'অবোধ'
— কে বললো কথাটা? ওই শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারীর স্মিত মুখটি?
— নাকি ওই সদ্যোজাত সুস্থিরদৃষ্টি সরীসৃপটি?
গভীর বিস্ময়ে ভাবলেন নিখিল।
এবং ভাবতে থাকলেন।
—তাহলে কি ঘটে গেল এতক্ষণ ধরে?
সেক্ষেত্রে একেবারে গোড়া থেকে ঘটনাটিকে ধরা যাক—
সেই রাতে নিখিল চক্রবর্তীর চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছিল সহজেই। জীবনের সত্তরটি বসন্ত পার হোলো সেদিন নিখিলের। অতি সাধারণভাবেই তিনি পার হয়ে গেছেন এই দীর্ঘ সাংসারিক জীবনের পথটুকু। একটি মধ্যমানের সরকারি চাকরি আর স্ত্রীপুত্রকন্যার যৎসামান্য দায় বহন করে কেটে গেছে তাঁর জীবনের সিংহভাগ।
এইভাবে জীবনের অনেকটা পথ অতিক্রম করে বর্তমানে তিনি কিছুটা ভারমুক্ত। তাই এই সত্তরতম জন্মদিনটি তিনি নিজের মতো করে কাটাতে পারলেন। নিজের মতো করে অর্থাৎ তাঁর পরমারাধ্য ঈশ্বর ভাবনায় সম্পূর্ণভাবে মগ্ন হয়ে।
শিশুকাল থেকেই নিখিল গভীরভাবে ঈশ্বরবিশ্বাসী। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা আরো গাঢ় হয়ে ঘিরে ধরেছিল নিখিলকে। ফলে সাংসারিক এবং ব্যবহারিক জীবনকে কিছুটা লঘু করেই গুরুত্ব পেয়েছিল নিখিলের এই ভগবৎচর্চা। এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে বর্তমানের আপাত নিশ্চিন্ত দিনগুলি তাঁর ঈশ্বরভাবনায় নিবেদিত।
অতএব গোটা দিনটা কাটলো তাঁর ইষ্টদেবতার বিশেষ মন্দিরটিতে। আর দিনশেষে বাড়ি ফিরে তাঁর সাধের ঠাকুরঘরে ওই একই বিগ্রহের পদপ্রান্তে। এমনকি রাতে শোয়ার সময় জানালা দিয়ে আসা পূর্ণচাঁদের আলোয় কোনো ভাবান্তর হল না নিখিলের। 'সারাজীবন তোমার কথাই ভেবেছি। এবার তোমার চরণে আমায় ঠাঁই দাও' — নিজের মনে এই কথা বলতে বলতে নিখিল চক্রবর্তীর চোখে ঘুম জড়িয়ে এল সহজেই।
সেই অচেতনে ঘুমের মধ্যেই তিনি অনুভব করলেন কে যেন আশ্চর্য স্বরে তাঁকে বলছে — 'তুমি কি প্রস্তুত যাওয়ার জন্য?'
নিখিল ব্যাকুল হয়ে উত্তর দিলেন - 'নিশ্চয়ই।'
— 'পারবে তো? এইসব কিছু ছেড়ে বরাবরের মতো চলে আসতে?'
— 'অবশ্যই। সারাজীবন ধরে আমি তো এই চেয়েছি।'
— 'তাহলে এসো।'
— 'কোথায়?'
— 'তোমার ইষ্টদেবতার কাছে।'
— 'চলুন চলুন। এখুনি চলুন।'
এইকথা বলার একটু পরেই নিখিল স্পষ্ট অনুভব করলেন যেন এক নির্ভার দেহে তিনি ভেসে চলেছেন এক দিব্যপথে — পিছনে পড়ে থাকা তাঁর ঘরবাড়ি লোকালয় ক্রমশ ছোটো হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে - যেন এক আকাশগঙ্গায় ভাসতে ভাসতে সহস্র নক্ষত্রের সীমানা পার হয়ে তিনি উপস্থিত হলেন এক আশ্চর্য প্রাসাদের দ্বারে। সেখানে অসংখ্য স্ফটিকের খণ্ড যেন অদৃশ্য সুতোয় ঝুলছে চারিদিকে।
— 'তাহলে এটিই কি সেই স্বর্গের দ্বার?' - নিজের মনেই বলে উঠলেন নিখিল।
'কি চাই তোমার?' - কোথা থেকে ভেসে এল এক কঠিন কণ্ঠস্বর। নিখিল দেখলেন এক প্রকাণ্ড বরাহের আকৃতিতে কেউ যেন এসে দাঁড়ালো তাঁর সামনে।
'ভিতরে যাবো। আমার ইষ্টদেবতার কাছে' - উত্তর দিলেন নিখিল।
— 'তোমার পরিচয়?'
— 'পরিচয়? আমি নিখিল। নিখিল চক্রবর্তী' - কিছুটা ভয়ে কিছুটা সম্ভ্রমে উত্তর দিতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল নিখিলের। কোনো প্রত্যুত্তর এল না। কথাগুলি যেন ঢেউয়ের মতো ফিরে এল নিখিলেরই কাছে।
খানিকক্ষণ এভাবে কেটে গেলে অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে নিখিল বলে ফেললেন - 'আমি সামান্য মানুষ। কিন্তু ঈশ্বরের সেবাতেই জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়েছি।'
আরো খানিকক্ষণের নীরবতার পর উত্তর এল -
— 'কোথা থেকে আসা হচ্ছে?'
— 'পৃথিবী।'
— 'পৃথিবী?'
— 'হ্যাঁ পৃথিবী। যেখানে ভগবানের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের বাস।' নিখিলের কথার কোনো উত্তর এল না। সেই বরাহরূপীও যেন কোথায় চলে গেলেন। এক দীর্ঘ সময়ের পর নিখিল অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন - 'কি হল? আমার ঈশ্বরের কাছে আমায় যেতে দিন।'
'অসম্ভব' — উত্তর এলো অত্যন্ত কঠোর কণ্ঠে। নিখিল দেখলেন ওই বরাহরূপী আবার এসে দাঁড়িয়েছেন এক প্রকাণ্ড স্বর্ণময় দেহে। নিখিল স্তম্ভিত হলেন। কোনোক্রমে বলতে পারলেন - কেন?
— 'তুমি ঠিক কোথা থেকে আসছো তা বোঝা যাচ্ছে না।'
— 'ঠিক আছে। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি।'
— 'আমি দ্বারপাল। আমাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।'
— 'তাহলে? তাহলে কি হবে?'
— 'অপেক্ষা কর। আমাদের তথ্যবিশারদ আসবেন। তাঁকে বুঝিও।'
— 'কখন? কখন আসবেন তিনি?'
নিখিলের এই আকুল প্রশ্নের কোনো উত্তর এল না। নিখিল পরম বিস্ময়ে দেখলেন ওই স্বর্ণদেহ বরাহটি ক্রমশ একটি প্রকাণ্ড সোনার পাহাড়ে পরিণত হলেন। এক প্রগাঢ় স্বর্ণিল নিস্তব্ধতায় ডুবে গেল চারিদিক।
বহুক্ষণ পরে সেই নীরবতা ভেঙে ভেসে এলো এক স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর - আমি তথ্যবিশারদ। আমাকে তোমার পরিচয় জানাও।'
নিখিল দেখলেন এক শ্বেতকূর্ম এসে হাজির হয়েছে তাঁর সামনে। কথাগুলি বলছেন ওই শ্বেত কূর্মটিই। নিখিল তৈরি হয়েই ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন — 'আমার নাম নিখিল চক্রবর্তী। আমার পিতা স্বর্গত নির্মল চক্রবর্তী। আমাদের সাত পুরুষের বাস ...' নিখিলের কথা থামিয়ে সেই শ্বেত কূর্ম বলে উঠলো — 'তোমার পৃথিবীর পরিচয় জানাও।'
— 'পৃথিবীর? পৃথিবীর পরিচয়? ভারী অদ্ভূত প্রশ্ন তো!' নিজের মনেই বলে উঠলেন নিখিল। তারপর বেশ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন —
— 'আমি পণ্ডিত নই। সামান্য লেখাপড়া জানা মানুষ। তাও যা জানি তাই বলছি। পৃথিবী একটি গ্রহ। আরো কয়েকটি গ্রহের সাথে সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। এদের মধ্যে শুধু পৃথিবীতেই প্রাণ আছে। আর এত লক্ষকোটি প্রাণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল মানুষ। কারণ তার সবচেয়ে উন্নত মগজ আছে। ভগবান তাঁকে সবচেয়ে বেশি যত্ন করে সৃষ্টি করেছেন। আর আমি সেই মানুষ। বুঝলেন?' প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে ফেললেন নিখিল।
শ্বেত কূর্মটি তার ছোট মাথাটা বার করে নিখিলের মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলল — 'আমরা তোমার কথার সত্যতা যাচাই করছি। যথাযথ হলে নিশ্চয়ই ডেকে নেব।'
এরপর আবার কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে। নিখিল অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন — 'কি হল? কি করছেন এতক্ষণ ধরে?'
— 'খোঁজ চলছে।।' উত্তর এল সাথেসাথেই।
— 'খোঁজ? কিসের খোঁজ?'
— 'সেটা তোমাকে বোঝাবেন আমাদের ব্রহ্মাণ্ডবিশেষজ্ঞ। ধৈর্য ধর।' - এই কথা বলে কূর্মটি তার ছোট্ট মাথাটি তার খোলসের নীচে ঢুকিয়ে নিল তারপর সে ধীরে ধীরে একটি ছোটো প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হল। নিখিল হাত দিয়ে সেটিকে স্পর্শ করতে যেতেই সেটি গড়াতে গড়াতে কোথায় যেন চলে গেলে।
এরপর যেন এক অমেয় সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর এক নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর শোনা গেল —
'পৃথিবী নামে কোনো গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেল না;' এক গভীর ক্লান্তিতে ডুবে থাকা নিখিলের কানের পাশ দিয়ে কথাগুলি ভেসে চলে গেল। খানিক বাদে নিখিলের মনে হল - একটু আগে কেউ যেন কিছু বলে গেল! কোনোক্রমে চোখ তুলে তাকিয়ে নিখিল বলতে পারলেন —
— 'কে বললেন? কি বললেন কথাটা?'
তখনই নিখিল দেখতে পেলেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এক সহস্রমুখ লক্ষচক্ষুবিশিষ্ট বিশাল অবয়ব! তিনিই উত্তর দিলেন যেন এক যান্ত্রিক কণ্ঠে —
'পৃথিবী নামের গ্রহটির এখনো কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না।'
— 'সেকি? কেন? - প্রায় আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন নিখিল।
সহস্রমুখের একেকটি একেকবার নড়েনড়ে বলতে লাগল —
'ঈশ্বরের মহাবিশ্বে অসংখ্য নক্ষত্রজগৎ আছে। ব্রহ্মাণ্ডের এই অজস্র নক্ষত্রের মধ্যে অতি নগণ্য তোমাদের সৌরজগৎ। তার ভিতর এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র গ্রহ তোমার ঐ পৃথিবী। তাই তার পরিচয় নির্ধারণ করতে অনেক সময় লাগবে। তারপর স্থির হবে তোমার পরিচয়। অতএব ধৈর্য ধর।'
কথাগুলি শুনে অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে নিখিল উত্তর দিলেন — 'আমি ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ। আমি তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। আমার আর কোন পরিচয়ের প্রয়োজন?'
এবার সেই সহস্রাননের সমস্ত মুখ একযোগে একসাথে বলে উঠল —
'পৃথিবী ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নয়। মানুষ ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ কীর্তি নয় কারো আরাধনার জন্য ঈশ্বর বসে নেই। আমাদের হিসেবে যখন তোমার পরিচয় পাওয়া যাবে তখন তোমায় ডাকা হবে। অপেক্ষা কর।'
বলতে বলতে সেই সহস্রমুখের লক্ষচক্ষু একযোগে ভীষণভাবে ঘূর্ণিত হতে লাগল।
নিখিল চিৎকার করে বলে উঠলেন —
'প্রয়োজন নেই। কোনো প্রয়োজন নেই আমার। সারাটা জীবন যাঁর ভাবনায় কাটিয়েছি ভালো করে লেখাপড়া শিখিনি - মন দিয়ে চাকরি করিনি - ভালোভাবে সংসার প্রতিপালন করিনি - শুধু সময় পেলেই তাঁর পায়ের কাছে গিয়ে বসবার জন্য - তাঁর কাছে আমার পরিচয় দাখিল করতে হবে?'
তারপর একটু থেমে আস্তে আস্তে আবার বলতে শুরু করলেন —
'ঈশ্বর, তোমার সংসার এত বড় আমি জানতাম না। তাই আমার মত যারা তাদের তোমার চোখে পড়ে না। আমার কোনো পরিচয়ই নেই তোমার কাছে। সেইজন্যই তোমার দেখা পেলাম না এত কষ্ট করেও।'
এরপর যেন আর কিছু বলতে পারছিলেন না নিখিল। কিন্তু অতি কষ্টে ফের বললেন আরো কটি কথা —
'এর চেয়ে আমার বাড়ি ভালো - আমার ঘর আমার পরিবার - আমার স্ত্রী পুত্র কন্যা - সেখানেই ফিরে যাব - অন্তত আমার ঠাঁইটা তো আছে সেখানে। তার আর অপেক্ষার দরকার নেই। আমি আসি' — বলতে বলতে গলা বুজে গেল নিখিলের।
আর তখনই যেন এক গাঢ় অন্ধকার সহসা ঘিরে ধরল নিখিলকে। আর সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে যেন কোন অতলে হু হু করে নামতে থাকলেন নিখিল। নিখিলের দম আটকে এল। সংজ্ঞা লুপ্ত হল ওই অপার অন্ধকারে।
যেন এক অমেয় সময় পার হয়ে যাওয়ার পর সেই নিকষ কালো অন্ধকারে হঠাৎ যেন ফুটে উঠলো এক রূপোলী আলোর বিন্দু। তারপর ধীরে ধীরে সেই বিন্দুটি ক্রমশ বড় হয়ে এক নিখুঁত বৃত্তে পরিণত হল। নিখিল অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর চোখের সামনে পূর্ণিমার বিশাল চাঁদ! সেই চাঁদের আলো যেন অভ্রের মতো ঝরে পড়ছে একটি প্রকাণ্ড গাছের উপর।
গাছটাকে ভীষণ চেনা মনে হল নিখিলের। আরে! এটাতো তার বাড়ির সামনের প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছটা! আর তখনই নিখিলের চোখে পড়লো সেই গাছের লাগোয়া তার বড় সাধের ছোট্ট বাড়িটাকে। নিখিলের মনে হল সেই আশ্চর্য আলোয় বাড়িটাকে মনে হচ্ছে একটা রূপোয় মোড়া রাজপ্রাসাদ। সেই মুহূর্তেই যেন নিখিলের সব গ্লানি কেটে গেল। নিখিল তাঁর বাড়িতে ঢুকলেন। কতকাল বাদে কে জানে!
নিখিল প্রথমেই ঢুকলেন তাঁর ছোট্ট বসার ঘরটি, একি! এ যে একেবারে বদলে গেছে! তাঁর সময়ের সামান্য দুটি বেতের চেয়ার আর একটি ছোটো কাঁচের টেবিলের বদলে ঝকঝকে সোফা সেট। সিলিং থেকে ঝোলা বাল্বের বদলে ঘরের কোণে হাল্কা আলোর বাহারি স্ট্যাণ্ড ল্যাম্প। দেওয়ালে বরাবরের আকাশী রঙের বদলে ডিমের হলুদের মতো গাঢ় মায়াবী রঙ।
নিখিল লক্ষ্য করলেন সেই দেওয়ালের গায়ে টাঙানো তাঁর পিতৃদেবের ছবিটি সেখানে নেই। তারপরেই নিখিল দেখলেন ঘরের কোণে রাখা ছোটো টুলটিতে বসে আছেন তাঁর বাবা! 'কখন এলি?' শীর্ণ মুখটি তুলে প্রশ্ন করলেন তিনি। নিখিল অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। কারণ তাঁর পিতৃদেব তো স্বর্গত হয়েছিলেন তাঁর কোন্ শৈশবে!
ভারী আশ্চর্য ব্যাপার তো! - নিজের মনেই কথাগুলি বলতে বলতে যেন কোন অজ্ঞাত ভীতিতে কেঁপে উঠলেন নিখিল।
এর পরের ঘরটি নিখিলের বড় আদরের কন্যা সুমু অর্থাৎ সুমেধার। কতদিন বাদে নিখিল আবার দেখতে পাবেন তাঁর মেয়েকে। সেই আনন্দ আর আগ্রহ নিয়ে নিখিল ঘরে ঢুকলেন।
একি। একেবারে বদলে গেছে মেয়েটার চেহারা; কি অদ্ভুত রুক্ষ আর উগ্র। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবছা হলুদ আলোয় একমনে মুখে কিসব ঘষে চলেছে।
নিখিল ঘরের চারিদিক দেখতে লাগলেন। ঘরের কি চেহারা করেছে। যে ঘরকে নিখিল প্রতি সপ্তাহে নিজে হাতে করে পরিষ্কার করে ছবির মতো ঝকঝকে করে রেখে দিতেন, সেই ঘরের কোনোদিকেই তো তাকানো যায় না। একদিকে ডাঁই করা হয়েছে এক রাশ জামাকাপড়। অন্যদিকে বইপত্তরের স্তূপ। তারই মাঝে ছড়ানো ছেটানো জলের গ্লাস টিফিন কৌটো চশমা ব্যাগ আরো কত কি।
এই সবকিছু অত্যন্ত খুঁটিয়ে দেখছিলেন নিখিল। কিছু কি খুঁজছিলেন তিনি? তাঁর কোনো ছবি? হয়তো সামান্য ফুলচন্দন দেওয়া হয়তো শুকনো ফুলের মালা ঝোলানো অন্তত ছোটো একটা ছবি।
নেই। কোত্থাও নেই। নিখিল আহত হলেন। গভীরভাবে। আর তখনই ঘরের আয়নায় দেখলেন তাঁর আত্মজার মুখটি। কি আশ্চর্য আধোআলোয় মনে হচ্ছে ঠিক যেন ছোটোবেলায় দেখা তাঁর পাগলী পিসির মুখখানি। অজান্তেই চমকে উঠলেন নিখিল।
এবার তাঁর নিজস্ব ঘর। যেটি একসময় ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত। ঘরের দরজা ভিতর থেকে ভেজানো। ঢুকতে গিয়ে নিখিলের মনে হল এ ঘরের ভিতরে ঢুকে আবার কি দেখবেন কে জানে। অতএব যথেষ্ট সংকোচের সঙ্গে নিখিল ঘরের ভিতরে এলেন। আর ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন তিনি।
ঘরের কোণে বসানো দুটি বৈদ্যুতিক বাক্স ঠিকরে বেরোচ্ছে জগঝম্প বাজনার আওয়াজ। আর সেই বাজনার তালে তালে সারা শরীর ঝাঁকিয়ে গিটার বাজাচ্ছে তাঁর পুত্র সমু অর্থাৎ সোমরাজ। যার সঙ্গে কোনোদিনই সহজ সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি নিখিলের। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেরিয়ে এলেন সেইঘর থেকে। যেন এক ধাক্কা খেয়ে নিখিল বুঝলেন তাঁর নিজস্ব ঘরটি এখন তাঁর পুত্রের আওতায় এসে গেছে যথার্থভাবে।
'তুমি আবার এখানে কেন?'
— কে বললো কথাটা! নিখিল দেখলেন কে একজন কথাটা বলেই তাঁর পাশ দিয়ে চলে গেল হন্হন্ করে। 'আরে। এ আমার সেই ছোটো শালাবাবুটি না? কিন্তু সে তো বহুদিন ধরেই নিখোঁজ। বেঁচে আছে কিনা সন্দেহ। সেই বাউণ্ডুলেটা কোত্থেকে এসে ...' নিজের মনেই ভাবলেন। নিখিল ভাবলেন এবং বড় বীতশ্রদ্ধ হলেন নিজের প্রতিই।
এরপর সামনে বাঁয়ে সেই ঘর যেখানে নিখিল ও তাঁর স্ত্রী সুমনা দীর্ঘ চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। এই ঘরের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে নিখিলের অসংখ্য সামান্য স্মৃতি। তবুও বড় দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এঘরে ঢুকলেন নিখিল।
ঘরে হাল্কা নীল আলো। স্ত্রী সুমনা অঘোরে ঘুমোচ্ছে বিছানায়। নিখিল দেখলেন এই বিছানায় নিখিলের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে এখন ঠাঁই পেয়েছে সুমনার টুকিটাকি জিনিসপত্র - জলের বোতল - পানের ডিবে - গল্পের বই ইত্যাদি ইত্যাদি। নিখিল অতি সন্তর্পণে সুমনার পাশটিতে গিয়ে বসলেন। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে।
ঘরের হাল্কা নীল আলোয় বড় পরিপূর্ণ লাগছিল সেই মুখশ্রী। বড় স্নিগ্ধ ও সুখাবিষ্ট। আগের তুলনায় বেশ মোটা হয়ে গেছে সুমনা।
নিখিল দৃষ্টি ঘোরালেন। এদিক ওদিক। এ ঘরেও বদলে গেছে অনেক কিছু। নতুন আলমারি। নতুন কাঠের বাহারি র্যাক। দামি কাচের ল্যাম্পসেড। কেবল দক্ষিণ দিকের জানালার কাছটা একই রকম আছে। একই রকম আছে তাঁর ছোট্ট কাচের আলমারিটা। তার উপরে সেই পুরোনো রেডিয়োটা। তার পাশে কবেকার কাঠের ডেট ক্যালেণ্ডারটা। এইভাবে তার প্রাণের জিনিসগুলো পড়ে আছে সাতপুরু ধুলোয়। দেখে খুব কষ্ট হল নিখিলের।
অন্যত্র তাকাতে যাবেন হঠাৎ তাঁর চোখ আটকে গেল ওই কাঠের ডেট ক্যালেণ্ডারের পাশে রাখা একটি ছোট্ট জিনিসে। নিখিল সেটির কাছে এগিয়ে গেলেন। স্বল্প আলোতেও সেটিকে চিনতে ভুল হল না নিখিলের।
সুমনার ঘরে মধ্যরাতের আবছায়াতে সে হাসছে। নিখিলের দিকে তাকিয়ে। পরনে কলার তোলা পাঞ্জাবী। চোখে চৌকো চশমা।
— 'মজা লাগছে না?'
— 'খুব মজা লাগছে আমায় দেখে?'
— 'তা তো লাগবেই।'
নিখিল বললেন সেটিকে উদ্দেশ্য করে।
'তা তো লাগবেই। তোমার যে একটা জায়গা জুটেছে এখানে। যদিও কোন্ জন্মের ধুলো ময়লার মধ্যে। কোন্ কালকার বাসি মালার পিছনে। তবুও একটা জায়গা তো। তাও আবার নিজের স্ত্রীর ঘরে! আর কি চাই?'
'কিন্তু আমার তো কোনো স্থান নেই হে। আমার নিজের এত কষ্টে বানানো এই বাড়িতে - এই পরিবারে। ভারি মজার ব্যাপার - তাই না?'
কথাগুলি বলে মাথা নীচু করে কোনোক্রমে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন নিখিল।
তাহলে? তাহলে এখন কি করি? বাড়ির সবাই কি চমৎকারভাবে ভুলে গেছে আমাকে। কোত্থাও কোনো ঠাঁই নেই আমার। এখন কোথায় যাব আমি? ভাবতে বড় কষ্ট হল নিখিলের। তখনই হঠাৎ মনে পড়ে গেল তাঁর - ঠাকুরঘর! হ্যাঁ ঠাকুরঘর। ঠাকুরঘরটাতে তো এখনো যাওয়া হয়নি। ভাবতে ভাবতেই দ্রুত ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়লেন তিনি।
ঘরটা যথেষ্ট অন্ধকার। অবশ্য পূবদিকের ছোটো জানালাটা থাকায় অন্ধকারটা দ্রুত কেটে যাচ্ছিল। সেই আলো আঁধারিতেই নিখিল বুঝলেন সমস্ত ঠাকুরঘরটা যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। নিখিল অন্ধকার হাতড়ে এগিয়ে গেলেন তাঁর ইষ্টদেবতার বিগ্রহের দিকে।
আবছা আলোয় শঙ্খচক্রগদাপদ্মে শোভিত সেই মূর্তিটি হেলে পড়ে আছে একদিকে। তাঁর মুখের স্মিত হাসিটি সম্পূর্ণভাবে ঢেকে গেছে অযত্নের ঘন ধুলোয়। নিখিল দেখলেন মূর্তিটির কাছে গিয়ে।
'কি অবস্থা!' - নিজের মনেই বললেন নিখিল। বলতে বলতেই তাঁর মনে হল এককালে কত যত্নে দুহাতে পরিষ্কার করেছেন এই বিগ্রহ - আর আজ তিনি সম্পূর্ণ অপারগ। ভাবতে ভাবতে ইষ্টদেবতার পড়ে থাকা মূর্তিটির আরো কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। তারপর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেই পতিত মূর্তিটির মুখের দিকে।
তখন বড় কষ্টে কোনোক্রমে তিনি বলতে পারলেন — 'আজ আমার কোথাও কোনো ঠাঁই নেই গো।'
— 'তুমি যদি সত্যিই থাকতে তাহলে এখন অন্তত এসে দেখা দিতে।'
বলতে না বলতেই নিখিল দেখলেন শেষরাতের আবছা আলোয় যেন একটা সাদাটে ডিমের মতো বস্তু পড়ে রয়েছে তাঁর ইষ্টদেবতার হস্তধৃত পদ্মটির উপর। তারপর নিখিলের চোখের সামনেই সেই স্বপ্নালোকে ডিমটি ফুটে বেরিয়ে এল একটি সদ্যোজাত টিকটিকির মুখ। যেন এক পরম প্রজ্ঞায় সে তার প্রগাঢ় দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে নিখিলের মুখে।
নিখিলও স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন ওই উন্মুখ আত্মপ্রকাশের দিকে।
আর তখনই দিনের প্রথম আলো যেন সস্নেহে মুখে এসে পড়লো নিখিলের।
ঘোর ভাঙলো তাঁর। বুঝলেন শেষরাতে ঘুমের ঘোরেই তিনি এসে হাজির হয়েছেন তাঁর ঠাকুরঘরটিতে।
— হয়তো স্বপ্নতাড়িত হয়ে।
— কিংবা এক বিভোর চৈতন্যে।
— ঈশ্বরের খোঁজে।
— অবোধের মতো।
কারণ তখনই যেন তিনি শুনলেন .......
(বিখ্যাত দার্শনিক ব্রাটাণ্ড রাসেল-এর ছোটোগল্প 'দি থিওলজিয়ানস নাইটমেয়ার' এর দ্বারা প্রাণিত)