হুঁ,হুঁ। এ এক মস্ত খবর। দারুণ খবর। সবাইকে বলে ঘাবড়ে দেবার মতো খবর!
পচার দাদুর এ-এক অভিনব আবিষ্কার — দেরিপ্যাথি!
তুমি তো এতদিন অনেক প্যাথিরই নাম শুনেছো। আহা, ওসব সিমপ্যাথি, টেলিপ্যাথির কথা বলছি না গো! বলছি, ধর তোমার কোনো রোগ-ব্যামো হল, তুমি কি কর? ওষুধ-পথ্যি খাও তো। ডাক্তার কোবরেজমশাইয়ের কাছে যাও তো? সে তোমার কোবরেজমশাই বা বদ্যিবাবু, কিংবা হাতুড়ে ডাক্তার, বা ধর নরমস-র-ম হোমিওপ্যাথি ডাক্তার কিংবা মস্ত পাশ করা গালফুলো অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারবাবু খস্খস্ করে যে যে ওষুধগুলো লিখে দেবেন, তুমি লক্ষ্মীসোনাটির মতো সে সব কিনে খাও কিনা বল? খাও তো!
হুঁ, হুঁ। পচার দাদু কিন্তু তা খায় না। ওসব ডাক্তার কোবরেজমশায়ের দুয়ারে যাবেই না।
পচার দাদু তাঁর সারাজীবনে কোনো ওষুধই মুখে ছোঁয়ান নি। ওষুধের সঙ্গে দাদুর আড়ি। দাদুর যখনই শরীরে কোনো রোগব্যামো হয়েছে, সব সেরেছে দাদুর ওই নিজের আবিষ্কার করা চিকিৎসায় — তা হল দেরিপ্যাথি!
দেরিপ্যাথি মানেই তুমি অপেক্ষা কর, ধৈর্য্য ধর, বিশ্বাস কর নিজের শরীরকে। দেখবে একদিন না একদিন ঠিক সে রোগ সেরে যাবে। যাবেই যাবে। হয়তো একটু দেরি হবে। হোক। সময়ের জিনিস সময়েই সারা তো ভালো। আহা, অত তাড়া কিসের? একটু সবুর কর। দেরি কর। এই দেরি থেকেই তোমার রোগ সেরে যাবে গো! তার জন্যই তো পচার দাদুর এই চিকিৎসার নাম দেরিপ্যাথি।
অবশ্য গাঁ-এর লোকেরা অন্যকথা বলে, দাদু এক নম্বরের কৃপণ। মাটির নীচে গর্ত খুঁড়ে এখনও পয়সা জমায়। দাদুর বাগান ভর্তি গাছ। সব গাছের গোড়ার নীচেই নাকি দাদু টাকা-পয়সা, গয়না-গাঁটি, সোনা-দানা সব লুকিয়ে লুকিয়ে রেখে দিয়েছে। দিদিমাকে কিচ্ছুটি পরতে দেয় না। কিচ্ছুটি কিনে দেয় না। বরং চারটে পান বেশি খেলে বলে এক একটা পান অত তাড়াতাড়ি শেষ কর কেন বল তো? মুখে পুরে রেখে দেবে। একটু একটু করে খাবে। দেরি করে করে খাবে। দেখবে তাতে স্বাদও পাবে বেশি, আর খরচও বাঁচবে অনেক। দাদু নাকি এমনই কঞ্জুস, হাড়কিপটে এক বুড়ো! হাত দিয়ে জলও গলে না। ওষুধ কিনতে পয়সা লাগবে বলে ওষুধ কেনে না। দেরিপ্যাথি করেই কাটিয়ে দেয়। আর বলে, আমি একজন আবিষ্কারক। এ গাঁ-এর কেউ আমাকে বুঝল না। ওরা তো জানে না, ওসব ওষুধের অনেক সাইডএফেক্ট আছে। হুঁ, হুঁ। এখন তুমি কিচ্ছুটি বুঝবে না। টেরও পাবে না। ক'টা দিন যাক। সময় গড়াক আরও কিছুদিন। তা বাপধন তখন টেরটি পাবে। সাইডএফেক্ট কাকে বলে! কিন্তু আমার ওষুধে শুধুই এফেক্ট। নো সাইড এফেক্ট।
দাদু আরও বলেন, ওষুধ তো সব আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্যের কিরণে, চাঁদের আলোয়, ঝলমলে রোদ্দুরে, তারাদের ঝিলিমিলিতে ওষুধ থাকে। ভোরের বাতাসে, কুসুম আলোয় ওষুধ আছে। বৃষ্টির জলে ওষুধ আছে। প্রকৃতির মধ্যে কত গাছ, লতা-পাতা, ফুল, ফল। সব গাছে-গাছে, লতায়-পাতায়, ফুলে, ফলের মধ্যে লুকিয়ে আছে তোমার আরোগ্যের মহৌষধি। তুমি কেন ওষুধ কিনে খাবে? প্রকৃতির মধ্যে থাক প্রকৃতিকে ভালোবাস। প্রাণভরে শ্বাস নাও। দু'চোখ ভরে দ্যাখো প্রকৃতিকে। অনুভব কর। স্পর্শ কর। আদর কর। হাসো। দেখবে তোমার শরীর কেমন সুস্থ, সুন্দর থাকবে। কোনো কঠিন, জটিল রোগ হবে না। ছোট্ট দু'একটা রোগ-ভোগ যা হবে প্রকৃতিই তোমার তা সারিয়ে দেবে। তুমি তো এই প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতিই তোমাকে মায়ের স্নেহে সুস্থ-সবল করে তুলবে। কেন তুমি তাড়া কর? কেনু ছুটে ছুটে যাবে ডাক্তার, বদ্যির বাসায়? বরং একটু অপেক্ষা কর। ধৈর্য্য ধর। না হয় একটু দেরিই হবে। হোক না দেরি। ভরসা রাখ দেরিপ্যাথিতে। দেরিপ্যাথিই তোমায় সারিয়ে তুলবে।
আচ্ছা দাদু ধর, খুব জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছে। তখন কি করব?
পচার দাদু মিটিমিটি হাসে। হেসে বলে, জ্বরের সবচেয়ে ভালো ওষুধ হল, জ্বর হলে জোছনারাতে বাগানে গিয়ে বসবে। চাঁদের দিকে চেয়ে থাকবে। চাঁদের আলো গায়ে মাখবে। দেখবে সব জ্বর আস্তে আস্তে ছেড়ে যাচ্ছে। পুড়ে যাওয়া শরীর কেমন শীতল হয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠছো। ভালো হয়ে উঠছো।
আঃ দাদু কি মুশকিল! জোছনা কি সারাবছর, সারা মাস ধরে থাকে নাকি? ধর, এক অমাবস্যায় আমার জ্বর এলো......
এলো! এলো তো এলো! আসুক না। দাদু এবার ছোট্ট হেসে বলছে, জ্বরের যখন ইচ্ছে হয় আসুক। থাকুক না তোমার সঙ্গে কটাদিন। ও তো আর তোমার কাছে মাংস-ভাত খাওয়ার বায়না করছে না! তোমার সঙ্গে কটাদিন একটু কাটাতে চাইছে। কাটাক। তুমি শুধু অপেক্ষা কর। উপেক্ষা কর ওকে। আর ধৈর্য্য রাখো। দেরি কর জোছনার জন্য। জোছনা তো আর পালিয়ে যায়নি! অমাবস্যা ফুরলেই জোছনার আলো ফুটবে আকাশে, চাঁদ হাসবে। আলো ঝলমল হবে চারপাশ। সেই ঝলমলে জোছনায় এবার তুমি গিয়ে বাগানে বস। স্নান কর চাঁদের আলোয়। পারলে চাঁদকে জড়িয়ে ধর। সারা অঙ্গে চাঁদের আলো মাখো। আর যদি গান জানো তো গলা ছেড়ে গানও গাও। দেখবে তোমার জ্বর-টর সব উধাও হয়ে যাচ্ছে। তুমি কেমন সুন্দর সতেজ, ফুরফুরে হয়ে উঠছো!
আচ্ছা দাদু ধর, বৃষ্টিতে ভিজে কাদামাঠে ফুটবল খেলে ঠাণ্ডা লেগে নাক দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছে। সর্দি-কাশি হয়েছে কি করব দাদু?
এটা কোনো কথা হল? দাদুর কি উদাস হাসি! বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল রোজ খেল না বলেই তো একদিন হঠাৎ খেললে সর্দি-কাশি হয়ে নাক দিয়ে জল গড়াবে। গড়াবেই! বলি শোন, রোজ খেলবে। রোদে খেলবে। বৃষ্টিতে খেলবে। সারাবছর খেলবে। শরীরচর্চা হবে। শরীর চাঙ্গা থাকবে। রোগ-ব্যাধি হবে না। আর চোখের জলের চেয়ে নাক দিয়ে জল গড়ানো ঢের ভালো। ও জল পড়ুক না কর পড়বে? ওই তো নাকের ছোট্ট দুটো ফুটো। ওখানে আর কত জল ধরে? জল ঝরতে ঝরতে একদিন ঠিক ফুরিয়ে শুকিয়ে যাবে, তোমাকে শুধু ধৈর্য্য ধরতে হবে। একটু যা দেরি হবে। হোক না দেরি। আর মাঝে-মধ্যে তখন প্রখর ঝলমলে রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে শরীরটাকে একটু সেঁকে নিতে হবে। সানবাথ্ বোঝ> সূর্যস্নান। ওটি করতে হবে। সূর্যের আলোয়, রোদের ঝিলিমিলিতে অনেক পথ্যি, অনেক দ্রব্যগুণ লুকিয়ে থাকে। যা তোমার শরীরকে উপশম এনে দেবে। রোগের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি জোগাবে দেখবে নাকের জল শুকিয়ে তখন বাষ্প হয়ে উবে গেছে আকাশে। তুমি কেমন দিব্যি সুস্থ, সতেজ হয়ে উঠেছো।
দাদু, আমাদের স্কুলের গেটে দারুণ হজমিগুলি, বিট নুন দেওয়া বিলিতি আমড়া, তেঁতুলের আচার, কষা কষা আলুরদম বিক্রি হয়। খুব খেতে ইচ্ছে করে গো। কিন্তু ওসব খেয়ে যদি পেটখারাপ হয়! কি করব তখন দাদু?
দাদু এবার খুব হাসছে। যেন ভীষণ খুশি হয়েছে কথাগুলো শুনে। তাই হাসতে হাসতে বলছে, ওরে হজমিগুলি, বিলিতি আমড়া, তেঁতুলের আচার, কষা কষা আলুরদম আমি কতদিন খাইনি রে, শুনে আমারই তো খেতে ইচ্ছে করছে। একদিন তোদের স্কুলের গেটে চলে গেলে হয় তো!
যাবে দাদু?
হুঁ, হুঁ। ভাবছি তো! দাদু ভাবতে ভাবতে এবার বলে, তা ধর যদি কখনো ওসব খেয়ে পেট গণ্ডগোল হয়। হবে। তা বলে অমন সব মনোহরণ জিনিস খাবে না! খাবে। খুব আনন্দ করে খাবে। খেয়ে যদি পেট গণ্ডগোল হয়। বারবার 'বড়' করতে যেতে হয়। যাবে। পেট সাফ হয়ে যাক। মাঝে মাঝে একটু পেট পরিষ্কার হওয়াও দরকার। হাবি-জাবি, আগডুম-বাগডুম সব বেরিয়ে গিয়ে পেট একদম সাফা হয়ে যাক।
কিন্তু দাদু, ততক্ষণে যে শরীরের নুন-জল সব বেরিয়ে শরীরটাও কাহিল হয়ে যাবে!
যাবে কোথায়? ঘরে তোমার কি নুন-চিনি-জল এসব নেই? আছে তো! তবে, গ্লাসে গুলে ঢক ঢক করে খেয়ে যাও বারকয়েক। দেখবে শরীর কেমন চাঙ্গা, ফিট হয়ে যাচ্ছে।
দাদু, খুব মাথা ব্যথা করছে গো!
করবেই তো। অতটুকু পুঁচকে একটা মাথা। তাতে সব কিচ্ছু ঢোকাও কেন? বলি, দরকার আছে কি কোনো? ফাঁকা রাখো। ফাঁকা রাখো। হালকা থাক। পলকা থাক। জানিস তো, অতিবিদ্যাও ভয়ঙ্কর। তোদের ইসকুলের ব্যাগগুলো কি ভারী, কি ভারী! মনে হয় বই তো নয়, ও যেন পাথরের বোঝা!
কি করব দাদু? তুমিই বল .....
কি আর করবি। মাথা ধরলে ভালো করে ঘুমোবি। গভীর ঘুম যাকে বলে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখবি। ভালো ভালো সব স্বপ্ন। সেই সব স্বপ্নে ভেসে যাবি, উড়ে যাবি। দেখবি মাথা-ব্যথা ট্যাথা সব ছুট। উধাও হয়ে গেছে। যাকে বলে একদম ভো-কাট্টা!
দাদু, পচা যে এবারও ফেল করেছে। ওর বাবা বলেছে, পচাকে আর পড়াবে না। স্কুল ছাড়িয়ে দেবে। বাবার ব্যবসায় নামিয়ে দেবে, কি হবে দাদু?
এসব কথা বলেছে বুঝি? দাদু কেমন ঘাড় দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ও মানুষ রাগ করে কত কথাই তো বলে। সব কথা ধরতে নেই। ওর বাপ এখন খুব রেগে আছে। তাই এসব বলেছে। বলতে দাও। বলতে দাও। কত বলবে? বলতে বলতে একদিন মুখ ব্যথা হয়ে যাবে। আর বলবে না। ততদিনে পচাও পাশ করে বড় হয়ে যাবে। এখন শুধু একটু অপেক্ষা করতে হবে। পড়াশুনাটা করতে হবে। ধৈর্য্য ধর। দেরিপ্যাথি ঠিক কাজ দেবে।
'দেরিপ্যাথির এমনই জাদু, জানে শুধু পচার দাদু'। — ছড়াটা ভালোই হিট করেছে। কে যে বানালো জানি না। কিন্তু সবাই দেখি জানে ও গুণ গুণ করে বলে। দাদু নিজেও শুনে বলেছে, 'খাসা হয়েছে রে। রবিঠাকুরও বোধহয় এত সুন্দর লিখতে পারতেন না!'
পচা আজ দারুণ একটা খবর নিয়ে এসেছে। আমরা তো শুনেই অবাক। আর এক সপ্তাহ বাদেই দাদুর নব্বই বছর বয়স হবে। দাদু নব্বই নট আউট! পচার সাতমামা, পাঁচ মাসি সবাই মিলে ঠিক করেছে, দাদুর নব্বই বছরের জন্মদিন খুব ধুমধাম করে পালন করবে। দারুণ একটা হৈ চৈ কাণ্ড হবে। প্রচুর লোকজনকে খাওয়ানো হবে। আমরা সব বন্ধুরা নিমন্ত্রণ পাব। বাড়ির দুই পুকুরেই জাল ফেলবে, যত মাছ সেদিন জালে ধরা পড়বে সব রান্না হবে। গণেশ মামার পোলট্রিতে যত মুরগি আছে, সব মুরগিই সেদিন রান্না হবে। মোল্লাচকের বিখ্যাত লালদই আর কাঁচাগোল্লা আসবে। সে এক বিশাল ব্যাপার হবে। আমাদের আশেপাশে, চারপাশে কোথাও নব্বই বছরের মানুষ নেই। আর এমন তরতাজা মানুষ তো নেইই! তাই কদিন ধরে পচাও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছোটাছুটি বেড়ে গেছে। আমরা তো খালি দিন গুনছি। একদিন যায়। দু'দিন যায়। তিনদিন যায়। চারদিনের দিন হঠাৎ দেখি পচা মুখকালো করে এসে হাজির। আমরা অবাক হয়ে বলি, কি রে পচা, কি হয়েছে?
পচা চুপ। কথা বলে না। মুখ গোমড়া করে থাকে। আমরা ভয় পেয়ে বলি, পচা বল না কি হয়েছে?
— দাদুর জন্মদিন পালন হচ্ছে না।
— হচ্ছে না! ওমা কেন রে?
— দাদু বলেছে, নব্বই বছর কোনো বয়সই নয়। এত তাড়া কিসের? আগে আমার একশো হোক, তারপর জন্মদিন পালন হবে।
— সে তো এখনও দশবছর দেরি!
— দাদু বলেছে, হোক দেরি। দেরি কর। ধৈর্য্য ধর। নব্বই দেখতে দেখতে একদিন একশো হবে। দাদুর জবাব, সেঞ্চুরি আমি দেখতে চাই।
— তাই! আমরা সবাই ভীষণ হতাশ হয়ে কপাল চাপড়ালাম।
— দাদু, তুমি একদম ভালো না। ভীষণ খারাপ! খুব খুব বাজে!
— ওমা! কেন? কেন বলছো একথা?
— আমাদের এখন দশবছর দেরি করতে হবে। কত আশা করেছিলাম দাদু!
— ওরে, আমার প্যাথিটাই তো দেরিপ্যাথি। দাদুভাই, একটু দেরি কর না। মোটে তো দশটা বছর। ও দেখতে দেখতে চলে যাবে। তারপর পেটপুরে যত খুশি খেও মণ্ডা-মেঠাই, কোপ্তা-কালিয়া। এই কটা দিন একটু অপেক্ষা কর দাদুভাই। এরমধ্যে টুক করে আমার সেঞ্চুরিটা হয়ে যাক্।।......