আমাদের পাড়ার ছোট বইয়ের দোকানটি বোধ হয় উঠেই যাবে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেখি একগাদা বই তাদের বাইরের বারান্দায়-----সাইনবোর্ডে যা লেখা তার সারমর্ম হলঃ জলের দামে বিক্রি হচ্ছে। জলের দাম তো বটেই। যে বই একসময় ছিল বিশ কি পঁচিশ ডলার সেবই তারা স্পেশালে দিয়েছে দুই থেকে পাঁচ ডলার। আজকাল তো দুবোতল জল কিনতেও তার চেয়ে বেশি লাগে। এগুলোকে এদেশে বলা হয় সাইডওয়াক সেল। যেসব পণ্য সারাবছরে একটি-দুটির বেশি বিকোয় না বলে গুদামজাত হবার দশা সেগুলোর ভাগ্যেই ঘটে এই বারান্দার টেবিলে আশ্রয় পাওয়া। বাচ্চাদের খেলনা, কাপড়, মেয়েদের অন্তর্বাস, রোজপাউডার, লিপস্টিক, ছেলেদের শার্ট গেঞ্জি সুইমিং সুট, তোয়ালে। তার সাথে হয়ত কিছু রহস্য উপন্যাস, ভূগোলের বই, মানচিত্র, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনকাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, বনজংগলের বিচিত্র গল্প, যা লিখতে লেখকদের হয়ত প্রাণান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে, ওগুলো সবই খোলা বারান্দার মলিন টেবিলে----একরকম বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছেই বলা চলে। ক্রেতারা যদি এত সস্তাতেও কিনতে আগ্রহ প্রকাশ না করেন তাহলে সম্ভবত পৌরসভার সাপ্তাহিক আবর্জনার সঙ্গেই চলে যাবে একদিন। অনর্থক দোকানদারের বোঝা বাড়িয়ে কি লাভ!
বাড়িয়ে বলছি না। আজকাল প্রায় সবখানেই পুরনোদিনের সুন্দর মলাটে সাজানো বাঁধানো বই আফ্রিকার হাতি আর গণ্ডারদের মত ‘এনডেঞ্জের্ড স্পিসিজ’এ পরিণত হবার উপক্রম। তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। আজকাল লোকে বই পড়েনা খুব একটা। পড়বেই বা কেন? সময় কোথায়? তাছাড়া বিনি পয়সায় হাজার হাজার ই-বই থাকতে মানুষ কোন আক্কেলে গাঁটের পয়সা খরচ করে বই কিনতে যাবে? ই-বইতে বাজার ছেয়ে গেছে সারা দুনিয়া জুড়ে। কিণ্ডেল, কোবো, কিকস্টার্টার। আরো কত কি বেরুবে বাজারে কে জানে। যুগটা তো যাকে বলে মুক্তবাজারের যুগ। এগুলোর সাথে যোগ করুণ ইন্টারনেট, আইপ্যাড, আইফোন, ফেসবুক, টুইটার, স্মার্টফোন। যেটুকু সময় হাতে থাকে তা’ও চলে যায় টেক্সটিং, ইমেইল আর মবিল করে করে। পরিবারের লোকেদের সঙ্গে সপ্তাহে একবার দুবার কথা বলার ফুরসৎ হয়না। আধুনিক মানুষ ‘ই’ আর ‘ডি’র সমুদ্রে ডুবন্ত----‘ই’ মানে ইন্টারনেট, ইমেইল, ইবুক, আর ‘ডি’ মানে ডিজিটাল। এগুলোর পেছনের বিজ্ঞান হয়ত কারুরই জানা নয়----জানার দরকারই বা কি। যুগটা তো জানবার নয়, প্রয়োগ করবার---সেকারণেই তো এর নাম হয়েছে প্রযুক্তি। পুরনোদিনের কাগজের বই, সুন্দর ছবিটবি আঁকা মলাটে তৈরি বই যে একসময় নগরের বর্জ্যদ্রব্যের অন্তর্গত হয়ে যাবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। পুরনোদিনের সবকিছুরই তো প্রায় একই পরিণতি----সিঙ্গার মেশিন, ফিল্মে তোলা ফটো, ফাউন্টেন পেন, দোয়াতকলম, পকেট ঘড়ি, ডায়েল-ঘোরানো টেলিফোন, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফোনবুথ----এগুলো সবই এখন বলতে গেলে মর্গে চলে গেছে। নতুন এসে পুরনোকে ঝেঁটিয়ে সরিয়ে দেবে, এটাই তো যুগের নিয়ম।
আমি দারুণরকমের পড়ুয়া মানুষ সেরকম দাবি কোনক্রমেই করতে পারব না। তবে আমি বই কিনতে ভালবাসি। পড়ি বা না পড়ি, পকেটে বাড়তি কিছু মুদ্রা জমা হলেই বই কেনার জন্য আমার হাত নিসপিস করে। পুরনোদিনের আরো একটা অভ্যাস আমার---খবরের কাগজ পড়া। একপ্রকার নেশাই বলতে পারেন। সকালবেলা মেলবক্সে কাগজ না পেলে মেজাজটা সঙ্গে সঙ্গে তিরিক্ষি হয়ে যায়। এংজাইটি সিন্ড্রমে ভুগতে শুরু করি। সকালের নাস্তার সঙ্গে পত্রিকা না হলে আমার দিনটাই মাটি। অথচ এই পত্রিকারও আজ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। একসময় আমাদের এই ছোট শহরটির লোকসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষের মত----পত্রিকা ছিল গোটাতিনেক। দুটো ইংরেজি, একটি ফরাসী। এখন লোকসংখ্যা দশ লক্ষ ছোঁয় ছোঁয়, অথচ পত্রিকার সংখ্যা একটিতে নেমেছে। সেটিরও স্বাস্থ্য খুব তাগড়া তা বলা যাবে না। কিছুদিন আগেও রোজ বেরুত পত্রিকাটি----এখন রোববার বাদ। বলতে পারেন একরকম লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমে কোনরকমে ধিক ধিক করে তার হৃদপিণ্ড ওঠানামা করছে। হবে না কেন? আজকাল কেউ খবরের কাগজ পড়ে নাকি? খবরের কাগজের চেয়ে হাজারগুণ বেশি খবর তো তারা রোজ ইন্টারনেটেই পাচ্ছে। স্থানীয় খবরই নয় কেবল, দুনিয়ার যত দেশের খবর চাইবেন সবই পেয়ে যাবেন----আঙ্গুল টেপার ব্যাপার মাত্র। আমাদের এ-শহরে আমার জানাশুনা লোকেদের প্রায় সকলেই কোন-না-কোন পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন একসময়। এখন কেউ নয়, আমি ছাড়া। আমি সত্যিকার সেকেলে মানুষ, অতীতের অধিবাসী। সেজন্যেই বোধ হয় পুরনো অভ্যাসগুলোকে ছাড়তে পারছিনা----ছাড়ার প্রয়োজনও বোধ করছি না।
প্রশ্ন হলঃ আমার প্রজন্ম শেষ হয়ে গেলে কি পত্রিকাও শেষ হয়ে যাবে? অতীতের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? সাধারণ বুদ্ধিতে বলেঃ প্রশ্নটাই হাস্যকর----অতীত তো অতীতই, মৃত, সমাহিত, তার আবার ভবিষ্যৎ কিসের? জানি, এ-প্রশ্নের কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সময় চিরকালই একমুখি। আমরা, পুরনোরা, নিজেদের স্মৃতিকাতর মুহূর্তগুলোতে, ভুলে যাই যে আমাদের ‘বর্তমান’ ও একসময় ‘অতীত’এর শবদেহকে পথের পাশে ফেলে এসেছে। একেই বলে এগিয়ে চলা----জরাজীর্ণ আর ক্ষীয়মান দুর্বলকে পেছনে রেখেই যুগের স্রোতকে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তাই, প্রশ্ন জাগে, একদিন কি উন্নত দেশগুলোর বইয়ের দোকানগুলি সব উঠে যাবে? সেখানে জায়গা করে নেবে চমকপ্রদ সব আধুনিক ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যের দোকান? নগরে-বন্দরে যত পাঠাগার আছে এখন সেগুলো একে একে ব্যবসা গুটিয়ে বিগতদিনের ধাতব মুদ্রার মত বিলীন হয়ে যাবে? এমনও কি হবে একদিন যখন পৃথিবীর লেখাপড়াজানা লোকেদের বাড়িতে কোনও লাইব্রেরি থাকবে না, থাকবে কেবল ঘরে ঘরে একটি করে কম্পিউটার? কবিসাহিত্যিকরা তখন লেখালেখি করে পারবে না জীবিকা অর্জন করতে? প্রাণের টানে কিছু লিখতে চাইলেও সেগুলো বড়জোর ব্লগ, ফেসবুক, আর ওয়েবপেজের মাধ্যমে লোকের কাছে পাঠাতে হবে? এবং যার ফলে কি এমন একটা দিন এসে যাবে যখন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই ব্লগের সাহায্যে নিজের মনের কথাগুলি দুনিয়াশুদ্ধ লোকের কাছে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হবে? অর্থাৎ তখন কোথাও পাঠক থাকবে না, থাকবে কেবল লেখক! হাসবেন না। আজকে সেটা অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু দশবছর পরে কি চেহারা দাঁড়ায় পৃথিবীর তা আমাদের কারো পক্ষেই কল্পনা করা সহজ নয়।
না, আমি কম্পিউটারের প্রভাব নিয়ে তামাশা করার চেষ্টা করছি না। যন্ত্রটি কি আশ্চর্য উপায়ে গোটা বিশ্বটাকে বদলে দিয়েছে বিশ ত্রিশ বছরের মাঝে সেটা তো আমার নিজের চোখেই দেখা। মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম আবিষ্কারগুলোর মাঝে কম্পিউটার একেবারে প্রথম সারিতে স্থান পাবার যোগ্য, সেবিষয়ে কারো দ্ব্বিমত থাকার কথা নয়। কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়া কি চাঁদে যাওয়া সম্ভব হত? বা মঙ্গলগ্রহে শূন্যযান পাঠানো? এমনকি বর্তমান যুগের আন্তর্জাতিক বিমানভ্রমণ, একই দিনে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পোঁছে যাওয়া, তা’ও তো কম্পিউটারেরই কল্যানে। আজকাল তো সাধারণ গাড়ি মেরামতকারিরাও কম্পিউটার ব্যবহার করেন গাড়ির জটিল সমস্যাগুলোর হদিস পেতে। বিজ্ঞানজগতে এর কি ভূমিকা তার তালিকা দিতে গেলে তো পাতা ভরে যাবে। গণিতের সবচেয়ে দুরূহ সমস্যাগুলো, যা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন জিনিয়াসদেরও সাধ্যের বাইরে, কম্পিউটার সেগুলো চোখের পলকে করে দেয়। বর্তমান যুগের এই যে উদার উন্মুক্ত পৃথিবী, চারিদিকে বিশ্বায়নের আয়োজন তার মূলেও তো কম্পিউটার। একে কি কোনও সুস্থমস্তিষ্ক মানুষ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতে পারবে? কোন-না-কোনভাবে আমরা সবাই, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ, রাস্তার মুটে-মজুর থেকে রাজাবাদসা প্রেসিডেন্ট ডিক্টেটার সকলেই এর হাতে বাঁধা। বইপুস্তকের কথাই ধরুণ না কেন। কত সহজে ছোট একটা যন্ত্রের ভেতরে পুরো বিশ্বকোষটাকে তারা ঠাঁই করে দিয়েছে। আজকে বিশ্বকোষ ঘেঁটে কোনও মূল্যবান তথ্য বের করতে চাইলে লাইব্রেরিতে গিয়ে খোঁজ করতে হবে না, অপেক্ষা করতে হবে না এক সপ্তাহ-----সেতথ্য আপনার পকেটের ওই ছোট্ট যন্ত্রটার ভেতরেই পেয়ে যাবেন। এর নাম স্মার্ট ফোন। সার্থক নাম----এমন সব অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম সেলফোনের মত দেখতে যে বস্তু সে তো অবশ্যই‘স্মার্ট’। বাড়িয়ে বলছিনা, কম্পিউটার একদিন মানুষের বুদ্ধিশক্তিকেও ছাড়িয়ে যাবে। সেরকম একটা ভবিষ্যদবাণী ইতোমধ্যেই করতে শুরু করেছেন কোন কোন বিশেষজ্ঞ। তখন হয়ত মানুষ তার নিজের আবিষ্কৃত যন্ত্র দ্বারাই নিষ্প্রয়োজনীয়তার পর্যায়ে চলে যাবে।
কিন্ত সত্যি কি তাই হতে যাচ্ছে? সত্যি কি মানুষের নিজেরই সৃষ্টি তার অস্তিত্বকে অবান্তর করে তোলার উপক্রম? নিয়ন্ত্রণের হাতলটি আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে আমাদের নির্মিত রবোট? কিন্তু তাই বা হয় কি করে? এই যে যুগ যুগ ধরে এত এত বিশাল বিপুল সৃষ্টি মানুষের, এত বড় একটা সভ্যতা গড়ে তোলা হল গত পাঁচশ বছরের অক্লান্ত সাধনা দিয়ে, তার অনেকটাই তো ছাপাখানার সেই আশ্চর্য যন্ত্রটির জাদুকরি অক্ষরগুলোর দান। ১৪৫০ সালে জার্মানীর স্বর্ণকার গুটেনবার্গ সাহেব তাঁর অসাধারণ সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় দিয়ে আবিষ্কার করলেন চলচ্ছক্তিসম্পন্ন মুদ্রণপদ্ধতি, যার সূত্র ধরেই দূর হতে থাকলো ইউরোপের হাজার বছরের জমাট অন্ধকার। এই যন্ত্রের ব্যবহারে প্রথম ইংরেজি বই প্রকাশিত হয় ১৫০০ খৃষ্টাব্দে। এবং অতি অল্প সময়ের মাঝে পশ্চিম ইউরোপের মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে ২০ কোটিতে পৌঁছে গেল। জ্ঞানবিজ্ঞানের জগতে এসে গেল এক অভিনব উত্তেজনা, সৃষ্টির অনবদ্য অদম্য উল্লাস, এক নতুন বিপ্লব। গোটা মহাদেশব্যাপী সৃষ্টি হতে লাগলো এক বলিষ্ঠ, আত্মবিশ্বাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা তাদের কলমের উদ্ধত উচ্চারণ দ্বারাই মুখোমুখি হবার সাহস পেল চার্চ আর ওপরতলার অভিজাত শ্রেণীর একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে। ছাপাখানা আবিষ্কার হবার আগ পর্যন্ত জ্ঞান তো ছিল ওই গোষ্ঠীটারই মুষ্টিমেয় কিছু বিজ্ঞজনের কুক্ষিগত-----যেনওটা তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। মুদ্রণযন্ত্র তাদের সেই দম্ভের দেয়ালখানি ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয়। জ্ঞান, শিক্ষা, আলোকায়ন, এগুলো অচিরেই আপামর জনসাধারণের এজমালি সম্পদে পরিণত হয়। এভাবেই পুরো একটা প্রজন্ম, ছোট বড় নির্বিশেষে, শিক্ষিত হয়ে ওঠে গোটা ইউরোপব্যাপী। ক্রমে সে আলোর বন্যা তাদের নবার্জিত উপনিবেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি হয় এযুগের তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা, যার উত্তরাধিকার আপনি আমি সকলেই ভোগ করে যাচ্ছি। আমি বলি, মুদ্রণযন্ত্র ছিল বলেই বিংশ শতাব্দীর সব বিস্ময়কর আবিষ্কার বিজ্ঞান আর শিল্পকলার জগতে সম্ভব হতে পেরেছে। আমি আরো বলি, মুদ্রিত অক্ষরগুলো ছিল বলেই আমরা আজকে কম্পিউটার নামক এই অত্যাশ্চর্য বস্তুটির অত্যন্ত অবাস্তব প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে পারছি। এই অক্ষর দ্বারা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে ‘গণতন্ত্র’এর বাণী পৌঁছুতে পারছে। পৌঁছাতে পারছে মানবাধিকারের মোহিনী ধ্বনি, সমাজতন্ত্রের প্রাণজুড়ানো আশ্বাস সাধারণ মানুষের জীবনে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনার। হতদরিদ্র লোকেদের পর্ণকুটির থেকে নির্গত হতে পারছে বিপ্লবের বজ্রধ্বনি। ছাপার অক্ষর মানবজাতির জন্য জীবনের আনন্দরসের এক অনন্ত, অবারিত প্লাবনধারা তৈরি করে দিয়েছে।
এই অসাধারণ কল্যানময়ী বস্তুটির অস্তিত্ব কি আজকের ‘ই’ অক্ষরটি দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে? আশা করি না।
আমার ছাত্রবয়সে ভালো ইংরেজি শেখার একটা বড় উপায় ছিল, অন্তত আমার বাবা তাই বলতেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে ইংরেজি পত্রিকা পড়া। স্টেইসম্যান, ইণ্ডিয়া টাইমস, ডন, ইত্যাদি। জ্ঞানবিজ্ঞানের কোনও অজানা তথ্য জানার ইচ্ছে হলে খোঁজ করতাম কোথায় বিশ্বকোষ পাওয়া যেতে পারে। মানে এন্সাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। ব্রিটানিকা পড়াটি দুদিক থেকেই উপকারি ছিল। একদিকে কিছু জ্ঞান অর্জন করা, অপরদিকে সমবয়সীদের সঙ্গে ‘ব্রিটানিকা পড়েছি’ বলে বড়াই করতে পারা। সেকালে বড়াই না করাটাই ছিল একধরণের নাকউঁচু দেমাগী ভাব। কিন্তু আজকাল সেগুলোর কোনটারই অবকাশ নেই। আজকাল পত্রিকা আর লাইব্রেরি দুটিই আমার ঘরে, এই ছোট্ট বাক্সটির ভেতর। এমনকি গোটা এন্সাইক্লোপিডিয়াটিও। এই যন্ত্রটির কল্যানে এযুগের ছেলেমেয়েদের তথ্যের অভাব হয় না----আঙ্গুল টেপার সাথেই সাথেই বিশ্বজগতের যাবতীয় সংবাদ চলে আসে কম্পিউটারের পর্দায়।
ক্যানাডায় এসে আমি বেশ কিছু লোককে দেখেছি যারা বাড়ি বাড়ি এন্সাইক্লোপিডিয়া বিক্রি করে কোনরকমে জীবিকা অর্জন করতেন। সেযুগে সেটা সম্ভব ছিল। বেশিদিনের কথা নয় কিন্তু----ষাট আর সত্তর দশক পর্যন্তও আমি দেখেছি তা। আজকাল ওই ফেরি করে বেড়ানোদের কথা বাদ দিন, এন্সাইক্লোপিডিয়া ছাপিয়ে প্রকাশকরা নিজেরাই ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। আগে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের যত বই পৃথিবীর যেখানে যেখানে প্রকাশিত হয়েছে সব তাঁরা লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন। ওটা ছিল জ্ঞানচর্চারই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের গণিত আর বিজ্ঞানের আগ্রহী পাঠক-গবেষকরা লাইব্রেরিতে গিয়ে তাক থেকে টেনে নিতেন নানা বিষয়ের রিভিউ----গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, প্রাণীবিজ্ঞান, ভূতত্ব, প্রত্নতত্ব। এখন প্রায় প্রতিটি লাইব্রেরিই সেগুলোর গ্রাহকত্ব বাতিল করে ‘অনলাইনে’ চলে গেছেন। প্রথমত খরচ কমে তাতে, দ্বিতীয়ত গবেষকদেরও কাজ চলে যায় মোটামুটি আগের মতই। সেদিক থেকে দেখতে চাইলে কম্পিউটার প্রযুক্তি এযুগেরই একটা নতুন শ্রেনী তৈরি করে ফেলছে----তাৎক্ষণিক তথ্যসমৃদ্ধ ডিজিটাল প্রজন্ম, যারা প্রয়োজনীয়ভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এবং আর্থিকভাবে মোটামুটি স্বচ্ছল, তাদেরই একটা বড় অংশ। যুগধর্মের একটা বড় বিড়ম্বনা নিশ্চয়ই কারো দৃষ্টি এড়াতে পারেনি----আগেকার যুগেরই একটা প্রযুক্তিকে অচল করে দিয়ে জন্ম নেয় এযুগের নতুন প্রযুক্তি। পনেরো শতাব্দীতে মুদ্রণ প্রযুক্তি এসে মানবজীবনের বুদ্ধিজগতে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, সৃষ্টি করেছিল যে বিস্ময়কর সজীব সচল সভ্যতা, আজকের এই নতুন শতাব্দীর আরেক বিস্ময়কর উদ্ভাবন, কম্পিউটার প্রযুক্তি, তাকে পশ্চাতে রেখে তৈরি করতে উদ্যত হয়েছে অন্য এক সজীব সচল প্রজন্ম।
কিন্তু একে কি এক নতুন প্রকারের ‘সভ্যতা’ বলে আখ্যায়িত করার সময় হয়েছে? কিম্বা আদৌ সেশক্তি আছে তার? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান প্রজন্ম, নিত্য ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা প্রজন্ম, তথ্যসমৃদ্ধ তো অবশ্যই, কিন্তু তাদের মানবিক চেতনা আর বিবেকবুদ্ধির জায়গাতে খানিক ঘাটতি আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে, এমপ্যাথি, তার অভাব। বেশ নিদারুণ অভাবই বলেন কেউ কেউ। তা যদি সত্য হয় তাহলে মানবজাতির বৃহত্তর কল্যানের খাতিরেই তো আমরা কিছুতেই যন্ত্রের আধিপত্যের ওপর আমাদের সমাজজীবনের দায়দায়িত্ব ছেড়ে দেবার ঝুঁকি নিতে পারছি না। অথচ এযুক্তির বিপক্ষেও যে যুক্তি নেই তা নয়। কেউ হয়ত ওদের পক্ষ নিয়ে বলবেনঃ এই নতুন প্রজন্মই বরং আগের চেয়ে অনেক বেশি উদারমনা বিবিধ সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে। যেমন মানবাধিকার, শ্রেনীবাদ, বর্ণবাদ,সমকাম, বর্ণান্তর ও ধর্মান্তরের বৈবাহিক সম্পর্ক, জীবজগতের প্রতি সহজাত মমতা, পরিবেশসচেতনতা, সংরক্ষণপ্রবণতা, এগুলো ওদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক জিনিস, যা আমাদের প্রজন্মের বেলাতে একেবারেই প্রযোজ্য নয়। বরং যুক্তি স্থাপন করা যায় যে আমাদের প্রজন্মই পৃথিবীটাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছিল জীবনভর পুর্ণমাত্রায় সুখবিলাশ ভোগ করার অভিলাষে। এরা তার লাগাম ধরার প্রয়াস পাচ্ছে, বললে হয়ত ভুল হবে না।
তাহলে? সেই ‘এমপ্যাথি’ যুক্তিটা কোথায় দাঁড়ায়? জানি। তবে এ’ও বলা যায় যে সবকিছুরই আছে ভালোমন্দ, আছে হারজিত। কোনটা কোনটির চেয়ে ভালো কি মন্দ তার বিচার কেবল দীর্ঘসূত্রীয় সময়ই করতে পারে।
ভবিষ্যবাণী করার মত সোজা কাজ বোধ হয় সংসারে আর একটি নেই। আমি এবার সেই সহজ কাজটিই করব চিরকাল যা করে এসেছে মানুষ। আধুনিক প্রযুক্তি আবশ্যিকভাবেই আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ দখল করে নিয়েছে, এবং যতদূর চোখ যায় ততদূর অবধি হয়ত থাকবেও। কিন্তু আমার মনে হয়, সাথে সাথে মুদ্রিত অক্ষরের বইপুস্তকও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। যখন ভাবি বইয়ের সঙ্গে আমি এবং আমার মত অনেকে, তরুণ বৃদ্ধনির্বিশেষে, একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত সম্পর্কের তাপ অনুভব করি, যেমন করে বই আমার হৃদয়ের গভীরতম, গহীনতম কথাগুলো ব্যক্ত করে তার জাদুকরি অক্ষরগুলোর মধ্যে দিয়ে তেমন জাদুর ছোঁয়া আমি যন্ত্রের ভেতর দিয়ে পাই না। ছোটবেলায় আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে, বাবামায়ের দৃষ্টি এড়িয়ে পড়ার বই খুলে রেখে তার নিচে মোহন সিরিজের বই পড়তাম। বড় হয়ে তো যাবতীয় নিষিদ্ধ বইয়ের প্রতিও আকৃষ্ট হতে শিখলাম। সেগুলোও পড়তাম লোখচক্ষুর আড়ালে-----পুকুরের ধারে একাকি বেঞ্চিতে বসে, বাসে করে কলেজে যাবার পথে, এমনকি জোছনার আলোতে বসেও আমি ডি এইচ লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটার্লির লাভার’ বইটা পড়ার চেষ্টা করেছি। পরীক্ষার পর আমার প্রথম কাজই ছিল কোথায়, কার কাছ থেকে, ধার করা যায় তারাশঙ্করের বই, বিমল রায় আর বিভূতিভূষণের বই। বঙ্কিমচন্দ্রের আমি ছিলাম এক নিদারুণভাবে ভক্ত পাঠক----তাঁর ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ ছেড়ে তো আমি বাথরুমে যেতেও দ্বিধা করতাম। তারপর যখন ইউনিভার্সিটি জীবনের শেষদিকে পৌঁচেছি তখন বাজারে বেরোয় নাবুকভের ‘ললিতা’। তখন আমাকে পায় কে----খাওয়াপরা বাদ দিয়ে ললিতার মধ্যে ডুবে থাকতে পারলেই মনে হত স্বর্গবাস বুঝি একেই বলে। মুদ্রিত অক্ষরের উপন্যাস যে একটা শিক্ষিত, বা অল্পশিক্ষিত লোকের মনের ভেতর কি অপরূপ আনন্দ উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। তখন অবশ্য পুরোটা বুঝিনি কেন এই অনুরাগ আমাদের উপন্যাসের প্রতি। এখন কিছুটা বুঝি। কারণ উপন্যাস, ইংরেজিতে যাকে বলে ফিকশন, একটা ভালো উপন্যাস, যেমন অস্টেনের ‘সেন্স এণ্ড সেন্সিবিলিটি’ রমা রোঁলার ‘জ্যাঁ ক্রিসতফ’, নুট হ্যামসনের ‘ দ্য গ্রেট হাঙ্গার’, রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’, বিভূতিভুষণের ‘পথের পাঁচালি’, টলস্টয়ের ‘ওয়ার এণ্ড পীস’, ‘এনা কেরেনিনা’, ডস্টয়ভস্কির ‘ক্রাইম এণ্ড পানিসমেন্ট’ ‘ব্রাদার্স ক্যারামযভ’----এসব অমর সৃষ্টি তাদের চরিত্রগুলর মধ্যে দিয়ে প্রতিটি পাঠকের জন্য নির্মাণ করে দেয় একটি নিজস্ব, অত্যন্ত ব্যক্তিগত ভুবন, এমন একটি জায়গা যেখানে তার কোনদিনই যাওয়া সম্ভব হবে না, এবং হবে না বলেই সেটা মিশে থাকবে তার কল্পনারাজ্যের এক রঙ্গিন এবং অসাধ্য স্বপ্নের সঙ্গে। উপন্যাস আমাদের কল্পনাকে পরিসর দেয়, দেয় তাকে নিজের উড়ুক্কু মনের সঙ্গে উড়ি উড়ি খেলা খেলবার দুরন্ত সাহস।
এই যুক্তিগুলোর একটা দুর্বলতা হল যে বই পড়ার অভ্যাস থাকলেই একটা মানুষ আলোকিত হয়ে উঠবে বা তার মনের যাবতীয় আবর্জনা দূর হয়ে একটি আধুনিক পরিচ্ছন্ন চিন্তাশীল মানুষে পরিণত হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। প্ল্যাটো আর সক্রেটিস পড়া মানুষও কালক্রমে একজন অত্যাচারি ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচারি শাসকে পরিণত হতে পারে। আবার উল্টোদিকে, এগুলো না পড়েও অত্যন্ত ভদ্র নম্র, ও সত্যিকার আদর্শ একজন নাগরিক হয়ে ওঠার উদাহরণও নেহাৎ বিরল নয়। অর্থাৎ এগুলোতে গাণিতিক কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপন করে মানবচরিত্র বিচার করা যাবে না। তবে, বইয়ের সপক্ষে কতগুলো সাক্ষ্য অবশ্যই দাঁড় করানো যায়। এখানে আমি নিজের কথা না বলে বরং টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক মার্ক কিঙ্গওয়েলেরই শরণাপন্ন হব। তাঁর এক সাম্প্রতিক লেখাতে তিনি বলছেনঃ “ It is clear that printed books and the democratized culture of reading and publicity they enable are the most significant developments in human consciousness since, perhaps, writing itself”. (এতে কোনও সন্দেহ নেই যে মুদ্রিত অক্ষরের বই এবং তার বরাতে গড়ে ওঠা এই গণতান্ত্রিক পঠন ও প্রচারের পরিচিত সংস্কৃতি আমাদের, এতে করে মানুষের চেতন মন যতটা আত্মবিকাশের সুযোগ পেয়েছে তার সমতুল গুরুত্বপূর্ণ বিকাশের ঘটনা বোধ হয় একমাত্র হাতে-লিখার শুরুটার সঙ্গেই তুলনীয়।) আরো একটা দারুণ কথা বলেছেন কিঙ্গওয়েল সাহেব। গ্রন্থপাঠ, যার ঐন্দ্রজালিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা শুনতে পাই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উত্থিত হওয়া সেই রহস্যঘেরা কণ্ঠস্বর, হৃদয়ের গভীরতম সিন্ধু মন্থন করে উদ্ধৃত সেই নিঃশব্দ বাণী, সেই ধ্বনি আর বাণী দিয়েই তো রচিত হয় এক নিত্যপ্রসারমান বিশ্ববলয়, যা অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় ও অপরিহার্য----তার চেয়ে শক্তিশালী তেজোশক্তি আর কোথায় আছে। সেকারণেই তো পৃথিবীর যাবতীয় স্বৈরশাসকরা, স্বৈরাচারি ধর্মপ্রধানরা, এমনকি ক্ষুদে সামন্তেরা---তারা সকলেই আর কিছুকে ভয় না পেলেও ভয় পেতেন মুদ্রিত অক্ষরকে। এবং ভয় পেতেন বলেই ইতিহাসে বারবার তারা আক্রমণ করেছেন পাঠাগারগুলোকে, পুড়িয়ে ভস্ম করে দিতে চেয়েছেন। তানাহলে তো পাঠাগারই তাদের পতনের পথ সৃষ্টি করে দেবে----সে জ্ঞানটুকু তাদের সবারই ছিল। বিড়ম্বনা এই যে আধুনিক প্রযুক্তির কল্যানে সেই পাঠাগারগুলি আজ আপনা-আপনিই বিপন্নদশাতে পৌঁচেছে----স্বৈরশাসকদের সহায়তার প্রয়োজন পড়েনি। এবং এতে করে মুদ্রিত অক্ষরের সেই যে গণতান্ত্রিক প্রসারের কথা বললাম সেটাই পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে এখন মুমূর্ষু অবস্থায়।
অপরদিকে ঈশানকোনেতে ভিন্নপ্রকারে এক অশনিসংকেতের আভাস দেখতে পাচ্ছি আমি। পাঠাভ্যাসের এই যে গণতন্ত্রায়িত সংস্কৃতির উদ্ভব সারা পশ্চিম বিশ্বব্যাপী, সেই সংস্কৃতি নিজের আভ্যন্তরীন দিকনির্দেশনা নিয়ে খানিক বিভ্রান্তির পরিচয় দিতে শুরু করেছে। তার প্রধান লক্ষণটি এসেছে শিল্পের অত্যাধুনিক বিমূর্তায়নের প্রবণতা থেকে----সে চিত্রকলাই হোক আর গল্প উপন্যাসই হোক। এই বিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার ক্রমপরিবর্তন ও প্রবৃদ্ধির একটা গূঢ় সম্পর্ক যে নেই তা নয়। পদার্থবিজ্ঞানে সম্ভবত এর প্রথম বিকাশ ঘটে আলবার্ট আইনস্টাইনের ১৯০৫ সালের লেখা আপেক্ষিক তত্ব বিষয়ক নিবন্ধ রচনার সূত্র ধরেই। তাঁর কথামত বিশ্বজগতের প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডের সম্যক ও সঠিক চিত্র অনুধাবন করতে চাইলে তাকে তার পরিচিত ত্রিমাত্রিক পরিসরের ভেতর আবদ্ধ না থেকে চতুর্মাত্রিক পরিসরের প্রতীতি গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থ একটি মাত্রা এতে যোগ হয়ে যায় আমাদের দুহাজার বছরের অতি পরিচিত ও অতি আরামপ্রদ বিশ্বদৃষ্টির সাথে। কল্পনাকে প্রেরণ করতে হয় ভিন্ন এক প্রায়-বিমূর্ত অস্তিত্বের জগতে। তখন সাধারণ মানুষকেও অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয় এই চতুর্মাত্রিক বিশ্বচিত্রের সথে। এই মাত্রা বিষয়টিকে আমি ঠিক গাণিতিক অর্থেই দেখি না, দেখি একটি ভিন্ন দরজা খুলে যাওয়ার মত কর। যেখানে রয়েছে আরো একটি বিকল্প পথ উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুবার-----আরো এক ঝাঁক মুক্ত হাওয়া। মাত্রা মানে, আমার দৃষ্টিতে, স্বাধীনতা। বিমূর্ত শিল্প-সাহিত্যকেও আমি অনেকটা সেভাবেই দেখি। জীবন যত জটিল হয়ে আসে তার কল্পনাতে ততই নতুন নতুন পন্থা আঁকা হয়ে যায় নিজেকে প্রকাশ করার। জ্যামিতিক বহুমাত্রিক চিত্রটি তখন শিল্পীরও আত্মপ্রকাশের একটি ভিন্ন পথের নির্দেশ তৈরি করে দেয়। আমার মতে, ঠিক তখনই শিল্পীর সৃষ্টিতে বিমূর্তিক একটা আঙ্গিক প্রবেশ করত শুরু করে। সাধারণ মানুষকে তখন, আইন্সটাইনের চতুর্মাত্রিক বাস্তবতার মতই, শিল্পীর বিমূর্ত চিন্তার সাথে, কথাশিল্পীর বিমূর্ত গল্পকাহিনী ও চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত, এমনকি অভ্যস্ত, হয়ে উঠতে হয়। এবং এভাবেই কালে কালে গড়ে ওঠে একটি ভিন্ন রুচি ও মনের প্রজন্ম যারা সৃষ্টির বহিরাবয়ব দেখে তার মর্ম অনুধাবন করার চেষ্টা করবে না, বরং বিমূর্ত রূপগুলোই তাকে আকৃষ্ট করবে বেশি। তখন হয়ত শিল্পীর বিমূর্ত, ভাবাশ্রয়ী কাজগুলোই স্বাভাবিক মনে হবে মানুষের।
শেষমেশ একটা কথা চিরসত্যের আকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তৃষিত হৃদয়ের দ্বারপ্রান্তে----বাস্তবে যা সম্ভব নয় কল্পনার রথে করে মানুষ সেখানেই যেতে চাইবে বারবার, এবং সেই আকুলতাকে নিরসণ করবার অন্যতম পথই হল কথাশিল্পীদের তৈরি কাল্পনিক জগত, যত বিমূর্তই হোক সেজগত----আধুনিক মানুষ বরং সেই বহুমাত্রিক ছবির সাথেই অধিকতর সখ্য বোধ করতে পারবে।
বই লিখে আগেকার যুগে যেমন অনেকেই জীবিকা অর্জন করতেন এখন হয়ত সেটা সম্ভব হবে না। কেউ কেউ পারবেন, যারা যুগের সঙ্গে পা রেখে চলতে দ্বিধা করবেন না, যারা ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্ন মাধ্যমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারবেন সহজেই, বিশেষ করে যারা আধুনিক মনের চাহিদাকে দরদ দিয়ে বুঝতে চাইবেন। বাজারে এখনো বই বেরুচ্ছে, অনেক লেখক নিজের কষ্টার্জিত পয়সা খরচ করেই বই প্রকাশ করছেন যার পাঠক হয়ত তাদের ব্যক্তিগত গোষ্ঠীর বাইরে বড় একটা নেই। সেগুলো সম্ভবত বইয়ের দোকানের বারান্দার টেবিলেও স্থান পাবার যোগ্য নয়। ওরকম আবর্জনা সাহিত্যের বাইরেও আছে ঢের----বিজ্ঞানে, গণিতে, দর্শনে। কিন্তু সেগুলোকে বাদ দিয়ে অনেক বই থাকবে যার আবেদন ‘এনা কেরেনিনা’র মতই অম্লান থেকে যাবে যুগ যুগ ধরে। সমূর্ত বিমূর্ত যাই হোক মহৎ সৃষ্টির একটা নিজস্ব জ্যোতি আছে যা মানুষের সহজাত নিঃসঙ্গতাকে আলোকিত করে রাখবে। ক্ষুধিত হৃদয়ের খোরাক জোগানোতে ভালো বইয়ের সঙ্গে আর কিসের তুলনা হয় বলুন তো।