যাঁর অসামান্য সংগ্রহে হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদমালার সংবাদ পাই, সেই অকালপ্রয়াত বিদ্যোৎসাহী বিনয়কুমার নন্দীর স্মৃতিতে এই রচনা নিবেদিত হল। তাঁর পুত্র অয়ন নন্দীর সৌজন্যে এই গ্রন্থাবলীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে।
এই নিবন্ধের প্রয়োজনে ‘কথা’ শব্দটির প্রয়োগ অবশ্য খুব সাবধানে (অর্থাৎ, যথেষ্ট অবধানের সঙ্গে) করতে হবে। বাংলাভাষায় ‘কথা’-র অর্থক্ষেত্রটি সুবিস্তৃত। ‘কথা’ মানে শব্দ, উক্তি, আলাপ, বক্তব্য, প্রতিশ্রুতি, বিষয়, প্রসঙ্গ, সংবাদ, গল্প বা কাহিনি, ইতিহাস, আরও কত কী। এত অর্থবৈচিত্র্য অপূর্বভাবে কাজে লাগাতে পারেন যে-কোনো বাঙালিই। বর্তমান প্রসঙ্গে আমরা শুধু ‘কাহিনি’, এবং তার একেবারে কাছাকাছি ‘ইতিহাস’, অর্থটিই ব্যবহার করব।
আখ্যান-মধ্যস্থ অন্য আখ্যানকে যদি উপাখ্যান বলি সেটাও একপ্রকার সংজ্ঞা নিরূপণের সুবিধার্থে। যুগ যুগ ধরে ‘আখ্যান’ ও ‘উপাখ্যান’ শব্দের যে প্রয়োগ-পরম্পরা তার মধ্যে এমন প্রভেদের কোনো সাক্ষ্য নেই। যখন লেখা হয় ‘রামায়ণ উপাখ্যান রচিল বাল্মীকি’ তখন বোঝা যায় আস্ত কাহিনিটাই উপাখ্যান। অথবা যখন বলা হয় ‘এই আখ্যান পুষ্টি ও আয়ুর্বৃদ্ধিকর ... এই ... রম্য উপাখ্যান পাঠ করিলে বেদাধ্যয়নের তুল্য ফলপ্রাপ্তি হয়’ (মহাভারত), তখন ‘আখ্যান’ ও ‘উপাখ্যান’-এর মধ্যে কোনো প্রভেদই সূচিত হয় না। বস্তুতপক্ষে, পুরাণ ইতিহাস কথা আখ্যায়িকা, বৃত্ত ইতিবৃত্ত পুরাবৃত্ত পূর্ববৃত্ত অথবা বৃত্তান্ত, এবং আখ্যান ও উপাখ্যান, এই শব্দসমূহ প্রায় সমার্থক ভাবে অনেককাল ব্যবহার হয়ে এসেছে। সকলেরই অর্থ পূর্বসংঘটিত বিষয়ের উক্তি বা বর্ণন, অর্থাৎ এক অর্থে সকলই ইতিহাসরূপী গল্প শ্রেণির সাহিত্য। এর মধ্যে ‘আখ্যায়িকা’ ও ‘কথা’ কিছুটা বিশিষ্টার্থক শব্দ; তারা সংস্কৃতভাষার দু’টি সাহিত্যধারার নাম। উভয়ই গদ্যসাহিত্য, তাদের সংজ্ঞা বিষয়ে কিছু প্রভেদ আছে। নিজের বা অপরের জ্ঞাত বিষয়ের বর্ণনকে ‘আখ্যায়িকা’ বলে, আর ‘কথা’ হল কাল্পনিক বিষয়ের বিবরণ। ‘আখ্যায়িকা’-র বক্তা নায়ক স্বয়ং; ‘কথা’ নায়ক বা অন্য ব্যক্তির মুখেও বিবৃত হতে পারে। এই প্রভেদটি সূক্ষ্ম ও চমৎকার, তবে প্রয়োগ ও প্রচলনের অনিশ্চয়তা অনুধাবন করলে একেও খুব আঁটোসাটো বা অলঙ্ঘনীয় হয়তো বলা চলে না।
উপরোক্ত সংজ্ঞানুসারে ‘কথা’ যদি একান্তভাবেই গদ্যসাহিত্য হয় তাহলে আমাদের আলোচ্য কবি সোমদেবভট্ট বিরচিত ‘কথাসরিৎসাগর’ সর্বার্থে ‘কথা’-জাতীয় সাহিত্য নয়। এর মধ্যে কিছু গদ্যাংশ থাকলেও এটি প্রায় ২২০০০ শ্লোকে রচিত। আবার, একে যদি ‘কথা’ ও ‘আখ্যায়িকা’-র প্রভেদের আলোতে দেখি তাহলেও একে জ্ঞাত না কাল্পনিক বিষয়ের বিবরণ বলব সেই শ্রেণিবিচারে দ্বিধা দেখা দেয়। প্রেমাকুলা পার্বতীকে অর্ধদেবতা বিদ্যাধরদের কাহিনি শুনিয়েছিলেন মহাদেব; সেই কাহিনি বররুচি বলে গেলেন কাণভূতিকে; কাণভূতি বললেন গুণাঢ্যকে; গুণাঢ্য তার এক সপ্তমাংশ দিয়ে গেলেন রাজা সাতবাহনকে; সাতবাহন সেই আখ্যান বিবৃত করলেন উত্তরকালের কাছে। তারপর কাহিনি যত এগোতে লাগল ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের মুখ থেকে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনির স্রোত বইতে বইতে কথার সমুদ্র হয়ে গেল।
একটি মূল আখ্যান-বলয়িত অসংখ্য উপাখ্যান, কখনও-বা উপাখ্যানের ভিতরে কথিত আরও উপাখ্যান কথাসরিৎসাগরের বিশিষ্ট আঙ্গিক। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের নিরিখে এটি অভাবিতপূর্ব নয়; কথাসরিৎসাগর যখন রচিত হচ্ছে তখন এই আঙ্গিকটি সুপরিণত। ততদিনে পঞ্চতন্ত্রের মাধ্যমে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে তা, এবং পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যেই এ আঙ্গিক বিশেষ সম্মান পাবে। আরবীতে Kitab Alf Layla wa Layla, সেই সুবিখ্যাত সহস্র এক আরব্য রজনী, গল্পে গল্পে তার ইমারত গড়ে তোলার যে প্রকরণ, তার জন্মও ভারতীয় সাহিত্যের এই আঙ্গিক থেকে, এমন সিদ্ধান্ত করেছেন পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা। মূল আখ্যান বা frame story–র বলয়ের মধ্যে প্রায় নশোটি কাহিনি গ্রথিত হয়েছিল কথাসরিৎসাগরে। সরাসরি রামায়ণ মহাভারতের দান সামান্য; আর কোনো সুচিরাগত কথা হয়তো এই সংগ্রহ থেকে বাদ পড়ে নি। এই প্রাচুর্যের দ্বারা কথাসরিৎসাগর কথাসাহিত্যের একটি মহাকোষ হয়ে উঠেছিল। এখানেই তার বিপুলতা। কোনো প্রাদেশিক ভাষায় রচিত নয়, আসমুদ্রহিমাচল প্রচলিত সংস্কৃতভাষায় রচিত হয়েছিল বলে এই মহাকোষ সর্বভারতে গ্রহণযোগ্য হবার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছিল। সেখানে তার সার্বভৌমতা। কথাসরিৎসাগর এক রাজবংশের দুই পুরুষের কীর্তিকথা। তাতে যুদ্ধবিগ্রহ ও রাজ্যবিস্তারের কাহিনি আছে; তার থেকেও বেশি আছে এই দুই পুরুষ বৎসরাজ উদয়ন ও তাঁর পুত্র নরবাহনদত্তের প্রেমবিহ্বলতা ও পূর্বাপর ভার্যাসংগ্রহের কথা। বস্তুত, প্রেমকথাই কথাসরিৎসাগরে প্রধান। মূল আখ্যান শুরু হয় উদয়ন ও অবন্তীরাজপুত্রী বাসবদত্তার প্রেমকাহিনি দিয়ে; তারপর তাঁদের কোলে নরবাহনদত্ত জন্মগ্রহণ করেন, যিনি বিদ্যাধরদের সম্রাট হবেন। উদয়ন ক্রমে গৌণ হয়ে যান কাহিনি থেকে, ও নরবাহনদত্ত অমিতকিরণে বিকশিত হন। আখ্যানটি চলতেই থাকে, চিত্তাকর্ষক উপাখ্যানগুলি গাঁথা হয় এত স্বচ্ছন্দে, বেড়ে ওঠে এমন অপূর্ব বিভঙ্গে, কথিত হয় এমন মনোহরণ শৈলীতে, যে কোনোটিকেই প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয় না এবং আখ্যানের ক্রমপরিণতিও ব্যাহত হয় না। এখানেই কথাসরিৎসাগরের সাহিত্যিক সমগ্রতা।
কথাসরিৎসাগর একেবারে মৌলিক কোনো গ্রন্থ নয়। উদয়ন-কাহিনির পরম্পরা নিশ্চয়ই লোককথার মধ্য দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে লালিত ও পরিবর্ধিত হয়েছিল। রাজা বিক্রমাদিত্যকে নিয়ে যেমন গল্পের শেষ নেই, তেমনি রাজা উদয়ন জনপ্রবাদের অংশ হয়ে একটি বিপুল ‘মিথ’-এ পরিণত হয়েছিলেন। এর ফলে তাঁর কাল-নিরূপণ অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল; যদিও উদয়ন-কথার দিকে গভীরভাবে তাকালে তা একেবারে ঐতিহাসিকতা-রহিত বলে মনে হয় না। এ-হেন নায়ককে নিয়ে যে romance রচিত হবে তা যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। অতএব তাঁর কীর্তিকথা তাঁর জীবনচরিত হয়তো প্রকৃতিপুঞ্জ বা সাধারণ মানুষের মুখে মুখেই একটা নিটোল ও সম্পূর্ণ আকৃতি প্রাপ্ত হচ্ছিল। কীভাবে সেই একটি সরল ধারার মধ্যে প্রায় সহস্র উপকথার ধারা এসে মিলল তা ক্রমান্বয়ে অবধারণ করবার কোনো উপায় আজ নেই, হয়তো প্রাচীনদের কাছেও ছিল না। তবে সন্দেহ নেই যে এই কথাসমূহের বাহুবন্ধন এবং এই ‘নানাকথাজাল’-এর বয়ন অতিদীর্ঘকাল ধরে নানা হাতে ঘটেছিল। হয়তো তৎকালপরিজ্ঞাত ভারতবর্ষের সমস্ত জনপদ ও দ্বীপ থেকে বিচিত্র বর্ণ ও ভাবের কথা-সূত্র এই মহাজালের ভিতরে গাঁথা হয়েছিল। উদয়নকথার যে-কোনো লিখিত রূপের মধ্যে যতগুলি জনপদের নাম পাওয়া যায় তা থেকে এই অনুমান অসঙ্গত নয়। উদয়নকথা ক্রমে ক্রমে বৈদগ্ধ্যের অভিজ্ঞান রূপেও স্বীকৃত হয়েছিল। কালিদাসের যক্ষ যখন মেঘকে বলে ‘প্রাপ্যাবন্তীনুদয়নকথাকোবিদগ্রামবৃদ্ধান্’ (৩১, পূর্বমেঘ), যেখানে গ্রামবৃদ্ধগণ উদয়নকথায় অভিজ্ঞ সেই অবন্তীদেশে পৌঁছে তুমি বিশালা নগরীতে (উজ্জয়িনীতে) প্রবেশ করবে, তখন সেই উদয়নকথাকোবিদ বৃদ্ধেরা যেন জনপদের সম্পদ রূপেই চিত্রিত হন।
বৃহৎকথা
এইভাবে কোনো ঐতিহ্যের ধীর নিশ্চিত অবিচ্ছিন্ন ও সার্বভৌম প্রসার হতে থাকলে তার সংকলনও একদিন অনিবার্য হয়ে ওঠে। কোনো দ্রষ্টার প্রখর মনীষা সেই কাজে ধাবিত হয়। যেন সেই নিয়মেই কোনো অনির্ণেয় অতীতে মহাকবি গুণাঢ্য রচনা করলেন ‘বৃহৎকথা’। প্রায় প্রত্যাশিত ভাবেই সেকালের অনেক ঘটনার মতো গুণাঢ্যেরও কাল-নিরূপণ আজ অসাধ্য হয়ে গেছে। তাঁকে নিয়ে যে জনশ্রুতি বৃহৎকথারই পরম্পরায় চলে এসেছে তাতে তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয় আরোই গেছে গুলিয়ে। কথাসরিৎসাগরের সাক্ষ্য থেকে জানা যায় – এক, তিনি আসলে মহাদেবের অনুচর মাল্যবান নামক গণ, শাপগ্রস্ত হয়ে নরযোনিতে গুণাঢ্য নামে জন্মেছেন; দুই, তিনি রাজা সাতবাহনের সমসাময়িক। তবে সংস্কৃতসাহিত্য ও অন্যান্য সাক্ষ্য থেকে এটা নিশ্চিত ভাবে বোঝা যায় ব্যাস বাল্মীকির মতো গুণাঢ্যও মহাকবি রূপে বন্দিত। দণ্ডীর কাব্যাদর্শে বলা হচ্ছে ‘ভূতভাষাময়ীং প্রাহুরদ্ভুতার্থা বৃহৎকথাম্’। হর্ষচরিতে আরও উচ্ছলিত উল্লেখ – ‘সমুদ্দীপিতকন্দর্পা কৃতগৌরীপ্রসাধনা। হরলীলেব নো কস্য বিস্ময়ায় বৃহৎকথা’। কাদম্বরীতে উজ্জয়িনী বর্ণনায় ‘বৃহৎকথাকুশলেন’ সূত্রে রামায়ণ মহাভারত ও বৃহৎকথার আলোচনায় সুনিপুণ পুরবাসীদের প্রসঙ্গ এসেছে। বাংলার কবি গোবর্ধন তাঁর সপ্তশতী-তে রামায়ণ মহাভারত এবং বৃহৎকথার কবিদের প্রণতি জানিয়ে বলছেন, ‘শ্রীরামায়ণভারতবৃহৎকথানাং কবীন্নমস্কুর্মঃ’। কাম্বোডিয়ায় প্রাপ্ত খ্রীষ্টীয় নবম শতকের কোনো শিলালিপিতে ভারতীয় কবিশ্রেষ্ঠদের মধ্যে গুণাঢ্যেরও প্রশস্তি উৎকীর্ণ রয়েছে। বৃহৎকথার আরও উল্লেখ পাওয়া যায়। সুবন্ধুর ‘বাসবদত্তা’, ধনঞ্জয়ের ‘দশরূপ’, হেমচন্দ্রের ‘কাব্যানুশাসন’ ইত্যাদি নানা গ্রন্থে বৃহৎকথা-প্রসঙ্গ চলে আসে।
সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্রে বৃহৎকথার এত অজস্র উল্লেখ থেকে তার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার একটা ধারণা পাওয়া যায়। অর্থাৎ, তার আদি উৎস উদয়নকথার মতোই বৃহৎকথাও দিনে দিনে একটা বিপুল ঐতিহ্য বা ট্র্যাডিশন হয়ে উঠেছিল। তার কাহিনি-বিশেষ অবলম্বন করে নতুন কথা কিংবা নাটক রচিত হচ্ছিল। বাণভট্ট তাঁর কাদম্বরীতে, সুবন্ধু তাঁর ‘বাসবদত্তা’-য়, ভবভূতি তাঁর ‘মালতীমাধব’ নাটকে বৃহৎকথা থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন। প্রেরণার উৎস যদি বৃহৎকথা হয় তা হলে সেই সাহিত্যকর্মের এক বিশিষ্ট মহিমা আছে সেকথা যেন লেখক ও পাঠক উভয়েই মেনে নিয়েছিলেন। পূর্বোদ্ধৃত নানা গ্রন্থে বৃহৎকথার উল্লেখ যদি কালের দিক থেকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই তারা সকলেই ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী। এই কাল হিন্দু মনীষার শ্রেষ্ঠ পর্ব। আবার ইতিহাসের বিচারে এই পর্বের শেষ অধ্যায়ে হিন্দুযুগের সূর্য অস্তাচলেও চলে যাচ্ছেন।
প্রশ্ন এই যে, সংস্কৃতসাহিত্য যে বৃহৎকথার ছায়ায় বিকশিত হচ্ছিল সেটা কোন্ বৃহৎকথা? কারণ মূল বৃহৎকথা নাকি সংস্কৃতে নয়, পৈশাচী প্রাকৃতে রচিত। এ নিয়ে যে উপাখ্যান তাতে পরে আসব। বৃহৎকথার মূল পাঠের আজ অবধি সন্ধান পাওয়া যায় নি; তার ধারা থেকে যে কতিপয় সংস্কৃত গ্রন্থ উৎপন্ন হয়েছিল সেই দর্পণেই বৃহৎকথা প্রতিবিম্বিত। কিন্তু পৈশাচী প্রাকৃতেই বৃহৎকথা প্রচারিত হচ্ছিল দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এ সংবাদ একটু অলীক লাগে বৈকি। অর্থাৎ মেনে নিতে হয় এই প্রায়-অসম্ভাব্য তথ্যটি যে পৈশাচী প্রাকৃত, যার লিখিত নমুনা আজ অবধি পাওয়া যায় নি এবং যা আলোচনার অবলম্বন প্রাচীন বৈয়াকরণদের যৎসামান্য উল্লেখ, সেই ভাষা সর্বভারতে অত দীর্ঘকাল ধরে সুবোধ্য ছিল। এবং বাণ সুবন্ধু দণ্ডী ভবভূতি এমনকি বাংলার সেনরাজসভায় গোবর্ধন পর্যন্ত এই প্রাকৃতের সঙ্গে সম্যক পরিচিত ছিলেন। অথচ যদি অবধান করি যে বৃহৎকথা আদিতে বররুচি-কথিত, এবং ইতিহাসপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি বররুচি ‘প্রাকৃতপ্রকাশ’ নামক প্রাকৃতভাষার ব্যাকরণ-প্রণেতা তাহলে আবার প্রাকৃতের দাবিকে নস্যাৎ করতে বাধে। তবু যে মূল পৈশাচী ভাষার বৃহৎকথা কোনোরকম আঙ্গিকেই, অখণ্ড না হলেও আংশিক রূপে, সংস্কৃতে প্রাপ্য ছিল না বাণ-ভবভূতির কালে সেকথা কে নিঃসংশয়ে বলতে পারে। মনে হয়, বৃহৎকথার মহিমা ক্রমে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়েছে, তার পৈশাচী উৎপত্তির কিংবদন্তি টিঁকে আছে, কিন্তু মাঝখানকার কোনো একটি সূত্র চিরতরে হারিয়ে গেছে। তাই বৃহৎকথার ঐতিহ্য, পাশ্চাত্য সংজ্ঞায় যার নাম the great Brihat-katha tradition, তার অবয়ব অনেকাংশে অস্পষ্ট।
এই প্রশ্ন প্রমাণাভাবে আজও অমীমাংসিত আছে। ইতিহাসের স্বাভাবিক যুক্তিসূত্রে আমরা কেবল প্রত্যাশা করতে পারি যে পৈশাচী ভাষার আদি বৃহৎকথার সম্যক ও সর্বজনমান্য সংকলন কোনোদিন সম্ভব হয়ে উঠবে। উদয়নকথা একদা বৃহৎকথায় সংকলিত হয়েছিল, বৃহৎকথা একটি প্রচণ্ড ট্র্যাডিশনে পরিণত হয়েছিল, অতএব এবারে তার দ্বিতীয় অঙ্ক, অর্থাৎ পুনর্লিখনের কাল, উপস্থিত হবে। খ্রীষ্টীয় একাদশ শতক সেই সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠল। ঘনসন্নিবদ্ধ রূপে বৃহৎকথা সংস্কৃতে লিখিত হল। এই সময় থেকে সংস্কৃতভাষায় বৃহৎকথার দু’টি সংকলন অখণ্ড রূপে পাওয়া যায়। তার আগে নেপালে বুধস্বামী[১] রচনা করেছিলেন ‘বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহ’; আর এই একাদশ শতকে কাশ্মীররাজের আনুকূল্যে ক্ষেমেন্দ্র লিখলেন ‘বৃহৎকথামঞ্জরী’, এবং সোমদেবভট্ট লিখলেন ‘কথাসরিৎসাগর’। বুধস্বামীর পুঁথি অসমাপ্ত; নায়ক নরবাহনদত্তের আখ্যায়িকা তাঁর ষড়বিংশ ভার্যার মধ্যে ষষ্ঠ ভার্যাগ্রহণের কাহিনিতে প্রবেশ করে অকস্মাৎ শেষ হয়ে যায়। সম্পূর্ণ আখ্যায়িকা লেখক রচনা করে যেতে পেরেছিলেন কিনা সেকথা জানার আর উপায় নেই। কাশ্মীরে ক্ষেমেন্দ্র ও সোমদেব অবশ্য বুধস্বামীর রচনা বিষয়ে অবহিত ছিলেন এমন প্রমাণ নেই। তাঁরা বৃহৎকথার একই মূল অবলম্বন করে এগিয়েছিলেন, সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রচলিত রূপ (North-western Brihat Katha), কিন্তু তাঁদের রচনাকর্ম স্বতন্ত্র ও স্বাধীন। রাজকবি ক্ষেমেন্দ্রের লেখনী ছিল বহুপ্রসবিনী। প্রায় বাইশটি সংস্কৃত গ্রন্থ তাঁর নামে প্রচলিত, তার অন্যতম ‘বৃহৎকথামঞ্জরী’। বইয়ের ব্যাপারে ‘মঞ্জরী’ অর্থ সুবিন্যস্ত সংগ্রহ। ক্ষেমেন্দ্র রামায়ণ ও মহাভারতেরও দু’টি সংকলন রচনা করেছিলেন, যথাক্রমে ‘রামায়ণমঞ্জরী’ ও ‘ভারতমঞ্জরী’। সোমদেবভট্টের রচনাবলীর এত বহুলতা হয়তো ছিল না, কিন্তু তাঁর ‘কথাসরিৎসাগর’-এর বিস্তার ও উৎকর্ষ ক্ষেমেন্দ্রকে ম্লান করে দিয়েছে। এই দুই-ই কাব্য, এবং তাদের গঠনে সাদৃশ্য আছে। উভয়ই অষ্টাদশ গ্রন্থ বা ‘লম্বক’-এ বিভক্ত। লম্বকের নামগুলিও মোটামুটি এক, কেবল ক্রম আলাদা রকমের। বৃহৎকথামঞ্জরী আয়তনে ক্ষুদ্রতর, দৈর্ঘ্যে কথাসরিৎসাগরের এক তৃতীয়াংশ।
বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহ ও বৃহৎকথামঞ্জরী সবিস্তার ও স্বতন্ত্র আলোচনার যোগ্য বিষয়। বর্তমানে আমরা অবশ্য সোমদেবভট্টে মনোনিবেশ করব।
কথাপীঠ
কী ছিল গুণাঢ্যের সেই বহুবন্দিত ও অভিবিশ্রুত বৃহৎকথায় তা বুঝতে গেলে আজ কথাসরিৎসাগরের মতো দর্পণ আর নেই। গ্রন্থের সূচনায় ‘কথাপীঠ’ লম্বকে সোমদেব বলেছেন, অশেষ পদার্থ যাঁর আলোকবর্তিকায় দীপ্ত হয় সেই বাগ্দেবীকে প্রণাম করে বৃহৎকথার সারসংগ্রহপূর্বক আমি এই সংকলন রচনা করছি। ‘বৃহৎকথায়াঃ সারস্য সংগ্রহং রচয়াম্যহম্’। তারপর তিনি গ্রন্থবিভাগসূচক অষ্টাদশ ‘লম্বক’-এর নামগুলি ক্রমান্বয়ে বলছেন – কথাপীঠ, কথামুখ, লাবাণক[২], নরবাহনদত্তজনন, চতুর্দারিকা, মদনমঞ্চুকা, রত্নপ্রভা, সূর্যপ্রভা, অলংকারবতী, শক্তিযশা, বেলা, শশাঙ্কবতী, মদিরাবতী, পঞ্চ, মহাভিষেক, সুরতমঞ্জরী, পদ্মাবতী, ও বিষমশীল। অতঃপর কবি বলছেন – ‘যথা মূলং তথৈবৈতন্ন মনাগপ্যতিক্রমঃ। গ্রন্থবিস্তরসংক্ষেপমাত্রং ভাষা চ ভিদ্যতে’। এই রচনা মূলের অনুগামী। মূল গ্রন্থের বিস্তৃতির সংক্ষেপ করা যায় এমন ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ঔচিত্যান্বয়রক্ষা চ যথাশক্তি বিধীয়তে। কথারসাবিঘাতেন কাব্যাংশস্য চ যোজনা’। ঔচিত্য ও অন্বয়রক্ষা এবং কাব্যাংশের যোজনা দ্বারা যাতে কথারস অবিঘাত (অবিঘ্নিত) থাকে যথাশক্তি সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। এবং - ‘বৈদগ্ধ্যখ্যাতিলোভায় মম নৈবায়মুদ্যমঃ। কিং তু নানাকথাজালস্মৃতিসৌকর্যসিদ্ধয়ে’। বৈদগ্ধ্যখ্যাতির লোভে আমার এই উদ্যম নয়, নানাকথাজালের স্মৃতিসৌকর্য সাধন করাই আমার লক্ষ্য।
লেখকের নিবেদন থেকে তাঁর রচনার আদর্শ ও উদ্দেশ্য জানা গেল। এরপর চলেছে আঠারোটি লম্বকস্থ ১২৪টি তরঙ্গে ২১৫১৯টি শ্লোকের ধারা। সব শেষে সমাপ্তি অংশে ‘গ্রন্থকর্তুঃ প্রশস্তিঃ’-র তেরোটি শ্লোকে ফুটে ওঠে কাব্যরচিয়তার ব্যক্তি-ইতিহাসের একটা অবয়ব। আমরা জ্ঞাত হই, কাশ্মীররাজ সংগ্রামের পুত্র অনন্ত তাঁর বংশের কল্পবৃক্ষ স্বরূপ ও পরাক্রান্ত সম্রাট ছিলেন। ত্রিগর্তাধিপের কন্যা অশেষগুণবতী সূর্যবতীকে অনন্ত বিয়ে করেন। সেই বিশ্ববন্দিতা দেবী সূর্যবতী ‘প্রজানাং বিভাতসন্ধ্যামিব’, প্রত্যুষের মতো প্রজাদের (অজ্ঞানান্ধকার) আলোকিত করেছিলেন। ভূমণ্ডলের তিলকসদৃশ শিবাবতার রাজা কলশ তাঁর পুত্র ছিলেন। কলশপুত্র শ্রীমান হর্ষ উর্বীভৃৎদের (রাজা ও পর্বত) মাথা নত করিয়ে নিজে সপ্ত সমুদ্র পান করতে সক্ষম ছিলেন। সেই নিরন্তর শিবার্চনা-হোমকর্মে নিরতা এবং শাস্ত্রাদির নিত্যবিহিত শ্রবণশ্রমক্লান্তা দেবী সূর্যবতীর ক্ষণকালের চিত্তবিনোদনের জন্য (‘চিত্তবিনোদহেতোঃ’) ভূরিগুণাভিরাম (বহুগুণশালী) বিপ্রবর রামের পুত্র সোম নানা কথামৃতময় ও সজ্জনের মানসসমুদ্রে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় বৃহৎকথার সারসংগ্রহ করেছেন। অমলমতি সোমের সেই বিস্তীর্ণ তরঙ্গভঙ্গিসম্পন্ন কথাসরিৎসাগর সকলের হৃদয়ানন্দদায়ক হোক।
এই সালংকারা অতিশয়োক্তিরঞ্জিত বক্তব্যের অন্তর্নিহিত ইতিহাসটি কাশ্মীর প্রদেশের এক বিড়ম্বিত, ষড়যন্ত্র ও রক্তক্ষয়ে বিদীর্ণ অধ্যায়। অনন্ত ও সূর্যবতীর পুত্র যে কলশকে ভূমণ্ডলের তিলক ও শিবাবতার বলা হচ্ছে তিনি পিতাকে সিংহাসনচ্যুত করেন (১০৬৩ খ্রীষ্টাব্দ)। কয়েক বছর পর অনন্ত সিংহাসনে ফিরে আসেন। ১০৭৭ খ্রীষ্টাব্দে কলশ পুনরায় আক্রমণ ও পিতার সর্বস্ব লুণ্ঠন করেন। অনন্ত সিংহাসন ত্যাগ করেন। ১০৮১ খ্রীষ্টাব্দে ভগ্নহৃদয় অনন্ত আত্মহত্যা করেন। সূর্যবতী পতির সঙ্গে সহমরণে যান। অনন্তের প্রথম ও দ্বিতীয়বার সিংহাসন ত্যাগের মধ্যে কোনো সময়ে, আনুমানিক ১০৭০ খ্রীষ্টাব্দে[৩], সোমদেব কথাসরিৎসাগর রচনা করেন।
কথাসরিৎসাগরের মূল আখ্যানটিকে লম্বকানুক্রমে বলা যেতে পারে, কিন্তু সেই সুদীর্ঘ অবকাশ এখানে নেই। অধিকন্তু, তার মাধ্যমে যে এই গ্রন্থের আস্বাদ পাওয়া যাবে এমনও নয়। কারণ ‘নানাকথাজাল’-কে বাদ দিয়ে এ কাব্যের কোনো অখণ্ড পরিচয় তৈরি হতে পারে না। তবে পূর্বোল্লিখিত কথাপীঠ লম্বক এই রচনার দুর্জ্ঞেয় জন্মকথাটি বুঝতে সাহায্য করে, তার মধ্যে বৃহৎকথার ইতিহাস নিহিত; আমরা সংক্ষেপে তার আলোচনা করব।
কিন্নর গন্ধর্ব অধ্যুষিত হিমালয়ের কৈলাস পর্বতে চরাচরগুরু শিব বাস করেন। গণ, সিদ্ধ ও বিদ্যাধরেরা তাঁর নিত্য সেবা করে। একদা ভার্যা পার্বতীর অনুরোধে শিব একটি সম্পূর্ণ নতুন কাহিনি শোনাতে প্রতিশ্রুত হলেন। নিজের দৈবশক্তি ও পূর্বজন্ম সম্বন্ধে তিনি দু’টি কাহিনি শোনাবার পরে পার্বতী তাঁকে বিরক্ত হয়ে বললেন, এ কি নতুন কাহিনি। তখন মহাদেব বললেন, দ্বার রুদ্ধ হোক। আমি প্রকৃতই অশ্রুত একটি কাহিনি বলব। দেবতাদের কাহিনি নয়, তাঁরা সততই সুখী; মানুষের কাহিনি নয়, তারা নিরন্তর দুঃখী; অর্ধদেবতাদের কাহিনি পরম প্রীতিপ্রদ, আমি তোমাকে বিদ্যাধরদের কাহিনি শোনাব। - এই উক্তিটি যেন গ্রন্থকারের মৌলিকতা[৪] ঘোষণা করে। অর্থাৎ, বেদ ও পুরাণের বহুচর্চিত আখ্যান নয়, এমন কাহিনি বিবৃত হবে যা ত্রিজগজ্জননী দেবীর কাছেও অভিনব।
অতঃপর শিব যে বিরাট কাহিনি বললেন তা অপরের অগোচর রইল না। তাঁর অনুগত গণ পুষ্পদন্ত যোগবলে অদৃশ্য হয়ে রুদ্ধদ্বার ঘরে প্রবেশ করে তা শুনতে লাগলেন। এই বিষয় জানাজানি হলে কুপিতা পার্বতী পুষ্পদন্তকে অভিশাপ দিলেন, সে মানুষ হয়ে জন্ম নেবে। আরেক গণ মাল্যবান পুষ্পদন্তের হয়ে অনুরোধ করতে এলে সেও একই দণ্ড পেল। কবে শাপমুক্তি হবে সেকথা জানতে চাইলে দেবী বললেন, সুপ্রতীক নামক যক্ষ কুবেরের শাপে পিশাচ হয়ে কাণভূতি নামে বিন্ধ্যপর্বতে বাস করছে। তার সঙ্গে দেখা করে এই কাহিনি বললে পুষ্পদন্ত শাপমুক্ত হবে। আর, মাল্যবান যখন কাণভূতির কাছে এই কাহিনি শুনবে তখন কাণভূতির শাপমুক্তি ঘটবে। তারপরে মাল্যবান সেই কাহিনি পৃথিবীতে প্রচার করলে তারও শাপমোচন হবে।
শাপগ্রস্ত হয়ে পুষ্পদন্ত কৌশাম্বী নগরে বররুচি (বা কাত্যায়ন) নামে জন্ম নিলেন, এবং মাল্যবান সুপ্রতিষ্ঠিত নগরে গুণাঢ্য নামে ভূমিষ্ঠ হলেন। অবশেষে বিন্ধ্যারণ্যে অসংখ্য পিশাচবেষ্টিত মহাকায় পিশাচ কাণভূতির সঙ্গে বররুচির দেখা হল। তিনি সপ্তলক্ষ শ্লোকে বিপুল সপ্ত কাহিনি বর্ণন করে জন্মাবধি নিজের বৃত্তান্ত শোনাতে লাগলেন। এমনি করে একদিন গুণাঢ্যও তাঁর জীবনবৃত্তান্ত বলবেন, এবং এই দুই বৃত্তান্তের পথ ধরে আমরা একাধিক ঐতিহাসিক চরিত্রের সাক্ষাৎ পাব।
বররুচি তাঁর আত্মকথায় বললেন, ব্রাহ্মণ সোমদত্ত ও তাঁর পত্নী বসুদত্তার কোলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মকালে আকাশবাণী হল, এই পুত্র বিদ্বান ব্রাহ্মণ বর্ষের কাছে শিক্ষালাভ করে পৃথিবীতে ব্যাকরণশাস্ত্র প্রচার করবে, এবং যা কিছু ‘বর’ অর্থাৎ ভালো তাতেই এর রুচি বলে এর নাম বররুচি হবে। বররুচির বাল্যকালে দুই ব্রাহ্মণ ভ্রাতা ব্যাড়ি ও ইন্দ্রদত্ত তাঁর মেধায় চমৎকৃত হয়ে তাঁকে পাটলিপুত্রবাসী বর্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। তাঁর অধ্যাপনায় ষড়ঙ্গবেদ বররুচির অধিগত হল। এখানে বর্ষের মুখে আমরা পাটলিপুত্র নগরের উৎপত্তি কাহিনি শুনতে পাই। রাজা পুত্রক রাজা মহেন্দ্রবর্মার কন্যা পাটলীকে হরণ করে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর অধিষ্ঠান এই নগরের প্রতিষ্ঠা করেন।
বর্ষের শিষ্যসংখ্যা ক্রমে বাড়তে লাগল। তার মধ্যে পাণিনি নামে এক জড়বুদ্ধি ছাত্র ছিল। তার মূঢ়তায় বিরক্ত হয়ে বর্ষপত্নী তাকে বিদায় দিলে সে হিমালয়ে গিয়ে শিবের তপস্যা করতে লাগল। মহাদেবের বরে সে একটি নবব্যাকরণ লাভ করে বররুচিকে তর্কযুদ্ধে আহ্বান করল। তাদের সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধের শেষ দিনে প্রায়-ধরাশায়ী পাণিনিকে শিব স্বয়ং উদ্ধার করলেন। বররুচির ঐন্দ্র ব্যাকরণ বিনষ্ট হল এবং তিনি মূর্খত্বে পতিত হলেন। তিনি সমস্ত ত্যাগ করে অনাহারে শিবের উপাসনা করবার জন্যে হিমালয়ে চলে গেলেন। সেখানে তপস্যায় তুষ্ট শিবের কাছে তিনি পাণিনি ব্যাকরণ প্রাপ্ত হলেন এবং শিবের ইচ্ছায় সেই গ্রন্থ সম্পূর্ণ করে ঘরে ফিরলেন।
পাণিনির শ্রেষ্ঠতর ব্যাকরণ তৎপূর্ব ব্যাকরণকে অতিক্রম করল এবং বররুচি সেই নবব্যাকরণকে পূর্ণতা দিলেন, এটাও এই কিংবদন্তির কাঠামোয় একটি ঐতিহাসিক সংবাদের বিবরণ।
ছাত্রের মুখে ওই নবব্যাকরণ শ্রবণ করে বর্ষ এক কোটি স্বর্ণমুদ্রা গুরুদক্ষিণা দাবি করেন এবং সেই সূত্রে যে বিচিত্র বৃত্তান্ত বর্ণিত হয় তার মধ্যে পাটলিপুত্রে নন্দ বংশের পতন ও মৌর্যবংশের প্রতিষ্ঠার ইতিহাসবিশ্রুত কাহিনির ছায়াপাত ঘটে। এই বৃত্তান্তে কুশাঙ্কুরে বিক্ষতপদ ও তার মূলোৎপাটনে রত ব্রাহ্মণ চাণক্য আবির্ভূত হন এবং নন্দরাজকে অপসারণ করে চন্দ্রগুপ্তকে রাজপদে অধিষ্ঠিত করেন।
পুষ্পদন্তের শাপমুক্তি হলে কাণভূতির সঙ্গে গুণাঢ্যের দেখা হল। সাক্ষাৎমাত্র গুণাঢ্য স্বপ্নোত্থিতের মতো নিজের পূর্বকথা স্মরণ করে প্রথমে পুষ্পদন্তের সেই সপ্তলক্ষ শ্লোকের সপ্ত কাহিনি শুনতে চাইলেন; তারপর কাণভূতির অনুরোধে নিজ বৃত্তান্ত বলতে লাগলেন।
প্রতিষ্ঠান রাজ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত নগরীতে ব্রাহ্মণ সোমশর্মার কন্যা শ্রুতার্থার গর্ভে গুণাঢ্যের জন্ম। তাঁর পিতা নাগকুমার কীর্তিসেন শ্রুতার্থাকে গোপনে গান্ধর্বমতে বিয়ে করেন। এই আখ্যানে গুণাঢ্যের বর্ণসংকর উৎপত্তি সূচিত হয়। এই সূত্রেও তিনি ব্যাস বাল্মীকির সমগোত্রীয়; এবং মনে রাখতে হবে, সংস্কৃতসাহিত্যে মহাকাব্যরচয়িতা ত্রয়ীর মধ্যে তৃতীয় পুরুষও গুণাঢ্য।
অতি অল্প বয়সে গুণাঢ্য দক্ষিণাপথে যাত্রা করেন ও সর্ববিদ্যায় পারঙ্গম হয়ে স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রতিষ্ঠান-নৃপতি সাতবাহনের দ্বারা সম্মানিত হয়ে তিনি রাজকার্যে নিযুক্ত হলেন। এখানে একটি ক্ষুদ্র উপাখ্যান সূত্রে আমরা জ্ঞাত হই সাতবাহন নামের ইতিকথা। তিনি কুবেরের অনুচর সাত নামক অভিশপ্ত যক্ষের পুত্র। অভিশাপ প্রভাবে সিংহরূপধারী পিতাকে বাহন করে তাঁর পিঠে আরোহণ করতেন।
এভাবে বারংবার আমরা পাই শব্দ-ব্যুৎপত্তির লৌকিক ব্যাখ্যা, কখনওবা folk etymology-র উদ্ভাস।
একদা বসন্তোৎসবকালে রাজা সাতবাহন তাঁর মহিষীদের সঙ্গে জলকেলিতে মত্ত ছিলেন। জলসিঞ্চনে অধীরা হয়ে এক মহিষী রাজাকে বললেন, ‘দেব, মোদকৈঃ পরিতাড়য়।’ ‘মা’ ও ‘উদক’-এর সন্ধি ধরতে না পেরে রাজা যথেষ্ট মোদকের (মিষ্টান্ন) ব্যবস্থা করলেন, এবং মহিষীর কাছে উপহসিত হলেন। প্রচণ্ড পরিতাপে রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন, পাণ্ডিত্য অর্জন করব অথবা মৃত্যু বরণ করব। এই কথা বলে তিনি দুশ্চিন্তায় স্থাণুবৎ হয়ে রইলেন। তখন গুণাঢ্য ও তাঁর বিজ্ঞ মন্ত্রী শর্ববর্মা তাঁকে আশ্বস্ত করতে এলেন। গুণাঢ্য বললেন, সর্ববিদ্যার প্রবেশদ্বারস্বরূপ ব্যাকরণ শিখতে বারো বছর লেগে যায়, কিন্তু রাজার শিক্ষা তিনি ছ’বছরেই সম্পূর্ণ করবেন। শর্ববর্মা আরও এগিয়ে বললেন, ছ’বছর কেন, মাত্র ছ’মাসেই তিনি রাজাকে শিক্ষা দেবেন। এই অসম্ভব কথা শুনে রুষ্ট হয়ে গুণাঢ্য বললেন, তাই যদি হয় তিনি সংস্কৃত প্রাকৃত ও কথ্যভাষা এই তিন ভাষার ব্যবহারই পরিত্যাগ করবেন।
শর্ববর্মা মরিয়া হয়ে দেব কার্তিকেয়ের তপস্যা করতে লাগলেন ও অবশেষে সফলতা লাভ করলেন। দেব আবির্ভূত হয়ে ‘সিদ্ধো বর্ণসমাম্নায়’ এই সূত্রটি আবৃত্তি করলেন। শর্ববর্মা মনুষ্যসুলভ চপলতায় পরের সূত্রটি অনুমান করে আবৃত্তি করলেন। দেবতা তখন বললেন, তুমি যদি এটা না বলতে তা হলে এই ব্যাকরণ পাণিনিকে অতিক্রম করত। সংক্ষিপ্ততা হেতু এই ব্যাকরণ ‘কাতন্ত্র’ ও আমার বাহন ময়ূরের কলাপের পরিচয়ে ‘কালাপক’ নামে অভিহিত হবে। অতঃপর শর্ববর্মার সাহায্যে রাজা সাতবাহনের সর্ববিদ্যা ও সংস্কৃতভাষা আয়ত্ত হল।
এভাবে ব্যাকরণ পৌঁছে গেল আরেকটি দশায়। পণ্ডিতভোগ্য দীর্ঘশ্রমসাধ্য শাস্ত্র সংক্ষিপ্ত হয়ে সর্বজনের ব্যবহার্য আকৃতি প্রাপ্ত হল। শর্ববর্মার বাজি-ধরা ও সাফল্যের মধ্যে ছিল সেই রূপান্তরের ইঙ্গিত। সংস্কৃত ভাষাচর্চার সর্বভারতীয় ইতিহাসে এই লঘু ব্যাকরণের গুরুত্ব অপরিমেয়।
অতঃপর শর্ববর্মার কৃতিত্বে পরাস্ত হয়ে গুণাঢ্য মৌনাবলম্বন করে বনবাসী হন ও বিন্ধ্যারণ্যে কাণভূতির সাক্ষাৎলাভ করেন। অসংখ্য পিশাচের পরস্পর আলাপ শ্রবণ করে তিনি পৈশাচী ভাষা শিক্ষা করেন। এই চতুর্থ ভাষা লাভ করাতে তাঁর মৌনভঙ্গ সম্ভব হয়। এখানে কাণভূতির উপরোধে গুণাঢ্য তাঁর অতীত নাম মাল্যবান ও সহচরের নাম পুষ্পদন্তের ইতিহাস বললেন। সে-ও কিংবদন্তিপ্রসূত শব্দ-ব্যুৎপত্তির দৃষ্টান্ত। পুষ্পদন্ত আদিতে ছিলেন ব্রাহ্মণতনয় দেবদত্ত[৫], ও মাল্যবান ছিলেন তাঁর ভ্রাতা সোমদত্ত। তপস্যা দ্বারা নিজেদের মূর্খতা দূর করে তাঁরা শিবের আশীর্বাদে তাঁর গণত্বে উন্নীত হয়েছিলেন।
এরপর এল সেই মহা মুহূর্ত। কাণভূতি ওই সপ্তগাথা সমন্বিত দিব্যকাহিনি বিবৃত করলেন। গুণাঢ্য সপ্তবর্ষে সপ্তলক্ষ শ্লোকে পৈশাচী ভাষাতে সেই বৃহৎকথা সংকলন করলেন, এবং মসীর অভাবে তাঁর নিজের রক্তে তা লিপিবদ্ধ হল। তিনি জানতেন তাঁকে শাপমুক্তির জন্য এই কথা পৃথিবীতে প্রচার করতে হবে। তাঁর দুই শিষ্য গুণদেব ও নন্দীদেব রাজা সাতবাহনের কাছে সেই পুঁথি নিয়ে গেল। বিদ্যাগর্বিত রাজা তা নীরস পৈশাচী ভাষায় শোণিত-মসীতে লিখিত বলে প্রত্যাখ্যান করে দিলেন। গুণাঢ্য দুঃখে জর্জর হয়ে এক অগ্নিকুণ্ড প্রস্তুত করলেন। তারপর বনের পশুপাখিদের কাছে সেই কাব্য পাঠ করতে করতে এক একটি পত্র আগুনে নিক্ষেপ করতে লাগলেন। পশুরা দিনের পর দিন তৃণাহার ত্যাগ করে মুগ্ধচিত্তে ওই পাঠ শুনতে শুনতে অপুষ্টিতে ভুগতে লাগল। রাজা সেই অপুষ্টিজনক পশুমাংস খেয়ে অসুখে পড়লেন এবং সবিশেষ অনুসন্ধান করে এই আরণ্যক কবিকে দেখতে এলেন। ততদিনে ছ’লক্ষ শ্লোক আগুনে ছাই হয়ে নরবাহনদত্তের চরিতসম্বলিত মাত্র এক লক্ষ শ্লোক অবশিষ্ট আছে। রাজা সাতবাহনের হাতে ততটুকুই অর্পণ করে মাল্যবানের শাপমুক্তি হল। সাতবাহন সেই কাব্যের ভূমিকা স্বরূপ ‘কথাপীঠ’ লম্বক রচনা করলেন।
বৃহৎকথার জন্ম ও প্রসারের পৌর্বাপর্য যা বর্ণিত হল তা মোটামুটি এই -
কৈলাসে ধূর্জটের্বক্ত্রাৎ পুষ্পদন্তং গণোত্তমম্। তস্মাদ্বররুচীভূতাৎ কাণভূতিং চ ভূতলে॥[৬]
কাণভূতের্গুণাঢ্যং চ গুণাঢ্যাৎ সাতবাহনম্। যৎপ্রাপ্তং শৃণুতেদং তদ্বিদ্যাধরকথাদ্ভুতম্॥[৭]
কী করে এই বিদ্যাধরকথা পৈশাচী ভাষায় রচিত হল সেই জিজ্ঞাসা রাজাকে তাড়িত করেছিল। কথাপীঠ প্রণয়নের পিছনে সেই প্রেরণা।
বৃহৎকথার যে-কোনো পাঠরূপের সঙ্গে যার পরিচয় ঘটবে পৈশাচী ভাষা সম্বন্ধে তার কৌতূহল স্বাভাবিক। আগেই বলেছি পৈশাচীর কোনো লিখিত সাহিত্য-নিদর্শন আজ অবধি আবিষ্কৃত হয় নি, যদিও প্রধান সাহিত্যিক প্রাকৃত মহারাষ্ট্রী শৌরসেনী ও মাগধীর পাশেই তার স্থান। প্রাচীন বৈয়াকরণদের আলোচনায় পৈশাচী ধ্বনিতত্ত্বের কিছু সূত্রের উল্লেখ থাকে, যেমন স্বরমধ্যগত ঘোষ ব্যঞ্জনের ঘোষবত্তার লোপ (সংস্কৃত ‘নগর’ > পৈশাচী ‘নকর’, রাজা > রাচা, কন্দর্প > কন্তপ্প); দেখা যায় পালির সঙ্গে পৈশাচীর মিল যথেষ্ট। কিন্তু এই শাস্ত্রকারদের রচনা থেকে এ ভাষার কোনো অনন্য রূপের ধারণা গড়ে ওঠে না। বররুচি (খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতক) মাত্র এক প্রকার পৈশাচীর উল্লেখ করেছেন, হেমচন্দ্র (ত্রয়োদশ শতক) বলেছেন পৈশাচী সাকুল্যে তিন প্রকার, মার্কণ্ডেয় (সপ্তদশ শতক) দিয়েছেন তেরো প্রকার পৈশাচীর সংবাদ। মহাভারতোক্ত পিশাচ জাতি উত্তর-পশ্চিম ভারত, হিমালয়, অথবা মধ্য এশিয়ার অধিবাসী, কিন্তু পৈশাচী প্রাকৃতের প্রসারক্ষেত্র হিসেবে বৈয়াকরণেরা ভারতবর্ষের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল নির্দেশ করেছেন। কেবল সিন্ধুনদের পূর্বদেশে উত্তর-পশ্চিম পঞ্জাবের কেকয় প্রদেশ তাঁরা সকলেই উল্লেখ করেন। মার্কণ্ডেয় মনে করেন এই কেকয় পৈশাচীই বৃহৎকথার মূল ভাষা, এবং বররুচি বর্ণিত পৈশাচীর সঙ্গে তার সারূপ্যও চোখে পড়ে। কিন্তু এ বিষয়ে সকলে একমত নন। রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’-র অন্তর্গত কোনো সূত্র ধরে অনেকে অনুমান করেন পৈশাচী বিন্ধ্যপর্বতের সংলগ্ন প্রদেশে কথিত হত। এ প্রসঙ্গে সোমদেবের পাঠকদের মনে পড়বে, কৈলাসে হরপার্বতীর দাম্পত্যের একটি প্রহর ছুঁয়ে কাহিনি সরে এসেছিল বিন্ধ্যারণ্যে যেখানে কাণভূতি পিশাচবেষ্টিত হয়ে বিরাজ করছেন। এবং সেই পিশাচকুলের আলাপ শুনে গুণাঢ্য শিখে নিলেন তাদের ভাষা। তবে এই মত স্বীকার করেন না স্যর জর্জ গ্রিয়ারসন (১৮৫১ – ১৯৪১)। তিনি সর্বভারতের ভাষাসমূহে অভিজ্ঞ এবং বিস্তর গবেষণা করেছেন আধুনিক ভারতের পৈশাচীগোত্রীয় ভাষা নিয়ে। গ্রিয়ারসন প্রমাণ করেন, পৈশাচী প্রাকৃতের দুটি স্বতন্ত্র ধারা ছিল, পূর্ব ও পশ্চিম।
কিন্তু কে এই রাজা সাতবাহন যাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন গুণাঢ্য? কথাসরিৎসাগরকার তার কোনো সূত্র রেখে যান নি। তিনি যদি প্রখ্যাত রাজা শাতকর্ণি হতেন, যাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞের সাক্ষ্য সেকালের মুদ্রায় খোদিত আছে, তাহলে সেই বিজয়-প্রসঙ্গ এই কাব্যেও বাদ পড়ত না। অতএব তিনি সাতবাহন কুলের অন্য কোনো পুরুষ হবেন। ইতিহাসে সাতবাহন অন্ধ্রদেশীয় একটি প্রসিদ্ধ রাজবংশের নাম। কৃষ্ণা গোদাবরীর মধ্যবর্তী প্রদেশে প্রতিষ্ঠান রাজ্যে তাঁদের রাজত্বকাল খ্রীষ্টীয় প্রথম কি দ্বিতীয় শতাব্দীর আশেপাশে। সাতবাহনেরা ছিলেন প্রাকৃত ভাষার ধারক। সংস্কৃত তাঁদের রাজসভায় প্রবেশ করে অনেক পরে, এবং নিশ্চয় বহু বিতর্কের ভিতর দিয়ে। গুণাঢ্য ও শর্ববর্মা-সংক্রান্ত ব্যাপারে একটি ভাষাবিষয়ক বিতর্কের আভাস মেলে। এই কুলের এক রাজাকে ঘিরে একটি সাহিত্যসভা জমে উঠেছিল, রাজা নিজেও ছিলেন প্রাকৃত ভাষার বিশিষ্ট কবি। তিনি হাল সাতবাহন। গুণাঢ্যের প্রভুর বৈদগ্ধ্যের সূত্রে এই হালের কথাই অনিবার্য ভাবে উঠে আসে, কিন্তু তাঁরা দু’জনে সমকালীন কিনা তা সংশয়াতীত নয়।
হরমুখাম্বুধেরুদ্গতম্
কথাসরিৎসাগরের প্রতিটি লম্বকের গোড়ায় আমরা পাই এক অপূর্ব মঙ্গলাচরণ। তার প্রথম পঙ্ক্তি - ইদম্ গুরুগিরীন্দ্রজাপ্রণয়মন্দরান্দোলনাৎপুরা কিল কথামৃতং হরমুখাম্বুধেরুদ্গতম্। ‘এই কথামৃত প্রাচীনকালে শিব এবং পার্বতীর প্রণয়রূপ মন্দর পর্বতের আলোড়নের ফলে হরমুখসমুদ্র হইতে উদ্গত হইয়াছিল’।[৮]
এই শ্লোক নিশ্চয় সোমদেবেরই মৌলিক যোজনা, কারণ বৃহৎকথামঞ্জরী-র প্রারম্ভে ক্ষেমেন্দ্র লেখেন – উমাপ্রণামসংক্রান্তচরণালক্তকঃ শশী। সন্ধ্যারুণ ইবাভাতি যস্য পায়াৎস বঃ শিবঃ। তবে ক্ষেমেন্দ্রও প্রথম লম্বকের একেবারে শেষ ভাগে একবার প্রসঙ্গক্রমে বলেন – হরমুখোদ্গীর্ণা লভ্যতে নিখিলা কথা।
বৃহৎকথার আদিরূপে কী ছিল তা নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা আছে, কিন্তু কাশ্মীরজাত তার সমস্ত রূপেই যে শৈবধর্মের উপস্থিতি তাতে সন্দেহ নেই। মঙ্গলাচরণ শেষ হলে সোমদেবের প্রতিটি লম্বক শুরু হয় নতুন প্রার্থনা দিয়ে। কাব্যাস্বাদনের লোভে তার কয়েকটি যদৃচ্ছা উদ্ধৃত করা যেতে পারে। কথাপীঠের আরম্ভে আছে –
শ্রিয়ং দিশতু বঃ শম্ভোঃ শ্যামঃ কণ্ঠো মনোভুবাঃ। অঙ্কস্থপার্বতীদৃষ্টিপাশৈরিব বিবেষ্টিতঃ॥
সন্ধ্যানৃত্তোৎসব তারাঃ করণূদ্ধয়ঃ বিঘ্নজিৎ। সীৎকারসীকরৈরন্যাঃ কল্পয়ন্নিব পাতু বঃ॥[৯]
‘অঙ্কস্থিত পার্বতীর দৃষ্টিপাশবদ্ধ শ্যামগ্রীব শিব তোমাদের উদ্ধার করুন। সন্ধ্যানৃত্যে মত্ত বিঘ্ননাশ শীৎকারে শুণ্ডদ্বারা তারকা সম্মার্জন করিতে করিতে যেন আরও অনেক তারকা সৃজনে রত। তিনি তোমাদের রক্ষা করুন’।[১০]
লাবাণক শুরু হচ্ছে এই প্রার্থনায় –
নির্বিঘ্নবিশ্বনির্মাণসিদ্ধয়ে যদনুগ্রহম্। মন্যে স বত্রে ধাতাপি তস্মৈ বিঘ্নজিতে নমঃ॥
আশ্লিষ্যমাণঃ প্রিয়য়া শংকরোঽপি যদাজ্ঞয়া। উৎকম্পতে স ভুবনং জয়ত্যাসমসায়কঃ॥
‘নির্বিঘ্নে বিশ্বনির্মাণ কার্যসিদ্ধির নিমিত্ত যাঁহার প্রসাদ স্বয়ং বিধাতা বাঞ্ছা করেন বলিয়া আমার মনে হয়, সেই বিঘ্নজিৎকে প্রণাম করি। প্রিয়া কর্তৃক আলিঙ্গনাবদ্ধ শঙ্কর যাঁহার আজ্ঞায় সতত কম্পিত, সেই পঞ্চশর ভুবনজয় করুন’।[১১]
মদিরাবতী লম্বকের প্রার্থনা –
স বো বিঘ্নেশ্বরঃ পায়ান্নমিতোন্নমিতেব যম্। অনুনৃত্যতি নৃত্যং সন্ধ্যাসু ভুবনাবলী॥
গৌরীপ্রসাধনালগ্নচরণালক্তকশ্রিয়ঃ। সখী সুখায় ভূয়াদ্বঃ শম্ভোর্ভালেক্ষণপ্রভা॥
কবীন্দ্রমানসাম্ভোজনিবাসভ্রমরীং নুমঃ। দেবীং সহৃদয়ানন্দশব্দমূর্তি সরস্বতীম্॥
যুগসন্ধ্যার অভ্যন্তরকালে নৃত্যপরায়ণ যে গণেশকে ভুবনাবলী নমিত ও উন্নমিত হইয়া অনুকরণ করে সেই বিঘ্নেশ্বর তোমাদের রক্ষা করুন।[১২] গৌরীর চরণালক্তকে রঞ্জিত যে শম্ভু, তাঁহার ললাটের চকিত প্রভা তোমাদের সুখের জন্য তোমাদের সহিত সখ্য স্থাপন করুক।[১৩] কবীন্দ্রমানসকমলস্থিতা ভ্রমরী আমাদের হৃদয়ানন্দশব্দমূর্তি সরস্বতীকে প্রণাম করি।[১৪]
সুরতমঞ্জরীর প্রথম শ্লোক –
পাতু বস্তাণ্ডবোড্ডীনগণ্ডসিন্দূরমণ্ডনঃ। বান্তাভিপীতপ্রত্যূহপ্রতাপ ইব বিঘ্নজিৎ॥
তাণ্ডব নৃত্যের সময় যাঁহার গণ্ডদেশস্থ সিন্দূররক্তরাগ পীত এবং উদ্গীরিত বিঘ্নের প্রতাপের ন্যায় প্রতীয়মান হয়, সেই গণেশ তোমাদিগকে রক্ষা করুন।[১৫]
বিশ্বসৃষ্টি ও ধ্বংসের আবহে শিব ও বিঘ্নজিৎ গণেশের স্তুতি দিয়েই সর্বত্র শুরু করছেন কবি, এবং কদাচ কামদেব ও শব্দমূর্তি সরস্বতী। প্রধান চরিত্রেরা সকলেই শাপভ্রষ্ট বিদ্যাধর; মর্ত্যলোক থেকে তাঁরা বিদ্যাধরত্বে উন্নীত হবেন। এই বিদ্যাধরেরা দেবযোনি বিশেষ, কিন্তু দেবতা নয়। অসামান্য তাদের রূপ, তারা বিপুল জ্ঞানের অধিকারী, তারা আকাশপথে ঘুরে বেড়ায়, ও মায়াবলে যে-কোনো রূপ পরিগ্রহ করতে সক্ষম। মর্ত্যলোকের সঙ্গে তাদের নিত্য আদানপ্রদান চলে, মর্ত্য পুরুষ অথবা মর্ত্য কন্যার সঙ্গে তারা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। কথাকার মানব থেকে এই অর্ধদেবতায় উন্নীত করবার ব্যবস্থা করেন বটে তাঁর চরিত্রদের, কিন্তু তিনি যে কেবল এই অমর্ত্যলোকেই আগ্রহী এমন বলবার কোনো উপায় নেই। একদিকে শিব ও গণেশের স্তুতি, মুহূর্তবিশেষে দেবতাদের আবির্ভাব, এবং বিদ্যাধরদের অবিরত আসাযাওয়া সত্ত্বেও মর্ত্য মানুষ সম্বন্ধে তাঁর অনিঃশেষ কৌতূহল দেখা যায়।
কিন্তু এই যে কাব্যের পরিচালক দেবতা শিব, যাঁর আজ্ঞায় ঘটনাবলী চালিত হয়, তাঁর উপস্থিতি আরোপিত নয় তো? এ কাব্য তো নরবাহনদত্তের চরিত, আর নরবাহন কুবেরের একটি নাম। শিবের আশীর্বাদে যে কুমারের জন্ম হল তার নাম কেন নরবাহনদত্ত? তুলনীয় কাব্য বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহের দিকে তাকিয়ে দেখলে এ প্রশ্ন অনিবার্য। সেখানে আরাধ্য দেবতা নিঃসংশয় ভাবে কুবের, শিব নন। বোঝা যায় শৈবধর্মের দেশ কাশ্মীরে এসে মূল বৃহৎকথার বর্ণান্তর ঘটেছে। মূলের সঙ্গে ক্ষেমেন্দ্র সোমদেব অনুসৃত উত্তর-পশ্চিমা বৃহৎকথার এ-হেন দ্বন্দ্ব পরেও আলোচিত হবে।
তবু কেবল ‘হরমুখাম্বুধেরুদ্গতম্’ কথামৃত রূপে কথাসরিৎসাগরকে দেখলে ভুল হবে। আমরা বলেছিলাম বটে, বৃহৎকথার এমন দর্পণ আর নেই। সেটা যে সর্বার্থে বিশ্বস্ত দর্পণ তার সম্ভাবনা কম। বরং সেটাকে বৃহত্তম দর্পণ বলাই সঙ্গত। তার বক্রতায় অনেক কিছু ধরা পড়ে গেছে যা আখ্যানের মূল প্রসঙ্গে অভাবনীয়, এবং একান্ত লৌকিক বিষয়। সোমদেব তাঁর দক্ষিণ দুয়ার খুলে রাখেন চারপাশের জগৎটার দিকে। সেই পথে প্রবেশ করে নানা লোককথার ধারা আর তাকে তিনি কেমন করে খাপ খাইয়ে নেন তাঁর কাব্যের সঙ্গে তার দৃষ্টান্তবিশেষ আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব।
বিদ্যাধরকথাদ্ভুতম্
‘বৃহৎকথা’ নামটি বিশুদ্ধ সংস্কৃত। মূলে তার নাম ছিল সম্ভবত ‘বড্ডকহা’। গুণাঢ্যের লক্ষ শ্লোকের সারাৎসার বাইশ হাজার শ্লোকে, অর্থাৎ এক পঞ্চমাংশ আয়তনে, সংগৃহীত হয়েছিল কথাসরিৎসাগরে। কী ছিল সোমদেবের সংক্ষেপের নীতি, ঠিক কী ও কতটুকু বাদ দিয়েছিলেন তিনি? কোনো কাহিনি, পল্লবিত বর্ণনার অংশ, অযাচিত উপমার বিস্তার? উপমা সোমদেবেও বিস্তর আছে। তাঁর মোক্ষম উপমার একটি নমুনা – রাজার বেগবান ঘোড়াদের ক্ষুরের চিহ্ন ধারণ করে আছে সম্মুখ ভূমিতে অবস্থিত পথ, যেন রাজা নখরাঘাতে ধরণীকে সম্ভোগ করেছেন। আবার, উদীয়মান চন্দ্রকে দেখার জন্য সমুদ্র যেমন পুলকিত হয়, সে-জাতীয় অভ্যস্ত উপমাও যথেষ্ট আছে। কিন্তু সোমদেব উপমা নিয়ে কোথাও বাড়াবাড়ি করেছেন, কিংবা অতিকথনের সুযোগ পেলে ছাড়েন নি, সংস্কৃত কবিদের বিরুদ্ধে এই যে পরিচিত অভিযোগ, তা তাঁর সম্বন্ধে খাটে না।
কোনো উপাখ্যানও কি আদৌ বর্জন করেছিলেন সোমদেব? মূল আখ্যান এই কাব্যে বেগবতী ও সুনিশ্চয়, কিন্তু উচ্ছলিত নয়। উপাখ্যানরাজির সংখ্যা ও বিস্তারের তুলনায় তার বহর সামান্য। বেলা নামের অতি ক্ষুদ্র লম্বকেও চন্দ্রসার নামক এক বণিক হঠাৎ হাজির হয়ে নিজের ও পত্নী বেলার বৃত্তান্ত শোনায়, এবং এই লম্বক নরবাহনদত্তের নবলব্ধ বধূ নরেন্দ্রসেনার নামে নয়, বেলার নামে আখ্যাত হয়। অতি দীর্ঘ শশাঙ্কবতী লম্বকে মূল আখ্যানভাগ নামমাত্র, পুরোটাই জনৈক মৃগাঙ্কদত্তের উপাখ্যান-মধ্যস্থ প্রায় পঞ্চাশটি উপাখ্যান। বেতালের পঁচিশটি কাহিনিও এই লম্বকের অন্তর্গত। এবং শশাঙ্কবতীও মৃগাঙ্কদত্তের উপকথার নায়িকা।
এমনিভাবে অনেক লম্বকেরই নামের সঙ্গে নরবাহনদত্তের জীবননাট্যের যোগ সামান্য। সেই ব্যাপারই ঘটছে অতি রমণীয় চতুর্দারিকা লম্বকে। বোঝা যায়, চতুর্দার অর্থাৎ চারটি পত্নী গ্রহণের কাহিনি থেকে এই নাম। কিন্তু পতিটি কে? তিনি শক্তিবেগ নামক বিদ্যাধর। একদা তিনি কিরীট কুণ্ডল ও খড়্গে সজ্জিত হয়ে আকাশ থেকে নেমে এলেন বৎসরাজ উদয়নের সামনে। নরবাহনদত্তের তখন শৈশবকাল। শক্তিবেগ জানালেন এই বালক একদিন বিদ্যাধরদের সম্রাট হবে, তিনি তার দর্শনার্থী। এই সূত্রে তিনি নিজের অত্যদ্ভুত জীবনকথা ব্যক্ত করলেন।
আদিতে শক্তিবেগ ছিলেন বর্ধমান নগরীতে জনৈক ব্রাহ্মণ বলদেবের পুত্র শক্তিদেব নামক এক উচ্ছন্নে-যাওয়া যুবক। দ্যূতাসক্ত হয়ে সে সর্বস্বান্ত হয়েছিল। বর্ধমানের রাজা পরোপকারী ও রানি কনকপ্রভার মেয়ে ছিল কনকরেখা, রূপে যেন দেবী লক্ষ্মীর প্রতিস্পর্ধী। লোকলোচনচন্দ্রিকা সেই কন্যা যৌবনপ্রাপ্ত হল, কিন্তু বিবাহে সম্মত হল না। পিতার উপরোধে সে আরোপ করল এক আশ্চর্য শর্ত। ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয় যদি কেউ ‘কনকপুরী’ নামক নগরী দেখে থাকে সে-ই তার পতি হবে। কনকপুরী কী বা কোথায় তা কেউ বুঝতে পারল না, কিন্তু এই মর্মে রাজা দিকে দিকে পটহনিনাদ করালেন। সর্বস্বান্ত শক্তিদেব ভাবল, এই তো সুযোগ। সে রাজার কাছে দাবি করল, আমি কনকপুরী দেখে এসেছি। কিন্তু রাজকন্যা তাকে পরখ করে তার চাতুরী ধরে ফেলল।
এইখান থেকে কাহিনির শুরু। ক্ষুব্ধ রাজকন্যা প্রথমে রাজাকে শোনাল শিব ও মাধব নামে দুই প্রতারকের বৃত্তান্ত। তার ঘটনাস্থল উজ্জয়িনী। প্রত্যুত্তরে রাজা বললেন, বয়ঃপ্রাপ্তা কন্যা অবিবাহিতা থাকলে মিথ্যা অপবাদের সৃষ্টি হতে পারে। নিদর্শনস্বরূপ তিনি শোনালেন কুসুমপুর নগরের তপস্বী হরস্বামীর গল্প। এ দু’টি উপাখ্যানের শেষে শক্তিদেবকে আমরা আবার দেখতে পাই। কনকপুরীর সন্ধানে সে কৃতসংকল্প হয়ে দাক্ষিণাত্যের পথে বেরিয়ে পড়েছে। দুর্গম বিন্ধ্যারণ্যে প্রবেশ করে সে সূর্যতপা নামক স্থবির মুনির দেখা পেয়েছে। তার অভীষ্টের কথা শুনে মুনি তাকে পাঠিয়েছেন কাম্পিল্য দেশের উত্তর পর্বতে তাঁর অগ্রজ দীর্ঘতপার কাছে। সেই তপস্বী শক্তিদেবকে বললেন, প্রথমে সমুদ্রতীরবর্তী বিটঙ্কপুরে যাও। সেখান থেকে কোনো বাণিজ্যতরীতে উৎস্থল নামক দ্বীপে পৌঁছে ধীবররাজ সত্যব্রতের সাহায্য প্রার্থনা করো। সমুদ্রপথে ঘোর ঝড় উঠল, তরী ভগ্ন হল, ডুবন্ত শক্তিদেবকে অতিকায় এক মাছ এসে গ্রাস করল। সেই মাছ পড়ল উৎস্থল দ্বীপের ধীবরদের জালে। তার পেট কাটা হলে শক্তিদেব নির্গত হল রাজা সত্যব্রতের সামনে। সত্যব্রত কনকপুরীর নাম শুনেছেন মাত্র, কোনো সুদূর দ্বীপে তা অবস্থিত। সে রাত্রে অতিথিশালায় বর্ধমানজ এক বিষ্ণুদত্তের কাছে শক্তিদেব শুনল অশোকদত্ত-বিজয়দত্তের সুদীর্ঘ উপাখ্যান। তার ঘটনাকেন্দ্র বারাণসী, এবং এখানে বেতাল-কাহিনির কিঞ্চিৎ পূর্বাভাস আছে, রাজা প্রতাপমুকুটও আছেন; কিন্তু আমাদের মূল আখ্যানের সঙ্গে তার সম্বন্ধ নেই।
পরদিন প্রাতে শক্তিদেব ধীবররাজ সত্যব্রতের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা করে। সমুদ্রে একটি বিরাট বটবৃক্ষের নিচে জলের ঘূর্ণাবর্তে সত্যব্রতের জাহাজ তলিয়ে গেল। সেই ঘূর্ণাবর্ত এক ভয়ংকর বাড়বানলের মুখে অবস্থিত। শক্তিদেব গাছের শাখা ধরে কোনোক্রমে রক্ষা পেল। সন্ধ্যা নামল; দলে দলে পাখি, অতিকায় শকুনের মতো, সেই গাছে এসে বসল। শক্তিদেব শুনল তারা মানুষের ভাষায় কথা বলছে। এক বৃদ্ধ পাখি সেদিন কনকপুরীতে গিয়েছিল, কাল ভোরে আবার সেখানে যাবে। পাখিটি ঘুমোলে সে তার পিঠের লোমের মধ্যে গিয়ে লুকোল, এবং সেই বাহনে চেপে পরদিন তার স্বপ্নের কনকপুরীতে পৌঁছে গেল।
কনকপুরী মনুষ্যের দুরধিগম্য স্থান, সেখানে কেবল বিদ্যাধরেরা বাস করে। সেখানকার রাজপুত্রীর নাম চন্দ্রপ্রভা। নগরীর কেন্দ্রে তার প্রাসাদ বহুমূল্য রত্নাদি ও দ্যুতিমান মাণিক্যস্তম্ভে গরীয়ান। প্রাসাদের প্রাচীর সোনায় মোড়া। এই স্থানে মর্ত্য মানুষের আগমনে চন্দ্রপ্রভা বিস্মিত হয়ে রইল। শক্তিদেব জানাল তার আগমনের হেতু। চন্দ্রপ্রভা ছিল বিদ্যাধরপতি শশিখণ্ডের চার কন্যার মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠা। অন্য তিন বোন চন্দ্ররেখা শশিরেখা ও শশিপ্রভা একদা যৌবনচাপল্যহেতু অগ্রতপা মুনির বিরক্তি উৎপাদন করেছিল। মুনির অভিশাপে তারা দেহত্যাগ করে মর্ত্যলোকে মানবী হয়ে জন্ম নিল। আবার মুনিরই কৃপায় তারা জাতিস্মর ও দিব্যদৃষ্টিসম্পন্না হল এবং তাদের শাপমুক্তির উপায়ও নির্দিষ্ট হয়ে রইল। শোকবিহ্বল পিতা চন্দ্রপ্রভার হাতে কনকপুরীর ভার দিয়ে বনবাসী হলেন।
অবিবাহিতা চন্দ্রপ্রভা স্বপ্নাদেশে জেনেছিল এক মর্ত্য নর তার পতি হবে। শক্তিদেবকে বিবাহপ্রস্তাব দিয়ে সে শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে পিতার সম্মতি আনতে গেল। বলে গেল, শক্তিদেব যেন এই প্রাসাদের মধ্যদেশে আরোহণ না করে। দুর্বার কৌতূহলে শক্তিদেব প্রাসাদের নিষিদ্ধ স্থানে উঁকি দিল। সেখানে তিনটি গুপ্তকক্ষ। প্রথমটিতে সে দেখল রত্নময় পর্যঙ্কে চিরনিদ্রায় শায়িতা এক কুমারীর দেহ। সে তারই বাঞ্ছিতা রাজকুমারী কনকরেখা ! এবং অপর দু’টি কক্ষেও দু’টি কুমারীর শব। মৃত্যুতেও তারা অম্লান অপরূপা। শক্তিবেগ বিদ্যুৎগতিতে নেমে এল। এক সুরম্য সরসীতীরে একটি সজিন ঘোড়ার পিঠে চড়তে গেল। ঘোড়া তাকে লাথি মেরে জলে ফেলে দিল।
জল থেকে উঠে সে দেখল স্বদেশ বর্ধমানে উপস্থিত হয়েছে। এ কেমন মায়া। কনকরেখাকে সে জিজ্ঞেস করল, রাজসুতে, কনকপুরীতে তোমাকে মৃতা দেখে এলাম, অথচ এখানে তুমি জীবিতা! কনকরেখা রাজাকে বলল, আর সন্দেহ নেই। সে জানাল তার বিদ্যাধরী জন্ম ও শাপের কথা। মুনি বলেছিলেন, যদি কেউ কনকপুরীতে তোমার দেহ দর্শন করে এসে তোমাকে সেই খবর দিতে পারে, তবে তোমার শাপমুক্তি হবে এবং সেই ব্যক্তি তোমার স্বামী হবে। সঙ্গে সঙ্গে সে বিদ্যাধরী পদ প্রাপ্ত হয়ে স্বলোকে ফিরে গেল। সে ছিল চন্দ্রপ্রভার ভগিনী চন্দ্ররেখা।
এরপর বিধির নির্দেশে শক্তিদেব চন্দ্রপ্রভার দুই শাপভ্রষ্ট বোন শশিরেখা ও শশিপ্রভাকে বিয়ে করে তাদের শাপমুক্তি ঘটাল। মানবজন্মে তারা ছিল যথাক্রমে বিন্দুমতী ও বিন্দুরেখা। এর সবিস্তার বিবরণ বাদ দিলে আমাদের আলোচনার কোনো লোকসান নেই। অতঃপর কনকপুরীতে গিয়ে চার বোনের সঙ্গে পরিণীত হয়ে শক্তিদেব অখিলবিদ্যাসহ রাজ্যলাভ করল ও বিদ্যাধরাধিপ ‘শক্তিবেগ’ নামে খ্যাত হল।
চতুর্দারিকা অবধি ঘটনাক্রম একরকম এগিয়ে চলছিল; খটকা লাগে ষষ্ঠ লম্বক মদনমঞ্চুকায় পৌঁছে। আমরা হঠাৎ জানতে পারি, কাব্যের নায়ক নরবাহনদত্তের জীবনের প্রধান ঘটনাবলী অতিক্রান্ত, মহর্ষিদের অনুরোধে তিনি এবার স্বীয় ‘দিব্যচরিতম্’ বলবেন। কিন্তু উত্তম পুরুষে নয়, যেন অপরের মুখে ব্যক্ত হয়েছে এমনভাবে অর্থাৎ প্রথম পুরুষে। তারপর দীর্ঘ কাব্য জুড়ে সেই জীবনকাহিনি বিবৃত হয়।
ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে এই মুহূর্তটি এত আকস্মিক যে পাঠক সূত্রহারা হয়ে পড়ে। সূত্রটি খুঁজে পাওয়া যায় ষোড়শ লম্বক সুরতমঞ্জরীর প্রথম তরঙ্গের শেষে এসে। এখানেই দেখা যায় পিতা উদয়নের মৃত্যুর পর নরবাহনদত্ত ‘অসিতগিরি’[১৬] পর্বতে কশ্যপমুনির আশ্রমে মাতুল গোপালকের সঙ্গে বর্ষাঋতু অতিবাহিত করলেন। মহর্ষিগণ এখানেই সমবেত।
যুক্তির দিক থেকে ষোড়শ লম্বকের এই প্রথম তরঙ্গ থাকা উচিত ছিল ষষ্ঠ লম্বকের আগে, বৃহৎকথার কোনো আদিরূপে হয়তো তা-ই ছিল। সোমদেবে কেন এই গোলমেলে উপস্থাপনা? বিশেষত, নায়কের আখ্যায়িকা কেন তাঁর নিজের জবানিতে নয়, প্রথম পুরুষে? গুণাঢ্যের মূল কাব্য কি কাশ্মীরি সংকলকদের পরম্পরায় পরিবর্তিত হতে হতে এই রূপ ধারণ করেছিল? ব্যাপারটা এতই বিভ্রান্তিকর যে দেখা যায় ক্ষেমেন্দ্র তাঁর কাব্যে এটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন। বৃহৎকথামঞ্জরীর লম্বকানুক্রম প্রথম পাঁচ লম্বকের পর কথাসরিৎসাগরের থেকে আলাদা।
মদনমঞ্চুকা অতি দীর্ঘ লম্বক। এতে আটটি তরঙ্গ-ভাগ, ২৬৫টি শ্লোক ও প্রচুর উপাখ্যান। মূল আখ্যানভাগ প্রায় পুরোটাই কলিঙ্গসেনাকে নিয়ে, যিনি একজন দিব্যাঙ্গনা। তাঁর কন্যা মদনমঞ্চুকার সঙ্গে নরবাহনদত্তের পরিণয় হয় লম্বকের একেবারে অন্তিম পর্বে এসে। ভবিষ্যতের একটি অশান্তির বীজও উপ্ত হয় এই অংশে, যখন বিদ্যাধর মানসবেগ মদনমঞ্চুকার পাণিপ্রার্থী হয়ে কলিঙ্গসেনার দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়।
দ্বাদশ লম্বক শশাঙ্কবতীতে এসে বিনা ভূমিকায় জানা যাবে যে প্রিয়তমা মদনমঞ্চুকা অন্তর্ধান করেছেন এবং নরবাহনদত্ত বিরহতাপে পীড়িত। ব্যস, আর কিছু নয়। এ রহস্যের জট খুলবে চতুর্দশ সর্গ পঞ্চ-লম্বকে। ওই বিদ্যাধর মানসবেগ হরণ করেছেন মদনমঞ্চুকাকে; তাঁকে উদ্ধারের প্রচেষ্টায় কাহিনি-নাট্য ঘনিয়ে উঠবে। এই অভিযানে, ঘটনার এই রামায়ণী মোচড়ে, নরবাহনদত্ত বিয়ে করবেন পাঁচটি বিদ্যাধরী কন্যাকে, সেই বৈবাহিক কথা অতি সংক্ষেপে স্পর্শ করে লম্বকের নাম হবে ‘পঞ্চ’।
এই আশ্চর্য সংক্ষিপ্ততার কারণ কী? পরবর্তী লম্বক মহাভিষেকে আরও পাঁচটি বিবাহও গূঢ় সংক্ষেপে বর্ণিত। এ প্রকরণ স্বাভাবিক লাগে না; মনে হয় যেহেতু বিবাহকথাই এ কাব্যে প্রধান তাই গুণাঢ্যের মূল রচনায় প্রতিটি বিবাহের জন্যই একটি করে অংশ নির্দিষ্ট ছিল। কথাসরিৎসাগরে যেমন আছে সপ্তম রত্নপ্রভা, নবম অলংকারবতী ও দশম শক্তিযশঃ লম্বকে। বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহের সঙ্গে তুলনা করলে এ ধারণা দৃঢ়তর হয়। আবার, এই মহাভিষেক লম্বকেই কাব্যের স্বাভাবিক পরিণতি, এখানে নরবাহনদত্ত বিদ্যাধরদের রাজচক্রবর্তী হলেন।
মহাভিষেকেই কাব্যের সমাপ্তি হতে পারত, ফ্ল্যাশব্যাক-এর প্রয়োজনে সুরতমঞ্জরী থাকতে পারত অনেক আগে – তা হয় নি। মহাভিষেকের পরে পদ্মাবতী ও বিষমশীল নামে দু’টি লম্বক অসংলগ্ন ভাবে গাঁথা আছে। অন্যান্য কিছু লম্বক বা লম্বকাংশও যেন তাদের যথার্থ স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্যত্র অবস্থান করছে। তুলনায় বৃহৎকথাশ্লোকসংগ্রহের যতটুকু পাওয়া গেছে তাতে ঘটনাক্রম অনেক যুক্তিসঙ্গত, প্রতিটি অংশ ব্যাপ্তি ও গভীরতায় অনেক সুষম। পৌর্বাপর্যের এই ওলটপালট, ঘটনার প্রাচুর্য ধারণ করবার জন্য স্থলে স্থলে অস্বাভাবিক সংক্ষিপ্ততা, এগুলো কাশ্মীরি বৃহৎকথার বৈশিষ্ট্য। কাব্যের মূল কাঠামোকে ধরে রেখে তার মধ্যে কত বেশি ও বিচিত্র কথার সন্নিবেশ ঘটানো যায়, তা-ই ছিল কাশ্মীরি সংকলকদের উদ্দেশ্য। এর ভালো মন্দ দু’দিকই আছে। একদিকে যেমন নরবাহনদত্তচরিত সুবিন্যস্ত ভাবে পাওয়া গেল না, অন্যদিকে ‘নানাকথাজাল’-এর মাধ্যমে পাওয়া গেল সেকালের ভারতবর্ষীয় সমাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র।
নানাকথাজাল
‘কথাসরিৎসাগর’-কে শুধু ‘সাগর’ বললে ‘সরিৎ’ অংশ বাদ পড়ে। কিন্তু সাগরই যে-হেতু বড়ো তাই এই গ্রন্থকে সংক্ষেপে Ocean বলার প্রচলন করেছিলেন ইংরেজি অনুবাদকেরা। তাঁদের অনুসরণে আমরাও ‘সাগর’ নামটি ব্যবহার করতে পারি। বর্তমানে সেই ‘সাগর’ পাড়ি দেবার চেষ্টা না করে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দু’একটি সরিৎ বা নদীপথের সন্ধান করে দেখব। তার একটি পঞ্চতন্ত্র, অন্যটি বেতালপঞ্চবিংশতি।
প্রাচীন কথাসাহিত্যের সঙ্গে আমাদের অধিকাংশ মানুষেরই প্রথম পরিচয় ঘটে পঞ্চতন্ত্রের মধ্য দিয়ে। জীবজন্তু এইসব কাহিনিতে প্রধান চরিত্র হয়ে বিরাজ করে, তারা সকলেই অতিপরিচিত। এদের সুবুদ্ধি দুর্বুদ্ধি, প্রেম অপ্রেম, জীবনের সংকট ও বিপন্মুক্তি পঞ্চতন্ত্রকথায় একটা চিরকালীন রম্যতা নিয়ে আসে। আসলে তো পশুরূপী চরিত্রের আড়ালে শাস্ত্রকার তাঁর অভিপ্রায় গোপন করেছেন মাত্র। তিনি নির্মম দৃষ্টিতে দেখেছেন পাপ ও শঠতা, অনুভব করেছেন মানুষ স্বতত অরাজক ও বল্গাহীন, এবং সমকাল উদ্ভ্রান্ত, ‘the time is out of joint’। যে-কথা বলা সম্ভব ছিল না, অথবা যে-কথা খোলাখুলি বললে সুরুচি লঙ্ঘিত হত, তাকে তিনি মুড়ে দিয়েছেন অন্যতর প্রচ্ছদে। এভাবে পশুপাখির গল্প নানা তাৎপর্যে বিন্যস্ত হয়ে ওঠে। সে গল্প চঞ্চল করে তোলে শিশুদের, বড়োরা তার কথক হয়ে ওঠেন, এবং সেই সঙ্গে সন্ধান করেন অকথিত অর্থময়তা।
পঞ্চতন্ত্রের ‘কথামুখ’ অংশে আছে, জগতে সকল অর্থশাস্ত্রের সারবস্তু সম্যক অনুধাবন করে পাঁচটি তন্ত্রের দ্বারা বিষ্ণুশর্মা এই মনোহর শাস্ত্র নির্মাণ করলেন।[১৭] এই পাঁচটি তন্ত্রের নাম – মিত্রভেদ, মিত্রসম্প্রাপ্তি, কাকোলূকীয়, লব্ধপ্রণাশ, এবং অপরীক্ষিতকারক। কম-বেশি সত্তরটি গল্প এই তন্ত্রগুলির অন্তর্গত। এগুলি একেকটি মূল আখ্যান বা frame story–র ভিতরকার উপাখ্যান। বিদ্যাবিমুখ তিন রাজপুত্রকে কথাচ্ছলে নীতিশিক্ষা দিয়ে চলেছেন পণ্ডিত বিষ্ণুশর্মা – এই হল গ্রন্থরচনার পটভূমি। প্রতিটি ভাগ বা তন্ত্রের আরম্ভে এই পটভূমিটি ফিরে আসে ক্ষণিকের জন্য, তারপরেই ‘তদ্যথা অনুশ্রূয়তে’ বলে নতুন কাহিনি শুরু হয়ে যায়। সেই মূল আখ্যানের স্রোতের মধ্যে একেকটি ঘূর্ণির মতো ঘনিয়ে ওঠে উপাখ্যানগুলি; কখনওবা একটি উপাখ্যানের ভিতরে দেখা দেয় আরও উপাখ্যান।
যুগ যুগ ধরে ঢেলে সাজানো হচ্ছে পঞ্চতন্ত্রকথা। তন্ত্রকার বিষ্ণুশর্মার কালনির্ণয় অসম্ভব হয়ে গেছে। কেবল খ্রীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে তাঁর রচনা যে প্রাচীন পহ্লবী ভাষায় অনূদিত হয়ে পৌঁছল পারস্যরাজের দরবারে তা থেকে এটুকুই বলা চলে যে তিনি এই সময়ের পরে নন। পঞ্চতন্ত্রকথার অনেক গল্পের উন্মেষ লক্ষ্য করা যায় জাতকের কথাগুলিতে – যেমন, বকজাতক, বানরেন্দ্রজাতক, মশকজাতক, মিতচিন্তিজাতক, ইত্যাদি। বিষ্ণুশর্মা ইত্যাকার নানা কথাকে সুসংকলিত করলেন। তারপর পারস্যের মাধ্যমে পঞ্চতন্ত্রের যে প্রসার ঘটল তা প্রকৃতই আন্তর্জাতিক। পঞ্চতন্ত্রই সম্ভবত একমাত্র ভারতীয় শাস্ত্র যার একটা অনূদিত রূপ পাশ্চাত্যে পৌঁচেছিল পশ্চিমি প্রাচ্যবাদের (Orientalism) প্রাদুর্ভাবের অনেক আগে। আরব পারস্যে তার নাম হল Kalila wa Dimna (শৃগাল করটক ও দমনকের নামে), পরবর্তীকালে ইংরেজিতে তা সংকলিত হল Fables of Bidpai বা Pilpay’s Fables[১৮] পরিচয়ে।
পঞ্চতন্ত্রের কথাবস্তুর যাবতীয় উপাদানই ঐহিক (secular); প্রখর বাস্তবতাই এ শাস্ত্রের সার। বিষ্ণুশর্মার মেজাজটিও অতি প্রখর। স্বয়ং রাজাকে তিনি নির্ভীক ভাবে বলেন তিনি অর্থের জন্য বিদ্যাবিক্রয় করেন না। এবং, রাজকুমারদের প্রতি তাঁর যে মনোভাব তা দেখে মনে পড়ে সেই গ্রীক রাজগুরুর উক্তি – হে কুমার, জ্যামিতিশাস্ত্রে সকলের জন্য সমান পথ, রাজন্যবর্গের জন্য কোনো ভিন্ন পন্থা নেই।
এ-হেন পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে ‘বিদ্যাধরকথাদ্ভুতম্’ কথাসরিৎসাগরের তা যেন একটা চমক। কিন্তু ‘সাগর’-এর মাঝদরিয়ায় শক্তিযশঃ লম্বকে এসে আমরা হঠাৎ এ শাস্ত্রের দেখা পাই। রাজ-অনুচর গোমুখ যুবরাজকে কিছু সদুপদেশ দেবেন এমন একটি উপলক্ষ্য কবি নির্মাণ করলেন; তারপর গোমুখ পঞ্চতন্ত্রের পঁয়ত্রিশটি কাহিনি বলে গেলেন। তবে তিনি অবিচ্ছিন্ন ভাবে গল্পগুলি বলেন নি, এবং নীতিবাক্যের দ্বারা তাঁর কথার প্রবাহকে ভারাক্রান্ত করেন নি। দেখা যায় তিনি পঞ্চতন্ত্রের ‘কথামুখ’ অংশ বর্জন করেছেন, সরাসরি বনমধ্যে পরিত্যক্ত ষাঁড় সঞ্জীবকের আখ্যান থেকে শুরু করেছেন, আর বেশ কিছু উপাখ্যান বাদ দিয়েছেন। ‘পঞ্চতন্ত্র’ নামটিরও কোনো উল্লেখ নেই।
পঞ্চতন্ত্রের গদ্যরূপই বেশি পরিচিত, কেবল নীতিবাক্যগুলি শ্লোক। এ গদ্য অপূর্ব তরলগতি এবং সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ পাঠকের কাছেও দুরূহ নয়। যদি হঠাৎ কোথাও পেয়ে যাই সে-গদ্যের কোনো নমুনা – ‘অস্তি দাক্ষিণাত্যে জনপদে মহিলারোপ্যং নাম নগরম্। তস্য সমীপস্থঃ অনেকশাখাসনাথঃ অতিঘনতরপত্রচ্ছদো ন্যগ্রোধপাদপঃ অস্তি, তত্র চ মেঘবর্ণো নাম বায়সরাজঃ’, – তখন আমাদের মন ‘এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি’ শ্রবণনিরত অপুর মতো সমুৎসুক হয়ে ওঠে। পঞ্চতন্ত্রের আদিপাঠ লুপ্ত হয়ে গেছে। যে ক’টি recension বা পাঠভেদের ওপর নির্ভর করে তার সংস্কৃতভাষা-রূপের প্রসিদ্ধি তার মধ্যে অন্যতম ‘তন্ত্রাখ্যায়িকা’, দক্ষিণ ভারতের পুঁথি (Southern Panchatantra), নেপালে প্রাপ্ত পুঁথি, কোনো অনামা জৈন লেখকের পুঁথি যা পাশ্চাত্য মহলে Textus Simplicior নামে পরিচিত, জৈন সাধু পূর্ণভদ্র রচিত আরেকটি পুঁথি, এবং ‘হিতোপদেশ’ নামক পুনর্লিখিত রূপ। তার পাশে স্থান পায় সোমদেবের ‘সাগর’-স্থ পাঠ। সেটি পদ্যে রচিত।
বেতালপঞ্চবিংশতিও কিছুটা আকস্মিক ভাবেই দেখা দেয় ‘সাগর'-কূলে। শশাঙ্কবতী লম্বকের প্রায় পুরোটা জুড়েই তার বিস্তার চলে। বেতালপঞ্চবিংশতির সর্বজনবিদিত রূপটি যে দু’টি পাঠের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তা হল শিবদাস ও জম্ভলদত্তের পুঁথি। এঁরা দু’জনেই আনুমানিক ভাবে খ্রীষ্টীয় একাদশ থেকে চতুর্দশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের লোক। বেতালপঞ্চবিংশতির বাংলা রূপান্তর অনেক রচিত হয়েছে, তার মধ্যে ১৩৫ বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত দু’টি রূপের কথা স্মরণ করলে দেখতে পাই কথাসরিৎসাগরের বেতাল কাহিনির সঙ্গে তাদের কোনো যোগসূত্র নেই। এই বাংলা রূপান্তরের একটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭), অন্যটি লীলা মজুমদারের ‘ছোটদের বেতাল বত্রিশ’ (১৯৮২)। বিদ্যাসাগরের হাত দিয়ে বেতাল যে বাংলাসাহিত্যে প্রবেশ করল তা বাংলাভাষার দিক থেকে একটি বিশেষ ঘটনা, কারণ তা আধুনিক বাংলা গদ্যের বাক্যান্বয়ের একটি আদি নিদর্শন। (কমা-চিহ্নের নিঃশেষ প্রাচুর্যও সেই গদ্যের একটি বৈশিষ্ট্য। যেমন, ‘স্বর্ণকার, ভয়প্রদর্শনপূর্বক, বার বার এইপ্রকার জিজ্ঞাসা করাতে, রাজপথবাহী বহুসংখ্যক লোক, কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া, তথায় সমবেত হইল।’[১৯]) কিন্তু বাংলায় এই বেতাল-গ্রন্থের উৎপত্তির সূত্রটাই আলাদা। সপ্তদশ শতকে জয়পুর মহারাজের উৎসাহে সুরত কবিশেখর ব্রজভাষায় বেতালের পুনর্লিখন করেন। ১৮০৫ সনে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যাপক গিলক্রিস্টের তত্ত্বাবধানে লল্লু লাল প্রমুখ তার হিন্দী রূপান্তর করেন। সেই হিন্দী পাঠ ‘বৈতালপচীসী’ অবলম্বন করে বিদ্যাসাগর বাংলায় বেতালপঞ্চবিংশতি প্রকাশ করেন। লক্ষণীয় যে বিদ্যাসাগর কেবল হিন্দী ‘বৈতালপচীসী’-রই ঋণ স্বীকার করেছেন; ‘কথাসরিৎসাগর’ তো নয়ই, অন্য কোনো সংস্কৃত পুঁথিরও উল্লেখ করেন নি। সম্ভবত শিবদাস বা জম্ভলদত্ত বিরচিত বেতালের কোনো সংস্করণ তখনও প্রকাশিত ছিল না।[২০] ‘কথাসরিৎসাগর’-এর উল্লেখ খুব প্রত্যাশিতও নয়, কারণ বিদ্যাসাগর কথিত বেতাল-কাহিনি ঘটনাবলী ও চরিত্রনামের দিক থেকে অনেকটাই আলাদা। ‘কথাসরিৎসাগর’-এর বেতাল কাহিনির প্রধান চরিত্র রাজা ত্রিবিক্রমসেন, দুষ্ট যোগীর নাম ক্ষান্তিশীল; বিদ্যাসাগরের বেতালের নায়ক রাজা বিক্রমাদিত্য, যোগী শান্তশীল। প্রথম বেতালের কাহিনি তুলনা করলে দেখা যায় ‘কথাসরিৎসাগর’-এর যুবরানি পদ্মাবতী কর্ণোৎপল রাজ্যের সংগ্রামবর্ধন নামক এক দন্তঘাটক (দন্তকার) সভাসদের মেয়ে, আর বিদ্যাসাগরে সে কর্ণাট নগরের রাজা দন্তবাটের কন্যা। কাহিনির অন্যান্য অনুপুঙ্খে, এবং পরিণতিতে, আরও প্রভেদ আছে। লীলা মজুমদারের আখ্যায়িকাও একই রকম, তবে তিনি বিদ্যাসাগর না অন্য কোন্ সূত্র অনুসরণ করেছেন তার বিন্দুমাত্র উল্লেখ ‘ছোটদের বেতাল বত্রিশ’-এ কোথাও নেই।
The Ocean
একাদশ শতকে তার রচনাকাল থেকে কথাসরিৎসাগর ঠিক কতখানি ও কী রূপে প্রচলিত ছিল ভারতভূমিতে তার স্পষ্ট ইতিহাস অপ্রাপ্য। অনুমান করা যায় উত্তর ভারতে তার প্রসার ঘটেছিল এক রকমের। ছোটো বড়ো রাজবংশগুলিতে রাজন্যবর্গ সংস্কৃতে শিক্ষিত হতেন, ব্রাহ্মণেরা সংস্কৃতে অভিজ্ঞ ছিলেন, তীর্থক্ষেত্রগুলিতে কথা পাঠ চলত অবিরত – অতএব এই কাব্যটির চর্চা কেবল কাশ্মীর ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ ছিল না তা ধরে নেওয়া যায়।
কথাসরিৎসাগর বিশ্বের দরবারে দেখা দিল উনবিংশ শতকে। অবশ্যই প্রাচ্যবিদ পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের চেষ্টায়। ১৮২৪ সালে সুবিখ্যাত উইলসন (Horace Hayman Wilson) প্রথম পাঁচটি লম্বকের সারাংশ ইংরেজিতে প্রকাশ করেন ওরিয়েন্টাল কোয়ার্টার্লি ম্যাগাজিনে[২১]। সেই হল সূচনা। এরপর আদ্যোপান্ত সংস্কৃত পাঠের সংকলনে প্রয়াসী হলেন জর্মন অধ্যাপক ব্রকহাউস (Hermann Brockhaus)। ছ’টি হস্তলিখিত পুঁথির ওপর নির্ভর করে তাঁর কাজ এগোল। তাঁর সম্পাদনায় মূল পাঠ প্রকাশিত হল লাইপ্ৎসিগ থেকে দু’দফায়, ১৮৩৯-এ প্রথম পাঁচ লম্বক, ১৮৬২-তে বাকি তেরোটি। Kathā Sarit Sāgara, Die Mӓrchensammlung des Somadeva Bhatta aus Kaschmir নামক এই সংকলনে সংস্কৃত শ্লোকসমূহের শেষে থাকল জর্মন গদ্যে তার সারানুবাদ। এখানে লক্ষণীয় যে সোমদেবের কাব্য প্রথম থেকেই গৃহীত হল Mӓrchen অর্থাৎ রূপকথা বা লোকসাহিত্যের শ্রেণিতে, ‘এপিক’-এর পঙ্ক্তিতে নয়।
ব্রকহাউসের নির্মিত পাঠের পরে ভারতবর্ষে পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদ আরেকটি সংশোধিত পাঠ সম্পাদনায় হাত দেন। তাঁর ভিত্তি ছিল ব্রকহাউসের পাঠ ও বোম্বাইয়ে আবিষ্কৃত দু’টি পুঁথি। ‘গ্রন্থকর্তুঃ প্রশস্তিঃ’ নামক পরিশিষ্টটি এই সময় যোগ হয়। ১৮৮৯ সালে দুর্গাপ্রসাদের সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় বোম্বাইয়ের (অধুনা মুম্বই) নির্ণয়সাগর প্রেস থেকে। ব্রকহাউসের কথাসরিৎসাগর ছাপা হয়েছিল প্রথম খণ্ড দেবনাগরী ও পরের খণ্ড রোমান হরফে; দুর্গাপ্রসাদ ব্যবহার করলেন সম্পূর্ণ দেবনাগরী লিপি।
এই দু’টি সংস্কৃত সংস্করণ বর্তমান কাল অবধি কথাসরিৎসাগরের প্রধান ভিত্তি। কালের বিচারে দুর্গাপ্রসাদের পাঠই অধিকতর শুদ্ধ ও প্রামাণিক বলে গণ্য হয়েছে।
কিন্তু দুর্গাপ্রসাদের সংস্করণ প্রকাশের আগেই কথাসরিৎসাগর পৌঁছে গিয়েছিল অনুবাদ-সাহিত্যের অঙ্গনে। সে কাজে আত্মনিয়োগ করেন চার্লস হেনরি টনি (Tawney)। শ্রী টনি (১৮৩৭–১৯২২) বিশিষ্ট বিদ্বান হলেও ঠিক প্রাচ্যবিদ হিসেবে জীবন শুরু করেন নি। গ্রীক ল্যাটিন ও ইংরেজি সাহিত্যে তিনি ছিলেন সুপণ্ডিত। ১৮৬৫-তে কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক রূপে তাঁর ভারতবর্ষে আগমন। ১৮৭৫-এ তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের কাজ করেন। ১৮৭৬-৯২ মোটামুটি একটানা, ছোটো ছোটো দু’এক দফা বাদে, তিনি অধ্যক্ষ পদে ছিলেন। ভারতে আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই টনি সংস্কৃতভাষায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠায় সংস্কৃত আয়ত্ত করেন। তাঁর প্রথম প্রকাশনা দু’টি বিখ্যাত নাটকের ইংরেজি গদ্যানুবাদ, ভবভূতির উত্তর-রামচরিত এবং কালিদাসের মালবিকাগ্নিমিত্র, যথাক্রমে ১৮৭৪ ও ১৮৭৫ সালে। ১৮৭৭-এ ইংরেজি পদ্যে তিনি অনুবাদ করেন Two Centuries of Bhartrihari. পরবর্তীকালে স্বদেশে ফিরে গিয়ে টনি জৈনধর্মবিষয়ক সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। জৈন গ্রন্থ ‘কথাকোষ’-এর টনি-কৃত অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৮৯৫-এ, আর ‘প্রবন্ধচিন্তামণি’-র অনুবাদ মুদ্রিত হয় ১৮৯৯-১৯০১ পর্বে।
চার্লস টনির মহত্তম সাহিত্যকর্ম অবশ্য কথাসরিৎসাগরের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি গদ্যানুবাদ। তিনি ব্যবহার করেছিলেন ব্রকহাউসের সংস্করণ, ও কোলকাতায় প্রাপ্ত কতিপয় সংস্কৃত পুঁথি। সে অনুবাদ The Kathā Sarit Sāgara, or Ocean of the Streams of Story নামে দু’খণ্ডে প্রকাশ হয় ১৮৮০ থেকে ১৮৮৪-র মধ্যে এশিয়্যাটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল-এর Bibliotheca Indica গ্রন্থমালায়। প্রকাশক ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রেস, কোলকাতা।
ইংরেজি অনুবাদের ব্যাপারে কোনো সহজ পন্থা অবলম্বন করেন নি চার্লস টনি। তাঁর ভর্তৃহরির ভূমিকাতেই ছিল তাঁর অনুবাদ-চিন্তার বলিষ্ঠ অভিব্যক্তি। তিনি বলেছিলেন যথেষ্ট ‘local colouring’ বজায় রাখতে তাঁর কুণ্ঠা নেই, এবং প্রাচ্য সাহিত্যের এমন কোনো পাঠ পরিবেশনে তাঁর অভীপ্সা নেই যা কেবল ‘Englishmen unacquainted with Sanskrit’-এর রসনার উপযুক্ত – ‘… a certain measure of fidelity to the original, even at the risk of making oneself ridiculous, is better than the studied dishonesty which characterises so many translations of Oriental poets’. কথাসরিৎসাগর অনুবাদের সময় তিনি আরও অভিজ্ঞ অনুবাদক, তাই ভাষান্তরের সমস্ত প্রতিবন্ধক ও জটিলতা উত্তরণের ক্লেশ তিনি বহন করেছেন। তাতে যে ক্লিষ্ট হয়ে পড়েছে তাঁর ভাষা এমন নয়, মূলানুগামিতার প্রয়াস-চিহ্নও যত্রতত্র ফুটে ওঠে নি – বরং কী অবলীলায় তিনি ধারণ করেন সংস্কৃতভাষার কোনো সুনিপুণ টান, কিংবা কোনো ঘননিবদ্ধ চিত্রকল্প, তা মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বিস্ময় জাগায়। তাই, যেখানে ‘কথামুখ’ লম্বকে বাসবদত্তার পাণিগ্রহণ করলেন বৎসরাজ, সেই অনুপম ‘রতিবল্লরীনবোদ্ভিন্নমিব পল্লবমুজ্জ্বলম্’ হাতটির বর্ণনাকে এই ভাষায় নিবেদন করতে পারেন টনি: Then the King of Vatsa received the hand of Vāsavadattā, like a beautiful shoot lately budded on the creeper of love[২২]
ব্রকহাউসের পাঠ বিষয়ে নানা সংশয় ছিল টনির। স্থানে স্থানে অন্য পুঁথির ভিত্তিতে প্রখর অনুমান কাজে লাগিয়ে তিনি যথার্থ অনুবাদের চেষ্টা করেছেন। তাঁর গ্রন্থপ্রকাশের পাঁচ বছর পর যখন দুর্গাপ্রসাদের সংস্করণ ভূমিষ্ঠ হল তখন দেখা গেল টনির অধিকাংশ অনুমান বেশ অভ্রান্ত। এর একটা নমুনা, পুষ্পদন্তের শাপ প্রসঙ্গে ‘অবিনীত’ শব্দটা। পার্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, ‘মর্ত্যো ভব অবিনীতেতি’ ইত্যাদি; অর্থাৎ, রে অবিনীত (দাস), তুই মর্ত্যজন হয়ে জন্মাবি। ব্রকহাউসে ছিল ‘অতিবিনীত’ শব্দটি। প্রসঙ্গ বুঝে টনি একেবারে বিপরীতার্থক ‘অবিনীত’ শব্দ অনুমান করলেন। পাদটীকায় লিখলেন, For the ativinīta of Brockhaus’ text, I read avinīta.[২৩]
টনি তাঁর অনুবাদগ্রন্থ অসংখ্য টীকা ও টিপ্পনীতে সমৃদ্ধ করেছেন। একদিকে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ক্ল্যাসিক ও আধুনিক সাহিত্যে তাঁর অধিকার এই টীকাগুলিকে অমূল্য করে তুলেছে। যে প্রসঙ্গেরই কিঞ্চিৎ পরিচয় আবশ্যক, যেমন শিবের অনুচর নন্দী, অথবা মন্দর পর্বত কিংবা কল্পবৃক্ষ, সৃষ্টির আদিতে যে ‘প্রকৃতি’, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি সংক্ষিপ্ত পাদটীকা যোগ করেছেন। ভারতীয় সাহিত্যের অনেক ঘটনা যে ন্যগ্রোধ বৃক্ষতলে সংঘটিত হয় তার জন্য তিনি উল্লেখ করেছেন সেই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম। সংস্কৃত বাগ্ধারায় ‘অস্তি’ শব্দ গল্পারম্ভে ‘একদা’-র ভূমিকা গ্রহণ করে, সেকথাও তিনি পাঠকের জন্য ব্যাখ্যা করেছেন। এসবের সঙ্গে নানা জায়গায় তিনি ব্রকহাউসের পাঠকে নিজের অন্তর্দৃষ্টি বলে পরিশোধন করেছেন। এবং আরও মূল্যবান, অনেক প্রসঙ্গসূত্রে তিনি অন্যান্য প্রসিদ্ধ গ্রন্থে সেই বিশেষ ভাবনা বা কাহিনির উৎস অথবা অনুরণন সন্ধান করেছেন। টনির সময়ের পরে প্রাচ্যবিদ্যা বহুদূর অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যবিদ্যার তৎকালীন পরিধির মধ্যে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রচেষ্টা ও সাফল্য রীতিমতো বিস্ময়কর।
চার্লস টনির এই বিরাট কীর্তি সম্বন্ধে আমরা যে আলোচনা করতে পারছি তার ভিত্তি অবশ্য টনির আদি গ্রন্থ নয়। তার ভিতরে একটি অন্য বৃত্তান্ত নিহিত। টনির অনুবাদগ্রন্থের আদি রূপ ক’জন স্বচক্ষে দেখেছেন আজকের দিনে জানা নেই; হয়তো কোলকাতা শহরের কোনো দুর্ভেদ্য ও সাধারণের অগম্য গ্রন্থাগারে সে বইয়ের কোনো কপি থাকতে পারে। টনির জীবদ্দশায় তাঁর কাজ নিশ্চয়ই সমাদর ও মনোযোগ লাভ করেছিল, কিন্তু সেটা সম্ভবত ঘটেছিল প্রাচ্য বিষয়ে কৌতূহলী অথবা পেশাদার বিশেষজ্ঞ ইংরেজ ও অন্যজাতীয় পাশ্চাত্য বিদ্বানদের মধ্যে। একান্ত গোত্রহীন ও নিছক সাহিত্যরসপিপাসু পাঠকের কাছে, এমনকি ইংরেজ পাঠকের কাছেও, কতখানি পৌঁচেছিল এশিয়্যাটিক সোসাইটির প্রকাশিত এ বই কে জানে। কারণ, এ বইকে আগাগোড়া ঢেলে সাজাবার সংকল্প যিনি করলেন প্রথম প্রকাশের চার দশক পরে, সেই N. M. Penzer নিজে আন্তর্জাতিক লোকসাহিত্যে বিশেষজ্ঞ (folklorist) ও প্রাচ্যবিষয়ে অধিকারী হয়েও টনি এবং কথাসরিৎসাগর সম্বন্ধে ছিলেন সম্পূর্ণ অনবহিত।
N. M. Penzer ইংলণ্ডে ফোক-লোর সোসাইটি ও রয়্যাল এশিয়্যাটিক সোসাইটির মেম্বার, ও রয়্যাল অ্যান্থ্রপলজিক্যাল সোসাইটির ফেলো ছিলেন। আরব্য রজনী, বিক্রম ও বেতালের আখ্যান, বাৎস্যায়নের কামসূত্র প্রভৃতি বহু গ্রন্থের অনুবাদক এক বহুবর্ণ চরিত্র রিচার্ড বার্টনের সম্পূর্ণ গ্রন্থপঞ্জী সংকলন করেন পেন্জ়ার। পুঙ্খানুপুঙ্খ টীকা সমন্বিত সেই পঞ্জীর নাম An Annotated Bibliography of Sir Richard Francis Burton. এই গ্রন্থপঞ্জী প্রণয়নের সূত্রে তাঁকে ডুবে যেতে হয় বার্টনের বিপুল গ্রন্থাবলী ও বিপুলতর ব্যক্তিগত কাগজপত্রের রাশীভূত সংগ্রহের ভিতরে; খুঁটিয়ে দেখতে হয় প্রতিটি পুস্তিকা নিবন্ধ ও পত্র, তার অনেক কিছুই বার্টনের লেখা না হলেও তিনি সাগ্রহে সঞ্চয় করে গিয়েছিলেন। এই নিরীক্ষণের মধ্যে একদিন ১৯১৭–১৮ সালে পেন্জ়ার-এর চোখে পড়ে যায় টনির কথাসরিৎসাগরের আদি সংস্করণের একাংশ। আরব্য রজনী তাঁর প্রায় কণ্ঠস্থ, আর সংস্কৃত কথাসাহিত্যে হিতোপদেশ ও তজ্জাত ইউরোপীয় কথামালা Pilpay’s Fables-এর সঙ্গে তাঁর পরিচয়; দ্রুত চোখ বুলিয়েই পেন্জ়ার বুঝতে পারেন এই নতুন বস্তুটি একেবারে অপরিচিত। অথচ এ যে কোনো মহৎ সাহিত্যরচনার অংশবিশেষ, যার রচনাকাল রচয়িতা এমনকি অনুবাদক সম্বন্ধেও বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাঁর, সেকথাও উপলব্ধি করেন তিনি। এবং সেই সঙ্গে কোনো দুর্জ্ঞেয় অনুভূতির বশে তাঁর মনে হয়, এই অজ্ঞাতপূর্ব ভারতীয় গ্রন্থটি তাঁর নিজের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যের সূচনা করছে। এরপর বার্টনের গ্রন্থপঞ্জী কিছুকালের জন্য সরিয়ে রেখে তিনি কথাসরিৎসাগর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। আর ক্রমেই মনে হতে থাকে ‘… as if Burton, with whom I had now become so intimate, was offering me the chance of giving to the public the Indian counterpart[২৪] of his own great Arabian Nights ’.
যাঁরা বিদ্যানুরাগী ও পুস্তক-পাগল তাঁদের অন্বেষণ ও আবিষ্কারের পথে পথে একধরনের নিয়তি কাজ করে, পেন্জ়ারের জীবনে যেন তা-ই ঘটল। তিনি সংকল্প করলেন তৎকালপরিজ্ঞাত প্রাচ্যবিদ্যা ও লোকসাহিত্যশাস্ত্রের যাবতীয় গবেষণা সম্ভার কাজে লাগিয়ে টনির অনুবাদের এক বৃহৎ সংস্করণ সম্পাদনা করবেন। বৃদ্ধ চার্লস টনির সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করলেন ও বিশিষ্ট বিদ্বানদের পরামর্শ প্রার্থনা করলেন। তারপর প্রকাশকের সন্ধানে বিস্তর অভিযান ও ক্রমাগত ব্যর্থতার পরে Mr. Sawyer নামক জনৈক পুস্তকবিক্রেতা তাঁর প্রস্তাবের গুরুত্ব অনুভব করলেন। এই Sawyer-ও নাকি বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম এই গল্পসংগ্রহ তাঁর দীর্ঘ পুস্তকবিক্রয়ের জীবনে কেউ কোনোদিন চায় নি, তিনি নিজেও কখনও চোখে দেখেন নি।
The Ocean Of Story, being C. H. Tawney’s translation of Somadeva’s Kathā Sarit Sāgara (or Ocean Of Streams Of Story), now edited with Introduction, fresh Explanatory Notes and Terminal Essay by N. M. Penzer ছিল দশ খণ্ডের সুবিশাল প্রকল্প। ১৯২৪-এ লণ্ডন থেকে Sawyer-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রকাশিত হয় প্রথম খণ্ড, কেবল গ্রাহকদের জন্য। চার্লস টনি ততদিনে লোকান্তরিত হয়েছেন; তাঁরই স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হল The Ocean Of Story। ১৯২৮-এ বেরোয় দশম ও অন্তিম খণ্ড, যেটি শুধু পরিশিষ্ট ও নির্ঘণ্টের জন্য নির্দিষ্ট। টনির পুস্তক দু’খণ্ড মিলিয়ে ছিল চোদ্দশো পৃষ্ঠার। পেন্জ়ারের বৃহৎ সংস্করণের আয়তন দাঁড়াল প্রায় তিন হাজার আটশো পৃষ্ঠা।
পরবর্তীকালে কথাসরিৎসাগর বিষয়ে যে-কোনো কাজ, গবেষণা অনুবাদ-প্রচেষ্টা অথবা নতুন সন্দর্ভ, তার আকর ও দিশারী হয়ে আছে পেন্জ়ার সম্পাদিত এই গ্রন্থাবলী। টনির অনুবাদ মোটামুটি অবিকল রক্ষিত হয়েছিল এই সংস্করণে। যৎসামান্য যে অংশগুলি অনূদিত হয় নি টনির বইয়ে, একমাত্র তারই নতুন অনুবাদ যুক্ত হয়েছিল। (এইসব অংশের কিছু কিছু ভিক্টোরীয় রুচির প্রতিকূল বলে টনি বর্জন করেছিলেন।) আদি রচনার প্রায় অর্ধশতাব্দী বাদে, একটি বিশ্বযুদ্ধ ও ইংরেজ জাতির মনন রুচি ও ভাষার গুরুতর ওলটপালটের পরেও যে অনুবাদের মূল পাঠটি অবিকৃত রইল তা থেকে বোঝা যায় টনির কাজকে একটি ক্ল্যাসিকের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত ছিলেন না সম্পাদক পেন্জ়ার। এবং এতটাই ছিল টনির অনুবাদের প্রতি তাঁর দরদ যে অনুবাদের ভ্রান্তি সম্বন্ধে স্থলবিশেষে নিঃসংশয় হয়েও তিনি পাঠের কোনো বদল করেন নি, কেবল পাদটীকা দ্বারা সমস্যার নিরসন করেছেন। এর নমুনা, গুণাঢ্যের জন্মবৃত্তান্তে দৈববাণী ধ্বনিত হয়েছিল, এই সন্তানটি একটি গণের অবতার। ‘গণাবতার’-কে ‘গুণাবতার’ ভেবেছিলেন ব্রকহাউস, হয়তো ‘গুণাঢ্য’ নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, আর তার প্রভাবে টনি করেছিলেন ‘an incarnation of virtue’. পেন্জ়ার এই ভ্রান্তির মর্মভেদ করে পাদটীকায় যথার্থ অনুবাদটি যোগ করেছেন।
বস্তুতপক্ষে, পেন্জ়ারের প্রয়াসে The Ocean Of Story হয়ে উঠল কথাসরিৎসাগর সংক্রান্ত এক মহাকোষ। টনির যে টীকাগুলির তাৎপর্য তখনও অখণ্ডনীয় এবং যেসব টীকা স্বয়ংসম্পূর্ণ, সেগুলিতে হস্তক্ষেপ করলেন না পেন্জ়ার। কিন্তু প্রয়োজনবোধে অধিকাংশ টীকার তিনি পুনর্লিখন করলেন, কোনোটা আংশিক কোনোটা সম্পূর্ণ ভাবে। যেগুলির আংশিক পুনর্লিখন হল সেখানে পেন্জ়ার যথাযোগ্য যতিচিহ্নের কৌশলে নির্দেশ করলেন কতটুকু টনির আর কতটুকু তাঁর নিজের সংযোজন। আংশিক ও সম্পূর্ণ উভয়প্রকার পুনর্লিখনের ভিতরেই সন্নিবিষ্ট হল এ-যাবৎ প্রকাশিত সমস্ত গবেষণা ও আলোচনার ফসল। কোনো কোনো টীকায় এত বিস্তারিত আলোচনার আবশ্যক হল যে সেগুলি সংযোজিত হল একেকটি অধ্যায়ের শেষে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ রূপে। যেমন, অশ্বমেধ যজ্ঞ কিংবা গান্ধর্ব বিবাহ বিষয়ক টীকা। লোকসাহিত্য বিশারদ পেন্জ়ারের ঝোঁক ছিল বিশ্বজনীন নানা লৌকিক ‘মোটিফ’-এর গতিপথ অনুসরণের দিকে। সেইসব প্রসঙ্গ ছুঁয়ে তাঁর সমীক্ষা সবিশেষ উজ্জ্বল ও সর্বগ্রাহী হয়ে উঠেছে। যে প্রসঙ্গগুলি পাদটীকার পরিসরের অনুপযুক্ত হওয়ায় সম্যক প্রবন্ধের চেহারা নিয়েছে সেগুলি প্রধানত ওই বিচিত্র মোটিফ-এর সন্ধান। লোকসাহিত্যে জাদু-দ্রব্য (যথা, জাদু যষ্ঠি বা পাদুকা), বা কৌশলে বন্দী প্রণয়প্রার্থী (entrapped suitors) এ-জাতীয় বিষয়ের দৃষ্টান্ত। এসব আলোচনায় পেন্জ়ার বিশ্বসাহিত্যে যে বিচরণ করেছেন তা কেবল পূর্ব ও পশ্চিমের উন্নত সভ্যতার সাহিত্যবীক্ষা নয়, পৃথিবীর অখ্যাত অবজ্ঞাত বহু আদিম জাতির সাহিত্যভাবনাকেও আলিঙ্গন করেছে।
এ ছাড়া প্রতিটি খণ্ডের পরিশিষ্টে পেন্জ়ার যুক্ত করেছেন বিশেষ বিশেষ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রবন্ধ। এগুলি সাধারণত কথাসরিৎসাগর তথা ভারতীয় পুরাণ ও সাহিত্যের কোনো বৃহৎ প্রসঙ্গ, অথবা সহমরণের মতো বহু-আলোচিত কোনো সামাজিক প্রথা, আর নয়তো অত্যন্ত কৌতূহলজনক কোনো বিষয়। প্রথম গোত্রে স্থান পায় দেবযোনিদের (বিদ্যাধর, কিন্নর, গণ প্রভৃতি) পরিচয় সম্বন্ধে তথ্যগর্ভ আলোচনা, দেবদাসী প্রথা, উর্বশী-পুরূরবার বৃত্তান্ত, নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান, ঘট-কর্পর কাহিনির উৎপত্তি, পঞ্চতন্ত্রকথা, এবং বেতালপঞ্চবিংশতি বিষয়ক দীর্ঘ প্রবন্ধ। দ্বিতীয় গোত্রে সন্নিবিষ্ট হয় গর্ভিণী নারীর সাধ বা দোহদ, ভারতীয় কঞ্চুকী (খোজা প্রহরী), এবং অবশ্যই সহমরণ প্রথা। তৃতীয় গোত্রটিতে বিচিত্র সমাবেশ, তার মধ্যে বিষকন্যা থেকে হাঁচি-সম্বন্ধীয় আশীর্বচন (sneezing salutations; যথা, কেউ হাঁচি দিলে কোনো ইষ্টনাম জপ করা হত) প্রসঙ্গের গবেষণাসমৃদ্ধ আলোচনা আছে। নবম খণ্ডের শেষে সম্পাদকের উপসংহারমূলক প্রবন্ধ (Terminal Essay) সমেত পরিশিষ্টের এইসব প্রবন্ধের সংখ্যা মোট সতেরো।
সম্পাদকীয় ভাষ্যের তিনটি মুখ – পাদটীকা, প্রবন্ধসদৃশ টীকা, ও পরিশিষ্টে আশ্রিত প্রবন্ধ। এবং, এই প্রতিটি আলোচনাই প্রাসঙ্গিক অসংখ্য বই ও গবেষণাকর্মের উল্লেখে পরিপূর্ণ, যা থেকে অনুসন্ধিৎসু পাঠক এতদ্সম্পৃক্ত বিদ্যার একটা মানচিত্রের ধারণা করতে পারবেন পদে পদে। এর পাশাপাশি রয়েছে সুবিশাল নির্দেশিকা। প্রত্যেক খণ্ডে সযত্নসাধিত দু’টি নির্ঘণ্ট, একটি নাম ও সংস্কৃত শব্দের জন্য, অন্যটি General। টীকায় উল্লিখিত প্রসঙ্গও নির্ঘণ্ট থেকে বাদ পড়ে নি, তাদের জন্য স্বতন্ত্র নির্দেশক চিহ্ন আছে। পরিশিষ্ট ও নির্ঘণ্টের জন্য নির্দিষ্ট দশম খণ্ডটি এক বিপুল সহায়িকা। এই খণ্ড আরম্ভ হয় টনির আদি সংস্করণ ও পেন্জ়ারের বৃহৎ সংস্করণের একটি তুলনামূলক সারণি (Correlation Table) দিয়ে। তারপর সংকলিত হয় এই সংস্করণের খণ্ড ও পৃষ্ঠা সংখ্যা সম্বলিত বিভিন্ন সূচি - সমস্ত উপাখ্যানের বর্ণানুক্রমিক সূচি, ব্যবহৃত মোটিফ-এর বর্ণানুক্রমিক সূচি, লম্বকগুলির নামের তালিকা, টীকা ও পরিশিষ্টে উল্লিখিত বিভিন্ন বৌদ্ধ জাতকের বর্ণানুক্রমিক সূচি, এবং বৃহৎকথা ও তার প্রধান পাঠরূপ (recensions) সম্বন্ধীয় সন্দর্ভের কালানুক্রমিক সূচি। শেষোক্ত সূচিটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে নানা ভাষায় (ইংরেজি, জর্মন, ফরাসী, রুশ, ডাচ, সংস্কৃত) বৃহৎকথা-চর্চার দীর্ঘ ইতিহাসের একটি আলেখ্য। পরিশেষে সংকলিত হয়েছে সমগ্র গ্রন্থাবলীতে আলোচিত ও উল্লিখিত বিষয়ের একটি সামূহিক নির্ঘণ্ট।
পূর্বোল্লিখিত সূচিগুলি কথাসরিৎসাগরের দিগন্তহীন ব্যাপ্তির মধ্যে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের মতো। সাধারণ পাঠকের বিশেষ সহায়ক উপাখ্যানের সূচিটি। এই সূচি যে মূল গ্রন্থোক্ত নাম অনুসারেই সাজানো তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে প্রসঙ্গবিশেষের ইংরেজি নাম অনুযায়ীও বিন্যস্ত [যেমন, (the) Ascetic who conquered anger]। পাঠকের সহায়ক সবই এই সূচিতে আছে, কেবল প্রতিটি নতুন উপাখ্যানের নামের বাঁদিকে যদি থাকত একটি ক্রমিক সংখ্যা তা হলে উপাখ্যানের মোট সংখ্যা বিষয়ে (যা নিয়ে প্রচুর মতান্তর) একটি নিঃসংশয় হিসেবে পৌঁছনো যেত।
পেন্জ়ারের নিজস্ব মেধাপ্রসূত সম্পাদনার কথা বলা হল। তবে তাঁর কর্মের পাশাপাশি অন্য কিছু বস্তু এই গ্রন্থাবলীকে আরও প্রসারিত করেছে। পেন্জ়ারের অনুরোধে প্রথম ন’টি খণ্ডের জন্য একেকটি মুখবন্ধ লিখেছিলেন ন’জন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিত। এঁরা সকলেই প্রাচ্যবিদ্যা ও লোকসাহিত্যে গভীর ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন, এবং অনেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নাইটহুড ও অন্যান্য খেতাব-ধারী; কিন্তু এঁদের নাম সর্বসাধারণের পরিচিত এমনটা বলা চলে না। এঁদের মধ্যে আছেন Linguistic Survey of India খ্যাত (আমাদের পূর্বোল্লিখিত) গ্রিয়ারসন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য পণ্ডিত, ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক নানা প্রসঙ্গে যাঁদের নাম উল্লিখিত হয়। আর আছেন একজন বাঙালি, স্যর অতুল চ্যাটার্জী। এই নিবন্ধগুলির বিস্তার অসামান্য। কথাসরিৎসাগরের কথামালার উৎস কী (আর্য না অনার্য, দেশজ না বিদেশাগত, জম্বুদ্বীপ না বৃহত্তর এশিয়ার) এবং তার বহুবিধ অনার্য উৎসের সম্ভাব্যতা নিয়ে অনেক গুরুতর জিজ্ঞাসা উঠে আসে প্রথম আলোচনায়। গ্রিয়ারসন তাঁর নিবন্ধে তুলনা করেন প্রাচীন মোটিফ ও তাঁর নিজের দেখা ভারতবর্ষে বিদ্যমান নানা বিশ্বাস ও প্রথা। একটি নিবন্ধে আলোচিত হয় লোককথার পশ্চিমমুখী ও পূর্বমুখী প্রবাহ, লিখিত সাহিত্য ও কথকতার মধ্যে উপাদানের চলাচল, এবং কথার মৌলিকতা ও তার উৎপত্তির দুরূহ প্রশ্ন। পরবর্তী একটি নিবন্ধে অনুরূপ ভাবনারই গভীরতর মন্থন করে দেখানো হয় সুসাহিত্যের উন্নত আঙ্গিকে সংকলিত কথার কাছে মৌখিক কথকতার ঋণ। আবার, সাধারণ লোকমানসেও গল্প নির্মাণের অপূর্ব প্রতিভা সক্রিয় সেই প্রসঙ্গে আসে অতি সরস মন্তব্য যে, গ্রামের এক সার কুটির ও আড্ডাকে এমন স্থান ভাবা ঠিক হবে না ‘where the Rudyards cease from kipling, and the Haggards ride no more’. অন্য এক নিবন্ধকার রূপকথা চর্চার প্রকরণ সম্বন্ধে কিছু প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন তোলেন। এবং, স্যর অতুল কথাসরিৎসাগরে প্রাপ্ত উপকরণ বিশ্লেষণ করে বুঝতে চান হিন্দুযুগের ওই অন্তিম পর্বে ভারতীয় জীবন ও সমাজের রূপটি কেমন ছিল।
পেন্জ়ারের সৌজন্যে সর্বতোমুখী আলোচনার সমাবেশ আমরা পেলাম, কেবল রইল না একটি প্রধান ও গুরুতর প্রসঙ্গ। তা হল গুণাঢ্য, পৈশাচী প্রাকৃত, ও বৃহৎকথা। এমন নয় যে এ বিষয়কে ছুঁয়ে গেল না কোনো নিবন্ধ, বরং একাধিক নিবন্ধেই আছে সেই ছোঁয়া; কিন্তু খুব শক্ত মুঠোয় আস্ত বিষয়টি ধরতে চাইলেন না কোনো লেখক। সম্পাদকের আলোচনায় বার বার উঠে আসে Lacȏte-এর Essai sur Guṇāḍhya et la Bṛhat-kathā-র প্রসঙ্গ, তবুও লাকোৎ-এর সিদ্ধান্তগুলির কোনো সারাংশ সন্তোষজনক ভাবে পেশ করেন না তিনি। এই অনুপস্থিতি খানিকটা হতাশ করে। এইরকমই আরেকটি প্রসঙ্গ পণ্ডিত জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত গদ্যে কথাসরিৎসাগর, ‘গদ্যাত্মকঃ কথাসরিৎসাগরঃ’ (কোলকাতা, ১৮৮৩)। এই কৌতূহলজনক পাঠরূপটিও উল্লিখিত হয়, কিন্তু তার কোনো পরিচয় বিবৃত করেন না সম্পাদক।
দু’টি ছোটো বিষয় জ্ঞাপন করে The Ocean-এর প্রসঙ্গ শেষ করব।
এক, পণ্ডিত দুর্গাপ্রসাদের সংস্করণে একটি মঙ্গলাচরণ ছিল প্রতিটি লম্বকের সূচনায়। তারই মধ্যে আছে সেই অপূর্ব ঘোষণা, ‘ইদম্ ... কথামৃতং হরমুখাম্বুধেরুদ্গতম্’। এই স্তোত্র ব্রকহাউসে ছিল না, কাজেই টনি-তে থাকবার প্রশ্ন ওঠে না। (টনি সাকুল্যে একবার, কথামুখ লম্বকের সূচনায়, এই স্তোত্র অনুবাদ করেছেন।) কিন্তু পেন্জ়ারেও কেন অনুদ্ধৃত এই মঙ্গলাচরণ তা ঠিক বোঝা যায় না।
দুই, কথাসরিৎসাগরের পর্বগুলির নাম যে ‘লম্বক’ তা কবে এল কীভাবে এল তা নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। মূল বৃহৎকথায় এই পর্ব-নাম ছিল কি না তা নিয়েও আছে সংশয়। পর্বের ‘লম্বক’ নামের কথা আলোচনা করেছেন পেন্জ়ার, তার উপবিভাগ যে ‘তরঙ্গ’ সেকথাও বলেছেন। কিন্তু তাঁর সংস্করণের অনুবাদ অংশে (টনির মতোই) লম্বক শব্দটি কোথাও নেই, সেগুলি Book I Kathāpīt͎ha, ইত্যাদি; আর তরঙ্গগুলি কেবল Chapter. লম্বক ও তরঙ্গ শব্দ দু’টি বর্জনের কারণ কী তা স্পষ্ট নয়।
(এর পরে)
প্রসঙ্গ-সূত্র :
[১] নামান্তরে ‘বুদ্ধস্বামী’
[২] ‘লাবাণক’ ও ‘লাবানক’ দুই বানানই পাওয়া যায়।
[৩] উইলসন এই অনুমান করেন তাঁর Hindu Fiction শীর্ষক আলোচনায়, ১৮২৪ খ্রীষ্টাব্দে।
[৪] এই মৌলিকতা সম্ভবত বৃহৎকথার আদি মৌলিকতা। সোমদেব এই মৌলিকতা রক্ষা করতে পারেন না শেষ পর্যন্ত, গ্রথিত করেন পঞ্চতন্ত্র, বেতালপঞ্চবিংশতি প্রভৃতি লোকপরম্পরায় বাহিত অন্য নানা কথা।
[৫] দেবদত্ত কথাসরিৎসাগরে সর্বাধিক ব্যবহৃত চরিত্র-নামের অন্যতম। কথামুখ, নরবাহনদত্তজনন, চতুর্দারিকা প্রভৃতি লম্বকে নানা উপাখ্যানে একাধিক দেবদত্তের দেখা মেলে।
[৬] কথামুখ, শ্লোক ২
[৭] কথামুখ, শ্লোক ৩
[৮] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[৯] ‘নৃত্ত’, ‘সীৎকার’ ও ‘সীকর’ শব্দের ‘নৃত্য’, ‘শীৎকার’ ও ‘শীকর’ বানান বাংলায় বেশি প্রচলিত।
[১০] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[১১] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[১২] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[১৩] এই অংশ হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাস বাদ দিয়েছেন। অনুবাদ বর্তমান লেখকের।
[১৪] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[১৫] হীরেন্দ্রলাল বিশ্বাসের অনুবাদ
[১৬] হীরেন্দ্রলালের অনুবাদে, সম্ভবত ছাপার ভুলে, হয়েছে ‘অমিতগিরি’, নির্ঘণ্টেও তদনুরূপ। মূলে ‘স তস্মিন্নসিতগিরৌ কশ্যপাশ্রমে’, ‘অসিতগিরি’ নিয়ে কোনো সংশয় নেই; টনির অনুবাদেও Black Mountain.
[১৭] সকলার্থশাস্ত্রসারং জগতি সমালোক্য বিষ্ণুশর্মেদম্। তন্ত্রৈঃ পঞ্চভিরেতচ্চকার সুমনোহরং শাস্ত্রম্॥ [পণ্ডিত জ্বালাপ্রসাদ মিশ্রের সংস্কৃত-হিন্দী সংস্করণের (১৯১০) পাঠ অনুসারে]
[১৮] পারসিক রূপান্তরে এক কাল্পনিক ব্রাহ্মণ কথকের প্রসঙ্গ ছিল, নাম বিদ্যাপতি। তা থেকে Bidpai > Pilpay.
[১৯] সম্ভবত ইংরেজি বিরামচিহ্নের রীতি ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’-র দশম সংস্করণে (১৮৬৬) প্রথম গৃহীত হয়।
[২০] শিবদাস প্রথম জর্মন ভাষায় সম্পাদনা সহ প্রকাশ করেন Heinrich Uhle, ১৮৮৪। জম্ভলদত্ত কোলকাতা থেকে প্রকাশ করেন পণ্ডিত জীবানন্দ বিদ্যাসাগর ১৮৭৩-এ।