লোকটার নামটা যে কি সেটা ঠিক জানা নেই। কিন্তু ওকে দেখলে পরে দুম করে একটা নাম মাথায় আসে। উপেন। ঢালু কপাল, মাথার সামনের দিকের চুল পড়ে যাওয়ায় তা খুব চওড়া, ঘামের ফোঁটাগুলো সেখানে চকচক করে। গালের হাড় উঁচু হওয়ায় চোখ কিছুটা কোটরে বসা, ছুঁচলো নাক, মুখের এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া হাসি। উপেন নামটা একেবারে লাগসই।
রাস্তাটা শহরের একেবারে হৃদপিণ্ডের কাছাকাছি। অফিস কাছারির সময় প্রচণ্ড ব্যস্ত। দুদিকে অনেকগুলো ব্যাঙ্ক, উঁচু উঁচু আধুনিক ছিমছাম বাড়ির তলায় তলায় সব অফিস, দামী দামী সব দোকান। এ রাস্তায় ঠেলা, রিকশা এ সব বারণ। রাস্তার দু পাশে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো — তার ভেতর যেটুকু রাস্তা পাওয়া যায় তাতেই যথেষ্ট বেগে সব গাড়ি চলে।
উপেনের বাহন কিন্তু ব্যতিক্রম। প্রতিবন্ধীদের জন্যে বিশেষ ধরনের তৈরি একটা তিন চাকার সাইকেল। পেছনের সীটের সঙ্গে লাগানো দুটো খাপে দাঁড় করিয়ে রাখা দুটো ক্রাচ। উপেন তার সীটে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থাকে আর ওর সামনের একটা চেন লাগানো চাকার পেডাল দু হাতে ঘুরিয়ে সাইকেল চালায়। রাস্তাটায় ওর ইচ্ছেমতো এবং দরকারমতো পাক খায় উপেন — কখনো রাস্তার পাশে ফুটপাথ দিয়ে, কখনো গাড়ির রাস্তা দিয়ে। গাড়িগুলো ওর সাইকেলকে সমীহ করে চলে — সামনে দেখলে গতি কমায়।
উপেনের দুটো পা হাঁটুর নিচ থেকে অস্বাভাবিক রকম সরু। ওকে বাচ্চা বয়সে পোলিওর ওষুধ খাওয়ানো হয় নি। খাওয়ানো তো দূরের কথা — ও যখন শিশু তখন ওর চোদ্দ গুষ্টিতে কেউ পোলিও রোগ বা তার ওষুধের কথা শুনেছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এখন যে রকম সাবলীল ভাবে উপেন তার বাহনকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাতে মনে হয় না ও খুব অসুবিধের মধ্যে আছে। ও নিজের সাইকেলের সীটে সোজা হয়ে বসে থাকে — যতক্ষণ রাস্তায় থাকে ততক্ষণ সেখান থেকে নামে না। এই শারীরিক অভ্যেসটা ও নিজেই রপ্ত করেছে — ওকে এর জন্যে কোনো নামজাদা গুরুর কাছে গিয়ে যোগব্যায়াম শিখতে হয় নি।
এখন সকালবেলা। রোদ সবে একটু একটু চড়া হতে শুরু করেছে। সাইকেল এবং উপেন, এই সমষ্টিটাও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। একটু এগোতেই উপেনের সাইকেলের দিকে ছুটে আসে দুটো প্রাণী। কেলো আর ভুলি। নামদুটো উপেনেরই দেওয়া। ওরা জন্মেছিল ভাইবোন হয়ে — বড়ো হতে ওদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। ভুলিটার রং সাদার মধ্যে কালো ছোপ ছোপ — কেলো একেবারেই কালো। কেলো শান্ত, শিষ্ট, ধীর, স্থির প্রকৃতির। ভুলি ঠিক উলটো — সবসময় উৎসাহে আর উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। ভুলির একনিষ্ঠতা প্রশংসনীয়। কোন দলছুট পুরুষ কুকুর যদি ভুলিকে দেখে লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসে তাহলে সে ভুলির দাঁতের স্বাদ নিয়ে ফিরে যায়। কেলো কিন্তু ভালমানুষ হলেও বৈচিত্রলোভী। অনেকবার রাস্তায় মেয়ে কুকুর দেখে আনমনে এক পা দুপা করে সেদিকে এগিয়ে গেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ভুলির কামড়। দুঃখিতভাবে কেলো ফিরে এসেছে বাল্যসঙ্গিনীর কাছে।
ওরা দুজন উপেনের সাইকেলের দু'পাশে চলে আসে। সাইকেলের সাথে সাথে চলতে থাকে। উপেন হাতের পেডাল বন্ধ করে সাইকেল থামায়। ওদের একটু আদর করবে — বিশেষ করে ভুলিটাকে। ভুলি সাইকেলের হাতলের ওপর দু' থাবা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় — উপেন হেসে মুখ ফেরায় ওর দিকে। ভুলি ওর ছুঁচলো মুখ উপেনের মুখের কাছে গিয়ে এসে জিব দিয়ে ওর নাক চেটে দেয়। উপেন রেগে হাত তোলে ওর মাথায় থাবড়া মারার জন্যে। একলাফে ভুলি ওর হাতের আওতার বাইরে সরে যায় — সেখানে দাঁড়িয়ে পিট পিট করে উপেনের দিকে তাকায়। উপেন কেলোর দিকে মুখ ফেরায়। বলে, এই দ্যাখ, শালি বদমাস কুত্তী আমার মুখ নোংরা করে দিয়েছে।
কেলোর কোনো ভাবান্তর নেই। ও নির্বিকার চোখে উপেনের দিকে তাকিয়ে থাকে। উপেন এবার হাসে। বলে, এ শালা একেবারেই বোদা।
এখন কুকুর দুটোকে খাওয়াবে উপেন। এই খাওয়ানোটা ওর একটা বড়ো মানসিক তৃপ্তির ব্যাপার। তাছাড়াও ওর মাথায় ঢুকে আছে যে সকালে এই জীবদুটোকে খাওয়াতে না পারলে ওর দিনটা ভাল যাবে না। ওর কারবারে লোকসান হবে, ওর ধান্দার মাল চোট হয়ে যাবে — বা ঐরকম কিছু। তবে ভুলির জন্যে ওর একটা দুর্বলতাও আছে। প্রথম যখন ওদের বাচ্চা বয়েসে উপেন ওদের দেখেছিল তখন থেকেই ভুলির জন্যে ও এই টানটা অনুভব করেছিল — আস্তে আস্তে সেটা আরও বেড়েছে। এমনিতে উপেনের মনে দয়া-মায়া — এসবের খুব একটা জায়গা নেই। খালি ভুলির বেলায় একটু অন্যরকম। হতে পারে এটা উপেনের কুসংস্কার — ওর মনের ঐ ধারণা। ভুলিকে যখন থেকে ও খাওয়াতে শুরু করেছে তখন থেকেই ওর কারবারে রমরমা হয়েছে। এখন ভুলির ওপর ওর একটা জোরালো টান হয়েছে — সেটা ও নিজেও ভালোই বুঝতে পারে। কেলোর জন্যে ওর অত কিছু মাথাব্যথা নেই। কেলো যেটুকু যত্ন পায় সেটা ও ভুলির সঙ্গী বলে। তার বেশি কিছু নয়।
উপেন তার তিনচাকায় চলে আসে রাস্তাটার শেষে — কেলো আর ভুলি কখনো ওর পাশে, কখনো ওর পেছনে। রাস্তাটা কোনাকুনিভাবে এসে মিশেছে আর একটা বড়ো রাস্তায়। সেই কোনাটায় প্রকাণ্ড চওড়া ফুটপাথের অর্ধেকটারও বেশি জায়গা জুড়ে বিশ্বেশ্বর ঠাকুরের খাবারের দোকান। গোটা তিনেক বড়ো বড়ো কেরোসিনের স্টোভে রান্নার ব্যবস্থা। ওপরে বাঁশের খুঁটির ওপরে টাঙানো ত্রিপলের চালা। বর্ষাকালে পেছনটা আর দুটো পাশও ত্রিপল দিয়ে ঘিরে দেয় বিশ্বেশ্বর। এখনও বর্ষা আসতে দেরি আছে — কাজেই চার পাশই খোলা। বসার কোনো জায়গা নেই — দাঁড়িয়ে খাওয়া। চায়ের জন্যে মাটির ভাঁড় আর প্লাস্টিকের ছোট গেলাস দুইই আছে। খাওয়ার জন্যে অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট। দুই রাস্তার কোনাটার কাছে একটা জলের কল — বিশ্বেশ্বরের দোকান তাকে দুপাশ থেকে গিলে নিয়েছে। সেই জলে আনাজ ধোওয়া, রান্না, খদ্দেরদের খাবার জল দেওয়া, এঁটো বাসন ধোওয়া। ময়লা ফেলার জন্যে বড়ো একটা ঢাকনাওলা ড্রাম — বিশ্বেশ্বর সেটা ওর দোকানের এক পাশে রেখে দিয়েছে। সেটা নিয়মিত সাফ হয়। সাফাইওয়ালারা বিশ্বেশ্বরের দেশের লোক। তাছাড়া একটা মাসোহারার বন্দোবস্তও আছে। সকাল আটটা থেকে জায়গাটা গম গম করে লোকে। ভিড়টা থাকে সন্ধে সাড়ে সাতটা আটটা পর্যন্ত। প্রচুর খদ্দের পায় বিশ্বেশ্বর। পাঁউরুটি, ডিম, ঘুগনী, রুটি, তরকারি, ভাত সবই আছে। একটু শৌখিন খদ্দেরের জন্যে চাউ, তার সঙ্গে টোমাটো সস এর লেবেল লাগানো বোতলে রাখা কুমড়োর সস।
উপেনের সাইকেল থামে বিশ্বেশ্বরের দোকানের গা ঘেঁষে। কেলো আর ভুলিও দাঁড়িয়েছে — ওদের জিভ থেকে টস টস করে জল পড়ছে রাস্তায়। ওরা জানে ওদের জন্যে এখন ভোজনসুখ অপেক্ষা করে আছে। উপেন হাঁক দেয় — এ বিশুয়া, ওদের খেতে দে।
বিশ্বেশ্বর বসে আছে জ্বলন্ত স্টোভের সামনে। গরম লাগছে বলে গায়ে কোনো জামা রাখে নি। ধুতিটা দুপাশ দিয়ে উরু পর্যন্ত তুলে ফেলেছে — ওটা একটা ল্যাঙটের মতো লাগছে। ও একটা আওয়াজ দিল — রামুয়া-য়া-য়া।
বিশ্বেশ্বর বছর দশেকের একটা ছেলেকে দেশ থেকে আনিয়ে নিয়েছে দোকানের কাজ করার জন্যে। ছেলেটা অর্থাৎ রামুয়ার বাপের অনেকগুলো ছেলেমেয়ে - ওদের সবাইকে খেতে দেওয়া মুস্কিল। কাজেই একটাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশ্বশ্বরকে। কোনো মাইনে নেই কেবল পেটভাতা। রামুয়া একটা পিঁড়িতে বসে আনাজ ধুচ্ছিল। কিলো দশেক আলু ছাল ছাড়িয়ে ডুমো ডুমো করে কাটা — তারপর তা এক বালতি জলে কচলে কচলে ধোয়া। মালিকের ডাক শুনে উঠে দাঁড়াল। দুটো কানা উঁচু থালায় চা ঢালল। তারপর গত রাতের বাসী রুটি তরকারি, চাউ এসব ছুঁড়ে দিল রাস্তায় — কেলো, ভুলির দিকে। ওরা কিন্তু নড়ে না। আগে ওদের চা-টুকু চাই — নেশা ধরে গেছে তো। দুটোতেই চায়ের থালাদুটোর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, আর ল্যাজ নাড়ে। রামুয়া চায়ে আঙুল ডুবিয়ে পরীক্ষা করে — চা একটু ঠাণ্ডা হয়েছে কিনা। গরম চা ওদের দেয়া যাবে না। জিভ পুড়ে যাবে।
চা একটু ঠাণ্ডা হলে রামুয়া থালা দুটো রাস্তায় রাখে — তারপর ঠেলে দেয় কেলো-ভুলির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ওরা এগিয়ে আসে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে চা খায়। রামুয়া এবার উপেনকে চা দেয়। একটা বড়ো মাটির খুরি ভর্তি ধোঁয়া ওঠা চা — একটু বেশি চিনি দিয়ে ঘুঁটে দেয়া। সেই সঙ্গে মোটা মোটা চৌকো গড়নের নোনতা বিস্কুট। উপেন কি পছন্দ করে রামুয়া তা জানে। আর এও জানে যে কেলোভুলি চায়ে মুখ দেবার আগে উপেন কিছুতেই নিজের চায়ে চুমুক দেবে না।
উপেন যতক্ষণ চা খায় বিশ্বেশ্বর ওর সঙ্গে সুখ দুঃখের কথা বলে। এক বছর হল বিয়ে করেছে, এখনও বৌ এর গর্ভ হয়নি। অনেক মন্দিরে মানত করে রেখেছে — দেখা যাক কিছু হয় কিনা। একটা বেটা হওয়ার খুব দরকার। এই ব্যবসা সামলাবে কে? ওর টাকা পয়সা খাবেই বা কে?
ভুলি ততক্ষণে চা শেষ করে খাবারে মুখ লাগিয়েছে। কেলোও তার চা শেষ করে। গুটি গুটি এগিয়ে এসে খাবারের এক পাশে মুখ দেবার চেষ্টা করে। তাতে আবার ভুলির আঁতে ঘা লাগে। ও সবকটা দাঁত বার করে কেলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটা বিকট ধমক লাগায়। কেলো পাশাপাশি লাফিয়ে সরে যায় — ভুলির দাঁতে বড়ো ধার। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে নর্দমায় ফেলে দেওয়া তরকারির খোসা শোঁকে — আর মাঝে মাঝেই ঘাড় ঘুরিয়ে ভুলিকে দেখে। ভুলির পেট একটু ভরে গেলেই ওর খাওয়ার পালা আসবে — সেটা ও জানে।
উপেন খুরির পুরো চা-টা চুমুক দিয়ে দিয়ে খায়। খুরিতে চায়ের তলানি রেখে দেয়া ও পছন্দ করে না। তারপর খুরিটা ছুঁড়ে মারে নর্দমাতে — একটা জোরালো শব্দ করে ওটা টুকরো টুকরো হয়ে যায়। এবার ও সাইকেলের পেডালে হাতের চাপ দেয়। বিশুয়া — সব খাবারের দাম আমার নামে লিখে রাখ্ — পেছনদিকে কথাকটা ছুঁড়ে দেয় উপেন — কারণ ওর সাইকেলের চাকা ততক্ষণে গড়াতে শুরু করেছে।
উপেনের চা, বিস্কুট খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত ভুলি ওর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। কেলোর দিকে ও তাকায় নি — তাকাবার দরকার মনে করে নি। কারণ কেলো ওর কাছে কাছেই থাকবে — ভুলিকে ছেড়ে বেশিদূর যাওয়ার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই ওর নেই। এবার ভুলি উপেনের গাড়ির এপাশে ওপাশে দুলকি চালে হাঁটে — কখনো বা থেমে পড়ে পেছিয়ে থাকা কেলোকে এক ধমক লাগায়। ওটা বড়ো আলসে - সেজন্যে ওকে সমানে শাসনে রাখে ভুলি। এখন ভুলি খানিকটা সময় উপেনের কাছে থাকবে। উপেন যেখানে যাবে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করবে — যতদূর যাওয়া যায়। আসলে উপেনের যেরকম ভুলির ওপর একটা মমতা রয়েছে ভুলিরও রয়েছে উপেনের জন্যে একটা জোরালো অনুভূতি — ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা মেশানো — হয়তো বা কিছু মাত্রায় ভয়ও। ও জানে যে ওর চার পাশে যেসব দুপেয়ে জানোয়ার ঘোরে উপেন তাদেরই একজন। এই দু'পেয়েরা অদ্ভুত ক্ষমতাশালী প্রাণী। তারা সোজা হয়ে দাঁড়ায়, দু পায়ে হাঁটে। বাকি যে-দুটো পা ওদের শরীরের দুপাশে ঝোলে সে-দুটো যে কোনো অঘটন ঘটাতে পারে — অকল্পনীয় সব কাজ করে ফেলতে পারে। ভুলির অভিজ্ঞতা আছে — অল্পবয়েসী দু পেয়েরা কতবার ওদের ওই ওপরের পা দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা ইঁট পাথরকে জীবন দিয়েছে — তখন দূর থেকে সেই পাথর ছুটে এসে আঘাত করেছে ভুলির গায়ে। ওই দু-পেয়েরা প্রভু শ্রেণীর প্রাণী — তারা দূর থেকে ভুলির শরীরে যন্ত্রণা ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম। রাস্তা দিয়ে যে সব ছোটবড়ো দৈত্য গোঁ গোঁ করে ছোটাছুটি করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে — তা সে যতই মৃদু ধোঁয়া হোক না কেন, ভুলির নাকে তা ঠিকই ধরা পড়ে — সেগুলো প্রাণ পায় তখনই যখন কোনো দুপেয়ে তার পেটের ভেতর গিয়ে ঢোকে। আবার এই দুপেয়েরা সেখান থেকে বেরিয়ে এলেই সেগুলো নিষ্প্রাণ হয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে — তখন তাদের গায়ে পা তুলে দিয়ে জল ছাড়লেও কোনো সাড়াশব্দ করে না। দিনের আলো নিভে গেলে যে রাস্তায় অন্য ধরনের আলো হয় তাতেও ভুলি দুপেয়ের কেরামতি বুঝতে পারে। কিন্তু উপেন তাদের মধ্যেও ব্যতিক্রম — সেরাদের একজন। ও দু পায়ে হাঁটে না। ওর শরীরের নিচের ভাগটায় একটা তিন চাকার যন্ত্র — সেটা ওকে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়। এ ছাড়া উপেন প্রভুদেরও প্রভু। একবার ও রাস্তার পাশে কেলোর সঙ্গে সঙ্গমে আবদ্ধ ছিল — তখন ও দেখতে পায় একটা অল্পবয়েসী দু পেয়ের ওপরের পায়ে উদ্যত হয়ে আছে একটা পাথরের টুকরো। অসহায় ভয়ে ভুলি অপেক্ষা করছিল কখন ঐ পাথর ছুটে এসে আঘাত করবে ওর শরীরে। ভাবছিল শরীরের ঠিক কোন অঙ্গে এসে সেটা লাগবে আর তাতে যন্ত্রণা কতখানি তীব্র এবং তীক্ষ্ণ হবে। এমন সময় ও একটা গর্জন শুনতে পায়। অল্পবয়েসী দুপেয়েটাও সেই গর্জন শোনে, কারণ সঙ্গে সঙ্গে সে পাথরটা রাস্তায় ফেলে দেয় এবং দ্রুত দৌড়ে পালিয়ে যায়। তখনই ভুলি জেনে যায় যে অন্য দুপেয়েদের ওপরও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা উপেনের আছে। ও যে রোজ কেলোর সঙ্গে ঐ রাস্তার কোনে খাবারের জায়গাটায় চা খেতে পায়, তার সঙ্গে পায় নানারকম সুস্বাদু খাবার—তাও যে উপেনের প্রত্যক্ষ অবদান সেটা ভুলি বোঝে। কেলোর এত কিছু অনুভূতি নেই। ভুলির তাঁবেদারি করে ও সুখে আছে—ওর পক্ষে তাই যথেষ্ট।
উপেনের সাইকেলের চাকা ধীরে সুস্থে গড়ায়—ওর তো কোনো নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাবার তাড়া নেই। পাশের ফুটপাথ দিয়ে একজন লোক দ্রুত হেঁটে আসছিল—তার সঙ্গে উপেনের চোখাচোখি হয়ে যায়। উপেন লোকটার মুখ চেনে—ওকে এই সময়ে অনেকবার দেখেছে। লোকটা ব্যাঙ্কে কাজ করে— রাস্তার কোণে যে বড়ো ব্যাঙ্কটা সেখানে ওকে ঢুকে যেতে দেখেছে উপেন। লোকটাও উপেনের মুখ চেনে না তা নয়— বিশেষ করে উপেনের তিন চাকাকে তো অনেকবারই নজর করে দেখেছে। উপেন একগাল হাসে—ডান হাত কপালে ঠেকিয়ে সেলাম করে। লোকটা কিন্তু নিজের পদমর্যাদা সম্বন্ধে সচেতন। পাল্টা সেলাম করে না। সামান্য একটু হাসে - মাথাটা খুব অল্প একটু ঝোঁকায়। তারপর দ্রুত হেঁটে নিজের অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। লোকটা চোখের এবং কানের আড়াল হতেই উপেন আবার হাসে - ওর কান এঁটো করা হাসি। পাশ দিয়ে হেঁটে চলা ভুলিকে বলে, এ মালটা একটা লাল্লু, বুঝলি ভুলি?
ভুলি চলতে চলতেই উপেনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়, চোখ পিটপিট করে। উপেন যা বলবে তাতেই ভুলির সায় থাকবে - এটা একেবারে স্বতঃসিদ্ধ।
খানিকটা এগোলে রাস্তার ধারে একটা প্রকাণ্ড লম্বা পাঁচিল পড়ে। একটা বিরাট বাড়ি, তার লাগোয়া প্রচুর জমি - এই পাঁচিল তাকে ঘিরে রেখেছে। মূল বাড়িটা অনেক ভেতরে - বাইরের দিকে খোলামেলা জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চৌকিদার, চাকরবাকর - সে-সবের ঘর। পাঁচিলটার এখন বার্ধক্যে জীর্ণ অবস্থা - অনেক জায়গায় ভেঙে গিয়েছে - পলেস্তারা খসে গিয়ে ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। একটা জায়গায় একটা বড়ো ভাঙা - লোকজন আর উপেনের তিনচাকা সেখান দিয়ে গলে যায়। ব্রিটিশ আমলের বাড়ি - কোনো এক সাহেব থাকত সেখানে। দেশ স্বাধীন হবার সময় সাহেব এ-বাড়ি বিক্রি করে দেয়। কিন্তু সেই বিক্রি আর জমির আদত মালিকানা নিয়ে তার পরেপরেই মামলা লেগে যায়। ঐ মামলা এখন চালাচ্ছে দু পক্ষের নাতি নাতনিরা। কোনো মেরামতি নেই - এই বাড়ি আর চারপাশের পাঁচিল আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। একজন চৌকিদার অবশ্য আছে - রাস্তার কাছাকাছি একখানা ঘরে সে থাকে। এই প্রকাণ্ড জমি, বাড়িতে থাকার স্বত্ব আইনত সে এখন একাই ভোগ করছে। তার মাইনে দুই যুযুধান পক্ষ সমান ভাগ করে দেয়। এটা আদালতেরই নির্দেশ।
ফুটপাথের জায়গায় জায়গায় রাস্তার পাশের সব বাড়ির থেকে গাড়ি বার করার জন্যে ঢালু করে রাস্তার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া আছে। এরকম একটা ঢালের ওপর দিয়ে উপেন তার সাইকেল ফুটপাথে তোলে। সামনেই ঐ লম্বা পাঁচিলের ভাঙা জায়গাটা। উপেন তার বাহনকে সেখান দিয়ে ঢুকিয়ে দেয় - চৌকিদারের ঘর ছাড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। সাইকেলের ঠিক পেছনে রয়েছে ভুলি। মাঝে মাঝেই ল্যাজ নেড়ে ওর মনের খুশী জানান দিচ্ছে। কেলো পাঁচিলের ভেতরে ঢোকে নি - রাস্তার ধারের নোংরা আর্বজনা শুঁকছে। চৌকিদারের ওই ঘরটার পেছন দিকে একটা গাছের নিচে ভুলি একবার তার আঁতুড় গেড়ে বসেছিল - চার পাঁচটা খুদে খুদে বাচ্চাকে নিয়ে সেখানে শুয়ে পড়েছিল। ঘটনাটা চৌকিদার পাঁড়েজীর নজরে আসে এবং সে বার বার বলতে থাকে - আরে রাম রাম, ইয়ে কুত্তীনে তো সত্যানাশ কর দিয়া। সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ পাঁড়েজী নিজে সে সব বাচ্চাদের ছোঁবে না, অতএব সে দুজন লোক ডেকে এনেছিল বাচ্চাগুলোকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্যে। পাঁড়েজীকে যদিও ভুলি আগে থেকেই চিনত - কিন্তু তার সঙ্গে আরও দুটো দুপেয়েকে দেখে ও ভয় পেয়েছিল। বিশেষতঃ অচেনা দুপেয়েদের সঙ্গে লাঠি, লোহার ডাণ্ডা এসব দেখে। ও অবশ্য নিজের সব দাঁত বার করে আর চাপা গর গর আওয়াজ করে অচেনা আগন্তুকদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। কেলো বুদ্ধিমানের মতো অনেকটা দূরে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়েছিল - দুপায়ের ফাঁকে ল্যাজ গুটিয়ে রেখে কুঁই কুঁই করে করুণ আর অসহায় আওয়াজ ছাড়ছিল। অচেনা দুপেয়েরা যখন ভুলির যথেষ্ট কাছে এসে পড়েছে তখনই উপেন তার তিন চাকা সমেত সেখানে হাজির হয়ে যায় - দরাজ হাতে টাকা বিলিয়ে ঐ ভাড়া করা লোকদের বিদেয় করে। সাত্ত্বিক পাঁড়েজীও টাকা পেয়ে যথেষ্ট খুশী হয় আর ভুলির তৈরি নোংরা থেকে নিজের চোখ সরিয়ে রাখতে রাজি হয়ে যায়। পাঁড়েজীর প্রাথমিক শত্রুতাতে যে উপেনই জল ঢেলে দিয়েছিল সেটা ভুলি তার স্ত্রী পশুর সহজাত বুদ্ধিতে বুঝতে পেরেছিল। এই ঘটনায় ভুলির মনে উপেনের জন্যে কৃতজ্ঞতা মেশানো শ্রদ্ধা পাকাপাকিভাবে গেঁথে যায়। উপেন যে অনেক দুপেয়ে প্রভুদের ওপরেও প্রভু ওর এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে যায়।
এ জায়গাটা এখন নির্জন। কিন্তু একজন লোক সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। উপেনকে দেখে সে দু হাত জোড় করে অভিবাদন করে। বলে, সেলাম মালিক।
উপেন পাল্টা অভিবাদন করে না। ওর মুখে এখন মালিকসুলভ গাম্ভীর্য। ও নিজের ডান হাতটা লোকটার দিকে বাড়িয়ে দেয়।
লোকটার কাঁধে একটা কালো রঙের ব্যাগ। ও ঝটপট ব্যাগের মুখের চেন টেনে ব্যাগ খোলে - তাড়াতাড়া নোট বার করে উপেনের হাতে দেয়। টাকাটা হাতে নিয়ে উপেন ভুলিকে বলে, এবার তুই কেলোর কাছে যা। আমার এখন কাজ আছে। ভুলি উপেনের দিকে তাকায়, তারপর দৌড়ে দৌড়ে মাটি শুঁকতে শুঁকতে পাঁচিলের ভাঙা জায়গা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে যায়। উপে্ন হাতের টাকার নোটগুলো দেখে। সব হাজার আর পাঁচশোর নোট। উপেন মন দিয়ে টাকাটা গোনে - তারপর খুশী হওয়ার ভঙ্গীতে মাথা নাড়ে। ওর সাইকেলের দু পাশের হাত রাখার জায়গার ওপরটা খুলে ফেলে উপেন - টানলেই তা খুলে আসে। দু দিকেই ভেতরে সরু লম্বা বাক্সের মতো জায়গা - নোটগুলো সেখানে রেখে ও জায়গাদুটো আবার বন্ধ করে দেয়। তারপর মোলায়েম গলায় বলে, হাঁ দয়াল - বাকী সব খবর বল্।
লোকটার নাম রামদয়াল। উপেনের অনেক লোকজনের একজন। এই এলাকাটায় বেশ কিছু স্কুল আর কলেজ আছে। যারা সেখানে পড়ে তাদের অনেকের বাবারই টাকার কোনো লেখাজোখা নেই। সে সব ছেলেমেয়েদের হাতে তুলে দিতে হয় পাতলা কাগজে সিগারেটের মতো করে মোড়া গুঁড়ো - তাছাড়া সাদা গুঁড়োর পুরিয়া - বিদেশ থেকে আসা মাল। প্রচুর ছেলেমেয়ে এসব নিচ্ছে - না নিলে জীবনের লুকোনো সুখের স্বাদ পাওয়া যাবে না। উপেনের কর্মচারীরা আরও অনেক জায়গায় কাজ করে। শহরের কলেজগুলো - তাদের ছাত্রছাত্রীদের থাকার জন্যে হস্টেল। এই কিছুদিন হল উপেন তার লোকজন মফস্বলের কলেজে টলেজেও পাঠিয়েছে। সে-সব জায়গাতে আজকাল ভালো কাটছে উপেনের মাল। অবশ্য এ লাইনে উপেন একা আছে তা নয়। আরও যারা আছে তাদের সঙ্গে রফা করে চলতে হয়। এ ব্যবসার নিয়ম কানুন বড়ো কড়া। নিয়ম মানে নি বলে উপেন নিজেই তো বাধ্য হয়েছিল ওরই একজন লোককে সরিয়ে দিতে। কি যে ভূত চাপল লছমনটার মাথায়। একগাদা টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজে এ লাইনে ব্যবসা শুরু করে দিল। বৌবাজারের কেলে পিন্টুকে দু লাখ দিয়েছিল উপেন। পিন্টু টাকাটা একটু বেশীই নেয়, কিন্তু ওর রিভলভারের হাত খুব পরিষ্কার। লছমনের বৌ তারপর পোকা মারার বিষ খেয়েছিল, বাচ্চাদেরও খাইয়েছিল - সবাই মিলে মরেছিল। উপেনের যে ব্যাপারটা খারাপ লাগেনি তা নয়। কিন্তু এছাড়া আর উপায় কি ছিল? এ সব লাইনে নিয়ম ভাঙতে দেওয়া চলে না। তাহলে এ লাইনটাই বন্ধ হয়ে যাবে।
রামদয়াল চলে যাবার পর আরও দুজন লোক এল উপেনের সঙ্গে দেখা করতে। আলাদা আলাদা সময়ে। উপেনের লোকজন সাধারণত কেউ কারোর দেখা পায় না। প্রত্যেকের কাজের জায়গাও আলাদা। এটা উপেনের ব্যবস্থা। নিজেদের মধ্যে বেশী দেখাশোনা হলেই ওরা ঘোঁট পাকাবে। আলাদা দল করে ব্যবসা করার চেষ্টা করবে। তা হতে দেবে না উপেন।
একটা চীৎকার উপেনের কানে এল। সালি হারামী রেণ্ডি - এখন কঞ্জুসি করছিস?
তার পরে পরেই একটা পাল্টা চীৎকার - চোপ্, লৌণ্ডা বদমাস কাঁহিকা।
চড় থাপ্পড় আর ঝটাপটির আওয়াজও পাওয়া গেল।
প্রথম গলাটা কোনো একটা অল্পবয়েসী ছেলের - গলা এখনও ভাঙে নি। পৌরুষ আসতে এখনও দেরি আছে। দ্বিতীয়টা কোনো যুবতী মেয়ের—ক্রুদ্ধ ঝগড়ার সময় তীক্ষ্ণ এবং কর্কশ।
উপেন মনে মনে হাসে। দুটো গলাই ওর চেনা। যেদিকে ঝামেলা হচ্ছে সেদিকে সাইকেল চালায়।
একটু এগিয়ে পাঁড়েজীর ঘরের পেছনে খানিকটা খালি জায়গা। মারপিটটা হচ্ছে সেখানে। রানি আর তার ভাই লালন। রানি ভাই এর গালে বেশ কয়েকটা ওজনদার চড় বসিয়েছে - লালন গালে হাত দিয়ে হাঁ হাঁ করে চেঁচিয়ে কাঁদছে।
উপেন ওদের কাছে যায়। লালনকে জিজ্ঞেস করে - কিরে, তোরা ঝগড়া করছিস কেন?
লালন একটা নালিশ করার লোক পেয়ে বেঁচে যায়। বলে, এই দ্যাখো না আঙ্কেল, কাল রাতে এতগুলো খদ্দের ধরে দিলাম - আর মাগি এখন আমাকে সির্ফ পচাস রুপেয়া ধরে দিচ্ছে।
রানি চেঁচিয়ে ওঠে। বলে, কাকা, খচ্চরটা ঝুট মুট ঝামেলা করছে। পচাস অনেক বেশি দিয়েছি ওকে। তাতেও চিল্লাচ্ছে। ও যত বলছে তত কামাই আসলে হয় নি।
তারপর চৌকিদারের ঘরের দিকে হাত ঘুরিয়ে বুড়ো আঙুল দেখায় রানি - এই বামহনটাকেও তো দিতে হবে।
রানির বয়েস এই আঠেরো-উনিশ, লালনের এগারো-বারো। ওরা এক মায়ের পেটের ভাইবোন - বাপ আলাদা। কে যে ওদের বাপ ওরা জানেই না। ওদের মা ছিল ফুটপাথের ভিখিরী মেয়েমানুষ - সেও জানত না ওদের বাপ কে? রাস্তার ফুটপাথে ওদের জন্ম, সেখানেই লম্বা টানা গাড়িবারান্দার নিচে শুয়ে বড়ো হয়েছে ওরা। লালনের জন্মের আগে থেকেই রানি রাস্তায় ভিখ মাঙতে শুরু করে। গায়ে-মুখে ময়লার পরত, মাথার চুল ধুলোয় লালচে, রাস্তার মোড়ে লাল সিগন্যালে সব গাড়ি থামলে গাড়ির বন্ধ কাঁচে আঙুল দিয়ে ঠকঠকিয়ে ভিক্ষে চাওয়া। তারপরই দৌড়ে পেছনের ট্যাক্সিটার কাঁচ নামানো খোলা জানালার ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে মহিলা যাত্রীর কাছে দয়া চাওয়া। তারপর লালনের জন্ম, হঠাৎ একদন মা-টা মরে গেল - রানি আর তার ভাই ফুটপাথেই রইল - সেভাবেই বড়ো হতে লাগল। আর পাঁচটা ফুটপাথের মেয়ের মতো রানি বহুবার ধর্ষিতা হয়েছে। ওর কাছে ওটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল - বৃষ্টি বাদলায় পড়লে ভিজে যাবার মতো। এমন কিছু ব্যাপার নয় - ভিজে জামা, ভিজে গা আবার নিজের থেকে শুকিয়েও যায়। গত কয়েক বছর হল রানি নিজস্ব ব্যবসা শুরু করেছে। জায়গার ব্যবস্থা হয়েছে এখানকার চৌকিদার পাঁড়েজীর সঙ্গে। ওর ঘরের পেছনদিকে একটু এগিয়ে একটা জায়গা বড়ো একটা গাছের ছায়ায় নির্জন। পাঁড়েজী একটা দড়ির খাটিয়া দিয়েছে রানিকে। এই শুনশান জায়গা আর দড়ির খাটিয়া - তার বদলে রানির রোজগারের শতকরা দশ ভাগ পাঁড়েজী নিয়ে থাকে। তবে পাঁড়েজী একটা ত্রিপলের তাঁবু দেয় বর্ষাকালে বৃষ্টি আর শীতকালের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া আটকাবার জন্যে। তার বদলে অতিরিক্ত আর কিছু নেয় না রানির থেকে। সন্ধে একটু ঘন হলে ব্যবসার কাজ শুরু হয়। খদ্দের জোগাড় করে আনে ভাই লালন। ওর ভাগও শতকরা দশ। একা একজন লোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে - সেরকম দেখলে লালন দৌড়ে গিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। বলে, সাব্, চলুন না - একদম ডবকা ছোকরি - সস্তায় হবে - এই কাছেই - আইয়ে না সাব্! এ কয়েক বছরে লালন এ কাজে বেশ পাকা হয়ে গিয়েছে - চেহারা দেখেই বুঝতে পারে কে ওর ডাকে সাড়া দিয়ে ওর সঙ্গে আসবে, আর কে ওর কথা শুনে মাথা নিচু করে জোরে হেঁটে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। রানি তার রেটটা মোটামুটি সস্তাই রেখেছে - দুশ টাকা আর রবারের সতর্কতার দাম। রবারের জিনিষ সব রানির কাছেই রাখা থাকে। কোনো কোনো খদ্দেরের পকেট আবার একটু হাল্কা থাকে। রানি তখন পাঁড়েজীর ঘরের দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে - গোটা পঞ্চাশ টাকাতেই খদ্দেরকে ছেড়ে দেয়। তবে হ্যাঁ, রবারের দাম যে কয়েক টাকা - সেটা খদ্দেরকে দিতেই হয়। সেটা রানি ছাড়ে না। মাঝে মাঝে ঝামেলাও হয়। পুলিশবাবুরা উর্দি পরে বা সাদা পোষাকে চলে আসে। তখন সব কিছুই বিনে পয়সায়। পাঁড়েজী এখানে একা থাকে - বৌ থাকে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে। কাজেই তারও মাঝে মাঝে রানির কাছে যাওয়ার দরকার পড়ে। রানি খিঁচিয়ে ওঠে - রাতে বিনে পয়সায় হবে না, সকালে আসিস রে বুড়ো। রোজ ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে স্নান করে হাতের আঙুলে পৈতে জড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করে শুদ্ধ হয় পাঁড়েজী। কিন্তু সে সব দিনে শুদ্ধ হওয়ার পরই রানির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে হয়। খাটিয়ায় প্রায় ঘুমন্ত রানি - চোখের কোনে পিঁচুটি - খোলা মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে খাটিয়ার একটুখানি দড়ি ঈষৎ ভেজা। রানির সঙ্গে শারীরিক কর্মের আগে পাঁড়েজী পৈতেটা কানে জড়িয়ে নেয় - কিন্তু কোনো কোনো সময় সেটা কান থেকে খুলে গিয়ে রানির গলায় ঝোলানো একটা সরু সোনার গিলটি করা চেনের ওপর পড়ে তার সঙ্গে জড়িয়ে যায়। রানি সে অবস্থাতেই খিলখিল করে হাসে। বলে, আরে বুঢ্ঢা তোর জনেউ আমার হারের সঙ্গে লটকে গেছে। অপ্রতিভ পাঁড়েজী তখন কোনমতে চটপট কাজ সারে - রানির হারের জট থেকে নিজের পৈতে ছাড়ায়। নিজের ঘরে এক বোতল গঙ্গাজল রাখা আছে - অবশ্য গঙ্গা থেকে তোলা নয় - দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে কেনা - পৈতেতে ছিটিয়ে শুদ্ধ করে তবে আবার গলায় পরে।
উপেন ভাই বোনের কাজিয়া শুনে হো হো করে হাসে। নিজের জামার পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বার করে লালনকে দেয়। বলে, এই নে। আর দিদির সঙ্গে ঝগড়া করিস না।
লালনের গালে রানির চড়ের দাগ। কিন্তু উপেনের টাকাটা হাতে পেয়ে ওর চোখে মুখে খুশী ঝলকায়। টাকা পকেটে পুরে লাফাতে লাফাতে চলে যায়।
রানি উপেনের কাছে মুখ নামিয়ে এনে চেঁচায়, আর আমি? কাকা, ঐ হারামজাদাকে টাকা দিলে, আর আমাকে দেবে না?
উপেন হাত দিয়ে নিজের কান চাপা দেয়। বলে, চেঁচাস না, থাম্ থাম্। তারপর বেরোয় পাঁচশো টাকার নোট। সেই নোট রানির হাতে দিয়ে বলে, এটা তোর।
রানি টাকাটা ভাঁজ করে নিজের চোলির ভেতর রাখে। তারপর দুহাত ওর সাইকেলের হাতলে রেখে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে। বলে, কাকা, আমাকে হাজার টাকা দাও না। পরশু রাতে দুটো পুলিশওয়ালা এসেছিল। ব্যবসার টাইম তো খারাপ করলই, আবার যাওয়ার সময় জোর করে হাজার টাকা নিয়ে গেল। ভয় দেখাল টাকা না দিলে থানায় নিয়ে যাবে। যা কাছে ছিল সব চলে গেল। দাও না টাকা, কাকা।
ঝুঁকে পড়ার ফলে চোলির ওপর দিয়ে রানির যৌবনের আভাস দেখা যাচ্ছিল। উপেনের চোখ সেদিকে যায় - সেখান থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকায় উপেন। ওর চোখের সামনে এই মেয়েটা একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠেছে। রাস্তায় ভিক্ষে করেছে, কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে। আজ নিজের মুরোদে রোজগার করে খাচ্ছে - ভাইটাকে খাওয়াচ্ছে। দু চোখে উদগ্র প্রত্যাশা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। একটা করুণ মমতা অনুভব করে উপেন। ভুলিকে ছাড়া রানিই বোধহয় আর একজন জীবন্ত প্রাণী যার জন্যে উপেনের দিলে খানিকটা জায়গা রাখা আছে। হয়তো ও নিজের সঙ্গে রানির কিছুটা মিল খুঁজে পায়। ওকেও এক সময় ভিক্ষে করতে হয়েছে। সে খুব ছোটবেলায় - যার স্মৃতি এখন ঝাপসা, অস্পষ্ট। বাবা মা বলে কিছু মনে পড়ে না - একটা বুড়ি মেয়েমানুষ - ও বলত আন্টি - তার কাছে ও থাকত। থাকা মানে আধপেটা খাওয়া আর রাতে শোওয়া। বুড়িটার চেহারাও ভাল মনে নেই। একটা লম্বা, রোগাটে চেহারা - মুখটা এখন আর মনে করতে পারে না। মেয়েমানুষটা রোজ সকালে ওকে ঘরের বাইরে বার করে দিত রাস্তায় ভিক্ষে করার জন্যে। দিনের আলো থাকতে ঘরে ঢুকতে দিত না। উপেন রাস্তায় ঘুরত - কখনো বুকে হেঁটে - কখনো হাতে ভর দিয়ে পা ঘষটে ঘষটে। ভিক্ষের রোজগার সব নিয়ে নিত ঐ আন্টি। কোনদিন পয়সা কম হলে ওকে মাটিতে শুইয়ে নোংরা, ময়লা, সাত জায়গায় ছেঁড়া হাফ্ প্যান্টটা খুলে ফেলে ওকে উলঙ্গ করত - তল্লাস করে দেখত উপেন ওর শরীরের কোথাও কোনো টাকা পয়সা লুকিয়ে রেখেছে কিনা। তারপর আসত মার। বুড়ির নিজের হাত, ঘর পরিষ্কার করার ঝাড়ু, রান্নাঘরের গরম খুন্তির ছেঁকা। কিন্তু উপেন কখনো চেঁচাত না - কাঁদত না। খালি ঘরের মেঝেয় একধার থেকে আর এক ধারে গড়াত। ও সেই বয়সেই নিজের শরীরকে হুকুম দিতে পারত ব্যথা সহ্য করে থাকতে। নিজেকে বশে রাখার ক্ষমতাই আজ ওকে এ জায়গায় এনেছে - ও এ লাইনে একজন ওস্তাদ হতে পেরেছে।
উপেন রানিকে বলল, তবে তো তোর জোর নুকসান গেছে রে। এই নে টাকা। এক চেয়েছিলি - দুই দিলাম। আর কিন্তু চাইবি না। আর দেব না।
রানি টাকা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, হি হি করে হাসে। বলে, আমি আবারও চাইব, তুমিও দেবে।
একটু থেমে রানি আবার বলে, কাকা, আমাদের দু ভাইবোনকে তোমার ঘরে থাকতে দাও না। তোমার বিছানায় তোমার বৌরাই শোবে - আমরা নিচে মেঝেয় শুয়ে থাকব।
উপেনের মুখ হাসিতে ভরে যায়। ও হাত বাড়িয়ে হাতের তালুতে রানির মুখটা নিয়ে ওর দু গাল টিপে দেয়। বলে, দাঁড়া দাঁড়া - অপেক্ষা কর। এবার কোনো একটা বৌ মরলে আর মেয়ে খুঁজতে যাব না। তোকেই বিয়ে করে নিয়ে যাব।
রানি খিলখিল করে হাসে - মুখের চকচকে সাদা দাঁতগুলো দেখা যায়। নিচু হয়ে উপেনের গালে একটা জোরালো চুমু খায় রানি - চকাৎ করে শব্দ হয়। বলে, আমার কোনো অসুবিধে নেই। কিন্তু কাকা, আমার যা রেট তা তুমি জান - সে টাকা কিন্তু আমাকে দিতে হবে।
উপেনও হাসে। বলে, তুই শালি বহুত হারামি। তারপর সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে পাঁচিলের বাইরে রাস্তার দিকে এগিয়ে যায়।
উপেনের দুই বৌ। আগেও ছিল - এখনও আছে।
বড়োটার বত্রিশ তেত্রিশের মতো বয়েস। গাঁট্টাগোট্টা শক্ত সমর্থ স্বাস্থ্যবতী। উত্তর বিহারের সাহারসা অঞ্চলের মেয়ে। পনেরো-ষোল বছর হল উপেনের ঘরে আছে। উপেনের ঘরে এসে ওঠার পরের থেকে বাপের বাড়ির সঙ্গে আর কোনোরকম যোগাযোগ নেই। বাপের বাড়ির কেউ উপেনের ঠিকানাও জানে না। উপেন তার এক চেলার হাত দিয়ে মেয়ের বাপের কাছে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল। দশ হাজার। মেয়ের বাপ মেয়ের সঙ্গে ট্রেনে - হাওড়া পর্যন্ত এসেছিল। উপেনের আর এক চেলা সেখানে মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। বাপটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে রাত কাটিয়ে পরের দিনের ট্রেনে উঠে দেশে ফেরত চলে যায়।
আরও একটা ছিল। মালদা না মুর্শিদাবাদ কোন একটা জায়গার থেকে আমদানি। গোটা পাঁচেক মেয়েকে জড়ো করে একটা দালাল নিয়ে যাচ্ছিল পশ্চিমে। রাস্তাতেই এই মেয়েটা বিক্রি হয়ে গিয়ে জায়গা পেল উপেনের ঘরে। অবশ্য ওর জন্যে টাকাটা একটু বেশি লেগেছিল - এই আঠারোর মতো। বাকি মেয়েগুলো উঠে গেল পশ্চিমে যাবার ট্রেনে।
সে মেয়েটা মারা গেছে কয়েক বছর আগে। তারপর উপেন আবার একটা ছোট বৌ আনিয়েছে। সুন্দরবনের মেয়ে। বছর ষোল সতেরো বয়েস। এবারে খুব কমে সেরেছিল উপেন - হাজার দেড়েকও পুরো লাগে নি। আয়লার পর ওদিকে মেয়ের দর খুব সস্তা।
উপেনের ঘরে ঢোকার পর থেকে ওরা হয়েছে বড়ী আর ছোটি। ছোট বৌ বড়োকে ডাকে বড়ীদিদি। সারাদিন দু বৌ এর কাটে ঘরের কাজে। বেশির ভাগটাই ছোটি করে - বড়ো বৌ করায়। কাজে ভুল বা গাফিলতি হলে দেয় মার। হাতা, খুন্তি, রুটি বেলার বেলন। বড়ো বৌ যখন যা সুবিধেমত পায় সেটা কাজে লাগায়। মার খেয়ে ছোটি কোঁক করে ওঠে - তারপর মন দিয়ে কাজ করে। কাজকর্ম সারা হয়ে গেলে দুই বৌ আবার দুই সখীর মতো একসঙ্গে বসে টিভি দেখে। সিরিয়াল বা সিনেমা সম্বন্ধে তাদের তারকাদের সম্বন্ধে - খুব জোর আলোচনা হয়। দুই বৌ এসব ব্যাপারে খুব ওয়াকিবহাল।
উপেন বাড়ি ফেরে বেশ রাত করে। গাড়ি মোটরের রাস্তা থেকে একটা গলি ভেতরে ঢুকে গেছে। আরও এগিয়ে এই গলিটা যেখানে খুব সরু হয়ে গেছে সেখানে উপেনের ঘর। পাড়াটার বিশেষ সুনাম নেই - নানারকম বেআইনি ব্যবসা চলে গলিটার দুপাশের বাড়িগুলোতে। বাড়িগুলো খুব পুরনো - বেশির ভাগেরই দেয়ালের পলেস্তারা খসা - ঘরের দরজাগুলো রঙ ওঠা। উপেনের ঘরের দরজাও গলির ওপরেই - ও তার সামনে ওর তিন চাকা থামিয়ে গাড়ির সামনের ঘন্টি বাজায়।
বড়ো বৌ বেরিয়ে আসে। হাতে একটা ব্রীফকেস। উপেন ব্রীফকেসটা নেয় - সেটাকে কোলের ওপর রেখে তার ডালা খুলে ফেলে। ওর গাড়ির হাতলের খোপ থেকে টাকা বার করে তাতে ভরে। একটু সাবধানে - কেউ যাতে না দেখে ও কি করছে। অবশ্যি এ পাড়ায় উপেনকে সবাই চেনে - ওর টাকায় হাত দেবার সাহস কেউ করবে না। তবুও - সাবধানের মার নেই।
উপেন টাকাভর্তি ব্রীফকেসটা কম্বিনেশন লক দিয়ে বন্ধ করে বড়ো বৌ এর হাতে দেয়। তারপর ওর বৌ ক্রাচ দুটো খাপ থেকে বার করে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়। উপেন দুটো ক্রাচে ভর দিয়ে সাইকেল থেকে নামে। ও ঘরে ঢোকে - পেছনে বড়ো বৌ। বৌ এর থেকে আবার ব্রীফকেসটা নিয়ে উপেন ঘরের কোনের লোহার আলমারিতে রাখে। বড়ো বৌ ততক্ষণে বাইরে যায়। উপেনের ঘর থেকে একটু এগিয়ে গলিটায় একটা ছোট্ট খাঁজ। রাতে তিন চাকাটা ওখানে থাকে। খোলাই থাকে - খালি বর্ষাকালে একটা প্ল্যাস্টিকের চাদর দিয়ে ঢাকা দেওয়া হয়। ঠিকঠাক করে সাইকেল সেখানে রেখে এসে ঘরে ঢোকে বড়ো বৌ - দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দেয়।
উপেনের এই একটাই ঘর। ঘরের এককোণে কেরোসিনের ছোট স্টোভ রেখে রান্নার ব্যবস্থা। দুই বৌ সাধারণতঃ দিনের বেলাতেই রান্না করে খায়। রাতের খাবার প্রায় রোজই বাইরে থেকে আসে। কাবাব রোটি, রুমালি রোটি, মাংসের চাপ, বিরিয়ানি। উপেনের ঘরের খুব কাছে এই গলিতেই একটা খাবারের দোকান থাকায় বৌ দুটোর খুব সুবিধে হয়েছে।
একটা মাত্র ঘরে থাকার জন্যে বড়ো বৌ মাঝে মাঝে ঘ্যান ঘ্যান করে - একটা বড়ো দেখে জায়গায় উঠে যাবার জন্যে বায়না করে। কিন্তু উপেন জাঁকজমক পছন্দ করে না। ও চোখ মেলে তাকিয়ে দুনিয়ার আলো দেখেছে এ পাড়ায় - আর এই ঘরটায় আছে আজ কত বছর হয়ে গেল ওর মনেও পড়ে না। উপেন বৌকে থামাবার জন্যে প্রথমে ধমক দেয়। তাতে কাজ না হলে চুলের মুঠি ধরে জোরে এক থাপ্পড়।
এ ঘরের পেছনদিকে তেলতেলে পেছল কলতলা, পায়খানা। পাশাপাশি অনেকগুলো ঘরের বাসিন্দাদের ব্যবহারের জন্যে। উপেন মুখ হাত ধুয়ে সেখান থেকে ফিরে আসে। ক্রাচ নিয়ে ওর চলাফেরা অত্যন্ত সহজ এবং সাবলীল - নিজের পায়ের মতই উপেন ও দুটোকে ব্যবহার করতে পারে। ঘরের একটা বড়ো জায়গা জুড়ে একটা খাট। উপেন তার একপাশে আসন করে বসে - হাত দিয়ে পা দুটোকে হাঁটুর থেকে ভাঁজ করে নেয়। ক্রাচ দুটো খাটের মাথার কাছে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে। বড়ো বৌ ওর সামনে একটা বড়ো টুল রাখে - তার ওপর খাবার দেয়। তারপর নিজেরা খাবার বেড়ে নিয়ে মেঝেয় বসে পড়ে।
খাওয়া শেষ হলে থালাতেই হাত মুখ ধুয়ে নেয় উপেন। তারপর খাটের বাজুতে পিঠ রেখে হেলান দিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরায়। সিগারেট, লাইটার, ছাইদানি এসব বড়ো বৌ খাটের মাথার ধারে রোজ সাজিয়ে রাখে। বৌরা এঁটো থালা বাসন সব তুলে নিয়ে যায়। কলতলায় নিয়ে গিয়ে মেজে ধুয়ে আনে। তারপর বড়ো বৌ ঘরের ভেতর কলতলায় যাবার দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাতে খিল চাপায়।
বড়ো বৌ এর আরও কাজ রয়েছে। ও নিজের হাতব্যাগ থেকে দুটো ওষুধের পাতা বার করে। দিন তারিখ মিলিয়ে একটা পাতার থেকে একটা বড়ি বার করে জল দিয়ে খায়। একই ভাবে আর একটা পাতার থেকে একটা বড়ি ছোটিকে খাওয়ায়। উপেন এখনও কোনো বাচ্চা কাচ্চা চায় না। আগের ছোট বৌটা চুপচাপ এই বড়ি খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। একদিন দেখা গেল সকালবেলা ওয়াক তুলছে। পাড়াতেই এক মহিলা লাল কালিতে বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ল্যাম্পপোস্টে, রাস্তার পাশে বাড়ির দেয়ালে সাঁটিয়ে দেয় - সাকশন পন্থায় পাঁচ মিনিটে আরোগ্য। এ পাড়ার মেয়েদের মধ্যে মহিলার ভাল পশার আছে। উপেন ছোট বৌকে পাঠিয়েছিল ঐ মহিলার কাছে - সঙ্গে বড়ো বৌ। কিন্তু কি গোলমাল হল, রক্ত পড়া আর বন্ধ হল না। পাড়ায় একজন ডাক্তারও বসে - উপেনের চেনা। তাকে উপেন দিয়েছিল পঞ্চাশ হাজার। পেয়েছিল একটা ডেথ-সার্টিফিকেট। স্বাভাবিক মৃত্যু - তীব্র পেট খারাপে ডিহাইড্রেশন এবং কিডনী ফেলিওর। এখনকার ছোট বৌ ঘরে আসার পর উপেনের কড়া নির্দেশ - রোজ বড়ো বৌ নিজে ওকে বড়ি খাইয়ে দেবে।
উপেন খাটে বসে দুই বৌ এর হাঁটাচলা, ওঠাবসা, টুকটাক কাজকর্ম করা দেখছিল। একটা আশ্চর্য ব্যাপার - ছোটিকে দেখে উপেনের মাঝে মাঝেই ওর ছোটবেলার ঐ আন্টির কথা মনে পড়ে। ছোটির সঙ্গে কোথায় যেন ঐ বুড়ির একটা মিল আছে। হতে পারে সেটা ছোটির রোগা লম্বা, ক্ষয়াটে চেহারায় - কিংবা হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গীতে। এরকম মনে হলেই ওর একটা অস্থিরতা আসে ও শরীরে বোধ করে একটা ছটফটানি। ও বড়ো বৌকে বলল, এবার ছোটিকে তৈরি কর।
বড়ো বৌ ছোটির হাত ধরে। একটা ভয়ের ভাব এখন ছোটির চোখে মুখে। ও একটা ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে, আজ নয় - আজ আমাকে ছেড়ে দাও। বড়ো বৌ ওর দিকে দু চোখ পাকিয়ে তাকায় - ওকে এলোপাথাড়ি কয়েকটা চড় চাপড় বসায়। মার খেয়ে ছোটি কুঁকড়ে যায়, আর কোনো বাধা দেয় না।
বড়ো বৌ অভ্যস্ত হাতে ওকে দ্রুত বিবস্ত্রা করে। খাটের ওপর ওকে শুইয়ে ফেলে - তারপর একহাতে ওর দুটো হাত ওর মাথার ওপর তুলে টিপে ধরে থাকে - আরেক হাতে ওর মুখ চেপে ওর মাথা বিছানার সঙ্গে ঠেসে ধরে থাকে। রোগা পাতলা একটা কিশোরী শরীর - বলিষ্ঠ বড়ো বৌ এর শারীরিক শক্তির কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে। উপেন হাতে ভর দিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা ছোটির শরীরটার কাছে সরে আসে। ছোটির মুরগীর মতো সরু গলা, তার নিচে হাড় বার করা কাঁধ, অপুষ্ট ক্ষুদ্রাকৃতি দুই বুক - দু চোখে হাড়িকাঠে মাথা ফেলা জানোয়ারের নিঃশব্দ ভয়ের চাউনি। উপেন ছাইদানি থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা তুলে নেয় - ছোটির নরম সংবেদনশীল শরীর - জ্বলন্ত ডগাটা সেখানে একটু ছুঁইয়েই আবার সরিয়ে নেয়। ধড়ফড় করে ওঠে জোর করে শুইয়ে রাখা দেহটা - পা দুটো থরথর করে কেঁপে ওঠে - বন্ধ মুখ থেকে একটা অস্ফুট গোঙানির আওয়াজ বেরোয়। উপেন সিগারেটটা ছাইদানিতে ঘষে নিভিয়ে দেয় - ছোটিকে দিয়ে নিজের শরীরের খিদে মিটিয়ে নেয়। তারপর ছোটির কাছ থেকে সরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে ছোটির অস্তিত্বের আর কোনো দাম নেই ওর কাছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এখন ওর খালি ঘুমের দরকার।
বড়ো বৌ ছোটির হাত আর মুখ ছেড়ে দেয়। ছোটি নড়ে না - পাথরের মতো বিছানায় পড়ে থাকে। খালি ওর দু চোখ দিয়ে জল গড়ায় - করুণ, বোবা একটা কান্না। বড়ো বৌ ওর ছেঁকা খাওয়া জায়গায় একটা ডাক্তারি মলমের পুরু প্রলেপ দেয়, তারপর তার ওপরে একটা স্টিকিং প্ল্যাস্টার লাগায়। এই নতুন ছেঁকাটার আশে পাশে অনেকগুলো কালো কালো দাগ রয়েছে। সব পুরোনো ছেঁকা। বেশির ভাগই শুকিয়ে গেছে - দু একটা প্রায় শুকনো। এবার একটা চাদর দিয়ে বড়ো বৌ ছোটির গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়।
ততক্ষণে উপেনের নাক ডাকতে শুরু করেছে। বড়ো বৌ আলো নিভিয়ে দেয়। উপেনের অন্য পাশে শুয়ে পড়ে উপেনকে নিজের কাছে টানবার চেষ্টা করে। বিরক্তিতে উপেনের মুখ কুঁচকে যায়। চোখ না খুলেই বড়ো বৌ কে ঠেলে সরিয়ে দেয়। ঘুমজড়ানো গলায় বলে, ঝামেলা করিস না মাগি - ঘুমোতে দে। তারপর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার জোরে জোরে নাক ডাকতে থাকে। বড়ো বৌ খানিকক্ষণ শুকনো চোখে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অন্য পাশ ফিরে শোয়।
ঘরের ভেতর অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না - খালি শোনা যায় সিলিং ফ্যানটার ঘোরার একঘেয়ে কুটকুট করে আওয়াজ। সেই অন্ধকারে জেগে থাকে ছোটি। সিগারেটের ছেঁকার জ্বলুনির সঙ্গে মিশে যায় স্মৃতি - ছেলেবেলার, বাপের বাড়ির। সেই স্মৃতির থেকে ও সুখ খুঁজে বার করার চেষ্টা করে - কিন্তু পায় না কিছুই। খিদে ছিল বাপের বাড়ির নিত্যসঙ্গী - কখনো তার যন্ত্রণা বোবা, কখনো পেটের ভেতর আলপিন ফোটানোর মতো। এখানে দুবেলা পেট ভরে খেতে পাচ্ছে - খিদে কষ্ট আর নেই। কিন্তু তখনই ছেঁকাটা চিনচিন করে ওঠে। ব্যথাটা একটু সামলে নেয় ছোটি - তারপর চিন্তা করার চেষ্টা করে ওর আর কি হতে পারত। নগদ টাকায় বিক্রি হওয়া মেয়ে সে - তাকে কি চালান করে দেওয়া হত পাড়ি দিয়ে মরুভূমির দেশে? সেখানে কি তাকে বেঁধে দেওয়া হত উটের পিঠের ওপর - পুরুষের সুখের বৈচিত্র বহুগুণে বাড়িয়ে তোলার জন্যে? তারপর তার কি হত? হয়তো অসহ্য কষ্ট পেয়েও সে বেঁচে থাকত - কিন্তু তা কি আরও ভয়ঙ্কর, আরও যন্ত্রণার অভিজ্ঞতার জন্যে? দু হাত দু পা একসঙ্গে বাঁধা ওপরে একটা শিকের থেকে দই এর ভাঁড়ের মতো ঝুলন্ত একটা কিশোরী শরীর - অপেক্ষা করে আছে পুরুষের বিভিন্ন, বিচিত্র, বিকৃত সব মর্জি মেটাবার জন্যে। ছোটির কল্পনার গণ্ডী আর ছড়াতে পারে না - ওর চিন্তা করার শক্তি ঝাপসা হয়ে আসে। শরীরে ছেঁকার যন্ত্রণা হয় - তবুও ঘুম আসে - ওর সব কিছু ভুলিয়ে দেয়।
সকালবেলা - রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। আরামসে তার সাইকেলের পেডাল ঘুরিয়ে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যাচ্ছিল উপেন। এখন বর্ষাকাল - আকাশ মেঘলা হয়ে আছে - সহজে রোদ উঠবে বলে মনে হয় না। ওর সাইকেলে একটা ছাতা লাগিয়ে নিয়েছে উপেন - বৃষ্টি পড়লে ও সেই ছাতাটা খুলে দেয়। তাতে ওর মাথাটা ভেজে না গায়ের অনেকটাও বৃষ্টির থেকে আড়াল পায়। রাজছত্র লাগানো তিন চাকা - তাতে গদিয়ান হয়ে বসে থাকে উপেন।
ভাঙা পাঁচিলের কাছে গিয়ে রানির চিৎকার শুনতে পেল উপেন। গলা খুলে চেঁচাচ্ছে মেয়েটা। কারোর সঙ্গে ঝগড়া করছে - মাঝে মাঝেই অশ্রাব্য ভাষায় কিছু বিশেষণে প্রতিপক্ষকে সম্বোধন করছে। অন্য পক্ষের গলা শোনা যাচ্ছে না। উপেন তার তিন চাকা নিয়ে পাঁচিলের ফাটলের ভেতর ঢুকল। ব্যাপারটা কি দেখতে হচ্ছে।
পাঁচিলে ঢুকেই চোখে পড়ল। একটা বড়ো বেল গাছের নিচে দুই মূর্তি। রানি চেঁচাচ্ছে পাঁড়েজীর ওপর - পাঁড়েজী তার সামনে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আর লালন একটু দূরে দাঁড়িয়ে হে হে করে হাসছে। কাছে গিয়ে উপেন রানিকে জিজ্ঞেস করল - কি হয়েছে - এত রাগ কিসের?
ব্যাপারটা ঝামেলার - রানির আঁতে জোর ঘা লেগেছে পাঁড়েজীর ব্যবহারে। বেলগাছটার গোড়ায় সিমেন্ট দিয়ে অল্প একটু জায়গা বাঁধিয়ে একটা বেদী তৈরি করিয়েছে পাঁড়েজী। অবিশ্যি সিমেন্ট কেনার টাকা সবটাই দিয়েছে রানি - যদিও ধার হিসেবে। শিউজীর একখানা বড়ো বাঁধানো ছবি সেখানে রেখে জায়গাটাকে ফুল টুল দিয়ে সাজিয়েছে পাঁড়েজী। আজ শ্রাবণ মাসের শেষ সোমবার - আজই প্রতিষ্ঠার দিন। এরপর এখানে নিয়মিত প্রণামী পড়বে - চারপাশের দোকান টোকানগুলোতে লোকের তো অভাব নেই। পাঁড়েজীর রোজগার আরও বাড়বে - দেশে আরও জমি জিরেত হবে। কিন্তু আজ সক্কালবেলাতেই রানি এখানে হাজির হয়ে গেছে - ঠাকুরের মাথায় জল ঢালবে বলে। পাঁড়েজী আপত্তি তুলেছে - শিউজী প্রথম দিন জল পাবেন - সে একটা রেণ্ডির হাতের জল হতে পারে না। রানি তীব্র চিৎকারে বলেছে, যে বামহনটা রেণ্ডির সঙ্গে শোয় তারই বা তাহলে কি অধিকার আছে ঠাকুর পুজো করার? রানির যুক্তি আর গলা দুইই জোরালো - ওই দুই এর বিরুদ্ধে পাঁড়েজী বলার কিছু পায়নি - সেজন্যে মাথা নিচু করে আছে। পাঁড়েজী তাকে এখান থেকে উৎখাত করবে সে ভয় রানির নেই। তাহলে পাঁড়েজীর একটা বড়ো রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। স্নান করে পরিষ্কার জামা পরে এসেছে রানি। টকটকে লাল চোলি আর ঘাগরা। এমনিতে ওকে দেখতে ভালই লাগার কথা। কিন্তু রাগের চোটে এখন ওর মুখের চেহারা আর চোখের চাউনি ভয়ানক দেখাচ্ছে।
উপেন মধ্যস্থতা করল। রানির পক্ষে আর একটা যুক্তি দাঁড় করাল। যে বেদীর ওপর দেবতা বসে আছেন। সেটা তৈরির টাকাটাও তো রেণ্ডিটাই দিয়েছে। কাজেই শেষ পর্যন্ত পাঁড়েজী সন্ধি করতে বাধ্য হল এবং রানি তার জল ঠাকুরের ছবির মাথায় ঢালল। তখন ফিরে এল ওর মুখের হাসি এবং চোখের ঝিলিক। ও ঠাকুরের পায়ে ফুল দিল, একটা হাজার টাকার নোট বেদীতে রাখল। তাই দেখে পাঁড়েজীর মুখের গাম্ভীর্য কেটে গেল এবং শিউজীর ছবির সামনে বসে বিড় বিড় করে সে কিছু মন্ত্রোচ্চারণ করল। বেদীর এক পাশে একটা বড়ো থালায় দেবতার জন্যে খাবার রাখা আছে - একটা বাক্সে শুকনো সন্দেশ, কিছু কলা, পেয়ারা এবং বেল। থালাটার কানাটা উঁচু - যাতে ঠাকুরের মাথায় ঢালা জল এসব সন্দেশ আর ফল ভিজিয়ে দিতে না পারে। সন্দেশের বাক্সটার সাইজ ছোট - মিষ্টির যা দাম। পাঁড়েজী রানিকে বলল, তোর আর তোর ভাইয়ের জন্যে প্রসাদ রেখে দেব - আর একটু বেলা হলে নিয়ে যাস। উপেন ততক্ষণে তার তিনচাকা নিয়ে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। ওর পুষ্যিদের খাওয়ানোর সময় হয়ে গিয়েছে।
ভাঙা দেয়ালের বাইরে বেরিয়ে উপেনের তিনচাকা তখনও ফুটপাথ থেকে রাস্তায় নামে নি - উপেন দূরে ওদের দেখতে পেল। জিভ বার করে লাফাতে লাফাতে ছুটে আসছে - যথারীতি ভুলি আগে, কেলো পেছনে। উপেন মনে মনে হাসে - শালি কুত্তিটার ভালরকম জোশ আছে। ও সাইকেলের মুখ ঘোরাতে থাকে - বিশ্বেশ্বরের খাবারের দোকানে যাবার জন্যে ওকে উল্টোদিকে যেতে হবে।
কালো রঙের বড়ো গাড়িটাকে উপেন প্রথমে দেখতে পায় নি। যখন দেখল তখন ওটা একেবারে কাছে এসে পড়েছে। হাইস্পীডে আছে - আশি নব্বই হবে। ধাক্কাটা ভুলির লাগল পাশ থেকে - ও উড়ে গেল মাটি থেকে ওপরে। হতভম্ব উপেনের মুখ থেকে একটা খাবি খাওয়ার মতো আওয়াজ বেরোল - গাড়িটা দেখতে দেখতে চোখের আড়ালে চলে গেল।
ভুলি আছড়ে পড়ল রাস্তায় - ছটফট করতে লাগল। উপেন দ্রুত হাতে ওর বাহনের পেডাল চালিয়ে পৌঁছে গেল ভুলির কাছে। ভুলির সবকটা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে - চোখদুটো বিকট ভাবে ঘুরছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে ভুলি চিৎ হয়ে গেল - হাওয়ায় ছুঁড়তে লাগল চারটে পা। কেলোও সেখানে পৌঁছে গেছে - কুঁই কুঁই করে কাঁদছে। তারপর ভুলির ঘাড়টা শরীরের সঙ্গে একটা অদ্ভুত কোন করে বেঁকে গেল - মুখ দিয়ে একটা ঘড়ঘড় করে আওয়াজ বেরোল - সেই সঙ্গে রক্তবমি। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল ওর পুরো শরীরটা। তারপর ভুলির সব নড়াচড়া একেবারে বন্ধ হয়ে গেল - সাদা পেটটা আকাশের দিকে একটা কৌণিক ভাবে মুখ করে রইল।
হাহাকার করে কেঁদে ওঠে উপেন। সেই আওয়াজে রাস্তার সকালের শান্তিকে ছারখার করে দেয়। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে বসে থাকা কয়েকটা কাক ডানা ঝাপটে উড়ে যায় - সমানে কা কা করে ডেকে তাদের অসন্তুষ্টি দেখাতে থাকে। ভাঙা পাঁচিলের ভেতর থেকে ছুটে বেরিয়ে আসে রানি, লালন - তাদের পেছনে পাঁড়েজী। রাস্তার অন্যদিকে কয়েকটা পান সিগারেটের দোকান - সেই দোকানিরাও ভীড় করে আসে সেখানে।
উপেন কাঁদে আর বলে - ওরে রানি, আমার ভুলি মরে গেল - ও হো হো রে - মরে গেল—
রানি ভুলির নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে দেখল। তারপর সাইকেলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উপেনের মাথাটা দুহাতে জড়িয়ে ধরল। পাঁড়েজী রানিকে ইঙ্গিত করল— উপেনকে ভাঙা পাঁচিলের ভেতর নিয়ে যেতে। এখন ওকে এ জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলার দরকার।
রানি আর লালন দু দিক থেকে টেনে টেনে উপেনকে পাঁচিলের ভেতরের বেলগাছের কাছে নিয়ে আসে। দুচোখ বন্ধ করে সমানে ফোঁপায় উপেন। রানিরও দু চোখ থেকে গালের ওপর জাল গড়ায় - ও তা মোছার কোনো চেষ্টা করে না। লালন হাতের মুঠোর উলটোদিক দিয়ে ডলে ডলে চোখ মোছে। পাঁড়েজীও মাঝে মাঝেই তার কোঁচার খুঁট চোখে লাগায়। রানি এবার উপেনকে বলে - কাকা, ভুলির জন্যে শিউজীর কাছে প্রার্থনা কর। ওর আত্মার সদ্গতি হবে।
উপেনের ফোঁপানি থামল - ও চোখ খুলে তাকাল রানির দিকে। ওর দুচোখ জলে ভরা, কান্নায় লালচে। ও রানির দিকে তাকিয়ে থাকে - রানির কথাটার অর্থ ভাল করে বোঝবার চেষ্টা করে।
রানি উপেনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ল—প্রার্থনা কর কাকা। তারপর গাছটার থেকে একটা বেলপাতা ছিঁড়ে এনে উপেনের হাতে দিল।
উপেন তার সাইকেল গড়িয়ে গড়িয়ে বেদীটার পাশে নিয়ে গেল। শিউজীর ছবির ওপর বেলপাতা দিল। ছবির মাথায় বেলপাতা থাকার জায়গা নেই - সেটা পড়ে গেল ছবির পায়ের কাছে। রানি ছুটে গিয়ে একটা ঘটিতে করে জল নিয়ে এল - সেই জল উপেন ঢালল ছবির ওপর। তারপর উপেন মাটি থেকে একটা ইঁট কুড়িয়ে নিল - রানির হাতে সেটা দিয়ে আঙুল দিয়ে গাছটা দেখাল। ওর তাঁবুর ভেতর থেকে একটা দড়ি নিয়ে এল রানি - ইঁটটায় বেঁধে সেটা গাছটার একটা ডাল থেকে ঝুলিয়ে দিল।
পুরো ব্যাপারটা চুপচাপ দেখে গেল পাঁড়েজী। একটা রাস্তার কুকুরের আত্মার সদ্গতির জন্যে শিউজীর কাছে মানত করাটা সাত্ত্বিক মানুষটির বিশেষ পছন্দ হয় নি। যত অনাসৃষ্টি কাণ্ড - সব ঐ রেণ্ডিটার জন্যে।
সেদিন কোনো কাজ করল না উপেন। ওর কর্মচারীদের ফিরিয়ে দিল রানি আর লালন। উপেন বাড়িও ফিরে গেল অনেক তাড়াতাড়ি - সন্ধে হতে না হতেই। সঙ্গে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে এল রানি আর তার ভাই। এর মধ্যে কর্পোরেশনের লোক ভুলির শরীরটাকে সরিয়ে ফেলেছে। রাস্তার ওপর ভুলির বমির রক্তের দাগ একেবারে হাল্কা করে দিয়েছে শ্রাবণ মাসের পশলায় পশলায় বৃষ্টি। কেলো ধারে কাছে নেই। কোথায় গিয়ে শোক করছে কে জানে। কিংবা কে বলতে পারে ও হয়তো খুশিই হয়েছে সঙ্গিনীর কঠিন শাসনের থেকে মুক্তি পেয়ে। ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে অন্য কোনো কুকুরদের দলে ঢোকবার জন্যে—বিশেষতঃ সে দলের যৌবনবতী কুকুরীটির জন্যে। হয়তো সেখানে সুবিধে হয় নি। সে দলের কুকুররা - এমনকি সেই আকর্ষণীয়া কুকুরীটিও - ওকে ধমকে পেছনে তাড়া করেছে - প্রাণের দায়ে দূরে পালিয়েছে কেলো। কিন্তু পরদিন সকালে চায়ের মৌতাতের সময় এলে ওর ভুলির কথা মনে পড়বে - তখন ও আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ আওয়াজ করে কাঁদবে। কারণ ওর জান্তব অনুভূতি ওকে বলে দেবে যে একা একা বিশ্বেশ্বরের দোকানে গেলে ও খেতে তো পাবেই না - বরঞ্চ কপালে জুটবে ঠেঙার প্রহার, দূর থেকে ছুটে আসা ইঁটের সজোর আঘাত। তারপর এক সময় নিজে থেকেই ওর কান্না বন্ধ হবে - রাস্তা শুঁকতে শুঁকতে ও জীবনের গন্ধ পাবে - ছুটবে সেদিকে।
উপেনের বৌরা রানি আর তার ভাইকে চা আর পরোটা করে খাওয়াল - তারপর রানি ফিরে গেল তার ভাইকে নিয়ে। বড়ো বৌ যদিও রানির সঙ্গে হেসে কথা বলে, আসলে ওকে একটু সন্দেহের চোখেই দেখে। বলা তো যায় না - যদি উপেন রেণ্ডিটাকে নিয়ে এসে ঘরে তোলে। ছোটি কিন্তু রানিকে পছন্দ করে - ওর সঙ্গে গল্প করতে ভালোবাসে। রানি ওর নানা অভিজ্ঞতার গল্প করে প্রায় সব সময়ই তাতে প্রচুর অতিরঞ্জন থাকে - ছোটি হাঁ করে সেসব শোনে। উপেন রানিকে এনে ঘরে তুলবে সে ভয়টা ওর নেই। যদি সেরকম হয়েও যায় তাতেও ওর কোনো দুঃখ হবে না। ও বরং খুশিই হবে সিগারেটের ছেঁকা খাওয়ার জন্য অন্য আর একটা মেয়ে জুটে গেল।
সেদিন রাতে উপেন খেল খুব কম। ওর বৌদের ভুলির জন্যে কোনো মাথাব্যথা নেই। ওরা ঠিকঠাকই খাওয়া দাওয়া করল - রোজকার মতো বাসনপত্র ধুয়ে টুয়ে রাতে ঘুমোবার জন্যে তৈরি হতে লাগল। তারপর বড়ো বৌ যখন ঐ ডাক্তারি বড়ির পাতাদুটো ওর ব্যাগ থেকে বার করেছে তখন খাটে বসা উপেন হঠাৎ বড়ো বৌ এর দিকে ঝুঁকে পড়ে সে দুটো ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। পাতাদুটো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ল, তারপর টুকরোগুলো ঘরের কোনে ছুঁড়ে ফেলল।
দুই বৌ অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। বিশেষ করে বড়ো বৌ। উপেন অদ্ভুত একটু হাসল। বলল, আজ থেকে তোদের এসব বড়ি খাওয়া বন্ধ।
হতবুদ্ধি দুই নারী তখনও হাঁ করে তাকিয়েছিল উপেনের দিকে, তাই দেখে আবারও এক বিচিত্র হাসিতে ওর মুখ ভরে গেল। ঘরের আলোর সুইচ ওর পেছনদিকের দেয়ালে। সেদিকে হাত বাড়িয়ে সুইচটা টিপল উপেন—আলো নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে দিল।