ভাষা কি মাত্র এক যন্ত্রসম, প্রকৌশল - যাকে চালনা করা বা যার ব্যবহার আয়ত্ব করাতেই সফলতার চাবিকাঠি রয়েছে লুকিয়ে? প্রায়ই শুনি 'বিনা কষ্টে ভাষা শিক্ষা' অর্থাৎ কিনা Bangla without pains গোছের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও তার বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে গাছের গুঁড়ি আর ল্যাম্প পোস্ট। অনেকে বই লেখেন 'বাংলা সহজ পাঠ' Bengali Made Easy অথবা 'সরল বাংলা শিক্ষা' এই নামে; আবার কোথাও দেখি বাংলা দ্রুতপাঠ (Rapidex Bangla), প্রভৃতি। নামকরণের উদ্ভাবনী শক্তি ও নামের বাহার দেখে সন্দেহ জাগে যে তাহলে বোধ করি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, বিজলিচালিত করাত কিংবা যন্ত্রগণকের মতই ভাষাকে বাগে আনার কিছু শাশ্বত ও বহুপরীক্ষিত পদ্ধতি রয়েছে, যাকে বশ করলেই বাগ্মিতা আয়ত্বে এসে যাবে। কখনও কখনও এও মনে হয় যে ছক কাটা, রং মেলানো ও তুলির টানের কৌশল শিখতে যেমন কিছুটা ভিতরের তাগিদ, কিছুটা অনুশাসন ও বাকিটা অভ্যাস ও মার্গদর্শন লাগে, ভাষার শিল্পকে আয়ত্ব করতে গেলেও বোধ করি তেমনটাই দরকার।
অন্যপক্ষে অনেকেই ভাষাকে মাত্র একটি স্বচালিত সাধন মাত্র মানতে নারাজ। হয়তো তারা গদ্যের 'কড়া হাতুড়ি' কিংবা 'কাব্যবাণে শরভেদ' এই ধরনের কথা আক্ষরিক অর্থে বলেন না। বরং তারা মনে করেন মানুষ, গাছ, পাখি ও অণু-জীবাণুদের মতো ভাষাও একটি সজীব সতেজ সুমনস্ক সপ্রাণ উপস্থিতি, তা আদৌ নিষ্প্রাণ রসহীন বস্তু নয়। এদের সমর্থকেরা ভাষার জন্ম, মৃত্যু ও ক্ষয়ের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। সারা পৃথিবী জুড়ে যে ভাষাদের জগতে ভাষাঘাত অথবা ভাষার প্রাণবিলোপ একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা রূপে রাষ্ট্রকূটের সামনে দেখা দিয়েছে যাকে আমরা ইংরেজিতে 'Language Endangerment' নাম দিয়েছি, তার মূলেও রয়েছে এই বিশ্বাস যে যেমন অন্যসব প্রাণীর ক্ষেত্রে 'জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে'র সূত্র কাজ করে, সপ্রাণ যেকোন ভাষার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। এটা অন্য ব্যাপার যে কোনো কোনো ভাষা সংরচনার নিরিখে না হোক অন্তত নামের ও পরিচয়ের দিক থেকে একই ঐতিহ্য বহুদিন ধরে বজায় রাখতে পারে আর এও সত্যি যে কোনো কোনো ভাষা সহজেই রণে ভঙ্গ দিয়ে লুপ্তির হাতে করে আত্মসমর্পণ।
ভাষার জন্ম মৃত্যু মানলে বার্ধক্য ও জরার কল্পনা আপনিই এই ভাবনার সঙ্গে জুড়ে যায়। ভাষাজীবনের জৈবিকতায় যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁদের অনেকে ভাষাকে কালের মাত্রায় সংযোজিত করে দেখতে ভালোবাসেন; অর্থাৎ কিনা তারা সহজেই ভাষার অতীত, ভাষার এই মুহূর্ত ও আগামী রূপের কথা বলে থাকেন। সহজে বলতে গেলে এরা অতীতকালে সংস্কৃত ও পারসিকের দুমুখী চাপে বাংলাকে হৃতগৌরব প্রাকৃতজনের ভাষারূপে দেখতে পেয়েছেন; যা নিয়ে সুনীতি কুমার ও শহীদুল্লাহ থেকে পবিত্র সরকার এবং আব্দুল হাই সবাই বিস্তারে বা সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন, পঞ্চাশের দশকে চার্লস্ ফার্গুসন এই বিষয়েও মুখর আবার ষাটে এসে মুনীর চৌধুরী সত্তরে রফিকুল ইসলাম ও হুমায়ুন আজাদ কিংবা আশির দশকের গোড়ায় মনিরুজ্জামান, আমি বা মনসুর মুসা কিংবা প্রবাল দাশগুপ্ত বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যে চিন্তা ভাবনা অথবা দুর্ভাবনা কথায় বা পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি সেসব দেখলে মনে হয় ভাষা বুঝি আমার আপনার মতো, আর পাঁচটা জীবের মতই ইতিহাস ও জ্যোতিষের পক্ষে সহজলভ্য ও লোভনীয় বিষয় বিশেষ। যেসব ভাষায় উত্থান-পতন, আবাহন-বিসর্জন কিংবা বজ্র-বিদ্যুৎ-বর্ষাপাত বিশেষ হয়নি, যারা কালের প্রবাহে নিস্তরঙ্গ সহজতোয়া নদীর মতন ভেসে চলেছে ও বেঁচে আছে তাদের নিয়ে আলোচনার অবকাশ কম থাকে। আবার যে ভাষার ভাষীরা বা বাক্-সমাজের সদস্যরা বিশেষ সচেতন নন, তাদের বাণী নিয়েও তেমন কিছু বলার সুযোগ থাকে না। কিন্তু যারা ভাষার জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ও বারবার বিভিন্ন দশকে শতকে পরীক্ষা দিতে থেকেছেন যেমন বাংলাদেশ বা অসমের বাংলাভাষার শহীদরা কিংবা শ্রীলংকার তামিল প্রেমীরা অথবা পৃথিবীর অজস্র দেশে মাতৃভাষার সৈনিকেরা - তাঁদের মানসিকতা ও মনোবেদনা নিয়ে বলার অবকাশ অনেকখানি আছে। আজকে আমরা যে স্বাধীন ভাষাদেশে দাঁড়িয়ে স্বজাতি, স্বীয় সংস্কৃতি, স্বকীয় সৃষ্টি ও ভাষাশিল্পের ভুবনে আলোচনা করতে চলেছি, তার পিছনে যেসব লেখক-কবি ভাষা ভাবছেন তাঁদের যেমন ভূমিকা রয়েছে, তেমনি গুরুত্ব আছে সেইসব স্বরগ্রামী, লিপি-প্রেমী, সৃষ্টিরযজ্ঞে সাধারণ পাঠক কথক বাচকদের যাঁরা অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণকে কেড়ে নিয়ে গঠিত করে এসেছেন সম্প্রীতি ও সংশ্লেষণের স্বরাজকে; যেমনটা ১৯০৫-এ এসে হয়েছিল, দমকা হাওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পথে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিভেদী শাসককুলের সরব বিরোধিতায়, তেমনি পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় এসে আমরা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে দেখেছি। আমরা যারা দুশ্চিন্তিত বিব্রত ও শোকাহত হয়ে বর্হিবিশ্ব থেকে তরুণ ও তাজা কিছু ভাষাভাষিদের বলিদানের কথা জেনেছি, পড়েছি বা বর্ণনা শুনেছি তারা হয়তো সময় সুযোগ এলে এর প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি ও যুগ্ম-সংগ্রামের সংকল্প তখনই করেছি যার প্রতিফল ৭১-এর যৌথ সংগ্রামে দেখা যায়।
কিন্তু ভাষায় ব্যক্ত না করতে পারা বা ভাবের তুলনায় ভাষার মধ্যে যে গহ্বর রয়েই যায়, প্রায় প্রতিটি স্বজনী ভাষাতেই, তার জ্বালা-যন্ত্রণাও কম নয়। যত এমন অভাবকে আমরা উপলব্ধি করতে পারবো এবং যত প্রয়াস হবে মাতৃভাষার এইসব অভাবপূরণের ততই সেই ভাষার প্রকাশ-শক্তি বাড়বে একথা আজ আমরা সবাই জানি। বস্তুত প্রায় প্রতিটি বাঙালি কবির মনের কথা কবিগুরুর চারটি পঙ্ক্তিতে ধরা পড়েছে 'মানসী' কাব্য-গ্রন্থ 'প্রকাশ-বেদনা' কবিতায়।
আপন প্রাণের গোপন বাসনা টুটিয়া দেখাতে চাহিরে হৃদয়-বেদনা হৃদয়েই থাকে ভাষা থেকে যায় বাহিরে।
ঠিক এর পরেই কবি ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, ভাষার এই অভাবী পৃথিবীতে আনন্দ ও ব্যথার বহিঃপ্রকাশ করা হয়ে উঠতে পারে না। কারণ
শুধু কথার উপরে কথা নিষ্ফল ব্যাকুলতা। বুঝিতে বোঝাতে দিন চলে যায় ব্যথা থেকে যায় ব্যথা।
এই সব ব্যথা ভবঘুরে মনকে নিয়ে বৃথা ঘুরে মরে প্রকাশ ভঙ্গির খোঁজে, শব্দের শরীর পাবে বলে; কবিবর বুদ্ধদেব বসুর 'বারোমাসের ছড়া'য় (১৯৫৬) আমরা প্রথমেই জানতে পারি এই সব ব্যথা ও ভাব যেন হাওয়াদের মতই।
'হাওয়াদের বাড়ি নেই, হাওয়াদের বাড়ি নেই নেই/নেইরে তারা শুধু কেঁদে মরে বাইরে'
এবং বাচনে ইচ্ছুক ভবঘুরে মনকে দেখা যায় -
বন্দর বন্দর, নগরের ঘনভিড়, অরণ্য, প্রান্তর, শূন্য তেপান্তর- সব পথে ঘুরেছি বৃথাইরে। (হাওয়ার গান, ১৯৫৫)
ফলে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে 'শেষ সপ্তক'-এ এসে রবীন্দ্রনাথ আত্মাভিমানের অখ্যাত ইতিহাস এবং প্রচ্ছন্ন আত্ম অবমাননার মূলে যে ভীরু লজ্জা রয়েছে লুকিয়ে সেই প্রসঙ্গে নিজেকে নিয়েই প্রশ্ন করেছেন -
এই অপরিণত, অপ্রকাশিত আমি, কার জন্যে, এ কিসের জন্যে? যা নিয়ে এল কত সূচনা, কত ব্যঞ্জনা, বহু ব্যথা বহুবেদনায় বাঁধা হতে চলল যার ভাষা, পৌঁছল না যা বাণীতে, তার ধ্বংস হবে অকস্মাৎ নিরর্থকতার অতলে...'।
কারণ রূপে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কবি বলেন যে গুণী মানুষ সাধারণত অপ্রকাশের পর্দা টেনেই কাজ করে থাকেন, ঠিক যেমন শিল্পী রাখেন অসমাপ্ত শিল্প প্রয়াসকে আড়ালেই, শুধু তার অভাব মাত্র টের পাওয়া যায় কিছু কিছু। যাঁরা ভাষা-শিল্পী যাদের তুলিকা চালিতা হয়ে শিল্পকৃতি সম্পূর্ণতা পায়, তাদের এইসব ভাষা তৈরি করে নিতে অকথ্য পরিশ্রম করতে হয়।
কোন শব্দশিল্পীকে বাংলা ভাষা যে কিভাবে ছুঁয়ে যায় হয়তো সামান্য একটি বিস্ময়সূচক চিহ্নে, কিংবা কিছু অবান্তর প্রগল্ভ প্রশ্নে, হয়তো বা শুধুমাত্র পরশে কিংবা চাহনিতে - বলা যায় না। এইরূপ একটা অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ জয় গোস্বামীর 'বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা'য় পাই যেখানে একই সঙ্গে দেশভাগ ভাষা বিভাগ থেকে শুরু করে বাংলা ছন্দ রাঙা আলো লেখা-কর্ম সর্বনাশ সবই বিধৃত কত সহজেই :
কে মেয়েটি হঠাৎ প্রণাম করতে এলে? মাথার ওপর হাত রাখিনি তোমার চেয়েও সসংকোচে এগিয়ে গেছি তোমায় ফেলে ময়লা চটি, ঘামের গন্ধ নোংরা গায়ে, হলভরা লোক, সবাই দেখছে, তার মধ্যেও হাত রেখেছ আমার পায়ে আজকে আমি বাড়ি ফিরেও স্নান করিনি স্পর্শটুকু রাখব ব'লে তোমার হাতের মুঠোয় ভরা পুষ্করিণী পরিবর্তে কী দেব আর? আমার শুধু দু-চার পাতা লিখতে আসা সর্বনাশের এপার ওপার দেখা যায় না কিন্তু আমি দেখতে পেলাম, রাঙা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সে-ছন্দ, সে-কীর্তিনাশা! অচেনা ওই মেয়ের চোখে যে পাঠাল দু'এক পলক বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা।
ভাষা দেশ ও কাল বিভাগ করেন রাজ পুরুষেরা, কিন্তু সর্বকালের জোড়া, সর্বভাষা ও আন্তরাষ্ট্রীয়তাবাদ এসব অবধারণা বেরোয় শিল্পীর সাহিত্যিকের ছাঁচ ও খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসার ফলশ্রুতি হিসেবে। এবং যারা শাসকের চোখ রাঙানি ও শাসনের জটাজাল থেকে বেরিয়ে এসে ভাষার পাশে দাঁড়াতে পারেন অথবা যাঁদের ইতিহাস এমন সুযোগ করে দেয় তারাই কবি আব্দুল হাকিমের মতো বলতে পারেন সাহস করে :
যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী। সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় না জানি।। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুড়ায়। নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ না যায়।। মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি। দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।।
হতে পারে এ কথা কবির অভিমান থেকে সঞ্জাত কিন্তু বাংলাকে যদি ধীর পদক্ষেপে চলমান চল-শক্তিমান অথচ শাস্ত্রীয় সাহিত্য ভাষা রূপে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় তাহলে এক ধাপ এগিয়ে বিচার করা দরকার যে আমরা কোন পথে এগুবো। কিন্তু কিছু কিছু ইঙ্গিত বিগত যুগের মহান লেখক শিল্পী ভাবুকেরা করে গিয়েছেন আর বাকিটা আমাদের ভাবতে বসতে হবে। দুই একটি ধারাও কর্মধারয়ের সন্ধান এখানে দেখা যেতে পারে। বাকিটা বসে স্থির করা দরকার।
সর্বপ্রথম আমাদের এই কথা স্থির করে নেয়া দরকার যে ইতিহাস ও কাল আমাদের নিশ্চিতরূপে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভিতর ভাগ করে দিয়েছে বটে; তবে ভাষার ভবিষ্যতের স্বার্থে এই দুই ভূভাগে বিস্ত্রস্ত বাংলাভাষার যুগ্মকে সাংস্কৃতিক পটভূমিতে এক অবস্থানে রাখতে হবে। পারস্পরিক সন্মান স্তরীয় আদান প্রদান ও সহজ সংযোগ প্রকরণ গড়ে তোলা দরকার যার ভিত এমন হবে যে রাজনৈতিক পরিবর্তনে তার বাঁধনটা শিথিল হয়ে যাবে না। মনে রাখতে হবে পূর্বে ও পশ্চিমে অন্য সবাই কিন্তু আমাদের এই বিভাজিত সত্তা অথচ অবিভাজ্য মানসকল্পের দিকে কখনও ঈর্ষায় কখনও কৌতুহলে তাকিয়ে আছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা ও পার্শ্ববর্তী কিছু ভারতীয় প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা যে বঙ্গভাষী সম্প্রদায় রয়েছে তাদের স্বীয় প্রদেশের সরকারের পটবদল ও পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের সত্তার পরিবর্তনের উপর যেন সাংস্কৃতিক সাহিত্যিক সাংগঠনিক ও শিল্পীর আদান প্রদান নির্ভর না করে - এই ব্যবস্থা যারা সভ্যসমাজের ধারক ও বাহক তাদের করতে হবে। এখানেই সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, একাদেমী, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্যান্য সিভিল সোসাইটির সব অঙ্গকে সক্রিয় হতে হবে। এখনও বেশ ছাড়া ছাড়া ভাব রয়ে গেছে যা খুবই ক্ষতিকর। এশীয়, বিশ্বজনীন ও সার্কের রাজনীতি কোন পথে এগুবে তার উপর নির্ভর করবে চুপিসাড়ে দুকদম পা ফেলা অথবা বোঝাবুঝি বন্ধুত্বের দুটি পঙ্ক্তি আওড়ে নেয়া। এমনটাই যদি থেকে যায় তো আমরাই আমাদের ভবিষ্যতকে কিছুটা মলিন করে ফেলব। খণ্ডিত ভবিষ্যত বাংলা ভাষার স্বার্থে অসম্ভব; দেশভাগকে ঘটনা বলি বা দুর্ঘটনা, মাতৃভাগ যেন না হয়, মাতৃভাষা যেন বিভাজিত না হয়।
এই প্রারম্ভিক সাবধানবাণীর পরই মনে করিয়ে দিতে চাই বেশ কিছু কাজের কথা যা বৃহৎ ও মহতী সাহিত্য ভাষার আঙ্গিনায় নীরবে নিঃশব্দে বহু ভাষা সাহিত্য প্রেমী ক্রমাগত করে চলেন। অথচ বাংলা ভাষার এত শতসহস্র যোজন প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও আমরা অন্তর্গত অনীহা বশত করে উঠতে পারছি না। বাংলা ভাষায় যেসব অনারব্ধ রয়েছে তার কথা বলতে গিয়ে 'লোকসাহিত্য'-এ গুরুদেব একটা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। 'ছেলে ভুলানো ছড়া' নিবন্ধে যেখানে বাঙালি শিশুর হৃদয়কে উর্বর করে তোলে যে গ্রামে গঞ্জে আদরে যত্নে বহুবর্ণে রঞ্জিত বহু চিত্রে বিচিত্রিত ছড়ার মেঘমল্লার, সেগুলির সামগ্রিক আকলন চিত্রায়ন, বাচন ও বিবেচনায় এমনকি যার অসাধারণ মঞ্চরূপ চিত্ররূপও সম্ভব, তা নিয়ে আমরা তেমন ভাবে কখনও ভাবিনি। এছাড়াও বাংলায় নতুন ছড়া গল্প লেখার ঐতিহ্যে কোথাও যেন একটা ভাটা দেখা গেছে। প্রতিদিন যে হাজার হাজার বাংলা পৃষ্ঠা লেখা হচ্ছে তার কত অংশ শিশু কিশোরদের প্রতি উদ্দিষ্ট তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। অথচ ভারতে বাংলাদেশের প্রায় শতকরা চল্লিশ ভাগ মানুষই শিশু কিশোর মানব যাদের বয়স আঠারোর কম। ভারতের একশত বিশ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ বছরের কম যারা তাদের সংখ্যায় সাড়ে বারো কোটির উপর। অর্থাৎ কিনা আমাদের দশভাগ বই, গান, ছবি, চলচ্চিত্র প্রভৃতি হওয়ার কথা শিশুকেন্দ্রিক। একইভাবে শতকরা চব্বিশভাগই হল ছয় ন্যূনতম বয়স থেকে অষ্টাদশ বর্ষীয়। অর্থাৎ আমাদের রচনার চার ভাগের এক ভাগ হওয়ার কথা কিশোর বয়সের সেই সব ভাবি নাগরিকদের জন্যই। যাদের উপর ভাষা ও দেশ দুইয়েরই ভবিষ্যত নির্ভর করে। অথচ ভাষা সমাজ হিসেবে আমরা এ নিয়ে ভাবিত না। কিন্তু যেসব বাবা মায়েরা শহরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বই মেলায় সাহিত্যোৎসবে কচি কাঁচা বা কিশোর সন্তানদের নিয়ে যান তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে যে কত শত সন্ধানের পরেও শিশু সাহিত্য বা কিশোর পাঠ্য বই পাওয়া কতটা দুষ্কর।
তৃতীয়ত: যেকোন ভাষার নির্মিতির পিছনে যারা গবেষণার মাধ্যমে সেই সব ভাষার গতি প্রকৃতি, শব্দ সম্পদ, প্রবচনাদি, প্রবাদ, বাগ্ধারা শৈলী সংক্রান্ত খুঁটিনাটি এসব নিয়ে ক্রমাগত কাজ করে চলেন, তাদের অবদান অসীম। ফরাসি, জর্মন, ইংরেজি যে অবস্থান রয়েছে তার পিছনে সেইসব ভাষার মহান কবি সাহিত্যিকদের পাশাপাশি এই অনামা খ্যাতিহীন বিরাম বিশ্রামহীন ভাষা গবেষকদের ভূমিকাও অসামান্য। ব্যাকরণবিদ্দের কথা যদি ছেড়েও দিই, তবু এমন সব সার্থক গবেষণা এই মুহূর্তে বাংলা বিভাগ গুলিতেও তেমন হয় না, ব্যক্তিগত উদ্যোগে কম। অথচ প্রচুর শোধগ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছে এবং গবেষণার ডিগ্রী ভাগ বাঁটোয়ারা করা হচ্ছে প্রায় অনেকাংশ চর্বিতকে আবার চিবানোর পুরস্কার স্বরূপ। বাংলা ভাষা সাহিত্য বিভাগ এবং ভাষা তত্ত্বের কেন্দ্রগুলি এ বিষয়ে সচল ও অতিসচেতন না হলে আমরা ক্রমশ: পিছিয়ে পড়বো বিশ্বভাষার দৌড় থেকে। এই সঙ্গে জুড়ে দিতে হয় বিশ্বমানবের বাংলা ব্যাকরণ এবং বাংলার বিভিন্ন উপভাষা ও শৈলীর ব্যাকরণ নির্মাণের বিশাল দায়িত্বের কথাও যা হয়তো দুই দেশের বাংলা একাডেমি ছাড়াও বিভিন্ন অভিজ্ঞ ভাষাবিজ্ঞানীকে যুক্ত করে করা দরকার। কিছু কাজ অবশ্যই হয়েছে এবং বর্তমানে যে দুই বাংলা মিলে পাঠ্য ব্যাকরণ রচনার কাজ চলছে, তা প্রশংসনীয়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে আবশ্যক কাজের তুলনায় প্রারদ্ধ কাজের পরিমাণ যৎসামান্যই বলতে হয়।
চতুর্থত: বহু পূর্বে ১৯৮১-৮৫ সালে প্রায় একক ভাবে আমি একটি প্রয়াস করেছিলাম যা পরে মহীশূর থেকে প্রকাশিত হয়। এই বৃহৎকার গ্রন্থে, যা এখন দুষ্প্রাপ্য, কেননা তার পুনর্মুদ্রণ হয়নি, একই সঙ্গে বাংলা ভাষায় ভাষাতত্ত্ব ও বাংলা বিষয়ক সব লেখার হদিস আছে আবার সারা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাতে মুদ্রিত/প্রকাশিত সেই সব গ্রন্থ ও নিবন্ধের সূত্রও রয়েছে যেখানে চর্চার বিষয় বাংলা ভাষার কোন না কোন দিক। এই কাজটি যদি প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে গ্রহণ করে গবেষক গোষ্ঠীর মাধ্যমে করানো যায়, এবং মুদ্রিত রূপ ছাড়াও একটি ওয়েব রিসোর্স-এর আকারে সেটিকে ইনডেক্সিং করে আবার প্রকাশিত করা যায়, তাহলে একটা বিরাট কাজ হতে পারবে। এরই সঙ্গে দরকার আর একটি তথ্যসমৃদ্ধ ডেটাবেসের যার মূল উদ্দেশ্য হবে বাংলা ভাষয় যত অনুবাদ হয়েছে ও বাংলা ভাষা থেকে যত অনুবাদ হয়েছে সে বিষয়ে একটা সামগ্রিক ছবি ও তথ্যাবলী আমাদের সামনে উপস্থাপিত করা। এটি যে কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ তা বলে বোঝানো যাবে না।
পঞ্চমত: অনুবাদের প্রসঙ্গ উঠে এলো বলেই সবিনয়ে বলতে চাই যে, যে হারে সারা বিশ্বের ভাষার জ্ঞানের বিস্ফোরণ ঘটছে ও যেভাবে প্রতিটি শাখায় নানান বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও নতুন গবেষণা দেখা দিচ্ছে সেগুলিকে বাংলা ভাষায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরী। আজকের পৃথিবীতে যা জ্ঞানের ভাষা হবে না বা হতে পারবে না, তার পক্ষে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারা কঠিন। এরই সঙ্গে জরুরী হল সেইসব মূল বাংলা নিবন্ধ ও জ্ঞান বিজ্ঞানের রচনার ইংরেজি অনুবাদের যাতে মৌলিক ভাবনা ও গবেষণা ইংরাজিতে ধরা পড়তে পারে এবং চর্চিত, আলোচিত হয়। এরই সঙ্গে তুলবো আরেকটি প্রসঙ্গ: বাংলাতে যে রচনায় এখন আধুনিক সময়ে বা বিগত কালেও মৌলিক চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটছে সেগুলিকেও অন্যান্য বিশ্বভাষায়, অন্তত ইংরেজিতে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক। তবে এই অনুবাদের প্রক্রিয়া অর্থনীতি এবং ব্যবহার সবই একের সঙ্গে অন্যটি জড়িত। এবং এও ঠিক যে জ্ঞানের অনুবাদ, যার উপর ভারতের ন্যাশনাল নলেজ কমিশনের (২০০৯) রিপোর্টে এত জোর দেয়া হয়েছে - তা কোন 'এক ধাক্কায় সেরে ফেলুন ও তাইতেই সাঙ্গ হল' গোছের ক্রিয়াকর্ম নয়। প্রক্রিয়াটি এমন ত্বরিত, সুষ্ঠ এবং সুস্থ হতে হবে যে ক্রমবর্ধমান গবেষণার কর্মের সঙ্গে তা যেন তাল রাখতে পারে, যেজন্য প্রয়োজনীয় একটি বিরাট অনুবাদ বাহিনীর। কয়েক অক্ষৌহিণী সেনার দরকার পড়বে এই জ্ঞানের যুদ্ধক্ষেত্রে এ সামান্য কর্ম নয়। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত ভাবে এগোনোর। এই সঙ্গেই কিন্তু দরকার অনুবাদ সংক্রান্ত একটি নির্মাণ প্রকল্প হাতে তুলে নেয়ার কাজ। বর্তমানে আমরা যারা অনুবাদ কর্মে যোগদান করতে ইচ্ছুক তারাও মোটামুটি অন্ধকারেই রয়েছি; জানিনা বাংলা থেকে কোন লেখা বা কার কোন কোন রচনা অনুবাদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে অন্য ভাষায় পৌঁছেছে এবং সেইসব অনুবাদের মান গ্রহণযোগ্য কিনা। এই ডেটাবেস নির্মাণের একটা প্রয়াস ১৮টি ভারতীয় ভাষার মধ্যেকার আদান প্রদানের ক্ষেত্রে আমি বছর পাঁচেক আগেই ভারতীয় ভাষা সংস্থান, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ও সাহিত্য একাডেমির সংযুক্ত তত্ত্বাবধানে অনুকৃতি নেট এই ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিশ্বজনের কাছে তুলে ধরেছিলাম, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটিও একটি বিশালকায় কাজ ও দায়িত্ব, প্রায় একটি ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজনে এইসব বড় বড় কাজ কাঁধে তুলে নিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে চলার জন্য।
সবশেষে এ কথাই বলব যে অনুবাদ, ভাষা চর্চা, ব্যাকরণ রচনা, ডেটাবেস নির্মাণ, শিশুকিশোর সাহিত্যের উপর জোর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষা ভাগকে সংস্কৃতির শক্ত বাঁধন দিয়ে রোখা এইসব বাংলাভাষার ভাবি কালের দাবি হিসেবে যার যেমন রুচি, ক্ষমতা ও অধ্যবসায় সেই মতো হাতে তুলে নেওয়া দরকার। এর জন্য দরকার একটা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম। যদি দুদেশের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রগুলি সেই দৃঢ় ও সুনিশ্চিত কাজের নেতৃত্ব দিতে পারেন, ভাবী প্রজন্মের মানুষ এই অবদানকে চিরকাল স্মরণে রাখবে। মনে হবে ভাষার জন্য জীবনদান হয়তো বা বৃথা গেলনা। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম তাই দিয়ে শেষ করা যাক। যদি প্রশ্ন ওঠে 'ভাষা তুমি কার' তাহলে উত্তরে অবশ্যই বলতে হবে 'যে চাহে তাহার'। এই চাওয়াটার ইচ্ছেটাই সব থেকে জরুরী, আর ইচ্ছে থাকলে উপায়ও হবে।