• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | গল্প
    Share
  • দিবাকরের ভারতবর্ষ : অরুণ কাঞ্জিলাল


    স ওয়াজেদ আলি—দিবাকর তাঁর একজন ভক্ত পাঠক। তিনি তাঁর মত করে ভারতবর্ষকে আবিষ্কার করেছিলেন। যে ভারতবর্ষকে এখন আর কেউ খুঁজে পাবে না। নির্বোধ দিবাকর, সে তার মত করে ভারতবর্ষকে খোঁজবার চেষ্টা করে। অদৃশ্য সুতোর টানে, গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে, নগর থেকে মহানগরে ঘুরে বেড়ায়। কখনও বা ট্রেনে চেপে, কখনও বা পায়ে হেঁটে এ দেশের রহস্যময় অন্দরটাকে চেনার চেষ্টা করে। শীতের কুয়াশায়, নিদাঘের দ্বিপ্রহরে, বর্ষার অঝোর ধারায়, তার ক্লান্তিহীন পরিক্রমা অব্যাহত। চিরকালটা সে শুনে এসেছে, কিছু মানুষের পায়ে নাকি সরষে বাঁধা। জীবনের শেষবেলা পর্যন্তই নাকি সেই সরষেই বাঁধা থাকে। ভারতবর্ষের গুপ্তধন, দিবাকর সেই কৈশোর থেকে খুঁজে যাচ্ছে। হয়তো কিছুটা পেয়েছে - বেশীটাই অনাবিষ্কৃত। কেউ যায় উত্তরে, কেউ যায় দক্ষিণে, কেউ যায় পুবে, কেউ যায় পশ্চিমে। ভ্রমণের উদ্দেশ্যও ভিন্ন ভিন্ন। কেউ যায় লেখার তাগিদে, কেউ যায় প্রকৃতির রং-রূপ ক্যামেরা-বন্দি করতে। দিবাকর ব্যতিক্রমী, সে সব্যসাচী। অভিজ্ঞতাও তার ব্যতিক্রমী, নিরুদ্দেশ ভ্রমণের মত এলোমেলো।

    || মণিপুর ||

    ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে বাসটা এসে দাঁড়াল। হুড়মুড় করে আধা সামরিক বাহিনীর জওয়ানরা বাসে উঠে পড়ল। বাসের পাটাতনে তাদের শক্ত বুটের শব্দ। বাসের মধ্যে চাপা গুঞ্জন — চেকিং, চেকিং। দিবাকর বাঁদর-টুপিটায় সারা মুখ ও মাথাটা ঢেকে নিল। শুরু হল তল্লাশি — 'এ ব্যাগ কিস্‌কা হ্যায়, উতারো।' সন্ধে থেকে এই নিয়ে তৃতীয় বার চেকিং। প্রথমটা হয়েছিল ডিমাপুরে, দ্বিতীয়বার কোহিমা, এই অঞ্চলটা সম্ভবত পশ্চিম-মণিপুরের সেনাপতি কলুপ। গৌহাটি থেকে ইম্ফল। মণিপুরি গোল্ডেনের বাসে প্রায় একুশ ঘন্টা। রাস্তা বহুত খতরনাক। কিন্তু জীবনকে অনুভব করতে হলে জীবনের গহেরাইতে মাঝে মধ্যে ডুব দিতে হয়। হাঁ, ঝুঁকি আছে, কিন্তু ঝুঁকিটাই তো পুঁজি।

    'ইস বোরা মে ক্যা হ্যায়।' এক জওয়ানের ঝাঁঝালো প্রশ্ন।

    দিবাকর বাঁদর-টুপিটা খুলে উত্তর দিল, 'কিতাব হ্যায়।'

    'কিতাব কিস বাত কে লিয়ে?'

    'ইম্ফল বুকফেয়ার কে লিয়ে।'

    জওয়ান মজার স্বরে বলল, 'কিতাব বাস মে কিঁউ। রাইনো মে ভেজনা চাহিয়ে।'
    'রাইনো ট্রান্সপোর্ট মে ভেজে হ্যায়। নয়া কিতাব, লাস্টমে আয়ে, ইসলিয়ে সাথমে লে যা রহে হ্যায়।'

    জওয়ান দিবাকরের লেটেস্ট বইয়ের খবরে আর আগ্রহী নয়। সামনের আসনে বসে থাকা দুই মহিলা যাত্রীকে দেখে তার চোখের তারায় বিদ্যুতের ঝিলিক,

    'ওয়ে খড়ে হো যাও।'

    মহিলা দুজন উঠে দাঁড়াল। দুজনেরই বয়স তিরিশ-বত্রিশের মধ্যে। পরনে ফানেক ও ইনাফি। নাগা, কুকি, মেইতেই — এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষেরই আধিক্য মণিপুরে। বাইরের মানুষের পক্ষে ওদের আলাদা করে চেনা সম্ভব নয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের মণিপুর যাত্রায় দিবাকর ওদের পার্থক্যগুলো চিনতে শিখেছে। নাগা আর কুকি মেয়েদের মধ্যে কুকিরা একটু বেশি সুন্দরী। গলায় কাঠের অলঙ্কার। মেইতেইরা স্বতন্ত্র্য, কপালে শুষ্ক গেরিমাটির তিলক।

    জওয়ান একজনের নিতম্বে হাত দিল। আরেকজনের সরাসরি কামিজের নীচে। বাসের সবাই দেখছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। জওয়ান চাপাস্বরে বলল, 'তুমহারা পাস ড্রাগ হ্যায়, চেকিং মে উতরো।' মহিলা দুজন চেকিং-এর জন্য নীচে নেমে গেল। চারিদিকে নিঃঝুম অন্ধকার। বাসে একটা গোটা ভারতবর্ষ। সবাই নির্বিকার।

    পুরাণে মণিপুরকে বলা হয়েছে 'সান্না লাইবেক'। তার মানে সোনার দেশ। সত্যি সত্যিই এ দেশ ছিল মুনিঋষিদের আশীর্বাদের দেশ। গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের নাটকে উঠে আসে অন্য এক বীরাঙ্গনার গল্প— চিত্রাঙ্গদা। চিত্রাঙ্গদার গল্প আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। তাছাড়া মণিপুরের শিক্ষিত সমাজ এই গল্পের সঙ্গে মণিপুরের কোন যোগসাজোস আছে বলে মনে করে না। প্রাসঙ্গিক হল, ইম্ফল থেকে দেড়শ কিলোমিটার দূরে মণিপুর ও বার্মার সীমান্তে এক বাণিজ্যিক কেন্দ্র 'মোরে'। একদিকে মোরে, অন্যদিকে টামু। দুদিকেই অবাধে বাণিজ্য চলে ড্রাগসের! তাছাড়া মোরে অঞ্চলের পথ ধরে থাইল্যাণ্ড, ইন্দোনেশিয়া, চীনের পণ্যসামগ্রী চলে আসে মণিপুরের বাজারে। দামেও কম। মণিপুরে আজ আর কোন ইণ্ডাস্ট্রি নেই, আছে শুধু স্মাগলিং ইণ্ডাস্ট্রি। মণিপুরের মেয়েরা ভয়ঙ্কর পরিশ্রমী। তারা পরিশ্রম করতে ভয় পায় না। তাই মহিলারাই হয়ে উঠেছে চোরা-বাজারের বিক্রেতা। সেই বাজারে মণিপুরের নিজস্ব পণ্য খুঁজতে গেলে ডুবুরি নামাতে হয়। কিন্তু কথায় আছে যে হাত আগুনকে লুকায়, আগুনই একদিন সে হাত জ্বালিয়ে দেয়।

    বাস ঘন্টাখানেক একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। দিবাকরের চরিত্রের একটা দিক--সে সব সময় জীবনের রূঢ় বাস্তবকে এড়িয়ে চলে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ তার জন্মপত্রিকায় নেই। এটা হয়তো অনেকের জিনঘটিত সমস্যা। সে একবার ভাবল এই ফাঁকে টয়লেটটা সেরে আসে। উঠে বাসের দরজার সামনে আসতেই সে লক্ষ করল স্ট্যাচুর মত দাঁড়িয়ে এক জওয়ান, পিঠে আগ্নেয়াস্ত্র। ফিরে এসে সিটে বসতেই পিছন থেকে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বললেন,

    'ক্যাতা, পিসাব লগা হ্যায়, ইম্ফল যাকে করনা। অভি পুরা ফৌজ চেকিং করেগা।'

    বাসের সবাই একযোগে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ পরেই মেয়ে দুটো ফিরে এলো। পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মনে হল ডানা ভাঙা দুটো পাখি। পূব আকাশটা তখনও ভাল করে লাল হয়নি। বাস চলতে শুরু করল। মেইতেই মেয়ে দুটি ঘুমে একজনের গায়ে আরেকজন ঢলে পড়ছে।

    দিবাকরের এক অন্য ভারতবর্ষের সঙ্গে দেখা হল।

    || চম্বল ||

    সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় ধারেকাছে কোনো জন-মানুষের চিহ্ন নেই। রাস্তার দু-পাশে শুধু ফাঁকা জমি। ডান দিকে একটু দূরে মাটির পাহাড়। মাটির পাহাড়ের গা বেয়ে থরে থরে নেমে এসেছে মাটির সংকীর্ণ গিরিপথ যাকে বলে র‍্যাভাইন। চম্বল নদীর র‍্যাভাইন।

    মোরেনা থেকে গোয়ালিয়র। মধ্যপ্রদেশ সরকারের পরিবহন নিগমের বাস। ড্রাইভার বুন্দেলখণ্ডী। চম্বল, ঝাঁসি, ছতরপুর, খাজুরাহো, ভিণ্ড, মোরেনা, শিবপুরী - বুন্দেলখণ্ডী ভাষার জয়-জয়কার। উচ্চারণ হিন্দি থেকে কিছুটা ভিন্ন তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

    'সাব ইয়ে হ্যায় চম্বল ডাকাইত ক্যা বেহড়। ইস ঘাঁটিমে কই বার পুলিশ অউর ডাকাইত কে বিচ মঠভেড় হুয়ে হ্যায়। কই পুলিশ অউর ডাকাইত কা মৌত হো গয়ি।'

    দিবাকরের বুকটা ধক্‌ করে ওঠে। এই মাটির আলপথেই একবার ফুলন দেবীর সঙ্গে মধ্যপ্রদেশ পুলিশের লড়াই হয়। ফুলনের দুই শাগরেদ পুলিশের গুলিতে মারা যায়। মাটির সংকীর্ণ গিরিপথে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে কোনোরকমে প্রাণ বাঁচায় ফুলন। এরপর মুলায়েম সিং যাদবের মধ্যস্থতায় ফুলনের রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ। বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকার কভারপৃষ্ঠায় ফুলনের ছবি ছিল। সে এক অন্য গল্প। এখন অবশ্য চম্বলের সেই দিন নেই। তবে মাঝে মাঝে পরিবহন নিগমের বাসে ডাকাতির খবর শোনা যায়। মুক্তিপণ নিয়ে দর-কষাকষি চলে। তাই এই পথ এখনও পরিত্যাজ্য। তবে দিবাকরের নেশা ঝুঁকি নেওয়া। এই পথে না আসলে তো চম্বল নদীর পাশে র‍্যাভাইন দেখা হত না। স্কুলজীবনে দিবাকর একটা সিনেমা দেখেছিল - অভিশপ্ত চম্বল। মঞ্জু দে আর প্রদীপ কুমারের ছবি। প্রেক্ষাগৃহের আধো অন্ধকারে জন্ম নিয়েছিল এক স্বপ্নের। আসলে সিনেমা হল ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি। আমাদের অবদমিত বাসনার স্বপ্নপূরণের আদর্শ পীঠস্থান। আবার সিনেমাই অনেক স্বপ্নের জনক। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপান্তরিত হতে চলেছে।

    গাড়িটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে গেল। এদিকটা অন্যরকম। র‍্যাভাইন অনেকটা পিছনে ছেড়ে এসেছে। ড্রাইভার বুন্দেলখণ্ডী ভাষায় বলে উঠল,

    'হোগো'।

    মানে হয়ে গেছে। কি হয়ে গেছে? সম্ভবত গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। এখান থেকে প্রায় দু-কিলোমিটার দূরে কুখ্যাত চম্বলের বেহড় ভয়টাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। চারিপাশে একরের পর একর সর্ষে ক্ষেত। মাঠের আলপথ বেয়ে একটা লোক আসছিল। ইয়া তাগড়াই তার চেহারা। কাঁধে বন্দুক। এই জনমানবশূন্য জায়গায় সন্দেহভাজন লোক - দিবাকর খুব অবাক হচ্ছিল। লোকটা মাঠ পার হয়ে উঁচু রাস্তায় উঠে এল। এবার মানুষটাকে কাছাকাছি দেখা গেল। উচ্চতা ছ'ফুটের মতো, বিরাট তার মুখ, তার সঙ্গে মানানসই কোদালে গোঁফ। ড্রাইভারের সঙ্গে বুন্দেলখণ্ডীতে অল্প কিছু কথা সেরে রাস্তার পাশের মোটা পিপল গাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল। বন্দুকটাও হেলান দেওয়া। ওকে দেখে দিবাকরের গব্বর সিংয়ের কথা মনে পড়ল। অল্প বয়সের কোনো ছেলেমেয়ে যদি ওকে এখানে দেখে তাহলে নিশ্চয়ই ভয় পাবে।

    তবে ভয় জিনিসটা ক্ষণস্থায়ী। ভয়ের সঙ্গে যদি কিছুক্ষণ সহাবস্থান করা যায়, ভয় কর্পূরের মতো উবে যায়। দুর্বল নার্ভের মানুষের ক্ষেত্রে অবশ্যই এর ব্যতিক্রম ঘটে। দিবাকর গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারের পাশে এসে দাঁড়াল। হেল্পার ছেলেটা গাড়ির নিচে। মেরামতির কাজ চলছে। ড্রাইভার এই ডাকাত অধ্যুষিত জায়গাগুলো সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। কোন জায়গায় বিপদ আছে তা ওর জানা। সে চাপা গলায় বলল,

    'ডাকু মেহের সিং। কই খুন কর চুকে হ্যায়। আভি উনহোনে আত্মসমর্পণ কিয়া হ্যায়।'
    একটু থেমে আবার বলল,

    'বাত কিজিয়ে না!'

    কি দরকার এই রকম একজন মারাত্মক ডাকাতের সঙ্গে কথা বলার।

    'ভরোসা রাখিয়ে এইসা মৌকা বার বার নেহি মিলেগা।'

    ড্রাইভারের ভরোসায় দিবাকর এগিয়ে গেল।

    'সিং সাহাব নমস্তে।'

    মেহের সিং বেশ গর্বভরে প্রতি-নমস্কার জানাল। এরপর আলাপচারিতা জমে উঠল। মেহের সিং জানাল যে সে সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সে খুন-ডাকাতি, অপহরণ এসব ছেড়ে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করবে। মেহের সিং এও জানাল যে সে বাঙালিদের পছন্দ করে। তরুণ ভাদুড়ী নামে একজন বাঞালি সাংবাদিকের সহযোগিতায় সে আত্মসমর্পণ করে। উনি ছিলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংয়ের বন্ধু। বর্তমানে সে কিষান। সর্ষের চাষ করে। সে গর্বের সঙ্গে এও জানাল যে সারা ভারতে যতটা সর্ষের তেলের চাহিদা তার অনেকটাই যোগান দেয় তার রাজ্য মধ্যপ্রদেশ। চাষবাস ছাড়াও সে সমাজসেবা করে, মানুষের বিপদে সাহায্য করে। সরকার মেহের সিংকে ক্ষমা করে দিয়েছে।

    দিবাকরের ভিতরে একটা প্রশ্ন ফিরে ফিরে আসছিল। দুরুদুরু বুকে সে জিজ্ঞাসা করল,

    'বন্দুক কিস লিয়ে?'

    মেহের সিং প্রথমে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। বলল,

    'লাইসেন্স হ্যায়।'

    'ফির ভি, যব আত্মসমর্পণ কর হি চুকে হ্যায়, তব বন্দুক কিস বাত কে লিয়ে হ্যায়?'

    'খতরা হ্যায়।'

    'খতরা কিস বাত ক্যা?'

    দুর্দ্ধর্ষ ডাকাত মেহের সিং কেমন যেন আনমনা হয়ে গেল। উদাস গলায় বলল,

    'জিন জিন কো ম্যায়নে খুন কিয়া হ্যায়, উনকে বাচ্চে অউর রিস্তেদার মুঝে মাফ নহি কিয়া। কভি ভি হামলা হো সকতা হ্যায়। ইস লিয়ে বন্দুক সাথমে রাখতা হুঁ।'

    গাড়ির ইঞ্জিন গর্জে উঠল। মেহের সিং যেন চমকে উঠল। মরচে পড়া বন্দুকটাকে হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। অসহায় গলায় বলল,

    'তব তো কিষান মেহের সিং ফির সে ডাকু বন জায়েগা।'

    সেই নাম-নিশান হীন চম্বলের প্রান্তরে দিবাকরের আর এক ভারতবর্ষের সঙ্গে দেখা হল।

    || চায়নাটাউন ||

    ষের অকেজো দাঁত দুটো উপড়ে ফেলতে গিয়ে অল্পবয়সি ডাক্তারটা গলদঘর্ম হয়ে গেল। সম্ভবত মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বড় ডাক্তাররা ওদের দিয়ে এখন থেকেই হাত পাকায়। সাঁড়াশিটা এখনও ঠিকমতো ধরতে শেখেনি। পরপর দুটো ইঞ্জেকশন দিয়ে বসিয়ে রেখেছে আধঘন্টা। এখন অ্যানেস্থেসিয়ার রেশ কেটে গেছে। দাঁত তুলতে গিয়ে রক্তারক্তি হয়ে গেল - কাজের কাজ কিছুই হল না।

    হাসপাতালের বেঞ্চে দিবাকর শুয়ে ছিল। ঠিক পুরুষের মত গলায় বয়স্কা নার্স চেঁচিয়ে ডাকল,

    'দিবাকর দেবশর্মা কে?'

    'এই যে এখানে।'

    নার্স হাতের কাগজটার দিকে চোখ রেখেই বলল,

    'ব্লাড সুগার পিপি টু-ফিফটি'।

    'তাহলে?'

    'সুগার কমিয়ে আসুন। এখানে অ্যান্টিবায়োটিক লেখা আছে। জেনেরিক মেডিকেল শপ থেকে নিয়ে নেবেন।'

    জেনেরিক শপ মানে হাসপাতালের ন্যায্য মূল্যের দোকান। ওখান থেকেই ইঞ্জেকশন কিনেছিল দিবাকর। হোপলেস। হাসপাতালের বাইরে এসে ট্যাক্সি খোঁজে সে। জৈষ্ঠ্যের প্রখর রোদ। একজন লম্বা ঢ্যাঙা লোক দিবাকরকে লক্ষ্য করছিল। ডানগালে স্টিকিং প্লাস্টার-এ সাঁটা তুলোর ঢিবি। এগিয়ে এসে বলল, 'দিবাকর না?'

    'হ্যাঁ, আপনি?'

    'আমি কৃষ্ণেন্দু। চিনতে পারছিস না?'

    এবার চিনেছে দিবাকর। নিমতা স্কুলের কৃষ্ণ। চিনবে কি করে, টাক পড়ে গেছে। দিবাকর গলা খাঁকারি দেয়। বলে, 'কেমন চলছে?'

    'ওই একরকম। হাসপাতালে এসেছিলাম। রোগটা প্রাইমারি স্টেজে আছে। ওষুধ পড়লেই সারবে।

    'প্রাইমারি স্টেজ মানে কি?'

    খুব আস্তে, প্রায় দিবাকরের কানে কানে বলে কৃষ্ণেন্দু 'ক্যানসার'।

    গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে দিবাকরের। তুলোয় ঢাকা আছে একটা নালি ঘা। ঘায়ের ভিতর পচন। একটা কালো হাত নালি ঘা বেয়ে নেমে আসছে বুকের উৎসের দিকে। মানুষটা কিন্তু নিশ্চিন্ত। বড় অবাক লাগে। একটা বাস সিগনালে আটকে ছিল। সেদিকে তাকিয়ে কৃষ্ণেন্দু বলল, 'বাসটায় উঠে শিয়ালদা চলে যাই। শিয়ালদা মার্কেটটা ঘুরে যাই। শস্তায়-গণ্ডায় যদি কিছু পাই তো সকলের জন্য একটু জামাকাপড় নিয়ে যাব। পুজোর তো আর দেরি নেই।'

    দিবাকর প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য বলে, 'কদিন ঘুমোতে পারিনি। দুটো দাঁত বড় কষ্ট দিচ্ছে। সুগার আছে। হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দিল।'

    বাসের ফুটবোর্ডে উঠে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণেন্দু চেঁচিয়ে বলে, 'চায়নাটাউন চলে যা। ওরা বংশপরম্পরায় দাঁতের ডাক্তার।'

    'চায়নাটাউন কোথায়? কলকাতার কোন প্রান্তে চায়নাটাউন?'

    এসব প্রশ্নের উত্তর ফিরে এল না। বাসটা এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বাল্যবন্ধু কৃষ্ণকে নিয়ে শিয়ালদা পাড়ি দিল। শিয়ালদায় দোকান পসার একটু শস্তা হয়। সম্ভবত এটাই তার শেষ পুজোর বাজার।

    চায়নাটাউন খুঁজে পেতে বেশ অসুবিধা হল। কেউ বলল যেখানে কলকাতার সব জঞ্জাল ফেলা হয়, সেই দিকটায়। কেউ আবার বলল, চারিদিকে ট্যানারি, পচা চামড়ার গন্ধ, সেই দিকটায়। রীতিমতো কনফিউসিং। দিবাকরের বন্ধু অমিত। বয়সোচিতভাবে এক সময় সিনেমা মুগ্ধ ছিল। এখন সিনেমার এন্‌সাইক্লোপিডিয়া বলা চলে। অনর্গল কাঁধ ঝাঁকিয়ে হিন্দি অথবা ইংরাজি বলার ঝোঁক। এসব ম্যানারিজম সে আয়ত্ত করেছিল প্রেক্ষাগৃহের গা-ছমছম করা অন্ধকার থেকে। চায়নাটাউন শুনে সে প্রথমে কাঁধ ঝাঁকাল। তারপর বলল, 'শক্তি সামন্তকা ফিল্ম, শাম্মি কাপুর-শাকিলা, ১৯৬২। বেস্‌ড অন চরস, ওপিয়াম ডেন্‌স রান বাই নেটিভ চাইনিজ।' একটু থেমে আবার বলল, 'চায়নাটাউন। দ্য অনলি চায়নাটাউন ইন ইণ্ডিয়া ইজ্‌ ভেরি নিয়ার টু ট্যাংরা।'

    পরদিন বিকেলে দিবাকর পৌঁছে গেল চায়নাটাউন। ড. চেন্‌স ডেন্টাল ক্লিনিক। শ্লিপে নাম লিখে বেয়ারার কাছে দিয়ে বসে অপেক্ষা করছে আরও তিন-চারজন। চারশো টাকা ফি দিতে পারে এমন কয়েকজন। দিবাকর একবার বাইরে বেরিয়েছিল। বিশাল সব পাঁচিল ঘেরা কম্পাউণ্ড। তার মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ রাস্তা। রাস্তার ধারে ধারে চাইনিজ রেস্টোর‍্যান্ট। হক্কাস, বেজিং ... সব অদ্ভুত নাম। হোর্ডিং-এ ড্রাগনের ছবি। জায়গাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। কলকাতায় থেকেও যেন কলকাতায় নয়।

    চৈনিক ডাক্তার যখন একটা বাঁকানো শলা দিয়ে দাঁতদুটোকে খোঁচা দিচ্ছিলেন, তখন প্রবল যন্ত্রণার মধ্যেও দিবাকর স্থির ছিল। ডাক্তারের হাসিতে আত্মবিশ্বাস। দাঁত খুঁচিয়ে ডেন্টিস্ট পরিষ্কার বাংলায় বললেন, 'ওয়াল ভেঙে গেছে, কেভিটি নার্ভ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তুলে ফেলতে হবে।'

    দিবাকর আরামদায়ক দাঁত তোলার চেয়ারটায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে ছিল। পর পর ডাক্তারদের ছবি - ড. পি. সি. চেন্‌, ড. কে. সি. চেন্‌। সম্ভবত এরা ডাক্তারের পূর্বপুরুষ। কোন ভারতীয় মনীষীর ছবি নেই। ডেন্টিস্টের চেম্বারে বসে তার মনস্তাত্ত্বিক এক ধরনের সাহস কাজ করছিল। একই সঙ্গে তার অনুসন্ধিৎসু মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। খুব স্বাভাবিকভাবে সে জিজ্ঞাসা করে, 'আপনারা কয় পুরুষ কলকাতায় আছেন?'

    হিটারে জল গরম হচ্ছিল। ডাক্তার হাত ধুতে ধুতে বললেন, 'ওয়ারেন হেস্টিংস যখন ব্রিটিশ ভারতের প্রথম গর্ভনর জেনারেল তখন থকে।'

    এক মহিলা এসে ওয়াল ভাঙা দাঁতের গোড়ায় একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে গেল। ইনিই ডাক্তারের স্ত্রী। নতুবা বোন। এরা পুরো পরিবার একসাথে কাজ করে। ইঞ্জেকশন দেওয়ার সাথে সাথে দিবাকরের চোয়াল-মাথা পাথর হয়ে গেল। হ্যাঁ, সে ঠিক জায়গাতেই এসেছে। রিয়াল প্রফেশনালিজম্‌। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে আরও একপ্রস্থ ইঞ্জেকশন। ভদ্রমহিলা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন পর্দার ঘেরাটোপে। ছোটো বড়ো প্রায় ত্রিশ-বত্রিশটা সাঁড়াশি ঝুলছে।

    ডাক্তার এলেন। হাসিতে বরাভয়। বললেন, 'টং অছি নামে একজন চীনা ব্যবসায়ী কলকাতা থেকে একুশ মাইল দূরে, হুগলী নদীর পাড়ে একটা চিনি কল স্থাপন করেন। জায়গাটার নাম আজও অছিপুর। উনিই আমাদের ফোর-ফাদার। হাঁ করুন।'

    দিবাকর হাঁ করল।

    'দাঁতের জন্য মায়া হচ্ছে নাতো?'

    এতকাল ডাক্তার, সার্জারি ইত্যাদি বিষয়গুলো সে সন্তর্পণে এড়িয়ে এসেছে। এই প্রথম শরীরের নিখুঁত নক্সায় একটা খুঁত ঢুকে যাবে। দিবাকর হ্যাঁ না কিছুই বলে না। ডাক্তার একটা সাঁড়াশি বাছাই করল। দক্ষ হাতে একটা দাঁত উপড়ে সামনের গামলায় ফেলল। একটু পজ্‌, ডাক্তার সামনের চেয়ারটায় বসলেন, একটু ইমোশনাল। বললেন,

    'একটা সময় চাইনিজ কার্পেন্টার বৌ-বাজার এলাকায় জড়ো হত। জায়গাটা এখনও কার্পেন্ট্রির জন্য বিখ্যাত। এরপর শ্যু-মেকিং। চাইনিজ ওন্‌ড ট্যানারিস। তবে আপার কাস্ট হিন্দুরা আমাদের প্রফেশনকে ঘৃণা করত। বলত চামার।'

    উদ্ধত সাঁড়াশি আবার দিবাকরের মুখ-গহ্বরে প্রবেশ করল। এক ঝটকায় দ্বিতীয় কালপ্রিটটাকে তুলে নিয়ে এল। গামলায় টক করে ফেলে ডাক্তারের গলায় আফশোসের সুর, 'তবু চাইনিজরা ভারতীয় নয়। এক সময় কুড়ি হাজার চাইনিজের শব্দে চায়নাটাউন গমগম করত। এখন মাত্র দু'হাজার।'

    বাইরে একটা ছাইরঙা সন্ধে। আকাশে মেঘ আছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। রেস্টোর‍্যান্টগুলোর সামনে গাড়ির বি লাইন। ঐতিহ্যবাহী চাইনিজ খাবারের লোভে কলকাতার বিত্তশালী লোকেরা এখানে সন্ধেবেলা ভিড় করছে। কত লোক কত সুখে আছে। আলোয় ঝলমল করছে। ড্রাগনের মুখ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে। ডাক্তারের কথাটা তখনও কানে বাজছে — চাইনিজরা ভারতীয় নয়। হাঁটতে হাঁটতে দিবাকর চায়নাগেট পার হয়ে ভারতবর্ষের মাটিতে পা দিল।

    (ক্রমশ)



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments