শরীর কাচের টুকরো; পিনাকী ঠাকুর; প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৪, সিগনেট প্রেস - কলকাতা, পৃষ্ঠাঃ ৭২ ; ISBN : 978-93-5040-360-0
আমরা কবিতা লিখি কেন? ভাড়াটে ব্রেসিয়ারের কাহিনি লিখতে পারতাম। মান-সম্মান-প্রতিপত্তি-শ্বশুরবাড়িতে যত্ন ধান্দা পানি এসব অন্য লাইনে বেশি আছে, তবুও কবিতা! কী দরকার ছিল? আর লিখলেই বা কী না লিখলেই বা কী পাতার বিপ্লব পাতাতেই চাপা পড়ে থাকবে সময় মতো হাজার টাকা ধার দেবারও লোক থাকবে না। পালটে গেছেন বলবার লোক অনেক। যারা প্রথম জীবনে শরীর ক্ষয় করে পয়সা আর পরে পয়সা ক্ষয় করে শরীরের কথা ভাবছেন তারা কী বুঝবেন শরীর কাচের টুকরো এই তিনটে শব্দের সিম্ফনিকে? কীভাবে একটা কবিতা নির্মাণ হয়, কতটা রক্ত-ঘাম মিশে থাকে একটা কবিতার শরীরে এইসব ভাবতে-ভাবতে 'শরীর কাচের টুকরো' কাব্যগ্রন্থের পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। প্রথম একটি বা দুটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে কবি অনেকগুলি সুবিধা পান। কিন্তু বারোটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবার পর সেই কবি কী খানিক বিপন্ন বোধ করেন? এক-একটি কাব্যগ্রন্থকে যদি এক-একটি জন্ম বলে ধরি তাহলে? তেমনই এক কবি পিনাকী ঠাকুর। খুব দায়িত্বের সঙ্গে বলছি পিনাকী ঠাকুরের এক-একটি কাব্যগ্রন্থ নতুন উদ্ভাসে-উদ্দীপনায় ভরপুর। রোমন্থনের চর্চা তিনি করেন না। তাই সাত মিনিট ঝড় থেকে কালো রঙের আগুন কিংবা বিপজ্জনক থেকে চুম্বনের ক্ষত সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এই ক্রম তালিকায় নবতম সংযোজন 'শরীর কাচের টুকরো'।
প্রথাসিদ্ধ আলোচনার ভঙ্গিতে প্রথমেই বলি 'প্রেমে পড়ার কবিতা', 'বৃষ্টি ভেজা খবরকাগজ', 'গিটার হাতে সরাইখানায়' এই তিন পর্বে কাব্যগ্রন্থটি বিন্যস্ত। প্রথম কবিতা 'এখনই', সেখানে মাত্র তেরোটি লাইনে কবি এই কাব্যগ্রন্থের সুর বেঁধে দিয়েছেন। জানিয়েছেন, 'জীবন একটাই, কালকে নয়, তুই এখনই চল!' এতগুলি কাব্যগ্রন্থ ধরে পিনাকী ঠাকুরের একজন পাঠক হিসাবে লক্ষ করে আসছি গ্রাম-শহর প্রতিবেশকে আমাদের গ্রামীণ বাংলার মেঠো সুরকে তিনি বিদেশী ফ্লুটে শোনাতে পারেন। দেখুন, ওড়িশা উপকূলের পাগল মেঘ কীভাবে আমাদের মফস্সলে আসে — 'ছোট্ট দোকানের আলুর চপ / ঝড়টা থামলেই আম কুড়োই / পুকুর ভেসে গ্যাছে, ব্যাঙের ডাক।' নগরকেন্দ্রিক আপাতমননকে এই প্রেম কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেখুন, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো ঘটছেই। প্রতিদিনের ক্লিষ্ট বাস্তবতা থেকে হঠাৎ করে আমাকে কেউ প্রবুদ্ধ করছে 'বৃষ্টি ভিজলেই সর্দিজ্বর / হোক, সে দ্যাখা যাবে, ডোন্ট কেয়ার'। এই যে আমার মতো সারাক্ষণ ভয়ে কুঁকড়ে থাকা একটা ছেলেকে কবিতা বন্ধুর বেশে ঘাড়ে হাত রেখে ভরসা দিচ্ছি ডোন্ট কেয়ার। সেখান থেকেই শুরু পথচলা। যৌনতা সম্পর্কে যে লোকদেখানো শুচিতা সেই বায়ুগ্রস্ত সামাজিক পরিমণ্ডলকে এই বলে কি প্রশ্ন করা যায় না 'তুমি আমার পেপারব্যাকের বাৎস্যায়ন ফেরত দাওনি, এর পরে কী?' এক আবহমানের প্রশ্ন দিয়ে শেষ হয় 'পাগলাঝোরা' রচনাটি 'এর পরে কী?' স্যাটিসফাই, অ্যানস্যাটিসফাই, ডিস্যাটিসফাই সবারই তো ওই একই প্রশ্ন 'এর পরে কী?' চোলি কি পিছে ক্যা হে? ছন্দ ও ভাষার পরিমিত মেলবন্ধনে এই কবি বরাবরই সিদ্ধহস্ত, যাঁরা বলেন এখনকার সফল কবিদের কবিতায় কোনও বোধ নেই, শুধু চটকদারি ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ তাঁদের এই কাব্যগ্রন্থটি পড়তে অনুরোধ করছি। উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে আমাকে অনেকগুলো পাতা ওল্টাতে হয়নি, 'পাগলাঝোরা'র পরের লেখাটিতেই তার প্রমাণ পেয়ে গেলাম। কবিতাটির নাম 'নিরাপদ দূরত্বে থাকুন'। পথচলতি যানবাহন, যেমন - অটো, বাস, লরির পিছনে লেখা থাকে কত টুকরো-টুকরো শিল্প। যেমন আমি এভাবেই জেনে ছিলাম - তেলের ট্যাঙ্কের নাম খাদ্যমন্ত্রী। 'কিপ সেফ ডিসট্যান্স'-এর এরকমই বাংলা দেখা যায় — নিরাপদ দূরত্বে থাকুন। প্রেমিকা যদি একটা ধাবমান ট্রাক হয় আর তার গায়ে লেখা থাকে এই সাবধানবাণী তাহলে বুঝুন কী ঠ্যালা।
চলে আসি 'প্রেমে পড়ার কবিতা'-টিতে। আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত সমাজ আর অসম্ভব দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াইয়ের সঙ্গে মিশে আছে প্রেম। কারখানার বদ্ধ নোংরা পরিবেশ ছেড়ে একটি ছেলে লড়াই করে বাঁচার জন্য, শিক্ষার জন্য। বাড়িতে বিধবা মা, দুটো বোন, কামাই করলেই মাইনে কাটার সঙ্গে লড়াই করেও সে 'বিকেল চারটে দুই ট্রেন ধরে লোডশেডিং কলেজে যেতাম'। এই যদি একটি সমাজের গল্প হয় তাহলে এর উলটো পিঠে কী আছে? আছে সেইসব সৌভাগ্যবান সহনাগরিক যারা 'বাপের পয়সায় ওরা লাল-কালো বাইক দাপাতো মেয়ে তুলত চোখে ধরলেই'। আর এইসব দেখতে-দেখতে জীবনযুদ্ধে ধ্বস্ত শরীর ভয় পায় 'স্বপ্ন দেখলেই যদি কাঁটার বিছানা থেকে প্রেমে পড়ে যাই ...' ভয় না পেয়ে আমাদের উপায় কী? কারণ 'বেপাড়া কাঁপিয়ে ছোটে বাইক-বাহিনী'।
ঘুম থেকে উঠে সকালবেলা প্রথমেই মনখারাপের শুরু। খবর কাগজের একটা করে পৃষ্ঠা উলটালেই শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে, ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। এটা কী একটা দেশ? নাকি সার্কাসের তাঁবু পড়েছে? সবকিছু বিক্রি হয়ে গেছে বিশ্বাস-প্রেম-ধর্ম-মানবতা এখন হাস্যকর কয়েকটি শব্দ ছাড়া আর কিছু নয়। 'বৃষ্টি ভেজা খবরকাগজ' তারই একটা জীবন্ত দলিল। আমাদের সমস্ত প্রতিবাদ কী 'মোমবাতি'তেই শেষ হয়ে যাবে? কবি লিখেছেন 'ড্রাকুলারা অরক্ষিতার রক্ত খায় / চোখের জলে আমরা জ্বালাই মোমবাতি'। আর কী হাস্যকর দেখুন 'মিছিল, পালটা মিছিল করি কলকাতায়!' 'আহেলিয়া বিলাবল', 'লিকুইডিশান' সব ধ্বংসের ছবি, ক্ষয়ের চিহ্ন গায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কবিতাগুলি। একটু ভালো রেজাল্ট কিংবা সুযোগ পেলে সবাই এই সার্কাসের দেশ থেকে পালাতে চায়। সচেতন কবি পিনাকী ঠাকুর লিখছেন "নব্বই প্লাস মার্কস পাওয়া ওই ছেলেমেয়ের / লম্বা একটা 'ভারত ছাড়ো' / ভিসার লাইন"। 'ভারত ছাড়ো' কবিতার শেষ চরণটি কী নির্মম অথচ শাশ্বত 'লুকিয়ে সব বাংলা মায়ের চোখের জল'।
'শরীর কাচের টুকরো' কাব্যগ্রন্থের তিনপর্বেই আমরা ভিন্ন স্বাদের রচনা পাই। সমাজ-ইতিহাস প্রেম মিলেমিশে এই বই প্রমাণ করে যে এখনই বাংলা কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার কোনও কারণ নেই। প্রচুর আশা নিয়ে আমরা অপেক্ষা করবো পিনাকী ঠাকুরের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের জন্য।