• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৭ | জুলাই ২০১৪ | গল্প
    Share
  • একটি অবাস্তব প্রস্তাবনা : শ্রাবণী দাশগুপ্ত


    লঙ্গ লাশটা ধ্বসে যাওয়া গুদোমঘরের কোণে বেড়ে ওঠা মস্ত গাছটায় রাতভর ঝুলেছিলো। মজা খালের পাশের ঝোপঝাড়ে জমাট অন্ধকার। গাছের ঘেরাটোপে সকালের আলো ঝিমোনো। বড্ড কন্‌কনানি, বরফঠাণ্ডা। মরার আগেও কালো জাঙিয়াটা ছাড়েনি লোকটা। আব্রু ছাড়তে চায়নি? কে জানে। ঘাড় মট্‌কে গিয়ে মুখটা ঝুঁকে পড়েছিলো। জিভের আগায় কয়েকফোঁটা শুকনো রক্ত। মাথা নেড়া। বয়স অনুমানে চল্লিশ বা কাছাকাছি। দশাসই নয়, পেটানো চেহারা। কাঠের বারকোশের রঙ। জেগে থাকা পেশীগুলো ঠাণ্ডায় ডিপফ্রিজের মাছের মতো। পুলিশ এসে নামালো, কাপড়ে মুড়িয়ে ভ্যানে তুললো।

    —বাবাগো!

    আবিষ্কারের আতঙ্কে কেষ্ট হাঁপাচ্ছিলো।

    —মরে গেছে না এখনো নিঃশ্বাস পড়ে?

    —কে লোকটা? চেনা তোর?

    কতজন ছুটে গিয়েছিলো দেখবে বলে। দু’চারটে প্যাংলা বাচ্চাও নাচতে নাচতে।

    —এরে দেখেছি তো...!

    —কেউ মেরে টাঙ্গিয়ে দিয়ে গেলো নাকি?

    সন্দেহ করেছিলো অনেকে। তখনই নামিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেললে ল্যাটা চুকে যেতো। ভেবেওছিলো। সুধীর মণ্ডল আটকালো,

    —চুপ চুপ! জানা নাই, আগেভাগে ছুঁস্‌নে। পুলিশে খবর দে।

    পুলিশে ছুঁলে সতেরো ঘা জানা কথা, তবু একপক্ষে নিশ্চিন্ত। কে জানে কী ঘটনা! ইদানিং কিছু অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা এগ্রামেরই নয়। শীতের দিন, বডি পচবে না তাড়াতাড়ি। গাছের ফাঁক দিয়ে কুয়াশায় ভারী ঢিলেঢালা চিকরিবিকরি রোদ্দুর ঝুলন্ত লাশে। একটু একটু দুলছিলো। ‘বডি বানিয়েছিলিস্‌ বটে! একেবারে সিক্‌প্যাক্‌... হায়রে, মরলি কেন?’ মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে ফেলা বিপিন হাড়গিলে চেহারা কম্বলে মুড়িয়ে বেজায় কাঁপছিলো।


    খান দিয়ে পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ওটা হাইওয়ের সঙ্গে জুড়ে যাবে। জায়গাটা মফঃস্বলের কাছাকাছি হয়েও এখন অবধি গণ্ডগ্রাম। অবাধ মাঠক্ষেত, কাঁচাপথ, পুকুর, ডোবা। নিধনযজ্ঞে কাটা-পড়া ঝোপঝাড় আর মাটি থেকে খুঁড়ে বের করা বড় গাছের গুঁড়িগুলো মুখ থুবড়ে আছে। খোবলানো ডেলাডেলা মাটি। ক্রেন, বুলডোজার...। পুরো আয়োজনটায় রণক্ষেত্র রণক্ষেত্র চেহারা। শীতের বিবশ অবেলায় ধুলোর গন্ধে নাক বুঁজে আসে। কিছু লোক কাজ পেয়েছে, যতদিন ধরে রাস্তা বানানো চলে। উদাস মাটির পথ বেয়ে কেউ সাইকেলে আসে, কেউ হেঁটে। সীমানা ধরে কতগুলো অস্থায়ী নোঙরা, ঘিঞ্জি, ছিরিছাঁদহীন কুঁড়ে। একটা চায়ের ঝুপড়ি। দূরের লোকগুলো এখানে এসে নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। জগা আর বসিরকে একদিন থানা থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। ওরা যতোটা জানে সত্যি বলেছিলো,

    —লোকটার নাম দামু - দামোদর, সার। কন্ট্রাকটারের খাতায় লেখা আছে দেখে নিবেন। সাকিন কোথায়, বাড়িঘর কোথায়, কিছু জানিনা। খালি কাজের সময় আমাদের সঙ্গে থাকতো। অদ্ভুতপনা বটে... সারাদিন মুখই খুলতো না সার। বোবা যেন! আর কী স্বাস্থ্য! বলদের মতো খাটতো। থানার বড়বাবু একটু চিন্তিত,

    —হুঁ। মিথ্যে বলছিস্‌ নাতো? লাশটা মর্গে পচ্‌ছে...। ওর গাঁয়ের, ফ্যামিলির কেউ এলোনা...।

    ওরা ভয়ে ভয়ে ছিলো। কে জানে কার অপরাধ? মৃত্যুটা খুন না অপঘাত না নিছক আত্মহত্যা? অবশেষে পুলিশসূত্রে জানা গেলো দামোদর আত্মহত্যা করেছে। গ্রামের মানুষগুলোর কাছে মরে যাওয়া জীবনবৃত্তের স্বাভাবিক অপরিহার্য ঘটনা। তার বেশি কিছু না। ভাবনাটায় জন্মগত বা স্বতঃসিদ্ধ একধরনের দাশনির্কতা থাকতে পারে। আদতে শান্তিপ্রিয় হয়েও রোজকার জীবনে কত কারণে দলাদলি, ঝগড়া কাজিয়া মারামারি পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। কিছুদিন পরে মিটমাট হলে আবার অভ্যস্ত যাপন। সেভাবে ইতিমধ্যে দামোদরের মৃত্যু ও মৃত্যুদৃশ্য গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিলো। লোকটা চুপচাপ ও একলা। ঘনিষ্ঠ হয়নি, কাছে আসেনি। শুকনো মাঠের একদম শেষ মাথায় কুঁড়ে। প্রথমদিনেই ওটাতে থানার লোক তালা মেরে দিয়ে গিয়েছে। এমনিতে ওদের ওখানে যাবার এদের প্রয়োজন হয়না। দেখেশুনে বরং আমোদ হয়েছিলো,

    —ভালো। বন্ধ থাক্‌, ভূতপ্রেত আছে!

    —না কাকা গুপ্তধন... চোরাই মাল। মিলিয়ে নিও। ধরা পড়ার ভয়ে...!

    —লোকটা নির্ঘাৎ অপকম্‌মো করে এসেছিলো। মরে গিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলো। দেখিস্‌নি এক্কেবারে কথা বলতো না?

    —শুধুমুদু কেচ্ছা রটিয়ে কী লাভ? ভালোমন্দ মিলিয়ে সকলে। কে-ই বা জানি কার দুখদরদ? নিজেকে মেরে ফেলা কী মুখের কথা? খুব কষ্ট!

    —ঠিক কথা। আমরা পারি কই? কিন্তু নিজেকে মেরে ফেলা কি ঠিক? কোনো ভালো কাজ?

    অজ্ঞাতে জন্ম নেয় সহমমির্তা। সকলে প্রায় একমত হয়ে বলে, নিজেকে মেরে ফেলা ভারী কঠিন। বাচালতা হঠাৎ থেমে যায়। ভাবতে থাকে মরতে গেলে আদৌ কোনো কারণ লাগে কিনা। নিজের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ নষ্ট করার অধিকারবোধ কি ব্যক্তিবিশেষের লুকোনো চিন্তায় থিতু থাকে? ওরা জ্ঞানতঃ অতশত বোঝেনা। আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে রহস্যের বাস। কিন্তু দামোদরের নীরবতা, দূরত্ব, স্বাস্থ্য, পরিশ্রমের সাথে কিছু মিল নেই। অনেক প্রশ্ন উঠে আসতে পারতো। বদলে ওদের মধ্যে অদ্ভুতভাবে সেঁধিয়ে যায় ভিজে ভিজে ভালো না লাগা। আজকাল ঝগড়ার অজস্র কারণ তৈরি হয়েও ঝগড়া বাধেনা। উদাসীন হয়ে যায়, কী লাভ? থাক্‌না যা আছে। নিজেদের ছোটোখাটো বদলগুলো ওরা চিনতে পারেনা। সমস্তটা অবাস্তব ঠেকে।


    খানে অনেকে নেশা করে কমবেশি। জীবনরস। অথচ বিপিন প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানের বাঁশবাঁধা বেঞ্চিতে বসে ঝিমোয়। হাবভাব বদলায়নি তেমন। মাথায় কিলবিলে চিন্তা। শীতভাঙা কোন্‌ দুপুরে গড়াতে গড়াতে খবর এনেছিল সে-ই,

    —দেখে এলাম, থানা থেকে লোক আসছে। তালাটা ভাঙ্‌বে গো।

    ওরা শুনলো। প্রায় অপরিচিতের একান্ত কুঠুরিতে উঁকি দেওয়ার গেঁয়ো কৌতূহল আর ছিলোনা। বরং চোরা অস্বস্তি... কেন মরেছিলো? আর পাঁচজন খেটে খাওয়াদের মতো হিজিবিজি সুখদুঃখই তো ছিলো লোকটার? না আরো কিছু? কাজ ফেলে, খাওয়া ফেলে উঠে এসেছিলো কতোজন। ফাল্গুনের শেষ। সকাল থেকে কড়া ঝাঁঝাঁ রোদ্দুর। অথচ, হঠাৎ মাঠের মাথার আকাশটাতে কীরকম একফালি ঠাণ্ডা মেঘ। বৃষ্টির মেঘ চেনে গ্রামের মানুষ, সেরকম ঠিক নয়। সেই মেঘটুকু চুঁয়ে চুঁয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। বিশ্বাস অবিশ্বাসে হতভম্ব দলটা কনস্টেবল জয়রামের পিছু পিছু হাঁটছিলো। কোনো প্রত্যাশায় নয়। জয়রাম বিরক্ত হয়নি, হাসছিলো,

    —গুপ্তধন পেলে ভাগ দেবোরে তোদের। কপাল খোলে কিনা দ্যাখ!

    দামোদরের আস্তানা এতো সামনে থেকে কেউ দেখেনি আগে। শুকনো নারকেলপাতা, গাছের সরু ডাল, প্লাস্টিকের চাদর, কাঠের ভাঙা টুকরোটাকরা দিয়ে বেশ একরকমের পাখির বাসার মতো। দরজাটা টিনের। কোত্থেকে জোগাড় করেছিলো সেই জানতো। তাতেও আবার তালা! জয়রাম কিছু না বলে মুখ বেঁকিয়ে হাসলো। গোঁফে তা দিয়ে হাতের ব্যাটন নাচালো,

    —আমি বলার আগে ঢুকবে না কেউ, মনে রেখো। দাঁড়িয়ে থাকো বাইরে।


    রা দাঁড়িয়েছিলো ধৈর্য ধরে। উত্তেজনা নেই, ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি নেই, আলোচনাও নয়। এই শৃঙ্খলা হয়তো স্বাভাবিক নয়... এরকম হওয়ার কথা ছিলো? থম্‌থমে মৃত্যুর নিশানায় স্থবিরতা স্তব্ধ হয়ে আছে। পেছনে বাঁজা পেয়ারাগাছ খুব ঝাঁকড়া। একটু জায়গা বেড়া দিয়ে শাকসবজি ফলিয়েছিলো দামু নামে লোকটা। অনেকদিন জল পায়নি। পৃথিবীর অতল থেকে রসদ নিয়েছে, বেঁচেও আছে। আগাছা গজিয়েছে। মাচায় সবুজ লাউ... ডগাগুলো মাটি ছুঁয়েছে। দূর থেকে দেখেছে অনেকে, মাটি কোপানোর সময়ে দামুর পেশল শরীর নেচে নেচে উঠতো। তেলতেলে ঘাম, চকচকে কালো। অন্য সুখ কিম্বা যৌনতা? সারাদিনের পর অন্ধকার অপরিসর অভ্যস্ত বিছানায় এখানে অন্তত রমণের জন্যে তার কেউ ছিলোনা। ঘরের সামনে কাঁচা বাঁশের বেড়াটা ভেঙে পড়েছে। উড়োখুড়ো ডেলা মাটি কাঠ হয়ে ফেটে আছে। জয়রাম চাড় দিয়ে ভাঙলো তালা। একা ভেতরে ঢুকলো। বাকিরা বাইরে অপেক্ষায়। সময় হলে, ডাক পড়লে তবেই যাবে। মিনিটদশেক পরে বেরলো জয়রাম। খালি দু’হাত ধুলোয় হলদেটে। ধীরেসুস্থে সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে, শান্ত গম্ভীরভাবে বলেছিলো,

    —যাও। তেমন কিছু নেই। দেখো, কিছু দরকার লাগলে নিয়ে নাও।

    ওরা সাবধানে ঢুকলো। প্রায় পা টিপে টিপে... কেউ যেন অসন্তুষ্ট না হয় অনধিকার প্রবেশে। ঘরে জানালা, ঘুলঘুলি কিছু নেই। দমবন্ধ করা অন্ধকার। চোখ সয়ে গেলো একটু পরে। তাদের ঘরের মত ঠাণ্ডা ভ্যাপসা নিস্তেজ। এলোমেলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে জয়রাম। মাদুর বিছানা কাঁথা বালিশ, একআধটা স্টিলের বাসন, পোড়া ডেকচি। দড়িতে ঝোলানো ধূসর ময়লা জামাপ্যান্ট গামছা তেমনিই। ময়াল সাপের ভার নিয়ে চেপে বসেছিলো আজব শিরশিরানি। কিছু নেবার ইচ্ছে হলোনা। লোভ হলো না। দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো।

    —সত্যি কিচ্ছু নেই এখানে। এগুলো আমাদেরও ঘরে... এই... এইরকম জিনিষপত্তর!

    —কিসে আলাদা ছিল? কিন্তু কেমন যেন মনে হচ্ছে...!

    কেউ স্বগতোক্তি করলো শান্তভাবে, অজুহাতের মতো। যেন কেন আলাদা, দেখার জন্যে ওরা জমায়েত হয়েছে। চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো কেউ কেউ,

    —থাকগে যা আছে... চল্‌। সময়ের দাম অনেক। কাজ কামাই হলে মজুরি কাটবে।

    সদ্যপ্রাপ্ত উপলব্ধির তাগিদে ভীড় হাল্কা হয়ে এলো। দাঁড়িয়ে রইলো মোটে চারজন। তাদের একজন বিপিন। জাদুঘরের প্রত্নবস্তু দেখার মতো আলতো করে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো চেনা ও পুরোনো সব। ঘুপচি ঘরখানায় ভালো করে কিছু নজরে আসেনা। এককোণে ছোট্ট জলচৌকির ওপরে যত্নে রাখা একরাশ কাগজ এলোমেলো ঘেঁটে গেছে জয়রাম। বিপিন তুলে ধুলো ঝাড়লো। দৈনিক খবরের কাগজ। আপাদমস্তক শিউরে উঠলো। লেখাপড়া জানত বুঝি দামোদর? ঘুণপোকা বাঁশের খুঁটি কাটছে, তার টানা আওয়াজ নীরবতা ভাঙ্‌ছিলো।


    ম্মোহকের মতো ডাকছিলো ঘরের পেছনদিকে মজা খাল। পেয়ারাগাছ প্রচণ্ড দুলছিলো। জমা মেঘটুকু থেকে চাপা আলোর ইশারা। হলুদ সবুজ নীল মিলিয়ে চারপাশে অবাস্তব রঙের কাণ্ডকারখানা। চারজনে সেখানে নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিলো বলতে পারবেনা। বিপিনের হাতে খবরের কাগজগুলো। আস্ত কাগজ নয় অবশ্য, ছবির কাটিং, ব্লো-আপ। ঝাপসা হওয়া ছবির মানুষকে ঠিকঠাক চেনা যায়না। হঠাৎ আলো পড়ে কোথা থেকে? ওদের মনে পড়ে গেলো স্পষ্ট, দেখেছে ওরা। শান্ত সৌম্য অশীতিপর বৃদ্ধ। ক্লাবের টেলিভিশনে দেখিয়েছে রোজ... ছ’সাত মাসের পুরোনো ঘটনা একটা।

    —ইনি তো জমিজমা ঘরবাড়ি দান করে গেছেন মানুষের জন্যে!

    —রেডিওতে শুনেছিলাম, টেলিভিশনে দেখেছি। মনে পড়ছে।

    —এগ্রামে ওঁর বাপঠাকুরদার বসত ছিলো জানিস্‌? কত একর ধানীজমি।

    —সব দান করে গেছেন বলছো?

    —স-ব। তাই তো শুনেছি তখন।

    জোরে নিঃশ্বাস ফেললো কে একজন।

    —যার থাকে সে-ই দিতে পারে রে। আমরা পারি? আমাদের আছেটা কি?

    একথাটার মধ্যে কোনো তিক্ততা ছিলোনা, হিংসের বিষ ছিলোনা। কেমন ব্যথা, ব্যর্থতা, আফশোষ। স্বাভাবিক পরিচ্ছন্ন শোনালো।

    —তাতো ঠিক। আমাদের আছেটা কি? কিন্তু মন চায় কি দান করতে?

    —ভেবে দেখিনি।

    —উনি আর কী যেন দিয়েছেন... মনে পড়েনা। দ্যাখ্‌তো।

    কি দিয়েছেন? চম্‌কে উঠে ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিলো। কবে স্কুলমুখো হয়েছিলো, ভুলে গেছে। যে দু’চারজন ঠিকঠাক পড়তে জানে, পড়ে দেওয়ার জন্যে উপস্থিত ছিলোনা। তবু অবাস্তব চেষ্টা... আলোতে ওরা মেলে ধরল কাগজের অংশগুলো। বড়বড় শিরোনাম। বিস্ময়ের গণ্ডি পেরিয়ে নিজেরাই পড়তে পারছিলো পরিষ্কার। “মরণোত্তর দেহদান”, “জনকল্যাণে নিজের শরীর দান”, “দেহদান করে অমর রইলেন মহাত্মা” এরকম কঠিন ও বিশিষ্ট হেডিং। ভয়ানক অবাক কাণ্ড। কিন্তু... কিন্তু, থিরথিরথির কাঁপছিলো চারপাশের ঝুপসি অন্ধকার, ঝোপজঙ্গল। একই সঙ্গে বুকের মধ্যে চমৎকার ভালো লাগা, ঝিরঝিরে কষ্ট।


    —দেহদান! মানে, নিজের শরীরখানা অন্য কোনো মানুষকে?

    —পোড়ালেই তো সব ছাই আর ভস্ম। তা’লে?

    —পোড়ায়নি... দেখো দেখো এইযে... ওনার অঙ্গ অঙ্গ রাখা শহরের হাঁসপাতালে।

    —যার দরকার নিতে পারে নাকি? শরীরটাকে দান? এমন ভাবি না... এমন জানিওনা।

    —দামু ভেবেছিলো নাকি এমন কথা? কতো আদর করে জমিয়ে রেখেছিলো কাগজের জঞ্জাল!

    স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছিলো ওরা। স্তব্ধ। সূক্ষ্ম সংযোগের তিরে ধরতে পারছিলো একে অন্যের আলোড়ন। অদ্ভুত রসায়ন! চোখ নরম মাটি। অনুসন্ধানের আগ্রহ মিটে গিয়েছিলো। বললো কেউ,

    —আলাদা... অন্যরকম ছিলোগো মানুষটা। চিনতে পারোনি কেউ! কিন্তু কে পেলো তার দান? পুলিশ খুঁজেও জানতে পেলোনা। খেটেপেটে অমন শরীর বানিয়েছিলো শুধু দিয়ে দেবার জন্যে? ভেবে মাথা নিচু করলো বিপিন। আহত হলো অপরাধবোধে।

    —এখন আর হয়না? দামু যেটা চেয়েছিলো...?

    —কি করে? কিছু নেই আর।

    —হাড়গোড়? কঙ্কাল-কাঠামো? সেগুলো শেষ নাকি?

    —কি করব তবে আমরা এখন? সবাইকে ডাকি?

    —নাঃ, ডেকে কি হবে গো? বরং নিরালার মানুষ নীরবে থাকুক না কেন?

    —তাহলে এসো।

    ওরা চারজনে মুহূর্তে পরস্পরের দিকে তাকালো। কাগজের মোটা বাণ্ডিল ধরে একসাথে ধরে ছুঁড়ে দিলো শুকনো ডোবায়, যেটায় শীতের সময়ে জল প্রায় নেই। হঠাৎ ওদের চমকে দিয়ে বগবগিয়ে উঠলো জলের ঘূর্ণি। তলিয়ে গেলো পুরোনো সব কাগজ। কী তৃপ্তি! ওরা ফিরে আসছিলো স্মিতমুখে, সুবাস নিয়ে। সেই সারারাত প্রবল ঝড় উঠেছিলো। সমুদ্র থেকে নাকি জন্ম নিয়েছিলো ঘূর্ণিবায়ু। বিদ্যুতের আলোয় যারা বাইরে নজর করতে পেরেছিলো, দেখেছিলো বর্শার ফলার মতো বৃষ্টি অসংখ্য হাতের আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছে। সকালে সেসব চিহ্ণও ছিলোনা। উজ্জ্বল পরিষ্কার। ওরা কাজ করতে এসে আলোচনা করেছিলো। আশ্চর্যি, কিচ্ছু ক্ষতি হয়নি কারো। ভয়ও পায়নি কেউ। অথচ মাঠের সেই শেষে নারকেলপাতা ছাউনির কুঁড়েটা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। উধাও হয়েছে ভোজবাজিতে। আর একরাত্তিরেই সামনের ধূধূ মাঠ ভরে গজিয়েছে ঘন সবুজ ঘাস। রাতভর তাদের মূলে লেগে থাকা আকণ্ঠ তৃষ্ণা মিটিয়ে নিয়েছে।


    মাঝে মাঝে বিপিন এসে দাঁড়ায় মজা ডোবার পাশে। ওপর থেকে একেবারে শুকনো, জল দেখা যায়না। মনে মনে ভাবে, পঞ্চায়েতকে বলে একটা “থান-টান” করে দেওয়া যায় কিনা জায়গাটা। ভাবে, তারপর নিজের মনে বলে, থাক্‌... কী দরকার ওসব?



    অলংকরণ (Artwork) : অলংকরণঃ অনন্যা দাশ
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments