'দেখো, চারপাশটা শুধু নীল। আমাদের নামের রং'
'শুধু তাই নয়? আকাশের রং শান্তির রং, সমুদ্রের রং, অবসাদ আর মৃত্যুর রং—
'ওই শেষেরটায় আমার আপত্তি আছে। মৃত্যুর রং যদি কিছু থাকে সেটা কালো, নীল মোটেই নয়। কক্ষনো আর আমাদের প্রিয় রংটাকে বদনাম দেবেনা।'
নীলাঞ্জনা হাসছে। সেই স্কুলের সময় থেকেই ওদের নামের মিল নিয়ে বন্ধুদের মধ্যে হাসাহাসি। নীলাদ্রি আর নীলাঞ্জনা যাদের ডাকনাম অবধারিতভাবে নীল এবং নীলা, বন্ধুদের ইয়ার্কি শুনতে শুনতেই নাকি পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেছিল। শুধু নামের মিল নয় ওদের জীবনের সেই প্রথম বড়ো হবার ম্যাজিক সময়টা নানাভাবেই ওরা কাছাকাছি। ওদের ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর ভারতের বিভিন্ন রেল কলোনিতে। যদ্দিনে ওদের বাবারা রিটায়ার করে বাইপাসের ধারে ফ্ল্যাট কিনে থিতু হয়েছেন, ওরাও তার মধ্যে বেঙ্গালুরু হয়ে আমেরিকায়। নীলাদ্রি একটা নামকরা টেক কম্পানিতে কাজ করে, পাক্কা ওয়ার্কোহলিক, ওর কাছে কর্পোরেট ল্যাডার মানে স্বর্গের সিঁড়ি। নীলা রাগ করে বলে ওর বরের প্রিয় খেলার নাম র্যাট রেস। এমনকি ছুটিতে এসেও রেহাই নেই, ও সারাদিন কিছু না কিছু অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে রয়েছে। নীলার প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও ও এখন গভীর জলে মাছেদের সঙ্গে সাঁতার কাটতে নামবে।
'রক্তে অক্সিজেন কমে গেলে গায়ের রং নীল হয়ে যায়, তাকে বলে সায়ানোসিস। শিব নিজের গলায় হলাহল বিষ ধরে রেখেছিলেন তাই তিনি নীলকণ্ঠ। আলবাৎ মৃত্যুর রং নীল কিন্তু সেটা মোটেই দোষের কথা নয়। মৃত্যুর চেয়ে সুন্দর আর কি আছে? এই টারকয়েজ স্বচ্ছ জল আর তরল রোদ্দুরে মাথা দোলানো কোরাল রীফগুলো দেখে তোমার মনে হয় না যে ওখানে ওই চিরন্তন জীবন-মৃত্যুর খেলা কি সুন্দর।'
পায়ে ফ্লিপার লাগাতে লাগাতে নীলাদ্রি কথা বলছে, নীলা ওর মুখ চেপে ধরলো।
এখন ওরা রয়েছে মেক্সিকোর উপকূলে পুয়ের্তো ভায়ার্তা শহরে। এখানে ব্যাণ্ডেরাস বে'র নীল জলের মধ্যে কোরাল রীফ আর মিহি পাউডারের মতো সোনালি রঙের বালি। পাহাড় ঘেরা দিগন্তে যখন খুশি ঘনিয়ে আসে কালো মেঘ, আবার এক পশলার শেষেই ঝকঝকে রোদ্দুর আর নারকেল গাছের হাতছানি। ঘনসবুজ রেইন ফরেস্ট ঢাকা পাহাড়গুলো গড়াতে গড়াতে নেমে এসেছে সমুদ্রে। আদ্যিকালের গাছেরা চিত্রবিচিত্র লতার পোষাক গায়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে ইণ্ডয়ানাদের ছোটাছুটি আর অর্কিডের অকারণ উল্লাস। সমুদ্রটা যেন খামখেয়ালি জমিদারের মতো উপকূলের বেশ খানিকটা জায়গা দখল করে বসেছে, সেখানে জলের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এবড়োখেবড়ো ডুবোপাহাড়। অগভীর জলে নানা রঙের প্রবাল পাথর, তার ওপরে তরল রোদ্দুরের আলপনা। মাথা ডোবালেই পৃথিবীর সব কোলাহল হারিয়ে যায়, অসীম আলস্যে হালকা হয়ে ভেসে যায় শরীর, চারপাশে খেলা করে বেড়ায় রঙিন মাছের ঝাঁক, আর সবকিছুর ওপর এক বিরাট ত্রিমাত্রিক পর্দার মতো জড়িয়ে থাকে এক শব্দহীন নীল প্রশান্তি। শুধু সাঁতারটা ভালো জানা দরকার। নীলাদ্রি দেশে থাকতেই ভালো সাঁতার জানতো, এখানে এসে ডাইভিং আর স্নরকেলিং করা শিখেছে। একটা নল লাগানো মুখোস পরে উপুড় সাঁতার দেওয়াকে বলে স্নরকেলিং। মুখ আর চোখ থাকে জলের তলায়, মুখোসের সঙ্গে লাগানো নলটা জেগে থাকে জলের ওপর সেটা দিয়ে দিব্যি নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। নীলা অবশ্য এসব অ্যাডভেঞ্চার আদপেই পছন্দ করেনা, ওর সাংঘাতিক জলে ভয়।
'তুমি সাবধানে নেমো আঁতেল মশাই, আবার কোনো মারমেইডের পিছু পিছু চলে যেওনা যেন। আর তাড়াতাড়ি উঠে আসবে'।
'আমার মৎসকন্যা রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে ডাঙায় ঘর বেঁধেছে। ল্যাজটা বাদ দিয়েছে বোধহয় প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে, ডাইনির ওষুধ খেতে হয়নি। কন্যার জিহ্বাটি বহাল তবিয়তে আছে, দিব্যি চোখা চোখা কথা শোনাতে পারে। ল্যাজের বদলে যা গজিয়েছে সেটাও ভালোই বলা যায়।' নীলাদ্রির হাতটা ওর পিঠ বেয়ে নেমে আসছিল। কোমরের নিচে নামার আগেই ওটার গন্তব্য আঁচ করে ছিটকে সরে গেল নীলা। এই বোটে শুধু ওরা দুজন থাকলে কি ভালোই না হতো। কিন্তু ডেকের ওপরে একগাদা লোক, সবাই স্নরকেলিং করতে এসেছে। নীলা এখনও এই দেশের লোকেদের মতো খুল্লম-খুল্লা ঘনিষ্ঠ হতে পারেনা।
'তাড়াতাড়ি উঠে এসো প্লীজ, আমার ভয় করে। বড্ড রাফ সমুদ্রটা আজকে।'
'সমুদ্র সবসময়ই রাফ ডার্লিং। আমিও রাফ প্লে পছন্দ করি বুঝলে না এখনও' - কথাটা শেষ হতে না হতেই ও জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
এখন ওর চারপাশে সেই অন্তহীন নীল ক্যানভাস। মাছের ঝাঁকগুলো ইচ্ছেমতো ভেসে বেড়াচ্ছে, হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। ওদের পৃথিবীতে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু অবশ্যই আছে কিন্তু দাসত্ব নেই, জীবিকার আবশ্যিক একঘেয়েমি ওদের আচ্ছন্ন করেনা, অস্তিত্বের গহন যন্ত্রণা ওদের তাড়া করে ফেরেনা রাত্রিদিন। 'আমি তোমাদের অবাধ মুক্তির খেলা দেখে মুগ্ধ হই অথচ আঁকড়ে থাকতে চাই আমার নিজের হাতে বানানো জীবনের সোনার খাঁচাটি।' ও মনে মনে বললো, 'আমি ভালোবাসি এই ব্যস্ত শহুরে জীবন, ভালবাসি সাফল্য, সংঘাত, অনুক্রমণ। কেন নীলা বুঝতে চায়না, কেন সে আঁকড়ে থাকতে চায় সারাদিন।' হঠাৎ ওর ইচ্ছে হল বোটে ফিরে যায়, নীলার সাথে আরো অনেকটা সময় কাটায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই ও দেখতে পেল ডানদিকে একটা পাথরের আড়ালে দুটো বিরাট সাইজের স্টিং রে। এদের চেহারা আমাদের দেশের শংকর মাছের মতো, এমনিতে খুব একটা বিপজ্জনক নয় কিন্তু ওদের লম্বা আর ছুঁচলো চাবুকের মতো ল্যাজটাকে সবাই ভয় পায়। ওরা একটু গভীর জলের মাছ, এরকম সাধারণ স্মরকেলিং ট্রিপে স্টিং রে দেখতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। ও সাবধানে মাছদুটোর পিছু নিল। দুপাশ দিয়ে উজ্জ্বল লাল কালো মাছের একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে, ডোবা পাথরটার মাঝখানে একটা গুহা, তার মধ্যে চুনাপাথরের আঁকাবাঁকা দেওয়াল, সেখানে গুচ্ছের পেলিক্যান বাসা বেঁধেছে। ও মাথা তুলে দেখে ঠিক সামনেই একটা ধবধবে সাদা ইয়ট গুহার মুখটাতে ভাসছে। দেখলেই বোঝা যায় কোনো বড়লোকের প্রমোদতরণী, ডেকের ওপর বিকিনি পরা কয়েকটি মেয়ে, তাদের হাতে বিয়ারের বোতল, ওরা জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলছে রুটি আর স্কুইডের টুকরো। খাবারের গন্ধ পেয়েই স্টিং রে দুটো এদিকে এসেছে নির্ঘাৎ। ও মাথা ডুবিয়েই দেখতে পেলো মাছদুটোর সাবলীল গতি, ওরা গুহার ভেতরদিকটায় ঢুকেছে। এবার ফিরে যাওয়া উচিৎ কিন্তু অনেকটা ঘুরতে হবে, সোজা রাস্তাটা আটকে কোথা থেকে এই হতচ্ছাড়া ইয়ট এসে জুটলো।
ঠিক সেই মুহূর্তেই নড়ে উঠলো বিরাট নৌকাটা, ওরা এঞ্জিন চালু করেছে। ঢেউয়ের দোলায় এক ঝলক নোনা জল ঢুকে পড়লো ওর টিউবে। গিলে ফেলা ছাড়া উপায় নেই, ওর পেটটা গুলিয়ে উঠলো একটু। হঠাৎ কোত্থেকে একদম ঘাড়ের ওপর এসে পড়লো স্টিং রে, বুকের ওপরে একটা তীক্ষ্ণ কিছু ফুটে গেল যেন, অবশ হয়ে উঠলো হাত পা। আরেকবার জোরে দুলে উঠলো ইয়টটা, ঢেউয়ের ঝাপটায় আবার ওর মুখোশে জল ঢুকে গেল, এবার সোজা ফুসফুসে। বুকে অসহ্য ব্যথা, তার সঙ্গে কাশির দমকে আরো জল ঢুকে যাচ্ছে। ওকে হাবুডুবু খেতে দেখে ইয়ট থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে কেউ একজন। লোকটা ওকে পিঠের দিক থেকে ঠেলে ধরেছে, চিৎকার করে কি একটা বলছে স্প্যানিশ ভাষায়। চরম আতঙ্কে নীলের মাথা ঠিক নেই, ও প্রাণপনে চেপে ধরেছে লোকটার কাঁধ, গলা আর হাত। এবার দুজনেই জাপটাজাপটি করে তলিয়ে যাচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসার আগে ও বুঝতে পারলো পিঠ থেকে লোকটার হাত সরে গেছে, ওর মাথার চুল ধরে টানছে কে যেন কিন্তু নিজের হাত পা আর নড়ছে না। চারপাশে সেই গভীর নীল পর্দা, তার ওপর ঠিক সিনেমার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের ঝাঁক। স্টিং রে দুটো রাজকীয় ভঙ্গিতে একবার ওর চারদিকে পাক খেয়ে গেল। এখন আর একটুও কষ্ট হচ্ছেনা বরং অসীম আরামে বন্ধ হয়ে আসছে দুচোখ।
ও যখন চোখ মেলে তাকালো নীল পর্দাটা তখন মাথার ওপরে উঠে গেছে, মাছের ঝাঁক উধাও, তার বদলে ভেসে বেড়াচ্ছে দু এক টুকরো সাদা পালকের মতো মেঘ। ও বুঝলো যে চিৎ হয়ে বালির ওপর শুয়ে আছে, মাথার ওপর পরিষ্কার রোদ্দুরে ভরা আকাশ। পায়ের কাছে ছোট ছোট ঢেউ ভাঙছে, একটু দূরে একসারি নারকেল গাছ। ওর পাশে শুয়ে অচেনা আরেকটা মানুষের শরীর।
'আমার কি হয়েছিল?' মনে মনে ও ভাবার চেষ্টা করলো। শরীরটা অসম্ভব দুর্বল লাগছে, মাথার ভেতররটা একেবারে ফাঁকা। বীচের ওপরে লোক জড়ো হতে শুরু করেছে, হঠাৎ একটা শোরগোল শোনা গেল। ওই তো একদল লোক ওর দিকেই ছুটে আসছে। ও চেঁচিয়ে উঠতে চাইলো প্লীজ হেল্প! নিজের গলার আওয়াজ নিজেরই অচেনা ঠেকছে, সে কি তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবার জন্যই? শরীরের সব শক্তি জড়ো করে ও উঠে দাঁড়াতে চাইলো কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুচোখের সামনে অন্ধকার। ও বুঝতে পারলো লোকগুলো এসে পড়েছে, কেউ একজন ওকে ধরে ফেললো। উত্তেজিত গলার কথা, হাসির আওয়াজ, খুশি আর বিস্ময়ে মেশানো একটা মিলিত কোলাহল ওর অর্ধচেতনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জ্ঞান হারাবার আগে ওর মনে হল ওর মাথাটা কেউ যেন কোলে নিয়ে বসেছে, অদ্ভুত অচেনা তার শরীরের গন্ধ।
কাল সকালে খুব বাঁচান বেঁচে গেছি। বিদেশি লোকটা নিজে তো ডুবতোই, সঙ্গে আমাকেও মারছিল প্রায়। বাবুদের গভীর সমুদ্রে সাঁতার কাটার শখ, ওদিকে এক ঢোঁক জল খেলেই চোখ উলটে আসে। মা মেরির দয়ায় লোকটা বেঁচে গেছে কিন্তু সেই থেকে আমার জীবনটাও বদলে গেছে কিরকম যেন। সত্যি কথা বলতে কি আমি যেন নিজেকেই চিনতে পারছি না।
আমার নাম আলবার্তো, আমি একজন মেক্সিকান জেলে। আমাদের গ্রামে একসময় প্রায় সবাই জেলে ছিল। এখন অনেকেই শহরে চলে গেছে তারা কাজ করে রিসর্টে, হোটেলে, ট্যুর কোম্পানিতে, যেখানে সারাবছর আমেরিকান ট্যুরিস্টের ভিড়। গ্রামের মাঝখানে তারা পাকা বাড়িগুলো বানিয়েছে, তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। আমি লেখাপড়া বিশেষ শিখিনি, আমার পুরো জীবনটা জুড়ে মেক্সিকোর এই পাথুরে সমুদ্রতীর, রোদ্দুরে পোড়া বালি, মাছের গন্ধ মেশানো নোনা হাওয়া, অতলান্ত নীল জল আর মাথার ওপরে ইন্দ্রনীল আকাশ। ট্যুরিস্টরা এদিকে আসে না, একটু দূরেই নামকরা রিসর্ট শহর পুয়ের্তো ভায়ার্তা, সেখানে বীচের ওপর সাদা বালি, রংবেরঙের পালতোলা নৌকা, কাবানায় সূর্যস্নান আর স্বচ্ছল ছুটির মেজাজ। আমার সম্পত্তি বলতে একটা ক্ষুদে বোট আছে, সেটার ফুটো সারাই করতে করতে আমার সকালটা যায়। দুপুরে অভ্যাসমতো মাছ ধরতে যাই। বাবার কাছে শুনেছি একসময় এখানে মাহি মাহি, গ্রুপার আর রেড স্ন্যাপার মাছেরা ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়াতো, জাল ফেলতে না ফেলতেই উঠে আসতো রাশি রাশি রুপোলি সমুদ্রের ফসল। এখন ক্যালিফোর্নিয়ার ফিশিং কোম্পানিগুলো মস্ত মস্ত ট্রলার নিয়ে এসে মাঝসমুদ্রে সব মাছ ঝেঁটিয়ে তুলে নেয়, আমাদের ভাগ্যে জোটে চুনোপুঁটি। বিকেল শেষ হলে ব্যাণ্ডেরাস বে'র জলে যখন লাল আর কমলা, রঙের মায়াবী ঢেউ খেলে যায়, দূরে শহরের সারি সারি হোটেল, ক্যাসিনো রাত্রির সাজে সেজে ওঠে, পাহাড়ের ওপরে লাইটহাউসের আলো সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে ঘুরপাক খায়, আমিও বাজার থেকে শ'খানেক পেসো পকেটে পুরে আমার কেবিনের দিকে রওনা হই। আমার সারাদিনের পরিশ্রমের দাম, একটা পেট তাতে কোনোরকমে চলে যায়। ভেবেছিলাম জীবনটা এভাবেই আলসেমি করে কাটিয়ে দেবো কিন্তু কাল রাত্তিরে সোফিয়া সব হিসাব গুলিয়ে দিয়েছে।
সোফিয়া আমার ছোটোবেলার বান্ধবী। চিরকালের অবাধ্য আর বেপরোয়া মেয়েটা এখন এই গ্রামের মক্ষিরাণী। প্রথমে জোর করে বাড়ির অমতে চাকরি নিল একটা রেস্টুরেন্টে, তারপর কোন এক আমেরিকান হোটেল ম্যানেজারের নজরে পড়ে গিয়ে একদম প্রজাপতির মতো ডানা মেলে দিয়েছে। এখন হিলটনে কাজ করে, মুখে ফটাফট ইংরাজি, সবসময় বেশ সাজগোজ করে থাকে। ওর কাজ ট্যুরিস্টদের সাথে ভাব জমিয়ে রিসর্টের টাইমশেয়ার বিক্রি করা। এই টাইমশেয়ার এক নতুন ফ্যাশন হয়েছে। আমেরিকা, ক্যানাডার লোকেরা শীতকালে থাকার জন্য রিসর্টে কয়েক সপ্তাহের সময় কিনে রাখে। এইসব শাঁসালো খদ্দের পাকড়ানোর জন্য মেক্সিকোর এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল, শপিংমল থেকে রাস্তার মোড় অবধি একদল পরিপাটি চেহারার ছেলেমেয়ে চব্বিশঘন্টা ওঁত পেতে আছে। মুখে হাসি, হাতে চটকদার সব প্যাম্ফলেট, ট্যুরিস্টদের তারা নানারকম অফার দেয়, কোনমতে মুরগি করতে পারলেই মোটা কমিশন। এইসব ছেলেমেয়েরা সাধারণত ভিটের মায়া কাটিয়ে শহরেই পাকাপাকি আস্তানা গাড়ে, এই মেয়েটা কিন্তু গ্রামেই থেকে গেছে। নাঃ আমি কিছু বলিনি, আমার কোনো অবাস্তব দাবিও ছিলনা। ও যখন আঁটসাঁট পোষাকে পালিশ করা চুল উড়িয়ে বাসস্টপের দিকে চলে যায়, আমি তখন আমার জলের ধারে এই পুরনো কেবিনটায় বসে হাই তুলি। দেখাই যাচ্ছে এ মেয়ে জেলের বৌ হবার জন্য জন্মায়নি। গ্রামের চালাকচতুর ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই তো চলে গেছে। যাদের সাহস বেশি তারা বর্ডার পার হয়ে আমেরিকায় নয়তো মেক্সিকো সিটিতে ড্রাগ মাফিয়াদের দঙ্গলে। বর্ডার এখন জমজমাট জায়গা, সেখানে অনেক কলকারাখানা, আমেরিকান কম্পানিগুলো ওখানে হরেক মাল সস্তায় বানায়, মাফিয়ারা ক্র্যাক কোকেন, গাঁজা আর অল্পবয়সী মেয়ে চালান দিতে ব্যস্ত থাকে। রোজই খুনোখুনি লেগে আছে, রাত মানেই গুলির শব্দ, সকাল হলেই দেখা যায় জোয়ান ছেলেগুলোর লাশ পড়ে আছে বর্ডারের আশেপাশে, কখনো নর্দমায়, খোলা মাঠে বা আবর্জনায় গাদায়। এদিকে সমুদ্রের ধারে ধারে ঝলমলে মেক্সিকান রিভিয়েরা, সেখানে কাঁচা টাকার স্রোত বইছে, সোনালি বালিতে গা এলিয়ে সাদা মানুষেরা সারাদিন শুষে নিচ্ছে ট্রপিক্যাল সূর্যের পর্যাপ্ত উত্তাপ। সেইসব রিভিয়েরার থেকে কিছুটা দূরে যেখানে সবুজ পাহাড় আর এবড়োখেবড়ো তটরেখা, সেইখানে নারকেল গাছ আর ভাঙা কবলস্টোনের রাস্তার ধারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে আদ্যিকালের পুরনো স্প্যানিশ চার্চ, সেইখানে কোনমতে টিকে ছিলাম আমরা কেউ কেউ। আমাদের ছিল সদ্য চোলাই করা টেকিলা মদ, গরম হাতরুটি, টমেটো, পেঁয়াজ আর লঙ্কা দিয়ে বানানো সালসা আর পুরনো মেক্সিকোর গা ছমছমে গল্প। আমাদের ছিল যখনতখন পাহাড়ের গায়ে ঘনিয়ে ওঠা কালো মেঘ, নৌকায় শুয়ে দোল-খাওয়া সারারাত। ওই নৌকায় সোফিয়া যেদিন প্রথমবার নারী হয়ে উঠেছিল, আমাদের বয়েস তখনো ষোল পেরিয়েছে কিনা সন্দেহ। সেই রাত্তিরে চাঁদ এসে দাঁড়িয়েছিল বেলাভূমির নির্জনতায়, চুপচাপ একটা নারকেলগাছের গায়ে ঠেস দিয়ে। আমরা দুজনে একটার পর একটা দরজা খুলছিলাম আর ছায়াপথের সব তারাগুলো ছুটে আসছিল আমাদের দিকে। কিন্তু সে তো অনেকদিন আগের কথা। কালকের সন্ধেটা তাই আমার এখনো অবাস্তব লাগে।
কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি আমার মলিন অগোছালো বাইরের ঘরটা যেন ভোজবাজির মতো পালটে গেছে। ছড়ানো জামাপ্যান্টগুলো পরিপাটি ভাঁজ করা আলনায় ঝোলানো, বিয়ারের খালি ক্যানগুলো উধাও, রান্নার জায়গাটা পরিষ্কার, ভাঙা টেবিলটার ওপর একটা সুন্দর চাদর পাতা, সেখানে টাটকা ফুল, ওয়াইনের বোতল আর মোমবাতি। সোফিয়া ওর কালো চুল উঁচু করে বেঁধেছে, মোমবাতির আলোয় ঝিকমিক করছে ওর যত্নে সাজানো ব্রাউন রঙের চোখ, আলো পিছলে যাচ্ছে ওর খোলা কাঁধের ওপর থেকে মসৃণ বাহুমূলে। আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো, সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল অবাধ্য উত্তেজনার শিরশিরে ঢেউ।
'হ্যালো আল, তুমি তো এখন গ্রামের হিরো, আমাকে চিনতে পারছোনা বুঝি? আমি কিন্তু অনেকক্ষণ বসে আছি। আরে এমন ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো তাকিয়ে আছো কেন? আজকে আমার জন্মদিন, উইশ করবে না?'
'কিন্তু তুমি তো উইকএণ্ডে শহরে থাকবে জানতাম।' আমি আমতা আমতা করছি।
'তাই বুঝি সকালে আমার পোস্টবক্সের তলায় প্যাকেটটা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলে।'
'না ভেবেছিলাম—'
'ভেবেছিলে আমি পাত্তাও দেবোনা, হয়তো খুলেও দেখবোনা। তাইতো?'
'মানে তুমি তো হোটেলের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। দেখো দেখি শুধু শুধু এতটা সময় নষ্ট করলে। আমার ঘরটা এতো নোংরা থাকে আজকাল।'
'এটাই তোমার বিরাট মুশকিল আল, তুমি চাইতে জানোনা। আমরা যে দুনিয়ায় বাস করি সেখানে চাহিদাই ঈশ্বর। রোজ যে সাদা চামড়ার লোকগুলোর সঙ্গে সময় কাটাই তারা সবাই চব্বিশ ঘন্টাই কিছু না কিছু চাইছে, ওটাই ওদের মৌলিক ক্ষমতা, তাই দিয়েই দুনিয়াটাকে ওরা গোলাম বানিয়ে রেখেছে। আর তুমি? আমিও উড়তে শিখলাম তুমিও এই শামুকগুলোর মতো খোলার মধ্যে গুটিয়ে গেলে।' সোফি গলার মালাটা তুলে ধরলো। প্রবাল আর সাদা শঙ্খের মালা, ওটাই আজ সকালে ওর বাড়িতে রেখে এসেছিলাম।
'বোকা ছেলে। এই দেখো বসের পার্টি থেকে পালিয়ে তোমার সঙ্গে জন্মদিন কাটাতে এসেছি।' বলতে বলতে ওর শরীরটা মোমবাতির ছায়ার মতো আমার গায়ের সঙ্গে মিশে গেল। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
'আল তুমি কেন ওদের মতো হলে না? কেন তোমার একটুও উচ্চাশা নেই? এই আধমরা গ্রামটায় কি পেয়েছো তুমি? তুমি একটু অ্যামবিশাস হলে আমাকে এইওসব বিচ্ছিরি কাজ করতে দিতেনা। আমি তো বেশি কিছু চাই না, শহরে একটা ফ্ল্যাট আর দুজনে মিলে একটা ছোটো ব্যবসা। শুধু তো আমেরিকানরা নয়, এশিয়ার লোকেরাও আজকাল দেখি দলে দলে বেড়াতে আসে, জমিয়ে ফুর্তি করে। পৃথিবীর সবাই তো একটা সুস্থ সচ্ছল জীবন চায়, আমরাই বা কেন সারাজীবন অন্যের চাকর হয়ে থাকবো?
ওর নরম শরীরটা থেকে কমলালেবুর খোসার মতো অনায়াসে খসে পড়ছে ইভনিং গাউন আর হালকা জালের মতো অন্তর্বাস। আমি টের পেলাম আমার মাথার মধ্যে উদ্দাম কামনার একটা ঝড় উঠেছে। শুধু সোফিয়াকে নয়, আমার বাকি সবকিছুও চাই। চাই অর্থ, প্রতিপত্তি, উজ্জ্বল নীল আর সাদা রঙের বীচ বাংলো, শ্যামপেন, ইয়ট, ক্যাসিনো আর গলফ, চাই ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাইভেট স্কুল আর ভায়োলিন ক্লাস। এগুলো সবই যে আমার প্রাপ্য, এতদিন সেটা বেমালুম ভুলে ছিলাম। আমার আত্মবিশ্বাস যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।
একি! অফিস নেই তোমার, সকালবেলা পাজামা পরে ফটো তুলতে বসেছে? শরীর খারাপ নাকি আবার? নীলা চিন্তিত গলায় বলল। ছুটিতে ওই কাণ্ড হবার পর একটা অহেতুক আতঙ্ক ওকে তাড়া করে ফেরে।
'আরে না না, আজকে এমনিই একদিন ছুটি নিয়েছি বুঝলে।' নীলাদ্রি খোশমেজাজে বললো, 'দেখোনা, রাস্তার ওধারে চেরিগাছগুলো কেমন পাগলের মতো ফুল ফুটিয়ে চলেছে। হাওয়ায় উড়তে উড়তে ঘাসের বিছানায় আলগোছে শুয়ে পড়ছে সাদা পাপড়িগুলো। আর তো একটা সপ্তাহ তারপরেই একদিনের বৃষ্টিতে সব ফুল ঝরে যাবে। তাই ভাবলাম ওদের সাথে একটু সময় কাটাই।'
'দাঁড়ান দাঁড়ান আগে একটা কথা বলুন দেখি। আপনি কে এবং আমার বরটাকে আপনি কি করেছেন?'
'আরে তুমিই না বলতে আমি সকাল থেকে রাত অবধি ছুটছি, নো টাইম টু স্ট্যাণ্ড অ্যাণ্ড স্টেয়ার।'
'তা বলতাম বটে কিন্তু তাই বলে এমনি এমনি অফিস পালানো। চাকরি গেলে কি হবে শুনি?'
'কি আর হবে। তোমার তো চাকরি আছেই, চলে যাবে এখন। নয়তো দেশে ফিরে যাবো। এই আমেরিকান সমাজে থাকা মানে তো একটা বিরাট জুয়ার আড্ডায় বসে থাকা। হারজিতের বাইরে যে একটা জীবন আছে সেটা এরা মানতেই চায়না।'
এ তো ভূতের মুখে রামনামের চেয়েও অবিশ্বাস্য! নীলার মুখে আর কথা ফুটলো না, ও গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো। ঠিক করেছিল আজ সকালেই খবরটা দেবে কিন্তু এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে না। আসলে ওর চাকরিটা সামনের মাস থেকে আর নেই অবশ্য এই বাজারে সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়। নিজের চাকরিটাকে ও কখনোই খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, নীলাদ্রি একাই যথেষ্ট রোজগার করে, ওর মাইনে আর বোনাস দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। অফিস থেকে ফিরে ও গভীর রাত অবধি কম্পিউটারে কনফারেন্স চালিয়ে যায় বেঙ্গালুরু থেকে বেইজিং, তারপর বসে পড়ে শেয়ারের পোর্টফোলিও নিয়ে। ছুটির দিনে সকালে কলিগদের সঙ্গে গলফ, সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে মদ্যপান। বিয়ের পর পাঁচ বছর প্রায় হতে চলল, তখনো বাচ্চাকাচ্চার কথা বললে আঁতকে উঠতো - 'আরে দাঁড়াও কেরিয়ারটা আগে গুছিয়ে নি'। সেই লোক এখন চেরিফুলের ছবি তোলার জন্য ছুটি নিয়েছে? নীলা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পেল না। নীলাদ্রি কেমন যেন বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে আজকাল। গত উইকএণ্ড ওরা কাটিয়েছে একটা লেক কেবিনে, ওর নাকি মাছ ধরার শখ হয়েছিল। নির্জন জেটির ওপর, রডোডেনড্রন ঝোপের আড়ালে ছিপ ফেলে ওরা বসেছিল অনেকগুলো ঘন্টা, গল্প করার ফাঁকে ফাঁকে নীলা পড়ছিল ঝুম্পা লাহিড়ীর বই 'আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ'। রাত্রে মাছভাজা করে খাইয়েছিল নীল, তারপর বাইরের ঘরে সোফার ওপরেই দুজনে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। এটাও নীলার কাছে অভাবিত কারণ প্রেমিক হিসাবে নীলাদ্রি বেশ একটু বোরিং। নমো নমো করে বড়জোর দু'মিনিটের ফ্লোরপ্লে, তারপরেই ও সোজা আসল কাজে নেমে পড়ে। নীলার শরীর সাড়া দিতে না দিতেই খেলাটা শেষ হয়ে যায়। সেদিন সোফার ওপর নীলার মনে হচ্ছিল ও যেন এক অচেনা পুরুষের সাথে রমণ করছে যে এক ঝটকায় উলটে দিতে পারে আদরের সব পুরনো নিয়মকানুন। আরেকটা ব্যাপারেও ও ভয়ে ভয়ে আছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আগে যতটাই সাবধানী ছিল নীলাদ্রি, এখন ততটাই বেপরোয়া। সেদিন ও নিজেই কথাটা তুলেছিল।
'তোমার আজকাল খুব ইয়ে বেড়েছে দেখছি, এরপর একটা অঘটন ঘটে গেলে আমায় দোষ দিয়োনা কিন্তু।'
'কি অঘটন?' নীল যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানেনা।
'ন্যাকা। এ মাসে আমার পিরিয়ড হয়নি এখনো।'
'তাই নাকি' নীল একলাফে উঠে জামা গলিয়ে ফেলল, 'যাই তাহলে একটা প্রেগনেনসি টেস্ট কিট কিনে আনি। এ তো খুব ভালো খবর, অঘটন কেন বলছো?'
'নীল!'
'কি হলো? আরে এই তো ঠিক সময়। দাঁড়াও আগে কনফার্ম করি তারপর সেলিব্রেট করবো।' নীল রীতিমতো উত্তেজিত।
'মনে আছে গতবার যখন আমার এইরকম দেরি হচ্ছিল, তুমি চিন্তিত গলায় বলেছিলে পজিটিভ হলে টার্মিনেট করার কথা ভাবতে হবে। আমি সারারাত ঘুমোতে পারিনি, কপাল ভালো পরেরদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে ওটা কিছু নয়। সেই তুমি—'
'তখন বোকা ছিলাম নীলি। আচ্ছা তাড়াহুড়ো করবো না, কদিন আগে যাক।' নীল হেঁড়ে গলায় একটা গান ধরলো - গোপন কথাটি রবে না গোপনে।
নীলা ভেবে পায়না ও আজকাল এতো আজেবাজে চিন্তা করে কেন। নীলাদ্রি এখন কাজ নিয়ে বাড়াবাড়ি করেনা, ওকে যথেষ্ট সময় দেয়, সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে আগ্রহ দেখায়। ওর সেই জেদি, আত্মকেন্দ্রিক স্বভাবটা আমূল বদলে গেছে। নীলার এসব কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে। আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ।
'আল, সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, কখন আসছো?'
'সরি ডার্লিং, আমার এখনো কিছুটা সময় লাগবে, খুব টেঁটিয়া ক্লায়েন্ট'।
'আজ আমাদের বিয়ের তারিখ আল। আজকেই তোমায় যেতে হল?' সোফিয়ার গলায় অভিমান।
'প্লীজ সোফি, আমি একটু পরে কথা বলছি।' আমি ফোনটা ছেড়ে দিলাম। আরেকটু দর কষাকষি করলেই এরা টোপ গিলবে। মালদার পার্টি জাপান থেকে একটা বড়ো গ্রুপ নিয়ে আসছে। এই ট্যুর কোম্পানিটা আমার নিজের হাতে বানানো। মাঝে মাঝে অবাক লাগে ভেবে যে এই আমিই জীবনের এতগুলো বছর নির্বিকল্প আলসেমি করে কাটিয়েছি। এখন আমার চব্বিশ ঘন্টাটা খুব কম সময় মনে হয়। মেক্সিকোতে এলেম থাকলে পয়সা কামানোর অনেক সুযোগ আছে কিন্তু রাস্তাটা পরিষ্কার নয়। ড্রাগ কার্টেলগুলোকে নিয়মিত তোলা দিতে হয় আর সরকারি অফিসারদের ঘুষ। আমি ধান্দায় আছে ফ্লোরিডার একটা কোম্পানির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবো তারপর পাকাপাকিভাবে পাড়ি দেবো আমেরিকায়। সোফি সারাদিন বাচ্চা বাচ্চা করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে কিন্তু আমার সোজা কথা - বাচ্চা হবে তো আমেরিকার মাটিতে। আমি সমুদ্রের ধারে ভাঙা কেবিনে জন্মানো আনপড় মেক্সিকান জেলে কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা হবে মাথা উঁচু সুশিক্ষিত আমেরিকান, তাদের সামনে খোলা থাকবে সারা পৃথিবীর দরজা। শুধু আরেকটু ধৈর্য্, কৌশল আর খাটনি। সোফি আমাকে উৎসাহ না দিলে আমি হয়তো ওই বোটে শুয়েই জীবন কাটিয়ে দিতাম কিন্তু আমার ভেতরকার বাঘ এখন রক্তের স্বাদ পেয়েছে। এখন কারো সাধ্য নেই আমাকে থামায় শুধু মাঝে মাঝে ধন্দ লাগে যে বাঘটা আচমকা এলো কোথা থেকে আর এতদিন ছিলই বা কোথায়? এখন অবশ্য ওসব ভাবার সময় নেই এখন সোফির মান ভাঙাতে হবে।
'আল তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।।'
'বলো না ডার্লিং। রাগ করেছো? দেখো এই কন্ট্রাক্টটা খুব জরুরী, আমরা আমেরিকা যাচ্ছি বুঝলে আমেরিকা! দেখো যা করছি তো আমাদের দুজনের জন্যই করছি তাইনা। কাম অন বেবি।
'আল আমি প্রেগন্যান্ট। তুমি আমার কথাগুলো শুনবে একটু?'
'ও মাই গড, এখনই? আমি তোমাকে বলেছিলাম না অপেক্ষা করতে!'
'আমার বয়েস হচ্ছে আল, আমি একটা বড়ো পরিবার চাই। তুমিও তো তাই চাইতে। কবে এরকম বদলে গেলে আল, আজকাল আমি তোমাকে চিনতে পারিনা। সারাদিন খালি কাজ, টাকা আর আমেরিকা যাওয়ার প্ল্যান। আমি কোথাও যেতে চাইনা আল, আমাদের সন্তান হোক মেক্সিকান, ও নিঃশ্বাস নিক সমুদ্রের হাওয়ায়, দুচোখ মেলে দেখুক পাহাড়ের গায়ে রেইন ফরেস্ট, ওর পায়ের তলায় থাকুক আমাদের পূর্বপুরুষদের নিজের হাতে চাষ করা মাটি। আমেরিকার একটা অজানা শহরে গিয়ে আমরা ওকে কি দিতে পারবো আল?'
একটা অসহ্য রাগ আমার মাথার ভিতর ঘুলিয়ে উঠলো। এই মেয়েটা আমাকে শহরে এনেছে। যখন আমি কেবিনে বসে ফুটো জাল সারাই করতাম সেই সময় ও এই হোটেলগুলোতে কতজনের সঙ্গে শুয়েছিল যীশুই জানেন। এখন আমাকে লেকচার দিতে এসেছে। আমেরিকা কি দিতে পারে? দিতে পারে সভ্য, নিরাপদ, নিয়মবদ্ধ জীবন আর ওপরে ওঠার অন্তহীন সম্ভাবনা। আর এখানে — খুনোখুনি, দুর্নীতি, দারিদ্র, অপদার্থতা আর স্বজনপোষণ। কোন দুঃখে এখানে থাকতে যাবো?
'রাগ করলে আল? আসলে আমি বড্ড একা হয়ে গেছি জানো। তুমি সারাদিন কাজে কাজে থাকো, একটা বাচ্চা থাকলে ভালোই হবে দেখো।'
'তুমি আমার সব প্ল্যান বানচাল করে দিলে সোফি। কিন্তু একটা কথা জেনে রাখো আমেরিকায় আমি যাবোই।'
'নীল তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে! দেশে ফিরে যাবে মানে? দেশে কি আছে আমাদের? আমাদের বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবেছো? নীল আমার চাকরি নেই, তুমিও কাজ ছেড়ে দিলে বাড়ির মর্টগেজ দিতে পারবে না সেটা খেয়াল আছে তোমার?'
'এতোবড় বাড়ি দিয়ে কি করবে নীলি? তিনটে মানুষের জন্য ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট হলেই চলে যায়। তাছাড়া দেশে তো নতুন কাজ নিয়েই যাচ্ছি।' নীলাদ্রি খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বললো, কিন্তু নীলা গলার শির তুলে চেঁচাচ্ছে।
'তোমার না কম্পানির রিজিওন্যাল ডাইরেক্টর হবার কথা ছিল? তার সঙ্গে দেশের একটা কলেজের চাকরির তুলনা? লোকে বলবে আমেরিকায় থেকে ছাঁটাই হয়ে দেশে ফিরে এসেছে।'
'তা যার যা খুশি বলুক। আমার এখানে ভালো লাগছে না নীলি। দেখো আমাদের দুজনেরই বাবা-মা আছেন, তাদের বয়েস হয়েছে, শরীর অসুস্থ। দেখবে কলকাতায় আমরা খুব ভালো থাকবো, আমাদের বাচ্চারা বাংলায় কথা বলবে, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবে। তুমিও তো তাই চাইতে। তুমি বলতে না যে আমি যেমন দিনরাত্তির কাজ নিয়ে থাকি, ছেলেমেয়ে না হওয়াই ভালো কেননা তারা বাবাকে চিনতেও পারবেনা।
নীলার খেই হারিয়ে যাচ্ছে। এই বয়সে আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করা? এই আমেরিকান সাবারবান্ জীবন, হাত বাড়ালেই সবকিছু হাজির, চমৎকার স্কুল, প্রবাসী বাঙালিসমাজের সুলভ সংস্কৃতিচর্চা - এসবই বড্ড অভ্যস্ত, আরামদায়ক। এসব ছেড়ে ভরসাহীন এক অজানা ভবিষ্যতের কথা ভাবলেই ওর মনটা ভয়ে শিঁটিয়ে যাচ্ছে। অথচ ও নিজেই তো এই সেদিন সব ছেড়েছুড়ে কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ভাবতো। ঠিক করেছিল বাড়ি থেকে নীলকে একটা ফোন করবে - 'আমি হঠাৎ করে কলকাতা চলে এসেছি, তুমি যদি দেখা করতে চাও, বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সেই ধাবাটার সামনে সন্ধ্যা ছটার সময় চলে এস। দেরি করলে রাগ করবো কিন্তু'। কিন্তু সে সব তো রোম্যান্টিক কল্পনাবিলাস, তাই বলে সত্যি সত্যি এই সময় আবার পুরো পরিস্থিতি বদল করার ঝক্কি নেওয়া সহজ কথা নাকি। নীলার সব গুলিয়ে যাচ্ছে, সামনের মানুষটা কিন্তু নির্বিকার।
'দেখো তুমি প্রোগ্রামার হিসাবে ভালো কাজ পেয়ে যাবে ওখানে। আমি ভাবছি কি জানো। বাংলায় লেখালেখি শুরু করবো আবার। সেই কলেজের পর বাংলায় একটা অক্ষরও লিখিনি, অথচ মনে আছে তুমি আমার চিঠি নিয়ে কি কাণ্ড করেছিলে?'
সব মনে আছে নীলার। ওর বন্ধুদের মুখস্ত হয়ে গেছিল সেই চিঠি।
'তখন আমি অন্যরকম ছিলাম নীল, আমার পৃথিবীটাও অন্যরকম ছিল। আমি তো তোমার জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি এখন, আর্থিক নিরাপত্তায় আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। আবার আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেবে তুমি?'
পসাইডন তাঁর ত্রিশূলটা ডুবোপাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে একটা বিরাট হাই তুললেন। ডুবন্ত মানুষদের নিয়ে নানারকম বদ রসিকতা করা ওঁর বহুকালের অভ্যেস, দাদা জীউস অনেক বকাবকি করেও ছাড়াতে পারেননি। উনি বুঝতে পারেন না মানুষ কেন অসহ্য কষ্ট সহ্য করেও সমুদ্রে পাড়ি দিতে চায়। নোনাজল, হালভাঙা নৌকা, সাইরেনের ডাক আর নীল মৃত্যুর চোরাস্রোত তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না। আবার সেই মানুষগুলোই কেন সাগরপারের রাজপ্রাসাদে, রাজকন্যার বিছানায় শুয়ে স্বপ্নে দেখে তার গ্রামের বাড়ির উঠোন, কেন নতুন পৃথিবীর হাজার সুগন্ধের মধ্যেও সে খুঁজতে থাকে চেনা মাটি আর চেনা শরীরের সুবাস। ইথাকার সেই ঘাড় বেঁকা ওডিসিউস শেষ অবধি তাঁকে হারিয়ে দিয়েছিল, ফিরে গেছিল যেখানে তার পুরনো চারণভূমি আর অলিভ গাছের ছায়া। উনি তো ভালো ভেবেই এই লোকদুটোর আত্মা বদল করে দিয়েছিলেন, এবার যে যার নিজের জায়গায়, নিজের সংসার পেতে সুখে থাক। তার বদলে যত্ত অশান্তি, আবার এরা অচেনা সমুদ্রে পাড়ি জমাতে চায়। মাছেদের রাজত্বে এইসব ঝামেলা নেই, সেখানে সব নিয়মে চলে। ঘর ভাঙা আর ঘরে ফেরার বিপ্রতীপ বাসনা শুধু এই দোপেয়ে জীবনগুলোরই মজ্জাগত। তাদের দুর্বল হৃদয়ে কেন রাখা আছে শিকড়ের টান আর ঢেউয়ের হাতছানি, কেন সেখানে দিনরাত এক আজব আয়নায় উলটো প্রতিফলন, দেবতা হয়েও তা তাঁর বোঝার ক্ষমতা নেই।