বছর তিনেক আগে পরবাস-এ এই বিষয়ে লিখেছিলাম, আর তার সঙ্গে ছিলো ভারতের কিছু পাখির বিবরণ ও ছবি। এবারে আমেরিকার পাখি সম্বন্ধে কিছু লিখতে চাই। এখানেই তো আমরা অনেকে বাসা বেঁধেছি। আমেরিকায় ভারতের মতো এত জাতির পাখি নেই ঠিক কিন্তু যা আছে তা সম্বন্ধে লেখা, গবেষণা, সহজগম্য জাতীয় পার্ক, ও সংরক্ষণের উদ্যোগ সবই উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জালে ঘুরলে আপনি অন্তত হাজারখানেক আন্তর্স্থল পাবেন যেখানে কোন স্টেট-এ কোথায় কোন্ পাখির দেখা পাবেন কখন, সব বলে দেওয়া আছে। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কয়েকটি বিশিষ্ট জায়গার নাম দিলাম। পাখির জন্যে এগুলি পৃথিবী-বিখ্যাত। স্যানিবেল দ্বীপ, ফ্লোরিডা, কেপ মে (নিউ জার্সি), টেক্সাসের গাল্ফ সমুদ্রতীর, আরিজোনার মরুভূমি ইত্যাদি। গাইড-বই-এরও ছড়াছড়ি। আমার নিজস্ব পছন্দ পিটারসন-এর বই। দুই খণ্ডে আছে পূর্ব ও পশ্চিম আমেরিকার পাখি। দেশের মাঝামাঝি একটা লম্বা লাইন টানলে দেখা যায় দুই দিকে পাখিরা অনেক আলাদা। আমার মতো যদি আপনি দেশের মাঝামাঝি বাস করেন তাহলে দু'টো বইই দরকার লাগবে। বসন্তকাল (এপ্রিল থেকে জুন) সব থেকে প্রশস্ত ঋতু। কিন্তু সারা বছরই কিছু না কিছু পাখি দেখা যায়। এমনকী বরফ কাঁপা শীতের সময়েও। আপনার বাড়ির বাগানে কয়েকটা খাবারের পাত্র ঝুলিয়ে দিন। দেখুন কতো রকমের পাখি আসবে। যে-কোনো পাখির খাবারের দোকানে ঝোলানো পাত্র (যা কাঠবেড়ালির নাগালের বাইরে), নানা রকমের দানা, পাখিদের জলের ফোয়ারা, বাসা তৈরির বাক্স, ইত্যাদি সবই পাবেন।
বাগানে কোনো চিরসবুজ গাছ থাকলে তা পাখিদের শীতের সময়ে আশ্রয় দেয়। কোনো বুড়ো গাছের পুরোনো ডালপালা কাঠঠোকরাদের প্রিয়। সবগুলো না কেটে দু'-একটা রাখুন। যে-কোনো বেরী পাখিদের প্রিয় খাবার, বিশেষত শীতের সময়ে। লন-এ বা গাছে কেমিক্যাল পোকার ওষুধ বা সার কম ব্যবহার করা ভালো। এগুলো অনেকসময় পশুপাখিদের পক্ষে বিষ হয়। পাখিরা মশা, মাছি, শুঁয়োপোকা ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। যদি আপনার বাড়ি শহরের বাইরে, পার্ক বা জলের কাছে হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনি অনেক পাখির দেখা পাবেন। বারান্দায় আরামচেয়ারে বাইনোকুলার ও গাইড-বই নিয়ে যতক্ষণ ইচ্ছা সময় কাটাতে পারবেন।
আমেরিকার শহর ও শহরতলির কয়েকটি সহজ-দৃশ্য পাখির বিবরণ দিলাম। সঙ্গে ছবিও রইলো। এগুলী সারা দেশে যে-কোনো সময়ে দেখা যায়ঃ
(১) চড়ুই পাখি (House Sparrow)-এর কথা আগেও বলেছি। মেয়ে ও পুরুষ দেখতে একটু আলাদা। মেয়েরা একটু বেশি ফ্যাকাশে। মাটিতে খুঁটে খুঁটে দানা খায়। আরো অনেক জাতির চড়ুই বনেজঙ্গলে দেখা যায়।
স্টারলিং (২) স্টারলিং (Starling)--চড়ুই-এর চেয়ে দু-তিনগুণ বড় সাইজ। শীতকালে পালকে ফুটকি দেখা যায়। ঝাঁকে উড়তে ভালোবাসে। পোকামাকড় খায়।
(৩) পায়রা (Pigeon, Rock Dove)-এর কথা আগেই বলেছি।
গ্রেকল (৪) গ্রেকল (Common Grackle)--শালিখ পাখির সাইজ। মিশকালো রঙ। উজ্জ্বল হলুদ চোখ। কর্কশ স্বর। স্বভাব, ভয়হীন। অন্য পাখিদের জোর করে তাড়ায়। আমি এদের মাফিয়া পাখি বলি। ঝাঁকে ঝাঁকে এসে সারা বাগান দখল করে বসে। দানা ও পোকা, দুই-ই খাদ্য। উত্তরে বেশি শীতের সময়ে এদের দেখা যায় না।
চিকাডী (৫) চিকাডী (Black capped chicadee)--ছোট্ট, গোলগাল চড়ুই সাইজের সাদা-কালো পাখি। ডাকটা শোনায় "চিকা ডী-ডী-ডী"--তাই এই নাম। ঝোলানো পাত্র থেকে দানা খায়। সহজেই বাগানে আসে।
ফিঞ্চ (৬) ফিঞ্চ (House finch)--এটাও অনেকটা চড়ুইএর মতো। (বেশিরভাগ পাখি-ই দেখছি তাই!) বুকে ও মাথায় লাল ছোপ। ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় বেশি উজ্জ্বল। এরাও ঝোলানো ফিডার থেকে দানা খেতে ভালোবাসে। সম্প্রতি চোখের রোগে এদের সংখ্যা একটু কমে গেছে। চোখদু'টো ফুলে বন্ধ এবং দৃষ্টিহীন হতে পাখিরা অনাহারে মরে যেত। তবে ইদানিং একটু কমেছে।
গোল্ড ফিঞ্চ (৭) গোল্ড ফিঞ্চ (Gold finch)--চড়ুই সাইজ। উজ্জ্বল হলুদ রঙ। মাথা ও ডানায় কালো রঙ। নাইজার দানা এদের ভীষণ পছন্দ। মেয়েরা একটু কম উজ্জ্বল। শীতের সময় এরা বেশ ফ্যাকাশে হইয়ে যায়। তারপর বসন্তকালে তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গেই এদের হলুদ রঙও ক্রমশ উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে।
কাঠঠোকরা (৮) কাঠঠোকরা (Downy woodpecker)--আমেরিকায় অনেকরকম কাঠঠোকরার মধ্যে ডাউনি সবচেয়ে ছোটো ও বাগানে খুব সহজেই দেখা যায়। অন্যরা বনে জঙ্গলেই থাকে। ডাউনির আকার চড়ুইএর থেকে সামান্য বড়ো। পিঠে সাদা-কালো দাঁড়ি টানা। ছেলে পাখির মাথায় একটু লালের ছোঁয়া। চর্বি (suet) আর 'পী-নাট (অর্থাৎ চিনাবাদাম) বাটার' খেতে খুব ভালোবাসে।
ব্লু-জে (৯) ব্লু-জে (Blue Jay)--পায়রার সাইজ। উজ্জ্বল নীল ও সাদা, মাথায় ঝুঁটি। কর্কশ নাকি স্বর। লম্বা লেজ। দেখতে ভারি সুন্দর কিন্তু মেজাজ রুক্ষ। খোসা-সমেত চিনাবাদাম খেতে খুব ভালোবাসে। পেট ভরে গেলে বাদামগুলো বাগানের আনাচে কানাচে মাটিতে পুঁতে রাখে, পরে খাবে বলে।
কার্ডিনাল (১০) কার্ডিনাল (Northern cardinal)--ময়না সাইজ। উজ্জ্বল লাল রঙ (তাই এই নাম), মাথায় ঝুঁটি। মোটা কালো ঠোঁট। মেয়ে পাখির রঙ মেটে সবুজ, ঠোঁট লাল। জোড়ায় থাকতে ভালোবাসে। 'ব্ল্যাক অয়েল্ড' সূর্যমুখীর দানা ভালোবাসে (বেশিরভাগ পাখিই এটা পছন্দ করে)। মিষ্টি স্বর।
(১১) ঘুঘু (Mourning dove)--পায়রার সাইজ। মেটে রঙ, লম্বা লেজ। উত্তরে গরমের সময় দেখা যায়। মন-খারাপ করা গলার স্বর। তাই এই নাম।
রবিন (১২) রবিন (American robin)--ভারতীয় ও ইয়োরোপীয় রবিনের দ্বিগুণ সাইজ। পেটের কাছে মেটে লাল রঙ। মাটিতে সোজা হয়ে চলে ও খুঁটে খুঁটে পোকামাকড় খায়। উত্তরে শুধু গরমের সময়েই দেখা যায়।
জাংকো (১৩) জাংকো (Dark eyed Junco)--গরমের সময় এরা আলাস্কা ও ক্যানাডায় থাকে। শীতকালে আমেরিকায় নেমে আসে। আকারে চড়ুইএর মতো। পিঠটা ঘন ধূসর ও পেটটা বরফ-সাদা। মাটিতে দানা ইত্যাদি খুঁটে খায়। মেয়ে পাখির রঙ একটু ফ্যাকাশে।
(১৪) কাক (Common crow)--আমেরিকার কাক ভারতীয় কাকের চেয়ে একটু বড়ো এবং মিশ কালো। কখনো সখনো বাড়ির বাগানে দেখা যায়।
নাট হ্যাচ (১৫) নাট হ্যাচ (White breasted nuthatch)--এটাও চড়ুই সাইজের। রঙ সাদা, নীল, ধূসর। গাছের গুঁড়িতে বা খাবারের পাত্রে উলটো হয়ে ঝুলতে ভালোবাসে। মেয়ে-পুরুষ একই রকম দেখতে। নামে নাটহ্যাচ হলেও এ বাদামে তা দেয় না। দানাপানিতেই সন্তুষ্ট।
ক্যানাডা রাজহাঁস (১৬) ক্যানাডা রাজহাঁস (Canada goose)--বিরাট আকারের এই পাখিদের অনেকেই শহরের পার্কে ও গল্ফ মাঠে দেখে থাকবেন। থুতনির কাছে সাদা ফিতে কাটা। নামে ক্যানাডা থাকলেও এরা সবাই আমেরিকা ও ক্যানাডা, দুই দেশেরই বাসিন্দা।
বাজপাখি (১৭) বাজপাখি (Red tailed hawk)--সব শিকারি পাখিদের মধ্যে এটাকেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যায়। হাইওয়ের ধারে কাঠের থামের ওপর বা গাছের উঁচু ডালে এদের বসে থাকতে দেখেছেন নিশ্চয়ই। সামনে থেকে দেখলে বুকে সাদা অংশ চোখে পড়ে। পিছন থেকে দেখলে কেবলমাত্র পূর্ণবয়স্ক পাখিদের লেজেই শুধু লাল রঙটা দেখা যায়। ভারতীয় চিলের সাইজ। ছোটো ইঁদুর ইত্যাদি খায়। শীতের সময় খিদের চোটে আমার বাগানে ছোটো পাখিদেরও আক্রমণ করতে দেখেছি।
শকুন (১৮) শকুন (Turkey vulture)--চিলের তুলনায় প্রায় দেড়গুণ বড়ো। বিরাট সাদা-কালো পাখা মেলে এরা ওড়ে খুব উঁচুতে। গলায় লাল রঙের এক গলকম্বলের জন্যে টার্কি নাম। সব শকুনদের মধ্যে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য শকুনদের মতোই এরাও মরা জন্তু-জানোয়ার খেয়ে সাফ করে।
এইগুলিই হলো আমেরিকার সব থেকে সাধারণ পাখি। এছাড়াও নদী নালার ধারে, জলায় বা লেকে আপনি রেড উইং ব্ল্যাকবার্ড দেখতে পাবেন। স্টারলিং-এর আকারের এই পাখিগুলির দুই ডানায় লাল ও হলুদ দাগ। মেয়ে পাখিদের দেখতে ঠিক স্টারলিং-এর মতোই। কর্কশ ধাতবিক স্বর, মিশকালো রঙ। জলার ধারে দুধ-সাদা বক (Egret) দেখতে পাবেন। এরা অনেক সময় গরুর পিঠে চড়ে উকুন ইত্যাদি খুঁটে খায়। সন্ধ্যার সময়ে দেখবেন ঝাঁকে ঝাঁকে কালো সাদা সোয়ালো ও সুইফ্টের আনাগোনা। পার্পল মার্টিন নামের সোয়ালো তো মশা খেতে ওস্তাদ। এরা না থাওলে মশার প্রাদুর্যে আমাদের বাঁচতে হতো না।
বসন্তকাল হলো ওয়ার্বলার (Warbler) দেখার উত্তম সময়। ছোট্ট হলুদ সবুজ রঙের পারিযায়ী পাখিগুলির স্বর ভারি মিষ্টি। প্রায় পনেরো-কুড়ি রকমের ওয়ার্বলার আছে। গাছের মগডালে পাতার আড়ালে এক ঝলক দেখে বা সুর শুনে এদের চেনা রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞ পক্ষীবিদ্রাই পারেন। যদিও গাছের মগডালের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়, কিন্তু পাখি দেখে চিনে নেবার নেশা ছাড়া মুশকিল।
আমেরিকার পশ্চিম অঞ্চলে (যেমন কলোরাডো, ক্যালিফোর্নিয়া, আরিজোনা) দেখতে পাওয়া যায় হরেক রকমের হামিংবার্ড। এরা শুধু উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার পাখি। অন্য কোনো মহাদেশে হামিংবার্ড নেই। চড়ুইএর থেকে ছোটো এই পাখিগুলির পালকে ধাতবিক উজ্জ্বল লাল, নীল, সবুজ রঙ। লম্বা সরু ঠোঁট ফুলে ডুবিয়ে মধু খায়। এদের ডানার কাঁপন এত দ্রুত যে খালি চোখে দেখাই যায় না। মনে হয় শূন্যে স্থির হয়ে আছে।
পাখি দেখার 'স্পোর্ট' আমেরিকায় ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। প্রত্যেক শহরে আপনি 'পাখি দেখার দল' (Birdwatching Group), ক্লাব ইত্যাদি পাবেন। তারা নিয়মিত ক্লাস, ফিল্ড ট্রিপ ইত্যাদির আয়োজন করে। বাচ্চাদের জন্যও এরকম অনেক ক্লাস আছে 'নেচার সেন্টার' বা 'বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র'গুলোয়। ছোটো বয়েস থেকেই এরা পাখি, গাছপালা, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি সম্বন্ধে জ্ঞান পায়। আর সব ছোটো ছেলেমেয়েই পাখির বাসা, ব্যাং, মাছ, সাপ ইত্যাদির খোঁজে সারা দিন বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। ঘরে বসে ভিডিও খেলার চাইতে অনেক স্বাস্থ্যকর।
বড়োদের জন্যেও আছে নানারকমের ট্রিপ-এর আয়োজন। আছে পাখি 'ব্যান্ডিং' ক্লাস। জাল দিয়ে সাবধানে পাখি ধরে তার পায়ে নম্বর লাগানো ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হয়। পরে এই ব্যান্ডধারী পাখি ধরা পড়লে জানা যায় এরা কতো বছর বাঁচে, কতোদূর এদের গতিবিধি ইত্যাদি। এছাড়াও আছে বার্ষিক পাখি গোনার কাজ। অনেক স্বেচ্ছাসেবী বছরে একবার স্থানীয় বা পরিযায়ী ঈগল, বাজপাখি, ওয়ার্বলার ইত্যাদি গোনার কাজে সাহায্য করেন। এতে সারা দেশের পাখির (এবং সেই সূত্রে সারা পরিবেশের) ভালো মন্দ অবস্থা সম্বন্ধে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ছোটো, বড়ো, মেয়ে, পুরুষ, যে কেউ এসব কাজে যোগ দিতে পারেন। নিচে দু'টি প্রধান আন্তর্স্থলের ঠিকানা দিলাম। এছাড়াও আন্তর্জালে হাজার রকমের স্থানীয় বা জাতীয় সংস্থার সন্ধান পাবেন।
১) National Audubon Society . এটাই সব থেকে বড়ো সংস্থা। এর শাখা-প্রশাখা সারা দেশে বিস্তৃত।
২) Cornell Lab of Ornithology . কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত এটি দেশের প্রধান পক্ষীবিদ্যার কেন্দ্র। এরা প্রতি বছর শীতকালে বাগানের পাখি গোনার আয়োজন করেন ('The Great Backyard Bird Count')। যে কেউ আন্তর্জালের মাধ্যমে যোগ দিতে পারেন।