• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৬ | মার্চ ২০১৪ | প্রবন্ধ
    Share
  • দূর এসেছিল কাছে… : শ্রেয়সী চক্রবর্তী


    বিপুল সুদূরের বাঁশরী বাজিয়ে অতীতের কথা আজ হুলুস্থুল বাঁধিয়ে তুলেছে মনের দোরগোড়ায়। মনে আসছে সেই সব আলো জ্বলা মুখগুলির ভুবনভ্রমণের অল্প একটু গল্প (হ্যাঁ এখন গল্পই মনে হয়), যা এই দ্রুততম পৃথিবীর বাসিন্দা আমাদের মুখেও অন্য কোনো আলো জ্বালিয়ে তোলে। আমরা আজ বেরিয়ে পড়েছি পথে পথে, নদী সমুদ্রের বাঁধন না মেনে, পাহাড় চূড়ার অসীম নেশায় স্নান সেরে, বেরিয়ে পড়েছি শাস্ত্রকারের হুকুমকে ফেলে রাখা চটিজোড়ার সামিল করে, আমরা মেয়েরা আজ বিশ্বব্যাপী, কিন্তু এই বেরিয়ে পড়ার, বা ‘বেড়িয়ে’ আসার ইতিহাস তো মাত্র কয়েক দিনের নয়!

    মৃণাল কে মনে আছে নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ‘স্ত্রীর পত্র’ গল্পের বিদ্রোহিণীর কথাই বলছি। মৃণালের জবানীতে জানা যায় তার যে রূপ আছে তা ভুলে যেতে তার ধনী স্বামী এবং গোঁড়া শ্বশুরবাড়ির একেবারেই বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু তার যে বুদ্ধি আছে, পদে পদে হোঁচট খেয়ে তারা তা এক মুহূর্তও ভুলতে পারেনি! ভাগ্যকে বেশি দোষারোপ না করেই বলা যায় বাংলাদেশের বাংলাভাষী মেয়েদের মনের এই সবচেয়ে বড় কথাটা শুধু রবীন্দ্র-ছোটোগল্পের নায়িকা মৃণালেরই নয়, উনিশ শতকের অজস্র বাঙালি মেয়ের জীবনের দগদগে সত্য, তা তার শাঁখা-সিঁদুরের বন্ধন কিম্বা ‘বাপের বাড়ির’ তাড়না--যাই থাকুক না কেন! আশাপূর্ণার প্রথম প্রতিশ্রুতির নায়িকা সত্যবতীর কন্যা, পুরী দেখতে যাওয়ার উদগ্র বাসনার হাঁড়িকাঠে বলি হয়ে যাওয়া সুবর্ণলতাটির কথা কেউই খুব সহজে ভুলে যাননি আশা করি।

    পূর্বকালে এবং বর্তমানে বাঙালি মেয়ের রূপের খ্যাতি, তাঁদের অতুলনীয় রন্ধনের সুস্বাদ, ইত্যাদি বিষয়ে চার্চিকদের কমতি নেই। অথচ সুখী গৃহকোণের পিঞ্জর ছেড়ে বেরোবার যে অদম্য ইচ্ছে...তা নিয়ে কণামাত্র আলোচনাও কি চোখে পড়ে? উনিশ-শতকের দ্বিতীয়ভাগে আলোকায়নপ্রাপ্ত এবং অপ্রাপ্ত বাঙালি মেয়েরা ভ্রমণ শুরু করেন। অন্তত ওই সময় থেকেই ভ্রমণের ঈপ্সা গড়ে উঠতে দেখি বাংলা সমাজের অর্ধাঙ্গিনীদের চেতনায়। পথ ছিল বন্ধুর, সময় ছিল পিছল...তবু মেয়েরা নিজেদের চোখে দেখে জীবনের স্বাদ মনের বাটি-চামচে ডুবিয়ে চেখে দেখেছেন, বড় পরিতৃপ্তিতে। আর এই খুশিমনের ছোটো ছোটো আলোকরশ্মি তাঁরা ছড়িয়ে গিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের এক গভীর নির্জন পথে...সে পথ ভ্রমণকথার, বলা ভালো ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার পথ। এই ভ্রমণকাহিনির বেশিটাই আসে স্মৃতির চলচ্ছবি হিসেবে। আবার খুব বুদ্ধি করে আত্মকথার বীজও বুনে দিলেন অনেকে ভ্রমণকথার মধ্যে।

    প্রথম দিকে ঘরের আর বাইরের শাসন সামলে মেয়েরা বেরিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তাতে পিছপা হওয়া তো দূরের কথা বরং তাঁদের উৎসাহ আরও বেড়ে যায় যখন দেখেন কৃষ্ণভাবিনী দাসের মতন মহিয়সী পাছদুয়ারে পড়ে থাকা আকাশ বাতাসের ইশারাকে আঁকড়ে ধরে এমনকি নিজের মেয়েকেও হারিয়ে স্বামীর সঙ্গে পা রাখলেন ইংল্যান্ড-এ! ক্রমশ লিখলেন ‘ইংলণ্ডে বঙ্গমহিলা’–র মতো বই, যা বাংলাভাষায় লেখা বাঙালি মেয়ের প্রথম ভ্রমণকাহিনি (১৮৮৫)। আজও মেয়েদের নিজের কালে নিজের সমাজে নিজের দেশে কোনোকিছু প্রথমবার করে দেখাতে গেলে যে কত বড় পাহাড় ডিঙোতে হয়, সে তো বিল ক্লিনটন আর মালালা ইউসুফজাই-এর বর্তমান সামাজিক ভূমিকার তুলনামূলক বিচার করলেই বোধগম্য হয়। যে-কারণে জেন্ডার স্টাডিজ এর রমরমা আশ্রয়ে পাশ্চাত্য আর প্রাচ্যের কোনো ভেদ নেই আজ।

    কৃষ্ণভাবিনীর মতো অশেষ দুর্গতি আর যন্ত্রণা কাউকেই সহ্য করতে হয়নি, এ কথা হলফ করে বলা যায়। তবে খুব সহজেই এই পৃথিবীকে তাঁরা পান্থনিবাসে পরিণত করেছেন, সমীকরণ এমন সহজ ইঙ্গিতও দেয়না মোটেই। আসলে স্বাধীনতা, নিজের খুশিমতো বাঁচার অধিকার, মেয়েদের জন্য আজকালকার মতোই তখনো ছিল দুর্লভ। আমাদের দেশের ঠানদিদের মুগ্ধ করে রাখা শাস্ত্র বলে ‘পথি নারী বিবর্জিতা’… খোদ রামায়ণে চিত্রকূট দর্শনে সীতার যে উল্লাস তা আসলেতে কেবলই কবিকল্পনা! আর সেখানে বিভিন্ন সংস্কার-কুসংস্কারের পাকে পাকে জড়িয়ে থাকা বাঙালি সমাজের থোড়-বড়ি-খাড়া রাখার জন্য মেয়েদের যে বিশেষ করে ত্যাগ স্বীকার করতেই হত (এমনকি আজো হয়) সে তো জানা কথা। তবুও কৃষ্ণভাবিনীর পর দলে দলে এসেছেন স্বর্ণকুমারী, প্রসন্নময়ী, শরৎরেণু, দুর্গাবতী ঘোষ, বিমলা দাশগুপ্তা, রাজলক্ষ্মী দেব্যা, সারদাসুন্দরী, সৌদামিনী, গিরীন্দ্রনন্দিনী, অমলাশঙ্কর, হরিপ্রভা তাকেদা, হেমলতা সরকার, রাণী চন্দের দল। তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছেন রাজস্থানের অখ্যাত প্রদেশ ধোলপুর থেকে য়ুরোপের প্রাণকেন্দ্র প্যারিস-এ। কেউ গিয়েছেন কাশ্মীর থেকে নরওয়ে তাও আবার নিজের ইচ্ছেয় একাধিক বার, নেপাল থেকে জাপানে (নেহাতই সাধারণ বাঙালি মেয়ে সেখানে জাপানের বধূ, কিন্তু বিপ্লবী বধূ), কেউ গিয়েছেন নেফা, কন্যাকুমারী হয়ে হিমাদ্রিশীর্ষে, ডুব দিয়েছেন পূর্ণকুম্ভে, বেড়িয়ে এসেছেন ‘জেনানা ফাটক’ এর অন্তরালে সকৌতূহল! কেউ গিয়েছেন স্বামীর হাত ধরে, সাহচর্যের আশ্বাসে, কেউ গিয়েছেন নিগড় ভেঙে, কেউ নিজের মতো করে নিয়মভাঙা সংরাগে, দুশ্চিন্তার ঝুলি পিছনে ফেলে রেখে, আর কেউ কেউ কোনো সমাজকর্তা কিম্বা স্বামী-শাসনের তোয়াক্কা না করেই শুধু নয়, নিতান্ত অক্লেশে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সম্পর্কের অস্বীকৃতির বিনিময়ে, যেমন নবনীতা দেবসেন।

    এই মেয়েরা গিয়েছেন যে-পথে সে-পথেই যেন তাঁদের মেয়ে জীবনের উদযাপন। ছোটখাটো ভাবনা থেকে বড়সড় সিদ্ধান্ত, নিজের জীবনের কিছু সময় নিজের একান্ত ইচ্ছের হাতে সঁপে দেওয়ার এই আহ্লাদের উত্তাপ দুশো বছর পেরিয়েও পাঠকের হৃৎপিণ্ড স্পর্শ করে, বুঝিয়ে দেয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা কেবলি টিঁকে থাকেননি, তাঁরা রীতিমতো বেঁচে আছেন, তাঁদের নিয়ে যখন শান পড়ছে ভাবনাচিন্তার ফসলে তখন তাঁরা একালের উত্তরসূরীদের কাছে রোজ রোজ হয়ে উঠছেন প্রদীপ্ত ঈশ্বরী, যাঁদেরকে লজ্জা দিয়ে সজ্জা দিয়ে, আভরণ দিয়ে সাজিয়ে, ভুল বুঝিয়ে, দুর্লভ গোপনের আড়ালে আর লুকিয়ে রাখা যায় না, যাঁরা ঈশাবাস্য পুনর্মিদং-এর একেলে সংস্করণ। তাই সেকালে তাঁদের, “দূর এসেছিল কাছে’… আর একালে আমাদের, “ফুরাইলে দিন দূরে চলে গিয়ে আরো সে নিকটে আছে” ।।

    তাই সুধী পাঠক আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই পায়ের তলায় সর্ষে রাখার নানানখানা অভিজ্ঞতা। তার কোনোটা ব্যাগ গুছিয়ে চৌকাঠ পেরোনোর গল্প তো কোনোটা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতে ফেরার কথা। এই লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে কৃষ্ণভাবিনী দাসের কথা। তাঁকে নিয়েই বরং শুরু করা যাক এই এল-ডোরাডো সফর। আর বাকিটা লুকোনো থাক ভবিষ্যতের ঝোলায়, যার রং মনের ঝাড়বাতিতে সলতে উসকে আরও একটু, এ কথা হলফ করে বলতে পারি।


    ।। ২ ।।

    শ্বশুরবাড়ি, কৃষ্ণভাবিনী এবং এল-ডোরাডো (লন্ডন) সফর


    কৃষ্ণভাবিনীর নাম শুনে অথচ তাঁকে একবারও চোখে না দেখে কিম্বা মর্মগোচর না করে পাঠকবৃন্দ নিশ্চয় ক্লান্তি বোধ করছেন। এইবারে যবনিকা উত্তোলন!! শুনুন তাহলে বিলেত ভ্রমণের আজবকাহিনি ! আজব এইজন্য নয় যে কৃষ্ণভাবিনীর বিলেতভ্রমণের সময় খুব মজার মজার ঘটনা ঘটেছিল বা তাঁর কোনো অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তবুও আজব এবং অভূতপূর্ব তাঁর লন্ডনভ্রমণ এই কারণে যে তাঁর নিজগৃহেই অদ্ভুত বা উদ্ভটতম দেশাচার-কালাচার-এর সাক্ষী হতে হয়েছিল কৃষ্ণভাবিনীকে, যার নিষ্ঠুরতায় তাঁর বেঁচে থাকার শেষ দিন পর্যন্ত মানসিক যন্ত্রণা ছিল তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গী। যা কিনা খুব আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর পরবর্তী অন্য কোনো মহিলাকেই ভ্রমণের কারণে সহ্য করতে হয়নি। তাই মেয়েদের ব্যাগ গোছানোর গল্পে প্রথমেই হাজির হন এই প্রগাঢ় পিতামহী কৃষ্ণভাবিনী দাস, যাঁর ‘বেড়াতে যাওয়া’য় আনন্দের ভাগ ততটা ছিলনা যতটা ছিল পরিজনকে ত্যাগ করার বেদনা, দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তা আর মেয়েজীবনের প্রচলিত গড়নের বাইরে গিয়ে স্বাধীনতা খোঁজার উদগ্র প্রয়াস।

    কৃষ্ণভাবিনী গ্রাম বাংলার মেয়ে। রবীন্দ্রনাথের থেকে তিন বছরের ছোটো। খুব আশ্চর্যভাবে এই লেখা যখন লিখছি, এই ২০১৪ সালে কৃষ্ণভাবিনীর জন্মের সার্ধ-শতবর্ষ! কৃষ্ণভাবিনী ১৮৬৪তে জন্মেছিলেন বহরমপুরে কিম্বা নদীয়ায়, মেয়েদের খবর সেসময় সঠিক ভাবে কেই বা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করত?! অথচ একটা ব্যাপারে কৃষ্ণভাবিনীর একটু সৌভাগ্য হয়েছিল, ঐ গ্রামবাংলার প্রচলিত রীতি ভেদ করেই তাঁর হাতেখড়ি হয়েছিলো! কিন্তু ওই পর্যন্তই। দশবছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় বিদ্যাসাগরের বন্ধু শ্রীনাথ দাসের ছোট ছেলে দেবেন্দ্রনাথ দাসের সঙ্গে। কৃষ্ণভাবিনীর বড়ভাসুর উপেন্দ্রনাথ দাস বিধবাবিবাহ করেছিলেন এবং তাঁর বাবা যদিচ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বন্ধু, তবু সেই বিয়ে তিনি মোটেও মেনে নেননি। ফলে এহেন প্রগতির ধ্বজাধারী শ্বশুরমশাই এবং শ্বশুরবাড়ি পেয়ে কৃষ্ণভাবিনীর খুব একটা আহ্লাদ হওয়ার কথা নয়। আর ঘরের চৌকাঠ ডিঙোনো তো দূর ঘোমটা খোলার অবকাশই তাঁর মেলার কথা নয়। তবু মেঘকে যে ঠেলা দেয় সেই তেপান্তরের বাতাসের খবর কে রাখে? তাই কৃষ্ণভাবিনীর স্বামী ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন যাওয়ার পর যদ্দিনে ফিরে এলেন তখন কৃষ্ণভাবিনীর প্রথম সন্তানটি মৃত আর জীবিত মেয়েটির বয়স পাঁচ বছর। প্রথম থেকেই কৃষ্ণভাবিনী তাঁর স্বামীর বিলেত যাওয়ার পক্ষে, বলা ভালো কালাপানি পেরোনোর পক্ষে ছিলেন, কারণ তখন সেটাই ছিল কলকাতার সংস্কারকামী নব্যসম্প্রদায়ের দস্তুর; এখনকার ভাষায় 'ইন থিং’ চেতনার প্রকাশ। তাই দেবেন্দ্রনাথ দেশে ফেরার পর কৃষ্ণভাবিনীর শ্বশুর তাঁকে গ্রহণ না করে যখন গৃহ এবং সমাজ-চ্যুত করলেন তখনো স্বাভাবিকভাবেই কৃষ্ণভাবিনী স্বামীর পাশেই থাকলেন। অর্থাৎ ধনী শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন প্রগতির রাজপথে। মনে রাখতে হবে এর বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই কলকাতায় স্ত্রীশিক্ষার প্রক্রিয়া এবং প্রয়োগ শুরু হয়েছে (১৮৪৯-এ বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠা)। কৃষ্ণভাবিনীর সমস্ত শিক্ষাই কিন্তু স্বামী দেবেন্দ্রনাথের কাছে, ঘরের ভিতরে সম্পন্ন হয়েছিলো। তাই স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও অন্য আকাশের ইঙ্গিতবাহী ছিল তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক। সেটা এতটাই তীব্র স্বাধীনতাকামী যে দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে বাড়ি ছাড়ার সময় কৃষ্ণভাবিনী তাঁর মেয়ে তিলোত্তমাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে যেতে বাধ্য হলেও সেটাই মেনে নিয়েছিলেন। তারপর যখন দেবেন্দ্রনাথ কলকাতার বিরুদ্ধবাতাসে আর ভেসে থাকতে পারলেন না তখন স্ত্রীসমেত লন্ডন ফিরে যাওয়া মনস্থ করলেন। এবং অবশ্যই শ্রীনাথ দাস, কৃষ্ণভাবিনীর শ্বশুর, তিলোত্তমাকে মা-বাবার সাথে লন্ডনে পাঠানোর চরম বিরোধিতা করে তাকে জোর খাটিয়ে কলকাতায় নিজের কাছে রেখে দিলেন।

    সুদূর এবং স্বাধীনতা-পিয়াসী কৃষ্ণভাবিনী এই ব্যবস্থা ক্ষুব্ধ অন্তরে মেনে নিতে বাধ্য হলেন, কারণ তিনি তাঁর স্বপ্ন সত্যি করার পথের কোনো বাধাকেই আমল দিতে প্রস্তুত ছিলেন না এবং পরবর্তীতে এই সিদ্ধান্তের তিক্ত জের তিনি সারাজীবন একা বয়েছেন। তবু তাঁর রক্তের অন্তরালে যে অজানা জীবনের অচেনা অভিজ্ঞতার হাতছানি খেলা করে গেছে তার আকর্ষণ কখনো উপেক্ষা করতে পারেননি কৃষ্ণভাবিনী দাস। তাই ১৮৮২ সালে ইংরেজ পোষাকে নিজেকে মুড়ে, বিলিতি আদব-কায়দা রপ্ত করে স্বামীর সঙ্গে কৃষ্ণভাবিনী বেরিয়ে পড়লেন অসীমের আহ্বানে। তাঁর নিজের কথায়, ‘২৬ শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাত্রি সাড়ে আট্‌টার সময় বোম্বাই হইয়া ইংলন্ডে যাইবার জন্য আমার স্বামীর সহিত হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া কলিকাতা হইতে রওনা হইলাম। আজ আমি মুখ খুলিয়া কলের গাড়িতে উঠিলাম। ...’ এবং বলছেন, ‘বহুদিন হতে হৃদয়ে আমার/ গোপনে রয়েছে এক আশালতা/ দেখিবার তরে প্রিয় স্বাধীনতা/ যাইব যে দেশে বসতি উহার... তাই বহুকষ্টে পিঞ্জর ভাঙ্গিয়ে/ হয়েছি বাহির জ্ঞানচক্ষু তরে...’ তারপর সোনার শিকল কেটে বেরোনোর কি আকুল আনন্দ! আসলে কৃষ্ণভাবিনীর কাছে ইংলন্ড/ লন্ডন ছিল সোনার শহর এল-ডোরাডো। সেখানে সর্বত্র স্বাধীনতার অমৃতস্বাদ। লন্ডন পৌঁছে সেখানে শুধু ঘুরেই দেখছেন না, সেখানে বসতি করছেন কৃষ্ণভাবিনী। আট বছর লন্ডনে কাটিয়ে শাসকের দেশকে নিজের চোখে আঁকছেন, নিজের ভাষায় মুদ্রিত করছেন। আর এখানেই অন্যতমা মহিয়সীর জন্ম দিচ্ছে বাংলাভাষা। কারণ কৃষ্ণভাবিনী দাস সেই প্রথমা যিনি বাংলাভাষায় প্রথমতম বিলেত ভ্রমণের কাহিনি ১৮৮৫ সালে দেশের মানুষকে জানাচ্ছেন ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখে! বিলেতে কৃষ্ণভাবিনীর আগে এবং প্রায় সম-সময়েই গিয়েছেন/থেকেছেন তরু দত্ত, রাজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অবশ্যই ঠাকুরবাড়ির জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। তাঁরা কেউই ভ্রমণকাহিনি লেখেননি, আর জ্ঞানদানন্দিনীর বিলেতবাসের স্বল্প অভিজ্ঞতা কোনোমতেই ভ্রমণকাহিনি হয়ে ওঠার দাবি করতে পারেনা। তাছাড়াও জ্ঞানদানন্দিনী পেয়েছিলেন স্বামী সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে শ্বশুর দেবেন্দ্রনাথের মহর্ষিতা, যা তাঁকে তৎকালে অন্যতমা আধুনিকা হয়ে ওঠার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। নইলে জ্ঞানদানন্দিনীর শ্বশুরবাড়ির অন্দরমহলে সে-আমলের মেয়েলি ব্যাবহার সাধারণ বাঙালি পরিবারের থেকে খুব যে অন্যরকম ছিলনা তার পরিচয় ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী সম্পাদিত জ্ঞানদানন্দিনীর স্মৃতিকথা ‘পুরাতনী’ পড়লেই জানা যায়। তাই কৃষ্ণভাবিনীর ‘ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা’কে শুধু ভ্রমণকথা নয় পড়তে হয় বাঙালি নারীর প্রথম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা হিসেবে। কারণ এর সাথে তাঁর জীবনের ট্রাজেডি জড়িয়ে রয়েছে পাকে পাকে।

    কলের গাড়িতে অর্থাৎ ট্রেনে কলকাতা থেকে এলাহাবাদ, জব্বলপুর হয়ে বোম্বাই, আধুনিক মুম্বই পৌঁছচ্ছেন কৃষ্ণভাবিনী। পথের বিবরণ দিচ্ছেন খুশিমনে। তারপর বম্বে থেকে জাহাজে ভেনিস হয়ে পাড়ি দিচ্ছেন লন্ডন। পথে সে নানান অভিজ্ঞতা। এডেন বন্দরে নানা মানুষ দেখা, পোর্ট সইদে গা ছমছমে অনুভুতি, সমুদ্র-পীড়া সব কিছুই নতুন কৃষ্ণভাবিনীর কাছে। তারপর লন্ডনে যখন নামছেন ঘুরে দেখছেন পার্লামেন্ট থেকে বাকিংহাম প্রাসাদ। লন্ডনের বাইরের ইংল্যান্ড তাঁকে টানছে আলো আর রঙের ইশারায়। আসছে আল্পসের গায়ে ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর বিপুল গতিময় উচ্ছাসের বর্ণনা। সেখানকার নারীপুরুষের সামাজিক আদান-প্রদান, শিক্ষাপ্রণালী, ঘরের কাজ আর বাইরের কাজে নারীর ভূমিকা, ঋতুপরিবর্তনের চরিত্র, সব দেখছেন বুঝছেন খুঁটিয়ে। লিখছেনও সেভাবে। তাই কৃষ্ণভাবিনীর লেখা ভ্রমণবৃত্তান্তে শুধু উনিশ শতকের ভদ্রমহিলার চোখে নতুন করে ইউরোপ দেখার আনন্দই নয়, বারে বারে উঠে এসেছে নিজের দেশের মেয়েদের এমন কত শত অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকা অন্ধকার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের কথা ভেবে উষ্ণ যন্ত্রণা। আর অন্যদিকে সেইসময় কলকাতায় তাঁর কন্যার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মাত্র দশ বছর বয়সে ধনী পরিবারের লম্পট পাত্রের সঙ্গে, যার হোতা অবশ্যই কৃষ্ণভাবিনীর শ্বশুর শ্রীনাথ দাস।

    আরও বেশ কিছু বছর পর যখন কৃষ্ণভাবিনী দেশে ফিরতে পারছেন, অসুস্থ কন্যাকে এনে রাখছেন নিজের কাছে এবং কিছুদিন পর স্বামী ও কন্যার মৃত্যু ঘটছে স্বল্প সময়ের অন্তরে। তার মধ্যেই শিক্ষিতা নারীর নিজেকে মেলে ধরবার ঈপ্সা কৃষ্ণভাবিনী ছড়িয়ে দিয়েছেন কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, আর সে বিষয়ে তাঁর মতামতের বিরোধিতা করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ! তর্কযুদ্ধে মেতে উঠেছে বিশ শতকের নতুন বাঙালি। কৃষ্ণভাবিনীর কন্যা তিলোত্তমা কিন্তু অভিমান ভরে কৃষ্ণভাবিনীকেই দায়ী করে গেছে তার জীবনের এই পরিণতির জন্য। কলকাতার পুরুষশাসিত সমাজ তাকে শিখিয়েছিল এই কৌশল, সেখানে কৃষ্ণভাবিনীর এই ভ্রমণের, এই বেড়িয়ে আসা বিচিত্র জীবনের বিন্দুমাত্র বিশিষ্টতা নেই। সেখানে কেবল আছে মায়ের কর্তব্যে অবহেলা করার অভিযোগ, যা সয়েছেন নির্বিচারে কৃষ্ণভাবিনী। যদিও এ ব্যাথার প্রকাশ কোনো ভাবেই ভারাক্রান্ত করেনি কৃষ্ণভাবিনীর ভ্রমণকথা, ১৮৮৫ সালে লেখা ‘ইংলন্ডে বঙ্গমহিলা’ বইকে, সেখানে ডিটাচ্‌ড্‌ ভ্রামণিকের যুক্তি-বুদ্ধি-সারবত্তা সম্পন্ন গভীর মেধাবিনী কৃষ্ণভাবিনী দাস আজকের যুগের এক উজ্জ্বল পুনরাবিষ্কার।।

    (এর পরে)

  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments