'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় বঙ্কিম একবার লিখেছিলেন যে "দৃশ্যকাব্য সচরাচর কথোপকথনেই রচিত হয় এবং রঙ্গাঙ্গনে অভিনীত হইতে পারে, কিন্তু যাহাই কথোপকথনে গ্রন্থিত এবং অভিনয়োপযোগী, তাহাই যে নাটক বা তচ্ছেনীস্থ, এমত নহে। এ দেশের লোকের সাধারণতঃ উপরোক্ত ভ্রান্তিমূলক সংস্কার আছে। এই জন্য নিত্য দেখা যায় যে, কথোপকথনে গ্রন্থিত অসংখ্য পুস্তক নাটক বলিয়া প্রচারিত, পঠিত এবং অভিনীত হইতেছে। বাস্তবিক তাহার মধ্যে অনেকগুলিই নাটক নহে।" এই সব কথাবার্তা থেকে এটা এক প্রকার স্পষ্ট বোঝা যায় যে, বঙ্কিমের নাটক সম্পর্কে যথার্থ ধারণা ছিল। উপযুক্ত শ্রোতা, অভিনেতা আর দর্শকের অভাবে তিনি নাট্যচর্চায় মন দেন নি। কালের সীমারেখা ঘুচিয়ে দিয়ে সাম্প্রতিক কালের বাংলাভাষার জনপ্রিয় নাট্যকার ব্রাত্য বসুর সঙ্গে বঙ্কিমের একটা জমজমাট সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করলে বঙ্কিম নাট্যচর্চাকে ব্রাত্য করে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। আর তাহলে অভিন্নহৃদয় বন্ধু দীনবন্ধু মিত্র তাঁর নাট্যচর্চায় স্বক্ষেত্রে যোগ্য সাহিত্যিক প্রতিযোগী খুঁজে পেতে পারতেন হয়তো। 'হা নাটক যো নাটক' বলে উনিশ শতকের নাট্য অনুরাগীর দল মঞ্চ সাজিয়ে নাটকের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে থেকে বঙ্কিম উপন্যাসের অযোগ্য নাট্যরূপ দিয়ে কাজ চালানোর মতো ব্যবস্থা করতেন না। তাতে হয়ত বাঙালির নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে বেশ খানিকটা রদবদল ঘটে যেত, সে তো গুড়ে বালি। অলীক স্বপ্ন কল্পনামাত্র। তাবড় তাবড় পণ্ডিত সমালোচকেরা হয়ত এই প্রলাপবাক্য শুনে নিন্দামন্দ করে বুঝিয়ে দিতে পারেন যে বঙ্কিম থেকে ব্রাত্য — সাহিত্যের ও সামাজিক ইতিহাসের ফলশ্রুতি মাত্র। উৎপল দত্তের নাট্য রচনার পর এ দেশের প্রথিতযশা দু চারটি নাট্যগোষ্ঠী নাট্য রূপান্তরের চর্চায় ঝুঁকেছিলেন। তার বড় একটা কারণ ছিল সময় উপযোগী নাটকের অভাব। তারপর আশির দশকে বাংলা নাট্যসাহিত্য সমৃদ্ধ হল মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র - এঁদের নাট্যচর্চায়। আর ছিলেন বাদল সরকার এবং আরও অনেকে। স্মৃতিতে ধারণযোগ্য নাটক এঁরা নিশ্চয়ই রচনা করেছেন এবং এ বিষয়ে সহমতের অভাব হবে না। সাম্প্রতিক কালের নাট্যচর্চার বিবর্তনে ব্রাত্য বসু একটি জাম্পিং ঝপাং। কেননা বাংলা নাটকের অনেকখানি পরিবর্তন ঘটল তাঁর কলমের জোরে। ব্রাত্য বসুর প্রথম নাটক দেখি 'অশালীন'। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে নাটকের এরকম একটি নাম এবং দর্শকের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসময় অভিব্যক্তির চোরাটান আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল কোনো এক সন্ধ্যায় অকাদেমিতে 'অশালীন' অভিনয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে। তারপর 'অরণ্যদেব', 'মুখোমুখি বসিবার', 'শহর ইয়ার', 'উইঙ্কল টুইঙ্কল', 'ভাইরাস এম্', 'সতেরোই জুলাই' এবং আরো নানা নাটক রচনা পরিচালনা ও অভিনয়ে ব্রাত্য স্বমহিমায় ভাস্বর এবং তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে দ্রুত। কিন্তু এত সব কথার পরে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে ব্রাত্য বসু বাংলা নাট্যচর্চায় এবং তার মঞ্চায়নে আদৌ কি বড়সড় কোনো পরিবর্তন আনলেন? সমকালে থেকে কারও প্রতিভা আর দক্ষতা বিচার করা বড়ো কঠিন ব্যাপার। কেননা সেই কালের সঙ্গে আমাদের সব ভাললাগা মন্দ লাগা, আবেগের প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তির ঝোড়ো উচ্ছ্বাস থাকে জড়িয়ে মিশিয়ে। তাছাড়া ক্ষুদ্র মনুষ্যজন্মে সাধ্য কি যে মহাকালের বিচারের অমোঘ কঠিন বিধানের মধ্যে নিজের লম্বা নাকটি গলিয়ে দিয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করার। তবে একথা তো অনস্বীকার্য ব্রাত্য বসু নতুন নাটক অভিনয় আর প্রযোজনা করলে এ পোড়া বাংলাদেশে আলোচনা, প্রতি আলোচনা এবং বিতর্কের ঝড় ওঠে। কফি হাউসের উদ্দাম আড্ডায় কিংবা ছুটির দিনের প্রভাতী চায়ের আয়োজনে। ব্রাত্যর নাটক আর তার অভিনয়ের সম্পর্কে দু চারটি মন্তব্য চায়ের টেবিল ছুঁয়ে যায়। একথাও বলা বোধহয় পুরোপুরি ভুল হবে না যে প্রকাশকরা বাংলা নাটক সহজে ছাপতে চান না। ব্রাত্যর নাট্যগ্রন্থ তার ব্যতিক্রম। হয়ত এই নাট্যগ্রন্থগুলো আগামী দিনের তরুণ নাট্যকারদের নাট্যরচনার পথ প্রশস্ত করে দেবে, কেননা ব্রাত্য বসুর নাটক ক্রমশঃ বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পরম সমাদর লাভ করে চলেছে। ড্রামাটিস্ট আর প্লে রাইটের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাঁর নাটকগুলি মঞ্চসফল, রচনায় আছে সাহিত্যরস এবং সাহিত্যের ইতিহাসে স্থান পাবার যোগ্য। ব্রাত্যর ভাষায় - 'আমরা যেভাবে বাঁচি, এই তথাকথিত middle class security এর মধ্যে আসলে এই বাঁচাটার কোনও মানে নেই। আমরা basically অসাড় senseless.' এর থেকে অন্যরকম বাঁচে যারা, তারা ঘুরে ফিরে আসে তাঁর নাটকে। তাঁর নাটকে দেশকালপাত্রের নির্দিষ্ট ছাঁচ থাকলে ব্রাত্য তা ভেঙে বেরিয়ে আসেন বার বার।। তাঁর নাটক পড়ে ও দেখে দর্শক এক বিপন্ন বিস্ময় অনুভব করেন। ব্রাত্যর মনে একটা গভীর আশা এই যে 'ঘোষণা নয়, দাবি নয়, চিৎকার নয় - কিন্তু এমন একটা কাজ যদি তৈরি করে যেতে পারি যে কাজটায় বহু মানুষ তাতে আকৃষ্ট হবেন এবং আসবেন এবং একটা সময় সত্যিই একটা বাবা-মা সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে আমার ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ার হবে, হোক, হতে পারল না, থিয়েটার করবে .....।' (মুখোমুখির ব্রাত্য বসু, আলাপে : সুমন দে (এ. বি. পি. আনন্দ, ২৮শে মে, ২০১৩ - প্রকাশ ব্রাত্যজন নাট্যপত্র, পঞ্চম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১৩)
'কালিন্দী ব্রাত্যজন' ব্রাত্য বসুর নিজের নাট্যদল। আর তাদের প্রথম প্রযোজনা 'রুদ্ধসংগীত'। দেবব্রত বিশ্বাসের জীবন এবং তাঁর সমকালে প্রশাসন এবং রাজনীতির সঙ্গে লড়াই এর স্তর-পরম্পরায় এই শিল্পীর ক্রমশঃ একা হয়ে যাওয়ার কাহিনী। এই নাটকের সময়কাল ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৯। নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০৯ সালের ২০শে মার্চ। শিল্পীর সঙ্গে ব্যক্তি তথা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক, শৈল্পিক প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক এবং গণমাধ্যমের গতায়াত বাঙালি সমাজে কিভাবে প্রতিফলিত হয় এ নাটকে আছে তার প্রতিফলন। নাট্যকারের মতে 'রুদ্ধসংগীত আমার কাছে সময়রূপ সাগরের পুনরাবৃত্তি, ব্যক্তি বিশেষের জীবনচরিত নয়।' আসলে ব্রাত্য বসুর নাটক গুলির মধ্য দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে সময়ের স্রোত। কখনো নতুন সময়, কখনো বা পুরাতন। কখনো বা নতুন আর পুরাতনে মিলেমিশে সময়ের কোলাজের জলছবি হয়ে ওঠে তার নাটক। 'রুদ্ধসংগীত' একজন শিল্পীকে ব্রাত্য করে দেওয়ার কাহিনী। মানুষকে ব্রাত্য করে দেওয়ার ব্রত নিয়ে চলেন যাঁরা, 'রুদ্ধসংগীত' হত তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত। 'শিল্পীর কোনও ধর্ম হয় না, জাত হয় না, জাতশিল্পী কোনও বিশেষ দেশকালের ধরাছোঁয়ার বাইরে'। দেবব্রত বিশ্বাসের নিজের কোনও প্রতিষ্ঠানের দরকার ছিল না। তিনি নিজেই ছিলেন এক জীবন্ত প্রতিষ্ঠান। প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তন ছেড়ে তিনি গানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সকলের মাঝে। 'রুদ্ধসংগীত'-এর প্রত্যেক দৃশ্য সেই সত্যকে পূর্ণ অর্থবহ করে তুলেছে, নাট্যকারের ভাষায় - 'বুঝতেই পারছেন আমি দেবব্রত বিশ্বাসের কথা বলছি। জর্জ বিশ্বাস। এ কথা ঠিক, আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে বর্তে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছি, যাঁরা চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে, তাঁদের সংখ্যা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু এই পূর্ব ভারতের নরখণ্ডে যাঁরা আছেন এবং যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্যের মধ্যে হয়ত এটাই অন্যতম — গায়ে গতরে বড় হয়ে ওঠার জন্য এবং শিল্প কী তার মানে অল্প করে বুঝতে হলে তাঁর গান শোনা অবশ্যকর্তব্য। 'রুদ্ধসংগীত' নাটকটি লিখে যে প্রযোজনাটি করা হয়েছিল তার পিছনে ছিল পূর্বপুরুষের প্রতি ওই অকথিত ও অব্যক্ত ঋণ। তার নাটককার ও নির্দেশক সেখানে নিমিত্ত মাত্র। আরও বহু মানুষের অভিপ্রায়, স্মরণ, চোখের জল, আশীর্বাদ - এ সবই এসে মিশেছিল থিয়েটারের শব্দ ও দৃশ্যের মোহনায়।' ('আমাদের জর্জদা' - ব্রাত্য বসু; আনন্দবাজার পত্রিকা, ২০শে আগস্ট, ২০১১) 'রুদ্ধসংগীত' পূর্বপুরুষের প্রতি নাট্যকারের একপ্রকার স্মৃতিতর্পণ। এই নাটকটি দর্শকের ভাল লাগুক আর না লাগুক, সেই অঞ্জলিপূর্ণ শ্রদ্ধা নিবেদনকে অসম্মান করার কোনও উপায় রাখেন নি নাট্যকার।
অতি সাম্প্রতিক কালের ইতিহাসের ইঁট গেঁথেছেন যাঁরা, তাঁরা এই নাটকের কুশীলব। এখনও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা এদের দেখেছেন, কথা বলার সঙ্গী হয়েছেন। অতি সতর্কতার সঙ্গে এ নাটকে তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহীকৃত। এখানে আছেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি মিত্র, জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, সন্তোষ কুমার ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার এবং আরও অনেকে, সংস্কৃতির জগতের ও রাজনীতির মঞ্চের এসব ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে বাঙালির মনে একটা 'ইমেজ' তৈরি হয়ে গেছে, সদ্য সমাপ্ত ইতিহাসের স্তর থেকে উঠে আসা এই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করা সুকঠিন, সেখানে 'ব্রাত্যজন' সুষ্ঠুভাবে এ দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষতঃ সন্তোষকুমার ঘোষের চরিত্রে ব্রাত্য বসুর অভিনয় অবিস্মরণীয়। ব্রাহ্মণ্য সমাজের কুক্ষিগত রামায়ণ, মহাভারত আর পুরাণের কাহিনিকে কথকতার মাধ্যমে কথকরা করে তুলেছিলেন জনপ্রিয়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুনের বেড়াজালে বন্দী রবীন্দ্রসংগীতকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। নেহাত ছাপোষা মানুষের কাছে তাঁর কণ্ঠের রবীন্দ্রসংগীত হয়ে উঠল কোন্ অগমপারের দূত। 'রুদ্ধসংগীত' নাটকে ব্রাত্য রবীন্দ্রসংগীতের প্রচুর ব্যবহার করেননি। তবু অভিনয়, প্রযোজনা আর নাট্যরচনার কুশলতায় গানের আবহ ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। দেবব্রত বিশ্বাসের ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদারের অভিনয় অনবদ্য, ১৯৭১ খ্রী: গান রেকর্ড বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে গোটা দশক জুড়ে নিজের বৈঠকখানা কাম সংগীতচর্চার ঘরটিতে ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের দিন রাত ২৪ ঘন্টার আবাস। যাঁরা সেই ঘরটিতে মাঝে মাঝে আড্ডায় যেতেন, 'রুদ্ধসংগীত' নাটকে মঞ্চের একদিক জুড়ে সেই ঘরটির মঞ্চায়িত রূপ দেখে হয়ত মনে পড়বে অনেক পুরনো স্মৃতি। মান অভিমান, তাস, চা পান আর গান, অতিথি অভ্যাগতর আপ্যায়নে এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর স্বভাবের যে নানা shade, মুখের রেখায়, মনের আনাচে কানাচে যে নানা আঁকিবুকি আর কাঁপন - এ নাটকের দ্বিতীয়ার্ধে দেবশঙ্করের অভিনয়ে তা দর্শকের মন ছুঁয়ে গেছে বারবার। দেবশঙ্কর হালদারের কাছে মঞ্চরসিকদের প্রত্যাশা আরও বহুগুণ বেড়ে গেল। কুশলী সংলাপ আর দক্ষ অভিনয়ে এই নাটকে নানা নিথর মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি হিসাবে সন্তোষকুমার ঘোষের ভূমিকায় ব্রাত্যর কঠিন, হিমশীতল উপস্থিতি, নীচু গলায় দৃঢ় উচ্চারণ দর্শকাসনে পিন-ড্রপ সাইলেন্স সৃষ্টি করে। মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের ভূমিকায় দোয়েলপাখি সরকারের অভিনয়ে, কণ্ঠস্বরের প্রক্ষেপণে আর নীরব চাউনিতে মঞ্চে অতল, গভীর দু একটি মুহূর্তের সৃজন দর্শক বহুদিন মনে রাখবেন। হাসপাতালে অসুস্থ দেবব্রত বিশ্বাস আর সুচিত্রা মিত্রের সাক্ষাৎ, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকারের সঙ্গে এই অপরাজেয় কন্ঠশিল্পীর কথোপকথনের ভাঁজে ভাঁজে মুহূর্তের নিটোল নীরবতায় অনেক না-বলা কথার আভাস মেলে। একেবারে শেষ দৃশ্যে নেপথ্য সংগীত হিসাবে বাজতে থাকে 'আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান' আর সে সময়ে সকলকে চমকে দিয়ে এই রবীন্দ্রসংগীতের উপর চড়া সুরে বেজে ওঠে মুক্তির উল্লাসের সিম্ফনিসম উদাত্ত সুরের ঝংকার। 'রুদ্ধসংগীত' হয়ে ওঠে উচ্ছ্বাসের জয়গাথা। মুক্তির সংগীত। দুরন্ত ক্ষোভে আর অভিমানে আপন আত্মজীবনী 'ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত'-এর শেষে দেবব্রত বিশ্বাস লিখেছিলেন - 'রবীন্দ্রসংগীত জগতে আমি হয়ে গিয়েছিলাম 'হরিজন' সেই হরিজন হয়েই আমার জীবনের কয়টি দিন কাটাতে হবে। শুনতে পাই হরিজনদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চারদিকে নানা চেষ্টা চালানো হচ্ছে কিন্তু রবীন্দ্রসংগীত জগতে আমার মতো হরিজনকে একটু ঠাঁই করে দেবার চেষ্টা হবে কিনা জানি না।' জীবৎকালে যে সুবিচার পাননি দেবব্রত, এই শিল্পীর কাছে সেই তাবৎ মানুষের তাবৎ ঋণ শোধ করে দিয়েছেন নাট্যকার ব্রাত্য। এই নাটকে সৌমিক পিয়ালীর মঞ্চ অসাধারণ। সুদীপ সান্যালের আলো, দোয়েলপাখি দাশগুপ্তের পোষাক পরিকল্পনা আর সুকল্যাণ ভট্টাচার্যের নৃত্যভাবনা প্রশংসনীয়। চার বছর ধরে এই নাটকটি তুমুল জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনয় হচ্ছে।
ব্রাত্য বসুর সাম্প্রতিক নাট্য প্রযোজনা 'সিনেমার মতো'। এই নাটকের একটি নিটোল কাহিনিবৃত্ত আছে। গত শতকের সাতের দশকের কাছাকাছি মিস্ ক্যালকাটা হয়েছিলেন জয়ন্তী ভদ্র, ওই খেতাব পাওয়ার পর তরুণ উদ্যোগী ব্যবসায়ী জয়জিৎ দত্তগুপ্তর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মহানায়ক উত্তমকুমারের বিপরীতে জয়ন্তীকে নায়িকা হিসাবে পরিকল্পনা করে জয়জিতের দুটি ছবি প্রযোজনার সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হয় না, উত্তমকুমার মারা যান। এর মধ্যে এই দম্পতির দুটি ছেলের জন্ম হয় অভিজিৎ ও পৃথ্বীজিৎ।
সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে জয় দত্তগুপ্ত মারা গেলে সে ঘটনার বেশ কয়েক বছর পরে জয়ন্তী তার থেকে কয়েক বছরের ছোট ফ্রি-লান্সার সাংবাদিক দীপায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিবাহ করে। নাটক শুরু হলে দেখা যায় দীপায়ন স্ত্রীকে কেন্দ্র করে বাংলা সিনেমার চার দর্শকের বিবর্তনের ইতিহাসভিত্তিক তথ্যচিত্র তুলতে ব্যস্ত। বড় ছেলে অভিজিৎ বার সিঙ্গারকে বিয়ে করে বম্বে চলে যায়। দূরদর্শনের সিরিয়ালের নাম করা অভিনেত্রী জয়ন্তীর সঙ্গে তার বড় ছেলের তিন বছর যোগাযোগ নেই। ছোটছেলে পৃথ্বী মেগা সিরিয়ালের স্ক্রিপ্টরাইটার। তার বান্ধবী মৈত্রেয়ী সিরিয়ালের অন্যতম অভিনেত্রী। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগাম জানান দিয়ে ২০১৩ সালের ১লা জানুয়ারী অভিজিৎ আবার ফিরে আসে এই পরিবারে আর সেখান থেকে শুরু হয় কাহিনির নতুন মোড়। তার আবির্ভাবের আগে মঞ্চে বার বার বাজতে থাকে অভিজিতের ফোন। অবশ্য এই ফোন কল যে বাড়ির বড় ছেলের তা দর্শক এবং নাটকের বাকি চরিত্ররা জানতে পারে নাটক অনেকখানি এগিয়ে যাওয়ার পর। এই নাটকে আছে সিনেমার নানা তথ্য আর টেকনিক, নাট্যকারের ভাষায় দীপায়ন যেন সমান্তরাল ধারার বাংলা ছবি, অভিজিৎ মেইন স্ট্রিম বাংলা সিনেমা, পৃথ্বীজিৎ আগামী দিনের বাংলা সিনেমার প্যাটার্ন আর জয়ন্তী ও মৈত্রেয়ী যেন ওই চারদশকের বাংলা সিনেমার বিবর্তনের প্রতিচ্ছবি। 'সিনেমার মতো' এমন একটি নাটক যা ফিল্মের শিল্পকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাছাড়া এ নাটকের টাইটেল মিউজিক, ক্রেডিট্স, মঞ্চে স্ক্রিনে জনপ্রিয় সিনেমার টুকরো দৃশ্য দেখানো এসব বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে এখানে। জয়ন্তী ও অভিজিৎ--মা ও ছেলের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন দর্শক টানটান হয়ে অনুভব করেন। জয়ন্তীর বড় ছেলে অভিজিৎ আপাদমস্তক ব্র্যাণ্ডের বিজ্ঞাপন। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শত নামের মতো সে বিভিন্ন ব্র্যাণ্ডের গুণকীর্তনে বিভোর। এ নাটকে সে তার ভাইকে বলে 'ব্র্যাণ্ড ব্র্যাণ্ড। ব্র্যাণ্ড ছাড়া কিচ্ছু পরবি না, সে দাম যাই হোক। জুতোটা দেখ আমার ভালো করে। মোচি, মোচি। সোলটা দেখ। সাড়ে পাঁচ দাম আছে বাচ্চু।' কিংবা এ ধরনের আরো নানা সংলাপ আছে এ নাটকে। অভিজিৎ ঝোড়ো হাওয়ার মতো উড়ে এসে পড়েছে জয়ন্তীর সংসারে। হিম হাড় করা শীতে হলুদ পাতা টুপটাপ খসে যাওয়ার মতো অভিজিৎ গানের টুকরো কলি ভাঁজে, ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে, মায়ের সঙ্গে তীব্র অভিমানী বাদানুবাদে মত্ত হয়। তবু ভিতরে ভিতরে নিরন্তর বহমান গভীর নিতল অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার প্রাক্ মুহূর্তে অভিজিতের কণ্ঠে শোনা যায় বিপন্ন হাহাকার। সম্ভাব্য মৃত্যুর মাঝে সে শেষ আশ্রয় খুঁজে নেয়। তীব্র সেন্সিটিভ অভিনয়ে ব্রাত্য নিপুণ ছবি আঁকিয়ের মতো অভিজিতের নির্ভেজাল মস্তানী আর নিরাশ্রয় শূন্যতার বুকভরা বেদনাকে পৌঁছে দেন পাঠকের মরমে। অভিজিতের বড়ো হয়ে ওঠা আর অতীত জীবনচর্যার খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে আছে মৃত্যু উপত্যকায় পৌঁছে যাওয়ার অশনিসংকেত। যৌবনের শেষ রক্তিমাভাটুকু হারাতে চায় না কোনো মূল্যে জয়ন্তী দত্তগুপ্ত।
অনসূয়া মজুমদারের অভিনয়ে সে আকূতি প্রকট। জয়ন্তীর ম্যানারিজমের অন্তরালে আছে মাতৃহৃদয়ের দমচাপা আর্তনাদ যা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে এ নাটকে। স্ত্রীর প্রথম পক্ষের সন্তান অভিজিৎ এ-নাটকে দীপায়নকে বারবার 'স্যাঁতা পাঁউরুটি' নামে অভিহিত করলেও দীপায়নরূপী পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয় মোটেও স্যাঁতানো নয়। বরং দত্তগুপ্ত পরিবারে তার অবস্থান ঠিক যে কোথায়, সে নিয়ে সামান্য অস্বস্তিকর অসহায়তা পীযূষের অভিনয়ে প্রকাশমান। দূরদর্শনে সিরিয়ালের অভিনেত্রী মৈত্রেয়ীর ভূমিকায় পৌলোমী বসু তাঁর অভিনীত চরিত্রটির মতো নিজের কাজের প্রতি আদ্যোপান্ত সৎ। বিশ্বস্ত এবং শতকরা একশোভাগ ডেডিকেটেড। মঞ্চে পৌলোমী বসুর আবির্ভাব বেশিদিন নয়। তবু তার মধ্যে টানা অভিনয়ে তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। পৃথ্বীজিৎ চরিত্রে কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী যথাযথ।
পরিচালক ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় মঞ্চের প্রতিটি ইঞ্চি জমিকে ব্যবহার করেছেন চরিত্ররা। নাটক দেখতে দেখতে মনে হয় মঞ্চে কোনো নিপুণ চিত্রশিল্পী রঙে রেখায় চলমান ত্রিমাত্রিক ছবি এঁকে চলেছেন। মঞ্চের একটু ওপরের দিকে সিনেমার প্রোজেকশনের ব্যবহার, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে গানের ব্যবহারে বাংলা সিনেমার বিবর্তনের প্রকাশ, চরিত্রদের কথায় বার্তায় সিনেমার তথ্য পরিসংখ্যানে দর্শক মাঝে মাঝে এই ভুলভুলাইয়ায় ঢুকে পড়তে পারেন যে সিনেমা বিষয়ে একটা ডিসকোর্সের অংশীদার হতে এসেছেন তিনি। সুদীপ সান্যালের আলো, আতাহার আলমের মঞ্চভাবনা, দিশারী চক্রবর্তীর আবহ, রুমা পোদ্দার ও সোমা নন্দীর পোশাকভাবনা এ-নাটকের উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বিশেষত মঞ্চভাবনায় একটি বসার ঘর, বারান্দা ও অনির্দেশ্য ভিতরের ঘরে নাট্যঘটনার বুনন তৈরি হয়েছে ক্রমাগত। অভিজিতের সম্ভাব্য আত্মহত্যা এই নাটকের চরিত্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে হয়ত প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করে। একটি নিখাদ ছোটগল্পের মতো 'শেষ হয়ে না হইল শেষ'। এখান থেকে শুরু হতে পারে আর এক নতুন নাটক। কবিতা আর গদ্যের উত্তাপ বিনিময়ে এতদিন যে নাট্যভাষা দেখা গেছে ব্রাত্যর নাটকে নাট্যকার তা দেখে দূরে সরে কবিতার মায়াভরা শব্দকে ঝেড়ে ফেলে নতুন নতুন শব্দের ব্যবহারে এক চাঁচাছোলা ভাষা সৃষ্টি করেন এ নাটকে।
'রুদ্ধসংগীত' আর 'সিনেমার মতো' দুটি নাটকের মধ্যে আছে বিষণ্ণতার হাতছানি, ট্র্যাজিকবোধ। সাম্প্রতিককালে একটি সাক্ষাৎকারে নাট্যকার বলেছেন — 'সারাজীবন আসলে আমি একটা নাটকই লিখে চলেছি।' 'রুদ্ধসংগীত' কিংবা 'সিনেমার মতো' তাহলে তার সেই সুবিশাল একক নাটকের অংশ মাত্র। পেশায় অধ্যাপক, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু শতসহস্র কাজের ফাঁকে ফিরে ফিরে আসুন নাট্যরচনা, অভিনয় আর প্রযোজনায়, প্রলম্বিত হোক তাঁর একক নাটকের সূত্রবদ্ধতা। আমরা বাঙালি দর্শক আগ্রহভরে সে অপেক্ষায় রইলুম।