভিত্তিক?

    বাঙলাভাষা-গঠনের আদিকালে, সেই ষোড়শ শতকে, সংস্কৃতভাষার কঠিন নিগড় থেকে তাকে মুক্ত করে আমবাঙালির জন্য দুয়ার খুলে দিতে সুলতান হুসেন শাহের মত মুসলিম-শাসকের মহান অবদান ছিল, যেটা অনেক সময় ভুলে যাওয়া হয়। তাঁর উৎসাহে যে কাব্য লেখা হল, সেটাও সাধারণের পাঠ্যঃ মঙ্গলকাব্য। বিজয়গুপ্ত লিখলেন ‘মনসামঙ্গল’। তারও আগে, কাব্য-সাহিত্য যে কেবল দেবদবীর গাথাই নয়, মানুষী প্রেম-ভালোবাসাও যে তার এক মুখ্য উপাদান, তা দেখিয়েছিলেন তারও আগে, ‘ইউসুফ-জুলেখা’-র কবি শাহ্‌ মহম্মদ সাগির। এ’সবই বাঙলা সাহিত্যে ঘটেছে ইসলামের প্রভাবে। এ’সব যে ক্রমে প্রায় ভুলে থাকা হয়েছে, সেটা মেকলীয় শিক্ষা-প্রভাবিত কলকাতা-কেন্দ্রিক হিন্দু ‘নবজাগরণ’-এর কুফল ছাড়া আর কিছু নয়। ‘এটা অন্য বিতর্ক’--- বলে এড়িয়ে গেলে চলবে না। এর উত্তর ইতিহাসের কাছে দিতে হবে।

    প্রকাশনালয়টিকে তো খুব নতুন বলে মনে হয় না, যদিও এঁদের বই আগে হাতে পাইনি। প্রকাশকের কাজে বড় একটা মন ভরলো না। অগুন্তি বানান ভুল। প্রচ্ছদখানি ভালো লেগেছে, যদিও তার কৃতিত্ব দু’জায়গায় দু’জনের নামে দেওয়া আছে। বাঙলাসাহিত্যের আলোচনায় লেখক কেন যে উর্দুকবি আল্লামা ইকবালের প্রসঙ্গ পাড়লেন, বোঝা গেল না। মহাকবি ফিরদৌসি প্রসঙ্গে যদিও ঠিক সে-কথাটা বলা যাবে না, কারণ তাঁর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

    মোট কথা, বইটি ভালো লেগেছে। এ’বই বাঙলাসাহিত্যের ইতিহাসের সকল উৎসাহী পাঠকের পড়া উচিত।



    || যমের মুখে ছাই দিয়ে বেঁচে থাক যম দত্ত ||

    যম দত্তের ডায়ারী—যতীন্দ্রমোহন দত্ত; রীতা প্রকাশনী, কলকাতা-৪১; ISBN: নেই

    মাঝ-১৯৩০’এর দশকের কথা। প্রতিষ্ঠার আধ-দশকের মধ্যে নিজক্ষেত্রের এক বিশ্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকার মান্যতা পেয়ে গিয়েছিল আইএসআইয়ের মুখপত্র ‘সাংখ্য’। সেই পত্রিকায় এক নিবন্ধ বেরিয়েছে। মধ্যত্রিশের তরুণ রাশিবিজ্ঞানী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, ইম্পিরিয়াল গভর্নমেন্টের ‘১৯৩১-বেঙ্গল সেন্সাস রিপোর্ট’-এ কোথায় কোথায় কী কী ভুল রয়েছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে ভারত সরকার ওঁকে রাশিবিজ্ঞানে ‘পদ্মশ্রী’ দেবেন। এই সময় উন্নাসিক ‘প্রবাসী’ (না, ‘ভারতবর্ষ’?) পত্রিকায় ইলিশমুড়ো দিয়ে কচুশাক রান্নার ওপর এক সরস রচনা বেরিয়েছিল। এই লেখকের সেইদিনটা অবশ্য কেটেছিল পানিহাটি পৌরসভার ‘আঞ্চলিক ইতিহাস কমিটি’-র মিটিং-এ’। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছেন। সন্ধ্যেবেলা দুঁদে এটর্নির চেম্বারে মক্কেল বসে থাকবে যে---শরিয়তি আইনের মারপ্যাঁচ ওঁর চেয়ে আর কে বেশি জানেন?!

    ইনি যতীন্দ্রমোহন দত্ত (১৮৯৪-১৯৭৫)। ‘যম দত্ত’ নাম নেওয়ায় যিনি প্রনাবি-বু.ব.-এর সিনিয়র। যাঁর অবিশ্রাম লিখন সেকালের প্রবাসী-ভারতবর্ষ থেকে ষাটের দশকের যুগান্তর-অমৃতেও প্রবাহিত ছিল। সম্প্রতি দক্ষিণবঙ্গের এক অনামি প্রকাশনালয় নানাস্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যম দত্তের এমন গোটা-পঞ্চাশ রম্যরচনার এক সম্ভার বের করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। সাবাসি পাওনা তরুণ গবেষক/সম্পাদক শ্রীমান কৃশানু ভট্টাচার্যের।

    নির্দ্বিধায় স্বীকার, যম দত্তের নাম আগে শুনে থাকলেও, অনেক বছর আগে ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় ওঁর ওপর এক নিবন্ধ ছাড়া আর কিছুই পড়া ছিল না। আর আজকে এই বইখানি পড়ে সটান বোল্ড আউট হয়ে গেছিঃ বোল্ড আউট তাঁর লিখনের রেঞ্জে, এবং অতি সূক্ষ্মরসের ঠাট্টায় (উদা. ‘আমি মরিলে সরকার-বাহাদুর যদি ডাকটিকিট ছাপাইতে চাহেন তাতে যেন আমার ছবি না দেওয়া হয়। বার্ধক্যে দাঁত পড়িয়া গিয়া চেহারাখানি খোলতাই হইয়াছে কিনা’!)

    ***

    সেকালের কথা তো রাজনারায়ণ বসু থেকে শুরু করে অনেকেই শুনিয়ে গেছেন। যমদত্ত এগারোটি অধ্যায়ে এমন এমন অনেক গল্প শুনিয়েছেনঃ

    (১) ‘ছিনিমিনি খেলা’ তো বহুল প্রচলিত শব্দ। কিন্তু আসল খেলাটা কী ছিল জানতাম না। পুকুরের জলে খোলামকুচি ছুঁড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পুকুর পার (আমরা ছোটবেলায় ‘ব্যাংবাজি’ বলতাম)! ধনীশ্রেষ্ঠ রামদুলাল সরকার যাঁর ঘরের গোলামী দিয়ে জীবন শুরু করেন, সেই মদন দত্তের নাতি তনু দত্ত তাঁর তৃতীয়পক্ষের স্ত্রীর সঙ্গে দত্তবাগানের পুকুরে মোহর ছুঁড়ে ছুঁড়ে এই ছিনিমিনি খেলা খেলতেন। তাঁর হেডচাকর সে-টাকা কুড়িয়ে কুড়িয়ে তার কাঁচা ঘর পাকা করলে।

    (২) যুগের সঙ্গে সঙ্গে কত প্রকার শিল্প কত ক্রীড়া যে হারিয়ে যায়! প্রেমাঙ্কুর আতর্থী শুনিয়েছিলেন ১৯১০-এর দশকে উত্তরভারতের কবুতর-খেলানোর অদ্ভুত এক গল্প, যেখানে কেবল ওস্তাদের শিসের তারতম্যে লাল-সাদা-কালো পায়রার দল আকাশে উড়তে উড়তে নানান ফরমেশনে নানান আলপনা এঁকে তুলত! বা, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সেই নবাববাড়ির নর্তকীর গল্প, যিনি আল্‌তা-পায়ে নেচে নেচে ভূমিতে অপরূপ মুখায়বব এঁকে তুলতে পারতেন! আর, যম দত্তের কাছে শুনলাম বুড়ো ওস্তাদের পাতলা কানখুস্কি দিয়ে কানের ভিতরে গৎ বাজানোর গল্প। ফরমায়েস মত তাঁকে ‘বন্দে মাতরম্‌’ গৎ-ও শুনিয়ে দিয়েছিলেন।

    (৩) ‘আঞ্চলিক ইতিহাস’-এর কথা আজকাল কত শোনা যায়। পশ্চিমে তো রীতিমত স্কলাসটিক গবেষণা চলে, ভারতেও এখন আইসিএইচআর-এর উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে। যতীন্দ্রমোহন আজীবন পানিহাটিতে থেকেছেন ও সে-অঞ্চলের কথা শুনিয়ে এসেছেন। যোগ্য গুরুত্ব পেলে ও সঠিক সংরক্ষণ হলে সে-সব আজ উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা পেত। যেমন, বিশের দশকে ব্যারাকপুর পৌরসভার নির্বাচনে সুরেন বাঁড়ুয্যের সঙ্গে ডাঃ বিধান রায়ের লড়াইয়ের গল্প। বা, হরিশ চ্যাটার্জির কথা---যাঁর নামাঙ্কিত রাস্তা আজ মুখ্যমন্ত্রীর দৌলতে সংবাদ-শিরোনামেঃ যিনি কেল্লায় চাকুরি করতেন ও দেদার ভবানীপুরবাসীকে তথায় নৌকরি করিয়ে দিতেন। যে-কাজ একজনে হয়, সেকাজের জন্য চারজন! ট্রাডিশনটা তাহলে সেই সেকালেই তৈয়ার হয়েছিল?!

    এ’হেন যমদত্ত একজন ভূত-বিশেষজ্ঞও ছিলেন, ভাবতে পারেন? রীতিমত দশটি অধ্যায় জুড়ে “ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো”-র তথ্যনির্ভর কাহানি শুনিয়েছেন, যা ত্রৈলোক্যনাথ বা শীর্ষেন্দু মনে পড়াবেই। শেষে কালবোস মাছের গল্প দিয়ে শেষ করি, যেটা কিনা ছয় অধ্যায়ব্যাপী “খাদ্য-অখাদ্য”-পর্বের প্রথম নিবন্ধ। রুই-কাতলা গোত্রের (কার্প) কালবোস মাছ বাঙালির পাতে কিছু নতুন নয়। কিন্তু কালবোস নামখানি হলো কোত্থেকে? মোগল আমলের শেষদিকে বর্ধমানের কালীনারায়ণ বসু মহোদয় কার্যব্যপদেশ গোদাবরীতীরস্থ নিজামপ্রদেশে যান। সেখানে এই জাতের মাছ দেদার পাওয়া যায়। বড্ড ভালো লেগে গেল তাঁর এ’মাছ খেয়ে। বহুকষ্টে ও ব্যয়ে বাঙলায় আনেন কালীবসু সে-মাছের ডিম। তা থেকেই এর রমরমা। নামটি তাই সে-ভগীরথের নামেইঃ কালীবসু থেকে কালবোস। বাঃ! গ্রেট! ওরাল হিস্ট্রির চূড়ান্ত নয় কি?

    অন্য স্বাদের লিখন যাঁদের ভালো লাগে এ’বই তাঁদের জন্য। কয়েকটি অধ্যায়ের নাম শুনবেন এই বই থেকে? ‘কড়াইয়ের ডালের গীত’, ‘আলেয়া ভূত’, ‘ভারতে ম্যাগনোলিয়া গ্রান্ডিফ্লোরার আগমন’, ‘খৃষ্টপুর্ব ৩২০ সালে চাউলের দর’ । আরও শোনার ইচ্ছে আছে? তাহলে বইটি পড়ুন। ভালো লাগবে।



  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments