• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | ছোটদের পরবাস | গল্প
    Share
  • মামাগিরি : সুব্রত সরকার


    মার এক নয়, দুই নয়, তিন নয় - নয় নয় করে আমার নয় মামা! লোকে বলে, নেই মামার চেয়ে কানামামা ভালো। আমার কিন্তু মামা অনেক। আর তারা কেউ কানামামা নয়। সবাই ভালো মামা। তবে গুড, বেটার, বেস্ট এভাবে যদি বলি, তবে বলব, আমার বেস্ট মামা হল নকুলমামা। মাই ফেভারিট মামা নকুলমামা। কিন্তু আমার মামি হল আট। নকুলমামার ঘরে মামি নেই। নকুলমামা ব্যাচেলার। বড় মামা, মেজমামা, সেজমামার পর ন'মামা হল গিয়ে নকুলমামা। শুধু নকুলমামার জন্যই আমার বারবার মামার বাড়ি আসতে ইচ্ছে করে। 'তাই তাই তাই, মামা বাড়ি যাই, মামা বাড়ি ভারি মজা কিল চড় নাই! —' নকুলমামার জন্যই মজাটা আমি যেন আরো বেশি বেশি করে পাই। ভীষণ এনজয় করি!

    এবারও গরমের ছুটিতে চলে এসেছি মামা বাড়িতে। মামা বাড়িতে এলেই কত মজা। আমি যেন পাখি হয়ে যাই। উড়ে বেড়াই। ঘুরে বেড়াই। এখানে নো শাসন, নো গার্জিয়ান-গিরি। এখানে শুধুই মামাগিরি। নকুলমামার সঙ্গে পুকুরে চান, নদীতে নৌকো চড়া, আমবাগানে দোল খাওয়া। গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল, হা-ডুডু, ডাংগুলি খেলি। লাল মোরামের রাস্তায় খুউব সাইকেল চালাই। গোঁসাইবাগানে গিয়ে বাউল গান শুনি। আদিবাসী পাড়ায় যাই, সাঁওতালি নাচ দেখি। ভোজের হাটে মুরগী লড়াই দেখি। ধানখেতে ছুটে ছুটে যাই। ঘুড়ি ওড়াই। ছিপ ফেলে মাছ ধরি। পায়রা ওড়াই। কত কত মজা!

    নকুলমামা সঙ্গে থাকলে কুছ পরোয়া নেই। দিল্লি টু ডেনমার্ক — নকুলমামা ফুলমার্ক! নকুলমামার এমনই জারিজুরি, মনসবদারি। যেমন পপুলার তেমন গুড লিডার। এ গ্রামের সবাই খুব মানে, কথা শোনে। আর তার কারণও আছে। এক দুই তিন করে বললে অন্তত একডজন গুণের কথা বলতে হয়। নকুলমামা এমনই গুণী এবং মুশকিল আসানকারি।

    নকুলমামা শুধু আমার মামাই নয়। এ গ্রামের সব ছোটরাই আমার নকুলমামাকে মামা বলেই ডাকে। খুব বড়রা বলেন, নকুলেশ্বর। কাকিরা বলে, নকুল।

    গ্রামে যখনই যার কোনও আপদ-বিপদ, সমস্যা হল সে ছুটে এসে ধরবে নকুলমামাকে। নকুলমামাও দৌড়ে যাবে। ঝাঁপিয়ে পড়ে তার সমাধান করবে। কখনো অর্থ দিয়ে, কখনো বুদ্ধি দিয়ে কখনো সাহস যুগিয়ে কিংবা কখনো নিছকই কৌশল খাটিয়ে চটজলদি সমাধান করতে নকুলমামার জুড়ি নেই। আমি তো মনে মনে বলি, মামা তুমি মিস্টার সলভ। ইউ ক্যান সলভ্‌ এনিথিং। এভরিথিং।

    আজ সকালে দারুণ একটা খবর খুব হৈ হৈ করে গ্রামে রটে গেল, লক্ষ্মীসায়রে নাকি শুটিং হবে। কলকাতা থেকে গাড়ি ভর্তি করে শিল্পীরা এসেছে। তাঁরা সব খুব নামি-দামী শিল্পী। সিনেমা, টিভি সিরিয়ালে তাঁদের রোজ দেখা যায়। খবরের কাগজে ছবি বেরোয়। এর আগে কোনওদিন এই গ্রামে এমন ঘটনা ঘটেনি। তাই একটা বিরাট হৈ হৈ কাণ্ড। সবাই সব কাজ ফেলে ছুটছে লক্ষ্মীসায়রের দিকে। ঘরে আর লোক নেই। পথে-মাঠে-চায়ের দোকানে কেউ নেই। সবাই ছুটছে লক্ষ্মীসায়রে।

    আমি কোনোদিন শুটিং দেখিনি, সিনেমা দেখেছি। কিন্তু শুটিং কেমন করে হয় জানি না। তাই আমারও খুব কৌতূহল হচ্ছে, শুটিং দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। নকুল মামাকে বলব কিনা ভাবছি, নিয়ে যাবে আমাকে? চল না একটু শুটিং দেখে আসি।

    মেজমামা সাইকেল থেকে নেমে বাজারের ব্যাগ নিতে বাড়িতে ঢুকেই বলল, ওরে লক্ষ্মীসায়রে তো মেলা বসে গেছে। গিজ গিজ করছে লোক। কোলকাতা থেকে নাকি শুটিং পার্টি এসেছে। শুনলাম, ওরা শুটিং শুরুই করতে পারছে না। নায়ক-নায়িকাকে দেখার জন্য এমন ভিড়, এমন চেল্লামেল্লি করছে মানুষজনরা যে সব লণ্ডভণ্ড। পরিচালকের ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা!

    নকুলমামা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে মেজমামার কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। একমুহূর্ত কি একটু ভেবে নিয়ে বলল, ডোডো যাবি নাকি শুটিং দেখতে? যাবি তো চল্‌....।

    আমি তো প্রায় লাফিয়ে উঠে বলব ভাবছি, যাব না আবার? শিগ্‌গির চলো। তার আগেই মামা আবার বলতে শুরু করেছে, এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা হলে ওরা যদি শুটিং না করে ফিরে যায় তো গ্রামের বদনাম হবে। খুব খারাপ ইমপ্রেশান হবে। এটা হতে দেয়া ঠিক হবে না। চল তো যাই।

    দূর থেকেই দেখতে পেলাম, লাইন দিয়ে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। নামি-দামী গাড়িও দু'তিনটে। কত লাইট, ক্যামেরা, ট্রলি, মেকআপভ্যান, বড় বড় থার্মোকল আর ছাতার মত গোল গোল সব জিনিস। নায়ক-নায়িকা সেজেগুজে রেডি। কিন্তু গাড়ি থেকে ওরা নামতেই পারছে না। গাড়ি ঘিরে রয়েছে সব লোকজনেরা। চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে খুব। শুটিং শুরু করাই যাচ্ছে না। এই অবস্থায় নকুলমামা আসরে প্রবেশ করল। যাকে বলে, একদম মাঝমাঠ থেকে সোজা গোলে শট্‌ এবং গো...ও...ল! নকুলমামা ভিড় ঠেলে সটান সামনে চলে গিয়ে মাথায় টুপি পরা একজনকে বলল, আপনি কি পরিচালক?

    হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই পরিচালক। আমার নাম মিলন সেন। ভদ্রলোক হাঁফাচ্ছেন। মাথার টুপিটা খুলে চুলগুলো সমানে টানছেন। এই বুঝি সব চুল ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় চলে এল!

    নমস্কার মিলনবাবু। আমি এই গ্রামেরই বাসিন্দা। আমার নাম নকুলেশ্বর মান্না। তবে সবাই নকুল বলেই ডাকে। সবাই আমাকে খুবই মানে। কথা শোনে আমার।

    তাই? পরিচালক এক গাল হেসে বললেন, তাহলে নকুলবাবু, প্লিজ আপনি আমাকে হেল্প করুন। আমি ফেড আপ হয়ে পড়েছি। এত ক্রাউড সামলাতে পারছি না। সকাল থেকে একটা শটও নিতে পারিনি। কলটাইম কখন পেরিয়ে গেছে। এঁরা সব নামি-দামী আর্টিস্ট। পেমেন্ট অনেক। আমি তো খুব বিপদে পড়ে গেছি দাদা। প্লিজ কো-অপারেট করুন একটু!

    কিচ্ছু বিপদ হবে না। আর কোনও ভয় নেই আপনার। শুটিং এক্ষুনি শুরু করে দিচ্ছি। নকুলমামা গলগল করে কথাগুলো বলে একটু থামল। সামান্য কি একটু ভেবে এবার বলল, তবে আমার একটা প্রস্তাব আছে। আবদারও বলতে পারেন। খুবই সামান্য দাবী। সেটা আপনাকে রাখতে হবে।

    হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন না কি প্রস্তাব। সম্ভব হলে নিশ্চয়ই রাখব। পরিচালক এক নিঃশ্বাসে কথাটা বললেন।

    যদিও প্রস্তাবটা আপনি আমার মুখ থেকে শুনছেন, কিন্তু আমি এই গ্রামের পক্ষ থেকে সমস্ত গ্রামবাসীর হয়ে প্রস্তাবটা রাখব।

    বলুন না, বলুন। পরিচালকের ব্যস্ততা বেড়ে যায়।

    আমাদের এই গ্রাম খুব প্রাচীন এক গ্রাম। আরও প্রাচীন আমাদের এই লক্ষ্মীসায়র। একদিন এই সায়রে মস্ত বড় একটা ঘাট ছিল। গ্রামের মা-বোন-জ্যাঠা-খুড়ো আমরা সবাই সে ঘাটে মনের আনন্দে চান করতে পারতাম। কিন্তু সংস্কারের অভাবে প্রাচীন সেই ঘাট ভেসে নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও আর নতুন ঘাট বানিয়ে উঠতে পারি নি। তাই আপনি যদি একটা নতুন ঘাট বানিয়ে দিয়ে যান তো খুব উপকার হবে। কথা দিচ্ছি, সেই ঘাট হবে আপনার ছবির নাম দিয়েই। নামটা অমর হয়ে যাবে। কি নাম রেখেছেন আপনার ছবির?

    পরিচালক হাসতে হাসতে বললেন, ময়নামতী।

    বাঃ আমরা এই নামই রাখব। সবাই বলবে, ময়নামতীর ঘাট। ঘাটের উদ্বোধনের দিন আপনাদের কিন্তু আসতেই হবে।

    পরিচালক মুহূর্তে রাজী হয়ে গেলেন নকুলমামার প্রস্তাবে। মামাও সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত থেকে কর্ডলেস মাইক্রোফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে গ্রামবাসীদের উদ্দেশে বললেন, শোন হে, তোমরা সবাই মন দিয়ে শোন, একটা সুখবর। আনন্দের খবর। কলকাতা থেকে এই সব গুণী-মানি বিখ্যাত মানুষজনরা এসেছেন আমাদের গ্রামের এই লক্ষ্মীসায়রে শুটিং করতে। এটা আমাদের কাছে খুবই আনন্দের ও গর্বের ব্যাপার। কত কত লোকজন সব জেনে যাবে আমাদের গ্রামের কথা। এই লক্ষ্মীসায়রের কথা। তাই তাঁদের সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। আমরা সেই কর্তব্য যেন ঠিকঠাক পালন করতে পারি। আর আরও একটা সুখবর, তোমরা জেনে খুশি হবে, মাননীয় পরিচালক মহাশয় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই লক্ষ্মীসায়রে একটা সুন্দর ঘাট বানিয়ে দেবেন। গ্রামের সবাই সেই ঘাটে চান করে আনন্দ পাবে। ঘাটের নাম হবে ময়নামতীর ঘাট। ময়নামতী এই যে শুটিং হচ্ছে, এই ছবির নাম। নায়িকার নামও ময়নামতী।

    গ্রামবাসীরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল। চারদিক থেকে ভেসে এল হাততালি। প্রবল হাততালি। শুরু হোক, শুরু হোক শুটিং। সবাই একসাথে বলতে লাগল।

    নায়িকা ময়নামতী হাসছে। নায়কের মুখেও হাসি। পরিচালক আনন্দে ছুটতে ছুটতে সবাইকে বলছেন, তোমরা তৈরি হও। তৈরি হও। লাইট সাউণ্ড ক্যামেরা রেডি কর। ট্রলিটা নিয়ে এসো। মুহূর্তে বদলে গেল চারপাশটা। গ্রামবাসীরা সবাই কেমন শান্ত নিশ্চুপ হয়ে গেল। শুটিং শুরু হবে। নায়ক-নায়িকা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। মেক আপ করা মুখ-চোখে তারা প্রস্তুত অভিনয়ের জন্য। আমি নকুলমামার গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছি। নকুলমামা একবার আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসল। হঠাৎ দেখি নায়ক এগিয়ে এসে নকুলমামার কানে কানে কি যেন বলছেন। দুজনে ফিসফিস করে কথা হচ্ছে। গ্রামবাসীরা তো অবাক! অবাক আমিও। ছবির নায়ক স্বয়ং নিজের থেকে এগিয়ে এসে নকুলমামার সঙ্গে কথা বলছেন! ওমা আবার হাত বাড়িয়ে কেমন হ্যাণ্ডশেক্‌ও করছেন! নকুলমামাও নায়কের হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে চলেছে। এই না হলে মামাগিরি! হা হা হা। মাই ফেভারিট গ্রেট নকুলমামা জিন্দাবাদ।

    মামাগিরি জিন্দাবাদ!



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments