• Parabaas
    Parabaas : পরবাস : বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি
  • পরবাস | সংখ্যা ৫৫ | অক্টোবর ২০১৩ | ভ্রমণকাহিনি, প্রকৃতি, বাকিসব
    Share
  • আনি একটি পাখির নাম : ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বিউট্রা

    আনি পাখির নাম অনেকেই হয়তো শোনেননি। বৈজ্ঞানিক নাম 'Crotophagus ani.' কুচকুচে কালো, বাংলাদেশের ফিঙে পাখির মতোই সাইজ। শুধু আমেরিকাতেই তাদের দেখা পাওয়া যায়। দু'রকমের আনি আছে। একটাকে বলা যেতে পারে 'কর্কশ-চঞ্চু' (Rough-billed), টেক্সাস ও মেক্সিকোর বাসিন্দা; অন্যটাকে 'চিক্কণ-চঞ্চু' (Smooth-billed)--ফ্লোরিডা ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলো এদের এলাকা। ইদানীং দ্বীপগুলিতে ইঁদুরের উৎপাতে এই পাখিদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে।

    বিখ্যাত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'আর্থ-ওয়াচ' (Earth Watch)-এর মাধ্যমে জানলাম পোর্টো রিকোয় আনিদের নিয়ে একটি গবেষণা চলছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক দরকার। ব্যাস, আর কি চাই! আমিও তৎক্ষণাৎ রাজী। পোর্টো রিকো তো প্রায় আমেরিকারই অংশ, খুব কাছে এবং আবহাওয়াও সুন্দর। আফ্রিকার তুলনায় অনেক পরিচিত, তাই গুরুজনেরাও কেউ বিশেষ আপত্তি করলেন না।

    জায়গাটা পোর্টো রিকো দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে কাবো রোহো ও লাগুনা কার্তাহেনা জঙ্গলের মধ্যে। নিকটস্থ এয়ারপোর্ট মায়াগুয়েজ। সেখান থেকে জীপ-এ ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। জঙ্গলের কোল


    আমাদের খোলামেলা বাড়ি
    ঘেঁষে ঠিক সমুদ্রতীরের ওপরে একটি ছোট্ট গ্রামে আর্থওয়াচ একটি বাড়ি ভাড়া করেছিল আমাদের থাকা খাওয়ার জন্যে। বাড়িটা দোতলা হলেও নিচের তলাটা শুধু থাম। কোনো দেয়াল-টেয়াল নেই। ওই চারদিক খোলা জায়গাতেই আমাদের বসার ঘর, রান্নাঘর, খাওয়ার টেবিল ও কাজকর্ম, বইপত্র, কম্পিউটার, সব কিছুই। ওপরতলায় তিনটে ছোট্ট শোবার ঘর ও দুটি বাথরুম। বাড়িটার চারদিক ঘিরে ছোট্ট একটু বাগান। এবং দুটি জীপ-গাড়ি। ব্যস্‌।

    জঙ্গলের মধ্যে বলেই হয়তো বাড়িটার অবস্থা বিশেষ ভালো ছিলো না। বাতি চলে যেত যখন তখন। বেশিক্ষণ বাতি না থাকলে রান্নাঘরের ফ্রিজে রাখা খাবার নিয়ে জঙ্গলের ফরেস্ট রিজার্ভ অফিসের ফ্রিজে রেখে আসতাম। ওখানেই একটা ওয়াশিং মেশিনে কাপড় চোপড় কাচতে হতো। ইলেকট্রিসিটি থাকলেও কানেকশনগুলো ছিলো একটি অদ্ভূত রকমের। রান্নাঘরে মাইক্রোওয়েভ চালালে বাথরুমের আলো নিভে যেত।


    'বসার ঘর'--হ্যামক, কাদামাখা জুতো ও পাখি ধরার জাল। পিছনে রান্নাঘর

    চারদিক খোলা থাকার দরুন সমুদ্রের মিষ্টি হাওয়ার সঙ্গে অসংখ্য মশা, মাছি, পোকামাকড়ের অবাধ আনাগোনা ছিলো। এছাড়াও অনেক 'উন্নত' প্রাণীরা আমাদের বাড়িতে বাসা বেঁধেছিল। রান্নাঘরে ছিলো একটা ইঁদুর--নাম হটপ্লেট, কারণ সে থাকতো সেখানেই। বাথরুমে একটা বিশাল কোলাব্যাং--নাম বুফো। তাকে বাইরে ফেলে দিলেও সে ঠিক ফিরে আসতো। একটা লোমওঠা নেড়ি কুকুর--পলি--আমাদের পায়ে পায়ে ঘুরতো। শোবার ঘরে একটা মোটা গিরগিটি--নাম লিজি। বারান্দার খাঁচায় গবেষণার কাজের জন্যে দুটি পোষা আনি--নাম বার্ট ও মেসকিটা। তিন তিনটে হুলো বেড়াল তাদের ধরবার আশায় ঘুরঘুর করতো। আর বাইরে বাগানে ছিলো একটা মুরগি ও তার চারটে ছানা--তাদের কোনো নাম দেওয়া হয়নি। এতসব প্রাণী নিয়ে আমাদের বাড়িটা বেশ জমজমাট।

    নীচের খোলা জায়গায় আমরা গোটা কয়েক দড়ির বিছানা (hammock) খাটিয়েছিলাম--সেখানেই শুয়ে বসে যেটুকু বিশ্রামের সময় পেতাম তো সেটা কাটাতাম।


    আমার হাতে সদ্যোজাত বাচ্চা আনি (২ দিন)
    সাধারণত আর্থ ওয়াচের গবেষণার কাজে কয়েকজন পাকাপাকিভাবে ব্যস্ত থাকে। তারা টানা বছরদুয়েক থাকে ও তাদের সঙ্গে একজন বয়স্ক অধ্যাপক থাকেন সবকিছু দেখাশোনা করার জন্যে। কিন্তু আমি যখন পোর্টো রিকোয় গিয়েছিলাম কোনো সিনিয়র লোক সেখানে ছিলেন না। ছিল শুধু পাঁচজন অল্পবয়সী গ্রাজুয়েট (অর্থাৎ 'দেশ'-এর বিচারে স্নাতকোত্তর শ্রেণির) ছাত্রছাত্রী। এরাই আমার দেখাশোনার ভার নিয়েছিল। আমি ছিলাম তখন একা ও একমাত্র স্বেচ্ছাসেবক।


    আমার সহকর্মীরা কাজে ব্যস্ত
    আর্থ ওয়াচ সার্থকনামা, তাদের কারবার পৃথিবী জুড়ে। তাই ছাত্রছাত্রীরাও নানা দেশের বাসিন্দা। পোর্টো রিকোয় আমাদের দলের নেতা ছিল কুড়ি-বাইশ বছরের গ্রাজুয়েট ছাত্র ফ্রেঞ্চ-ক্যানাডিয়ান গ্রেগ, কানাডার ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ভালো স্প্যানিশ বলতো। তার অধীনে ছিল বেন--অস্ট্রেলিয়ার ছেলে, ঢ্যাঙা লম্বা ও রোগা। লম্বা হওয়ার দরুন ওই গাছে চড়ত পাখির বাসার খোঁজে। ওর সঙ্গে থেকে থেকে আমি কয়েকটা অস্ট্রেলিয়ান স্ল্যাং শিখে নিয়েছিলাম, যেমন স্পার্কি (sparky) হলো ইলেকট্রিসিটি, ফেস্টি (festy) হচ্ছে বিশ্রী (disgusting); সিনবিন (sinbin)=(হক খেলার) পেনাল্টি-বক্স, ইত্যাদি। ও ছিল সমুদ্রের পোকা। মাঝরাতে উঠে সমদ্রে সাঁতার দিত। এছাড়াও ছিল এক ছাত্রী--জেসিকা--আমার মতোই পক্ষীপ্রেমী; ছিল আলানা--সুদূর উত্তর কানাডার ইউকন অঞ্চলের মেয়ে--অক্টোবরেও পোর্টো রিকোর গরমে অস্থির হতো বেচারা। শেষজন ছিল সিনডি--সেও ম্যাকমাস্টারের ছাত্রী। গ্রেগ-এর সহকর্মী। দোতলায় দু'টি ঘরে আমরা চার মেয়ে ও তৃতীয় ঘরে গ্রেগ ও বেন।


    পাখির রক্তপরীক্ষা
    মায়াগুয়েজে আমি পৌঁছেছিলাম বেশ রাতে। এয়ারপোর্ট শুনসান। গ্রেগ বলেছিল আমাকে নিতে আসবে কিন্তু বেচারা রাস্তা হারিয়ে দেরি করে ফেলেছিল। আমি তো এয়ারপোর্টেই রাত কাটাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌঁছতে মাঝ-রাত।

    পরদিন শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। কাজকর্ম বন্ধ, শুধু কম্পিউটারে তথ্য ঢোকানো আর তাস খেলে সময় কাটানো। সবার সঙ্গে আলাপ হলো। হ্যামকে বেশ আরামে সময় কাটানো। ভাবছিলাম ভারি মজা। কিন্তু একটু পরেই মজাটা উবে গেল। দোতলায় পায়খানার নালী বন্ধ হয়ে গেছে। সে এক বিচ্ছিরি কাণ্ড। সামনে বাগান বৃষ্টির জলে পুকুর হয়ে গেছে। যাক্‌ বেশিকিছু আর বলবো না--সেই বৃষ্টিতে কারিগর পাবার উপায় ছিলো না।

    পরের দিন অবশ্য স্থানীয় কারিগর এসে ড্রেন পরিষ্কার, সামনের উঠোন পরিষ্কার করতে সারাদিন লাগিয়ে দিল। শুরুতেই এই। আমি তো প্রমাদ গুণলাম।

    তার পরের দিন থেকে গ্রেগ উঠে পড়ে আমাদের কাজে লাগালো। আমাদের প্রধান কাজ ছিলো আনি-দের যতোটা পারি লক্ষ্য করে তথ্য জোগাড় করা। আশা, এইভাবে বোঝা যাবে ওদের সংখ্যা কেন কমে যাচ্ছে আর সেটা কী করে ঠেকানো যায়।


    পাখির বাসায় ডিম
    আমাদের দৈনিক কাজ বলতে গেলে শুরু হতো কাকভোরে, সূর্য ওঠার অনেক আগে। আগেরদিন বিকেলে আনিদের বিশ্রাম করার গাছ ও বাসার জায়গাগুলি চিহ্নিত করে রাখা হতো। পরেরদিন ভোরে উঠে সেই জায়গায় লাগাতাম 'মিস্ট নেট'। যখন আনিদের ঘুম ভাঙতো, তারা ওই জালে আটকে পড়তো। তখন ওদের পায়ে ব্যাণ্ড বাঁধা, ওজন করা, ডানা থেকে রক্তের নমুনা নেওয়া ইত্যাদির কাজ শুরু হতো। তারপর শুরু হতো ওদের পর্যবেক্ষণ করা, ওরা কী খায়, কোথায় যায়--এসব লক্ষ্য করে নোটবুকে টুকে রাখতাম। আমরা একেকজন এক এক রকমের কাজ নিতাম। মাঠে বসে আনিদের দেখতাম--ঘাস থেকে ফড়িং ইত্যাদি খাচ্ছে। কখনো কখনো ছোটো গিরিগিটিও তুলে নিচ্ছে। দলের একজন একটা টিলায় বা কাছাকাছি কোন তার থাকলে সেখানে বসে পাহারা দেয়, আর বাকি সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে খাওয়ায় মন দেয়। যদি শিকারি বাজপাখি বা কেস্ট্রেল দেখা দেয় তো পাহারাদার উঁচু গলায় ককিয়ে ওঠে। অমনি সব পাখি উড়ে ঘন পাতার আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।


    পাখির পালকে রেডিও ট্রান্সমিটার বাঁধা হচ্ছে
    কখনো আমরা আনিদের পাখায় রেডিও টেলিমিটার বেঁধে দিতাম। তারপর লম্বা স্ক্যানার নিয়ে সেই পাখির পিছনে ছুটতাম মাঠ ঘাট, খানা-খন্দ পেরিয়ে। তারা তো কোনো সীমারেখার ধার ধারে না। ওদের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমি প্রায়ই পেছিয়ে পড়তাম ও হারিয়ে যেতাম। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙোতে গিয়ে কতো যে জুতো-জামা ছিঁড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তার ওপরে আবার দেখে শুনে পা না ফেললে সৈনিক-পিঁপড়ের আক্রমণ অনিবার্য। প্রথমবারেই আমার পা-দুটো পিঁপড়ের কামড়ে ফুলে ঢোল। বড়ো বড়ো লাল চাকতির মতো ফোলা, তার ওপর চিকেন পক্সের মতো ফুসকুড়ি। আর কী দারুণ চুলকুনি। জুতো মোজা প্যান্ট সবকিছু ভেদ করে এই পিঁপড়েরা আক্রমণ চালায়। তবে প্রথমবারেই বেশি কষ্ট। পরে সয়ে গেছিল।

    মাঝ-সকালে ফিরে নাস্তা--চটপট কফি, টোস্ট, ডিম ইত্যাদি--তারপর আবার জঙ্গলে। এবার বাসা-পরীক্ষার পালা। আমি যাবার আগেই গ্রেগ-এর দল প্রায় কুড়িটা গাছ দেখে রেখেছিল। সবগুলোতেই একটা করে আনির বাসা। আমাদের কাজ হলো মই লাগিয়ে, গাছে চড়ে (বেন-এর কাজ) ডিম গোনা, দেখা ডিম ফুটেছে কি না, বাচ্চা বেরোলে তাদের পায়ে ব্যাণ্ড লাগানো, ওজন করা, রক্ত পরীক্ষা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সর্বক্ষণ বাবা ও মা আনিরা মাথার ওপর চেঁচামেচি করত।


    বাচ্চা পাখির মাথায় বট-ফ্লাই (Botfly) মাছির সংক্রমণ
    এইসব করতে করতে লাঞ্চের সময় হয়ে আসে। দুপুরবেলা রোদের তাপও বেশ। পোর্টো রিকোয় এটা সরকারিভাবেই সিয়েস্তা বা দিবানিদ্রার সময়। আমরাও হালকা স্যাণ্ডউইচ, চীজ, ফল ইত্যাদি খেয়ে হ্যামকে আরাম করতাম।বেন অবশ্য সর্বক্ষণ সমুদ্রে। সিনডি-ও তার সঙ্গী। জেসিকা স্কেটবোর্ড নিয়ে বীচ-এ প্র্যাকটিস করত। গ্রেগ তার কম্পিউটার ও ডাটা নিয়েই ব্যস্ত। আলানা ও আমিই শুধু অলস। সেই ঝিমধরা দুপুরে কখনো কখনো দূরে মেগাফোনে শুনতাম স্থানীয় নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিজেদের গুণ গাইছে। সুর করে মেগাফোনে গাওয়া ও গাড়িতে চড়ে পাড়ায় পাড়ায় গেয়ে বেড়ানোই ওখানে নির্বাচনের বিজ্ঞাপন। টেলিভিশন তো দেখেই না কেউ।


    ডিম ফুটছে, ভেতরে পাখির ঠোঁট দেখা যাচ্ছে
    দুপুর তিনটে নাগাদ আবার বেরিয়ে পড়তাম--আবার খাঁচা পরীক্ষা, রেডিও স্ক্যানার নিয়ে পাখির পিছনে ছোটাছুটি। কখনো কখনো আমরা বার্ট ও মেসকিটাকে খাঁচায় পুরে নিয়ে যেতাম টোপ হিসেবে। ওদের ডাকে নতুন আনিরা আকৃষ্ট হলে সুযোগ বুঝে জাল দিয়ে ধরে তাদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হতো। এ-ছাড়াও গাছের তলায় ইঁদুর ধরার কল পেতে ইঁদুর ধরেছি, জাল দিয়ে মাঠ থেকে পাখিরা যে পোকা খায় সেগুলো ধরেছি।


    মই চড়ে পাখির বাসায় ডিম গোণা

    একটা গাছে আমরা ভিডিও ক্যামেরা লাগিয়েছিলাম--ঠিক বাসাটার ওপর। তাতে পাখিদের দৈনিক আচার আচরণ টেপ করা হতো। প্রতিদিন সেই টেপ বদলাতাম, এছাড়াও ছিল ব্যাটারি চেক করা, লেন্স পরিষ্কার ইত্যাদি ইত্যাদি।

    সূর্যাস্তের সময়ে আনিরা তাদের রাত কাটানোর গাছে ফিরত। তখন আমাদের কাজ ছিল সেই গাছগুলো চিনে রাখা। পরদিন ভোরবেলা সেই গাছের কাছে জাল ছড়িয়ে রাখতাম।


    দুপুর রোদ্দুরে পাখি পর্যবেক্ষণ

    এতসবের পর বাড়ি ফিরে বিশ্রাম, স্নান, গল্প-গুজব, কম্পিউটারে কিছু ডাটা ঢোকানো, খবর-পড়া ও ইমেল করা। প্রতিদিন এক-একেক জনের ওপর রান্নার ভার থাকত। ভাগ্যিস আমি কিছু ভারতীয় মশলাপাতি নিয়ে গিয়েছিলাম--ওদের মুরগির ঝোল, ভাত, মাছভাজা ইত্যাদি খাইয়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছি। মুশকিল হতো যেদিন থাকত গ্রেগ-এর রান্নার পালা--ওর ফরাসী রান্নার জন্যে আলাদা সামগ্রী কেনা--ঘন্টা ধরে কাটা, বাটা, সেদ্দ, রান্না, সস ইত্যাদি করতে করতে আমরা সবাই খিদেয় কাহিল আর ঘুমে ঢুলতে শুরু করতাম।

    সপ্তাহান্তে আমাদের ছুটি ছিল। সেদিন বাজার করা, কাপড় কাচা, ঘর-দোর পরিষ্কার করা (পালা করে করা হতো এসব কাজ), বিকেলে গাঁইয়ে নাচের ক্লাবে যাওয়া, সমুদ্রতীরে সাঁতার, এখানে ওখানে অন্য পাখির সন্ধানে বেড়ানো এসবই চলতো।


    পাখি দেখার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি

    পোর্টো রিকোয় সালসা ও বাচাটা নাচ খুব জনপ্রিয়। বেন, সিনডি ও জেসিকা প্রতিবেশীদের কাছে একটু আধটু শিখে নিয়েছিল। সেটাই প্র্যাকটিস করত ক্লাবে; এমনকী অজ্ঞ আমিও প্রাথমিক স্টেপগুলো শিখে নিয়েছিলাম।

    সালসা নাচের আদব-কায়দাও বেশ মজার। মেয়েরা দেয়াল ঘেঁষে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় ও ছেলেরা সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে চোখ দিয়ে মেপে নেয়। তারপর বাঁ-হাত বাড়িয়ে তর্জনী নাচিয়ে ডাকে একজনকে। সে-ডাকে সাড়া দিতেই হবে, না বললে চলবে না। কোনো কথাবার্তার দরকার নেই। কিন্তু ওই অজ গ্রামেও নাচিয়েরা ভীষণ দুরস্ত। তাদের তুলনায় আমরা তো একেবারেই আনাড়ি, অবশ্য অন্যান্যরা অল্পবয়সী বলেই উৎসাহিত ছিল বেশি। আমার তো লাইনে দাঁড়ালেই বুক ধুকপুক--কে ডাকবে কে জানে। অবশ্য কেউ কখনো অশালীন আচরণ করে না। এটিকেট খুব কড়া।

    একবার আমরা হ্যালোউইন পার্টিও করেছিলাম। টয়লেট পেপার পেঁচিয়ে আমি ওদের মিশরীয় মমি বানিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিন ক্লাবে ছিল কস্টিউম পার্টি। খুব জমেছিল।


    ভোর রাত্রে পাখি ধরার জন্য জাল টাঙানো হচ্ছে

    এতসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল যে কী তা হয়ত আপনারা জানতে চান। সেটার কথাই বলি একটু। আমি ওখানে তিন সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম। অন্যরা ছিল কয়েকমাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত। তাই তথ্য সংগ্রহ করে তার বিশদ আলোচনা ওরাই করেছে। আমার কাজ শুধু কয়েক-পাতা তথ্যের সংগ্রহণ।

    আনিরা পক্ষীসমাজে অন্যতম এই কারণে যে এরা ১০-১২টা পাখি একসঙ্গে বাসা বাঁধে ও এক বাসায় ১০-৪০টা পর্যন্ত ডিম পাড়ে। পাখিদের মধ্যে আনি, জে ও একর্ন কাঠঠোকরাই একমাত্র এরকম বাসা বাঁধে। আফ্রিকার অস্ট্রিচও করে বোধহয়। আর কোনো উদাহরণ আমার জানা নেই।


    ঘন জঙ্গলে পাখির খোঁজে

    একসঙ্গে বাসা বাঁধার উপকার আছে। সবাই মিলে বাসা পাহারা দেয়। ডিম ও বাচ্চাদের দেখাশোনায় সাহায্য করে। কিন্তু এর অপকারও আছে। আনিরা জুটি বাঁধলেও জুটির বাইরে পরকীয়া প্রেম চলে খুব। তার উদাহরণ পেয়েছি বাবা, মা ও ডিম-এর ডিএনএ পরীক্ষা করে। এছাড়াও অনেকগুলো ডিম পাড়ার জন্যে পুরনো ডিমগুলো তলায় ঢাকা পড়ে যায় আর খারাপ হয়ে যায়। কখনো কখনো আনিরা নিজেদের ডিম বাঁচাতে অন্যদের ডিম বাসা থেকে ফেলে দেয়। গাছের তলায় ভাঙা ডিম আমরা অনেক দেখেছি।

    নিজেদের ডিম বাঁচাতে আনিরা আরো অনেকরকমের চাতুরি করে। পাড়ার আগে ডিমের ভেতরে বেশি করে Androgen (পুং হরমোন) যোগ করে, যাতে বাচ্চারা বেশি শক্তিশালী হয় এবং অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতে যায়। পাখি ও বাচ্চাদের রক্ত পরীক্ষা করে এই হরমোন মেপে দেখেছে গ্রেগ ও তার সহকর্মীরা। এইসব তথ্যই আনি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানবৃদ্ধি করে ও এদের সংরক্ষণে সাহায্য করে।

    এছাড়াও গ্রেগ ও তার দল ইঁদুরকলে ধরা ইঁদুর গুণে দেখেছে কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় তাদের উপদ্রব বেশি। সেখানে ইঁদুর তাড়াবার ব্যবস্থা করে শুধু আনিই নয় অন্যান্য পাখিদেরও বাঁচাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই মেঠো ও জংলী ইঁদুররা গাছে চড়ে বাসায় পাখির ডিম ও বাচ্চাদের নষ্ট করে। পোর্টো রিকোয় স্প্যানিশ নাবিকদের জাহাজে চড়ে ইঁদুররা প্রথম এই দ্বীপগুলোয় আসে। তারপর গত পাঁচশ' বছর ধরে এদের উপদ্রব বেড়েই চলেছে।

    ইঁদুর ছাড়াও বাসায় অনেকসময় পোকামাকড়ের উপদ্রবে বাচ্চা (পালক না-ওঠা) পাখিরা মারা যায়। আমরা বটফ্লাই নামক মাছির ডিম ও লার্ভা দেখেছি বাচ্চা পাখির চামড়ার নিচে। আনিদের বাসায় এর উপদ্রবের এটাই বোধহয় প্রথম উদাহরণ।

    একদিন পাখিদের পিছনে দৌড়তে দৌড়তে কাঁটা-তারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আমি দলছাড়া হয়ে পড়েছিলাম। এমনিতেই আমার দিক্‌জ্ঞান খুব দুর্বল। তার ওপর জঙ্গলে একলা পথ হারিয়ে ফেলে মোটেই কঠিন নয়। তবে আমার তেমন দুশ্চিন্তা হয়নি। মোটামুটি বড়ো রাস্তাটা কোনদিকে সেটা মনে ছিল। তাই আমি সেদিকে হাঁটা দিলাম। আশা ছিল রাস্তায় দাঁড়ালে আমার বন্ধুরা জিপ-এ তুলে নেবে।

    শুরু হলো টিপ টিপ করে বৃষ্টি। বেলা পড়ে আসছে। আমি ছেঁড়া জামায় জলে কাদায় ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি রাস্তার ধারে। গ্রেগ-এর জিপ-এর দেখা নেই। তার বদলে আমার সামনে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। আমাকে দেখে মনে করেছিল দুঃস্থ ডমিনিকান রিপাবলিকের লোক, বেআইনিভাবে পোর্টো রিকোতে ঢুকেছি। অতএব গন্তব্য এখন জেল। ডমিনিকান রিপাবলিক সমুদ্রের ঠিক ওপারে বলে অনেক বেআইনি এদেশে ঢুকে পড়ে। তাই পুলিশদের কড়া নজর। আমি ভাঙা ভাঙা স্প্যানিশে বোঝাবার চেষ্টা করলাম--তাতে ওদের সন্দেহ দূর হলো না, তবে আমার স্প্যানিশ শুনে বুঝলো যে আমি ড.রি. থেকে আসিনি। তাহলে নিশ্চয়ই হেইতি থেকে এসেছি--ওরা তো ফরাসী বলে, তাই স্প্যানিশ ভালো জানে না। হেইতিও খুব কাছে। তাই ওরা ধরে নিল আমার নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে--হয়তো ড্রাগ পাচার করছি, কিংবা হয়তো বা বেশ্যা!

    হঠাৎ আমার মনে পড়লো ব্যাগের মধ্যে আছে ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা আমার বাড়ি, পাখি, বন্ধুরা ও যন্ত্রপাতির ছবি। আমি দেখাতে দেখাতে আবার বোঝাতে চেষ্টা করলাম। এইবারে ওদের বুদ্ধি খুলল একটু। ওদের মধ্যে একজন গ্রেগকে চিনতো। আমার ক্যামেরায় ওর ছবি দেখে সন্দেহ নিরসন হলো।

    তারপরে কী অভ্যর্থনা, কতোই না প্রশংসা--কতোদূর থেকে আমি এসেছি এমন একটা ভালো কাজ করতে; কতোই না উপকার করেছি ওদের ইত্যাদি। তারপর জিপ-এ করে আমায় বাড়ি পৌঁছে দিল। রাস্তায় গ্রেগ-এর দলের সঙ্গে দেখা। ভয়ে ওদের তো মুখ শুকনো। আমার কিছু হলে পুরো দায়িত্ব ওদেরই। তাই আমায় ফিরে পেয়ে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শুধু পুরো কাহিনি শুনে গ্রেগ বলল গোমড়া মুখে--"তোমায় কী করে ওরা হেইতির লোক বলল? তোমার ফ্রেঞ্চ তো স্প্যানিশের চেয়েও খারাপ!"


    পোর্টো রিকোর কার্তাহেনা পার্কে লেখক

    রাস্তা হারানো ও বাথরুমের গণ্ডগোল সত্ত্বেও আমার হাঁটুর বয়সী বন্ধুদের সাঙ্গে সময়টা কিন্তু খুব মজায় কেটেছিল। সেই সঙ্গে পাখি সম্বন্ধে হাতে কলমেও অনেক জ্ঞান হয়েছিল। তবু, একথাও স্বীকার করতেই হবে যে এরকম ফিল্ড ওয়র্ক কুড়ি-বাইশ বছরের ছেলে-মেয়েরাই করতে পারে। সেজন্যেই তাদের ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট বা পোস্ট-গ্রাজুয়েট কাজে নেওয়া হয়। আমার নিজস্ব জিনিসপত্র--ক্যামেরা, বাইনোকুলার, জলের বোতল, মশার ওষুধ, সানস্ক্রিন, পাখির গাইডবই ইত্যাদি ছাড়াও বইতে হতো মই, স্পটিং স্কোপ, রেডিও স্ক্যানার, বিরাট জাল, পাখির খাঁচা, ব্যান্ডিং কিট্‌, ব্যাটারি, স্পিকার ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব নিয়ে কাঁটা-তারের বেড়া ডিঙোনো, জলে কাদায় আছাড় খাওয়া আর্মি পিঁপড়ের কামড় সহ্য করা--আর সবার ওপর খটখটে রোদ্দুর ও গরম। নাঃ আমার শিক্ষা হয়েছে খুব। ওই নোভা, নেচার, ডিসকভারি চ্যানেলে পশুপাখির প্রোগ্রামের পিছনে কতো পোস্ট-গ্রাজুয়েটের হাড়-ভাঙা খাটুনি আছে তা এখন খুব বুঝতে পারি।

    তারা সবাই আমার নমস্য।



    অলংকরণ (Artwork) : ছবিঃ লেখক
  • এই লেখাটি পুরোনো ফরম্যাটে দেখুন
  • মন্তব্য জমা দিন / Make a comment
  • (?)
  • মন্তব্য পড়ুন / Read comments