|| এক ||
পৃথুলা জন্ম থেকেই রোগা আর বাকপটু। তবু সে ভালবেসেছিল পৃথুলাকে। ভালবেসে বিয়ে করেছিল, সংসার করল। সন্তান উৎপাদন করল এবং সবশেষে মিলিত প্রচেষ্টায় সংসার উৎসাদন করে চলল।
তাই সৃষ্টি হলো নাগলোকের মিথ-এর, সৃষ্টি হলো মাত্র কয়েকমুহূর্ত আগে। পৃথুলার আস্ফালন, তারপর পড়ে যাওয়া...। সে আধ গ্লাস পানি খেয়ে টেলিফোনটা উঠাল। দেখল সেটা ডেড। বেডরুমে ঢুকে দেখল মেয়েটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। তার খুটখাট শব্দে মেয়েটা পাশ পরিবর্তন করল। ছয়বছরের একমাত্র সন্তান বাবা-মা’র সাংঘর্ষিক সময়টায় টিভিতে কার্টুন ছেড়ে দিয়ে আনমনে কার্টুন দেখে।
বাপমায়ের কলহ থামবার অপেক্ষায় থাকে। রাত অনেক। ঘড়ি দেখল সে‒সোয়া একটা। আবার ডাইনিংয়ে এলো সে, পৃথুলা তখনো পড়ে আছে ফ্লোরে।
ফের বেডরুমে ঢুকল সে। টিভি খোলা। কার্টুন চলছে। কয়েক মিনিট বিছানায় বসে চ্যানেল বদলাল আনমনে। আসলে সে পৃথুলার ওঠার প্রতীক্ষা করছে।
আজও এসেছিল আরিফ। সে অফিস থেকে আগে ফিরে আসায় দেখা হয়ে গেল আরিফের সাথে। পৃথুলার জন্মদিন আজ, সেটা মনে ছিল তার। অফিসে যাবার সময় উইশ করেনি ইচ্ছে করেই। উদ্দেশ্য, পৃথুলাকে চমক দেবে বাসায় ফিরে। তাই অফিস থেকে আগেভাগে বেরিয়ে পৃথুলার জন্য মুঠোফোন কিনল। পৃথুলার হ্যান্ডসেট হাত থেকে পড়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। পরিচিত দোকান থেকে সেট কিনে অন্য এক দোকানে গিয়ে সেটা র্যাপিং করাল। মনে মনে প্ল্যান আঁটল, পৃথুলা আর সিমিনকে নিয়ে চায়নিজ খেতে যাবে সন্ধ্যেয়। বাসায় ঢুকে সব গড়বড় হয়ে গেল তার। পৃথুলার জন্মদিনকে ঘিরে তার সব প্রত্যাশা নিমেষে চুরমার হয়ে গেল।
পৃথুলার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু আরিফ। পৃথুলাকে নিবেদন করেছিল সে। তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল পৃথুলা। বিয়ের অব্যবহিত পরেই এসব কথা পৃথুলা তাকে বলেছিল। বলা যায়, স্বীকারোক্তি করেছিল পৃথুলা।
তারপর একদিন পৃথুলা বলল, ‘আরিফ আসতে চায়। ডাকব একদিন?’
‘ডাকো।’ সে বলেছিল।
|| দুই ||
...আরিফ একদিন এসেছিল। বিয়ে করেনি। গাড়ি আছে নিজের। পৃথুলাকে নিবেদনের সময় আরিফ ছিল খাঁটি বেকার। তারপর নাকি সে কী একটা ব্যবসা ধরে লাল হয়ে যায়। সেদিন আরিফ অনেকক্ষণ ছিল। ওদের বিয়েতে আসতে পারেনি বলে আক্ষেপ করল। ব্যবসার কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছিল, তাই আসতে পারেনি।
তার কয়েকদিন পর পৃথুলা বলল, ‘আরিফ আমাদের বিয়েতে একসেট গোল্ডের গহনা দিতে চায়।’ শুনে তার চক্ষুস্থির হয়, ‘বিয়ের এতদিন পর এতবড় উপহার!’
‘হ্যাঁ। শোনো না’, উচ্ছ্বসিত হয়ে পৃথুলা বলল, ‘বিয়েতে আসতে পারেনি, তাই মনের মতো গিফট দিয়ে সেটা পূরণ করতে চাচ্ছে।’
সে আক্ষেপ করে বলেছিল, ‘হায়রে জমানা! এক্সপেক্টেশনের একটা লিমিট থাকা উচিৎ। আমি যে চাকরি করি, তাতে তোমাকে কোনো উপলক্ষে বা অ্যানিভারসারিতে এতবড় গিফট দেয়া সম্ভব না। তুমিও আশা করোনা নিশ্চয়ই?’
‘কেন করব না? তোমার বেতন বাড়লে, বা কোনো বড় চাকরি হলে অবশ্যই আশা করব।’
‘দ্যাটস রাইট। এখন এসব আশা করোনা। আমাদের বিয়ের মাত্র একবছর কাটল। আমাকে সময় দাও, দেখি তোমাকে বড় কিছু উপহার দিতে পারি কিনা।’
পৃথুলা বলল, ‘বিয়ের আগে তোমারও একটা প্রেমিকা ছিল। সে তোমাকে ভালবাসত, তুমিও ওকে ভালবাসতে। টগর আমাকে একদিন ফোন করেছিল, তা জানো? বলছিল, তুমি একটা ইয়ে...। বহু মেয়ের সাথে তোমার রিলেশন ছিল।’
‘ছিল, যেমনটি তোমার ছিল বাটুর সাথে। পার্থক্য, আমার সাথে টগরের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক নেই। কিন্তু বাটুর সাথে তোমার সংশ্রব এখনো আছে।’
এখানেই সূত্রপাত হয়েছিল পরস্পরের হৃৎপিণ্ড বধ কাব্য ...।
|| তিন ||
অফিস থেকে ফিরে এসে সেন্টার টেবিলের ওপর সুদৃশ্য মুঠোফোনের লাল একটা বাক্স দেখল সে। তারপর বলল, ‘এটা কোত্থেকে এলো! অরুচিকর। শিষ্টতার বাইরে।’
‘মুরোদ নেই, আবার বড়বড় কথা বলছ। কই, পারলেনা তো একটা এসি কিনতে। গাড়ি তো দূরের কথা।’ পৃথুলা কেঁদে ফেলল, ‘আজ আমার জন্মদিন। অফিসে যাবার সময় তুমি আমাকে উইশ করোনি। অফিসে গিয়েও ফোন করোনি।’
সে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকে পৃথুলার দিকে।
‘ভুলে যাইনি। দেখো তোমার জন্য কী কিনেছি। আর শোনো, কী প্ল্যান করেছি।’ এরকম উত্তর সে দিতে চাইল না। যেটা মনে মনে সে সাজিয়েছে সাজানো বাগানের মতো, তাকে ভাষা দিয়ে প্রকাশ করতে চায়নি সে। করে দেখাতে চেয়েছিল। অথচ পৃথুলা সব লেজেগোবরে করে ফেলল।
ওদের বিয়ের সপ্তমবার্ষিকী চলছে। এই সাতবছরে চেষ্টা করেছে সে পৃথুলাকে, মেয়েকে সুখি করার। এমনকি পৃথুলার মুঠোফোনে দিনের ছয়সাত ঘন্টা ফোনালাপের প্রেক্ষিতে সে নিজের মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধ করে খরচ কমিয়েছে। দুর্বল হৃৎপিণ্ড বিশিষ্ট এই কাপালিক-কন্যা ওর নান্দনিক মন আর আর্তিকে এভাবে চটকাতে থাকবে সে ভাবতে পারেনি। সে ধপ করে চেয়ারে বসে শখের প্যাকেটটা ছুড়ে দেয় ডাইনিংরুমের অন্যপ্রান্তে। মাথায় ঘুরছে কেবল বাটু। ‘বাটু এসেছিল আবার!’ সে যে মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনেছে পৃথুলার জন্য, সেটা সে দিতে পারবেনা! বাটু যে হ্যান্ডসেট এনেছে, সেটা গ্রহণ করবে পৃথুলা!
এইসময় আকাশপথে ছুটে এলো লাল বাক্সটা! পৃথুলা বাক্সটা সবেগে ছুড়ে দিল তার কপাল সই করে, সে মাথা কাত করে আঘাত এড়াল। শব্দ পেয়ে দৌড়ে এল সিমিন। ‘কী করছ তোমরা!’ বলে সে অবাক চোখে একবার জন্মদাতা, একবার জন্মদাত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার বেডরুমে সেঁধোল।
...দৃশ্যটা কেমন ভৌতিক মনে হলো তার কাছে। পৃথুলা টলছে। হাত দু’টো কোনো নর্তকীর ঢেউখেলানো মুদ্রার মতো নৃত্যচ্ছন্দ করল। ‘একী!’ বলে সে ছুটে যাবার আগেই ধপাস করে পড়ে গেল পৃথুলা।
|| চার ||
...সিমিন টিভি ছেড়ে রেখে ঘুমোচ্ছে: টম দৌড়াচ্ছে জেরিকে ধরার জন্য। টিভির চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে একটা চ্যানেলে এসে থেমে যায় সে। অনুষ্ঠানটা বোধহয় ফার্স্টঅ্যাইড বিষয়ক। বেসিক সিপিআর দেখাচ্ছে একটা বিদেশি চ্যানেলে। এক মহিলা নিঃসাড় পড়ে আছে। একজন লোক বিশেষ কায়দায় মহিলার বুকের ওপর দুইহাত রেখে চাপ দিচ্ছে। এরকম তিরিশটি চাপ দেবার পর মহিলার মুখে মুখ রেখে দুইবার ব্রেদ দিচ্ছে। নেপথ্যে একটা মেয়েকন্ঠ ব্যাখ্যা করে বলে যাচ্ছে: এই চাপ দেয়ার নাম কমপ্রেশন। এরকম ত্রিশবার চাপ দেবার পর দুইটি ব্রেদ দিতে হবে, ৩০:২, এই রেশিওতে।
হঠাৎ লাফ দিয়ে ওঠে সে। একদৌড়ে চলে এলো ডাইনিংয়ে। তেমনি নিথর পড়ে আছে পৃথুলা। ধক করে ওঠে তার ভেতরটা। সে দ্রুত এগিয়ে যায়। হাঁটু গেঁড়ে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে পানি দিয়ে ভিজিয়ে পৃথুলার মুখে বুলিয়ে দিল। ঘামতে শুরু করেছে সে।
পৃথুলার মাঝে কোনো সাড়া নেই। তার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামে। সমস্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে ঘামে। সে টিভিতে দেখা পদ্ধতিতে পৃথুলার বুকে কম্প্রেশন-ব্রেদ চালাল।
সে আবার অ্যাপ্লাই করল পদ্ধতিটা।
মনে হলো, বোধহয় পদ্ধতিটা নিখুঁতভাবে প্রয়োগ করতে পারেনি সে। পারলে হয়তো বেঁচে উঠত পৃথুলা। আবার মনে হলো, পৃথুলা বেঁচে ছিল বা বেঁচে উঠত বরাবরের মতো। ওর উল্টাপাল্টা চাপে হয়তো...। তার হৃৎপিণ্ড ধরাস-ধরাস করে লাফাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চেতনা হারিয়েছিল সে। চোখ মেলে সে অনুভব করল সে যেন কোনো রক্তমাংসের মানুষ নয়। কী, সেটা তার জানা নেই। বোধহয় সে নিম্নস্তরের বুদ্ধিহীন কোনো প্রাণী।
ময়নাতদন্ত হলে ডাক্তারি রিপোর্ট বলবে: ‘অতি উত্তেজনায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু।’ হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যু হলে সব দায়দায়িত্ব যে মরেছে তার। ‘হৃদযন্ত্র বিকল’ মানে হলো একটা কুহকী বেড়াজাল। কারণ তার হৃদযন্ত্র এখনো সচল কিন্তু সে ‘মৃত’, যদিও সোম্যাটিক মৃত্যু তার হয়নি।
বুদ্ধিহীন প্রাণির মতোই সে দিশেহারা। আবার সে বেডরুমে এলো। তেমনি ঘুমোচ্ছে সিমিন। ওর সাড়া পেয়ে পাশ ফিরে শুলো।
ড্রয়িংরুমে এলো সে, ফোনটা তুলে রেখে দিল ফের। আগের মতোই ডেড। এইসময় দরজায় ঠক-ঠক করে কেউ নক করল। সে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলে দিল। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা গরীবনেওয়াজ দম্পতি হুড়মুড় করে ঢুকলেন। ‘কী হয়েছে! হট্টগোল শুনে চলে এলাম। কোনো সমস্যা?’ গরীবনেওয়াজ জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমার স্ত্রী মরে গেছে।’ সে বলল।
‘মরে গেছে! কেমন করে? কী হয়েছিল?’ হতভম্ব হয়ে তাকালেন গরীবনেওয়াজ, ‘কোথায়, দেখি?’ গরীবনেওয়াজ দম্পতি ছুটে গেলেন ডাইনিংয়ে। ফিরে এলেন আবার। মিসেস গরীবনেওয়াজ চেঁচিয়ে বললেন, ‘মরে গেছে না মেরে ফেলা হয়েছে। পুলিস ডাকো।’
গরীবনেওয়াজ বললেন, ‘পুলিস ডাক্তার দু’টোই ডাকব। আর তুমি এমন বেফাঁস কথা বলোনা। উনি কেন হঠাৎ উনার স্ত্রীকে মারতে যাবেন! আর ভাবি মরে গেছে কি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, সেটা আমরা বলবার কে?’
‘তোমার মতো বুদ্ধু না বললেও আমি বলছি। তারা স্বামী-স্ত্রী সবসময় ঝগড়া করে। ভাবির কাছে একটা লোক এসেছিল। আর ভাই বাসায় ফিরে এসে...। বুঝতে পারলে?’ মিসেস গরীবনেওয়াজ চোখ গরম করে তাকালেন স্বামীর দিকে।
গরীবনেওয়াজ মুঠোফোন থেকে থানায় রিং করে বললেন, ‘আমি গরীবনেওয়াজ বলছি। আমার পাশের ফ্ল্যাটে একজন মহিলা মারা গেছে। মারা যাবার আগে তারা স্বামী-স্ত্রী ঝগড়া করছিল।’ তিনি এরপর বাসার ঠিকানা বললেন। তারপর বললেন, ‘দয়া করে জলদি আসুন।’
রাত সোয়া দু’টোয় পুলিস এলো। ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস করলেন গৃহকর্তাকে, ‘কখন হলো? আপনি কী করছিলেন, কোথায় ছিলেন?’ ‘আজ আমার স্ত্রী’র বার্থডে বলে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলাম। ফিরে দেখি বাসায় বাটু নামের একজন অবস্থান করছে।’ সে ঢোক গিলে বলল, ‘আমাকে দেখে লোকটা বের হয়ে গেল।’
‘বাটু কে?’ পুলিস অফিসার জিজ্ঞেস করলেন।
‘বাটু আমার স্ত্রী’র বন্ধু।’
‘তারপর?’
‘তারপর স্ত্রীকে বললাম, এটা অরুচিকর। অভব্য। স্ত্রী আমার সাথে তর্ক করল। আমাকে উল্টোসিধে বলতে লাগল। এই পর্যায়ে আমার মেয়ে এসে আমাদের দু’জনকে ঝগড়া করতে দেখে যেমন নীরবে এসেছিল, তেমনি নীরবে বেডরুমে ঢুকল। কার্টুন দেখতে লাগল। একসময় সে ঘুমিয়ে যায়।’
‘তারপর?’
‘আমাদের মধ্যে তর্ক চলছিল। স্ত্রী আমার মুখের ওপর বন্ধুর কাছ থেকে গিফট পাওয়া মোবাইল সেটটা ছুড়ে মারে। আমি আঘাত এড়াই কোনোক্রমে। এরপর দেখলাম সে টালমাতাল হয়ে দুলছে। আমি ছুটে গিয়ে ধরার আগেই সে মেঝেতে পড়ে যায়।’
এইসময় সাব-ইন্সপেক্টর এসে বললেন, ‘স-স্যার, ডে-ডেডবডিটা মৃত। হা-হার্টফেল ক-করে মা-মা-মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে। গ-গলায় বা শরীরে কোনো দাগ দেখলাম না।’
‘আপনে যদি সব কথা একবারে বয়ান কইরা ফালান তাইলে আমি কী...ছিঁড়ব। যান, আসতেছি আমি।’ অফিসার আবার ফিরলেন ওর দিকে, ‘আপনার স্ত্রী কেন মরে গেল বলে আপনার মনে হয়?’
‘ওর হার্ট দুর্বল ছিল বলে ডাক্তার জানিয়েছিলেন। তাই আমি সবসময় চাইতাম ও যেন কখনো উত্তেজিত না হয়। কিন্তু ওর মাথা গরম থাকত, অল্পতেই রেগে যেত। আর আজকের ব্যাপারটায় সে অতিরিক্তি সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়ে।’
‘আপনি তবে বলতে চাইছেন উনি আত্মহত্যা করেননি বা উনাকে মেরে ফেলা হয়নি?’
‘হ্যাঁ, তাই বলতে চাইছি।’
‘ডাক্তার ডাকেননি কেন?’
‘ডাকতাম, সেসময় উনারা চলে এলেন’, গরীবনেওয়াজ দম্পতিকে দেখিয়ে বলল সে, ‘আগেও এমন দু্ইবার হয়েছিল। আমার স্ত্রী নিজে থেকেই আবার রিগেইন করে। তাছাড়া ফোন করতে গিয়ে দেখি ফোন ডেড। স্ত্রী পড়ে যাওয়ার পর বড়জোর সাত-আট মিনিট কেটেছে, তখন উনারা এলেন।’
‘হুম।’ পুলিস অফিসার একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর বললেন, ‘লাশ ময়নাতদন্তের পর বুঝা যাবে, উনি কীভাবে মরলেন। বাটু সাহেবের মোবাইল নাম্বার দিন। আপনি আপাতত কোথাও যাবেন না। আপনার অফিসের ঠিকানা বলুন।’
সে বলল, ‘আরিফের মোবাইল নাম্বার আমার জানা নেই।’ এরপর সে তার নিজের অফিসের ঠিকানা বলল। চরকির মতো তার দিকে ফিরলেন অফিসার, ‘আরিফ কে!’
‘আরিফ হচ্ছে বাটু যাকে আমি বাটু বলি।’
‘তার সত্যিকারের নামটা কী?’ অফিসার প্রায় ধমকে উঠলেন।
‘আরিফ।’
‘তাহলে বাটু বলছেন কেন!’
‘কারণ সে বেঁটে। সে এই গরীবনেওয়াজ সাহেবের চেয়েও বাট্টু।’ এইসময় ‘হা হা’ করে উঠলেন ফর্সা-গোলগাল-টেকো গরীবনেওয়াজ সাহেব। সে আবার বলল, ‘নাম গরীবনেওয়াজ হলে কী হবে, উনি বিরাট ধনী।’
‘কথা কম’, পুলিসটি একমুখ ধুঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘আপনার মেয়েকে একটু জিজ্ঞেস করব। ও কি ঘুমিয়ে আছে?’
পাশে অপেক্ষমান গরীবনেওয়াজ সাহেব ও তাঁর স্ত্রীর দিকে অফিসার চোখ কুঁচকে তাকালেন, ‘আপনারাই কি...।’
‘আমরা পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা, আমি অধম গরীবনেওয়াজ আর ও হচ্ছে আমার স্ত্রী, মুখরা টাইপের মহিলা। আমিই থানায় ফোন করেছি।’
‘আই সী। আপনারা কীভাবে টের পেলেন?’
‘আমরা তখন ঘুমাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এসময় দেয়ালে একটা ভারি শব্দ পেলাম। তারপর উনি আর উনার স্ত্রীর তীক্ষ্ণগলার আওয়াজ পেয়ে ভাবলাম সামথিং রং। তার মিনিটদশেক পরেই আমরা চলে আসি।’
‘সন্ধ্যা থেকেই আমি উনাদের দুইজনের তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম।’ মিসেস গরীবনেওয়াজ এবার বললেন।
‘চিৎকার যদি সন্ধ্যা থেকে শুনে থাকেন তাহলে আগে আসেননি কেন!’ পুলিস অফিসার বক্রচোখে চাইলেন মিসেস গরীবনেওয়াজের দিকে, ‘তাহলে এই মৃত মহিলার অকালমৃত্যুটা না-ও হতে পারত।’
আমতা আমতা করে মিসেস গরীবনেওয়াজ বললেন, ‘না, মানে উনাদের পার্সোনাল ব্যাপার। তাছাড়া, এভাবে ভাবির মৃত্যু ঘটবে, সেটা তো কল্পনা করিনি।’
‘কীভাবে মৃত্যু হতে পারে বলে মনে করেছিলেন? এটা মৃত্যুও হতে পারে, আবার হত্যাও হতে পারে।’ অফিসার বললেন।
‘এ্যাঁ! হত্যা!’ গরীবনেওয়াজ দুই পা পেছুলেন। আর তাঁর স্ত্রী অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন। তা দেখে অফিসার বললেন, ‘আপনাদের একজনের চোখে নেশা লেগে আছে, আর আরেকজন একটু বেশি কথা বলছেন। ভাল করে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার আসুন। আপনাদের জবানবন্দি নেব।’
‘না, না। কী যে বলেন...। নেশা কোথায়, এই তো। কিন্তু ...।’ গরীবনেওয়াজ সাহেব মোচড়াতে লাগলেন।
|| পাঁচ ||
দৃশ্যটা দেখে সবার চোখ আটকে গেল সেদিকে। শুভ্র-শাদা ফ্রক পরে কেমন মাতালের ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে সিমিন। কোঁকড়ানো এলোমেলো চুল, বিষণ্ন এক অভিব্যক্তিতে সিমিনকে মনে হচ্ছে ‘অ্যামিটিভিল হরর’ ছবির সেই ছোট্টো মেয়েটির মতো। মেয়েটাকে কেমন অপার্থিব আর নির্বোধের মতো দেখাচ্ছে।
অফিসারটি সেদিকে তাকাতে সে নির্জীব ও নির্বিষ গলায় বলল, ‘আমার মেয়ে।’ অফিসারটি বললেন, ‘আপনি কিছু বলবেন মামণি?’
একথায় নিঃশব্দে ঘাড় নাড়ল মেয়েটি সম্মোহিতের মতো। কলের পুতুলের মতো বলল, ‘না।’
‘কিছুই বলবেন না!’
‘কী বলব?’
‘এই যে আপনার আব্বু-আম্মু ঝগড়া করে। আজও তো ঝগড়া করেছে... তারপর?’
‘তারপর আম্মু পড়ে যায়। আম্মুর অসুখ আছে। তাই পড়ে যায়।’
‘পড়ে যাবার পর কী হলো?’
‘আব্বু আম্মুর বুকের ওপর বসে দুইহাত দিয়ে চেপে ধরে।’
পুলিস অফিসার বললেন, ‘আপনি দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি।’
‘কিন্তু আপনি তো ঘুমিয়ে ছিলেন।’
‘না, কার্টুন দেখছিলাম শুয়ে শুয়ে, আব্বু এলে চোখ বন্ধ করে ফেলছিলাম।’
‘তারপর?’
‘তারপর...আমার খিদে পেয়েছিল...ডাইনিংয়ে উঁকি দিলাম আব্বু-আম্মু ঝগড়া বন্ধ করেছে কিনা দেখার জন্য। তখন দেখলাম...।’
‘কী দেখলেন!’
‘দেখলাম...’, সিমিন রোবটের মতো গলায় থেমে থেমে বলল, ‘আম্মুকে ফ্লোরে ফেলে আব্বু আম্মুর বুকে জোরে চেপে ধরেছে...।’
‘আপনাকে আপনার আব্বু দেখেনি?’
‘না-তো, আব্বু আমার দিকে পেছন ফিরে ছিল।’
পুলিস অফিসার গরীবনেওয়াজ দম্পতির দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনারা বাচ্চাটিকে দেখুন। ওর স্বজনদের খবর দিন। আমরা উনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’ এরপর তিনি ইশারা করতে একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
সে আত্মজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। সিমিন চোখ নামিয়ে নিল। তার মনে হলো, পৃথুলা মরেনি, মরে গেছে সে। সে আর রক্তমাংসের মানুষ নয়, সে প্লাজমা। নড়তে পারে কিন্তু বোধহীন।
নাগলোকের দরজাটা দিয়ে সে বের হয়ে যাচ্ছে দুইহাতে কড়া পরে। গরীবনেওয়াজ সাহেব হতাশায় মাথা দোলালেন, ‘এ হতে পারেনা, কিছুতেই না।’ পাশ থেকে তাঁর স্ত্রী ধমকে উঠলেন: ‘মাথা ঝাঁকাবার দরকার নেই। ঘরে যাও তুমি, তোমার চোখে ঘুম লেগে আছে, আজও তো গলা পর্যন্ত পান করে এসেছ।’
সে ভাবছে: জনাকীর্ণ রাস্তা দিয়ে সে পুলিসের গাড়িতে চড়ে গরাদঘরে পৌঁছে যাবে। গরাদের শিকের আড়ালে একটা ছোটো কুঠুরিতে তার বাস হবে। গরাদের ভেতরে হৃৎপিণ্ড বিকল হয়ে মৃত্যুর কোনো মিথ তৈরি হবেনা। নাগলোকের দুর্মক উভলিঙ্গী-পরিবেশের চেয়ে সেই গরাদঘর, এমনকি ফাঁসির মঞ্চ অনেক ভাল।
এসময় একটা চিৎকার ভেসে এলো। ‘পুলিস ডেকে, আশেপাশের মানুষ ডেকে ঘরটাকে নরক বানিয়ে ফেলেছ। সিমিন, সিমিন...।’
হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো সাব-ইন্সপেক্টর, ‘স্যার ভো-ভৌতিক কারবার। মড়া মেয়েলোকটা জ্যাতা হইয়া দাঁড়াইয়া চিল্লাইতেছে।’
‘এত সহজে!’ মিসেস গরীবনেওয়াজ খপ করে স্বামীর হাত ধরে ফেললেন, ‘গরাদে গিয়ে আরাম করে জেলের ভাত খাবে, না? আমি তা হতে দিচ্ছিনা,’ বলে তিনি এক ঝটকায় গরীবনেওয়াজ সাহেবকে টেনে নিয়ে নিজ ফ্ল্যাটে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
পৃথুলা এসে আছড়ে পড়ল তার ওপর। ‘এ কী! তোমার হাতে হাতকড়া কেন! অফিসার ওকে ছেড়ে দিন। ও নির্দোষ।’ পৃথুলা কেঁদে ফেলল।