পরাশান্তি মনপ্রহরা; ঋতব্রত মিত্র; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১৩, সিগনেট প্রেস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৭২ ; ISBN : 978-93-5040-237-5
ঋতব্রত মিত্রের এই কাব্যগ্রন্থের নাম 'পরাশান্তি মনপ্রহরা'। মনপ্রহরা বাউল বাউল গন্ধ, কিন্তু পরাশান্তি — উপনিষদ, নাকি সাংখ্য-টাংখ্য? নাকি মোক্ষপ্রাপ্তির ফতোয়া? কিন্তু আমি তো কবিতা পড়ব বলেই বইটা খুলেছি। কবিতা অবশ্যই এক মেঘরমণী — সে আমাকে হাসাবে, কাঁদাবে, নব নব ভঙ্গিমায় কেজো ঘন্টামিনিটগুলিকে ছিনতাই করবে — এই জন্যেই তো কবিতাকে ভালোবাসি, ভয়-টয়ও করি।
স্বীকার করতেই হবে, এ বইয়ের ৪৮ খানা কবিতায় মন-ভোলানো কোনো বাক্যই নেই। কবিতা লিখতে বসে তিনি অন্য কোনো দায় অনুভব করেন। সম্ভবত ঋতব্রত এ ব্যাপারে নিজেও এক সজাগ প্রহরী, তাই তিনি প্রায় ঘোষণার বাগ্ভঙ্গিতে জানিয়েছেন :
এই ব্যাপারে আমার মতে
পদ্য লিখে সম্-সমাধান
না-ই বা হলো —কী যায় আসে—
না, শুধু স্বগতোক্তি করেই তিনি নিবৃত্ত হন নি, একটি চ্যালেঞ্জও রেখে দিয়েছেন :
পুর-পুরাতন বৃন্দ কবি(চন্দ্র প্রিয়তমেষু ৩৪-৩৬ পৃ.)
তোমরা অদ্য শ্রবণ করো
চন্দ্রকথা বর্ণনাতে
এই কবিরাজ হচ্ছে সামিল
তবে 'পরাশান্তি মনপ্রহরা'র কবি কবিতারূপা মেঘরমণীদের যে উপেক্ষা করতে পারেন নি তার স্বীকৃতি আছে 'মেয়েদের নিজস্ব মেঘ' কবিতায় (২৮ পৃ.)
কারণ মেয়েরা বুকে অসময়ে মেঘ মেঘ খেলেঅথবা,
আকাশ তুমি তো নদী-ই ছিলে,এবং শেষ দুই ছত্র—
হও না নদী এই বার
আমরা খানিক ভাসি,
আজ দিন যার যার নিজস্ব মেঘে
মেয়েদের উঁচু-নিচু বুক ভেজাবার
হও না নদী এই বার
আমরা খানিক ভাসি,
বাউল, চর্যা, দেহতত্ত্ব, সহজিয়া সাধন ইত্যাদির পরিশীলিত অনুভব উৎসারিত হয়েছে অনেক কবিতায়।
সূত্রপাতে মুখবন্ধ কবিতাটি পুরোপুরি এক বাউল-দরবেশের দেহতত্ত্ব বিষয়ক অভিজ্ঞতার উৎসার :
ভাণ্ড ভাঙাইলাম, গড়াইলাম, বানাইলাম ঘরএবংবিধ তত্ত্ব কিংবা তত্ত্ব-সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যায় — অন্ধ (৯ পৃ.), চর্যা (১০ পৃ.) কূট (পৃ.), ভুল চোখ (২৪ পৃ.), শিবদুর্গাপালা (২৯-৩০ পৃ.), অশরীরী (৩২-৩৩ পৃ.), বিষকন্যা (৪১ পৃ.), চর্চা (৪২ পৃ.), নিশিযাপন (৪৩ পৃ.), শীতকথন (৬৩ পৃ.) ইত্যাদি কবিতায়।
তয় মানবজমিন টুটা-ফুটা —আসমানে অম্বর
আরো একটি তত্ত্ব আছে ঋতব্রতর 'পরাশান্তি মনপ্রহরা' কাব্যগ্রন্থে। সে তত্ত্বটি হল - 'মৃত্যু' অথবা 'জন্ম-মৃত্যু'। কোজাগর গূঢ়, জাতক, মৃত্যু আড়ি আড়ি, শ্মশানচারীদের গান, মৃত্যু-ঘাম (যথাক্রমে ১৭, ১৮, ১৯, ২০-২১, ২২, ২৩ পৃষ্ঠা) ইত্যাদি কবিতায়।
কোন্ কবিতায় কী তত্ত্ব--চর্যা না বাউল নাকি অন্যকিছু, কী তার সূত্রাবলী — এ সবের হকিকত দাখিল করা বলা বাহুল্য, এই অভাজনের কাজ নয়। যে-কোনো তত্ত্ব, তা মহাসুখ কিংবা ষট্চক্রভেদ অথবা জন্ম-মৃত্যু যাই হোক না কেন, তা কতখানি কবিতা হয়েছে — মাত্র এটুকু দেখাই এই অভাজনের কাজ। দেখানোও বটে। অতঃপর বলা যায়, কবির মনে যে-কোনো তত্ত্বভাবনা আসে কমবেশি রহস্যানুভূতি অথবা রহস্যময়তার আকারে। এই রহস্য অবশ্যই গোয়েন্দা ব্লেকের 'রহস্যলহরী' সিরিজের গপ্পো নয়, এ রহস্য হল — যা কিছুটা জানি বাকিটা জানি না, সেই না জানাকে জানার জন্যই এক সন্ধিৎসা অন্তঃসলিল ফল্গুর মতো কবির অন্তরে নিরন্তর বয়ে যেতে থাকে, তার শাব্দিক তথা ছান্দসিক অভিব্যক্তিই কবিতা। আমরা সেই কবিতাই পড়ব, সেই কবিতাই পড়তে চাই — যে কবিতায় তত্ত্বের, পরা কিংবা অপরা বিদ্যারাশির চমক থাকে তো নিশ্চয়ই থাকুক, কিন্তু সেই চমক যেন চমৎকৃতিতেই নিষ্পন্ন হয়। চমৎকৃতি নেই শুধু চমক আছে — পাঠকের তাতে অনুরাগ নেই।
আলগোছে বইটার পাতা খুলতেই ৩১ পৃষ্ঠা, সেখানে আছে 'আকাশ-মাটির গল্প-গাছা' কবিতাটি। তার প্রথম স্তবক :
গ্রামের শেষেই শ্মশানঘাটা
'দুগ্গা' বলে পার হয়ে যায়
ওইটুকু পথ — সুয্যিমশাই —
একশ' মেঘে সন্ধ্যে ঘনায়
অবশ্যই এক মনোহর চিত্রকল্প — সূয্যিমশাইও শ্মশানকে ভয় পান, নিশ্চয়ই তাঁর গা ছমছম করে, এবং আপনি-আমি যেমন ছা-পোষা সংসারী, ঠিক সেইভাবেই সেই মহাদ্যুতি এবং ধ্বান্তারি 'দুগ্গা' বলে ভয় কাটাতে চাইছেন। আমি একেই বলতে চাইছি তাত্ত্বিকতা থেকে কাব্যিকতায় উত্তরণ, চকমকে চমৎকৃতিতে রূপদান।
দুর্গার প্রসঙ্গই যখন এল, ঠিক আগের কবিতা হল — 'শিবদুর্গাপালা' (২৯-৩০ পৃ.)। সেই দশভুজা দশপ্রহরণধারিণী অসুরবিনাশিনী দুর্গার সঙ্গে শিবের বিয়ে হয়ে গেল। কবি ঋতব্রত এখানে এক অভিনব কল্পনা করেছেন, তিনি সেই শম্ভু স্বয়ম্ভু অযোনিজ supreme দেবতার মা-বাবাকে উপস্থাপিত করেছেন তাঁর এই কবিতায়, এবং তা-ও কোনো উদ্ভট ভঙ্গিমায় নয়, একেবারেই সংসারমনস্ক ভয়ভাবনার প্রেক্ষিতে —
শিবের মা-বাপ কাঁপছে ভয়ে শিবের কোঠাবাড়ি'কূট' কবিতায় গুহ্য কায়াসাধনার স্পর্শ আছে — 'শঙ্খ-লাগা সাপ দুখানি'। এবং-বিধ গুহ্য সাধনায় অভিজ্ঞ সাধক-সাধিকারা জানেন, মনুষ্য দেহকান্তের গোড়ায় আছে মূলাধার, মূল আধার, সেই আধারে সুপ্ত হয়ে আছে অনন্ত শক্তি। সুপ্ত এবং কুণ্ডলীকৃত, যেমন সাপ বা সাপেরা কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকে। সাধকও একধরনের গবেষক, তিনি এবংবিধ সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে দিতেই সাধনা করেন। তখনও ইড়া ও পিঙ্গলা দুই সাপ, আসলে দুই নাড়ি সুষুম্নাকাণ্ড অর্থাৎ মেরুদণ্ড বেয়ে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। সাধকদের কথায় এই দুই সাপের একটি সাপ, অপরটি সাপিনী। একটি পুরুষ, অপরটি প্রকৃতি। সাপ-সাপিনীর মৈথুনবাসনা লোকভাষায় হয়েছে 'শঙ্খ-লাগা'।
'দুগ্গা' বলে পার হয়ে যায়
এই বুঝি মা দুর্গা বলেন—সবার সঙ্গে আড়ি।
ঋতব্রত তাঁর 'কূট' কবিতায় এই শঙ্খলাগা সাপদুখানির কথা বলেছেন; অভিনবত্ব বা চমৎকারিত্ব এই যে, তিনি সাপ-সাপিনী মিলন-মুহূর্তের ছবি আঁকেননি, এঁকেছেন তাদের আকস্মিক বিচ্ছেদের কথা, তাও আবার সুস্পষ্ট চিত্রাঙ্কনে নয়, অর্ধছিন্ন চিত্রকল্পের মাধ্যমে —
শঙ্খ-লাগা সাপ দুখানি ছিটকে সরে গেলেকূটস্থ অর্থ হল, শরীর থেকে মনের খসে পড়া, তখন শরীর মানেই শবদেহ, এখানেই ঋতব্রত একটি চমৎকার অনুভবকে ছুঁয়ে ফেলেছেন, শবদেহটির কান্না ঢেকে দিচ্ছে সময়, যে সময় আবার অনন্তকে অর্থাৎ endless time and space-কে ছুঁয়ে থাকে :
শরীর থেকে মন খসে খুব ফুঁ লাগে শঙ্খয়
... ... শবদেহটির কান্না ঢেকে দ্যাখেকবির অনুভব আবিষ্কারে কিংবা আপ্তবাক্যে উন্নীত হয়েছে 'কূট' কবিতার উপসংহারে একটি মাত্র ছত্রের স্তবকে :
সময় যেন অনন্তকে ছোঁয়।
অনন্তর অনন্তও অতিক্রমণীয়Endless time and space-কে অতিক্রম করার কথা ভাবতেও পেরেছেন কবি ঋতব্রত মিত্র।
প্রায় সমান অনুষঙ্গের আরেকটি কবিতা 'গূঢ়' (১৮ পৃ.)। এ কবিতার উপজীব্য হল ইঁদুর :
ইঁদুর অন্ধকারে — মুখবন্ধ সরা'কূট' কবিতায় যেমন অনন্ত, তেমনি এই 'গূঢ়' কবিতায় কোনো এক অজ্ঞাত বা অজ্ঞেয়ের স্পর্শ। সাপ কিংবা ইঁদুর হল প্রতীক।
এর বেশি কিছুই জানি না
শরীর এবং অশরীর, শরীর থেকে মনের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে যে বোধ — তা প্রথাগত দেহতত্ত্ব থেকে আরো অন্য কিছু ভাবনা যা কবিকে সর্বক্ষণ পীড়িত করে, সেই সংবাদটি পাওয়া যায় 'অ-শরীরী' কবিতায় (৩২-৩৩ পৃ.) :
অথচ সব কথাগুলো
এক পলকে পাখনা-মেলা মাছ হয়ে যায়
তাদের পিঠের পরে চেপে
জলের আকাশ ঝির ঝিরে সুখ-দুঃখ কাঁপায়
কী-বিচ্ছিরি ভেংচি কাটে,
শরীর কোথায়, শরীর কোথায়?
বন-পাহাড়ে
ঝর্নাজলে
গঞ্জ-গ্রামে
রোদ্দুর-পার ধুলো-হাওয়ার চৌহদ্দি-তেপান্তরে
কোত্থাও নেই, কোত্থাও নেই
ঋতব্রতর কবিতায় প্রায়শ এসেছে সাপ, সর্পাঘাত, বিষ এবং বিষজর্জর এক শরীর কিংবা আত্মিক অস্তিত্ব। আর তার ফলশ্রুতি স্বরূপ এসেছে মৃত্যুর চেতনা কিংবা দুশ্চেতনা। এ কবিতাগুলি হল : কোজাগর (১৭), গূঢ় (১৮), জাতক (১৯), মৃত্যু আড়ি আড়ি (২০-২১), শ্মশানচারীদের গান (২২), মৃত্যু-ঘাম (২৩) — পর পর ছয়টি কবিতায়। তাছাড়া অন্যান্য কবিতায়ও যে মৃত্যুভাবনার চকিত ইঙ্গিত কিংবা অস্ফুট চিত্রকল্প নেই এমন নয়।
এখন প্রশ্ন, কবি ঋতব্রত মিত্রের এই মৃত্যুভাবনার স্বরূপ কী?
ইতিপূর্বে আমরা দুই প্রণম্য কাব্যগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনানন্দের কবিতায় মৃত্যুচেতনার বৃহৎ ভূমিকা লক্ষ করেছি। রবীন্দ্রনাথ অক্লেশেই বলতে পারেন,
মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যামসমান। (ভানুসিংহ)অথবা
অত চুপি চুপি কেন কথা কওরবীন্দ্রনাথের কাছে মৃত্যু অমৃতস্বরূপ, মৃত্যুং তীর্ত্বা অমৃতমশ্নুতে। তাঁর ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুর আঘাত বার বার হানা দিলেও শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবেদনাকে জয় করে তিনি হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয় :
ওগো মরণ, হে মোর মরণ,
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও
ওগো একি প্রণয়েরই ধরণ! (মরণমিলন)
'আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো' এই শেষ কথা বলেএমন কি, জীবনের একেবারে অন্তিম লগ্নেও মৃত্যু তাঁর কাছে এক নিপুণ শিল্পী:
যাব আমি চলে। (মৃত্যুঞ্জয়, পরিশেষ)
মৃত্যুর নিপুণ শিল্প বিকীর্ণ আঁধারে। (শেষলেখা)আর জীবনানন্দের সব পুরোবর্তী কবিতাতেই মৃত্যু উপস্থিত — কোথাও পুরোপুরি উটের গ্রীবা, কোথাও বা 'সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম-নিম ...' শেষ পর্যন্ত জীবনানন্দের অন্তর্গূঢ় কবিদৃষ্টিতে মৃত্যু এক বিপন্ন বিস্ময়। যে জীবন কোনো কিছুতেই ব্যর্থ নয় — নারীর হৃদয়, প্রেম, শিশু, গৃহ, অর্থ, কীর্তি কিংবা সচ্ছলতা সব কিছুতে যে জীবন ছিল ভরভরন্ত, সেই জীবনও কিনা একদিন ক্লান্ত হয়ে উঠল। এ কেমন ক্লান্তি, কীসের ক্লান্তি? এ ক্লান্তি অভ্যাসের ক্লান্তি, তৃপ্তির ক্লান্তি, প্রাপ্তির ক্লান্তি, থেমে যাওয়ার ক্লান্তি এবং যে ক্লান্তি —
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরেতাই ক্লান্ত লোকটি মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিল।
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত — ক্লান্ত করে।
মৃত্যু সম্পর্কে এবংবিধ উচ্চারণ কবি জীবনানন্দের কবি-ব্যক্তিত্বকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় ভূষিত করেছে, আর বাংলা কাব্যধারার এক বিশিষ্ট সম্পদও বটে। মৃত্যুচেতনা সম্পর্কে জীবনানন্দ রবীন্দ্রনাথ হয়তো অনুভব করেছিলেন, অন্তত পাঠক হিসেবে আমরা একটা অন্তর্লীন যোগসূত্র আবিষ্কারও করতে পারি — যে-মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের কাছে নিপুণ শিল্প, সেই মৃত্যুই জীবনানন্দের কাছে বিপন্ন বিস্ময় এবং দৈনন্দিন অভ্যাসের জীবনযাপনজনিত ক্লান্তি অপনোদনের একমাত্র উপায়।
ঋতব্রত মিত্রও তাঁর কবিতায় মৃত্যু সম্পর্কে কিছু একটা বলতে চান। তিনি অনুভব করেন, জীবনের মধ্যে কোথায় যেন একটা চোরাটান —
চোরাটান এত? এত? ...কে কার মুখাগ্নি করে, মাতাপিতৃহীন কে বটেক — এ সব অন্বয়-তথা-সংগতিপিপাসা আপাতত মুলতুবি রেখে মাত্র এটুকু বলা যায় যে কবির ব্যক্তিজীবনের কোনো মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এখানে ইঙ্গিতায়িত হয়েছে, যে অভিজ্ঞতা কবিকে মৃত্যুভাবনার, - শুধু মৃত্যু নয়, জন্মমৃত্যুর এক রাহস্যিক চেতনার মুখোমুখি নিরন্তর কৃতজল্প করে রেখেছে। গড়পড়তা মানুষের কাছে জন্মমৃত্যু কেবল দিনগত পাপক্ষয়, কেবল দেহযান্ত্রিকতার অনিবার্যতা, সেই জন্মমৃত্যুই কবির কাছে হয়ে উঠেছে মনফকিরার একতারাতে কখনো গুঞ্জন কখনো ঝঙ্কার:
কী যেন কী বাকি ছিল ... কী যেন কী
এ খোঁজার উত্তরটি কিন্তু অতি মর্মান্তিক —
সন্তানে মুখাগ্নি করি,
আগুনশয়ান নিভে আসে
কাজে। কর্মে। ছিছিক্কারে
মাতাপিতৃহীন (কোজাগর)
নিজের কবর খুঁড়ে কী-ই বা বলার আছে আর?গীতার সেই 'বাসাংসি জীর্ণানি যথাবিহায়' শ্লোকের রকমফের পরের তিন ছত্রে এসেছে কবির নিজস্ব রাহস্যিক চেতনায়
পুরোনো কাপড় কেচে আবার নতুন করে পরা—
ইঁদুর অন্ধকারে — মুখবন্ধ সরাজন্ম এবং মৃত্যু — এদিকে অন্ধকার ওদিকে অন্ধকার। ইঁদুর বুঝি প্রাণকণা জীবন, এটুকুই জানা, বাকি সবটাই অজ্ঞাত। সে অজ্ঞাত রাজ্য কারুর আবিষ্কৃত নয়। কবি নিজেও অক্ষম এ-হেন আবিষ্কারে, তাই তিনি বলে ওঠেন — আমি তো আমারও নই কিনা!
এর বেশি কিছুই জানি না
আমি তো আমারও নই কিনা! (গূঢ়)
জন্মমৃত্যুর রহস্যময় এই মেলবন্ধন এক চমৎকার চিত্রকল্পে বিধৃত হয়েছে 'জাতক' কবিতায় —
জানতাম না, ভাঙা চাঁদখণ্ড থেকেওঅতঃপর জন্ম ও মৃত্যু নিয়ে কবিচেতনা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে 'মৃত্যু, আড়ি আড়ি' কবিতায়। এখানে ঋতব্রত জন্ম এবং মৃত্যু — দুই বিপরীত অস্তিত্বের এক অভিন্ন প্রতীক খুঁজে পেয়েছেন। সে প্রতীকটি হল — কবির কবিতার পাণ্ডুলিপি। এখানে আরেকবার পূর্বসূরী জীবনানন্দের কথা বলতে হচ্ছে, কেননা পৃথিবীর সব রঙ মুছে যাওয়ার পরেও তিনিই দেখেছিলেন পাণ্ডুলিপির আয়োজন, শুধু আয়োজন বা সূচনা নয়, এক সময়ে 'ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন।'
জ্যোৎস্না বেরোয়, তাতে জ্বলে খাক চোখ
কবি ঋতব্রতের কাছে পাণ্ডুলিপির আরো একটি স্পষ্টরূপ ধরা পড়েছে। তাঁর কাছে পাণ্ডুলিপি মানেই পাণ্ডুর লিপি:
পাণ্ডুর লিপি মৃত্যুকে বেয়েএভাবে পরম্পরার সুতো ধরে হাঁটলে দেখা যাবে, পাণ্ডুলিপির মধ্যেই সব কবির বাঁচন-মরণ, পাণ্ডুলিপিতেই সব কবির ঘর-সংসার, প্রিয় ভার্যা, প্রিয়তর পুত্রকন্যা, তৎসহ বাজার-হাট এবং ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স:
পাণ্ডুলিপিটি আগাগোড়া ছেয়ে
ঘুমে হেসে ওঠে,
... ... ... ... ...
হাওয়া রোদ্দুর গাছ আর আগাছা
ভেসে উড়ে গ্যাছে, কবি ছাড়াছাড়ি
তবুও মৃত্যু, মৃত্যু কোমলা
শোকাশ্রু টলমল — শাকান্ন ভোগআর এই সব দহনজ্বালা আত্মসাৎ করেন কবি —
পেছনেই ফেলে আয় রতিসংযোগ
... ... ...
কোল-জোড়া ছেলে কেঁদে ফেরে চরাচর
চন্দন-চর্চিত কনেও নিথর
... ... ...
মহানভ-অঙ্গন অথৈ অটল
বলো হরি হরিবোল, বলো হরিবোল (শ্মশানচারীদের গান)
এক মৃত্যু জেনে গেছিদহনজ্বালায় ভাস্বর কবিই বলতে পারেন —
দুই মৃত্যু দ্বারে
তিন মৃত্যু ভেবে নিয়ে
চার মৃত্যু পারে
(মৃত্যু-ঘাম)
মেঘ হয়ে ভেসে এলঅতঃপর কবি-মনীষী অরবিন্দের মন্তব্য উল্লেখ করা যায় — 'Death has no reality except as a process of life .... even in the death of the body there is no cessation of life, only the material of one form of life is broken up to serve as material for other forms of life.'
যত মৃত্যু-ঘাম
মৃত্যু-দেবীর শাপে
অমৃত হলাম
ঋতব্রত মিত্র কবিতার আঙ্গিক-সচেতন শিল্পী।
'মন-প্রহরা'র অনেক কবিতা দলবৃত্তে নির্মিত, ছত্রগুলি প্রায়শই দ্বিপর্বিক, কোথাও কোথাও বাড়তি একটি অপূর্ণ পর্ব টুকি দিয়ে গেছে।
বিশুদ্ধ এবং প্রথানুগ মাত্রাবিন্যাসে :
চন্দ্র এবার কী কাণ্ড দ্যাখ ৪+৪তবে মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়েছে প্রলম্বিত মাত্রাবিন্যাসের কারুকার্য, যাতে পাঠকের শ্রুতিসুখ আরো বেড়ে গিয়েছে। ওই একই 'চন্দ্র প্রিয়তমেষু' কবিতায়—
তোর বিষয়ে পদ্য লেখা ৪+৪
বারণ কারণ সবার মতে ৪+৪
তুই হচ্ছিস খুব পুরনো! ৪+৪
রাদ্দিন তোর চাঁদপারা মুখ ৪+৪দলবৃত্তের রীতি মেনে চললে 'রাদ্দিন তোর' পর্বটি তিন তিন মাত্রার। অথচ পুরো কবিতাটি চেঁচিয়ে পড়তে গেলে যেকোনো অশিক্ষিতপটু কবিতাপাঠকও চার মাত্রার টান স্বচ্ছন্দে বজায় রেখে পড়ে যাবেন। কেবল ঘর্মাক্ত-কলেবর ছন্দ-পরীক্ষকই দেখতে পাবেন, কবিতাপ্রেমিক পাঠক তাঁর অজ্ঞাতসারেই এক মাত্রা জুড়ে দিয়েছেন 'তোর' অন্তিম পর্বাঙ্গে।
ডিগবাজি খায় স্কাইস্ক্র্যাপারে ৪+৪
চতুর্থ মাত্রার এই আশ্চর্য ম্যাজিক নিয়ে সন্ধিৎসু কবি একটি কবিতাও লিখেছেন— বহুমাত্রিক (৬৬ পৃ.):
দৈর্ঘ্যে সে দিশেহারাপদার্থবিজ্ঞানীর ভাষ্যে চতুর্থ মাত্রার কথা শোনা যায় বটে, তাঁরা এমন কথাও বলেছেন, প্রাকৃতজনের চর্মচক্ষুর নাগালের বাইরে যে অদৃশ্য সময়প্রবাহ, সেই প্রবাহই নাকি চতুর্থ মাত্রা, যা দৃশ্য তথা স্পর্শসহ বস্তুসত্তাকেও বদলে দিচ্ছে। আশ্চর্য ম্যাজিকই বটে। আরও আশ্চর্য যে, এ হেন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে কবিতায় রূপমন্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন ঋতব্রত মিত্র।
প্রস্থে সীমানাহীন
এত উঁচু ভাবাই যায় না — কী আছে তারপর ...
আশ্চর্য বিশ্বচরাচর
সবেধন তিন মাত্রা
চতুর্থটি সময়ের জোর
আর অপরাক্রান্ত পাঠকের কানে লেগে থাকে ঋতব্রত কবির প্রিয়ব্রত দলবৃত্তে চতুর্থ মাত্রার আশ্চর্য ম্যাজিক:
এইজন্যেই শব্দ, ওরে শব্দপরিশেষে কাব্যগ্রন্থের প্রান্তিক কবিতার কয়েকটি ছত্র এলোমেলো উদ্ধারান্তে দায়োদ্ধার ঘোষিত হোক:
তোকেই সাক্ষী মানি
পদ্য লিখতে শব্দ, ইয়ে
শব্দের আর নেই প্রয়োজন (শব্দ, শব্দ)
কবিতা লিখে তো বাউল অস্থিরতা,
লেখনীর মুখে হাজারো রঙের স্বর—
বুকে যদি পাই জীবনানন্দকে তো
ভাগ্যে জোটেনি সজনীকান্ত দাস!