ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু ; মানস চৌধুরী; সৃষ্টিসুখ প্রকাশন - কলকাতা; ISBN: 978-163041985- 1
জীবনের আঁতি-পাতি ছড়িয়ে থাকে সুখ-দুঃখ, শোক-আহ্লাদ, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, গতানুগতিকতা-চমক, পরিবর্তন-অচলায়তন, বাসপত্তন-বাসোচ্ছেদ, নির্মাণ-ধ্বংস এবং অবশ্যই জন্ম ও মৃত্যু। আবার একেকটা মানুষের জীবনের প্রবাহে এইসব ঘটনার দ্যোতনা, অভিঘাত একেক রকম। সেইসব নানা রঙের নানা রসের নটি জীবনগাথার সংকলন হলো লেখক মানস চৌধুরীর সাম্প্রতিক বই “ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু”। তবে এই বইটিতে তদন্ত হয়েছে মৃত্যুর নয়, জীবনের।
এই বইয়ের গল্পগুলি লেখা হয়েছিল জুন ২০০৪ থেকে মে ২০০৫-এর মধ্যে। গল্পগুলির প্রকাশকালও ডিসেম্বর ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে। এর মধ্যে সংকলন শিরোনামের গল্পটি স্থান পেয়েছিল “পরবাস ৩৫”-এ। অন্যান্য গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছিল “কবিসভা সঞ্চালিত গদ্য সংকলন ৬, একুশে সংখ্যা”-য়, “দৈনিক প্রথম আলো”-র “সাহিত্য সাময়িকী”-তে, মীজানুর রহমানের “ত্রৈমাসিক পত্রিকা”-তে। এছাড়াও লেখক মানস চৌধুরীর অন্যান্য গল্পগুলি যেসব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে “দৈনিক যুগান্তর”-এর “যুগান্তর সাহিত্য”, “নতুন দিগন্ত”, “দৈনিক সংবাদ”–এর “সংবাদ সাময়িকী”, “ডেইলি স্টার”-এর “ডেইলি স্টার লিটারেচার”, “কিয়োটো জার্নাল” এবং “সাপ্তাহিক খবরের কাগজ”।
“ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু”-তে সংকলিত জীবনগাথাগুলি অনন্য হয়ে উঠেছে তাদের ভাষার সহজ ঔপভাষিক লৌকিকতার জন্য। যেমন “ওস্তাদ” গল্পে-- “তাঁর বা পা-খানা মেঝেতে লাছানো। আর সেটার সঙ্গে হারমোনিয়ামটা ঠেসে রেখেছেন।” কিংবা “বিরুদ্ধাচারণ”-এ “এতকিছু তো তোমারে ভাবতে কই না। ... তুমি খালি মাথাডা ঠাণ্ডা রাইখা চইলো।” এবং “চুল বানলি। কই যাবি?”
“কই যামু?”
“আমি কেমনে কমু। আমারে কি আর কসনি?”-এর মতো সাধারণ কথোপকথনে। কিংবা, “সকাল বেলায় উঠে নদী আর হাওড় যে সীমানায় একাকার হয়ে আছে সেখানে একটা গামছা গলায় গোসল করতে যায় রহমত।”-এর মতো নৈমিত্তিকতার বিবরণে।
আবার “ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু” গল্পে “ধনরাজ আর শাহাবুদ্দিন ল্যাটকা মেরে বসে ছিল।”-- পড়লে ঝিমন্ত দুটো মানুষকে বেশ দেখতে পাওয়া যায়। তারপর “আলি বিহারীর কম্বল”-এ “কেবল বাবাকে জিগ্যেস করল, ‘এ দুইটো?’ বাবা জোরালো গলায় বলল, ‘এইতো তোমাদের দোয়ায়।’ আলির স্ত্রী দোয়া করবার একটা বাংলা বাক্য শুরু করেও আগাতে পারল না।” ও “আর একটু পর পর নানান উসিলায় বাইরে এসে ধুনকারের কাজ দেখি।” -- বিবরণগুলিতে উপভাষার কারুকাজ গল্পের স্থানকালকে অনায়াসে প্রোথিত করে ভূগোল আর ইতিহাসের নির্দিষ্ট গণ্ডিতে। “কুমড়া” গল্পের আদ্যন্তে ঔপভাষিক অলঙ্কারেরই রাজত্ব। সেই অলঙ্কার বাহন করে ঝলমলিয়ে বয়ে গেছে যাপনের স্রোতচ্ছবি কলকলানো জীবনের এবাঁক সেবাঁক বেয়ে।
এই সংকলনের গল্পগুলিতে লেখক সাধারণ জীবনে নিহিত পাঠটি অকল্পনীয় সাবলীলতায় পাঠককে উপহার দিয়ে ফেলেন বলেই বোধহয় গল্পগুলি বিশেষভাবে মনে ছাপ ফেলে। হতে পারে যে, এর কারণ লেখকের প্রাতিষ্ঠানিক তালিমটি ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার। তাঁর আরেকটি গল্পসংকলন “কাকগৃহ”-এর উৎসর্গপত্রে লেখক মানস চৌধুরী লিখেছিলেন, “আমার নিষ্ঠাবান নৃবিজ্ঞানী হওয়ার কথা ছিল.../ ... আর আমি হয়েছি নাছোড়বান্দা গল্পকারী।” হয়তো সেই কারণেই, নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত নিরূপণের প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত বিজ্ঞানী যখন গল্প বললেন তখন তাতে উঠে এল যাপনের জীবন্ত পরীক্ষাগার থেকে নৈর্ব্যক্তিক পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিনির্ভর সিদ্ধান্তের নির্যাসলব্ধ সত্য। তাই গল্পগুলির শিকড় বাস্তবের গভীরে রোপিত হয়েও বিন্যাসে, আঙ্গিকে সেগুলি দৈনন্দিন উপলব্ধির অবাক আকর। অথচ গল্পগুলি বর্ণনায় সরস, সরল, এবং প্রাঞ্জল। সমগ্র সংকলনটি একটা দেশের একটা নির্দিষ্ট কালপর্যায়ের বিবরণ হয়ে সংরক্ষিত করেছে এক অদ্যাবধি অগ্রন্থিত ইতিহাস। তাই এই বইটি সংগ্রহযোগ্য পাঠোপদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
“আলি বিহারীর কম্বল” গল্পে ভাষ্য প্রথম পুরুষে হলেও আলি বিহারী বা তার কম্বল বা গল্পকার কেউই গল্পের মুখ্যচরিত্র নন। বরং প্রত্যেকেই এই গল্পের অনিবার্য চরিত্রমাত্র। গল্পের মূল চরিত্র ঘটনা প্রবাহ। র্যাডক্লিফ লাইন ভারতীয় উপমহাদেশকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল। কালক্রমে আরও খণ্ডায়ন ঘটে গেছে। একবার আলি বিহারীর ধর্ম তার ভিটে কেড়ে নিয়েছে, আরেকবার তার ভাষা-সাংস্কৃতিক মূল কিংবা জন্মস্থলের পরিচয় তার চোখ উপড়ে নিয়েছে। রিলিফে মানে সান্ত্বনায় সে কম্বল পায় বটে কিন্তু কম্বলটা অনমনীয়, গা ঢাকতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। মানে কম্বলটা গায়ে দিলে শীত থেকেই বাঁচা যায় না, সেটা নিতান্তই ব্যবহারের অযোগ্য। তাই কম্বলটা যার হাতে যায় সে হয় কম্বলটা বেচে শান্তি পায়, নয়তো বাড়ির বাতিলের স্তূপে ফেলে রাখে, খুব দরকার পড়লে ব্যবহার করবে ভাবে কিংবা জিনিসটা পেয়ে খুশি হবে এমন মানুষকে দান করে দেয়। কিন্তু কম্বলটার এমন মায়া যে একবার সেটা গায়ে ওঠালে অন্য কম্বলের আরামের তলাতেও সেটা গায়ে দেওয়ার বেদনাটা মনে পড়ে যায়। আবার সেই কম্বল ফিরে পাওয়া মুস্কিল, ফেরত দেওয়াও মুস্কিল। কারণ সময়ের খাতে একমুখী বইতে বইতে কম্বলের পূর্বতন আর পরবর্তী মালিকের মধ্যে যোগাযোগ থাকে না। এ কী কম্বল নাকি উপমহাদেশের রাজনীতিকদের বানানো এক কৃত্রিম সমস্যার নিরসনে বুনে তোলা কৃত্রিমতর এক সমাধান, যা সময় বেয়ে পিছিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলেই আর শোধরানোর উপায় নেই?
“কুমড়া” গল্প আগাগোড়া মজার। সাধারণ দরিদ্র মানুষ উপার্জনের ফিকিরে প্রশাসনের মার খায়। কিন্তু প্রশাসনের নানান দপ্তরের টানা-পোড়েন আর তাদের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর অহং, ব্যক্তি-সংঘাত, ভয়, লোকদেখানো সামাজিকতা, দূর্নীতি আর তা ধামা-চাপা দেওয়ার প্রবণতা এবং দ্বিচারিতার সন্ধান পেলে দরিদ্র মানুষও হীনবল থেকে মহা ধুরন্ধর হয়ে উঠতে পারে। দমকা হাসির আবহাওয়ায় জমাটি নাটকের ঢঙে টানটান উত্তেজনায় ভীষণ উপভোগ্য গল্প এটি।
“একটি [জাপানী] মোরগ কাহিনী” জীবস্বাতন্ত্র্যের সাথে সমাজের সংঘাতের গল্প। প্রকৃতিতে আদিমতম থেকে বর্তমান সময় অবধি যত প্রাণী জন্মেছে, অবলুপ্ত হয়েছে বা টিঁকে গেছে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব জৈবিক সত্তা ছিল/আছে আর তার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রকাশও ঘটে। কিন্তু সেই চাকা আবিষ্কার হওয়া থেকে যত এগিয়েছে মানষের প্রযুক্তি তত অন্য জীবের নিজস্বতায় জীবনধারণের প্রাকৃতিক অধিকারটি খর্ব থেকে খর্বতর হয়েছে কিংবা ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে অবলুপ্তির পথ নিয়েছে। এই ঘটনা প্রবাহের একটা দারুণ উপভোগ্য বিবরণ আলোচ্য গল্পটি। সবথেকে চমৎকার অনুভব হলো যে পুরো গল্পটা পড়ার সময় এতকথা মনে হয় না। পরিবেশনের মুন্সীয়ানায় গল্প মাঠ জঙ্গল ভেঙে চড়তে থাকে পাহাড়ে। গল্প পরিণতি পেলে ধীরে ধীরে গল্পটা আছন্ন করে প্রযুক্তি আর জীবস্বাতন্ত্র্যের চিরন্তন সংঘাতের উপলব্ধি দিয়ে।
“ওস্তাদ” গল্পে ফুটে ওঠে ওস্তাদি করা কঠিন কিনা। গল্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও মনের ওপর লেপ্টে থাকে একটাই উপলব্ধির অনুরণন যে ব্রতধারণ না করলে বোঝা যায় না সত্যিই ব্রাত্য হওয়া গেল কিনা। “পাখিসংক্রান্ত একটা গল্প” খুব মায়াবী ভাষায় বলে যায় পাখি কেন বাসা বাঁধে আর কেন উড়ে যায়। কোন প্রেম স্বীকৃতি পায় আর কেন কোনো প্রেম অস্বীকৃত হয়। “সাহেবালির ঘোড়ারোগ” বর্তমানে আন্তর্জাতিক অনুদানপুষ্ট বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে লেখা হলেও যে কোনো অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশের ছবি পাওয়া যায় তাতে। কিন্তু বিষয়গত প্রাসঙ্গিকতা ও গাম্ভীর্য ছাপিয়ে মনে রয়ে যায় সরস কৌতুকময় কথকতার অভাবনীয় গতিময়তা।
সময়ের সাথে বদলায় ভূপ্রকৃতি আর মানুষের সাথে ভূমির সম্পর্ক, তার টানা-পোড়েনে পড়ে মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক - ব্যক্তি, শ্রেণী, সমষ্টি ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে। কিন্তু সময়ের সেই একমুখী চলনের মুখে পড়ে যাওয়া আর বিরোধিতা করা দুইই অস্তিত্বের সংকট ঘনিয়ে তোলে। এই পরিস্থিতিতে কী করতে পারে মানুষ? সেই সংকটকালের দারুণ বাস্তব কিন্তু মোহময় মায়াবী এক ছবি পরম মমতায় এঁকেছেন মানস “বিরুদ্ধাচরণ” গল্পে।
“ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু” গল্প থেকেই সম্পূর্ণ সংকলনটির নামকরণ হয়েছে। এই গল্পটিতে রয়েছে লাশকাটাঘরের কর্মীদের জীবনযাত্রার পরতে পরতে লেপ্টে থাকা মৃত্যুকামনার বিবরণ ও মূল্যায়ন। অবশ্যই তার থেকে লেখক বুনেছেন এক অবাক উপলব্ধি যে লাশকাটাঘরের কর্মীদের মৃত্যুকামনাকে কেবলমাত্র চাষীর দেখা ফসলের স্বপ্নের সাথে তুলনা করা যায়। গল্পটা সমাজের অন্ত্যজ মানুষদের অশুচি কিন্তু পুণ্যকর্ম এবং আনুপূর্বিক সেইসব মানুষগুলির নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্ক বা তাদের সাথে বাদবাকি সমাজের সম্পর্ক নিয়ে হলেও সমগ্র সমাজই যে মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে তার এক অকপট ছবি। আবার মৃত্যুর মধ্যেও, বরং বলা ভালো, ভয়াবহ মৃত্যুর মধ্যেও যে অন্ত্যজ মানুষগুলির জীবনসংগ্রামে টিঁকে থাকার সম্ভাবনাটি নিহিত থাকে সেই সত্যের উদ্ঘাটনও বটে।
“দাড়ি কামাবার জন্য শুভক্ষণ” খুব হালকা চালে বলে যায় যে একজনের নজরে যা নিতান্ত তুচ্ছ, অন্যের অবস্থানে তাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। সেটা সম্পূর্ণ ব্যক্তির সামাজিক অবস্থা ও অবস্থানজাত মনন আর বিভিন্ন ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে স্থির হয়।
এই গল্প সংকলনে অধিকাংশ গল্পই রূপকাশ্রয়ী। কিন্তু কথকতা এত সরল যে বিষয়ের গাম্ভীর্যে বা উপমার গভীরতায় পাঠ কখনোই ভারাক্রান্ত হয় না। বরং ক্ষুরধার শ্লেষ সমস্ত স্নায়ুকোষকে নুন জলে চুবিয়ে তাজা করে দেয়। দুঃখ কখনও ভারী হয়ে ওঠে না, কিন্তু একটা বিবর্ণ ছোপের মতো উপলব্ধির স্বাক্ষর রাখে। অথচ লেখকের পাণ্ডিত্যে বা দর্শনে কখনোই পাঠ আছন্ন হয়ে যায় না। এই বইয়ের সার্থকতা এটাই যে কল্পকথা বা কথাসাহিত্যের যে চিরন্তন ভূমিকা, বিনোদন যোগানো, সেই কাজটা এই বই করে ষোল আনা। ষোলর ওপর আঠার আনা পাওনা হলো সম্পূর্ণ বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা। সাহিত্য যখন কথাশিল্প তখন কথার পিঠে কথা গেঁথে সাহিত্যের সৌষ্ঠবে লেখক ফুটিয়ে তোলেন সৌন্দর্য। “ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু”র পাঠ সম্পূর্ণ হলে মন জুড়ে রয়ে যায় একটাই অনুভূতি – “সুন্দর”।
“ময়নাতদন্তহীন একটি মৃত্যু” বইতে লেখক মানস চৌধুরী আজকের বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন। তাঁর কথকতা বিত্তশ্রেণীনির্বিশেষে সাধারণের নৈমিত্তিক যাপনের ছবিটি বড়ো মমতায় মেলে ধরেছে, বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের বর্তমানকে পরিচিত করেছে। এই বইটি পড়লে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লাতিন আমেরিকার গল্প বা জন এম কটজির দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প কিংবা অ্যালিস মুনরোর লেখা কানাডার নানান কসবার গল্পগুলির কথা মনে পড়াটাই স্বাভাবিক।